ছবি : ইন্টারনেট |
বিবেকের জ্বালা
প্রীতম সরকার
টেলিফোনেই চিৎকার
করে উঠলো বাবলু। যেন সে আরতির কোন কথা শুনতে চাইছে না। বারবার ওপাশ থেকে বলে
চলেছে, “না মা, তুমি এই কাজ করে ভীষন রকম খারাপ করেছে। আর এখন আমাকে জানাতে এসেছো!
করার আগে আমাকে একবারের জন্যও জানানোর কোন প্রয়োজন মনে করলে না! তুমি এখনই
ভদ্রলোককে বাড়ি থেকে বের করে দাও! আমি আর কিছু শুনতে চাই না!”
আরতি
বাবলুকে শান্ত করার চেষ্টা করে চেলেছে। মা ছেলের মধ্যে কথা হচ্ছে সেলফোনে। বাবলু
এখন মুম্বইতে একটি হোটেলে চাকরি করছে। আরতি তাঁকে শান্ত করতে ফের বলে, “নিজের
বাবাকে কেউ এভাবে কথা বলে! এই তোকে আমি শিক্ষা দিয়েছি!”
“হুঁ, বাবা!
কোথায় ছিল বাবাত্ব! যখন তোমাকে ছেড়ে ডিভোর্স দিয়ে ওই মহিলার সঙ্গে ড্যাংডেঙ্গিয়ে
আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল! আমাকে নিয়ে তুমি কি অবস্থায় পড়েছিলে, তখন সেকথা আমাকে
তুমি বলোনি! আর এখন আবার এসেছে তোমার কাছে! অসভ্য, ছোটলোক একটা! আবার এখন অসুখ
বাঁধাতেই সব আপনজন তাঁকে ছেড়ে ফুঁটে গেলো! এখন সেই আরতিই ভরসা!।”
“ আঃ। কি
হচ্ছে কি বাবলু! এভাবে কেউ নিজের বাবার সম্পর্কে কথা বলে!” আরতি প্রতিবাদ করে
ছেলের কথায়। যদিও আরতি নিজেও জানে যে ছেলে একবিন্দু মিথ্যা কথা
বলছে না!
“আমি কোন
কথা শুনতে চাই না! আমি যেন এবার বাড়িতে ফিরে কোনভাবেই ওই লোকটাকে দেখতে না পাই।
সেরকম হলে আমি সামনের সপ্তাহেই কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসছি!” বাবলু মোবাইলের
ওপাড় থেকেই চিৎকার করতে থাকে।
“তোকে এভাবে
আসতে হবে না! কয়েকদিন পরে সুস্থ ভাবে বাড়িতে আসিস্। আরে বাবা, লোকটা তো তোর বাবা
নাকি! এখন বিপদে পড়ে সাহায্য চাইছে। কোন
সাহায্য প্রার্থীকে বিপদের মধ্যে আমি ফেলতে পারবো না! আর উপর সে আবার আমার
প্রাক্তন স্বামী, তোর নিজের বাবা!”
“ হোক বাবা!
তুমি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখাবে না! তুমি কি ভুলে গিয়েছো সেই সব দিনগুলির কথা!”
জবাব দেয় বাবলু। বাবলুর এই কথার কোন জবাব দেওয়ার ভাষা হারিয়ে গিয়েছে আরতির কাছে।
সত্যি তো, বাবলু যে কথাগুলো বলছে, সেগুলোকে উড়িয়ে দিতে পারছে না আরতি। এই লোকটার
জন্য তাঁর নিজের জীবনে একদিন কি ভীষন দূর্যোগ নেমে এসেছিল। কিভাবে অন্য আত্মীয়
স্বজনদের সাহায্য নিয়ে বাবলুকে পড়াশোনা করাতে হয়েছে! আর বাবলু তো এখনও জানে না যে
আরতী তাঁকে বাবলুকে না জানিয়েই বাড়ির একটি ঘরে ইতিমধ্যেই আশ্রয় দিয়ে দিয়েছেন। ঘরের
একটি তক্তপোষ সেই লোকটা এখন শুয়ে আছে!
বাবলু যখন
বাড়িতে আসবে, তখন যে কি হুলুস্থুল কান্ড করবে, সেটা ভেবেই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল
আরতীর। তার উপর লকটা যে তাঁকে দিয়ে যে অঙ্গীকার করিয়েছে, তাতে বাবলু আদৌ রাজি হবে
কি না সেটা তো আরও চিন্তার বিষয়।
আরতী বাবলুর
ফোন কেটে দেওয়ার পরে নিজেই নিজের অতীতের সেই দিনগুলির কথা ভাবতে শুরু করে আরতী।
যদিও সেইসব কষ্টের দিনগুলেক ফের মনে করতে চায় না সে, তবুও স্মৃতির আয়নায় বারবার
ফিরে ফিরে আসছে সেইসব দিনের কথা।
শঙ্খদীপ
যেদিন অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে এসে রাতে খেতে খেতে আরতীকে জানিয়েছিল, যে সে তাঁকে
ডির্ভোস করতে চায়! মুখে সবে মাত্র রুটির
টুকরোটা দিয়েছে আরতি, সেই মুহুর্তে শঙ্খদীপের মুখের থেকে কথাটা শোনা মাত্র এমন
বিষম খেয়েছিল, যে প্রান অষ্টাগত হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। শঙ্খ চাকরি করতো পোর্ট
ট্রাষ্টে। বিশাল কোন বড় পোস্টে চাকরি না করলেও তাঁদের সংসারে কোন অশান্তি সে অর্থে
ছিল না।
কিন্তু
এরমধ্যেই বেশ কয়েকমাস ধরে আরতী বুঝতে পারছিল, শঙ্খদীপের চালচলনে কিছু একটা
পরিবর্তন এসেছে। প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরা, প্রায়ই মদ্যপ অবস্থায়, এদিকে ছেলে
বাবলুর তখন সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। স্বামীর আচরনের এই বিচিত্র স্বভাব পরিবর্তন
চিন্তায় ফেলেছিল আরতীকে।
একদিন
শঙ্খের প্যান্ট কাঁচতে গিয়ে পকেটের থেকে কন্ডোমের প্যাকেট পেয়ে আরতী এতটাই চমকে
উঠেছিল যে সারাদিন কারো সঙ্গে কোন কথা বলতে পারেনি। তাঁর মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল
না। বাবলু স্কুল থেকে ফিরে মাএর মুড খারাপ আন্দাজ করতে পেরে বিকালে পাড়ার মাঠে
খেলতে চলে গিয়েছিল। একটু রাত করে শঙ্খদীপ বাড়িতে ফিরে এলেও আরতী স্বামীর সঙ্গে ওই
বিষয় নিয়ে কোন কথা তোলেনি। সেরাতে শঙ্খ ফিরেছিল, সুস্থ অবস্থায়। মদ্যপানের করেছিল
না। রাতে খাওয়ার পরে নিজেদের শোবার ঘরে এসে সারাদিনের রাগ অভিমান আর চেপে রাখতে
পারেনি আরতী। প্রচন্ড চিৎকারের ঝড় তুলে শঙ্খদীপের উপরে ঝাপিয়ে পড়ে বলেছিল, “বাইরে
কি করছো এসব! বাড়িতে প্ররযন্ত যাঁর চিহ্ন নিয়ে আসছো! আর কত নীচে নামবে তুমি!”
“আমার
ড্রিঙ্ক করার বিষয়ে বলছো! আরে সে তো অফিস ছুটির পরে প্রতিদিনই কোন না কোন অফিস
কলিগ প্রায় জোর করে টেনে বারে নিয়ে যাচ্ছে! কিন্তু আমি তো মদ খেয়ে এসে কোনদিন
মাতলামি করিনি! তবে রাগটা কিসের! একটু বিয়ার বা সামান্য দু-এক পেগ হুইস্কি নিলেও কোন
অসভ্যতা তো কোন দিন করিনি। তবে কেন রাত দুপুরে এসব নিয়ে কথা তুলছো!”
“না! মদ
খাওয়া নিয়ে আমি এখন কিছু বলছি না! সে তো তুমি অনেক দিন ধরেই করে চলেছো! কিন্তু এখন
আরও কিসব নোংরামি করছো!” চিৎকার করে ওঠে আরতী।
“মানে! কি
বলতে চাইছো তুমি! তোমাকে কে বললো, যে আমি নোংরামি করছি!” যেন কিছুটা স্বগোক্তির
ঢঙেই কথাগুলো বলেছিল শঙ্খদীপ।
“ তাহলে
তোমার প্যান্টের পকেটে ওই জিনিস আসলো কিভাবে!” আরতী প্রশ্ন করেছিল।
“ কি
জিনিস!” জানতে চায় শঙ্খ।
“ দেখবে কি
জিনিস ! দ্যাখো তবে,” বলেই আরতী সকালে কাপড় কাচতে গিয়ে শঙ্খের প্যান্ট্রের পকেট
থেকে যে কন্ডোমের প্যাকেটটা পেয়েছিল, সেটা তখন রেখে দিয়েছিল। সেই প্যাকেটটাই এখন
ছুঁড়ে দিলো শঙ্খের দিকে। প্যাকেটটা শঙ্খের শরীরে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে গিয়ে পড়লো।
সেই প্যাকেট দেখে শঙ্খ যে শুধু চমকে উঠলো, তাই নয়, ভীষন রকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
গেল। সে শুধু বললো, “ও এটা।”
যেন কিছুই
হয়নি এমন ভাবে আরতীকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ তোমাকে একটা কথা অনেকদিন ধরেই বলবো
বলবো ভাবছিলাম! যাক্ তুমিই সেই সুযোগ করে দিয়েছো!”
“মানে!”
“হ্যাঁ
আরতী, আমার অফিসের এক কলিগের সঙ্গে আমার বেশ কিছুদিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক চলছে।
আমাদের মধ্যে বহুবার শারিরীক সম্পর্কও হয়েছে। মহিলা উইডো। আমি তাঁর বাড়িতেই যাই
এবং সেখানেই মদ খাই। আমাদের সম্পর্কটা বেশ গভীরে চলে গিয়েছে।”
এরপরে দু’দিন
স্বামী স্ত্রীর কোন কথা ছিলনা।
তারপরেই
রাতে খেতে বসে শঙ্খ ওই ডির্ভোসের কথা। আরতী যেন মানসিকভাবে এই ঘটনার জন্য তৈরিই
ছিল। বাবলুকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলো নিজের ছোট বোনের বাড়িতে। শঙ্খকে একবারের জন্যেও
কোন প্রতিবাদ করেনি।
ছোট বোন
কবিতার পরিবারের আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালোছিলনা। বড় দিদি এবং তাঁর স্কুলে পড়া
ছেলেকে ভরনপোষন করা কবিতার পরিবারের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সেটা জেনেই আরতী নিজেই
উদ্যোগ নেয় নিজে কিছু রোজগার করার। ব্যবস্থা করে দিলো কবিতাই। আরতী নিজেও বাপের
বাড়িতে বিয়ের আগে সেলাই, হাতের কাজ শিখেছিল। এখন সেটাই কাজে লাগলো। পাড়ায় পাড়ায়
ঘুরে হাতের কাজ শেখানোর কাজ শুরু করে বাবলুর পড়াশোনার খরচ চালাতে লাগলো। বাবলু
তাঁর বাবার এই আচরন মেনে নিতে পারছিল না। এরমধ্যেই কবিতার বাড়ির ঠিকানায় ডিভোর্সের
নোটিশ এলো একদিন।
বাবলু সেই
ঘটনা জেনে বাবার উপরে আরও ক্ষেপে উঠলো। আরতী ছেলেকে কোনভাবে মাথা ঠান্ডা করিয়ে
পড়াশোনায় মন দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বোনের সংসারে থাকতে লাগলো।
এভাবে বেশ কয়েক
বছর সময় কেটে গেলো। আরতী শুনতে পেয়েছে, শঙ্খ ওই বিধবা অফিস কলিগকে বিয়ে করে বাড়িতে
এনে তুলেছে। শঙ্খও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে হোটেল ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হয়েছে।
সেলাই স্কুল করে ভালো রোজগার শুরু করার পরে আরতী বোনের সংসার ছেড়ে নিজেই একটা
আলাদা বাড়িভাড়া নিয়ে উঠে এসেছে। যা রোজগার হচ্ছিল, তাতে মা ছেলের মোটামোটিভাবে দিন
চলে যচ্ছিল।
এখন বাবলু
মুম্বই এর এক তিন তারা হোটেলে চাকরি পেয়েছে। আরতী ভাড়া বাড়িতে একাই থাকে। একদিন
সন্ধ্যায় সেলাই স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখলো গায়ে চাদর জড়িয়ে একটি লোক তাঁর
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাছে এসে লোকটাকে চিনতে পেরেই নিজের মনেই চমকে উঠলো আরতী।
এ যে শঙ্খদীপ! কি চেহারা হয়েছে ওঁর। কি চায় লোকটা তাঁর কাছে! কেন এসেছে এত দিন
পরে!
আরতী মুখে
কিছু না বলে শঙ্খদীপকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারলো না সে। শঙ্খদীপ এমনভাবে
আরতীর পথ আটকে দাঁড়িয়েছে, যে তাঁকে এড়িয়ে বাড়ির ভিতরে যাওয়া সম্ভব নয় আরতীর পক্ষে।
এবার নিজেই কথা বললো শঙ্খদীপ।
“আমাকে
ক্ষমা করো আরতী। আমার গলায় ক্যানসার ধরা পড়েছে। লাষ্ট স্টেজ বলা চলে। আর হয়তো
বেশিদিন বাঁচবো না। তোমাকে ছেড়ে আমি তিথিকে যে বিয়ে করেছিলাম। সেই তিথিও এখন আমাকে
ছেড়ে চলে গিয়েছে! এখন এই মৃত্যুর পথে তুমিই আমার একমাত্র সঙ্গী।”
আরতী মুখে
শুধু বললো, “চলো, বাড়ির ভিতরে চলো! সেখানেই বাকি কথা শুনবো!”
সব কথা বলার
পরে শঙ্খদীপ আরতীর কাছে এক অদ্ভুত আবদার করে বসলো। বললো, “আমাদের একমাত্র সন্তান
বাবলু। আমার একান্ত ইচ্ছা, আমার মৃত্যুর পরে আমার মুখাগ্নি যেন আমার ছেলেই করে!”
আরতীর দুচোখ
দিয়ে জলের ধারা নেমে আসছিল। সে নিজে ছেলেকে নিয়ে একবার জীবনে বেসাহারা হয়েছিল। বেসাহারার
অর্থ সে নিজে ভালো করে বোঝে। এখন তাঁদের যে বেসাহারা করেছিল, সেই লোকটাই তাঁর কাছে
সাহারার খোঁজে এসেছে। আরতী আর কিছু বলতে পারলো না। শুধু বললো, “তুমি একটু পরিস্কার
হয়ে নাও। তারপর বিশ্রাম করো। আর ডাক্তারের প্রেসক্রিপ্সন থাকলে আমাকে দিও।
ওষুধপত্র যা লাগবে, এনে দেবো।”
No comments:
Post a Comment