1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

উত্তরাধিকারী


 উত্তরাধিকারী  
 উত্তম চক্রবর্তী

ll এক ll                                                              
কলকাতায় নাকি এখন ১৩ ডিগ্রী চলছে। ঠাণ্ডায় সবার হাত পা জমে যাচ্ছে একেবারে। এই বয়সে শীতে একজন বৃদ্ধা মহিলার যে কত কষ্ট হয় সেটা ছেষট্টি পার করা মৃণালিনী সেন বেশ ভালই জানেন। সকালে বিছানা থেকে, কম্বলের নিচে যখন হাত পা তখনও বেশ গরম, তখন কি আর মাটিতে পা ফেলতে চায় কেউ। যদিও ঘরের মধ্যে চটি পরে হাঁটা চলার অভ্যাস অনেকদিনের। কিন্তু শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠতেই আর ইচ্ছা করে না যেন। কিন্তু উপায় নেই, ঠিক আটটার সময় শান্তি, মানে মৃণালিনী দেবির রান্নার মহিলা এসে হাজির হবে আর দরজা না খোলা পর্যন্ত সমানে কলিং বেল টিপতে থাকবে। শান্তি তো না, এখন মৃণালিনী দেবীর এই হয়েছে এক অশান্তি।

মৃণালিনী সেন ওঁর পাইক পাড়ার এই এতো বড় বাড়িতে দোতলায় একাই থাকেন । নিচের তলায় একটা অফসেট প্রিন্টিং প্রেসকে ভাড়া দেওয়া আছে। এই প্রেস থেকে বই ছাড়াও ছাপা হয় কলকাতার বিখ্যাত মহিলা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘তিলোত্তমা’ আর শিশু ও কিশোরদের মাসিক পত্রিকা ‘হৈ চই’। দুটো শিফটে প্রায় তিরিশ জন কাজ করে এই প্রেসটাতে। মৃণালিনী সেনের স্বর্গত স্বামী পিনাকি সেন আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগে নিচের অংশটা ঐ প্রেসকে ভাড়া দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক উত্তরাধিকার সুত্রে বাবার তৈরি করা এই বিশাল সম্পত্তি পেয়েছিলেন উত্তর কলকাতার বুকে এতো জমজমাট এলাকায়। আজ নাহলেও ছয় কাঠা জমির উপর তৈরি এই আড়াই হাজার স্কয়ার ফুট সম্পত্তির মুল্য কমপক্ষে তিন কোটি টাকা বা তার চেয়েও বেশি। পঞ্চাশ বছরের পুরানো এই বাড়িটার উপর তাই অনেক প্রমোটারের নজর রয়েছে।      

পিনাকি সেন নিজে ছিলেন এয়ার ফোর্সে। জম্মু, গৌহাটি, হাইদ্রাবাদ, কানপুর হয়ে শেষে অবসরের আগে পোস্টিঙে ছিলেন দিল্লিতে। সেই সময় বাবা মা ছিলেন এই বাড়িতে আর নিচে দুই ঘর ভাড়াটে। গৌহাটি থাকতেই এক পরিচিত অসমিয়া পরিবারের মেয়ে মৃণালিনী গোগইকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন পিনাকি। বিয়ের দুই বছর বাদে হয় ওদের একটা মাত্র ছেলে পল্লব সেন। কিছুদিন বাদে পুরী থেকে ফেরার পথে একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে পিনাকির বাবা মা দুজনেই মারা যান। পিনাকি তার পরেই উপরের ওদের ফ্ল্যাটখানা ভাড়ায় দিয়ে বাইরে চাকরি করতে থাকেন। এরপর দিল্লি থেকে  রিটায়ার করে ওপরের ফ্ল্যাটের ভাড়াটে তুলে দিয়ে ঘরদোর রঙ চং করিয়ে বরাবরের মত কলকাতায় চলে আসেন।

দিল্লিতে বারো ক্লাস পাশ করে পল্লব দেরাদুন চলে যায়। সেখানে মিলিটারি একাডেমী থেকে পাশ করে বাবার মতই এয়ার ফোর্সে চাকরী পেয়ে যায় পল্লব। শ্রীনগরে পোস্টিং পেয়ে সিমলা থেকে গত মাসেই সিফট করেছে সেখানে। পিনাকি সেন চৌষট্টি বছর বয়সে হার্ট ফেল করে মারা যান পল্লবের বিয়ের ঠিক এক বছর বাদে। সেই থেকেই বিধবা মৃণালিনী সেন এই এতো বড় বাড়িতে একা থাকেন। পল্লব ও তার স্ত্রী শ্রেয়া মৃণালিনী দেবীকে অনেক অনুরোধ করেও নিজেদের সাথে সিমলা নিয়ে যেতে পারে নি। ওঁর একই কথা, যেই বাড়িতে ওঁর স্বামী মারা গেছেন, সেই বাড়িতেই উনি দেহ রাখবেন। পল্লব সেন বাবা মার পছন্দ করা দিল্লির মেয়ে শ্রেয়া সান্যালকে বিয়ে করেছিল তিন বছর আগে। শ্রেয়া দিল্লি ইউনিভারসিটি থেকে বায়ওলোজিতে এম এস সি পাশ করেছে। ওর বাবা ছিলেন পল্লবের বাবা পিনাকির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনে একসাথে জম্মুতে ছিলেন প্রায় চার বছর। সেই থেকেই ছিল ওঁদের বন্ধুত্ব। শ্রেয়া বিয়ের আগে কয়েকবার দেখেছিল পল্লবকে। নিজে খুব প্ল্যান করে জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পল্লবের সাথেই যে বাবা মা বিয়ের কথা প্ল্যান রেখেছেন সেটা জানত না। শ্রেয়া মনে মনে ভেবেছিল ওর এক আই পি এস পাশ করা পাঞ্জাবি বন্ধু জিতুকে জীবন সাথী হিসাবে বেছে নেবে। কিন্তু জীবনের এই একটা প্ল্যান ওর কাজ করল না।  ওর এক্স মিলিটারি বাবা মৃত্যু শয্যায় শ্রেয়াকে জানান তার শেষ ইচ্ছা। মেয়ের কাছ থেকে কথা নিয়ে বরাবরের মত চোখ বোজেন শ্রেয়ার বাবা। শ্রেয়া বাধ্য হয়ে রাজি হয় এই বিয়েতে।   

শ্রেয়া সেন পল্লবের সাথে বিয়ের পর একদম বদলে যায়। পল্লব ভীষণ হাসিখুশি জলি টাইপের ছেলে। দেখতেও ভীষণ হ্যান্ডসাম, লম্বায় প্রায় ছ ফুট, ফর্সা, জিম করা স্বাস্থ্য, তার উপর ফোর্সের রেগুলার ফিসিকাল এক্সারসাইস তো আছেই। পল্লবের সবচেয়ে বেশি যেই জিনিষটা শ্রেয়ার ভালো লাগে সেটা হল ওর মধ্যে একটা ছেলে মানুষী ভাব আর সাথে অসম্ভব রোমানটিসিসম আছে। এছাড়াও পল্লব ভীষণ সৎ ও সভ্য ছেলে। শ্রেয়া আজ পর্যন্ত ওর মধ্যে কোন চারিত্রিক দোষ খুঁজে পায়নি। পল্লব তার আদর যত্ন আর ভলোবাসা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছে ওর সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী শ্রেয়ার জীবন। ওরা দুজন দুজনকে পেয়ে সুখের সাগরে ভাসতে থাকে।

পল্লব কোনদিন শ্রেয়াকে নিয়ে কলকাতার বাড়িতে আসেনি। মেয়ের বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী দিল্লিতে একটা বাসা ভাড়া করে মা বাবা ও কলকাতার কিছু বন্ধুকে নিয়ে এসে পল্লব ও শ্রেয়ার দুই হাত এক করা হয়। মৃণালিনী দেবীও বৌমাকে কলকাতায় ওঁর বাড়িতে আনতে পারেন নি। এমনকি কয়েক বছর আগে পিনাকি সেনের মৃত্যুর পরেও শ্রেয়া ওর শ্বশুর বাড়িতে আসতে পারেনি। কারন সেই সময় পাকিস্তান বর্ডারে ঝামেলা চলছিল বলে পল্লবকে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। ও নিজেও বাবার শেষ কাজে যেতে পারে নি। যদিও পরে নিজে এক দিনের জন্য এসে আবার ফিরে যায় সিমলায়। শ্রীনগরে পোস্টিং হবার পর পল্লবের সপরিবারে কলকাতা যাওয়া দুবার প্ল্যান করেও হয়ে উঠতে পারে নি।

ছেলে ও ছেলের বৌয়ের সাথে প্রায় রোজই ফোনে কথা হত মৃণালিনী দেবীর। বাড়িতে ঝি চাকর সবই আছে। বৌমার সাথে তারা সবাই ঠিকমত কাজ করছে কিনা, কী রান্না হয়েছে, বাড়িতে কোনরকম অসুবিধা হচ্ছে কিনা এসব কথাই হত বেশির ভাগ সময়। বৌমাকে একদিন ফোনে মৃণালিনী দেবী জানালেন যে ওঁর শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। এবার ওদের একটা সন্তান হলে তার মুখ দেখে শান্তিতে চোখ বুজতে পারবেন উনি। পল্লবের আর শ্রেয়ার সন্তান হবে এই সেন বংশের প্রদীপ, তার মুখ দেখে আশীর্বাদ না করে মৃণালিনী দেবী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারছেন না।

সেই রাতেই বিছানায় শুয়ে পল্লবকে কথাটা জানাল শ্রেয়া। পল্লব মায়ের ইচ্ছাটা শুনে বেশ গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ’এই ব্যাপারে তোমার কী প্ল্যান বল আগে শুনি। মা তো চাইবেনই, ওঁরও তো বয়স বাড়ছে তাই না ? কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু আমাদের ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা, তোমার ইচ্ছাটা কী সেটা জানা আগে খুব জরুরী। সত্যি কথা বলতে আমি এখন এই নিয়ে কিছুই ভাবিনি। ভালো করেছ কথাটা তুলে। লেট আস টেক এ ডিসিশন রিগারডিং আওয়ার চাইল্ড নাউ। 

শ্রেয়ার বয়স এখন মাত্র ছাব্বিশ, পল্লবের ত্রিশ। শ্রেয়া আগে থেকেই মনে মনে ভেবে রেখেছিল যে ও তিরিশ বত্রিশ বছরের আগে মা হতে চায়না। কিন্তু এই নিয়ে পল্লবের সাথে ওর কোন আলোচনা হয়নি কোনদিন। পল্লবের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে আদুরে গলায় শ্রেয়া বলল,’কিছু মনে করোনা সোনা, আমি কিন্তু এখনই মা হতে চাই না। একবার বাচ্চা কাচ্চা হয়ে যাওয়া মানে আমাদের জীবন ধারা একদম বদলে যাবে। সো লেট আস এঞ্জয় দিস লাইফ এট লিস্ট ফিউ মোর ইয়ার্স, দেন উই উইল হ্যাভ আ বেবি। তুমি কী বলো সোনা ? আমি কি কিছু ভুল বললাম, বলোনা।‘

পল্লব নিজেও এরকম একটা কথা ভাবছিল। কিন্তু মায়ের কথা মনে করে ওঁর মনটা অশান্ত হয়ে উঠছিল। শত হলেও পল্লবের ঘরেই তো আসবে সেন বংশের উত্তরাধিকারী। কিন্তু এই ছাব্বিশ বছরের পরিপূর্ণা যুবতী ওর স্ত্রী শ্রেয়াকে ও রাজি করাবেই বা কিভাবে ? ওর যুক্তিটাও তো একদম ফেলনা নয়। সবারই তো একটা ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে। শ্রেয়া যদি চায় আরও তিন চার বছর এইভাবে ঝাড়া হাত পা নিয়ে স্বামী স্ত্রীতে মিলে জীবনটাকে সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে, তাহলে ওকে বাধা দিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা ভুল বোঝা বুঝি আর অশান্তি ডেকে আনার কোন মানে হয় না। পল্লব ফিস ফিস করে জবাব দেয়,’ঠিক আছে শ্রেয়া। তুমি যেরকম চাইবে ঠিক তাই হবে। চিন্তা করোনা। আমি মার সাথে কথা বলব।‘ 

শ্রেয়া সেন পল্লবকে ভীষণ ভালোবাসে। ওর জীবনে বিয়ের আগে ওর পাঞ্জাবি বন্ধু সেই জিতুর যতটুকু প্রভাব ছিল, পল্লবের উজার করা ভালোবাসা সেসব ওকে ভুলিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। সেই রাতে শ্রেয়া যতই পল্লবকে বলুক আরও কয়েক বছর বাদে ও বাচ্চা নেবে, পল্লবের চাকরীর কথা, ওর জীবনের ঝুঁকির কথা ভেবে ভেবে শ্রেয়া খুব দুশ্চিন্তায় পরে গেল। ভাবে পল্লবের যদি কিছু হয়ে যায় তখন ওর কি হবে, ওর মাকে ও বংশধর দেবে কোথা থেকে। তার উপর পল্লবের পোস্টিং এখন শ্রীনগরে। যখন তখন বর্ডারের ওপার থেকে শ্রীনগরকে টার্গেট করে মিসাইল ছোড়া হয়। কোনদিন একটা অঘটন ঘটে যাবে কে জানে ? তখন ওর একুল ওকুল দুকুল যাবে।

শ্রেয়া বায়ওলোজি নিয়ে এম এস সি করেছে। অনেক চিন্তা করে ঠিক করল পল্লবের সাথে আলোচনা করে ও যদি রাজি থাকে তবে আই ভি এফ (ইন ভিট্রো ফারটিলাইজেসন ) পদ্ধতিতে ওর স্পারম কালেক্ট করে স্পারম ব্যাঙ্কে রাখতে হবে এখন, যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে ফ্রজেন এম্ব্রাও ট্রান্সফার করে সময় মত প্রেগনেন্সি নেওয়া যায়। ইন্টারনেট ঘেঁটে আই ভি এফ এর ব্যাপারে আরও খোঁজ খবর নিয়ে শ্রেয়া এক ছুটির রাতে খুব ঘনিষ্ঠ এক মুহূর্তে ওর সোনা পল্লবের বুকে মুখ গুঁজে কথাটা পারল। পল্লবকে বলল, ’দেখ, তোমার যেই চাকরী তাতে আমি সব সময়ই আতঙ্কে দিন কাটাই। এদিকে আমি মনে প্রানে চাই আমি শুধু মাত্র তোমার সন্তানকেই আমার গর্ভে ধারণ করি। সুতরাং আমি চাই তোমার স্পারম ফ্রজেন করে রাখতে ভবিষ্যতের কথা ভেবে।‘

পল্লব জানে শ্রেয়া বায়ওলোজির ছাত্রী ছিল। এই সব আধুনিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ওর অনেক বেশি জ্ঞ্যান এবং কথাটা ও খুব একটা খারাপ কিছু বলেনি। সত্যিই তো, মা সেদিন ওকে ওদের সন্তানের কথা বলায় শ্রেয়া স্বাভাবিক ভাবেই সাপ ও মরবে লাঠিও ভাঙবে না, এরকম একটা উপায়ের কথা ভেবে রেখেছে। পল্লব মনে মনে শ্রেয়ার বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না। এদিকে ওর যে ধরনের রিস্কের চাকরী তাতে আজ না হয় ও জীবিত আছে, কাল কী হবে তার কি কোন গ্যারান্টি আছে ? আর এই কারনেই শ্রেয়া ওর ভবিষ্যৎ সন্তানের বাবা এখন থেকেই ঠিক করে রাখতে চাইছে। তাতে যদি ভগবান না করে ওর কিছু হয়েও যায়, তবুও পরে কোন একসময় শ্রেয়া ওর গর্ভে পল্লবের সন্তান ধারন করতে পারে। বিদেশে নাকি অনেকেই এইভাবে তাদের বংশধরদের সময়ের ফ্রেমে বেধে রাখে আজকাল।                                                                         

পল্লবের অনুমতি পেয়ে পরদিন বেলার দিকে ফোন করে তার পরের দিন সকাল দশটায় শ্রীনগরের রেমিনার হামজা কলোনিতে,  মেড এজ ইনফারটাইলিটি সেন্টার এন্ড গাইনি সল্যুশন হসপিটালে শ্রেয়া পল্লবের নামে একটা এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিল। এই হাসপাতালের নাম শ্রেয়া আগেও ওর  শ্রীনগরেরই এক বান্ধবীর কাছে শুনেছিল। পল্লবকে  ফোন করে জানিয়ে দিয়ে বলে দিল পরদিন ছুটি নিয়ে নিতে। সেই অনুযায়ী মঙ্গলবার সকালেই দুজন গিয়ে হাজির হল মেড এজ হাসপাতালে।    

ডাক্তার ভদ্রলোক বয়স্ক এবং যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ওদের দুজনের পরিকল্পনার কথা শুনে বিস্তৃত ভাবে ওদের জানালেন যে আই ভি এফ পদ্ধতিতে পল্লবের স্পারম কালেক্ট করে ফ্রজেন করে প্রায় দশ বছর পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। এই স্পারম কালেকশনের জন্য পল্লবকে কিছু ওষুধ খেতে হবে, বারবার ব্লাড টেস্ট ইত্যাদি করাতে হবে, এবং প্রায় চোদ্দ পনের দিনে বেশ কয়েক বার এই হাসপাতালে এসে ওকে স্পারম দিয়ে তার পরিক্ষা করবার জন্য সাহায্য করতে হবে। ফাইনাল স্টেজে কিছু সবল সক্ষম স্পারম ফ্রজেন করে রাখা হবে এবং তার রেজিস্ট্রেশন কার্ড ইত্যাদি ওদের দেওয়া হবে ভবিষ্যতের প্রয়োজনের জন্য।

যদিও খরচটা বেশ ভালই হবে, কিন্তু পল্লব এই পদ্ধতিতে ওর সন্তানের জন্য স্পারম জমা করবার প্রসেসে রাজি হয়ে গেল। পরবর্তী দুই সপ্তাহে পল্লব তার ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য মেড এজ হাসপাতালে দৌড়া দৌড়ী করে ওর স্পারমের ফ্রজেন এম্ব্রাও ট্রান্সফারের পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলল। শ্রেয়া ভীষণ খুশি।  পল্লবকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলল। এখন ওর মত সুখী বোধ হয় আর কেউ নেই এই দুনিয়াতে।

মানুষ জন্মাবার পর তার জীবনকে নিজের ইচ্ছামত চালিয়ে যাবার চেষ্টা করে ঠিকই কিন্তু ভবিতব্য বলে একটা কথা আছে সেটা তো মানতেই হবে। শ্রেয়া ফোনে দিল্লীতে ওর মাকে সমস্ত জানিয়ে রাখল। শ্রেয়ার ছোট ভাই হেমন্তের বিয়ে পরের মাসে। পল্লব কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছিল। শ্রেয়া আর পল্লব হেমন্তর বিয়ে উপলক্ষে দুদিন আগেই চলে এলো শ্রীনগর থেকে। ওদের চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িতে বেশ ধুম ধাম করেই শ্রেয়ার ভাই হেমন্তর বিয়ে হয়ে গেল ময়ুর বিহারের মেয়ে জুঁই দাশগুপ্তর সাথে। বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে। বাবার কনট প্লেসে জুতার দোকান আছে আর ময়ুর বিহারে নিজেদের বেশ বড় ফ্ল্যাট।

হেমন্তর বিয়ে সেরে পল্লব আবার ওর চাকরী আর অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এদিকে মাস কয়েক বাদেই কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে গেল। পল্লব এখন ওদের অবন্তি পুরা এয়ারপোর্ট স্টেশনে ডিউটি করছে। ওর শ্রী নগরের এয়ার ফোর্স কোয়ার্টারে শ্রেয়া একা। হেমন্ত আর নব বিবাহিতা স্ত্রী জুঁই এসে কাস্মীরে দিদির বাড়িতে থেকে গেল কয়দিন। ওদের নিয়ে কয়েকদিন বেশ আনন্দেই কেটে গেল শ্রেয়ার। পল্লব রোজ রাতেই ফোনে শালা আর শালার স্ত্রীর সাথে বেশ ইয়ার্কি ফাজলামি করতে ভোলেনা। আর এরপর হেমন্ত আর জুঁই দিল্লি ফিরে যাবার তিন দিন বাদেই পাকিস্তানের বর্ডারের ওপার থেকে মিসাইল আক্রমন হল অবন্তি পুরা এয়ারপোর্ট কোয়ার্টারের উপর। পল্লব সাহ মোট সাতজন জওয়ান শহীদ হল উগ্রপন্থীদের এই আক্রমনে। পরদিন বিকেলে হতভাগিনী শ্রেয়া শ্রীনগরের মিলিটারি বেসে পল্লবের ক্ষতবিক্ষত মরদেহে সাদা ফুলের মালা অর্পণ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল ওর বান্ধবীর বুকে।                                         

শ্রেয়ার স্বামী পল্লব আর নেই শুনে সেই রাতেই দিল্লি থেকে উড়ে এসেছিল হেমন্ত। এয়ার ফোর্সের অফিসে যোগাযোগ করে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের পরামর্শে শ্রেয়ার জন্য দিল্লীতে এয়ার ফোর্স স্কুলে একটা টিচারির চাকরীর পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলল হেমন্ত। চারদিন বাদে শ্রেয়াকে নিয়ে শ্রী নগরের কোয়ার্টার ছেড়ে দিল্লীতে চলে গেল হেমন্ত। পল্লবের জামা কাপড় বই ইত্যদি সমস্ত কিছুই সুটকেসে ভরে নিয়ে গেল শ্রেয়া। পিছনে পড়ে রইল শুধু ওর সুখের মুহূর্তগুলির স্মৃতি আর মেড এজ হাসপাতালে স্পারম ব্যাঙ্কে পল্লবের ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্য ওর রেখে যাওয়া ফ্রজেন স্পারম।

প্রথমে মায়ের কাঁধে কান্না কাটি করে কেটে গেল প্রায় এক সপ্তাহ। পল্লবের শ্রাদ্ধ শান্তিও করা হল শ্রেয়াদের চিত্ত রঞ্জন পার্কের বাড়িতে। ফোনে শ্রেয়ার কাছে একমাত্র ছেলের এইভাবে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে কলকাতার বাড়িতে দুঃখে কষ্টে একা একাই কাঁদতে থাকেন হতভাগিনী মৃণালিনী দেবী। শ্রেয়া অনেকবার চাইলেও শাশুড়ি কিছুতেই ছেলের শেষ কাজে দিল্লীতে আসতে রাজি হলেন না। ভাবলেন এখন আর গিয়ে কি হবে, পল্লবকে তো আর বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেননা মৃণালিনী, হতভাগিনী মা।

যদিও শাশুড়ি মা ওকে অনেকবার কলকাতায় চলে আসতে বললেন, কিন্তু শ্রেয়া কলকাতায় যেতে রাজি হল না। শ্রেয়া ভাবে ওর স্বামীর জীবদ্দশায় যখন ও শ্বশুর বাড়িতে কোনদিন প্রবেশই করতে পারে নি, তখন পল্লবের অবর্তমানে এভাবে বিধবা সেজে আরেক বিধবার ঘাড়ে গিয়ে বসার কোন মানে হয় না। তার চেয়ে শ্রেয়া দিল্লীতেই টিচারির চাকরী করে পল্লবের মাকে প্রতি মাসে টাকা পাঠাবে যাতে ওর সাথে সম্পর্কটা কোন দিন নষ্ট না হয়ে যায়। যদিও শ্বশুর মশাইয়ের পেন্সন ও বাড়ি ভাড়ায় মৃণালিনী দেবীর কোন আর্থিক অনটন নেই শ্রেয়া জানে। কিন্তু একমাত্র ছেলের বিধবা স্ত্রী হিসাবে শ্রেয়া ওর কর্তব্য করে যাবে। তাতে উপর থেকে পল্লবের আত্মা অন্তত শান্তি পাবে।  

 

ll দুই ll                                                            

দুইমাস বাদে প্রথম মানি অর্ডারে পাঁচ হাজার টাকা হাতে পেয়েই বৌমাকে ফোন করলেন মৃণালিনী দেবী। কেমন আছ , স্কুলের চাকরীতে কেমন লাগছে ইত্যাদি কথা বার্তা সেরে মৃণালিনী দেবী শ্রেয়াকে জানিয়ে দিলেন ওঁর শ্বশুরের পেন্সন ও বাড়ি ভাড়ায় বেশ চলে যাচ্ছে। শ্রেয়া যেন ওঁকে আর টাকা পয়সা না পাঠায়। পারলে টাকা জমাক। ভবিষ্যতে অন্য কোন কাজে লাগবে। শাশুড়ি টাকা পাঠাতে মানা করায় শ্রেয়া মনে মনে খুব দুঃখ পেলেও চুপচাপ মেনে নেয় ওঁর আদেশ।

দেখতে দেখতে আরও আড়াই বছর কেটে গেছে। শ্রেয়া রঙিন শাড়ী কাপড় পরে, বাইরে বের হয়,  জীবনের লড়াইয়ে এগিয়ে চলেছে। এখন রীতিমত ব্যস্ত ওর স্কুল এবং ছাত্রীদের নিয়ে। বেশ একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে ওর। নিজের মা ভাই আর ভাইয়ের পরিবারের সাথে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে পল্লবের অভাবটা অনেকটা সহ্য হয়ে গেছে শ্রেয়ার। সারা জীবন প্রতিটা পদক্ষেপ শ্রেয়ার মেপে মেপে এগিয়ে চলা। যদিও ওর বিয়ের ব্যাপারটায় শুধু ওকে বাবার জন্য কম্প্রমাইস করতে হয়েছিল, কিন্তু পল্লবের ভালোবাসা ওর মনের সব দুঃখ অচিরেই ঘুচিয়ে দিয়ে ওকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল। তাই শ্রেয়া পল্লবের মত চরীত্রবান সভ্য ভদ্র স্বামীর সন্তানকে গর্ভে ধরবার পরিকল্পনা করে রেখেছিল পল্লবের জীবদ্দশায় এবং সেই মত ওর স্পারম কাশ্মীরের হাসপাতালে জমা করে রেখেছিল। পল্লব আজ নেই, কিন্তু ওর সন্তানের স্পারম রয়ে গেছে যাকে শ্রেয়া এবার গর্ভে ধরবে ঠিক করল।

হেমন্ত আর জুঁই ওদের সন্তান এখনি নিতে চায়না দিদিকে জানিয়ে দিয়েছিল। পল্লব মারা যাবার চার বছর বাদে মার সাথে পরামর্শ করে শ্রেয়া একা একাই  স্কুলের ছুটিতে শ্রীনগরে চলে গেল এক সপ্তাহের জন্য। ওর ভাই সাথে যেতে চাইলেও শ্রেয়া ওকে বুঝিয়ে বলে এই কারনে শুধু শুধু ভাইয়ের যাবার দরকার নেই। হেমন্ত এবং জুঁই জানত যে শ্রেয়া প্ললবের সন্তানের জন্য আই ভি এফ পদ্ধতিতে পল্লবের স্পারম জমা করে রেখেছে যাতে সেই স্পারমের ফ্রজেন এম্ব্রাও ট্রান্সফারের মাধ্যমে শ্রেয়া একদিন পল্লবের সন্তানের মা হতে পারে। শ্রেয়া ওর শাশুড়িকে তাদের বংশধর দিতে পারে।

শ্রেয়া হাসপাতালের দেওয়া সার্টিফিকেট ও অন্যন্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সাথে নিয়ে মেড এজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা করল। এই পদ্ধতিতে ওর প্রেগনেন্সি কনফার্ম করবার জন্য শ্রীনগরে  সাত  দিনের জায়গায় পনের দিন থাকতে হল শ্রেয়াকে। ডাক্তাররা ওকে গ্রীন সিগনাল দেবার পরের দিন দিল্লী ফিরে এলো শ্রেয়া। মেড এজ হাসপাতালের ডাক্তাররা পল্লবের রেখে যাওয়া ডিম্বাণু সাক্সেস্ফুলি শ্রেয়ার জঠরে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছেন এবং শ্রেয়ার গর্ভে ওর সন্তানের প্রান সঞ্চার শুরু হয়ে গেছে। শ্রেয়াকে এখন দিল্লির মেড এজ হাসপাতালে ওদের পরামর্শ মত চলতে হবে এবং সময়ে সময়ে চেক আপ করাতে হবে। শ্রেয়ার পরিকল্পনা মত পল্লবের সন্তান আসছে এই পৃথিবীতে শুনে আনন্দে কেঁদে ফেললেন শ্রেয়ার বিধবা মা ও ভাই। জুঁইও কেঁদে ফেলে জামাই দাদার কথা চিন্তা করে।

নয় মাস দেখতে দেখতে কেটে গেছে। শ্রেয়া ভগবানের আশীর্বাদে শীতের এক ভোরবেলা দিল্লির মেড এজ হাসপাতালে একটা ফুট ফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। আনন্দে ভেসে গেল শ্রেয়ার পরিবারের সবাই। শ্রেয়া পল্লবের নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখল বিপ্লব, বিপ্লব সেন। হাসপাতাল থেকে শ্রেয়াকে ওর সন্তানের জন্ম বৃত্তান্ত লিখে বাবা মার নাম লিখে বার্থ সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। শ্রেয়া সজত্নে সেই সার্টিফিকেট রেখে দেয় নিজের কাছে। দিল্লীতে চিত্তরঞ্জন পার্কে শ্রেয়াদের প্রতিবেশীরা ওর মার কাছ থেকে সব শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। শ্রেয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে সবাই। একজন দেশভক্ত শহীদের স্ত্রী হিসাবে শ্রেয়া এবং শাশুড়ি হিসাবে ওর মা গর্বে ফুলে ওঠেন।

শ্রেয়া এবার ফোন করে সমস্ত খবর জানাল ওর শাশুড়ি মাকে, মানে মৃণালিনী দেবীকে। কিন্তু মৃণালিনী দেবী কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না শ্রেয়া ওরই ছেলে পল্লবের সন্তানকে এতো বছর বাদে জন্ম দিয়েছে। এটা যে সম্ভব সেটা শ্রেয়ার শাশুড়ি মা মানতেই পারলেন না। উল্টে মনে মনে শ্রেয়াকে চরিত্রহীন ভেবে বসলেন এবং পরিস্কার জানিয়ে দিলেন যে এই সন্তানকে উনি কোনদিন মেনে নিতে পারবেন না। ওর একমাত্র ছেলে পল্লবই যখন আর নেই তখন এই এতদিন বাদে কার না কার সন্তানকে উনি নাতির জায়গায় বসাতে পারবেন না। আর বৌমা যখন এতদিন কলকাতায় শাশুড়িকে দেখতেও আসতে পারে নি তবে আর ওকে এই বাড়িতে এসে আদিখ্যাতা করতে হবেনা। উনি একা ছিলেন, একা আছেন এবং একাই থাকবেন। শ্রেয়া বেশ বুঝতে পারে যে ওর এই একটা পরিকল্পনা এখন অবধি ঠিকমত কাজ করল না। এই সন্তানকে তার পৈতৃক পরিবারের পরিচয় থেকে আপাতত বঞ্চিত থাকতে হবে।   

এদিকে মৃণালিনী দেবীর বয়স জনিত কারনে শরীরে অনেক রকম রোগ দেখা যাচ্ছে। শ্রেয়া যে এইভাবে একটা কাণ্ড করে বসবে সেটা উনি কল্পনাও করতে পারেন নি। মনে মনে পল্লবের বিধবা স্ত্রীকে বরাবরের মত বাতিলের পর্যায়ে ফেলে দিয়ে ওর কথা গুলি ভুলবার চেষ্টা করতে থাকেন। পিনাকি সেন যখন মারা গেছেন তখন ওঁর বয়স ছিল প্রায় ষাট, আর এখন সাতষট্টি। পরিবারের পুরানো ডাক্তার চ্যাটার্জি প্রায়ই এসে খোঁজ খবর নিয়ে ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। মৃণালিনী ভাবেন এইভাবেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন।

এরকমই একটা দিনে তন্ময় সেন নামের একজনকে ওর সাথে দেখা করতে উপরে নিয়ে এলো শান্তি। তন্ময়ের বয়স প্রায় আটাশ, বিয়ে সাদি করে নি। উত্তর বঙ্গের জলপাইগুড়িতে নিজেদের বাড়িতে মা বাবা আর একটা বোন আছে। গত মাসেই তন্ময় কলকাতা কর্পোরেশনের চাকরীতে ঢুকেছে। পাইক পাড়া ও শ্যামবাজার এলাকার ট্যাক্স কলেক্সন ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব তন্ময়ের। বাড়ির রাধুনি শান্তি  এসে জানাল যে এই বাবুটা ওদের দোতলায় একটা ঘর ভাড়া নিতে এসেছে। গিন্নি মার এখন শরীর দিন দিন ভেঙে যাচ্ছে। দোতলায় অনেক গুলি খালি ঘর ফাকা পড়ে আছে। এখন বাড়িতে দোতলায় একটা ভাড়া বসালে সব দিক দিয়েই ভালো। রাত বিরেতে মা ঠাকুরণকে একা থাকতে হবে না।  

তন্ময় আপাতত থাকে শ্যামবাজারের এক মেস বাড়িতে। বকেয়া ট্যাক্স আদায়ের কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  দেখতে গিয়ে পিনাকি সেনের সম্পত্তির বেশ কিছু টাকা বকেয়া আছে দেখে তন্ময় ওর সহ কর্মীর কাছে খোঁজ খবর নিতে শুরু করে। একজন কলেক্সন এজেন্ট তলব পেয়ে এসে জানাল যে বিধবা মৃণালিনী দেবীর একমাত্র ছেলে এয়ার ফোর্সে চাকরী করত। সে নাকি চার পাঁচ বছর আগে কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের আক্রমনে শহীদ হয়েছেন। আর তারপর থেকেই সেন বাড়ির ট্যাক্স জমতে শুরু করে দিয়েছে। মহিলা একা থাকেন, আর কেউ নেই যে এসব দেখবে এবং এসে ট্যাক্স মিটিয়ে দিয়ে যাবে।

তন্ময় সারারাত ভাবল মৃণালিনী দেবীর সম্পত্তির কথা। রেকর্ড বলছে এই সম্পত্তির মুল্য এখন কম করে কয়েক কোটি টাকা। প্রচুর টাকা ট্যাক্স দিতে হয় বছরে। কিন্তু এজেন্ট জানাল বিধবা ভদ্র মহিলা একা থাকেন ঐ বাড়িতে। নিচে নাকি একটা প্রেসকে ভাড়া দেওয়া আছে। তাহলে এই মহিলার অবর্তমানে কে হবে এই বিপুল সম্পত্তির মালিক ? ব্যাপারটা নিয়ে তন্ময় আরও বেশি করে খোঁজ খবর নিতে আরেক এজেন্ট দীপুকে কাজে লাগিয়ে দিল। তাকে শুধু জানাল ঐ বাড়িতে গিয়ে কর্পোরেশন থেকে এসেছি বলে ভিতরে ঢুকে মৃণালিনী দেবীর সাথে আলাপ করে ওঁর সম্পর্কে সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে আসতে।  

মৃণালিনী দেবীর বাড়ির চাকর গগন পাল নতুন এসেছে এই বাড়িতে। আগের চাকর কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে তাই রাধুনি শান্তি ওকে এনে লাগিয়ে দিয়েছে কাজে। ছেলেটার বয়স উনিশ। বাড়ি ঘর পরিস্কার রাখা, বাজার রেশন করা, ব্যাঙ্কে যাওয়া, লাইটের বিল জমা দিতে যাওয়া সব কাজই করে গগন। দীপু এসে বেলা সাড়ে বারোটায় বেল টিপতে গগন এসে দাঁড়াল দোতলায় উঠবার দরজায়। ‘কাকে চাই’ ? দরজা খুলেই হাংলা চেহারার দীপুকে জিজ্ঞাসা করে গগন। দীপু জানায় ,’আমি কলকাতা কর্পোরেশন থেকে এসেছি। বাড়ির মালিককে ডেকে দাও, কথা আছে।‘ গগন চালাক ছেলে। জিজ্ঞাসা করে,’ এখন তো কাউকে ডাকা যাবে না। কী বলবার আমাকে বলুন, আমি বলে দেব খন।‘ দীপু বুঝতে পারে এই ছোকরা ওকে ভিতরে ঢুকতেই দেবেনা। জিজ্ঞাসা করে,’ বাড়িতে কে কে থাকে ? কাউকে তো ডেকে আন। বলছি তো কথা আছে।‘ দীপু যতই আদেশের সুরে বলুক না কেন গগন পথ ছাড়ে না। বলে ওঠে,’ বললাম তো। এখন এতো বেলায় মা ঠাকরণকে বিরক্ত করা যাবে না। আমাকে বলুন কী জানতে চান।‘

দীপু সুজোগ বুঝে বলে,’ তোমার মা ঠাকরণের সাথে আর কেউ থাকে না, ছেলে মেয়ে বা অন্য কেউ ?’ গগন এবার জানিয়ে দিল মা ঠাকরণ একা বিধবা মানুষ। দুনিয়াতে ওর আর কেউ নেই। ওর ছেলে মারা যাবার পর একদম একা হয়ে গেছেন। একুল ওকুলে আর কেউ নেই ওঁর। শরীরটাও ভালো নেই। কে জানে কবে পটল তুলবে বুড়ি। দীপু মনে মনে ভাবে সাহেবকে গিয়ে এখনই সব খবর জানাতে হবে।

শান্তি এই বাবুটাকে প্রথম দেখল। উনি যে ভদ্রলোক সেটা দেখলেই চেনা যায়। অনেকদিন থেকেই মৃণালিনী দেবীকে শান্তি একটা ভাড়াটে রাখবার বুদ্ধি দিচ্ছিল। কিন্তু মৃণালিনী কথাটার কোন গুরুত্ব দেন নি। এই ভাবে হটাত একজন যুবক এসে পড়ায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। বসবার ঘরে এসে দেখলেন ওঁর পল্লবের মতই একটা যুবক ওঁকে দেখেই উঠে এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করল। মৃণালিনী আজকালকার ছেলেদের মধ্যে এই কালচার এখনো আছে ভাবতে পারেন নি। ভাল লাগল ছেলেটার সাথে কথা বলে। দক্ষীন দিকের একটা ঘরে এটাচ বাথরুম আছে। ছেলেটা একা মানুষ, বিয়ে সাদি করে নি। তার উপর ওকে জ্যাঠিমা জ্যাঠিমা ডেকে বেশ আপন করে নিল তন্ময়।

মাত্র তিন হাজার টাকায় তন্ময় মৃণালিনী দেবীর দোতলায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে নিল সেদিন। এডভান্স হিসাবে কুড়ি হাজার টাকা ক্যাশ দিয়ে দিল মৃণালিনীর হাতে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শান্তি সব দেখে শুনে খুব খুশি হয়। এই বুড়ি মানুষটার জন্য সত্যিই ওর চিন্তার শেষ নেই। এই ছেলেটা এসে থাকলে বুড়ি একটা কথা বলার লোক পাবে আর তাতেই ওঁর মানসিক আর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হবে। একা একা থেকে থেকে কেমন যেন খিট খিটে হয়ে যাচ্ছিল আজকাল। ভালই হল, এবার নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।

তন্ময় লম্বা রেসের ঘোড়া। ওর মাথায় অনেক কিছু প্ল্যান নিয়ে ঢুকেছে এই বাড়িতে। মৃণালিনী দেবীকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলা ওর প্রথম টার্গেট। সেই মত জেঠিমার সাথে রোজ রাতে অফিস ফেরত অনেক গল্প গুজব করা শুরু করল প্রথমে। ওর বাড়ির কথা, ওর বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন সেই গল্প করা, ওর বোনের কথা, মায়ের কথা সব বলল ধীরে ধীরে। এরপর একদিন জিজ্ঞাসা করল মৃণালিনীর ছেলের কথা। এয়ার ফোর্সে থাকতে শ্রীনগরে মিসাইল এটাকে মারা গেছে শুনে দুঃখ প্রকাশ করল তন্ময়। পিনাকি বাবুর কথা এবং ছেলের কাহিনী শুনল ঠিকই, কিন্তু বিধবা বৌমার এরপর কি হল সেটা বুড়ি আর জানালেন না। সে নাকি দিল্লীতে মা ও ভাইয়ের সাথেই থাকে। পল্লবের কোন বাচ্চা কাচ্চা ছিলনা সেটা আগেই শুনেছে।

ধীরে ধীরে মৃণালিনী একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন। তন্ময় ওকে ট্যাক্সি করে একদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দির, একদিন কালীঘাটের মন্দির ঘুরিয়ে আনল। রাস্তা ঘাটে পাড়ায় এমনকি নিচের প্রেসের লোকজনকেও তন্ময় বলে মৃণালিনী দেবী ওর জেঠিমা হন। মৃণালিনী দেবী ছেলেটার এই ব্যবহারে বেশ খুশি হলেন। আগে তন্ময় বাইরে থেকে খাবার কিনে খেত। এখন শান্তিকে বলে দিলেন তন্ময়ের জন্যেও রান্না করতে। স্বাভাবিক ভাবে তন্ময় হয়ে উঠল সেন পরিবারের একজন। গগন আর শান্তি ছাড়া সবাই জানল তন্ময় মৃণালিনী দেবীর দেওরের ছেলে, জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে।   

তন্ময় এরপর সবচেয়ে আগে যেটা করল সেটা হল গগন কে এক সামান্য অজুহাতে তাড়িয়ে দিয়ে পরদিন ওর অফিসের এক সহকর্মীর সাহায্যে ডায়মণ্ড হারবার থেকে একটা গ্রামের ছেলেকে চাকর হিসাবে নিয়ে এসে কাজে লাগিয়ে দিল। শান্তি বা মৃণালিনী তন্ময়ের কথার প্রভাবে ওকেই বিশ্বাস করে নেন। কিন্তু এই ঘটনার চার মাস বাদেই শান্তি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। তার কারণও তন্ময়। মৃণালিনীর অগোচরে তন্ময় প্রায় দিনই যুবতী শান্তিকে খারাপ খারাপ কথা বলে, শারীরিক ভাবে উৎপীড়ন করে ওকে লজ্জায় ফেলে দেয়। কৃষ্ণনগরের গ্রামের মেয়ে, কলকাতায় বস্তিতে থাকলেও ভদ্র ঘরের মেয়ে। লোক লজ্জার ভয়ে এক সকালে মৃণালিনীকে কোন কারন না দেখিয়েই কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায় শান্তি। তন্ময়ের লোক ঠিক করাই ছিল,আরেক মহিলা। এক বিধবা রাঁধুনি নির্মলা এসে কাজে যোগ দিল পরের দিন।     

ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই তন্ময়ের হাতের মুঠোয় এসে পড়লেন মৃণালিনী। কথায় কথায় আগেই জেনে নিয়েছিল পিনাকি সেন কোন উইল করে যান নি। অফিসে বড় বাবুকে ধরে ওঁর বকেয়া ট্যাক্স অর্ধেক করে মৃণালিনীর বিশ্বাস জয় করে নিতে একটুও দেড়ি করল না তন্ময়। মৃণালিনী এখন ব্যাঙ্কের কাজ কর্ম সবই তন্ময়কে দিয়ে করায়। আরও তিন বছর পার হয়ে যায়। একদিন গভীর রাতে মৃণালিনী দেবী হার্ট ফেল করে চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে। তন্ময় হয়ে উঠল এই সম্পত্তির মালিক, সেনদের উত্তরাধিকারী

বিপ্লব সেনের বয়স এখন সাত। নার্সারি স্কুল শেষ করে ক্লাস ওয়ান হয়েছে। কিন্তু শ্রেয়ার ইচ্ছা ছেলেকে দার্জিলিং কনভেন্ট স্কুলে রেখে মানুষ করা। সেই অনুযায়ী কালিম্পঙে সেন্ট গ্রাহামস হোমস স্কুলে ই মেলে যোগাযোগ করে বিপ্লবকে সেখানেই ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দেবে ঠিক করল শ্রেয়া। অন লাইনে টাকা পয়সাও পেমেন্ট করে দিল আর কালিম্পঙে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটা হোটেলে চার দিনের জন্য রুম বুক করে ফেলল। এবার দার্জিলিং যাবার পথে শ্রেয়া ঠিক করে পল্লবের পাইক পাড়ার বাড়িতে শাশুড়ি মার সাথে একবার দেখা করে  তিন দিন থেকে তারপর দার্জিলিং যাবে ছেলেকে রেখে আসতে। তাতে শাশুড়ি মা হয়ত নাতিকে দেখে খুশি হবেন, রক্তের টানে তাকে বুকে টেনে নেবেন।

কিন্তু শ্রেয়া জানত না যে চার বছর আগেই পল্লবের মা মৃণালিনী দেবী পরলোক গমন করেছেন। বিপ্লব হবার খবর দেওয়ার পর থেকেই শ্রেয়ার সাথে ওর শাশুড়ির দুরত্ব এমন একটা জায়গায় চলে যায় যে প্রথমে মাসে একবার ফোন তারপর বেশ কয়েক মাস বাদে আর তারপর একেবারে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেন মৃণালিনী দেবী। এমনকি ওঁর মৃত্যুর খবরটুকু পর্যন্ত জানত না শ্রেয়া। মৃণালিনী দেবীর ফোনে নম্বর  বদলে নতুন সিম লাগিয়ে ব্যাঙ্কে জানিয়ে দেয় তন্ময়। বছর তিনেক আগে জলপাইগুড়ির এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। এখন এই সম্পত্তির মালিক সেজে পাড়ায় একজন বিশিষ্ট মানুষ হয়ে উঠেছে তন্ময়। এমন কি এতোদিনের প্রেসটা তুলে দিয়ে নিচে একটা ব্যাঙ্ককে মোটা ভাড়ায় বাড়ি ভাড়া দিয়ে রেখেছে তন্ময়।

 

ll তিন ll

দিল্লী থেকে কলকাতার ফ্লাইট ছিল বেলা নটায়। শ্রেয়া আর বিপ্লবকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে যায় হেমন্ত আর জুঁই। জুঁইয়ের একটা মেয়ে হয়েছে তিন বছর আগে। ওকে বাড়িতে শাশুড়ির কাছে রেখে  দিদি আর বিপ্লবকে বিদায় জানাতে চলে এসেছিল ওরা। চেক ইন করে ফ্লাইটে উঠে জানলার পাশে গিয়ে বসল বিপ্লব আর ফ্লাইট ছাড়বার একটু আগেই শেষ মুহূর্তে শ্রেয়ার পাশে এসে বসল ওর পুরানো বন্ধু জিতু, যাকে একদিন শ্রেয়া মনে মনে ভালবেসেছিল আর বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছিল। শ্রেয়া এতদিন বাদে জিতুকে দেখে অবাক হয়ে গেল। জিতু বসবার সময় খেয়াল করেনি, প্লেন ছাড়বার পরেই শ্রেয়া হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠে,’হাই জিতু, চিনতে পাড়ছ ?’

জিতু আই পি এস করে কলকাতা পুলিসে চাকরী পেয়ে আট বছর যাবত কলকাতায় আছে। দিল্লীতে বাবা মা ভাই ও এক বোন থাকে। তাই মাঝে মাঝে ওকে দিল্লী আসতেই হয়। এবারও সেইরকম এসেছিল ছুটিতে বাড়ি থেকে ঘুরে যেতে। শ্রেয়াকে একদম ওরই পাশে প্লেনে দেখতে পাবে জিতু ভাবতেও পারে নি। অবাক হয়ে জবাব দিল,’ আরে শ্রেয়া, তুমি এখানে ! কোথায় যাচ্ছ, কলকাতায় ? এটা কে, তোমার ছেলে নাকি ? বা বাঃ, কত দিন বাদে দেখা হল বল তো ! সেই তোমার বিয়েতে গেছিলাম, আর তারপর তো তোমার মিলিটারি বরের সাথে কোথায় উবে গেলে। তা সেই ভদ্রলোক কোথায় ?’ কথাটা বলে এদিক ওদিক তাকায় জিতু পল্লবের খোঁজে। শ্রেয়া জিতুকে জানাল ওর পিছনের গত এগারো বছরের ইতিহাস।

সেই বছর কাশ্মীরে আরও ছয়জন এয়ার ফোর্সের জওয়ানের সাথে পল্লবও মারা গেছে শুনে হতবাক হয়ে গেল জিতু। বিপ্লবের জন্মের ইতিহাস শুনে আরও স্তম্ভিত হয়ে গেল। শ্রেয়া জিতুর বোনের বন্ধু, ও যে জিতুকে মনে মনে ভালোবাসে জিতু সেটা জানত। কিন্তু পাঞ্জাবী হয়ে বাঙ্গালী মেয়ের সাথে ওর বাবা বিয়েতে কোনদিনই মত দেবে না ভেবে আর এগোয় নি। এদিকে শ্রেয়াও মুখ ফুটে কোনদিন বলেনি যে ও জিতুকে চায়। ওর বিয়ে হয়ে চলে যায়। দুজনের মধ্যে সেই শেষ দেখা আর তারপর এই আজ মেঘের কোলে। জিতু জানাল ও কলকাতায় আছে বহুদিন। সেখানে কলকাতা পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের সিনিওর অফিসার। ওর বোনের বিয়ে দু দু বার ঠিক হয়েও ভেঙে যাওয়াতে জিতু আজও বিয়ে করে নি। এবার এসে বোনের বিয়ে ফাইনাল করে গেল। সামনের শীতে ওর বিয়ে। সল্ট লেকে পোস্টিং জিতুর। পুলিস কোয়ার্টারে একাই থাকে । রান্নার লোক, কাজের লোক সব রেখে দিয়েছে। এমনিতে অন্য কোন অসুবিধা নেই ওর। শ্রেয়াকে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে বলল কলকাতায় থাকতে একদিন ছেলেকে নিয়ে ওর সাথে লাঞ্চ করতে আসে যেন। শ্রেয়া জিতুকে কথা দেয় একদিন দেখা করবে।

শ্রেয়া জানত বাড়ির নিচে একটা প্রেস আছে। ঠিকানা মিলিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ঠিক মত এসে পৌছায় পাইক পাড়ায় ওর শ্বশুর বাড়িতে। এই প্রথম আসছে এখানে। মনের মধ্যে দুরুদুরু ভাব তখন। কি জানি শাশুড়ি মা ওকে দেখে কিভাবে রিএক্ট করবে কে জানে ? দিল্লী থেকে শাশুড়ির জন্য দামী শাড়ী আর ভাল মিষ্টি নিয়ে এসেছে শ্রেয়া। কিন্তু ঠিকানা ঠিক থাকলেও কোথায় সেই প্রেস ! এতো একটা বাঙ্কের অফিস দেখা যাচ্ছে। তবুও ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে সেই ব্যাঙ্কের দারোয়ানকেই জিজ্ঞাসা করল ঠিকানাটা ঠিক আছে কিনা। দারোয়ান ঠিক আছে বলল আর সাথে দোতলায় যাবার সিঁড়িটাও দেখিয়ে দিল। শ্রেয়া সুটকেস হাতে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির ডান দিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়।   

তন্ময় তখন অফিসে। ওর স্ত্রী কমলা দরজায় বেল শুনে এসে দরজা খুলে দাড়ায়। বাড়িতে কমলা একা। চাকর আগেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন শুধু সকালে ঝি আর রান্নার লোক আসে এই বাড়িতে। কমলা এই অবেলায় কে আবার এলো বলে দেখতে এসে ভিতর থেকেই জিজ্ঞাসা করেছিল,’কে, কাকে চাই ?’ শ্রেয়া ভাবে বোধহয় কাজের মাসী, জবাবে বলে,’ আমি শ্রেয়া। দরজাটা খোল।‘

মহিলার গলার আওয়াজ শুনে কমলা দরজা খুলে আবার জিজ্ঞাস করে,’কে আপনি ? চিনলাম না তো !’

শ্রেয়া কমলাকে ঘরে পরার সাধারন শাড়ী কাপড়ে দেখে ভাবে কাজের মহিলা। শান্ত গলায় বলে,’ আমার নাম শ্রেয়া সেন, দিল্লী থেকে এসেছি। মা কোথায় ? মাকে বল গিয়ে পল্লব দাদার বৌ এসেছে তার নাতিকে সাথে নিয়ে।‘ বলে শ্রেয়া তাকিয়ে থাকে। ভাবে কথাটা শুনে কাজের মাসীটা দৌড়ে গিয়ে পল্লবের মাকে খবরখানা দেবে আর শাশুড়ি মা সব রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে এসে ওদের অভ্যর্থনা জানাবে, বিপ্লবকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। মনের মধ্যে সেই আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে শ্রেয়া। কিন্তু কথায় আছে না, অভাগা যেখানে যায় সাগর শুকায়ে যায়। কমলা অবাক হয়ে শ্রেয়া আর বিপ্লবকে দেখতে থাকে আর বলে ওঠে,’কে মা, কার মা ? আপনি কার কথা বলছেন ? ভুল করে অন্য ঠিকানায় এসে পড়েন নি তো আবার ? এখানে তো কোন মা থাকেন না।‘  

শ্রেয়া আকাশ থেকে পড়ল। অবাক হয়ে বলল,’ তার মানে ? এটাই তো মৃণালিনী সেনের বাড়ি। আমি নিচে ব্যাঙ্কে ঠিকানা কনফার্ম করেই এসেছি। তুমি ডাক , আমার শাশুড়ি মাকে ডাক একবার।‘ শ্রেয়ার গলার স্বরে বিরক্তি ফুটে ওঠে। কিন্তু কমলা আরও বেশি বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,’ আরে আরে, আপনি এখনো মাকে ডাকুন মাকে ডাকুন বলছেন কেন ? এখানে মৃণালিনী নামের কেউ থাকে না। এটা আমার স্বামী তন্ময় সেনের বাড়ি। যান আপনি নিচে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করুন। সবাই আপনাকে সেই একই কথা বলবে। আপনার কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে ম্যাডাম। যানতো, আমি দরজা বন্ধ করব, যত্ত সব।‘ শ্রেয়া হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল। দরজাটা মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেছে  তখন। বিপ্লব মায়ের আঁচল টেনে ধরে বলল ,’চলো মা, আমরা নিচে যাই।‘ শ্রেয়া পুতুলের মত নিস্তব্ধ হয়ে ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে নেমে এলো নিচে। একবার ভাবল আবার গিয়ে দরজা ধাক্কা দেবে, কিন্তু না। সেটা না করে শ্রেয়া গিয়ে ব্যাঙ্কের মানেজারের সাথে দেখা করল। ভাবল এরাই হয়ত ওকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে।

ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ভদ্রলোক বয়স্ক। মৃণালিনী সেনের নাম কোনদিন শোনেন নি। ওদের ব্যাঙ্কের এই বাড়িটার ভাড়ার এগ্রিমেন্ট হয়েছে তন্ময় সেনের সাথে। তার নামেই প্রতি মাসে চল্লিশ হাজার টাকা অন লাইনে ভাড়ার টাকা ট্রান্সফার হয় জানালেন। তবে এখানে আগে একটা প্রেস ছিল সেটা উনি কনফার্ম করে বললেন আজ পাঁচ বছর যাবত এখানে এই ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ খুলেছে। তখন থেকেই ওরা জানে তন্ময় বাবু এই বাড়ির মালিক। শ্রেয়া নিজের পরিচয় কিছু দেয়নি। শুধু মৃণালিনী দেবীর আত্মীয় সেটুকুই জানিয়েছিল। এখানে থেকে আর কোন লাভ নেই দেখে শ্রেয়া বেরিয়ে আসে। রাস্তায় এসে প্রথমেই ওর মনে হয় যার কথা সে হল জিতু। জিতু তখন কোয়ার্টারেই ছিল। শ্রেয়ার মুখে ফোনে সব শুনে ওর ঠিকানা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি নিয়ে ওর কোয়ার্টারে চলে আসতে বলে দেয়। শ্রেয়া ট্যাক্সির খোঁজে এগিয়ে যায়।

তিন দিন বাদে শিয়ালদা থেকে রাতের দার্জিলিং মেলে ওদের বুকিং করা আছে। শ্রেয়া জিতুর কোয়ার্টারে এসে কলকাতার মত অজানা অচেনা জায়গায় একটা মাথা গোজার স্থান পেয়ে মনে মনে ঠাকুরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানায়। মৃণালিনী দেবীর বাড়ি এখন তন্ময় সেন নামের কেউ দখল করে আছে আর মৃণালিনী দেবীর কোন খোঁজই আর পাওয়া যায়নি শুনে জিতু বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। পুলিসের লোক, বুঝতে পারছিল যে পিছনে কিছু রহস্য আছে। এই তন্ময় সেন লোকটা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কারণ শ্রেয়ার কথা মত পল্লবের কোন কাকা বা মামা কেউই নেই। এমন কি গৌহাটিতেও ওর মায়ের কোন আত্মিয়ের সাথে কোন যোগাযোগ ছিলনা। তাহলে এই তন্ময় সেনটা আসলে কে ?

জিতুর কোয়ার্টারে দুখানা ঘর। দুটোতেই খাট বিছানা আলমারী সবই আছে। জিতু শ্রেয়াকে লাঞ্চ করতে করতে বলল,’তুমি এখানেই নিশ্চিন্তে থেকে যাও শ্রেয়া। আমি নিজে গিয়ে তোমাকে আর বিপ্লবকে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব। এই তিন দিনের মধ্যেই আমি এই তন্ময় সেনের সব খোঁজ খবর নিচ্ছি। তুমি একদম চিন্তা করবে না। আগে কালিম্পং গিয়ে বিপ্লবকে ভর্তি করে হস্টেলে রেখে নিশ্চিন্ত হও। এদিকটা আমি দেখছি। ওর নাড়ি নক্ষত্র সব খুঁজে বের করব আমি।‘ জিতুর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলার ধরন দেখে বিপ্লব হেসে ওঠে। শ্রেয়া আর জিতু বিপ্লবের হাসি দেখে হেসে ফেলে।  

এদিকে কমলা ফোনে তন্ময়কে জানিয়ে দিলো দিল্লী থেকে মৃণালিনী দেবী নামের কাউকে খুঁজতে এসেছিল এক মহিলা ও সাথে একটা বাচ্চা ছেলে। দিল্লী থেকে মহিলা সাথে একটা ছেলে শুনেই চমকে ওঠে তন্ময় সেন। তারপর কমলা ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি শুনে নিশ্চিন্ত হলেও বেশ ভয় পেয়ে গেল তন্ময়। মৃণালিনী দেবীর কাছে শুনেছিলেন পল্লবের কোন বাচ্চা ছিলনা। তাহলে কে এই মহিলা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ওর দুয়ারে মৃণালিনী দেবীর খোঁজে ? এ কি পল্লবের বিধবা স্ত্রী নাকি ওদের অন্য কোন আত্মীয় ? পিনাকি বাবু তো আগে দিল্লীতেই থাকতেন। কিন্তু কমলা জানিয়েছে এই মহিলার গায়ে রঙিন সিল্কের শাড়ী ছিল পরনে। তাহলে তো পল্লবের বিধবা নয়, কে এই মহিলা ? 

সেদিন ওর ছুটি থাকায় মোটর সাইকেল নিয়ে লাঞ্চের পর সোজা লাল বাজারে গোয়েন্দা দপ্তরে ওর বিশেষ বন্ধু সঞ্জয় হালদারের সাথে গিয়ে দেখা করল জিতু। সঞ্জয় হালদার একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা অফিসার। এ ডি আই জি লেভেলের অফিসার। জিতুর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনেই বুঝে গেলেন যে তন্ময় সেন একজন ফ্রড। একা একজন বিধবা মহিলা এতোবড় সম্পত্তির মালিক দেখে প্ল্যান কষে এগিয়েছে। জিজ্ঞাসা করল,’ আচ্ছা জিতু, লোকটা কি পুরসভা বা রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরী করে, জানিস কিছু ?’ জিতু অতশত কিছুই জানে না। উল্টে জিজ্ঞাসা করল,’ জানি না, বলতে পারব না। কিন্তু কেন বলত ?’ সঞ্জয় হালদার হেসে বলে, ‘ আরে বুঝলি না, এসব জায়গা থেকেই তো সম্পত্তি সংক্রান্ত সব খবর পাওয়া যায়। তুই চিন্তা করিস না। আমি কালকের মধ্যেই সব খবর জোগাড় করছি। নে এবার কফি বলছি, খাবি তো ?’

পরদিন সত্যিই সঞ্জয়ের কাছ থেকে ফোনে অনেক খবর পেয়ে গেল জিতু আর শ্রেয়া। তন্ময় সেন কলকাতা পুরসভায় চাকরী শুধু করে না, ইদানীং সরকারী দলের একজন ছোটখাটো নেতা। লোকটা নাকি খুব অল্প সময়ে অনেক সম্পত্তি করে ফেলেছে। বিবাহিত মানুষ, পাইক পাড়ায় পিনাকি সেনের সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। তন্ময় নাকি পিনাকি সেনের ভ্রাতুস্পুত্র, জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে কলকাতায়। আর তাছাড়াও এলাকার একজন মান্য গন্য ব্যাক্তি।

এসবের মধ্যেও একটাই সুখবর ছিল ওদের জন্য। আর সেটা হল কলকাতা পুরসভার রেকর্ড কিন্তু বলছে পাইক পাড়ার বাড়িটা এখনো স্বর্গত পিনাকি সেনের নামেই আছে। অর্থাৎ ঐ সপত্তির মিউটেশন করা হয়নি। রেজিস্ট্রি অফিস থেকে সার্চ রিপোর্ট করিয়ে  জানা গেছে এই সম্পত্তিরে কোন হস্তান্তর হয়নি। তবে পুরসভার রেকর্ডে বর্তমানে পিনাকি সেনের সম্পত্তির কোন ট্যাক্স বাকি নেই, সব আপ টু ডেট। তবে মারাত্মক খবর যেটা ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে মৃণালিনী দেবী এখনো জীবিত, তার নামের পেনশন প্রতি মাসে জমা হচ্ছে তার একাউন্টে।

মৃণালিনী দেবী জীবিত আছেন শুনেই কেঁদে ফেলল শ্রেয়া। একই শহর কলকাতায় তার নাতিকে নিয়ে এসে এখন পর্যন্ত মার কোন দেখাই পাওয়া গেল না। তাহলে মা কোথায়, কিভাবে আছেন কে জানে। শ্রেয়া ফোনে সঞ্জয়ের দেওয়া খবর শুনে যখন কান্না কাটি করছে জিতু কিন্তু অন্য কথা ভাবছে। রাত তখন আটটা বাজে। জিতু ওর সেল ফোন নিয়ে কোয়ার্টারের ছাতে চলে যায়। ওর অফিসের দুই একজনের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে নিচে নেমে আসে। আর দুদিন বাদেই শ্রেয়া চলে যাবে কালিম্পং। সেদিন শ্রেয়া জানিয়েছে যে দিল্লী থেকে ফিরবার পথে কলকাতায় আর আসবে না। বাগডোগরা থেকে সোজা উড়ে যাবে দিল্লীতে। জিতু ছাত থেকে নেমে আসল আর বলল,’ শ্রেয়া, তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করার ছিল।‘

শ্রেয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে, ‘কী রিকোয়েস্ট বলো জিতু। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই রাখব, কথা দিলাম।‘   

জিতু খুব সিরিয়াস মুখ করে সোফায় শ্রেয়ার সামনে বসে বলল,’ আমার বসের সাথে আর লিগ্যাল সেলের এক অফিসারের সাথে কথা হচ্ছিল এতক্ষন। সমস্ত শুনে তারা বলেছে যে তন্ময় সেনের মত ধূর্ত মানুষকে ফাঁদে ফেলে হাতে নাতে ধরতে হবে আর তারপর জেলে পুরতে হবে। তার জন্য কয়েকটা দিন সময় লাগবে। তাই আমি বলছিলাম কি তুমি কালিম্পং থেকে এখনই দিল্লী না ফিরে ওখান থেকে কলকাতায় চলে এসো। এর মধ্যে আমি সব ব্যাবস্থা করে ফেলছি। আমার বস একটা ভালো প্ল্যান দিয়েছেন। তুমি কলকাতায় যখন ফিরে আসবে আমি কথা দিচ্ছি তোমার মুখে আমি হাসি ফোটাব। এই কেসটা কিছুতেই আমি হারতে পারব না, শুধু তোমার জন্য শ্রেয়া। তুমি একবার এখানে ফিরে এসো।
uttamchakraborty306@gmail.com
ব্যাঙ্গালোর

No comments:

Post a Comment