ছবি : ইন্টারনেট |
ভাসান
সিদ্ধার্থ সিংহ
বেলুড় মঠের দুর্গা
প্রতিমা দশমীর দিনই ভাসান হয়। সেই ভাসান দেখতে
হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য বাঁশ দিয়ে পুরো চত্বর ঘিরে দেওয়া
হয়। লাগানো হয় প্রচুর ফ্লাড লাইট। মোতায়েন থাকে সাদা পোশাকের অজস্র পুলিশ।
যেতে একটু দেরি হয়ে
যাওয়ায় সেই ভিড়ের একেবারে পেছনে গিয়ে দাঁড়াল রিচা, প্রসিত আর তাদের দশ বছরের একমাত্র মেয়ে চিকি।
প্রসিত ছবি তুলতে
খুব ভালবাসে। তেমনি পটুও। আজ পর্যন্ত কতগুলো ক্যামেরা যে কিনেছে তার হিসেব নেই। যে
কোনও দৃশ্যকে ফ্রেমবন্দি করতে সে খুব দক্ষ।
একই দৃশ্য বারবার ক্লিক করে যায়। রিচা একবার তার একটা বনসাই গাছের বিভিন্ন দিক থেকে
তোলা একটা সিরিজ দেখে বলেছিল, বাব্বা, এ তো একই ছবি। একগুলো তুলেছ কেন?
প্রসিত বলেছিল,
ছবিগুলো দেখে কি তোমার একই
ছবি মনে হচ্ছে? এগুলো প্রত্যেকটার
ফ্রেমই তো আলাদা। তোমার চোখে হয়তো এই ছবিগুলোর সূক্ষ্মতম তফাত ধরা পড়ছে না। কিন্তু
যাদের ছবি দেখার চোখ আছে, তারা ঠিকই ফারাকটা
বুঝতে পারবে।
ভ্রু কুঁচকে রিচা
বলেছিল, তা বলে একই গাছের এতগুলো ছবি!
ও বলেছিল, হ্যাঁ, এতগুলো না তুললে এর মধ্যে থেকে সেরা ছবিটা আমি বাছব কী করে! সেরা ছবিগুলো বেছে বেছে জেলা, জাতীয় এমনকী আন্তর্জাতিক ফোটোগ্রাফি এক্জিবিশনগুলিতেও ও পাঠায়। ইদানীং বেশ নামও হয়েছে।
আজ যখন বেলুড় মঠে
আসার সময় একটা নয়, তিন-তিনটে ক্যামেরা
সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। কখনও এমনি, কখনও আবার জুম করে ব্যারিকেডের ভিতরে থাকা স্বামীজিদের ক্লোজ
আপ নিচ্ছে। নিচ্ছে বাঁ দিকের মন্দিরের সিঁড়িতে গ্যালারির দর্শকদের মতো বসে থাকা মানুষের ছবি। ব্যারিকেডের বাইরে অধীর আগ্রহে
অপেক্ষা করতে থাকা ভিড়ের ছবিও।
মণ্ডপ থেকে প্রতিমা
নামানো হয়েছে অনেকক্ষণ। মাঠের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে গঙ্গার পাড়ের দিকে নিয়ে যাওয়া
হচ্ছে। সবার চোখ এখন সে দিকেই। সেটা আরও একটু ভাল করে দেখার জন্য রিচা আর চিকি
চেষ্টা করছে ব্যারিকেডের একদম সামনে যাওয়ার জন্য। বাচ্চা দেখে কেউ কেউ কাত হয়ে বা পেছন
দিকে চেপে যেই একটু জায়গা করে দিয়েছে, চিকি ঠেলেঠুলে ঠিক এগিয়ে গেছে। মেয়ের পিছু পিছু রিচাও। কিন্তু দু’-চার জনের সামনে
এগিয়ে যেতেই এত চাপাচাপি শুরু হল যে, চিকির প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। চিকিই বলল, এত ঠেলাঠেলি হচ্ছে না! যেখানে ছিলাম, সেখানেই ভাল ছিলাম। ওখান থেকে তাও দেখতে পাচ্ছিলাম, এত ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে যে, এখানে ঠিক মতো দাঁড়াতেই পারছি না।
রিচা বলল,
তা হলে বেরিয়ে আয়,
বেরিয়ে আয়।
দু'জনকে বেরিয়ে আসতে দেখে কেউ বলল, এরা যে কী করছে! একবার ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। কেউ বলল, কী হল কী? কেউ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আর ঢুকবেন না তো?
রিচা বলল,
না। বলেই, সবার পিছনে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে একটু আগে যেমন বিসর্জন
দেখছিল, সে ভাবেই দেখতে লাগল। এ দিকে
মেয়ে-বউ কী করছে সে দিকে না তাকিয়ে একের পর এক নিজের খেয়ালে ছবি তুলে যেতে লাগল প্রসিত।
প্রসিত কোথায়! এ পাশে
ও পাশে চোখ ঘোরাতেই রিচির চোখ পড়ল মাত্র দশ-বারো হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলের
দিকে। না, ঠিক ছেলে নয়,
লোক। হ্যাঁ, প্রসিতের থেকে বয়সে দু’-চার বছর কেন, হয়তো পাঁচ-সাত, কি তারও
বড় হবে। কিন্তু এই বয়সেও বেশ হ্যান্ডসাম। লম্বা চওড়া। দেখলেই মনে হয়,
বড় কোনও কোম্পানির কোনও উঁচু
পদে আছেন। সাদা-কালো মেশানো মাথার ঝাঁকড়া চুল আর চাপ চাপ দাঁড়ি তাঁকে যেন আরও স্মার্ট
করে তুলেছে। তিনি একদৃষ্টে তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে
নিল রিচা। কিন্তু যতই বিসর্জনের জন্য মাঠে নিয়ে আসা প্রতিমার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে
সে, ততই তার মনে হচ্ছে,
লোকটা কি তার দিকে এখনও ফ্যালফ্যাল
করে তাকিয়ে আছেন! আর যেই সেটা মনে হচ্ছে, অমনি তার চোখ চলে যাচ্ছে লোকটার দিকে।
চোখ যেতেই রিচা দেখল,
হ্যাঁ, লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তা হলে কি তিনি তাকে
চেনেন! কোথাও আলাপ হয়েছিল! কলেজ জীবনের কেউ
কি! নাকি কোথাও কোনও ট্যুরে কিংবা কোনও বিয়েবাড়িতে অথবা অন্য কোথাও তার সঙ্গে আলাপ
হয়েছিল! না হলে তিনি অমন করে তাকে দেখবেন কেন! একমাত্র চেনা হলে কিংবা চেনা চেনা মনে
হলেই তো মানুষ এই ভাবে দেখেন!
রিচা নিজেও মনে করার
চেষ্টা করতে লাগল, এঁকে কোথায় দেখেছে! কোথায় দেখেছে! কোথায় দেখেছে!
আচ্ছা, আমি কি এঁকে আদৌ কখনও দেখেছিলাম!
আর একবার মুখটা দেখি তো!
রিচা তাঁর দিকে তাকাতেই
লোকটা মুচকি হাসলেন। হাসলেন!তার মানে তো তিনি তাকে চেনেন! না হলে কেউ কি এ ভাবে খামোকা হাসে নাকি! আর কেউ যদি তাকে
চেনেন, তাঁকে দেখে মুখ গোমড়া করে
থাকাটা শোভন নয়, বরং অভদ্রতা। তাই
তাঁর মুচকি হাসি দেখে সেও হাসি হাসি মুখ করল।
আর সে হাসি হাসি মুখ
করতেই লোকটা ইশারা করে জানতে চাইলেন, সঙ্গে ওরা কারা?
এই প্রশ্নটা শুনে
রিচা বুঝতে পারল, না, ইনি তার পূর্বপরিচিত নন। পরিচিত হলে নিশ্চয়ই এ ভাবে
জিজ্ঞেস করতেন না। এগিয়ে এসে বলতেন, কেমন আছ? নিজেই যেচে আলাপ করতেন
প্রসিতের সঙ্গে। মেয়ের গাল টিপে হয়তো আদরও করতেন। কিন্তু সে সব যখন করেননি,
তার মানে আলাপ হওয়া তো দূরের
কথা, এঁকে সে এর আগে কখনও চোখেই দেখেনি। তবু ব্যাপারটা খারাপ
লাগল না তার। তাই রিচাও ইশারাতে বোঝাতে চাইল,
পাশের বাচ্চাটি তার মেয়ে।
আর চোখের ইশারায় প্রসিতকে দেখিয়ে বোঝাতে চাইল, উনি আছেন।
লোকটা ইশারা করলেন,
আমি ওখানে যাব?
রিচা ইশারায় ওঁকে ওখানেই থাকতে বলল। বলেই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাত দেখিয়ে ইশারাতেই বোঝাল,
আমি দেখছি। তার পর একটু চিৎকার
করেই প্রসিতকে বলল, ছবি পাচ্ছ?
প্রসিত বলল,
ওই, যা পাই...
--- ও দিকে গেলে বোধহয়
আরও ভাল ভাল অ্যাঙ্গেল পেতে!
--- সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ!
--- গিয়ে দেখতে পারো।
প্রসিত বলল,
তা হলে তোমরা এখানে থাকো।
আমি না আসা পর্যন্ত অন্য কোথাও যেয়ো না।
--- হ্যাঁ হ্যাঁ,
আমরা এখানেই আছি। আর তুমি
যদি আমাদের খুঁজে না পাও, ফোন কোরো।
--- আচ্ছা, ঠিক আছে। বলেই,
ঘাটের দিকে চলে গেল প্রসিত।
প্রসিত যখন লোকটার
পাশ দিয়ে যাচ্ছে, লোকটা ইঙ্গিতে বোঝালেন,
ফ্যানটাস্টিক। তার পরেই আবার
ইঙ্গিত করলেন, যাব?
রিচার বাঁ দিকে ছিল
মেয়ে। তাই চোখের ইশারায় তার ডান দিকে এসে দাঁড়াতে বলল তাঁকে।
লোকটি এসে রিচার পাশে দাঁড়ালেন। রিচা হাসি হাসি মুখ করে তাঁর দিকে তাকাল। লোকটিও।
ফাঁকা ভেবে প্রসিত যেখানটায় গেল, দেখল আগের জায়গাটার চেয়েও সেখানে বেশি ভিড়। তবু ক্যামেরা তাক করতে লাগল প্রতিমাকে। প্রতিমাকে ঘিরে থাকা লোকজনকে। সে যখন ছবি তুলছে, ঠিক তখনই কে যেন পিছন দিয়ে যেতে যেতে তাকে ধাক্কা মারল। সে নড়তেই তার ল্যান্সে ধরা পড়ল একটি ঢলঢলে সুন্দর মেয়ের মুখ। ওর মনে হল, এ কোনও মেয়ে নয়, জ্যান্ত প্রতিমা। এত সুন্দর নিঁখুত মুখ কারও হয়! এই মুখের কাছে মাটির ওই প্রতিমার মুখ তো একেবারে নস্যি। সে আর প্রতিমার দিকে ক্যামেরা ঘোরাল না। একের পর এক ছবি তুলে যেতে লাগল সেই মেয়েটির।
খেয়াল করেননি,
এমনিই লেগে গেছে, এমন ভান করে লোকটি আলতো করে রিচার আঙুল ছুঁলেন।
স্পর্শ পেয়েই লোকটির দিকে তাকিয়ে রিচা ইশারা করল, পাশে মেয়ে আছে।
লোকটি মুখের ভঙ্গিমা
করে বোঝালেন, ঠিক আছে, আমি আছি। ঠিক ম্যানেজ করে নেব। বলেই, এ বার আর আঙুল নয়, রিচার হাতের পুরো
তালুটাকে আঁকড়ে ধরলেন। রিচা ফের তাঁর দিকে
তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করল। লোকটা এ বার রিচার হাতে আলতো করে হাত বোলাতে লাগলেন। রিচা
কিচ্ছু বলল না।
প্রসিত ওই মেয়েটির
ছবি আরও ভাল করে তোলার জন্য একটু ঝুঁকতেই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের পেছনে
তার শরীর ঠেকে গেল। এবং ওটা স্পর্শ হওয়ামাত্রই
ওর শরীরে যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টের কারেন্ট লাগল। ও ঠিক হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু পরমুহূর্তেই
সেই কারেন্টের জন্যই ওর কেমন যেন একটু সুখানুভূতি হল। সেই সুখ ফের পাবার জন্য এ বার
আর অসাবধানতাবশত নয়, ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে, ইচ্ছে করেই মেয়েটির পেছনে শরীর লেপটে দিল।
মেয়েটি ঝট করে পেছন
ফিরে তাকাল, কী হল? ঠিক হয়ে দাঁড়ান।
প্রমিত ইতস্তত হয়ে
বলল, সরি সরি সরি।
মেয়েটি আবার প্রতিমা
ভাসান দেখতে লাগল। ততক্ষণে আরও কয়েক জন এসে দাঁড়িয়েছে প্রসিতের ডান পাশে। বাঁ পাশে।
পিছনে।
প্রতিমা দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি মারার ভান করে প্রসিত ফের মেয়েটির পেছনে অত্যন্ত সন্তর্পনে ধীরে ধীরে শরীর ঠেকাল। মেয়েটি আবার মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও, প্রসিতের পেছনের ভিড় দেখে আর কিছু বলল না। মেয়েটি কিছু না বললেও, প্রসিত নিজেই বলল, এত চাপ আসছে না, দাঁড়াতেই পারছি না…
রিচা কিছু বলছে না দেখে লোকটা আস্তে আস্তে হাত থেকে কোমর, কোমর থেকে পিঠে, পিঠ থেকে ধীরে ধীরে হাত রাখলেন কাঁধে। না, তিনি ভাসান দেখছেন না। রিচার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। রিচাও যত না সামনে তাকাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি তাকাচ্ছে ডান দিকে। লোকটার মুখের দিকে। মাঝে মাঝে বাঁ দিকে। মেয়ে দেখতে পাচ্ছে না তো!
না, কেউই টের পায়নি প্রতিমাকে কখন জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
না রিচা। না লোকটা। না প্রসিত।
সামনের লোকজন তাদের
ধাক্কা মেরে, ঠেলেঠুলে পেছন দিকে
চলে যেতেই, যেই সামনেটা ফাঁকা
হয়ে গেল, রিচার ঘোর কাটল। লোকটারও।
সম্বিৎ ফিরে পেল প্রসিতও। ভিড় ছত্রাকার হতেই ব্যারিকেড উধাও হয়ে গেল। সারা মাঠ লোকে
লোকে ছেয়ে গেল। কে কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল খুঁজে পাওয়া মহামুশকিল।
রিচার কানের কাছে
মুখ নিয়ে লোকটা বললেন, আপনার মোবাইল নম্বরটা
পাওয়া যাবে? ঠিক তখনই রিচার ফোনটা
বেজে উঠল। ও প্রান্তে প্রসিত--- তোমরা কোথায়?
রিচা বলল,
এই তো এখানে।
--- এখানে মানে কোথায়?
--- যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
--- আমিও তো সেখানেই।
তোমাদের দেখতে পাচ্ছি না তো! কোথায়?
রিচা বলল,
আমিও তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছি
না। এত লোক! হাত তোলো। হাত তোলো।
রিচার পাশেই দাঁড়িয়ে
ছিলেন লোকটা। রিচার কথোপকথন শুনে যেই বুঝতে পারলেন তার স্বামী ফোন করেছে, অমনি মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যে উধাও হয়ে গেলেন,
রিচা টেরও পেল না।
বাঁ হাতে কানে মোবাইল
ধরে ডান হাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে নাড়াতে
লাগল প্রসিত। বলল, দেখতে পাচ্ছ?
রিচা সবার মাথার ওপর
দিকে তাকিয়ে এ দিকে ও দিকে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে পেছন ফিরতেই দেখে, সামনেই প্রসিত হাত নাড়াচ্ছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ও
বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, পেয়েছি পেয়েছি। পেছন ফেরো, পেছন ফেরো।
প্রসিত পেছন ফিরতেই
দেখল, তার বউ মেয়ের হাত ধরে সামনেই
দাঁড়িয়ে আছে। দেখা হতেই ওরা তিন জন ওই ভিড়ের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে বড় রাস্তার দিকে
হাঁটতে লাগল। শুধু মাঝে মাঝে পেছন ফিরে রিচা দেখতে লাগল, লোকটা কোথায়! লোকটা কোথায়! লোকটা কোথায়!
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment