দুঃসপ্নের হাভেলি
জগদীশ গাঙ্গুলি
সুধী পাঠক যেটা লিখতে যাচ্ছি সেটা বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ইচ্ছে, বিশ্বাস করলে ভালো না করলেও দয়া করে সমালোচনা করে আঘাত করবেন না। কথাতেই আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর!
১
সালটা ১৯৯৮ এর শীতকাল, আমার বয়স তখন একতিরিশ বছর রাজস্থানে বিশেষ ভাবে সক্ষম বাচ্ছাদের একটা স্কুলে চাকরি পেলাম, স্কুলটা ছিল নাওয়ালগড় বলে একটা জায়গায়, নাওয়ালগড় এর থেকে মোটামুটি তিরিশ কিলোমিটার উত্তরে সদর শহর ঝুনঝুনু আর দক্ষিণে সিকার বলে একটি জায়গা, এখানে শীতকালে যেমন তীব্র শীত, গ্রীস্ম কালে আবার তেমন গরম! ভোর ছটায় বাস থেকে নামলাম, তখনো সূর্যের আলো ফোটেনি, ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে, কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো, অচেনা শহর, অচেনা ভাষা, ওখানকার ভাষা শেখাবাটি ভাষা, কিছুই বুঝছিনা, যাই হোক একটা অটোকে স্কুল এর নামটা বলাতে চিনতে পারলো আর আমায় নিয়ে রওনা দিলো। রাস্তার দুইধারে শুধু দেখলাম বড় বড় রাজস্থানি ব্যাবসাদারদের তৈরী করা বড়োবড়ো হাভেলি , পোদ্দার, ডালমিয়া, গোয়েঙ্কা ইত্যাদি বড় বড় শিল্পপতিদের হাভেলি যেখানে তারা কেউ থাকেনা, কেয়ারটেকার দেখাশোনা করে, চারিদিকে শুধু বালি আর বালি, কিছু চাষবাস দেখলাম হচ্ছে!:রাস্তার দুই ধারে ময়ূর ঘুরছে, অটোওয়ালা ঠিক ঐ স্কুল এর সামনে নামিয়ে আমায় চলে গেলো, অসহ্য শীত, মনে হচ্ছে হাড় ফুঁড়ে ঢুকে যাবে, দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করবো সেই সময় দূর থেকে একজন কে এগিয়ে আসতে দেখলাম, সে কাছে এসে আমার নাম জিজ্ঞাসা করলো, নাম বললাম। সে বললো "আমার নাম মনোজ, আমি এখানকার পিওন, ম্যানেজার বাবু আপনায় নিতে আমায় পাঠিয়েছে "! মনোজ এই বলে আমার ব্যাগ টা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো পিছনে পিছনে আমি ওকে অনুসরণ করলাম!
২
ম্যানেজার এর নাম রোহিত, আমায় সে সাদরে অভর্থনা করে ভিতরে নিয়ে বসালো, গরম চা এনে দিলো, বললো "আজ আর খাবার দাবার তৈরির হ্যাপ্পা করবেন না আমার সাথে লাঞ্চ করে আমার এখানেই আজ থাকুন, কাল থেকে আপনার নতুন ডেরা দেখিয়ে দেবো "! আমি মাথা নাড়লাম।
পরের দিন স্কুলে গিয়ে নতুন সবার সাথে পরিচয় হলো, দুজন বাদে সবাই স্থানীয়, দুইজনের মধ্যে একজন বিহার থেকে এসেছে তার নাম নিরঞ্জন রায়, বিহারী, অন্যজন রাধেশ্যাম বিকানের থেকে এসেছে, ম্যানেজার রোহিত ঐ দুজনকে বললো আজ থেকে ইনিও তোমাদের সাথে থাকবে বিকালে ছুটির পর একে নিয়ে যেও। নিরঞ্জন আর রাধেশ্যাম দুইজনেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
বিকালে যথারীতি ওরা আমায় নিয়ে নতুন ডেরায় চললো, একটা বিরাট হাভেলি, এটা প্রায় দুশো বছরের পুরোনো, এখনকার বংশধরেরা মুম্বাই তে ব্যবসা করেন, ইনারা আমাদের স্কুল কে এটা ব্যবহারের জন্যে দিয়েছেন, আমাদের এখানে বাইরের যতো স্টাফ আসবে সবাইকে এখানে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে! প্রত্যেকের জন্যে একটা করে রুম বরাদ্দ, বাথরুম ছেলেদের, মেয়েদের আলাদা কিন্তু কমন, বিশাল বিশাল চারটে রান্না ঘর। হ্যাভলিটা দোতলা, এর দুটো ভাগ একটা বাহির মহল আর একটা অন্দর মহল, দুটো পার্ট কে সংযুক্ত করে রেখেছে ছোট্ট সরু একফালি প্যাসেজ, যেটায় মাথা নিচু করে হাটতে হয়, বাথরুম গুলো ম্যানেজমেন্ট থেকে নতুন করা হয়েছে যা সবগুলোই অন্দর মহলে, সারা হাভেলিতে একটা প্রাচীন অদ্ভুত গন্ধ! নিরঞ্জন আমায় বললো-" তুমি আজ নতুন এসেছো, আমি আর রাধেশ্যাম দুজনেই আলাদা রান্না করে খাই, আজ বরঞ্চ তুমি আমার সাথে খাও কাল থেকে জিনিষপত্র এনে নিজে রান্না করে খেও "! আমি সম্মত হয়ে হাত মুখ ধোয়ার জন্যে ভিতর মহলের বাথরুম এর দিকে এগালাম, অন্দর মহলে যেহুতু কেউ থাকেনা তাই কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার শুধু বাথরুম এ আলোর ব্যাবস্থা আছে। প্যাসেজ এ পা দেওয়া মাত্র আমার মনে হলো আমায় কেউ অনুসরণ করছে, পিছনে পায়ের শব্দ! সভয়ে পিছনে চাইলাম কিন্তু কাউকে দেখলামনা, আবার যেই চলা শুরু করেছি আবার একই জিনিস! কোনোরকমে নমো নমো করে বাথরুম সেরে ফিরে আসলাম, একবার ভাবলাম নিরঞ্জনদের ব্যাপারটা বলি কিন্তু ওরা হাঁসাহাঁসি করবে বলে আর কিছু বললামনা, চেপে গেলাম!
৩
এর মধ্যে রাধেশ্যাম আর নিরঞ্জনের সাথে আরো হৃদতা বাড়লো, একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম সারাদিন কিছু নেই, বিকালে হাভেলি তে ঢোকার পরেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়, মনে হয় আড়াল থেকে সর্বক্ষণ কেউ দেখছে, অনুসরণ করছে আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম রাধেশ্যাম বা নিরঞ্জনের মধ্যে কেউ একজন বাথরুম গেলে সাথে আরো একজন যায়, এর চার পাঁচদিন পরের ঘটনা, আমরা নাইট শো সিনেমা যাবো, আমি আর নিরঞ্জন তৈরী হয়ে রাধেশ্যাম এর রুম এ প্রবেশ করলাম, ও আমাদের সামনে পরনের লুঙ্গি খুলে ভাঁজ করে রেখে প্যান্ট পড়ে শার্ট গায়ে দিয়ে বেড়ালো! সিনেমা দেখে ফিরে সদ্য রুমে ঢুকে পোশাক পাল্টাচ্ছি, রাধেশ্যাম চিৎকার করে ডাকলো " গাঙ্গুলী, নিরঞ্জন তাড়াতাড়ি এসো " দৌড়ে গিয়ে দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য, মেঝের মধ্যে ছড়ানো ছেটানো বিছানা মায় ওর ছাড়া লুঙ্গি, গেঞ্জি অব্দি! ও বললো " বেড়াবার সময় তোমরা দেখলে আমি সব পাটপাট করে ভাঁজ করে বিছানায় রেখে গিয়েছি, এসে এই দৃশ্য দেখছি "! কিভাবে সম্ভব যেখানে বাইরে থেকে দরজা লক করা, দেউড়ি গেট (মেইন গেট) লক করা, তবে কে ঢুকে এমন করবে! এটা দেখার পর আমিও আমার অভিজ্ঞতা সেদিন ওদের বললাম, শুনে ওরা বললো "আমরা এটা জানি যার জন্যে সন্ধ্যার পর একা একা আমরা বাথরুম এ যাইনা আর তুমিও যেওনা "! সেদিন রাতে নিরঞ্জন আমার রুমে শুতে আসলো, সেদিন ও বললো রাতে নাকি ওর রুমে কেউ পায়চারি করে আর সেটা এক না একাধিকবার!
রাতে বাহির মহলেই আমরা ছোটো একটা অস্থায়ী বাথরুম করলাম, একদিন রাতে আমি বাথরুম গিয়েছি, হঠাৎ মনে হলো আমার দরজার সামনে রাধেশ্যাম দাঁড়িয়ে, সামনে যেতে স্যাট করে মনে হলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো, পরের দিন সকালে ওকে জিজ্ঞাসা করাতে ও বললো সে সারারাত রুমেই ছিলো বাইরে বেড়াইনি।
৪
সমস্যাটা ঘোরোতোর হলো উপরের একতলার তিন মহিলা কর্মচারীকে তিনটে রুম খুলে দেওয়াতে, এই তিনজনই দিল্লির থেকে এসেছিলেন, আরো দুইজন পুরুষ কর্ম্মচারিও এসেছেন, একজন মুম্বাই আর একজন বিহার থেকে, আমি রাধেশ্যাম আর নিরঞ্জন ঠিক করে নিয়েছিলাম নতুন আগতদের আমরা আগ বাড়িয়ে কিছু বলবোনা, কপাল খারাপ হলে ওরা নিজেরাই অনুভব করবে। এর মধ্যে গ্রীস্ম এসেছে আমরা পাঁচ পুরুষ মানুষ ছাদের উপর বিছানা পেতে শুতে শুরু করেছি, একদিন রাতে আমার রুমে বসে আমি বই পড়ছি, বাকিরা ছাদে শুতে গেছে, আমিও যাবো যাবো করছি, হঠাৎ অস্বাভাবিক গলায় এক মহিলার চিৎকারে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো, আমি দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি তিন মহিলা কর্মচারীর একজনকে আর এক মহিলা যার নাম কিরণ জাপটে ধরে আছে। চিৎকার শুনে বাকি পুরুষরাও উপর থেকে নিচে নেমে এসেছে, পাণ্ডে ম্যাডামও (ইনি তৃতীয় মহিলা যিনি দিল্লি থেকে এসেছেন) বেরিয়ে এসেছেন। কিরণ বললো -" ও নিজের রুমের সামনে পায়চারি করছিলো আর গুপ্তা ম্যাডাম(যাকে কিরণ জাপটে ধরে ছিল)সকালের মেলে যাওয়া কাপড় তুলছিলেন, হঠাৎ কিরণ দেখে গুপ্তা ম্যাডাম চিৎকার করে দৌড়ে নিচে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলো তখন কিরণ দ্রুততার সাথে উনাকে জাপটে ধরে "! গুপ্তা ম্যাডামের চোখে মুখে অসম্ভব ভীতির ছাপ, শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে, কাউকে যেনো চিনতে পারছেনা, অনেক কষ্টে উনাকে স্বাভাবিক করার পর উনি বললেন " উনি যখন শুকনো কাপড় তুলছিলেন উনার মনে হলো উনাকে হঠাৎ পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলো, উনি ভাবলেন কিরণ বুঝি ইয়ার্কি করে জড়িয়ে ধরেছে, উনি ছাড়তে বলাতে আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো, ব্যাথা লাগায় উনি পিছন ফিরে দেখেন একজন পুরুষ মুখভর্তি দাড়ি, বলিষ্ঠ চেহারা পরনে একটি লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত উনাকে জড়িয়ে ধরে আছে এরপর উনি অসম্ভব ভীত হয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ঝাঁপ মারতে যান, এইসময় মুম্বাই থেকে যে ছেলেটি এসেছে বিশেন, সে বলে ওঠে তার রুমেও রোজ সে ফিশফিশ করে শেখাবাটি ভাষায় পুরুষ আর মহিলার কণ্ঠে কথা শোনে, আমরা হাসাহাসি করবো বলে সে এতদিন চেপে রেখেছিলো, সেদিন সারারাত বিনিদ্র কাটিয়ে আমরা ঠিক করি পরের দিন ম্যানেজামেন্ট কে সব জানানো হবে।
৫
পরের দিন রোহিত কে সব বলাতে উনি হেঁসে গড়িয়ে পড়লেন! আমরা অ্যাডামেন্ট অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা না হলে চাকরি করবোনা, প্রাণ আগে। রোহিত উনিবিংশ শতাব্দীতে কিভাবে এসব আমরা বিশ্বাস করি সেই নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন! তারপরেও আমরা সিরিয়াস দেখে অনুরোধ করলেন আর কিছুদিন থাকতে, উনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবেন বলে। এর পর আমরা বিকালের আলো থাকতে থাকতে কোনোরকম দুটো রান্না করে খেয়ে রাতটা একটা ধর্মশালাতে কাটানো শুরু করলাম। রান্নার দায়িত্বে রোজ দুইজন করে থাকতো বাকিরা উঠানের মাঝে খাঁটিয়া বিছিয়ে বসে গল্প করতাম! একদিন এমন দুইজন রান্না করছে আর বাকী আমরা বসে গল্প করছি হটাৎ দেখি আমার রুমে সেই গুপ্তা ম্যাডাম বর্ণিত অবিকল সেই লোকটা কিছু খুঁজতে খুঁজতে ঢুকছে, ভয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসলো আমি চিৎকার করে কিছু বলতে চাইলাম গলা দিয়ে স্বর বেড়ালোনা, পাণ্ডে ম্যাডাম আমার মুখোমুখি বসেছিল আমার মুখের অভিবাক্তি দেখে বললো "গাঙ্গুলি কি হয়েছে "! অনেক সাহস নিয়ে বললাম "আমার রুমে কেউ ঢুকেছে " সবাই দৌড়ে দেখতে যাবো ওদিকে রান্নাঘর থেকে রাধেশ্যাম চিৎকার করে বললো " ওখানে কে দাঁড়িয়ে "! আমরা গিয়ে রাধেশ্যাম কে জিজ্ঞাসা করলাম " কি হয়েছে "! সে বললো অবিকল ঐ লোকটা রান্নাঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো যার কথা গুপ্তা ম্যাম বলেছিলো "! যেখানে আমার রুম থেকে রান্না ঘর প্রায় হেঁটে গেলে তিন মিনিটের পথ, এতো তাড়াতাড়ি একই লোক আমার কামরা থেকে ওখানে যেতে পারেনা! খাওয়াদাওয়া শিকায় উঠলো সবাই মিলে ধর্মশালায় রওনা দিলাম।
৬
পরের দিন জয়পুর থেকে কর্তৃপক্ষ এক নামকরা তান্ত্রিক কে নিয়ে আসালো, তখনকার দিনে তার ফিস চার হাজার টাকা সাথে দুইজন চেলা, উনি এসে সব সরোজমিনে দেখে জানালেন ওখানে অতৃপ্ত প্রেত আত্মার অস্তিত্ব আছে কিন্তু উনি তিন দিনের যজ্ঞ করে সব শুদ্ধ করে দিলে আর কোনো কিছু গোলমাল হবেনা যথারীতি তার পরের দিন থেকে যজ্ঞ শুরু হলো, তৃতীয় দিন আমরা সবাই সন্ধ্যের সময় যজ্ঞ দেখতে গেলাম, তান্ত্রিক মশাই হোম কুন্ড জ্বালিয়ে মন্ত্র পাঠ করছেন তাকে ঘিরে আমরা সবাই বসে! হঠাৎ এই সময় ছাদে একসাথে তিরিশ চল্লিশজন মানুষ দৌড়ালে যেমন আওয়াজ হয় সেরকম আওয়াজ শুরু হলো! তান্ত্রিক মশাইও চোখ খুলে উপর পানে চাইলেন! এরপর কোনোরকমে যজ্ঞ শেষ করে আমাদের ঘটিতে জল আর আম পল্লব দিয়ে সব রুমে ছেটাতে বললেন! আমার আর রাধেশ্যাম এর উপর সেই দায়িত্ব পড়লো! আমরা একেকটা রুমের সামনে দাড়াই আর নমো নমো করে জল ছিটাই! এই করে আর দুটো রুম বাকি হঠাৎ দেখি সেই দাড়িওয়ালা লোকটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, পরিমরি করে দৌড়ে আমরা বাইরে এসে দেখি সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে এমনকি সেই তান্ত্রিক অব্দি! সবাই ঐ ভাবে আমাদের আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে! আমরা সব খুলে বলি, অতঃপর তান্ত্রিক মশাই বলেন " আনঅফিসিয়ালি আমি তোমাদের এখানে থাকতে বারণ করবো কারণ এই হাভেলি টা সত্যি গন্ডগোলের"! এর পর অত কিম! সবাই এক এক করে নাওয়ালগার কে বিদায় জানাতে শুরু করলাম।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment