![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
মহামিলনের বন্ধনে দুর্গাপূজার মহা আয়োজন
রূপম চক্রবর্ত্তী
যে দেবী অগম্যা, দুষ্প্রাপ্যা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না এই অর্থেও তিনি দুর্গা। দুর্গ নামক দৈত্যকে দমন করে ইনি দুর্গা নাম প্রাপ্ত হন। হিন্দু ধর্মমতে, পরমাপ্রকৃতি স্বরূপা মহাদেবী, মহাদেবের পত্নী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের মতে, ইনি মহামায়া, পরমবিদ্যা, নিত্যস্বরূপা, যোগনিদ্রা। ইনি জন্মমৃত্যু-রহিতা। মহাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থেও ঈশ্বরকে দুর্গা বলে বর্ণনা করা হয়। দেবীর দশ হাত সেই অর্থে মহাশক্তির পরিচায়ক। তন্ত্রে, পুরাণে আরও কয়েকজন দুর্গা-নামধারিণী দেবীর সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন— পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা, বনদুর্গা, অগ্নিদুর্গা, বিন্ধ্যবাসিনী-দুর্গা, রিপুমারি-দুর্গা, অপরাজিতা-দুর্গা। শাস্ত্রে দুর্গার নয়টি নির্দিষ্ট মূর্তিকে 'নবদুর্গা' বলে। এঁরা হলেন—ব্রহ্মাণী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, নারসিংহী, বারাহী, ইন্দ্রাণী, চামুণ্ডা, কাত্যায়নী ও চণ্ডিকা। মহাশক্তি বলে দুর্গাকে নিদ্রা, ক্ষুধা, লজ্জা, তুষ্টি, আগুনের দাহিকা শক্তি, সূর্যের তেজ, জলের শীতলতা, ব্রাহ্মণের ব্রহ্মণ্যশক্তি, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়শক্তি, তপস্বীর তপস্যাশক্তি, ক্ষমাবানের ক্ষমাশক্তি, পৃথিবীর ধারণ ও শস্য-উত্পাদন ক্ষমতা প্রভৃতি বলে স্তব করা হয়েছে ও হয়ে থাকে।
দুর্গাপূজার সময় দেবীদুর্গার আবরণদেবতা হিসেবে এঁদের পূজা করা হয়। বনদুর্গার আট হাত। অস্ত্রশস্ত্র মহিষমর্দিনীর অনুরূপ। পরাক্রমাধিষ্ঠাত্রী দেবতার সিংহই উপযুক্ত বাহন। দুর্জন বা অসুরেরাই জগতের দুর্গতির প্রধান কারণ, অতএব দুর্গা অসুরনাশিনী বলে বর্ণিত হয়েই একপ্রকারে দুর্গতিনাশিনী বলে বর্ণিত হয়েছেন। যখন নানা রকমের দুর্গতি আছে, তখন অন্য প্রকার দুর্গতিনাশিনী অর্থেও দুর্গাকে দুর্গা বলা যায়। দুর্গাদেবীর পূজার প্রথম প্রচলন হয় সত্যযুগে। সত্যযুগের রাজা ও সমাধি বৈশ্য দুর্গামূর্তি তৈরি করে তিন বছর পূজা করেন। সত্যের পরের যুগ ত্রেতায় রাবণ চৈত্রমাসে দুর্গাদেবীর পূজা করতেন। সে কারণে এই পূজার নাম ছিল বাসন্তী পূজা। রামচন্দ্র রাবণের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণের পূর্বে আশ্বিন মাসে অকালে দুর্গার পূজার আয়োজন করেন।সে কারণে এই পূজাকে বলা হয় দুর্গার অকালবোধন। বাংলাদেশে রামচন্দ্রের অনুসরণে এই পূজা পালিত হয় শারদীয়া দুর্গাপূজা হিসেবে। মূল প্রকৃতিকে ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তি বা মায়াশক্তি বলে। আবার পঞ্চভূত ইত্যাদি জড় পদার্থের সমষ্টিকেও প্রকৃতি বলে গণ্য করা হয়। দুর্গা হলেন মূল প্রকৃতির এক অংশ। তবে বর্তমানে পরিচিত মহিষাসুরমর্দিনী ও তন্ত্রকথিত মহিষমর্দিনীর রূপে সামান্য পার্থক্য আছে। দেবী মহিষমর্দিনী অষ্টভুজা। এর ধ্যানে সিংহের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দেবীকে মহিষের মাথার উপর বসে থাকতে দেখা যায়। হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খক্ষ, খেটক, ধনুক, বাণ, শূল ও তর্জনীমুদ্রা।
মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করলে দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহাদেব ও অন্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য ছিলেন বলে বিষ্ণু দেবতাদের পরামর্শ দেন যে, 'প্রত্যেক দেবতা নিজ নিজ তেজ ত্যাগ করে একটি নারীমূর্তি সৃষ্টি করবেন। এরপর সমবেত দেবতারা তেজ ত্যাগ করতে আরম্ভ করেন। যে যে দেবতার তেজ থেকে এই নারী মূর্তির শরীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি হলো, তা এ রূপ 'মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙুল, বসুগণের তেজে হাতের আঙুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূ, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতার তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হলো। এরপর দেবতারা তাকে বস্ত্র, পোশাক ও অস্ত্র দান করলেন।
সনাতনধর্মী বাঙালিরা দুর্গার যে মূর্তিটি শারদীয়া উত্সবে পূজা করে থাকেন, সেই মূর্তিটির শাস্ত্রসম্মত নাম মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা। ডান দিকের দশ হাতে থাকে শূল, খক্ষ, শঙ্খ, চক্র, বাণ, শক্তি, বজ্র, অভয়, ডমরু, ছাতা; আর বাঁদিকের দশ হাতে থাকে নাগপাশ, খেটক, পরশু, অঙ্কুশ, ধনুক, ঘণ্টা, পতাকা, গদা, আয়না ও মুগুর। মহাদেব দিলেন শূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু ও বাণপূর্ণ তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘণ্টা, যম দিলেন কালদণ্ড, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, সূর্য দিলেন রশ্মি, কালখক্ষ ও নির্মল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দিলেন অক্ষয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলঙ্কার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশুসহ নানাবিধ অস্ত্র, অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দিলেন সিংহ, কুবের দিলেন অমৃতের পান পাত্র, শেষ নাগ দিলেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতা তাদের সাধ্যমতো বিষয় উপহার দিলেন। এভাবে তিনি হয়ে উঠলেন দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রতিরূপ।
সিন্ধু উপত্যকায় আবিস্কৃত
প্রাগৈতিহাসিক যুগের অসংখ্য পোড়ামাটির স্ত্রী মূর্তীগুলো মাতৃমূর্তীর সূদুর অতীতকালের
নিদর্শন। বাংলায় দুর্গাপূজার তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে, মোঘল সম্রাট আকবরের সুবাদার রাজা কংস নারায়ন রায়
বাংলার দেওয়ান ছিলেন। তিনি পন্ডিত রমেশ শাস্ত্রির পরামর্শে মহাযজ্ঞ না করে দুর্গাপূজা
করেছিলেন। ব্যক্তিগত পূজায় যখন সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে তখনই প্রয়োজন
দেখা দেয় সকলের অংশগ্রহণে সার্বজনীন পূজার। সার্বজনীন দুর্গোৎসবের শুরুটা হয়েছিল ১৭৯০
সালে হুগলী জেলার গুপ্তি পাড়া গ্রামের বারো জন বন্ধুর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। বারো জন
বন্ধু বা ইয়ার মিলে পূজার আয়োজন করেছিল বলেই পূজার নাম হয়েছিল বারোয়ারি পূজা যা আজকে
সার্বজনীন পূজা রূপে পরিগণিত। সনাতনীদের অন্যান্য পুজার পাশাপাশি এই পূজায় আধ্যাত্মিক
ও সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে বলে এ পূজাকে মহাপূজা বলা হয়। এই পূজায় রয়েছে সকল পূজার সংশ্লিষ্টতা।
দুর্গা পূজায় কেবলমাত্র দুর্গারই পূজা হয় না। পূজা হয় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, শিব এমনকি তাঁদের বাহনদি যেমন- সিংহ, পেঁচা, হাঁস, ময়ূর, ইঁদুর, বৃষ ইত্যাদির। আবার
এমনকি অসুরের পূজাও হয় এই পূজায়।
শক্তিময়ী মা মঙ্গলময় শিবকে মাথায় ধারণ করার শিক্ষাটি আমাদের জন্য এক অনুপম বার্তা প্রদান করেছে। অনেকে সময় আমরা অর্থ বিত্তের মধ্যে খুব বেশি দিনাতিপাত করি । আমরা ভুলে যাই মানুষের মঙ্গল কামনার পবিত্র শিক্ষাটি। আমরা অনেক শক্তিশালী হতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দেহগত শক্তি আর আর আর্থিক শক্তি একদিন শেষ হইয়ে যাবে। তাই আমাদের উচিত শক্তিকে মংগলের কাজে নিয়োজিত করা।
ঐক্যেই শক্তি, মহাশক্তি। দুর্গা সিংহবাহিনী, মহিষাসুরমর্দিনী। তাঁর ডানপাশে ধনাধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর ডানে সিদ্ধিদাতা গণেশ। বামপাশে জ্ঞানধিষ্টাত্রী সরস্বতী ও তৎ বামে দেব সেনাপতি কার্তিক। দুর্গার উপরে সর্ব মঙ্গলকারী শিব। দুর্গাপূজার এই কাঠামোতে রয়েছে সুগভির তাৎপর্য। একটি রাষ্ট্র এমনকি একটি পরিবার পরিচালনা করতে গেলেও চারটি শক্তির সমাহার প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ্যশক্তি সরস্বতী,ক্ষাত্রশক্তি কার্তিক, বৈশ্যশক্তি লক্ষ্মী,গণশক্তি গণেশ। দুর্গার কাঠামো একটি আদর্শ জীবনকাঠামো। যারা পূজা করেননা তারাও দুর্গা কাঠামো থেকে আপন জীবনের উন্নয়ন ও সংহতি আদর্শ আহরণ করতে পারেন। তেলি, মালি, ধুলি, নাপিত থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ পর্যন্ত সকলের অংশগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী। বলা চলে দুর্গাপূজা সকলকে মিলায়। সকলের মিলনে হয় মহামিলন। নানা প্রকারের উদ্ভিজ, দ্রব্য, বাধ্য, অলংকার, মাটি পর্যন্তও দুর্গা পূজায় প্রয়োজন হয়। নানা প্রকারের মানুষ, নানাবিধ বস্তুর মিলনে সৃষ্টি হয় সামাজিক ঐক্য। মায়ের আগমনে মন্ডপে মন্ডপে মাংগলিক আওয়াজে মুখরিত। কেউ ফুল তোলার কাজে ব্যস্থ , কেউ মায়ের পজ়ার জন্য দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে ব্যস্থ। ছোট শিশুরা এক মন্ডপ থেকে আরেক মন্ডপে ছুটে চলার জন্য মায়ের কাছে আবদারের বার্তা নিয়ে ছুটে আসে। সনাতন ধর্মের যারা অনুসারী তারা একে অপরের সাথে মহামিলনের এক অপুর্ব প্রচেষ্টায় রত থাকে কারণ মা আসেন মিলনের বার্তা নিয়ে। পূজার আয়োজক থাকেন হিন্দু সম্প্রদায়। কিন্ত সাজসজ্জা , সাউন্ড , লাইটিং এর কাজে নিয়োজিত থাকে অন্য সম্প্রদায়। সবাইকে নিয়ে কাজ করার এক শিক্ষা মাতৃপূজা পেয়ে থাকি।
সুর অসুরের সংঘাত আমরা প্রতিনিয়ত পরিলক্ষিত করছি। এই সংঘাত আমরা দেখি মাতৃ পূজার কাঠামো বিন্যাসে। দেবতারা শুদ্ধ শক্তিতে শক্তিমান ছিল। কিন্তু তারা তা ভুলে গিয়েছিল। যার কারণে তাঁদের উপর পরীক্ষা নেমে আসে। দেবতাগণ অসুর কর্তৃক পরাজিত হয়ে রাজ্য হারা হন। রাজ্যচ্যুত দেবতাগণের সম্মিলিত প্রার্থনার ফল হিসেবে মা দুর্গার শুভাগমন।সর্বমঙ্গলা মা দুর্গার কাছে জগতকে যিনি উগ্রভাবে কামনা করতেন তার প্রতীক মহিষাসুর পরাজিত হন। মহিষাসুর নারীরূপী মহাশক্তি দেবীকে ভোগ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। উক্ত ভোগেচ্ছা অসুরের পরাজয়ের আরেকটি কারণ। আমরা ও বাস্তব জীবনে যদি শুভ শক্তির মিলন ঘটাতে পারি তাহলে সকল অশুভ অহংকারী শক্তি আমাদের পদানত হবে। দেবী দুর্গা শুধু মুর্তিতে অথবা মন্দিরে নন। তিনি সর্বত্র বিরাজিতা। মায়ের পূজার উপকরণের দিকে থাকালেও সম্মিলিত সমাজ সৃষ্টির আরেকটি শিক্ষা আমরা পেয়ে থাকি।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়
যে ঐক্য , সম্প্রীতির বন্ধনে
সমৃদ্ধ হওয়ার মানসে আমরা মায়ের পূজা করি সেই ঐক্য আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পারছি। মাতৃপূজা
নারী জাতিকে সম্মান জানানোর শিক্ষা প্রদান করে। একদিকে ভোগবাদী কিছু মানুষের অতি বাড়াবাড়ির
কারণে সভ্রম হারাচ্ছে নারী জাতির বিশাল অংশ। অন্যদিকে উগ্রবাদী কিছু মানুষের কাছে পরাজিত
হচ্ছে আমাদের মানবতা। বিভিন্ন জায়গায় চলছে ধর্মের নামে অধর্ম , পূজার নামে ব্যবসায় , ত্যাগের বহিরাবরণে চলছে বিলাস সামগ্রীর আধিক্য।
অনেক টাকা খরচ করে মায়ের পূজা করছি মায়ের কৃপা লাভ করার জন্য। কিন্তু মায়ের কৃপা পাওয়ার
আরেকটি বড় উপকরণ ঘরের মাকে সঠিকভাবে শ্রদ্ধা করছি কিনা সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে
হবে। একে অপরের সাথে মহামিলনের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি। সমস্থ অশুভ শক্তির পরাজয়ের মাধ্যমে
শুভ শক্তির জয় হোক। পূজার সার্থকতা আরো বেশি করে আমাদের সামনে আসবে যদি আমরা মাতৃজাতির
উপর সঠিক সম্মাননা জানাতে পারি।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment