![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
গ্লুকোমিটার
দিলীপ দাসবিশ্বাস
ধীরে ধীরে আমার ধৈর্যচ্যূতি ঘটছে। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে, ঘেন্না হচ্ছে। বিনা দোষে একজন স্পেশালিষ্ট ফিজিসিয়ানকে খুনির মতো লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে. মফস্বল শহরের সাধারণ হোটেলে তিনদিন গা ঢাকা দিয়ে আছি। বন্ধু তন্ময় সব ব্যবস্থা করেছে। ভায়োলেন্ট মব যখন হসপিটাল ভাঙচুর করছিল, আমার নাম ধরে চিৎকার করছিল, তখন হসপিটাল স্টাফরা আমায় প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছিল, “স্যার, বদমাসগুলো সব-গেটে পার্টির ঝাণ্ডা নিয়ে পাহারা দিচ্ছে, আপনি গেলে ঝামেলায় পড়বেন। হসপিটালের বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট নিয়ে যাবার জন্য ওপাশে একটা দরজা আছে, ওটা দিয়ে গেলে বড়রাস্তায় পৌঁছানো যায়। তন্ময় স্যার আপনাকে আপাতত এখনেই থাকতে বলেছেন। উনি এক্ষুনি আসবেন...।”
মিনিট কয়েকের মধ্যে সেই পিছনের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে তন্ময় ঢুকল। তন্ময় আমার কলিগ কাম বেস্ট ফ্রেন্ড। ঝড়ের গতিতে বলতে শুরু করল, “অর্ণব শোন, হাতে সময় নেই, চটপট শুনে নে। ইউ আর নট সেফ হিয়ার। আমি যে-দরজা দিয়ে এলাম, ওই দিক দিয়ে বেরিয়ে যা। সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারকে সব বলা আছে। তিন ঘন্টার জার্নি। এই ছোট্ট নোটবুকটা রাখ, গাড়ীতে যেতে যেতে পড়ে নিবি। কোথায় যাচ্ছিস, কোথায় থাকবি স-ব লেখা আছে।” ক্ষণিকের জন্য থেমে তন্ময় পকেট থেকে ছোট একটা কাগজের মোড়ক বের করে বলল, “মোবাইল থেকে তোর সিমটা বের করে নষ্ট করে দিস রাস্তায়, আর এই সিমটা মোবাইলে ঢুকিয়ে নিস। আমার কোয়ার্টার থেকে আনালাম, পারমিতা এটা ইউজ করত না। বাট নেভার মেকে এ কল, ইট উইল বি এ ব্লান্ডার। পুলিশ তোর ঘনিষ্ট সবার মোবাইল ধরে লোকেসন ট্র্যাক করবে। তাই প্রয়োজন মতো আমিই অন্য কারো ফোন থেকে কল করব তোকে।” সেইদিন থেকে তন্ময়ের একটা ফোনের অপেক্ষায় আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। ওদিকে হাসপাতালে কী চলছে কোনও আপডেট পাচ্ছি না…
বিকালে সাড়ে তিনদিনের গভীরঘুম ভেঙে মোবাইলটা জেগে উঠল।আমি “হ্যালো” বলতেই ওপার থেকে তন্ময়ের গম্ভীর গলা, “শোন্, ফোন করছি এই নাম্বারটাও পারমিতার। যাক্গে, লেটেস্ট সিচুয়েশন তোর জানা দরকার। ঘাবড়ে যাস না। এ-দিকে, ওরা ঝান্ডাধারী-পার্টি লেলিয়ে দিয়েছে। তুই জানিসই তো, আজকাল পার্টির দাদাদের ট্যাঁকে মাল ঢুকলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মতো ঝান্ডা-শ্লোগান-ধর্ণা-ধোলাই সব আইটেম টাইমলি আপসে এসে যায়। আমাদের অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য পুলিশের ওপর প্রেসার রেখেছে। পুলিশের প্রশ্ন, তুই ভুল না-করলে অ্যাবস্কন্টেড কেন? আমরা বলেছি, পারসোনাল সেফটি…। ঝান্ডাধারীরা কনফিডেন্সিয়ালি জানিয়েছে, পেসেন্টের বউকে কুড়ি লাখ দিলে পুলিশ-কেস হবে না।”
“মাই গড! ওরা নেতিয়ে পড়া ডীপলি কোমাটোজ পেসেন্টকে নিয়ে এসে উল্টে কুড়ি লাখ টাকা ডিমান্ড করছে? ইটস ডায়ার ব্ল্যাকমেলিং !”
(পৃঃ- ২)
তন্ময় বলল, “ওরা জানে, বারগেনিং-এ কিছুটা কমবে। তারপরে পার্টির দাদা তো অর্ধেক নেবে…”
“ঠিক বলেছিস, একদম গুছিয়ে জাল ফেলেছে! বল তো, এরা এতো সাহস পায় কী করে?”
“চারিপাশে দুর্নীতির জঙ্গল বিড়ালকেও বাঘ বানিয়ে দিচ্ছে। বেপরোয়া লোভ। যে ভাবে সব অ্যালিগেসনগুলো পুলিশের কাছে প্লেস করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে পিছনে কোনও ঘাগু মাথা কাজ করছে। শুনলাম, পেসেন্টের বউ তোর এগেন্স্টে থানায় ডায়েরি করেছে। 'মহিলা থানায় বলেছে যে, ভুল ট্রিটমেন্টের ফলে ওর স্বামী মারা গেছে’..., হাসপাতালে ভর্তি করার সময় নাকি ওর স্বামীর জ্ঞান ছিল। কিন্তু শিরায় একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া এবং স্যালাইন চালানোর পরই ওর স্বামী মারা গেছে। ওগুলো না-দিলে নাকি পেসেন্ট মরতো না।”
আমি রেগে চেঁচিয়ে উঠলাম, “বললাম তো ইমারজেন্সিতে যখন পেসেন্টকে আনা হয়, তখন পেসেন্ট ছিল ডীপ কোমায়। ভদ্রলোক আমার মুখ-চেনা। ওপিডি-তে আমাকেই দেখাত, বহুবছরের ডায়েবেটিক। ইমিডিয়েটলি পর পর দু'বার ব্লাডসুগার টেস্ট করে দেখি, ব্লাডসুগার ২৮ এবং ২৬। ‘হাইপোগ্লাইসেমিক কোমা’! তক্ষুনি এই-কেসে যা-যা করণীয় সবই করি। আমি, আর.এম.ও পলাশ এবং দু’জন সিস্টার এই পেসেন্টকে নিয়ে দেড়ঘণ্টা ধরে লড়াই করেছি। কিন্তু পেসেন্টকে রিভাইভ করাতে পারিনি...। কেসসিটে এভরি মিনিটের প্রসিডিংস লেখা আছে। ভর্তির সময় ওর স্ত্রীকে অফিসিয়ালি জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পেসেন্টকে খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে ভর্তি করা হয়েছে। মস্ত ধান্দায় এখন সব উল্টো গীত গায়ছে!”
“সবই শুনেছি আমি... ” “অন্যের মুখে শোনার মধ্যে ভুল থাকতে পারে। তুই এসেছিলি অনেক পরে। তখন আমি প্যানিকড্, কথা বলার অবস্থায় ছিলাম না। তা ছাড়া, তখন তুই আমার সেফ-সিকিওরড সেল্টারের জন্যে ফোনে ব্যস্ত। তুইই সাবধান করলি, এরা আমায় পুলিশ দিয়ে অ্যারেস্ট করাতে পারে। আমি ভাবছি― শিক্ষিত রোগী, সব বোঝানো ছিল! তবু হাইপোগ্লাইসেমিক কোমা-তে পেসেন্ট গেল কী করে? এটা অ্যাক্সিডেন্ট না সুইসাইড? আর হলুদজামা পরা ওই লোকটার এত হম্বি-তম্বি কেন ? নিশ্চয় কিছু রহস্য অছে, খুঁজে আমি বার করবই। তন্ময়, তুই আমার হাইড-আউটের ব্যবস্থা করেছিস, তোর মিসেসের আন-ইউজড মোবাইল-সিম খুলে আমাকে দিয়েছিস, যাতে পুলিশ আমার লোকেশন ট্র্যাক করতে না-পারে। তোর তো পুলিশের ওপর-মহলে একটু চেনা-জানা আছে, আমার আর একটা উপকার কর ভাই, প্লিজ"।
তন্ময় আন্তরিকতা নিয়ে বলল, “নিশ্চয় করব। তবে আরও কিছু খবর তোকে দেবার আছে। তোর কথা মতো সব এনকোয়্যারি করলাম। ওই হলুদজামা-পরা লোকটা―যে তোকে
(পৃঃ - ৩)
মারমুখী হয়ে তেড়ে গেছিল, ওর নাম রতন, ওদের পাড়ার ওষুধের দোকানদারের চামচা। পাড়ায় কোয়াকগিরিও করে। অসুখের সূত্রে এই পেসেন্টের বাড়িতে যাতায়ত ছিল...।
এরপর আমি তন্ময়কে বলি, পুলিশ মারফত মৃতের বাড়িতে কয়েকটি বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে। অলরেডি দেরি হয়ে গেছে, আর যেন দেরি না হয়, তাহলে কোনও এভিডেন্স আর পাওয়া যাবে না।
পরের দিনই তন্ময় জানায় যে, আমার অনুমান সঠিক। পেসেন্টের গ্লুকোমিটারের মেমারি-রিডিং পুলিশ দেখেছে। হাতে পেয়েছে, প্রায় শেষ-হওয়া ইনসুলিন-ভায়াল। পুলিশি-জেরায় কাজের মেয়েটি একান্তে জানিয়েছে, বাচ্চা-কাচ্চা না-হওয়ায় স্বামী-স্ত্রী-র মধ্যে হামেশাই ঝগড়া লেগে থাকত। ওষুধের দোকানদারের সাথে পেসেন্টের স্ত্রীর সম্পর্কের দিকেও কাজের মেয়েটি সন্দেহজনক কিছু ইঙ্গিত করেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সেই চামচা রতনের সঙ্গে ...?”
“ না রে। ওটা তো উচ্চিংড়ে। ওর গুরু, ফার্মেসীর মালিককে নিয়ে। নাম বটকেষ্ট ডাক্তার।
“ডাক্তার?”
তন্ময়ের স্বরে হাসি, “হ্যাঁ, ডাক্তার। আবার কেষ্টও বটে। এলাকার নামী কোয়াক। ওই তো ইনসুলিন ইনজেকসন দিতে যেত মাঝে মাঝে। মৃতের স্ত্রী, ঠিকে কাজের মেয়ে, চামচা-উচিংড়ে, গুরু কোয়াকডাক্তার, মানে বাড়িতে যাতায়ত করতো সবারই দু’দিন আগে আঙ্গুলের ছাপ কালেক্ট করেছে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট। কাল-পরশু ফিঙ্গার প্রিন্টের রিপোর্ট এসে যাবে।”
আমি পরেরদিনই সোজা থানায় গিয়ে ওসিকে বলি, “আপনারা আমাকে খুঁজছেন, তাই নিজেই এলাম কিছু ইনফরমেশন শেয়ার করব বলে।”
ওসির মুখে হাসি, “না, আমরা সেভাবে সেরিয়াসলি খুঁজিনি। আমাদের কাছে খবর ছিল, সময় মতো আপনি থানায় আসবেন। বলুন কী জানাতে এসেছেন।”
“সেদিন ভর্তির সময় পেসেন্টের ট্রিটমেন্ট-ফাইল দেখতে গিয়ে জানতে পারি, সে ‘ইরেক্টাইল ডিসফাংসন’-এর জন্যে প্রায় এক বছর থেকে প্রাইভেটে ট্রিটমেন্ট করাচ্ছিল। স্থুলকায় ডায়েবেটিকদের ইরেক্টাইল ডিসফাংসনের সম্ভবনা থাকে। আর অনাত্মীয় ফার্মেসিওয়ালার প্রচন্ড তড়পানি ! আমার খটকা লাগে। ওর স্ত্রী বলেছিল, চার-পাঁচদিন ধরে পেসেন্ট ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগছিল। জ্বরের দুর্বলতায় রোগী সম্ভবত নিজে ইনসুলিন-ইনজেকশন নিতে পারত না। বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, মৃতের বাড়ি থেকে আপনারা গ্লুকোমিটার, ইনসুলিন-ভায়াল ইত্যাদি সিজ করেছেন এবং এনকোয়্যারি করে দেখেছে্ন,― গ্লুকোমিটারের মেমারিতে শেষ চারবারের ব্লাডসুগার রিডিং ৭৬, ৬৮, ৩৮, ৩২, ওদিকে ইনসুলিন-ভায়াল প্রায়-শেষ। স্যার, আপনাদের এই ইনফরমেশনগুলো সত্যি হলে আমি একটা মেডিক্যাল তথ্য দিতে পারি।”
(পৃঃ - ৪)
ওসি বললেন, “যদিও এই কেসটা আমি আর দেখছি না, আমার সিনিয়র এটা নিজে টেক-আপ করেছেন।। তবু আপনার ইনফরমেশন ভ্যালিড মনে হলে আমি সিনিয়ারের কাছে ফরোয়ার্ড করব। বলুন, শুনি আপনার মেডিক্যাল তথ্য।”
আমি বলতে শুরু করলাম, “যে কোনও মানুষের ব্লাডসুগার চল্লিশের নিচে নামলেই হাইপোগ্লাইসিমিক কোমা শুরু হবে। গ্লুকোমিটারের রিডিং দেখিয়েছে, এই পেসেন্টের শেষ দু’বারের ব্লাডসুগার ছিল ৩৮ এবং ৩২। আমাদের ইমার্জেন্সিতে দেখলাম আরও কম অর্থাৎ ব্লাডসুগার অত্যন্ত কমে-যাওয়া সত্ত্বেও ওকে ইনসুলিন দেওয়া হচ্ছিল, তারপর মৃতপ্রায় অবস্থায় হস্পিটালে আনা হয়। আবার টাকা-পয়সার অজুহাত দেখিয়ে তখন পেসেন্টকে আইসিইউ-তে নিয়ে যেতে দেয়নি। ইটস্ ওয়েল-প্ল্যানড্ মার্ডার! মোটিভের ইঙ্গিত তো কাজের মেয়েটিই দিয়েছে। এরপর 'ভুল ট্রিটমেন্ট'-এর হাওয়া তুলে আমাদের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতানোর ফন্দি! কোয়াকসাহেব একসাথে ডবল চাল চেলেছিলেন ! ভেস্তে দিল, পেসেন্টের গ্লুকোমিটার।"
“ডক্টর, কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্ট যদি ফার্মেসির গুরু বা চ্যালা কারোর সাথে ম্যাচ না-করে, তখন ?
“দেখুন স্যার, এই কেসে আমি যা যা গেস করেছি সব মিলে যাচ্ছে। কারন, একটাও ব্লাইন্ড গেস নয়। পারসপেক্টিভ, মোটিভ, পাস্ট হিস্ট্রি সব কিছু র্যাসেনালি স্টাডি করার পরই আমি ডিসিসনে এসেছি। তাই আমি সিওর গ্লুকোমিটারে বটকেষ্টর ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকবেই।”
ওসি বললেন, “চ্যালার নয় কেন?”
বললাম, “বটকেষ্ট যে ভাবে প্ল্যান করে কেসটা সাজিয়েছে তাতে বোঝা যায়, ইনসুলিনের ওভারডোজের রেজাল্ট নিয়ে ভালই গুগল ঘেঁটেছে সে। এটাও বুঝেছি, কোয়াকডাক্তার জানে- এই ধরণের অপকর্মে কোনও দ্বিতীয় ব্যাক্তিকে জড়ানো চরম বোকামি। তা ছাড়া, চ্যালা রতনের লাভ কি? পরকীয়া তো গুরু করছে। তাই হাইডোজে ইনসুলিন দেওয়ার বিষয়টা চ্যালার জানার কথা নয়।”
আমার কথা শেষ হলে, ওসি বললেন, "আপনি ডাক্তারির সাথে সাথে গোয়েন্দাগিরিও চালিয়ে যান, আপনার মগজাস্ত্র বেশ ধারাল। একটু আগে ফরেনসিক রিপোর্ট পেয়েছি, আপনার আনুমান নির্ভুল।"
No comments:
Post a Comment