![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
কুয়াশা যখন
মণিমোহন বন্দোপাধ্যায়
পুরনো জমিদার বাড়িটায় ঢুকে জায়গাটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো ঋজুর ।
খিলান, দরজা জানলা যেন কত পরিচিত ।
তাহলে কি সত্যিই... । ..জাতিস্মর বা তেমনই কিছু ।
ঘটনাটার সূত্রপাত আকস্মিকই । ..বর্ধমানের এই অঞ্চলে বি ডি ও হয়ে আসার পরে, সরকারি কাজে গ্রামেগঞ্জে তাকে ঘুরতেই হয় । ..কালনা পেরিয়ে আরো অনেক গ্রামের মধ্যে দিয়ে সরকারি জীপে যেতে যেতেই বাঁ হাতি একটা পরিত্যক্ত জীর্ন প্রাসাদ চোখে পড়লো ঋজুর । ..দুপুরের ঠা ঠা রোদ পড়ে ক্ষয়িষ্ণু লাল ইঁটের দেওয়াল আর চওড়া থামগুলো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে । ..হঠাৎ ঋজুর নিশ্চিত মনে হলো, এই অট্টালিকা সে আগে কখনো দেখেছে । ..ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বলে, ধীর পায়ে কিছুটা আচ্ছন্নের মতোই সে এগিয়ে গেলো সেই জরাজীর্ন, প্রায় ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া তিনতলা বাড়িটার দিকে l..চারিদিক আগাছায় ভর্তি, প্রায় জঙ্গল l..বিরাট বিরাট থামের ফাটল দিয়ে যত্রতত্র অশ্বথ আর বটের ঝুড়ি l..বিশাল উঁচু সদর দরজা, তেমনি চওড়া l..দুপাশে দুটো ভাঙা সিংহের মুখ, পাথরের l
আরো ভিতরে যেতে কটা চামচিকে ঝটপট করে উড়ে গেলো মাথার উপর দিয়ে l..
ভিতরে খোলা উঠোন, চারপাশে তিনতলা ভাঙা ঘর দিয়ে ঘেরা l..একপাশে একটা উঁচু বেদি, হয়তো নাটমঞ্চ ছিলো lঋজুর মনে হতে থাকলো এই জায়গা, এই পরিবেশ তার খুব পরিচিত l..অথচ এ তল্লাটে সে কোনোদিন আগে আসে নি l..তারা পদ্মাপাড়ের লোক, দেশভাগের সময় দাদু একবস্ত্রে এসে সটান কলকাতায় l..
একটা ঘোরের মধ্যে সেই নিঝুম হলুদ দুপুরে সে দাঁড়িয়ে থাকে সেই ভগ্ন প্রাসাদপুরী তে l..
ইতিমধ্যেই খবর হয়ে গ্যাছে, কোনো সরকারি বাবু হাজির হয়েছেন l
অল্প ভীড়ও উঁকি মারছে l..দু একজন মুরুব্বি টাইপের লোক জানাল, এটা এক পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি l..সেই বর্গীদের হানার সময় এক জমিদার এটা বানিয়েছিলেন, নাম দর্পনারায়ণ চক্রবর্তী l. ঐ উঁচু ফটক দিয়ে নাকি মাহুত পিঠে হাতি যাতায়াত করতো l তাঁর উত্তরসূরিদের আমলে এই জমিদারবাড়ির আরো রমরমা হয় l..বর্ধমানের রাজার সাথে নাকি তাঁদের ওঠাবসা ছিলো l.চক্রবর্তী তাঁদের রাজ উপাধি, তাই পরে নিজেদের অরিজিনাল সারনেম বন্দোপাধ্যায়ে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁরা l.তারপর, যা হয় !..শরিকি বিবাদ আর কালচক্রে, উপরন্তু জমিদারি প্রথা বিলোপের পরে, এঁদের বংশজরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশে প্রবাসে, বিদেশে l..আর কেউ আসেও না l..খোঁজ খবরও নেয় না l..হয়তো এভাবেই একদিন মাটিতে মিশে যাবে, বা জবরদখল হয়ে যাবে l
বেশ কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে ঋজু ফিরে যায় l
কিন্তু, ঐ জমিদার বাড়ির ভাবনা তার মাথার মধ্যে অহরহ ঘুরপাক খেতে থাকে l
এমনকি তার স্বপ্নেও ঐ প্রাসাদের বিশাল থাম, প্রাচীর আর সিংহদুয়ার হানা দিতে থাকে l
কাজে আজকাল মন বসেনা l
ইদানীং বেশ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে ঋজু l.. অ্যাসিস্ট্যান্ট তপন সেদিন বলেই ফেলল, স্যার, আপনার কি আজকাল শরীর ভালো নেই? প্রায়ই দেখি দুহাতে মাথা চেপে বসে আছেন, কোনো কোনো সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন l.. তবে কি সে মানসিক ব্যামোর শিকার হোলো, ভাবে ঋজু l.. এক আধবার হাতও কাঁপছে মনে হচ্ছে l.
অনেক দ্বিধার পরে, বাড়িতে ফোন করে ব্যাপারটা জানালো l..সে কি জাতিস্মর?
বাবা শুনে বলল, দূর. ওদিকে আমাদের চোদ্দো পুরুষ কোনো কালে যায় নি l..
মা বলল, একা একা থাকিস, হোটেলে খেয়ে পেট গরম হচ্ছে, তারপর সারাদিন টো টো করে ঘোরা l.. কয়েকটা দিন ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে আয় l
ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হতেই বাড়ীর পথ ধরে ঋজু l.
কোলকাতার অভ্যস্ত জীবনে ফিরে বন্ধুদের সান্নিধ্যে থাকতেও, সেই মায়াবী দুপুর কে ভুলতে পারেনা ঋজু l.. অবশেষে, আর থাকতে না পেরে বন্ধুদের খুলে বলে l.. তাদের একজন কিন্তু বেশ সিরিয়াস হয়ে বলে, তোর একজন সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো উচিৎ l.. এরকম চললে কাজ করবি কিভাবে?
চল, আমার পিসেমশাই ডাক্তার, ওনার কাছে নিয়ে যাচ্ছি l. বন্ধুর পিসেমশাই সব শুনে বললেন, দ্যাখো ভাই, বেশী পাঁচকান কোরো না l. মিডিয়া জানতে পারলেই, তোমার গায়ে জাতিস্মরের ছাপ দিয়ে দেবে l.. হয়তো খবরের কাগজ আর টিভিতেও ভাইরাল হয়ে যাবে l
আমি ফোন নম্বর দিচ্ছি l
প্রফেসর ডাঃ সতপথীর কাছে চলে যাও l. বি আই এন এর প্রাক্তন অধ্যাপক l..
এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এক সন্ধ্যেয় ঋজু পৌছালো প্রফেসর সতপথীর চেম্বারে l.
জায়গাটা আগেকার শ্যামবাজার ট্রামডিপোর ঠিক পিছনে, একটা নার্সিং হোমের ভিতরে l. ডাক্তার বাবু ছোটোখাটো মানুষ, কাঁচাপাকা চুল, পুরু লেন্সের চশমা চোখে, মাথা ঝুঁকিয়ে, একটু আনুনাসিক স্বরে কথা বলেন l
নানা রকম পরীক্ষার পরে, জিজ্ঞেস করলেন, এই মাঝে মাঝে হঠাৎ হাত কাঁপা আর আনমনা হয়ে যাওয়াটা কতদিন? আরো বললেন মাঝে মধ্যে ঠোঁট নাড়া আর জিভ বার করাও ও তো দেখছি l.. প্রেসক্রিপশন প্যাডে বড় বড় করে
লিখলেন.. টেম্পোরাল লোব এপিলেপসি.. উইথ 'ডেজা -ভু' ফেনোমেনন l তারপরে
চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে বললেন.. ফ্রান্সের এক ঊনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক প্রথম এই লক্ষণ এর ব্যাপারে বলেন, যাতে প্রথম দেখা কোনো জায়গাকে দেখেই খুব চেনা মনে হয়, মনে হয় আগেও এখানে এসেছি । ..ফরাসীভাষায় নাম দেন ডেজা -ভু .. মানে অচেনা কোনো কিছু কে খুব চেনা মনে হওয়া lকেন এমন হয়, তার বহু ব্যাখ্যা আছে, তবে ডাক্তারি শাস্ত্রে.. টেম্পোরাল লোব এপিলেপসি, যা এক ধরণের মৃগীরোগ.. তার সাথে এটা হতে দেখা যায় ।
তোমার ওটাই হয়েছে । ..
একটা ই ই জি, আর.. এম আর আই করিয়ে নাও । .. ওষুধ লিখে দিচ্ছি । .. ভালো হয়ে যাবে, তবে লম্বা ট্রিটমেন্ট ।
আর হ্যাঁ, তোমার ওই 'ক্ষুধিত পাষান 'এর ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফ্যালো ।
...(সমাপ্ত)...
পড়লাম মন দিয়ে। ডাক্তারী অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।
ReplyDeleteবেশ ভাল লাগল। অভিনন্দন মণির কলমকে।