![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
পর্দার আড়ালে
রণিত ভৌমিক
(১)
- ইমতিয়াজ ভাই, দারুণ খাওয়ালে। সত্যি বলতে অনেকদিন পর, এমন বিরিয়ানি খেলাম।
- ঠিক বলেছ, বিনয়। এলাহি আয়োজন করেছে ইমতিয়াজ।
পাশ থেকে অমলেন্দুর স্ত্রী অনন্যা বলে উঠল,
- তোমরা শুধু ইমতিয়াজ ভাইয়ের সুখ্যাতি করে যাচ্ছো, ওনার গিন্নী এশার নামটা একবারও বলছ না তো!
- আচ্ছা। সরি, সরি ম্যাডাম। আমাদের আগে এশা বৌদির নামটা উল্লেখ করা উচিত ছিল। ভেরি সরি। তবে, আমাদের মধ্যে উপস্থিত পূর্ববঙ্গীয়ও মহান পরিচালক চন্দ্রনাথ এই বিষয় ওর বাঙাল ভাষায় কিছু একটা না বললেই নয়, কি চন্দ্রনাথ তাই তো?
- উপফ! পোলা নয় তো আগুনের গোলা। এই দীনেশকে নিয়ে আর পারলুম না। সকলের পিছন ধইরা টান দেওয়াটা ওর বরাবরের স্বভাব।
চন্দ্রনাথের কথা শেষ হতে না হতেই, সকলে হেসে উঠল ঠিকই কিন্তু ওখানে উপস্থিত একমাত্র অমলেন্দুর মুখে হাসি ছিল না। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে তার। মদ্যপান পরিমাণে অত্তাধিক করলে যেমনটা হয় আর কি।
- ও গো, তুমি চুপ করে বসে থাকলে চলবে। কিছু বলো।
অনন্যার এই কথার উত্তরে অমলেন্দু গলা ঝেড়ে বলল,
- হুম! ভাই ইমতিয়াজ, তুমি আর এশা মিলে এই রিইউনিয়নটা আয়োজন করে খুব ভালো করলে। মনের মধ্যে থাকা সবার পাহাড় সমান অভিমানগুলো আজ অবশেষে মিটল।
- অমলেন্দু দা, আর পুরনো কথা তুলো না।
- না, ইমতিয়াজ। আমাকে বলতে দাও।
এই বলে অমলেন্দু বাকি কথা বলবার জন্য সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে যাবে, এমন মুহূর্তে তার হাতে থাকা কাচের গ্লাসটা গেল মেঝেতে পড়ে। গ্লাস ভাঙার শব্দটা সকলের কানে আসতে না আসতেই, চোখের সামনে তারা অমলেন্দুর ভারি শরীরটাকে ধপ করে সোফায় পড়তে দেখলো। আর সেইসঙ্গে বলা যেতে পারে, রিইউনিয়নের শেষ লগ্নে এসে ইমতিয়াজদের ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমে তখন এক গুচ্ছ প্রশ্ন রেখে দিয়ে প্রখ্যাত ব্যবসায়ী অমলেন্দু জানার মৃত্যু ঘটল।
(২)
জীবনটা এক কঠিন রঙ্গমঞ্চ, এই মঞ্চে আমরা সবাই অভিনেতা। যারা ভালো ভাবে অভিনয় করতে পারে, তারাই টিকে থাকে। আর যারা অভিনয় করতে পারে না, তারা পদে পদে পথ হারিয়ে ফেলে। কথাগুলো ভীষণ সত্যি মনে হচ্ছে আজ কারণ এই গল্পটা লিখতে বসে আমার স্ত্রীর সেই প্রথম মার্ডার কেস শলভ করার ঘটনাটা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই প্রখ্যাত ব্যবসায়ী অমলেন্দু জানার মার্ডার মিস্ট্রি। আমার স্ত্রী ওরফে লালবাজার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের মহিলা অফিসার স্বর্ণালী পাল চৌধুরী এই কেসটা প্রথম যেদিন হাতে পেয়েছিল, আমি তখন সবে লেখক সম্মিলনী থেকে বাড়ি ফিরেছি।
ও হ্যাঁ, আমার পরিচয়টাই আপনাদের দেওয়া হয়নি। আমি অর্থাৎ ভাস্কর পাল চৌধুরী পেশায় একজন লেখক হলেও, বাড়ি সামলানোর বেশিভাগ দায়িত্বটাই থাকে আমার কাঁধে। অবশ্য এর জন্য আমার স্ত্রীর স্বর্ণালীকে আমি খুব একটা দায়ী করি না। আসলে ওর কাজটা সমাজের এমন একটা বিষয় নিয়ে যার উপর বাড়তি চাপ আমি আর ওকে দিতে চাই না।
যাইহোক, ফেরা যাক সেদিনের কথায়। আমি বাড়ি ঢুকে ওর মুখটা থমথমে হয়ে আছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
- কি ম্যাডাম, আজ আবার নতুন কোনও কঠিন কেসের দায়িত্ব পেলে নাকি?
হ্যাঁ, কথাটা বলার আসল কারণ হচ্ছে স্বর্ণালী যখনই কোনও নতুন কেস হাতে পায় ও বাড়ি ফিরে বরাবরের মতো সোফায় বসে এক মনে কি যেন ভাবতে থাকে। সেদিনও তেমনটাই ঘটেছে।
আমাকে উত্তরে স্বর্ণালী বলল,
- হুম! ভাস্কর। তবে, এই প্রথম একটা মার্ডার কেস হাতে পেয়েছি।
- মার্ডার কেস? বাহ! এতদিনে তোমার মনের মতো একটা কেস হাতে পেলে স্বর্ণালী। তুমি নিশ্চয়ই হ্যাপি?
- উপফ! ভাস্কর। একজনের মৃত্যু কি কখনও কারোর জন্য হ্যাপি হতে পারে? তুমি একজন লেখক হয়ে এমনটা বলছ কীভাবে?
পাশে গিয়ে ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম,
- আই এম সরি। তবে, লেখক হয়ে বলছি না। একজন স্বামী হয়ে স্ত্রীর দিনের পর দিন এমন একটা কেস পাওয়ার ইচ্ছাকে যখন বেড়ে উঠতে দেখেছি, তখন সেই ইচ্ছাপূরণ হওয়ার খুশিতে আমি এমনটা বলে ফেলেছি, স্বর্ণালী।
এরপর খাবার টেবিলে বসে ওর মুখে কেসটার বিষয় জানার ইচ্ছাপ্রকাশ করতেই স্বর্ণালী আমাকে জানালো,
- প্রখ্যাত ব্যবসায়ী অমলেন্দু জানা স্ত্রী সহ ওনার এক পুরনো বন্ধু ইমতিয়াজ আলীর বাড়িতে বাকি বন্ধুদের সঙ্গে রিউনিয়নে সামিল হয়েছিলেন। খাওয়া-দাওয়া মেটার পরও নাকি অমলেন্দুবাবু মদ্যপান করে চলেছিলেন এবং এতটাই তাতে ডুবে ছিলেন যে ওনার কোনও হুঁশ ছিল না। বাকিরা হাসাহাসি করলেও, ওনার মুখে হাসি ছিল না বলেই জানা গেছে।
এখানেই আমি স্বর্ণালীকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- আচ্ছা! ওনার মৃত্যু তাহলে কখন ঘটল? না, মানে তেমন কিছু প্রমাণ পেয়েছ?
- দেখো, ভাস্কর। প্রাথমিক ভাবে বাকিদের জেরা করে যেটুকু তথ্য সামনে এসেছে, তা থেকে বলতে পারি যে এটা ঘটানো হয়েছে। ওনার হাত থেকে পড়ে যে গ্লাসটা ভেঙে গেছিল, তার কিছু স্যাম্পেল পরীক্ষা করে জানা গেছে যে মদে বিষ ছিল। কিন্তু কে এই বিষ ওনার গ্লাসে মিশিয়ে দিয়েছিল, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। কারণ অপরাধী বাকিদের মধ্যে থেকে যে কেউ হতে পারে।
এই 'যে কেউ হতে পারে' কথাটা শোনা মাত্র আমি ওর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,
- যে কেউ কেন?
উত্তরে স্বর্ণালী সামনে রাখা গ্লাসের জলে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
- কারণ ওনাকে হত্যা করার কোনও না কোনও মটিভ প্রত্যেকেরই রয়েছে।
(৩)
জীবন যোদ্ধে টিকে থাকার জন্য চাই ভাগ্য, যাদের ভাগ্যের চাকা মজবুদ তারা খুব দ্রুত সামনে এগোতে পারে। আর যাদের ভাগ্যের চাকা নড়বরে, তারা সামনে এগোনোর পথ খুব বেশি কঠিন। সে যতই পরিশ্রমী হোক না কেন।
কথাটা এখানে উল্লেখ করার একটাই কারণ সেই রাতে আমি স্বর্ণালীর মুখে শুনেছিলাম যে বিনয় দত্ত গরীব ঘরের ছেলে হলেও, উনি একজন প্রতিভাশালী এবং ব্যবসায়ী অমলেন্দু জানার বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও বিনয় বাবু কিন্তু ওনার কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কোম্পানির উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা কম বেশি সকলেই প্রায় এই ব্যাপারে অবগত যে বিনয় দত্তকে ছাড়া অমলেন্দুবাবু কখনোই নিজের কর্মক্ষেত্রে এতটা উন্নতি করতে পারতেন না। অথচ এই বিনয়বাবুকেই নাকি ওনার প্রাপ্য সম্মান অমলেন্দুবাবু কোনওদিন দেয়নি। উনি কেবল সাধারণ এক কর্মচারী হয়েই থেকে গেছেন।
- আচ্ছা, রাজেশবাবু। বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু জানতে পারলেন?
- আজ্ঞে, ম্যাডাম। বাকিরা বলতে চন্দ্রনাথ সরকার, দীনেশ গুপ্ত আর ইমতিয়াজ আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা বিষয় আমি নিশ্চিত।
- কি বলুন তো?
- বুঝলেন ম্যাডাম, এরা অমলেন্দুবাবুর বন্ধু হলেও, প্রত্যেকের মনেই ওনাকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ ছিল এবং আমার ধারণা সেই ক্ষোভ থেকেই ওনাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন এই হত্যার পরিকল্পনা রচনা করেছেন।
স্বর্ণালী জানতে চাওয়ায়, সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবু বলতে লাগলেন,
- চন্দ্রনাথ সরকার একজন ব্যর্থ চলচ্চিত্র পরিচালক। সেইভাবে সফল কাজ বলতে একটিও সিনেমা আপনি খুঁজে পাবেন না। অনেকবার উনি অমলেন্দুবাবুর থেকে সিনেমার জন্য টাকা ধার নিয়েছেন এবং এক টাকাও কোনওদিন ফেরত দিতে পারেননি। ফলে, অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে ওনার সাক্ষাৎ ঘটলেই, অমলেন্দুবাবু সবার সামনে ওনাকে গালমন্দ করতেন। এমন অপমান দিনের পর দিন মুখ বুঝে চন্দ্রনাথবাবু সহ্য করেছেন স্রেফ নিজের ব্যর্থতার কারণে। আর তাই চন্দ্রনাথবাবুর পক্ষে এই হত্যার পরিকল্পনা করা খুব একটা আশ্চর্যপূর্বক কাজ নয় বলেই আমার ধারণা। খোঁজ নিয়ে কিন্তু এটাও জানা গেছে যে নিজের চিত্রনাট্যের উপরই উনি সিনেমা তৈরি করেন। অতএব...
না, কথাটা সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবুকে আর শেষ করতে দিল না স্বর্ণালী। ওর কথায়,
- তারমানে এই দাঁড়ায় যে হত্যার চিত্রনাট্য রচনা করা থেকে শুরু করে সেই কর্মকাণ্ড ঘটানো, সমস্তটাই চন্দ্রনাথ সরকারের পক্ষে করা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়।
- ইয়েস, ম্যাডাম। তবে, বাকিদের ক্ষেত্রেও সম্ভবনাটা কিন্তু রয়েছে। বিশেষ করে দীনেশ গুপ্তর নামটা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। একজন উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার হওয়ার দৌলতে বলা যায়, উনি জীবনে বেশ ভালো ভাবেই প্রতিষ্ঠিত। তবে, মানুষটা একেবারেই সৎ প্রকৃতির নয়। ক্রমাগত ভাবে ঘুষ নিতে নিতে হয়ত উনি ভুলেই গেছেন যে বাড়ির শেষ কোন জিনিসটা নিজের বেতনের টাকায় উনি কিনেছেন। এনার সঙ্গেই আবার অনন্যা দেবী ওরফে অমলেন্দুবাবুর স্ত্রীর নাকি বিয়ের আগে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। পৈতৃক ব্যবসার কারণে প্রচুর টাকার মালিক হওয়ার জন্যই অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে অনন্যা দেবীর বাবা নিজের একমাত্র কন্যার বিয়ে দেন, সেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে।
স্বর্ণালী রাজেশবাবুর কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনছিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ওর মনে একটা সংশয় দেখা দিতেই প্রশ্নটা ও রাজেশবাবুর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিল,
- রাজেশবাবু, সত্যিই কি দীনেশ গুপ্ত আর অনন্যা দেবীর সম্পর্কটা চিরকালের জন্য শেষ হয়ে গেছিল?
একটু থতমত খেয়ে রাজেশবাবু বলল,
- আজ্ঞে, ম্যাডাম। এই বিষয়টা তো খোঁজ নিয়ে দেখা হয়নি
- এতো ফাঁকফোকর রেখে কাজ করলে যে এমন মার্ডার কেস কোনও ভাবেই সমাধান করা সম্ভব নয়, রাজেশবাবু।
- জানি, ম্যাডাম। কিন্তু এদের প্রত্যেকের জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব মিটিয়ে গতকাল আর সময় পাইনি। তাই ভাবলাম প্রাথমিক তদন্তের কাজটা সেরে এই রিপোর্টটা আপনাকে দেওয়ার পর নেক্সট কোর্স অফ অ্যাকশনটা প্ল্যান করব।
সেই মুহূর্তে স্বর্ণালী একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
- যাইহোক, বাকি রয়ে যাওয়া ইমতিয়াজ আলীর ব্যাপারে এবার বলুন। কেন অমলেন্দু বাবুকে উনি খুন করতে যাবেন? ওনাকে সন্দেহ হওয়ার কারণ কি?
- ম্যাডাম, আমার কিন্তু এনাকে বেশি সন্দেহ হয়। ইমতিয়াজ আলী একজন ধীরস্থির মানুষ। একটা সাধারণ চাকরি করে এবং বলতে দ্বিধা নেই যে সম্পূর্ণ ভাবে স্ত্রীর দ্বারাই উনি চালিত। এই রিইউনিয়নটা ওনারা দুজনে মিলেই আয়োজন করেছিলেন। এখানে আরেকটা বিষয় না বললেই নয়। ওনার স্ত্রী ওরফে এশা দেবীর সঙ্গে কিছুদিন আগে অবধি অমলেন্দুবাবুর প্রকাশ্যে সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। ইমতিয়াজ আলী সবকিছু জানা সত্ত্বেও মুখ বুজে দিনের পর দিন সেটা সহ্য করেছেন কারণ ওনার কথা অনুযায়ী, এশা দেবীকে উনি নিজের চেয়েও অধিক ভালোবাসে বলেই উনি মনে মনে শুধু কষ্ট পেয়ে গেছেন। আর বিশ্বাস রেখেছেন হয়ত এমন একদিন আসবে, যখন এশা দেবী নিজের ভুল বুঝতে পেরে এই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে ওনাকেই কেবল ভালোবাসবে আর কাউকে নয়।
(৪)
বাড়ি ফিরে, আমার কাছে যখন স্বর্ণালী এই বিষয়গুলো এক এক করে বলছিল, আমি তো একেবারে অবাক হয়ে গেছিলাম।
- ওহ মাই গড! প্রতিশোধ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, ক্ষোভ সবকিছুই এই কেসের মধ্যে আছে দেখছি। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের ওয়েব সিরিজের মতো লাগছে।
- আজ্ঞে হ্যাঁ, লেখক মশাই। ঠিক তাই। তবে, আমি যতদূর শুনেছি, লেখক সাহিত্যিকরা সাধারণ মানুষকে এটাই বোঝায় যে বাস্তব চিত্র থেকেই সাহিত্যের জন্ম হয়। তাহলে আপনি এক্ষেত্রে অবাক হচ্ছেন যে বড়?
ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা স্বর্ণালীর হাসিটা দেখে আমিও হেসে ফেললাম।
- দূর! সবসময় এমন ঠাট্টা করো না তো। স্বর্ণালী, এবার কিন্তু তুমি একটা বেশ জটিল কেস হাতে পেয়েছ। অতএব বাড়তি একটু সতর্ক থেকো। এর সমাধান কিন্তু খুব সহজে হবে না।
- হ্যাঁ, জানি ভাস্কর। এটা আমার জীবনের অন্যতম একটা কঠিন কেস। আমি যতটা সম্ভব নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব।
এরপর আমাদের সেই বিষয় আলোচনা আরও কিছুটা সময় প্রলম্বিত হলো। কথায় কথায় স্বর্ণালীর কাছ থেকে শুনলাম যে আগামীকাল সকালেই কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ও পৌঁছে যাবে মৃত ব্যবসায়ী অমলেন্দু জানার বাড়ি ওনার স্ত্রী ওরফে অনন্যা দেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। হ্যাঁ, সাক্ষাৎ হলেও বিষয়টাকে অলিখিত ভাবে জিজ্ঞাসাবাদও বলা যেতে পারে।
দ্বিতীয় হুগলী সেতু হয়ে গাড়িটা ছুটে চলেছে। স্বর্ণালী চোখ বন্ধ করে কি যেন তখন ভাবছিল এমন সময় পাশ থেকে রাজেশবাবু বলে উঠল,
- ম্যাডাম, যা বুঝছি বারুইপুর থানায় গিয়ে কোনও লাভ হবে না। ওই থানার ওসি একেবারেই অকর্মার ধাড়ি। আমরা বরং অমলেন্দুবাবুর বাড়িতেই আগে যাই চলুন।
কথাটা শোনা মাত্র স্বর্ণালী জিজ্ঞেস করল,
- আপনার ওনাকে এমন মনে হওয়ার কারণ?
উত্তরে রাজেশবাবু বলল,
- আসলে ম্যাডাম, ওনার সঙ্গে আমার বিগত দু-বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছি, যা ঘটে আর যা রিপোর্টগুলোতে লেখা থাকে, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
- বুঝলাম। তা ওসির নাম কি?
- আজ্ঞে, সনাতন বাগচী।
নামটা শোনার পর স্বর্ণালী রাজেশবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
- দেখুন রাজেশবাবু। আমরা তো সরকারের অধীনে থেকে কাজ করি, তাই প্রটোকল মেনেই আমাদের এগোতে হবে। অতএব ওখানে গিয়ে তেমন সুবিধে হবে না জেনেও, আমাদের যেতে হবে।
বারুইপুর থানার ওসি সনাতন বাগচী আদতে ধার্মিক ব্যক্তি হলেও, সে কিন্তু বড্ড ভীতু গোছের লোক। আর এই অনুমান স্বর্ণালীর কাছে সঠিক বলে প্রমাণিত হলো যত তাদের মধ্যে এই কেস নিয়ে কথাবার্তা এগোতে লাগল।
- বুঝলাম, সনাতন বাবু। তবে, এই কেসের সঠিক এফআইআর বা জিডি রিপোর্টটা একবার দেখে যায় কি?
কথা শেষ হতে না হতেই স্বর্ণালী লক্ষ্য করল যে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওসি সনাতন বাবু যেন কিঞ্চিত দ্বিধায় পড়ে গেল এবং এদিক ওদিক তাকে চাইতে দেখে ও ফের প্রশ্নটা করল,
- কোনও কেস ডায়েরি আছে কি? তৈরি করেছেন?
স্বর্ণালীর কথা শুনে সে ওমনি একগাল হাসি নিয়ে বলল,
- আজ্ঞে, হ্যাঁ ম্যাডাম। সেটা আছে।
এই বলে শঙ্কর ওরফে হেড কনস্টেবলকে সে নির্দেশ দিতেই, শঙ্কর একটা খাতা এনে স্বর্ণালীর হাতে তুলে দিল। সেই খাতা খুলে চোখ বোলাতে শুরু করা স্বর্ণালী কিছু সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারল যে আসার সময় রাজেশবাবু সেই ওসি সম্পর্কে যা যা বলছিল, তা একেবারেই সঠিক। হ্যাঁ, অমলেন্দু জানার মৃত্যুর পর কাজ যতটা হওয়ার কথা ছিল, তার অধিকাংশই বাকি রয়ে গেছে। একটা প্রকৃত কেস ডায়েরি বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটা একেবারেই ওটা পড়ে মনে হবে না। ফলে, স্বর্ণালী গম্ভীর গলায় তাকে বলল,
- সনাতন বাবু, আপনাকে আমি একটা গোটা দিন দিচ্ছি। আগামীকালের মধ্যে যে করে হোক ডায়েরিতে লেখা প্রত্যেকটা তথ্য সঠিক ভাবে যাচাই করে আমার হাতে তুলে দেবেন। এই কেসের মীমাংসা করতে হলে এই সমস্ত তথ্য আমার ভীষণ প্রয়োজন।
কাঁচুমাচু মুখে সনাতন বাবুর তেমন আর কিছুই বলার অবকাশ ছিল না। ঘাড় নেড়ে সে শুধু বলল,
- ঠিক আছে, ম্যাডাম।
এরপর থানা থেকে বেরিয়ে স্বর্ণালী আর সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবু চলল অমলেন্দুবাবুর বাড়ি, ওনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে।
(৫)
- আচ্ছা, স্বর্ণালী। সবসময় যে প্রটোকল মেনেই তোমরা কাজ করো, এমন তো নয়। তাহলে এই ক্ষেত্রে প্রটোকল মানাটা কি খুব প্রয়োজন আছে?
বাড়ি ফিরে যখন স্বর্ণালীর কাছ থেকে সেদিনকার ঘটনাগুলো আমি ওর মুখ থেকে শুনছিলাম, তখন এই প্রশ্নটা আমি মাঝ পথেই ওকে করে বসলাম। যার উত্তরে ওকে বলতে শুনলাম,
- দেখো, ভাস্কর। সবসময় হয়ত সবকিছু মেনে চলা সম্ভব হয় না কিন্তু বারুইপুর থানায় কেমন রিপোর্ট লেখা হয়েছে, সেটা আমার কাছে জানাটা খুবই জরুরি ছিল। কারণ অনেক সময় দেখা গেছে যে গোড়ায় গলদ থাকা সত্ত্বেও আমরা বিষয়টাকে লক্ষ্য না করেই অসীম শূন্যে সমাধান সূত্র খুঁজে বেড়াই।
যাইহোক, আমরা আবারও ফিরে এলাম মূল ঘটনার কথায়। অনন্যা দেবীর সঙ্গে স্বর্ণালীদের সাক্ষাতের বিষয়টা নিয়ে ওকে বলতে শুনলাম,
- আজ একটা দারুণ বিষয় ঘটেছে, বুঝলে ভাস্কর।
- কি বলত?
- আমি আর রাজেশবাবু যখন অমলেন্দুবাবুর বাড়িতে ঢুকছি, দেখি ওই সময় দীনেশবাবু ওই বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন।
- দাঁড়াও, দাঁড়াও। দীনেশবাবু মানে দীনেশ গুপ্ত?
- ইয়েস, ডিয়ার। এই দীনেশ গুপ্ত হচ্ছে আমাদের সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম একজন।
- তারপর কি হলো?
আমার কৌতূহল দেখে স্বর্ণালী বেশ সুন্দর ভাবে এক এক করে প্রত্যেকটা ঘটনার বিবরণ দিতে লাগল। ওর কথা অনুযায়ী, পুলিশের এই হঠাৎ আগমনে অনন্যা দেবী কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েছিলেন। আর যদি বলতে হয় দীনেশবাবুর কথা, উনি তো একেবারে হকচকিয়ে গেছিলেন।
- এই অফিস ফেরত বাড়ি যাওয়ার আগে একটু অনন্যার সঙ্গে দেখা করে গেলাম আর কি। বুঝতেই পারছেন অমলেন্দু মারা যাওয়ার পর ও একেবারে একা হয়ে পড়েছে।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ। বুঝতে পারছি। তা আপনার কি মাঝে মধ্যেই এখানে আসতে হচ্ছে?
- মানে? কি বলতে চাইছেন? অমলেন্দু আমার বন্ধু আর ওর অবর্তমানে, ওর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোটা একজন বন্ধু হিসাবে নিজের কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
দীনেশবাবু হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে পরায়, স্বর্ণালী বেশ ধীরস্থির ভাবেই ওনাকে জবাবটা দিয়েছিল। ওর কথায়,
- নিশ্চয়ই এটা একজন ভালো বন্ধুর কর্তব্য। তবে, কি বলুন তো দীনেশবাবু। এই কর্তব্যের আড়ালে অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকলেই, সেটা আবার আমাদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
দীনেশবাবুর গালের পেশী দুটো শক্ত হয়ে গেল। উনি গম্ভীর গলায় বললেন,
- কি বলতে চাইছেন, সোজাসুজি বলুন?
- না, কিছু না। আপনার সঙ্গে আবার পরে দেখা হবে।
এই বলে স্বর্ণালী আর রাজেশবাবু বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল। অনন্যা দেবী তখন সোফায় বসে। পড়নে সাদা শাড়ি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো নিয়ম-কানুন মেনে চলার মতো মহিলা সে একেবারেই নয়। পড়নে তখন তার ঘিয়ে রঙের শাড়ি, চুলটা ভালো মতোই আঁচড়ানো। তাকে দেখে যেকোনো অচেনা ব্যক্তির পক্ষে বোঝা কিছুতেই সম্ভব নয় যে সে কয়েকদিন আগেই তার স্বামীকে হারিয়েছেন।
- কি দরকার অফিসার, এই সময় আমাদের বাড়িতে আপনারা?
অবাক হয়ে অনন্যা দেবী এই প্রশ্নটা স্বর্ণালী এবং সঙ্গে থাকা রাজেশবাবুকে করতেই স্বর্ণালী বলে উঠল,
- হ্যাঁ, একটু দরকারেই আজ আমাদের এখানে ছুটে আসা।
- দরকার?
- আসলে আপনার স্বামীর কেসটা আমি তদন্ত করছি। সেই ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল, অনন্যা দেবী।
- হ্যাঁ, বলুন। কি জানতে চান?
- আচ্ছা, আপনার কাকে অপরাধী বলে মনে হয়?
প্রথমেই যে এই প্রশ্নটা স্বর্ণালী করে বসবে তাকে, সেটা হয়ত অনন্যা দেবী বুঝতে পারেনি। তাই কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গিয়ে সে বলল,
- আমি কাউকে সন্দেহ করি না। এটা হয়ত ওর নিয়তি ছিল। সবার সঙ্গে শত্রুতা করলে যা হয়।
তার কাছ থেকে এমন স্পষ্ট উত্তর শুনে স্বর্ণালীর সঙ্গে থাকা সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবু তো ধরেই নিয়েছিল যে অনন্যা দেবীও হয়ত এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু স্বর্ণালী যে এতো সহজে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাত্রী নয়। সে বরং আরও প্রশ্ন অনন্যা দেবীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিতে লাগল।
- একটু আগে দীনেশবাবুকে বাড়ি থেকে বেরতে দেখলাম। উনি কি এখন প্রায়ই আসছেন এখানে?
- না, মানে। ওর সঙ্গে কি কিছু কথা হয়েছে আপনাদের?
পাল্টা প্রশ্ন স্বর্ণালীর দিকে আসতে দেখে সে বলে উঠল,
- না, আমাদের মধ্যে সঙ্গে তেমন কথা না হলেও, এটুকু উনি বলে গেলেন যে এখন বন্ধুর অবর্তমানে তার পরিবারের দায়িত্ব ওনার।
- হুম! দীনেশ তো ঠিকই বলেছে। আসলে ও বরাবর আমার স্বামীর খুব ভালো বন্ধু ছিল। কিন্তু অমলেন্দুই বন্ধুত্বটা স্বাভাবিক পর্যায় রাখেনি।
- কিন্তু কেন?
স্বর্ণালীর প্রশ্নের উত্তরে অনন্যা দেবী বেশ গম্ভীর গলায় বলল,
- বিয়ের আগে দীনেশের সঙ্গে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বাবা তা মেনে নেয়নি। তার কথা মতো অমলেন্দুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। তবে, বিয়ের আগের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে অমলেন্দু দীনেশের সঙ্গে নিজের বন্ধুত্বটা নষ্ট করে ফেলল। আমাকেও অহেতুক সন্দেহ করতে লাগল। আমাদের বিবাহিত সম্পর্কটা ছিল ওই খাতায় কলমে, এর বাইরে কিছু না।
- আচ্ছা, সেদিন রাতে অমলেন্দুবাবুর মৃত্যুর আগে ঠিক কি ঘটেছিল একটু মনে করে বলতে পারবেন?
- হি ওয়াস ফুললি ড্রাঙ্ক। তবে, বিষটা কীভাবে ওর গ্লাসে এলো সেটা আমি বলতে পারব না। অবশ্যই ওর মৃত্যু ঘটার কিছুক্ষণ আগে আমরা যখন গল্প করছিলাম, ওই সময় একবার কারেন্ট অফ হয়ে গেছিল।
- কারেন্ট অফ?
- হ্যাঁ, কারেন্ট অফ। ইমতিয়াজ ভাই চটজলদি মেইন সুইচ অন করতেই আবার কারেন্ট চলে আসে।
(৬)
- এই 'মেইন সুইচ' নিয়েই যত গণ্ডগোল বুঝলে তো, স্বর্ণালী।
- হ্যাঁ, ভাস্কর। আমারও তাই মনে হচ্ছে। বিষটা মেশানোর জন্যই হয়ত কেউ মেইন সুইচটা অফ করেছিল।
- ঠিক তাই। তবে, এটা কি কারোর একার পক্ষে ঘটানো সম্ভব? আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে এই কর্মকাণ্ডের পিছনে একাধিক ব্যক্তি জড়িত আছে।
আমার কথাটা শুনে সেই রাতে স্বর্ণালী যেন আবারও গভীর চিন্তায় পরে গেল। পরদিন সকালে রাজেশবাবুকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্ণালী বেরিয়ে পড়ল বারুইপুর থানার উদ্দেশ্যে। গতকাল বলে যাওয়া কথা মতোই সনাতনবাবু কাজগুলো সেরে রেখেছিল। সুতরাং থানায় ঢুকতেই স্বর্ণালীর হাতে সে রিপোর্টটা তুলে দিয়ে বলল,
- ম্যাডাম, প্রত্যেকটি তথ্য যাচাই করে দেখছি। অমলেন্দুবাবুর মৃত্যুর পিছনে ওনার স্ত্রীর ভূমিকা থাকতে পারে কারণ গতমাসে বাড়িতে একবার শর্ট-সার্কিটে অমলেন্দুবাবুর প্রাণ যেতে যেতে বেঁচেছে। এই দেখুন, ওই ঘটনার পর বিদ্যুৎ দফতরে শর্ট-সার্কিট সংক্রান্ত একটা অভিযোগ তার নামে জমা পড়েছিল।
- হুম! বেশ ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশন, সনাতনবাবু। আর ওনার মৃত্যুটাও ঘটে ইমতিয়াজ আলীর বাড়িতে কারেন্ট অফ হওয়ার পর। আমি নিশ্চিত মেইন সুইচ অফ করেই বিষটা মেশানো হয়েছিল।
- আজ একবার ইমতিয়াজ আলীর বাড়ি গেলে হয় না, ম্যাডাম?
সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবুর এই প্রশ্নের উত্তরে স্বর্ণালী বলল,
- হ্যাঁ, আজই ইমতিয়াজ আলীর বাড়ি যাব। তবে, সেটা শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নয়। আরও একটা উদ্দেশ্য আছে বটে। আপনি ফরেনসিক কনসালটেন্ট সৌমেনকে একবার খবর দিন। মেইন সুইচের ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো যদি সম্ভব হয়, তাহলে সংগ্রহ করতে হবে। জানি না কেন, এইদিকটায় আপনাদের দৃষ্টি পড়েনি।
ইমতিয়াজ আলীর বাড়ি বেহালার দিকে। নিউ আলিপুর হয়ে যখন স্বর্ণালীদের গাড়িটা ওনার বাড়ির দিকে যাচ্ছে, ওই মুহূর্তে স্বর্ণালীর ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা এসেছিল শঙ্কর ওরফে বারুইপুর থানার হেড কনস্টেবলের কাছ থেকে। ফোনটা তুলে 'হ্যালো' বলতেই, শঙ্করের গলার স্বর ভেসে এলো ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।
- হ্যালো, ম্যাডাম। বিনয় দত্ত এই মাত্র থানায় ঢুকেছে। স্যারের সঙ্গে কথা বলছে। আমি স্যারকে ইশারা করতে দেখে, আপনাকে বিষয়টা ফোন করে জানালাম।
- আচ্ছা, এই ব্যাপার। তোমরা ওদিকটা আপাতত সামলাও, দেখো ওনার কি বক্তব্য। আমি আর রাজেশবাবু এদিকের কাজটা সেরে থানায় আসছি।
- ঠিক আছে ম্যাডাম।
বিনয় দত্ত ওরফে অমলেন্দুবাবুর বন্ধু এবং ওনার কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এই হঠাৎ থানায় আগমন যেন এই কেসটাকে আরও জটিল করে তুলল।
এদিকে, স্বর্ণালী আর রাজেশবাবু যখন ইমতিয়াজ আলীর বাড়ির গিয়ে পৌঁছালো, তখন দেখে স্বামী স্ত্রী মিলে কোথাও একটা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। সেই বিষয় জিজ্ঞেস করতেই ইমতিয়াজ আলী জানালেন,
- আমরা ঈদের জন্য কেনাকাটা করতে বের হচ্ছিলাম। আপনারা এই সময় কি ব্যাপার অফিসার?
- আপনাদের দুজনের সঙ্গেই কিছু কথা ছিল।
- কেন? আমরা তো যা বলার বলে দিয়েছিলাম। আপনার সঙ্গে উপস্থিত ওনাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবুকে দেখে যে ইমতিয়াজ আলী কথাটা বলল, সেটা বুঝতেই পেরেছিল স্বর্ণালী। আর তাই সে বলল,
- পুলিশ তো শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করতেই আসে না ইমতিয়াজ বাবু। আরও কিছু কাজ থাকে। আপনি ভুলে যাবেন না যে আপনার বাড়িটা কিন্তু মার্ডার স্পটও। অতএব তদন্তের স্বার্থে আমরা আবারও আসতে পারি।
- ঠিক আছে, ম্যাডাম। আসুন।
স্বর্ণালীরা ভিতরে ঢুকে আগেই মেইন সুইচের দিকে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল এবং ইমতিয়াজ আলী সেই ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের সেদিকেই নিয়ে গেলেন। মেইন সুইচটা ভালো করে দেখার পর স্বর্ণালী সঙ্গে আসা ফরেনসিক কনসালটেন্ট সৌমেনকে ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা সংগ্রহ করবার কাজ শুরু করে দেওয়ার নির্দেশ দিল। তারপর ড্রয়িংরুমের চারিপাশটা দেখতে দেখতে সেই দম্পতিকে জিজ্ঞেস করল স্বর্ণালী,
- অমলেন্দুবাবুর মৃত্যুর সময় আপনারা দুজন, কে কোথায় ছিলেন একটু মনে করে বলতে পারবেন?
উত্তরে ইমতিয়াজ আলী বলে উঠলেন,
- কেন? এর উত্তর তো আমরা আগেই আপনাদের দিয়েছিলাম।
- হ্যাঁ, জানি। কিন্তু আরও একবার জানতে চাইছি। আপনার বলতে সমস্যা হচ্ছে নাকি?
- না, সমস্যা হবে কেন। তবে, বারবার এই একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে কি অপরাধী ধরা পড়বে?
- পড়বে কি পড়বে না, সেটা আমাদের উপরই ছেড়ে দিন। এখন যেটা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তরটুকুই দিন ইমতিয়াজ বাবু।
- হুম। আমি সোফায় বসেছিলাম আর এশা রান্না ঘরের বাইরে।
এইবার এশা দেবীর দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্নটা করল স্বর্ণালী,
- আপনার সঙ্গে অমলেন্দুবাবুর যে একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে আপনার স্বামীর সঙ্গে আপনার ঝগড়া অশান্তি হতো নিশ্চয়ই? তা শেষ অশান্তি কবে হয়েছিল একটু ভেবে বলতে পারবেন?
এশা দেবী কিছু বলার আগেই ইমতিয়াজ আলী উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,
- কীসব প্রশ্ন করছেন, বলুন তো? এর সঙ্গে এই কেসের কি সম্পর্ক রয়েছে?
- অবশ্যই সম্পর্ক রয়েছে কারণ যে মৃত সে আপনার স্ত্রীর প্রেমিক। স্ত্রীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক রয়েছে জেনেও আপনি যে চুপ করে বসে থেকেছেন, এটা মানতে যে আমার খুব সমস্যা হচ্ছে ইমতিয়াজ বাবু। এই সমাজে এখনও কি এমন মানুষ আছে যে এই ধরণের ঘটনা দিনের পর দিন চোখের সামনে দেখেও ভালো মানুষ সেজে থাকবে?
- (রাগে গজরে উঠল ইমতিয়াজ আলী) বলতে কি চাইছেন? আমি খুন করেছি ওকে?
- না, আমি কেন বলতে চাইব। তথ্য প্রমাণ সেটা বলবে।
এশা দেবীর দিকে তাকিয়ে স্বর্ণালী বেশ কিছু প্রশ্ন তাকে করেছিল যেমন,
- আপনার সঙ্গে অমলেন্দু বাবুর সম্পর্ক ঠিক কবে থেকে? আপনার স্বামীর অবর্তমানে উনি কি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এই বাড়িতে আসতো? অনন্যা দেবীর সঙ্গেই বা আপনার সম্পর্ক কেমন?
এই সকল প্রশ্নের উত্তরে নিজের স্বামীর দিকে একবার চেয়ে গড়গড় করে সে বলতে লাগল,
- আমার সঙ্গে অমলেন্দুর সম্পর্ক বিগত দু'বছরের। আমার বাড়িতে না এলেও আমরা দেখা করতাম ওনার অফিসের নিকটবর্তী একটি অ্যাপার্টমেন্টে। ইমতিয়াজ প্রথম থেকে বিষয়টা না জানলেও, পরে জানার পর নিজের মনেই ক্ষতটা জমতে দিয়েছিল। আমিও চেয়েছিলাম জীবনের এই চরম ভুলটা থেকে বেরিয়ে আসতে কিন্তু বিশ্বাস করুণ কিছুতেই পারছিলাম না। অনন্যা ওর স্বামীকে ভালোবাসত না, সে আজও মনের মধ্যে দীনেশকেই রেখেছে।
- আর তাই আপনি আর ইমতিয়াজ বাবু দুজনে মিলে প্ল্যান করে অমলেন্দুবাবুকে হত্যা করেছেন, কি তাই তো?
কান্নায় ভেঙে পড়া এশা দেবী তখন বলতে লাগল,
- না! না! আমি অমলেন্দুকে খুন করিনি। আমি যে ওকেও অন্তর থেকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
(৭)
- ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! কি সমাজে আমরা বসবাস করছি স্বর্ণালী? এর বউয়ের সঙ্গে তার বউ আবার তার সঙ্গে অন্যের কেউ। লজ্জা লাগছে আমার ভাবলে এরা নাকি মানুষ!
রাতে যখন স্বর্ণালীর কাছে বিষয়টা শুনছিলাম, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। অন্তরের রাগটা ওইভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটল।
এরপর স্বর্ণালীর কাছে থেকে শুনলাম সেদিনের বাকি ঘটনার কথা অর্থাৎ থানায় ফিরে বিনয় দত্তের বিষয় ওরা জানতে পাড়ল যে উনি এসেছিলেন এটা জানতে যে অমলেন্দুবাবু নাকি আগে থেকেই একটি উইল করে রেখে গেছেন যার মাধ্যমে পুরো সম্পত্তি ওনার অবর্তমানে বিনয়বাবুকে উনি দিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন সেই উইলের কথা কেউ মানতে নারাজ। অনন্যা দেবীর কথায় দীনেশবাবুও নাকি সহমত পোষণ করেন যে এটা নাকি বিনয়বাবুর চক্রান্ত। উনি চান এই পুরো সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে। আর এখানেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে।
- আচ্ছা, অমলেন্দুবাবু কি এতটাই দিল-দরদি মানুষ যে নিজের সম্পত্তি নিজের বউকে ছেড়ে অন্য কাউকে দিয়ে যাবেন?
এর উত্তর অবশ্য স্বর্ণালী দিল। ওর কথায়,
- দেখো, ভাস্কর। আমার মনে হয় এই প্রশ্নের দুটো উত্তর হতে পারে। এক, অমলেন্দুবাবু আগাগোড়া নিজের বন্ধ বিনয়কে কখনোই সেই মর্যাদা দেয়নি তাই অন্তরের অনুশোচনা থেকেই হয়ত ওনার অবর্তমানে সমস্ত সম্পত্তি বন্ধুকে দিয়ে যেতে চেয়েছেন। কারণ বিনয় দত্তকে ছাড়া অমলেন্দুবাবু কখনোই নিজের কর্মক্ষেত্রে এতটা উন্নতি করতে পারতেন না। আর দুই, এটা বিনয় দত্তর পরিকল্পনা হতে পারে। এতদিন উপেক্ষিত থাকার পর, এই সুযোগে সব সম্পত্তির মালিক হওয়ার লোভে উনি ভুয়ো দলিল বানিয়ে এই কাজটি করতে চেয়েছেন।
- তোমার কোনটা মনে হচ্ছে, স্বর্ণালী?
- আমার দ্বিতীয়টাই মনে হচ্ছে, ভাস্কর। যদি জানতে চাও কেন, তাহলে বলবো যে উইল নিয়ে সরাসরি থানায় এসে পুলিশকে জানানোর পিছনে মূল করণ হতে পারে এর স্বচ্ছতার প্রমাণ রাখার জন্য।
- তোমরা কি উইলটা খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছ?
- সই বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলেই বাকিটা পরিষ্কার হবে।
- বুঝলাম, স্বর্ণালী। কিন্তু সইটা যদি মিলে যায়, তাহলে তো সমস্যা আরও বাড়বে।
- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু এই রহস্যের জট আমি খুলেই ছাড়ব। স্বর্ণালী পাল চৌধুরী সহজে হার মানবে না।
পরদিন সকালে দেখলাম স্বর্ণালী তাড়াহুড়ো করে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। অফিসের গাড়ি তখনও এসে পোঁছায়নি। আমি অবশ্য লেখার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, না হলে ঠিকই একবার স্বর্ণালীকে ফোন করে জানার চেষ্টা করতাম। যাইহোক, রাতে বাড়ি ফিরতেই আমি এই বিষয়টা নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম এবং উত্তরে যেটা বলল স্বর্ণালী, তা শুনে আমি একেবারে অবাক!
- আমাদের ফরেনসিক কনসালটেন্ট সৌমেন গতরাতেই আমাকে একটা ম্যাসেজ করেছিল, ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে আমার নজরে আসে সেই ম্যাসেজ এবং তৎক্ষণাৎ ওকে ফোন করে বেরিয়ে যাই ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের ল্যাবের উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে জানতে পারি যে ওই মেইন সুইচে ইমতিয়াজ আলী ছাড়াও আরও একজনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। আর সেটা বিনয় দত্তের।
- বিনয় দত্ত? কীভাবে সম্ভব? ওনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষা করার জন্য পেলে কোথায়?
আমার কৌতূহলপূর্বক এই প্রশ্ন স্বর্ণালী শুনে বেশ ধীরস্থির ভাবেই ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি রেখে বলল,
- ভাস্কর, তুমি কি ওই উইলের কথাটা ভুলে গেলে? আমাদের যাচাই করে দেখবার জন্য উনি তো স্বয়ং নিজে এসে ওই উইল বারুইপুর থানায় গতকাল দিয়ে যান। ওটা তো সই বিশেষজ্ঞের কাছেই ছিল। বাকিটা এবার না হয় বুঝে নাও।
হ্যাঁ, বাকিটা বুঝতে আর আমার সময় লাগল না। ওই উইলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং মেইন সুইচে ইমতিয়াজ আলী ছাড়া বাকি আরেকজনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট একেবারেই মিলে গেছে। অতএব বলতে দ্বিধা নেই যে সেই ব্যক্তি আর কেউ নয়, বিনয় দত্ত। কিন্তু এখন মনে যেটা প্রশ্ন, এই বিনয় দত্তই কি মূল অপরাধী? আসলে কি বিনয় দত্তই অমলেন্দুবাবুকে খুন করেছেন?
না, এটা হয়ত এখনই বলা সম্ভব নয়। কারণ মেইন সুইচ অফ করা আর বিষ দেওয়া দুটো ঘটনা কোনও এক ব্যক্তির পক্ষে একই সময়ের মধ্যে করা কখনোই সম্ভব নয়। সুতরাং পর্দার আড়ালে নিশ্চিত আরও একজন রয়েছে। আর এখন সেই পর্দার আড়ালে থাকা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতেই অভিযান চালাতে বদ্ধপরিকর স্বর্ণালী এন্ড কোম্পানি।
(৮)
- উইলের সইটা পরীক্ষা করে কি দেখলে স্বর্ণালী? ওটা কি জাল সই?
- না, গো। ভাস্কর। ওটা অমলেন্দু বাবুরই সই।
- এটা কীভাবে সম্ভব স্বর্ণালী? উনি তারমানে নিজের সব সম্পত্তি বিনয় দত্তকে দিয়ে গেছেন?
- না, সেটার প্রশ্নই ওঠে না। তুমি হয়ত ভুলে যাচ্ছো একজন ব্যক্তি যে আজীবন তার বন্ধুকে কোনও স্বীকৃতি দিল না, সে কিনা নিজের মৃত্যুর পর এই উদারতা দেখানোর সাহস দেখাবে? তাও আবার ওনাদের মতো মানুষ।
- তাহলে?
সেই রাতে খাওয়ার টেবিলে আমার এই প্রশ্নের উত্তরে স্বর্ণালী শুধু বলল,
- তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আশা করি আগামীকাল দিতে পারব, ভাস্কর।
স্বর্ণালীর মুখে যেটুকু শুনলাম তারপর আমি ওই রাতে কিছুতেই ঘুমাতে পাচ্ছিলাম না। রাতটা মনে হচ্ছিল যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। আমাবস্যা না হয়েও চারিদিকটা যেন ঘোর অন্ধকার। মনের মধ্যে তখন একাধিক প্রশ্ন জাগছে। কে যে আসল অপরাধী আমি কিছুতেই ঠাউর করতে পারছি না। কেন জানি না আমার সবাইকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আসলে এই কেসটার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটা মানুষ যেন অক্টোপাসের এক একটা পায়ের মতো। অমলেন্দ বাবুর উপর তাদের প্রত্যেকেরই রাগ রয়েছে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সর্বপ্রথম যে খবরটা পেলাম, তা শুনে বুঝলাম আমার গতরাতের আশঙ্কাটাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। হ্যাঁ, এই কেসে কোনও একজন নয়, রয়েছে দুজন অপরাধী। আরও স্পষ্ট করে বললে অমলেন্দুবাবুকে দুজন মিলে হত্যা করেছে। কিন্তু সেই দুজন কারা, তা জানতে আমায় স্বর্ণালী বাড়ি না ফেরা অবধি অপেক্ষা করতে হলো।
রাতে যখন স্বর্ণালী কেসটা সমাধান করে বাড়ি ফিরল, আমি বেশ কৌতূহল নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
- স্বর্ণালী, শেষ অবধি কারা অপরাধী রূপে চিহ্নিত হলো গো?
উত্তরে স্বর্ণালী আমাকে এক দীর্ঘ অধ্যায়ের কথা বলতে আরম্ভ করল। সেদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও প্রথম গেছিল বারুইপুর থানা কারণ সেখানেই পুলিশ বিনয়বাবুকে তুলে নিয়ে আসে। তাকে হেফাজতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে ওরা সক্ষম হয় এটা জানতে যে এই সইটা উনি ছল পূর্বক অমলেন্দুবাবুকে দিয়ে করিয়েছিলেন এবং ওনার মৃত্যুর পিছনে রয়েছে আরও একজন। তবে, সেটা কে এই বিষয় বিনয়বাবু সঠিক ভাবে কিছু বলতে পারে নি। কারণ একটাই। হ্যাঁ, সেই ব্যক্তি সর্বদা পর্দার আড়াল থেকেই যাবতীয় কাজ করেছেন। বিনয়বাবুর কথায়,
- হ্যাঁ, ম্যাডাম। আমি স্বীকার করছি, ছলের আশ্রয় নিয়ে আমি সইটা অমলেন্দুকে দিয়ে করিয়েছিলাম। আসলে কিছু মাস আগে আমার কাছে একটা ফোন আসে। পুরুষ কণ্ঠ।
- পুরুষ কণ্ঠ?
প্রশ্নটা স্বর্ণালী বিনয়বাবুর দিকে ছুঁড়ে দিতেই ওনার জবাব এলো,
- আজ্ঞে, হ্যাঁ। ম্যাডাম। পুরুষ কণ্ঠ। আমাকে বলা হয় যে অমলেন্দুকে খুন করার পরিকল্পনায় আমি যদি তাকে সঙ্গ দি, তাহলে ওর সমস্ত সম্পত্তির আশি শতাংশ পাব আমি এবং মাত্র কুড়ি শতাংশ সে নিজের জন্য রাখবে। প্রস্তাবটা পাওয়ার পর, বিষয়টা ভাবার জন্য আমি তার কাছে থেকে কিছুটা সময় চাই। আর এর মাঝে কেটে গেল পাঁচ পাঁচটা দিন। সেই বিকেলে লন্ডন ফেরত এক ক্লাইন্ট প্রজেক্টের সফলতার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমাকে দিতে চাওয়ায়, লক্ষ্য করেছিলাম অমলেন্দু খুব একটা খুশি হয়নি বরং ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট ঊর্মিলাকে এই কাজের কৃতিত্ব দিতে ও বেশি আগ্রহী ছিল। এতে আমার খুব অপমান লাগে এবং দিনের পর দিন এইভাবে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আর কাজ চালিয়ে যেতে পারছিলাম না। সেইজন্য বাধ্য হই সেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা ওই পুরুষ কণ্ঠের প্রস্তাবে।
সাময়িক একটু থামার পর, সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবু ওনার দিকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিতেই, সেই গ্লাসের জলে বিনয়বাবু নিজের তৃষ্ণা মেটানোর পর বাকি কথা বললেন,
- তারপর ওই ব্যক্তির পরিকল্পনা মাফিক আমি উইলে অমলেন্দুর সই নিলাম এবং অপেক্ষায় রইলাম তার বাকি নির্দেশের। সেদিন রিইউনিয়নে আমি যখন ইমতিয়াজ ভাইয়ের বাড়িতে উপস্থিত ছিলাম, তখনই একটা ম্যাসেজ আসে ফোনে। তাতে লেখা ছিল- ডিনারের পর বাড়ির মেইন সুইচ অফ কইরা দিও।
কথাটা শেষ করেই বিনয়বাবু নিজের ফোনে থাকা ওই ম্যাসেজটা স্বর্ণালী সহ ওখানে উপস্থিত বাকি পুলিশ কর্মীদের দেখালেন এবং সেইসঙ্গে বললেন,
- আমি একেবারেই হকচকিয়ে গেছিলাম। ভাবলাম আমাদের বন্ধুদের মধ্যে থেকে কেউ এই কাজটা করছে না তো? কারণ ওখানে উপস্থিত বাকিদেরও অমলেন্দুর উপর যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। তবে, আমি আর অতকিছু না ভেবে তখন সেই নির্দেশ মতো ওই মেইন সুইচ অফ করে দি এবং তারপর যা ঘটল সেটা আপনারা জানেন।
- আমরা জানি কি?
প্রশ্নটা স্বর্ণালী বিনয়বাবুকে করতেই ওনার উত্তর,
- ওই যে আমার মতো আপনারাও জানেন যে ওখানে উপস্থিত বাকিদের মধ্যেই আসল অপরাধী রয়েছে।
- যদিও বা আপনি এই কেসের অন্যতম এক অপরাধী। তাও সেই পর্দার আড়ালে থাকা মূল অপরাধী বলে আপনার কাকে মনে হয়, বিনয়বাবু?
এইবার বেশ গম্ভীর ভাবে উনি বললেন,
- আমার সন্দেহ হয় ইমতিয়াজ ভাইকে। আসলে ওর বউ মানে এশার সঙ্গে অমলেন্দুর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল আর কোনও স্বামীর পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। হতে পারে ওকে মারতেই এই রিইউনিয়নটা নিজের বাড়িতে ইমতিয়াজ ভাই আয়োজন করেছিল।
বিনয়বাবুর সমস্ত কথা শুনে স্বর্ণালী আর সময় নষ্ট করতে চাইল না। অমলেন্দুবাবুর স্ত্রী সহ এই কেসের প্রত্যেক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ওর নির্দেশ মতো বারুইপুর থানার ওসি সনাতন বাবু থানায় দেখে পাঠালো।
(৯)
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই থানায় এসে উপস্থিত হলেন। চন্দ্রনাথ সরকার, অনন্যা দেবী এবং দীনেশ গুপ্ত প্রথমে এসে পৌঁছালেও ইমতিয়াজ আলী কিন্তু স্ত্রী এশা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে একটু দেরি করেই ঢুকলেন। ওনাকে অবশ্য এই দেরি করে ঢোকার কারণে বলতেও শোনা গেছিল,
- আসলে রোজার কারণে আমাদের আসতে একটু দেরি হয়ে গেল, আমাদের মার্জনা করবেন।
- হুম! তা এবার মূল কথায় আসি তাহলে।
- হ্যাঁ, মূল কথায় আসুন। খামকা আমাদের এখানে ডেকে এনে সময় নষ্ট করছেন কেন সেটা বলুন।
কঠোর শব্দ প্রয়োগ করতে থাকা দীনেশ গুপ্ত তখন নিজের বক্তব্য শেষ করে তাকিয়ে ছিলেন স্বর্ণালীর দিকে। উনি ভাবছিলেন স্বর্ণালীও ওনাকে পাল্টা কিছু বলবে। কিন্তু বইয়ে পড়া গোয়েন্দা আর আমাদের পুলিশের গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্টের ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের মধ্যে যে অনেকটাই তফাৎ রয়েছে, সেটা হয়ত দীনেশবাবু ভুলে গেছিলেন। স্বর্ণালী ওনার কথায় কোনও গুরুত্ব না দিয়ে বরং অনন্যা দেবীর দিকে চেয়ে বলতে লাগল,
- আপনার স্বামীর হত্যার পিছনে থাকা অপরাধীদের আমরা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি অনন্যা দেবী। তবে, অপরাধী কিন্তু একজন নয়, দুজন।
কথাটা শেষ হতে না হতেই অনন্যা দেবী বলে উঠলেন,
- কি? দুজন?
- হ্যাঁ। আর সেই দুজন এই থানার মধ্যেই উপস্থিত রয়েছেন।
কথাটা বলা মাত্রই ওনারা একে অপরের দিকে এমন ভাবে তাকাতে লাগলেন যেন মনে হবে ওনারা নিজেরাই একে অন্যকে দোষী ভাবতে শুরু করেছেন। সেই দেখে স্বর্ণালী আর সময় নষ্ট না করে শঙ্কর ওরফে হেড কনস্টেবলকে ইশারায় বিনয় দত্ত ওখানে নিয়ে আসার জন্য বলল এবং শঙ্কর ওনাকে নিয়ে আসতেই অনন্যা দেবী বলে উঠলেন,
- একি বিনয়কে আপনারা এখানে ধরে এনেছেন কেন? তার মানে বিনয় অমলেন্দুকে মেরেছে?
- আজ্ঞে, না। আপনার স্বামীকে বিনয়বাবু মারেন নি। ওনাকে মারতে আসল অপরাধীকে সে কেবল সাহায্য করেছে। বলতে পারেন, এই হত্যা কাণ্ডের সহযোগী হিসাবে বিনয়বাবু কাজ করেছেন।
উত্তর দিল স্বর্ণালী। যা শুনে বাকিদের মধ্যে থেকে ইমতিয়াজ আলী বলে উঠলেন,
- হে আল্লাহ্! বিনয় শেষে কিনা তুমি? এটাও কি সম্ভব! আমরা তো ভাবছিলাম অমলেন্দু দার মৃত্যুটা নিয়ে পুলিশ অযথা জলঘলা করছে। কিন্তু...।
না, কথাটা আর শেষ করতে দিল না স্বর্ণালী। ও বলতে লাগল,
- ইমতিয়াজ বাবু, আপনার হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে। অমলেন্দু জানার মৃত্যু হয় বিষক্রিয়ায়। ওনার মদের গ্লাসে বিষ পাওয়া গেছে। এটা জানা সত্ত্বেও আপনি কীভাবে বলতে পারছেন যে আমরা অযথা জলঘলা করছি? আমার তো মনে হয় আপনারা প্রত্যেকেই ওনাকে মারার পরিকল্পনা করছিলেন।
সবাই অবাক হয়ে একে অপরের মুখ দেখতে লাগলেন এবং ওনাদের মধ্যে থেকে দীনেশবাবু বেশ রেগে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
- ম্যাডাম, আপনি কি বলছেন বলুন তো? বিনয় যদি দোষী হয়ে থাকে, তাহলে ওকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করুণ। ওর সঙ্গে আবার আমাদের মধ্যে থেকে কাকে জড়াতে চাইছেন?
- কাউকে জড়ানো আমাদের কাজ নয় দীনেশবাবু, যদি না সে নিজে থেকেই এর মধ্যে জড়িয়ে থাকে। সেই মূল অপরাধীর কথায় আসার আগে বিনয়বাবুর মুখে থেকে ওনার স্বীকারোক্তিটা আরও একবার শুনে নিন।
এই বলে স্বর্ণালী বিনয়বাবুকে আরও একবার নিজের কৃতকর্মের কথা সবার সামনে খুলে বলতে বললেন এবং বিনয়বাবুও বেশ করুণ মুখে তা বলতে লাগলেন। যা শোনার পর, সবাই বিস্মিত হয়ে গেল।
এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, অমলেন্দুবাবুর স্ত্রী হয়েও অনন্যা দেবী যতটা না কান্নায় ভেঙে পড়লেন, তারচেয়ে অনেক বেশি ভেঙে পড়েছেন এশা দেবী। আর এখানেই প্রশ্ন জাগতে পারে, আসল অপরাধী অনন্যা দেবী নয়ত?
উত্তরটা পেতে খুব একটা সময় লাগল না। কারণ কথায় আছে অপরাধী যতই বুদ্ধিধর হোক না কেন, সে ঠিকই কোনও না কোনও ভুল করেই থাকে। কোনও অপরাধ আসলে নিখুঁত হয় না। আর এখানেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছে।
এতক্ষণ যিনি সবার মাঝে থেকেও চুপ করে ছিলেন সেই চন্দ্রনাথবাবুর দিকে তাকিয়ে স্বর্ণালী বলল,
- আচ্ছা, চন্দ্রনাথ বাবু। আপনি টাকা ফেরত না দেওয়ার কারণে অমলেন্দুবাবুর কাছে প্রায়শই অপমানিত হতে হতে রাগে ওনাকে আবার হত্যা করার পরিকল্পনা করেননি তো?
- কেমন কথা কন আপনি, ম্যাডাম? ওকে আমি মারতে যাইব ক্যান? এই সমস্ত বাজে কথা কইয়া অযথা আমাদের সময় নষ্ট করেন না।
স্বর্ণালী ওনার কথার সেইভাবে কোনও উত্তর না দিয়ে বরং হাসি মুখে বলল,
- অযথা তামাশা করা পুলিশের স্বভাব নয়। ঠিক কথা বলছি কিনা এবারই টের পাবেন চন্দ্রনাথবাবু।
এই বলে স্বর্ণালী সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবুকে বিনয়বাবুর হস্তান্তর করা ফোনটা নিয়ে আসার জন্য বলল এবং সে ফোনটা নিয়ে আসার পর, ওই ম্যাসেজটা আবারও বের করে সবার সামনে তুলে ধরল স্বর্ণালী। তারপর প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে একটাই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল স্বর্ণালী,
- দেখুন, তো ম্যাসেজটা ভালো করে পড়ে কিছু বুঝতে পারছেন কিনা।
সবাই ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ম্যাসেজটা পড়তে লাগল- ডিনারের পর বাড়ির মেইন সুইচ অফ কইরা দিও।
দীনেশবাবু সবার আগে বলে উঠলেন,
- একি! 'কইরা' শব্দটা তো একটা বাঙাল শব্দ। তার মানে কি তুমি চন্দ্রনাথ?
- ওই একখান ম্যাসেজ দিয়া কিসসু প্রমাণ কইরা যাবে না, ম্যাডাম। আমি কোথাও ভুল করসেন।
চন্দ্রনাথবাবুর এই কথার উত্তরে হেসে উঠল স্বর্ণালী, সাব ইন্সপেক্টর রাজেশবাবু, এমনকি ওই থানার ওসি সনাতন বাবুও। স্বর্ণালী হাসতে হাসতে বলল,
- শুধু একটা ম্যাসেজ দিয়ে যে এটা প্রমাণ করা যাবে না, সেটা আমি ভালো করেই জানি চন্দ্রনাথবাবু। তবে, কি বলুন তো। এই দুনিয়ায় প্রযুক্তির কাছে আপনি হেরে গেলেন। আপনার ব্যবহৃত যে সিমটা থেকে এই ম্যাসেজটা এসেছিল, তার IMEI ট্র্যাকিং এবং সেল টাওয়ার অনুসন্ধান করে আমরা দেখেছি। আপনার বাড়ির লোকেশনে বেশ কয়েকবার এই সিমটা অন করা হয়েছে আর বিশেষ করে এই ম্যাসেজটা নিজের বাড়িতে বসেই তো পাঠিয়েছিলেন আপনি, তাই না? আপনার বাড়ির পিছনের ডাস্টবিনের একটা কালো মোড়ানো প্লাস্টিকের মধ্যে থেকে সিমটা উদ্ধার করা হয়েছে। হয়ত কার্যসিদ্ধির পর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণেই সিমটা ওইভাবে ওখানে ফেলে দিয়েছিলেন। এখন তাই আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং সিমে থাকা ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে দেখলেই, বাকিটা আর বলার প্রয়োজন পড়বে না।
রাগে যেন তখন ফুঁসছে চন্দ্রনাথবাবু। ওনার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেছে। দাঁত চিপে উনি বললেন,
- কি বলতে চাইছেন?
- আমি তো শুধু এইটুকু বলতে চাইছি যে আপনি রিলের দুনিয়ার চিত্রনাট্য লিখতে লিখতে এই হত্যার চিত্রনাট্যটাও মন্দ রচনা করেননি। তবে, আপনার এই আড়াল থেকে নিজের কার্যসিদ্ধি করার পুরো পরিকল্পনাটা আজ আমাদের কাছে পরিষ্কার। বিনয়বাবুর কাছে নিজের পরিচয় গোপন রেখে যথাযত ভাবে চেষ্টা করেছেন নিজের ভাষা বদলে অমলেন্দুবাবুর হত্যার পরিকল্পনায় ওনাকে কাজে লাগাতে। পর্দার আড়ালে থাকা আসল অপরাধী আপনি। হ্যাঁ, আপনি মিঃ চন্দ্রনাথ সরকার।
স্বর্ণালীর কথা শেষ হতেই চন্দ্রনাথবাবু ওর হাতে পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু এমন কার্যের জন্য ক্ষমা কি মেলে? না, একেবারেই নয়। আর তাই ওই মুহূর্তে চন্দ্রনাথবাবুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে সিমটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো পরীক্ষার জন্য।
(১০)
- আচ্ছা, স্বর্ণালী রিপোর্টে নিশ্চয়ই সিমে থাকা ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে ওনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে গেছে?
- হ্যাঁ, সেটা আর বলতে। সন্ধ্যেবেলায় যখন রিপোর্ট হাতে এলো, আমরা তখনই চন্দ্রনাথবাবুকে গ্রেপ্তার করি।
- উনি তাহলে নিজের অপরাধ স্বীকার করলেন?
- হ্যাঁ। ওনাকে তো স্বীকার করতেই হতো। রিপোর্ট মিলে যাওয়ার পর উনি বাধ্য হন আমাদের সমস্তটা জানাতে। রিইউনিয়নের দিন ইমতিয়াজ আলীর বাড়িতে রাতের খাওয়ার পর একমাত্র অমলেন্দুবাবুই মদ্যপান করছিলেন। টেবিলে উপর রাখা মদের বোতলটার ছিপিও ছিল খোলা সুতরাং সুযোগ এসে যাওয়ায় চন্দ্রনাথবাবু আর সময় নষ্ট করেননি। বিনয় দত্তকে চটজলদি সবার আড়ালে একটা ম্যাসেজ মারফৎ উনি মেইন সুইচ অফ করে দিতে বলেন এবং কাজটা বিনয়বাবু করতেই, ওই অন্ধকারের মধ্যে উনি পকেট থেকে বিষটা বের করে সামনে রাখা মদের বোতলে মিশিয়ে দেন। তারপর আলো আসতেই বাকি ঘটনা সকলের সামনে ঘটল।
- আচ্ছা, স্বর্ণালী এবার নিশ্চয়ই কেসটা কোর্টে উঠবে?
উত্তরে স্বর্ণালী বলল,
- হ্যাঁ, ভাস্কর। কেসটা আগামীকালই কোর্টে উঠছে। আমি সেই কারণে আজই এই কেস সংক্রান্ত সব ফাইলগুলো কমপ্লিট করে ভবানী ভবনে স্যারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।
মুখে একগাল হাসি নিয়ে বললাম,
- তাহলে তো বলতেই হচ্ছে আমার মিসেস বেশ ভালো ভাবেই সফল হলো তার প্রথম মার্ডার কেস শলভ করতে।
ঠোঁটের কোণে তখন হাসি রেখে স্বর্ণালীও আমাকে বলল,
- দাঁড়াও, ভাস্কর। দাঁড়াও। সবে তো কেসটা কোর্টে উঠছে। একটা কথা জানবে, যতক্ষণ না অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে, ততক্ষণ মার্ডার কেস পুরোপুরি ভাবে শলভ বলা চলে না।
- বুঝলাম, ম্যাডাম। কিন্তু তোমার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না। স্রেফ একটা ম্যাসেজের কয়েকটা শব্দ পড়েই আড়ালে থাকা অপরাধীকে চিহ্নিত করে ফেললে। সত্যি, তোমাদের মতো অফিসারা আছে বলেই সমাজের বুকে এখনও ঘটে যাওয়া অপরাধের সঠিক তদন্তের ফল মেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অনেকের মুখে আজও শোনা যায় যে পুরুষের তুলনায়, মহিলারা নাকি পিছিয়ে!
- কি আর করা যাবে, ভাস্কর। সবার চিন্তা ভাবনা তো আর জোর করে পাল্টাতে পারব না সুতরাং নিজের কাজটাই আজীবন সততার সঙ্গে পালন করে যেতে চাই।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্বর্ণালীর দিকে এগিয়ে এলাম এবং আলতো করে ওর কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বললাম,
- তুমি হলে আমাদের বাড়ির গর্ব আর সেই গর্ব যতদিন এই উর্দিতে থাকবে, ততদিন সমাজে জয়ের ধ্বজা উড়বে, উড়বেই।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment