ছবি : ইন্টারনেট |
ধুকপুক
স্বরবী রায়
১
বৈশাখ মাসের আঠারো তারিখ ।অরূপের জন্মদিন। ওইদিনই রাত এগারোটা সাঁইত্রিশ মিনিটে মারা গেলেন দোলার বাবা দেবকুমার চৌধুরী ।এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে ফেরার সময় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয় তাঁর ।গুরুতর ভাবে মাথায় চোট পান।সেইসময় তাঁর সাথে ছিলেন কলেজের ছাত্র ও জুনিয়র লেকচারার দিব্যেন্দু ভৌমিক।তিনি দেবকুমার বাবুকে নার্সিংহোমে নিয়ে যান এবং তাঁরই নির্দেশ মতো সুবিমলবাবুর সাথে যোগাযোগ করেন।দোলার নার্সিংহোমে পৌঁছানো পর্যন্ত দেবকুমার বাবুর জ্ঞান ছিল।ঘন্টাখানেক মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হার মানেন।আর নিতে পারলো না দোলা।তার নার্ভ ফেল করলো।দিন সাতেকের জন্য শয্যা নিল সে।ইতিমধ্যে দেবকুমারবাবুর সকল পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম ছেলের মতো দাঁড়িয়ে সামাল দিল দিব্যেন্দু ।সাতদিন পর একদিন সকালে চোখ খুলে দোলার মনে হল অনেক বছর পর সে যেন ঘুমিয়ে উঠলো।এই কদিন সে ওষুধের ঘোরে সর্বদা আছন্ন হয়ে ছিল।আছন্ন অবস্থায় বেশ কয়েকবার তার বাবার সাথে দেখা হয়েছে।বাবা এসে তার পাশে বসে কত কথা বলে গেলেন,মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।বাবার কয়েকটা কথা তার কাণে ভাসছে'দোলা লিখে সব কষ্টযন্ত্রণা খাতার পাতায় উগরে দে।মনে চাপ রাখিস না।জীবন একটা বই।বইটা শুধু পড়ে যা।নিজেকে জড়াস না ।দূর থেকে পাতা উল্টে শুধু পড়ে যা'দোলা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।শরীরটা আজ ঝরঝরে।মন খারাপ থাকারই কথা কিন্তু সেরকম খারাপও নয় বরং সে ভেতরে ভেতরে আত্মবিশ্বাস অনুভব করছে।বাবা হয়তো সত্যিই এসেছিলেন আর তার মনে এই শক্তির সঞার করে গেছেন।ধীরে ধীরে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল ডাইনিং এ বাবার একটা বড় ছবি ।তাতে ফুলের মালা।সোফা কাম বেডে শুয়ে আছে ছোটো মাসি।কাছাকাছির মধ্যে নিকট আত্মীয় বলতে ছোটোমাসিই থাকে।দোলা মাসিকে জাগালো ।মাসি তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল 'দোলা তুই!উঠে এলি কি করে?তোর শরীর এখন দুর্বল।'
'এখন ঠিকাছি'
ছোটোমাসি ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম ঠুকলো।
'দাঁড়া আগে দিব্যেন্দুকে একটা খবর দিই।'
বাবা যেন যাওয়ার আগে উপহারের মতো দিব্যেন্দুকে দিয়ে গেলেন।কোনো সম্পর্ক ছাড়াই দিব্যেন্দু দোলার দায়িত্ব নিয়ে নিল।কোনো চটুল কথা ,হাসি গল্প, মন দেওয়া নেওয়ার কথা, কোনো কিছুই হয় নি তাদের মধ্যে ।তবু দোলার ভালো লেগেছিল দিব্যেন্দুকে। মানুষটার প্রতি সে ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
শুধু তাই নয় দিব্যেন্দুর মধ্যে সে বাবার ছায়া দেখতে পেত।তার উপস্থিতিতে সে নিজেকে সুরক্ষিত মনে করত।এর মধ্যে একদিন অরূপ এসেছিল।তাকে দেখেই দোলার বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি বেড়ে গেল চিরকালের মতো ।মামুলি কুশল বিনিময়ের পর ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এল।দিব্যেন্দুর ব্যপারে সে তখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি।জীবনের প্রথম ভালোবাসায় তার হার হয়েছে সে জানে তবু আরো নিশ্চিত হতে আরেকবার জিজ্ঞাসা করলো সে
অরূপকে 'সেদিন কি যেন প্রশ্ন করবেন বলছিলেন ?'
'অ্যাঁ?'
'বলছি যে সেদিন মানে আপনার জন্মদিনের দিন কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন না আমায় ?'
দোলার কথায় অরূপ যেন কেমন সিঁটিয়ে গেল।সেদিন রাতেও যখন অরূপের বাবা তার বিয়ের অ্যানাউন্সমেন্ট করছিল ঠিক এমন কেঁচোর মত গুটিয়ে যাওয়া একটা মানুষকে দেখেছিল সে।
অরূপ নিরুত্তর।তার চোখ দুটো মেঝেতে যেন মিশে যাচ্ছে ।পকেট থেকে রুমাল বার করে সে কপালের ঘাম মুছতে লাগল।স্থির দৃষ্টিতে দোলা দেখছে অরূপকে।একইসাথে তার রাগ এবং করুণা দুইই হল।মানুষটা বড়ই ভীতু।ভালবেসেছিল বটে কিন্তু পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার মতো বুকের পাটা নেই।এইসময় মাসি ঢুকলো সরবত নিয়ে।'কেমন আছ অরূপ ? বাবা মা ভাল আছেন?'
প্রসঙ্গ ঘুরতে অরূপ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।দু- একটা কথা বলেই সে তাড়া দেখিয়ে উঠে পড়লো ।যাবার আগে দোলাকে বলল 'কোনো দরকার পড়লে খবর দিও।'
দোলা কঠিনভাবে উত্তর দিল'আপনাকে কোনো দরকার পড়বে না'
দোলার দিকে একপলক তাকিয়েই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অরূপ ।
একবছরের মাথায় দোলার বিয়ে হল দিব্যেন্দুর সাথে। দিব্যেন্দুর দায়িত্ববোধ আগেই মুগ্ধ করেছিল দোলাকে।এরপর যতই সে দিব্যেন্দুর ঘনিষ্ঠ হয়েছে ততই ভাল লেগেছে তার সূক্ষ চিন্তাশক্তি বিচারবোধ আর ধৈর্য্য দেখে ।বিবাহিত জীবনে দোলা মনপ্রাণ থেকে সম্পূর্ণ অনুগত থেকেছে দিব্যেন্দুর প্রতি।তবে তার কিশোর জীবনের মাতাল প্রেমের অনুভূতিগুলো ফিরে আসে নি কোনোদিন।এক ঝলক চোখের দেখায় ,এক চিলতে হালকা ছোঁয়ার মিষ্টি ঘোরে সে আর কখনও পাগল হয় নি।আজ এতবছর পর জীবনের শেষে পর্বে দাঁড়িয়ে দোলার মনে সে সব অনুভূতিগুলোই উঁকি মারছে।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের পরিভাষায় দোলা আর অরূপও ডেটিং করতে শুরু করছে। কলকাতা শহরের আনাচে -কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা।সিনেমা দেখা ,রেস্তোরাঁয় খাওয়া,শপিং মল-এ ঘোরা এসব করে দুটো মাস হু হু করে কেটে গেল।
২
বৈশাখ মাস পড়ে গেছে। গরমটা বেশ জাঁকিয়ে বসছে এখন থেকেই ।বাড়ি ফিরে ক্লান্তি বোধ করছে দোলা।আজ তারা কলকাতা যায় নি।মায়াপুর বেড়াতে গিয়েছিল।তোয়ালে নিয়ে স্নানে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে দোলা ।হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠলো ।এইমাত্র তাকে ছেড়ে গেল অরূপ ।এততাড়াতাড়ি আবার কি প্রয়োজন পড়ল কে জানে!দোলা চিন্তিত হয়ে ফোনটা ধরল 'কি হল অরূপ ?তুমি ঠিকাছ?'
'না ঠিক নেই।'
'কেন?কি হল?'
'সারাটা দিন তুমি আমার সাথে থাক।সন্ধ্যে হলেই চলে যাও।আমার খুব একা লাগে।'
'হুম।কি আর করা যায়।'
'করা যায় তো।তুমি চাইলেই এমন ব্যবস্থা করতে পারি যাতে সন্ধ্যে হলে আর তোমায় ফিরতে না হয়। '
ফোনের এ প্রান্তে দোলা নিরুত্তর।সে আবারও তার ধুকপুকের শব্দ শুনতে পাচ্ছে খুব জোরে।
অরূপ আবারও বলল
'দোলা ,আমার কথা শুনতে পাচ্ছ।?'
কাঁপা কাঁপা গলায় দোলা উত্তর দিল 'পাচ্ছি,বল।'
'যে প্রশ্নটা আজ অবধি করতে পারিনি তা যদি আজ করি?তুমি কি আমায় ফিরিয়ে দেবে?'
'ফিরিয়ে তো তুমি দিয়েছিলে আমায়।'দোলার কন্ঠে কান্নার আভাস।এতবছরের তীব্র অভিমান সুযোগ পেয়ে আজ ঝরে পড়ল।
'ক্ষমা করে দিও দোলা ।সেদিনের অরূপ আজ অনেক বদলে গেছে।পরিবারের চাপে ,বাবার সন্মানের খাতিরে সেদিন মুখ খুলতে পারি নি।কি বা বয়স ছিল আমার বল!বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম।পায়ের তলায় শক্ত মাটি তখনও তৈরী হয় নি।কিন্তু আজকের অরূপ স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষ ।তাকে তুমি ভরসা করতে পার।বল দোলা বাকি জীবনটা কাটাবে আমার সাথে,আমার জীবনসাথী হয়ে ?'
'এই উত্তরটাই তো একদিন চেয়েছিলে জন্মদিনের উপহার হিসাবে।তাই পাবে।দুটো দিন সবুর কর।'
ফোনটা রেখে দিল দোলা ।আজ ষোলোই বৈশাখ ।দুটো দিন পর অরূপের জন্মদিন।সেদিনই না হয় হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নটা আবার পূরণ করবে তারা।'.....(এখনও বাকি আছে )
একটা আকাশী রংএর জামদানিতে আজ নিজেকে সাজালো দোলা।কয়েকদিন আগে নিউমার্কেট থেকে অরূপ নিজে পছন্দ করে বেশ কয়েকটা শাড়ি কিনে দিয়েছে তাকে ।তারই মধ্যে থেকে এটা বেছে নিল সে।হালকা গয়না পরল।সাথে একটা ছোট্ট খয়েরী টিপ।যাবার পথে ফুলের দোকান থেকে পছন্দ মত তোড়া বানিয়ে নেবে।তাছাড়া নতুন জামা কেক মিষ্টি আরো অনেক উপহার সাথে নিয়েছে সে।
অরূপের বাড়িটা দূর থেকে দেখেই দোলার খুব নার্ভাস লাগলো।যেদিন প্রথম সে এই বাড়িতে এসেছিল অনেককিছু হারিয়েছিল চিরকালের মতো।
কোনোদিন ভাবে নি এই বাড়িতে আবারও আসতে হতে পারে।দুবার জোরে শ্বাস নিল সে।পুরোনো স্মৃতির ঘন কুয়াশাটা সরিয়ে অন্দরমহলে পা বাড়ালো দোলা ।
ডাইনিং এ অরূপ দাঁড়িয়ে ছিল।দোলাকে দেখেই এগিয়ে এসে হাসিমুখে ওয়েলকাম করলো সে।
'কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছি।এসো এসো।
দোলা উপহারগুলো এগিয়ে দিল।অরূপ সেগুলো হাতে নিয়ে দোলার চোখে চোখ রেখে বলল 'এতকিছুর কি দরকার ছিল।তুমি তো জানো আমি কি উপহার চাই।'
'জানি...'
'আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল দোলা তার আগেই একটা অল্পবয়সী মেয়ের মিষ্টি গলা শোনা গেল
'বাপী এদিকে আসুন ,কফি এনেছি।'
দোলা তাকিয়ে দেখল এক সুন্দরী যুবতী ট্রেতে কফি সাজিয়ে ভেতর থেকে নিয়ে এল।পেছন পেছন এক যুবক ও আরো দুজন মোটাসোটা ভদ্রমহিলাও ঢুকলো।মেয়েটি এতক্ষণ দোলাকে দেখেনি। এবার তাকিয়েই হেসে এগিয়ে এসে বলল'ও তাহলে ইনি আপনার বান্ধবী ,আসুন আসুন,বাপী বলেছেন আজ আপনি আসবেন '
অরূপ দোলার দিকে তাকিয়ে বলল 'দোলা মিট অহনা সি ইজ মাই ডটার ইন ল,কাল রাতে ওরা হঠাৎ এসে পড়েছে,জন্মদিনে আমায় সারপ্রাইজ দেবে বলে।'
'ও ,তাই নাকি!খুব মিষ্টি দেখতে তোমার ছেলের বউকে।'
অহনা চোখ নাচিয়ে বলল'ধন্যবাদ ।তবে বাপী কিন্তু বলেন নি যে তাঁর বান্ধবী এই বয়সেও এত সুন্দরী ।'
দোলা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল।অরূপ তার ছেলে রিভুর সাথেও দোলার পরিচয় করিয়ে দিল। আরো দুজন মহিলার মধ্যে একজন অহনার মা, অপরজন তার মাসি।তাদের পোশাক ও সাজগোজ দেখে বোঝার উপায় নেই তারা সধবা না বিধবা ।অহনা সকলকে কফি পরিবেশন করলো।অরূপের ছেলে রিভুও বেশ হাসিখুশি স্বভাবের ।খুব সহজভাবে তারা দোলার সাথে গল্প করতে লাগলো।কিছুক্ষণ পর অহনার মা মাসি কিচেনে গেল রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করতে।ওরা চলে যেতেই অহনা শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কি যেন বলল ।ব্যপারটা
দোলার চোখ এড়াই নি বুঝে সে হেসে দোলাকেই বলল 'আচ্ছা আন্টি আপনিই বলুন এতে লজ্জার কি আছে? বাপীর কি বা এমন বয়স হয়েছে,আমরা সবাই চাই বাপীর একজন কমপ্যানিয়ন আসুক।'
দোলা ভাবতে পারেনি এত সহজে প্রসঙ্গটা উথাপিত হবে আর অরূপের পরিবার এমন আন্তরিকতার সাথে তাকে গ্রহণ করবে।এই ব্য়সেও অষ্টাদশীর মতো দোলার হৃদস্পন্দন আবারও বাড়তে শুরু করলো।
অহনার কথার সূত্র ধরেই রিভু বলল'একাকিত্ব থেকে অনেক ডিসিস আসে।তাছাড়া আমরা সবাই নিজেদের জীবনে ভীষণ ব্যস্ত ।বাপীর সাথে কেউ থাকলে আমরাও নিশ্চিন্ত হই।তাই অহনা ঠিক করেছে ওর মাসি মানে একটু আগেই যিনি এখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর সাথেই যদি শুভ কাজটা সেরে ফেলা যায়..।'
অহনা দোলার হাত ধরে বলল'অান্টি আপনি তো ওনার খুব কাছের বন্ধু ।আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না প্লিজ ।'
দোলা অরূপের দিকে তাকিয়ে বললো'সে কি অরূপ ,তোমার আপত্তি কিসের?এরা তো তোমার ভালোই চাইছে।'
অরূপ সরাসরি কোনো উত্তর দিতে পারলো না।আমতা আমতা করে কি যে বলল তা শোনা গেল না।দোলা চোখের সামনে দেখতে পেল ত্রিশ বছর আগের অরূপকে।অস্বস্তিতে গুটিয়ে গেছে অরূপ ।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।দৃষ্টি তার মেঝে ভেদ করে কোন পাতালে হারিয়ে গেছে।
দোলা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো 'আমি তবে চলি।
অহনা ও রিভু বাধা দিতে উঠলো 'অান্টি খেয়ে যাবেন না?'অরূপও কেমন যেন মরিয়া হয়ে বলল
'এখনই কেন,একটু সময় দাও...।'
দোলা হেসে বলল'আর সময় দিয়েও লাভ হবে না।'
দোলা হনহন করে বেরিয়ে এল বাড়ির বাইরে।বড় বড় নারকেল গাছ গুলো দুলে উঠছে ।বোধহয় ঝড় উঠবে।উঠুক।এখন দোলার বুকের ভেতরটা খুব শান্ত
খুব হালকা লাগছে তার।আজ সে নিশ্চিত জীবনে আর কখনও হঠাৎ অরূপের সাথে দেখা হয়ে গেলে তার বুকের ধুকপুক আর বাড়বে না।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment