1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

এই তো জীবন

ছবি  : ইন্টারনেট

এই তো জীবন

রাজশ্রী দে

মালিনী সক্কাল সক্কাল পূজো দিয়ে ফিরল কালীঘাট  থেকে  |  ড্রয়িং রুমে শাশুড়ি প্রভাবতী দেবী তখন আনন্দবাজারের পাতা ওলটাচ্ছেন |তিনি বললেন ....আর কতকাল এইদিনে  মন্দিরে দৌড়োবে, সে তো রাতভর জন্মদিনের পার্টি করে বাড়ি  এসে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে |আবার বেলায় বাবু ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে যাবেন বার্থডে সেলিব্রেট  করতে |নামকরা গায়ক  নিলয়  মজুমদার মানে সেলেব্রেটির ওয়াইফ তুমি | পাত্তা তো দেয়  না তোমাকে  , সম্মানও  করে না | নিজের একটা পরিচয় বানাও মালিনী , নিজের কথা ভাবার দিন চলে এসেছে |এই যে  রান্নার লোককে কিছু করতে না দিয়ে আজকের দিনে নিজে হাতে এলাহী রান্না করে গোটা পরিবারের জন্য   ,  নিলয় তো কিছুই মুখে দেবে না |কার জন্য করো এসব বোলো  দেখি| মা সবাইকে আজকের দিনে ভালো রান্না করে খাওয়াতে পারলেই  তো আমার তৃপ্তি ,বললো মালিনী |

নিলয়  মজুমদার খ্যাতনামা গায়ক , দেশে বিদেশে স্টেজ শো করে  বেড়ায়  , বয়েস   মাত্র  চল্লিশ , যথেষ্ট হ্যান্ডসম |  অসংখ্য  মহিলা ভক্ত  তার |  পুনম  তার  গার্ল ফ্রেন্ড  ,  নিলয় আর মালিনী  নিঃসন্তান , প্রায় দশ বছর তাদের বিয়ে হয়েছে | মালিনী পুনমের কথা জেনেও পরে আছে নিলয়ের এই যৌথ পরিবারে |কারণ পরিবারের সকলে তাকে খুব ভালোবাসে আর মালিনীর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, বাবার বাড়ি  বড্ড গরীব। শুধু রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রভাবতী দেবী   তাঁর আদরের ছোট ছেলের  জন্য নির্বাচিত করে ছিলেন । আর একটা ব্যাপার  প্রভাবতী দেবীর মন ছুঁয়েছিল , স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছিল মালিনী  প্রচন্ড দারিদ্রতার মধ্যে।

প্রভাবতী  দেবী বললেন .... মালিনী এবার তুমি নিজে কিছু একটা করো | মালিনী বলল ...... মা আমি তো কিছুই জানিনা  , শুধু রান্না জানি l  প্রভাবতী  দেবী বললেন .... রান্না দিয়েই শুরু করো, টাকা আমি দেবো , পরে   টাকা  এলে তুমি আমাকে দিয়ে দিও| ইতিমধ্যে দুটো  লোক রেখেছে  মালিনী, রুমা    রান্না করতে   সাহায্য   করে আর বিভাস বাড়ি বাড়ি খাবার দিয়ে আসে| শ্বশুর বাড়ীর  একতলায়  পেছনের দিকে একটা বড় ঘরে ব্যবস্থা করা হয়েছে  রান্নার। সব রান্না মালিনী নিজে হাতে করছে । আগুনের তাপে সারাদিন রান্না করতে কষ্ট হলেও একটা আলাদা তৃপ্তি  পাচ্ছে মালিনী। প্রথমদিকে  পাড়ার  বন্ধুরা নিত খাবার , তারপর পাড়ার লোকেরা অর্ডার দিতে শুরু করল।তার রান্নার  প্রশংসা চারিদিকে ছড়িয়ে পরল। উত্তর কলকাতার এপাড়া থেকে অন্য পাড়ায় লোক অসুবিধায় পরলেই মালিনীদির রান্নাঘরে ফোন। ছোটখাটো অনুষ্ঠান বাড়িতে অর্ডার যখন আসতে শুরু করলো তখন মালিনী আরোও দুজন লোক রাখলো, মিন্টু ও পলাশকে।

 অন্যদিকে নিলয় মজুমদার বিশাল ফ্ল্যাট কিনেছে নিউটাউনে ।এই  পুরোনো উত্তর কলকাতার গলির  মধ্যে  বাপ ঠাকুরদার আমলের বাড়িতে তার লোকজন আসা খুব লজ্জার  ব্যাপার তার কাছে। মা আর মালিনীকে অবশ্য যেতে বলেছিল নিলয়  তার নতুন  ঝাঁ চক চকে ফ্ল্যাটে।   মা প্রভাবতী দেবী এককথায় নাকচ করে দিয়েছেন আর মালিনী জানিয়ে দিয়েছে.....  আমার বিজনেস ছেড়ে আমি যেতে পারব না । নিলয় আর  পুনম একসঙ্গে থাকে   নতুন  ফ্ল্যাটে l   নানা ম্যাগাজিনের মাধ্যমে কথা  আসে মালিনীর কাছে। শুধু শাশুড়ির জন্য ডিভোর্স ফাইল করছে না মালিনী । এই বাড়িতে এখনও পর্যন্ত ডিভোর্স হয় নি  কারোর ,কথাটা বলেন প্রায়ই ।  বড়ো ভাসুর , মেজো  ভাসুর, জায়েরা সবাই  বোঝায় মাকে  । হয়তো একদিন তিনি বুঝবেন , আসলে তিনি চান নিলয় ডিভোর্স  ফাইল করুক   মানে তার দিক থেকে আসুক প্রস্তাবটা।

 জীবন চলছে সময়ের  তালে তালে , মালিনীর ভাসুরদের ছেলে মেয়েরা সকলেই একে একে দেশের বাইরে   সেটেল হয়ে গেছে । তাদের বিয়েও হয়ে গেছে। তারপর   জা ভাসুররা চলে গেছে দক্ষিণ কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে। এখন এই বিশাল বাড়িতে মালিনী ,   শাশুড়ি আর চারটে কাজের লোক । ইতিমধ্যে মালিনী বড় রাস্তার ওপরে  রেস্টুরেন্ট  খুলেছে , নাম দিয়েছে মালিনীর রান্নাঘর। এখানে সব বাঙালি রান্না পাওয়া যায় । রান্নাঘরে

 বেশ কিছু লোক কাজ করে । তাছাড়া মালিনীর  পরিকল্পনা আছে একটা ক্যাফের ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়ার।  শাশুড়ি মা বিশেষ চলাফেরা করতে পারেন না এখন।  ও হ্যাঁ মালিনীর একটা  বাপের বাড়ি আছে  শ্রীরামপুরে, সেখানে এখন দাদা বৌদি  থাকেন , তাদের অবস্থাও ভালো নয়।  নিসন্তান দাদা বৌদির দায়িত্ব পালন করে মালিনী।

ওদিকে নিলয় দেশ বিদেশে গান করে বেড়ায় , বিশাল নামজাদা  শিল্পী । পুনমের পরে একে একে অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জড়িয়ে ছিল নিলয়। বর্তমানে কোনো এক নবাগতা মডেল জুনের সঙ্গে  রিলেশনে আছে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও নিলয় এতটাই হ্যান্ডসাম যে আজও ইয়াং  জেনারেশনের  হার্ট থ্রব।  মালিনীর সঙ্গে  আজও আইনত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা  রয়ে গেছে।তবে কোনো কন্টাক্ট  নেই।

বিশাল ফ্ল্যাটে ঠান্ডা বেড রুম, পাতলা ফিনফিনে পর্দা, ডিভানের চাদর , বালিশের কভার , দেওয়ালের  কালার, সিলিং সবেতেই আকাশী  নীলের ছোঁয়া। যেন এক স্বপ্নপুরী , নরম গদীর ভেতরে ঢুকে গান শুনতে শুনতে নিলয় ঘুমিয়ে পড়ল। আজ জুন গেছে মুম্বাই মডেলিংয়ের কাজে। বাড়িতে দুজন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ নেই। ভোর রাতে স্বপ্ন দেখল  নিলয়........   মা ঠাকুর দালানে বসে ফুলের মালা   গাঁথছেন  আর ছোট্ট নিলয় বসে আছে মায়ের  কোল  ঘেঁসে , বাবা দালানের চেয়ারে বসে আছেন , বলছেন .....  তোমার আদরের ছেলে  কি মা   ন্যাওটা হয়েছে । মা খুব হাসছেন। ধীরে ধীরে  সব কিছু কেমন  মিলিয়ে গেল।  কত বছর পরে মা বাবাকে একসঙ্গে দেখল নিলয়।  চোখ খুলল, চারিদিকে নীল মায়াবী আলো, খুব যেতে ইচ্ছে করল মায়ের কাছে। কতদিন যাওয়া হয়নি , মায়ের কোলে মাথা  রাখা হয়নি। কতবার চেয়েছে মাকে কিছু দিতে, মা নেন নি। একমাত্র মালিনিকে আশ্রয় করে বেঁচে আছেন মা। কোনো ছেলের কাছ থেকে কিছু নেন না তিনি। মালিনীর জীবনটা শেষ করে দিয়েছে সে,  নতুন করে জীবন তৈরি করার পথটাও খুলে দেয়নি  বাড়ির  আভিজাত্যের  কথা ভেবে। আজ অনুতাপ হয় নিলয়ের। একদিন সময় করে  বাড়িতে যেতে হবে মায়ের কাছে।

বিয়ের পরে নিলয় এরকম ছিল না। হাসিখুশি প্রানবন্ত, মালিনীকে নিয়ে বেড়িয়ে পরত লং ড্রাইভে,  কখনও    ডায়মন্ড হারবার , মন্দরমনি,  শঙ্করপুর, বককালি। আর  বাড়ির সকলে মিলে যাওয়া হত বছরে দুবার করে দেশভ্রমনে। কিন্তু সাফল্যের  সিঁড়ি চড়তে চড়তে সম্পূর্ণ  পাল্টে গেল  নিলয়। আর তখন মালীনিকে ভালো লাগত না । অসহ্য একঘেঁয়ে আটপৌড়ে  লাগত মালিনীকে।

মালিনী ভাবছে ....  মা পাশে না থাকলে কি দুর্দশাই না হত  আমার। আজ কোথায় ভেসে  যেতাম।  এত বড় সাফল্য  আমার  জীবনে এসেছে মায়ের হাত ধরেই। মায়ের সব  টাকা মিটিয়ে দিয়েছি অনেক বছর আগেই। কিন্তু  আমি  সেই দুর্দিনের  ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। আজ মা  শয্যাশায়ী তবু তো আছেন।  রুমার ডাকে বাস্তবে ফিরে এল মালিনী। দেখল শনিবারের উইক  এন্ড বলে রেস্টুরেন্টের সব টেবিল ভর্তি।

 কিছুদিন থেকে নিলয়ের গলায়  অসহ্য যন্ত্রণা।   বড় নামকরা  ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল বন্ধু বিশালের সঙ্গে। অনেক টেস্ট হল , অবশেষে জানা গেল গলায় ক্যান্সার হয়েছে নিলয়ের। দেশ বিদেশের সব  প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করল নিলয়ের সেক্রেটারি জুলিয়া।  জুন সুযোগ বুঝে পাড়ি দিয়েছে নিউইয়র্কে।  নিলয় মুম্বাইয়ে ট্রিটমেন্ট করছে, সঙ্গে যাচ্ছে বন্ধু বিশাল। সেক্রেটারি, দুজন কাজের লোক সব ছাড়িয়ে দিয়েছে নিলয়। এখন  ফ্ল্যাটে শুধু থাকে  পুরোনো  কেয়ারটেকার  রঘু। ডাক্তাররা আশ্বাস  দিয়েছেন ভালো হয়ে যাওয়ার।

মালিনী বন্ধু  রমির কাছ থেকে  খবর পেয়েছে নিলয়ের  ক্যান্সার হয়েছে।  বুকের ভেতরের জমাট পাথর ভেঙে কান্না হয়ে  ঝরে পরে নি। গলায় কাছে  জমে আছে বহু বহু বছরের কান্নারা।একদিন সব বন্ধুরা  এসেছিল মালিনীর সঙ্গে দেখা করতে ।  ওরা বলেছে......মন  শক্ত কর, একদম ভেঙে পরবি না। মালিনি কোনো উত্তর দিতে পারে নি সেদিন বন্ধুদের।

 সক্কাল সক্কাল বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ । এত সকালে কে এল ভাবতে ভাবতে  মালিনী  উঠোন পেরিয়ে দরজার হুড়কো খুলে দেখে সামনে নিলয় দাঁড়িয়ে। ভূত দেখার মত চমকে ওঠে সে। কি চেহারা হয়েছে নিলয়ের ,  খুব রোগা হয়ে গেছে, চোখের  তলায় কালি,  কেমোথেরাপির জন্য সব চুল উঠে গেছে। সরে দাঁড়ায় মালিনী, ড্রাইভারকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল নিলয় প্রায় একযুগ পরে। প্রথমেই মায়ের ঘরে গেল। মা  বসে

আছেন বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে, আয়া মুখে যত্ন করে  ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছে। নিলয় এসে মায়ের সামনে দাঁড়াল, মা .... মা করে ডাকল। প্রভাবতী দেবী বললেন......... মালিনী কে  ছেলেটা আমায় মা বলে ডাকছে, চিনতে পারছি না তো। আমার তো কোনো ছেলে নেই। তুইই আমার একমাত্র মেয়ে। অবাক মালিনী , অনেক চেষ্টা করল সে,  বার বার বোঝালো  কিন্তু মা তার আদরের ছোট ছেলেকে চিনতেই পারলেন না। নিলয় উদভ্রান্ত,   চোখে জল নিয়ে বলল.......  মালিনী আমায় ক্ষমা করে দাও , আমি আবার ফিরে আসতে  চাই।

মালিনী বলল........   আমি যদি এত বছর বাইরে ফুর্তি  করে তোমার কাছে ফিরে আসতাম , তুমি কি করতে?? নিলয় বলল ........ মেনে নিতে পারতাম না । মালিনী  ধীরে ধীরে বলল....... আমার পক্ষেও তোমাকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তুমি এবার এসো...........

গল্পের শেষে এটা বলা দরকার, প্রভাবতী দেবী অনেক বছর আগেই তাঁর  বাড়ি , সম্পত্তি  সবকিছু মালিনীর নামে উইল করে দিয়েছেন।

 ...(সমাপ্ত)...




No comments:

Post a Comment