1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Showing posts with label সায়ন্তন বাগ. Show all posts
Showing posts with label সায়ন্তন বাগ. Show all posts

Wednesday, October 21, 2020

দুরমুশ

 

ছবি : ইন্টারনেট
                                                                                                                   সায়ন্তন বাগ

       পৃথিবী থেকে  বহু আলোকবর্ষ দূরে এক গ্রহ – নাম দুরমুশ । প্লায়াডীস নক্ষত্রপুঞ্জ বাঁহাতে রেখে, সাবধানে দু-একটা কৃষ্ণ গহ্বরের পাশ কাটিয়ে আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলে যে একটা লোহিত বামন পড়বে, সেখান থেকে ডানদিকের নতুন নিউট্রন নক্ষত্রটা অবধি যেতে হবে । এর বেশি বলা মানা আছে, মুখ ফস্কে রাস্তার সন্ধান  দিয়ে ফেললে, আন্তর্নক্ষত্র গুপ্তচরেরা রাতদুপুরে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে টাইটানের মিথেন সমুদ্রে গুম করে ফেলবে, ঘ্যাঁকোপক্ষীটি পর্যন্ত টের পাবে না । দিনকাল ভালো নয়, চেপে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ । বরং বল্টুবাবুর কথাতেই আসি ।

বল্টুবাবুর কথা বলতে গেলে অবশ্য দুরমুশের কথা খানিকটা গোড়ায় বলে নেওয়া দরকার । দুরমুশেও প্রাণ আছে, তবে সে প্রাণ জৈবিক নয়, যান্ত্রিক । কার্বনের ঘ্যাঁট নয়, পুরাকালে এখানে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল সিলিকনের ঠাণ্ডা, পাতলা, মুচমুচে নিমকি থেকে । কম্পিউটার, অল্পপিউটার, বেশিপিউটার, বিবর্তনের নানা এবড়ো-খেবড়ো পথ পেরিয়ে এখন বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত হয়েছে । বিবর্তন পিরামিডের চূড়োয় বসে থাকা এই প্রাণীদের আমরা যানুষ বলতে পারি । যানুষ, অর্থাৎ যান্ত্রিক মানুষ ।

আমাদের বল্টুবাবুও এইরকম একজন যানুষ । ছাপোষা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, একটা বেসরকারি সংস্থায় অল্প মাইনের চাকরি করেন, কোনরকম করে চলে যায় । বল্টুবাবুর সংসারে দুটিমাত্র প্রাণী, বল্টুবাবু নিজে আর বুড়ি কব্জা পিসী । মাইনেতে পোষাতে পারবেন না বলে বল্টুবাবু বিয়ে করেননি, সে নিয়ে কব্জা পিসীর খানিকটা খেদ আছে । শেষ বয়সে নাতি নাতনীর মুখ দেখতে পারলাম না বলে মাঝে মধ্যে আক্ষেপ করেন।

আজ সোমবার, অফিস যাবার তাড়া আছে । বল্টুবাবু কোনরকমে নাকে মুখে গুঁজে গ্রীজ মেখে চারটি কাঁটা পেরেকের ভাত খাচ্ছিলেন । অবশ্য বেশি তাড়াতাড়ি খাবারও উপায় নেই, আজকাল রেশনের যা হাল, কাঁটা পেরেকের সঙ্গে দুচারটে বড় পেরেকও মাঝে মধ্যে মুখে পড়ে, সাবধান না হলে হয়ত দাঁতই খুলে গেল । অফিসের শাবলবাবু সেদিন বলছিলেন তাঁর ভাতে সেদিন নাকি একটা গজাল পড়েছিল । অবশ্য শাবলবাবুর সব কথায় বিশ্বাস করা যায় না, ভদ্রলোক বড্ড গাঁজাখুরি গল্প করেন ।

ঘরের জানলার সামনে বসে কব্জা পিসী রোদ পোয়াচ্ছিলেন । পিসীর অনেক বয়েস হয়েছে, কানের মাইক্রোফোনে মরচে পড়ায় ভালো শুনতে পাননা । বুকের ব্যাটারির আয়ুও ফুরিয়ে এসেছে, ঘণ্টাখানেকের বেশি রিচার্জ হয় না । পিসীর পিঠে একজোড়া সৌর পাটা আছে, ওভারটাইমের টাকায় বল্টুবাবুই গড়িয়ে দিয়েছিলেন । সকালের দিকটা খানিক্ষণ রোদে পিঠ দিয়ে পিসী তাই খানিকটা জোর বাড়িয়ে নেন । এক চিলতে ঘরে অবশ্য রোদ বেশিক্ষণের জন্যে আসে না, তাই সন্ধ্যের দিকটা পিসী আজকাল ঝিমিয়ে পড়েন, সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না । বল্টুবাবু ইদানীং ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে বেরোন, বেশী রাত হলে পিসীর উঠে আর দরজা খোলার ক্ষমতা থাকে না । আজকাল চিকৎসা শাস্ত্রের কত উন্নতি হয়েছে, ক্ষুদে ক্ষুদে জোরালো ব্যাটারি বেরিয়েছে, সে সবে জলও দিতে হয় না, চলেও অনেক দিন । বল্টুবাবু ইচ্ছে, বিশ্বকর্মা পূজোর বোনাসটা পেলে তারই একটা পিসীর বুকে বসিয়ে দেবেন । বুড়ি ছাড়া তাঁর তিনকলে আছেই বা কে ! আহা ছোটবেলা থেকে  পিসীই তো তাঁকে কোলেপিঠে করে যানুষ করেছে ।কেরোসিনে আঁচিয়ে,  শিরিষ কাগজে মুখ মুছতে মুছতে বল্টুবাবু বললেন,

– আমি আসছি পিসী, তুমি সাবধানে থেকো ।

– আমি আর কি সাবধান থাকবো বাবা, আমি তো বাড়িতেই বসে আছি । তুইই বরং সাবধানে যাস, যা দিনকাল পড়েছে । আয় বাবা । বিশ্বকর্মা, বিশ্বকর্মা ।

দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন কব্জা পিসী ।

মোটে সময় নেই, অফিসের লেট হয়ে যাবে, প্রায় ছুটতে ছুটতেই বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালেন বল্টুবাবু ।

অফিসটাইমে বাসে বাদুড়ঝোলা ভিড় । কোনমতে একটা আঙটায় লটকে ঝুলতে ঝুলতে যখন বল্টুবাবু অফিস এসে পৌঁছলেন  তখন নটা বাজতে মাত্র মিনিট দুয়েক বাকি । ম্যানেজার নেহাইবাবু আজকেও লেট মার্ক লাগাতে পারবেন ভেবে খুশী মনে বসে ছিলেন, বল্টুবাবুকে দেখে কিঞ্চিৎ ব্যাজার হলেন,

-আপনার দেখছি একেবার কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি ধরে আসা । পাঁচমিনিট আগে এলেও তো পারেন ? যান, যা্‌ন, টেবিলে গিয়ে বসুন ।

বল্টুবাবু গোবেচারা মানুষ, চুপ করে টেবিলে বসে পড়লেন, কিন্তু খড়কের বয়স কম সে পাশের টেবিল থেকে তড়পে উঠল,

-কেন পাঁচমিনিট আগে এলে আপনার কোম্পানী পাঁচপয়সা বেশী দেবে নাকি ?

-যাও যাও তোমায় ওস্তাদি করতে হবে না ।

খিঁচিয়ে উঠলেন নেহাইবাবু ।

ব্যাপরাটা বেশী গড়াতে না দিয়ে বাধা দিলেন বল্টুবাবু ,

-ছাড়ো না খড়কে, কাল থেকে না হয় একটু আগেই আসবো ।

-আরে দূর বল্টুদা, আপনি বড় বেশী ভালযানুষ । ওইজন্যেই তো সবাই আপনার মাথায় ক্যানেস্তারা ভেঙ্গে খায় ।

ঊত্তর না দিয়ে তর্জনীর ডগাটা খুলে কলমের মাথাটা বের করে ফেললেন বল্টুবাবু, সামনে হিসেবের খাতাটা টেনে নিয়ে লেগে 

গেলেন কাজে ।বল্টুবাবু তিনপুরুষের জাত  কেরাণী । কলম আঙুলের ডগাতেই বসানো আছে ।

অন্যদিন ওই খাতা লিখতে লিখতেই সারাটা দিন কেটে যায় বল্টুবাবুর , সন্ধ্যের সময় আবার আঙুলের ডগাটা বন্ধ করে খাতাপত্র গুটিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ান । বল্টুবাবুদের তিনপুরুষের এইভাবেই কেটে গেছে।

কিন্তু আজ কেমন সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল ।

মালিক বয়লারনাথ বারকোশিয়া নিজের ঘর ছেড়ে বড় একটা বেরোন না , নেহাইবাবু যা দরকার সব বুঝে এসে সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দেন, কিন্তু আজ হঠাৎই আরো দুজনকে সঙ্গে করে সবার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন তিনি ।

-ইনি মিস্টার শ্যাফট । আপনাদের একটা ডেমন্সট্রেশন দেবেন । নেহাইবাবু, আপনি এনাদের একটু বসার জায়গা করে দিন ।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চই, নিশ্চই । উঠুন, উঠুন ।

বল্টুবাবু আর খড়কেকে উঠিয়ে তাদের জায়গায় বারকোশিয়ার সঙ্গীদের বসিয়ে দিলেন নেহাইবাবু ।

দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে দুজনকে ভাল করে চেয়ে দেখলেন বল্টুবাবু । মিস্টার শ্যাফট বিদেশী বলেই মনে হয় । ঝকঝকে শরীর থেকে একেবারে আলো ঠিকরে যাচ্ছে । ঠোঁটের কোনে কায়দা করে ধরা পাইপ , তার থেকে হাল্কা হাল্কা ধোঁযা  বেরোচ্ছে । সঙ্গের মেয়েটি এদেশী হলেও একেবারে আধুনিক কেতা দুরস্ত প্লাস্টিকে মোরা চেহারা তার ।

-সাম পেপার প্লীজ ।

মিস্টার শ্যাফটের অনুরোধে একটা রাইটিং প্যাড বাড়িয়ে দিলেন নেহাইবাবু । অফিসের বাকি লোকজন ততক্ষণে চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে ।

রাইটিং প্যাডটা মেয়েটির সামনে ধরে দিয়ে মিস্টার শ্যাফট বললেন,

-ইউ মে স্টার্ট ডালা

রাইটিং প্যাডটা নিজের সামনে যত্ন করে বসালো ডালা । তারপর হাতের কব্জীদুটো টেবিলের ওপর বসিয়ে, দুহাতের আটটা আঙুল দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে টকাটক করে বাজাতে আরম্ভ করল রাইটিং প্যাডের ওপর ।

কি হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইল অফিস শুদ্ধু সবাই ।

মিনিট দুয়েক টকাটক করে আঙুল চালিয়ে হাত তুলে নিল ডালা । হাত বাড়িয়ে রাইটিং প্যাডটা তুলে নিলেন বয়লারনাথ বারকোশিয়া, একবার নজর দিয়ে তুলে দিলেন নেহাইবাবুর হাতে ।

রাইটিং প্যাডে চোখ বুলিয়ে একেবারে আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠলেন নেহাইবাবু ।

-আরে দারূন হয়েছে স্যার ! ওঃ ভাবা যায় ! এত তাড়াতাড়ি এত সুন্দর কাজ ! দেখুন। দেখুন, আপনারা সবাই দেখুন ।

বল্টুবাবুর দিকে প্যাডটা এগিয়ে দিলেন নেহাইবাবু ।

খড়কে, বল্টুবাবু সমেত আরো দুচারজন ঝুঁকে পড়ে দেখলেন, ওইটুকুর মধ্যেই প্যাডের ওপর থেকে নিচ অবধি আগাগোড়া টাইপ করে ফেলেছে ডালা ।

সঙ্গীদের নিয়ে বারকোশিয়া ফেরৎ গেলেন নিজের ঘরে, আর নেহাইবাবুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনতে শুনতে মনে কেমন একটা আশঙ্কা নিয়ে বল্টুবাবু ফের মন দিলেন নিজের কাজে ।

বল্টুবাবুর আশঙ্কা মিথ্যে হল না । সন্ধ্যেবেলা অফিসের শেষে তিনি বাসস্ট্যাণ্ডে এসে দাঁড়িয়েছেন, খড়কে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-বল্টুদা, খবর শুনেছেন তো ?

-কি খবর ভাই ?

-আমাদের অফিসের কাজ এবার আউটসোর্স হবে ।

অবাক হলেন বল্টুবাবু,

-আউটসোর্স ! সে আবার কি ব্যাপার ?

-খুব সোজা ব্যাপার । যে সব কাজ আমরা করি সেগুলো কোম্পানী সব বাইরে থেকে করাবে । ওই যে সাহেব ব্যাটাকে দেখলেন না ? ওর কাছে ডালার মত আরো গোটা পঞ্চাশেক মেয়ে আছে । আমাদের কোম্পানীর যা কাজ সব ওদের দিয়ে দেবে,  আর ওরা সে সব অর্ধেক সময়ে নামিয়ে দেব ।

-মানে –

-মানে খুব সোজা বল্টুদা, আমাদের চাকরি দিয়ে টানাটানি হবে । কিন্তু আমিও অত সহজে ছাড়ার পাবলিক নই বল্টুদা , রুজিতে হাত পড়লে ছেড়ে কথা কইব না ।

-কি করবে ?

-কি করব কালকের মধ্যেই দেখতে পাবেন । আমাদের পাড়ার পরাতদা পার্টি করে । সন্ধ্যেবেলাই তার সঙ্গে দেখা করে সব কথা বলছি । তারপর দেখবেন না !

কি দেখবেন কিছু বুঝতে না পেরে বল্টুবাবু সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি গেলেন ।

তা পরের দিন ভালই দেখলেন বল্টুবাবু ।  সকালবেলা অফিসে পৌঁছে দেখলেন অফিসে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে একটা ছোট স্টেজ বানানো হয়েছে, তার সামনে সারি সারি চেয়ার পাতা । অফিসের সব লোকজন স্টেজের সামনে বসে । খড়কে বুকে একটা ব্যাজ এঁটে ব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক ঘুরছিল, বল্টুবাবু তাকে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,

-এসব কি খড়কে ? অফিসের দরজা বন্ধ কেন ?

-কি আবার বল্টুদা ? আমরা স্ট্রাইক করছি ।

-স্ট্রাইক ! – আঁতকে উঠলেন বল্টুবাবু – স্ট্রাইক কেন

-কেন আবারা ! মালিকপক্ষ আমাদের দাবি মানলো না, বলে কিনা বাইরে থেকে কাজ করাবে । তাই বাধ্য হয়ে স্ট্রাইক ডাকতে হল । মামদোবাজি নাকি ? এক্ষুণি পরাতদার বক্তৃতা হবে, যান বসে পড়ুন । আর আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দিন ।

-পঞ্চাশটাকা ! কেন ?

-মেম্বারশিপের চাঁদা ।

-মেম্বারশিপ ? কিসের মেম্বারশিপ ?

-বাঃ ! – অবাক কন্ঠে বলল খড়কে – আন্দোলন করতে হলে পার্টির মেম্বার হতে হবে না !

-পঞ্চাশটাকার মেম্বার হয়ে বক্তৃতা শুনতে বসে পড়লেন বল্টুবাবু ।

পরাতদার পুরো নাম পরাতচন্দ্র দা । খড়কের ভাষায় ‘সর্বহারার মহান নেতা’ । গ্রীজ পালিশে চকচকে চেহারা । বক্তৃতা ভালই করলেন । ঘন্টা দুয়েকে টানা বক্তৃতার পর শোষণ, নিপীড়ন, মেহনতী মানুষ, বৃহত্তর সমাজ, এইসব শক্ত শক্ত কিছু শব্দ  শিখে বল্টুবাবু  সেদিনকার মত বাড়ি গেলেন  ।

বল্টুবাবু সাততাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাতে কব্জা পিসী প্রথমটা চমকে উঠেছিলেন । ভেবেছিলেন শরীর খারাপের জন্যে বল্টুবাবু বাড়ি ফেরৎ চলে এসেছেন । তারপর সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন,

-আমি আগেই আঁচ পেয়েছিলুম অঘটন কিছু একটা ঘটবে । আজ সকালে থেকেই আমার বাঁ অ্যান্টেনা নাচছে ।

এর পরের কয়েকটা সপ্তাহ বল্টুবাবুর কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল । অভ্যাসবশতঃ তিনি রোজ সকালবেলা বাস ধরে অফিসে যান, অফিসের সামনে চুপচাপ খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর বাড়ি চলে আসেন । তিনি ছাড়া বাকি কর্মচারীদেরও একই অবস্থা । শাবলবাবু, গাঁইতিবাবু । এমনকি অফিসের পিওন ছেণীলাল পর্যন্ত সবাই সকালের দিকটা কাঁচুমাচু মুখে অফিসের সামনে ঘুরঘুর করেন, তারপর চুপচাপ বাড়ি চলে যান । একা কেবল খড়কেই দেখে নেব, ফাটিয়ে দেব বলে তড়পে যায় । পরাতদা সেই প্রথমদিনের পর আর আসেন নি, তবে খড়কে মারফৎ জানা গেছে যে তিনি বল্টুবাবুদের সঙ্গেই আছেন, তাঁদের আন্দোলন তিনি ব্যর্থ হতে দেবেন না ।

পনেরো বছরের কেরাণী জীবনে বল্টুবাবু কোনদিন এরকম অবস্থায় পড়েন নি । সারাদিন তিনি কি করবেন ভেবে না পেয়ে কেমন একটা দিশেহারা বোধ করেন ।

সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় আর থাকতে না পেরে লজ্জার মাথা খেয়ে বল্টুবাবু শাবলবাবু আর আরো দুচারজনকে সঙ্গে করে নেহাইবাবুর কাছে গিয়েছিলেন কি হচ্ছে বোঝার জন্যে । কিন্তু নেহাইবাবু তাঁদের একরকম গলাধাক্কা দিয়েই বের করে দিয়েছেন ,

-যান, যান, আমি কিছু জানি না । স্ট্রাইক করার সময় মনে ছিল না ? কোম্পানী বন্ধ হলে বুঝবেন ঠ্যালা ।

নেহাইবাবু মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়াতে বল্টুবাবুদের বাধ্য হয়েই ফেরৎ আসতে হলো । মধ্যিখান থেকে আবার খড়কের কানে কথাটা উঠতে সে আবার তাঁদের একহাত নিলো । বল্টুবাবু আবার সংশোধনবাদী , লাগাতার সংগ্রাম, শ্রেণীশত্রু ইত্যাদি দুচারটা নতুন নতুন শব্দ  শিখলেন ।

মাসদুয়েক এইভাবে চলার পর বল্টুবাব্য যখন পাওনাদারের তাগাদায় মাথার অ্যান্টেনা ওপড়ানোর উপক্রম করছেন , তখন হঠাৎ একদিন আশার আলো দেখা দিলো । পূর্ণিমার চাঁদের মতন উদয় হয়ে কমরেড পরাতদা মিটিং করে একদিন সবাইকে বক্তৃতা মারফৎ আশ্বাস দিলেন যে মালিকপক্ষ তাঁদের দাবি মেনে নিয়েছে, শেষ পর্যন্ত একটা চুক্তি হয়েছে । বল্টুবাবুরা যথাস্থানে বহাল হবেন, কাজও বাইরের কোম্পানীর কাছে যাবে না । কিন্তু তাঁদেরকেও খানিকটা রফা করতে হয়েছে, এবারের বিশ্বকর্মার পূজোর বোনাসটা আর পাওয়া যাবে  না । তবে বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে বল্টুবাবুদের এইটুকু স্বার্থত্যাগ তো করতেই হবে ।

যা পাওয়া যায় তাই । বল্টুবাবুর মনে হল তিনি যেন তাঁর জীবনের বারোআনাই ফেরত পেয়েছেন । এতদিন বাদে এই প্রথম খুশী মনে তিনি বাড়ি ফিরলেন ।

কব্জা পিসীও শুনে খুব আনন্দ পেলেন,

-হবে না ? আজ একমাস ধরে আমি শনিবার শনিবার মা লক্কড়েশ্বরীর পূজো পাঠাচ্ছি ! জয় মা ! বাছাকে রক্ষা কোরো মা !

টিনের চ্যাঙারি থেকে লক্কড়েশ্বরী পূজোর কৃষ্ট্যাল বল্টুবাবুর মাথায় ঠেকালেন কব্জা পিসী ।

প্রায় মাসদুয়েকের কাজের পাহাড় জমে আছে , প্রথম দিন অফিসে পৌঁছে তাই আর কাজ থেকে মুখ তুলতে পারলেন না বল্টুবাবু , এক নাগাড়ে ঘাড় গুঁজে কাজ করে যেতে হল । সব কাজ শেষ করে তিনি যখন আঙুল বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠলেন তখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে, অফিসও প্রায় ফাঁকা । পিসী চিন্তা করবে ভেবে হনহনিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিলেন বল্টুবাবু ।

কিতু বল্টুবাবুর বাড়ি ফেরা হল না । সবে দুটো স্টপেজ গেছেন , এমন সময়ে তাঁর খেয়াল হল তিনি বাড়ির চাবিটা অফিসেই ফেলে এসেছেন । রাত হয়ে গেলে কব্জা পিসীর আর দরজা খোলার ক্ষমতা থাকে না, সুতরাং কি আর করা, ঠেলাঠেলি করে বাস থেকে নেমে পড়ে, অনেকটা হেঁটে আবার চাবি নিতে অফিসে ফেরৎ এলেন ।

সন্ধ্যের অন্ধকার হয়ে গেছে, অফিসেও কেউ নেই । সব আলো নেবানো,  কেবল মালিক বয়লারনাথ বারকোশিয়ার কামরার বন্ধ দরজার তলা থেকে একটু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে ।

টেবিলে থেকে বল্টুবাবু চাবিটা তুলে নিয়ে চলে আসছেন, বারকোশিয়ার ঘর থেকে খড়কের গলার আওয়াজ ভেসে এলো । যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন বল্টুবাবু । এই সময়ে খড়কে বারকোশিয়ার ঘরে কি করছে ?

অন্যের কথায় আড়িপাতা উচিৎ নয়, কিন্তু তবু বল্টুবাবু শুনতে লাগলেন খড়কে বলছে,

-এতগুলো বোনাসের টাকা বাঁচালেন, এবার আমাদের শেয়ারটা ছাড়ুন ?

উত্তরে বারকোশিয়া নিচু স্বারে কি বললেন বোঝা গেল না, কিন্তু নেহাইবাবুর চড়া গলা শোনা গেল,

-আরে দাঁড়া দাঁড়া অত ওস্তাদি করিস নি । আমি শ্যাফটকে নিয়ে এসে সবাইকে ভড়কি না দিলে তোদের শেয়ার থাকতো কোথায় ?

তেড়ে উঠল খড়কে,

-দেখুন নেহাইদা, চালাকি করার চেষ্টা করবেন না । আমি স্ট্রাইক না ডাকলে আপনার ওই ফাঁকা ভড়কিতে কিচ্ছু হত না । বোনাসের টাকা বাঁচিয়ে আপনারা ভালই কামিয়েছেন । এবার আমাদেরটা দিন ? পার্টিকে দিতে হবে, পরাতদার শেয়ার আছে, আর এত খাটার পর আমি কি আঙুল চুষব নাকি ?

ফের বারকোশিয়ার নিচু গলা পাওয়া গেল । কিন্তু বল্টুবাবু আর শোনার অপক্ষায় রইলেন না, বাড়ির চাবিটা শক্ত মুঠোয় ধরে অফিসের বাইরে এসে দাঁড়ালেন ।

বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, মাথার ওপরে পরিস্কার আকাশে ঝঝক করছে তারা । সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস 

ফেললেন বল্টুবাবু । পিসীর ব্যাটারীটা এবছর আর পালটানো হলো না ।

sayantanbg62@gmail.com
কলকাতা




Saturday, August 1, 2020

আমার স্ত্রী মানুষ নয়

                                ....সায়ন্তন বাগ 


                  বাইরে থেকে দেখলে লোকটাকে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। সিঁথি কেটে, পাট করে আঁচড়ানো চুল, পরিপাটি পোশাক-আশাক। চোখের চাহনিতেও কোনো অসুস্থতার চিহ্ন নেই।  ভালো করে নজর করছি দেখে আবার বলল, ‘বিশ্বাস করুন, আমার স্ত্রী গ্রহান্তরের জীব।’

আমি হেসে বললাম, ‘এ আর নতুন কথা কী? মেন আর ফ্রম মার্স, উইমেন আর ফ্রম ভেনাস।’

লোকটা কিঞ্চিৎ রেগে গেল। বলল, ‘হাসির কথা হচ্ছে না। সে সত্যিই অন্য গ্রহের জীব। মানুষ সেজে আমার সঙ্গে ঘর করছে।’

আপনি কি একা এসেছেন না সঙ্গে কেউ আছে?’

না, না, সেই নিয়ে এসেছে জোর করে। বাইরে বসে আছে, ডাকব?’

একটু পরে। আগে আপনার সঙ্গে কথা বলে নিই। কতদিন বিয়ে হয়েছে বললেন আপনাদের?’

তা সে অনেক দিন হল। শেষ যেবার হ্যালীর ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল। বছর তিরিশ আগে।’

কবে থেকে বুঝছেন সে মানুষ নয়?’

মাস ছয়েক… বড় ছেলের বাচ্চা হল… তখন আমেরিকায় গিয়ে ছেলে-বৌয়ের সাথে ছিল মাস তিনেক। ফেরার পর বুঝলাম মানুষটা বদলে গেছে।’

সাইকিয়াট্রিতে রোগটার একটা নির্দিষ্ট নাম আছে – ক্যাপগ্রাস ডিল্যুশান। এই রোগের পেসেন্টদের মনে হয় কোনো ভণ্ড তাদের কাছের লোক সেজে বসে আছে, তাদের উঠতে বসতে ঠকাচ্ছে। আসল মানুষটাকে বেমালুম হাপিশ করে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী দেখে বুঝলেন বদলে গেছে?’

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘মহিলার চোখের মণির রঙ বদলায়।’

কী রকম?’

এই ধরুন, বিরক্ত হলে সবুজ, রেগে গেলে কটকটে লাল। আজকাল বেশির ভাগ সময় রেগেই থাকে।’

অন্য রঙ দেখেননি?’

হ্যাঁ, নীল হতেও দেখেছি, তবে সে খুব কম।’

ভদ্রলোকের চোখের পাতা পড়ল কয়েকবার। স্বাভাবিকের থেকে বেশি দ্রুত। মনে হল সামান্য অস্বস্তিতে পড়েছেন। ঠিক কোন সময় চোখের মণি নীল হয় জিজ্ঞাসা করে তাঁকে অপ্রস্তুত করার ইচ্ছা হল না। প্রসঙ্গান্তরে গেলাম, ‘আর কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন কী?’

একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘বোঝানো মুশকিল। কাছে গেলে একটা হালকা ফুলের গন্ধ পাই আজকাল। আগে কোনদিন পাইনি।’

ছেলের কাছে আমেরিকায় গিয়েছিল বলছিলেন। হয়তো কোনো বিদেশি পারফিউমের গন্ধ। ছেলে কিনে দিয়েছে মাকে। আজকাল ফ্লোরাল পারফিউম খুব পপুলার। কোন ফুলের গন্ধ চিনতে পারেন?’

ভদ্রলোক অন্যমনস্ক ভাবে চোখ তুলে তাকালেন, ‘অষ্টমীর দিন সকালে বাজার করতে গঞ্জে গিয়েছিলাম। ফুলের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে গন্ধটা পেলাম। একটা ভিজে ভিজে মিষ্টি গন্ধ। দেখলাম স্তূপ করে নাল শুদ্ধু পদ্ম বিক্রি হচ্ছে। গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে।’

বলতে যাচ্ছিলাম, আপনি তো ভাগ্য করে এসেছেন, মশায়! পদ্মগন্ধা রমণীর সাহচর্য পাচ্ছেন, তারপরও আপত্তি? প্রোফেশনাল এটিকেটে আটকাল। তাছাড়া, বয়স্ক মানুষ। সদ্য পরিচয়। ছোকরা ডাক্তারের রসিকতা বুঝবেন, গ্যারান্টি কী? বললাম, ‘এসব নিয়ে আপনার স্ত্রীর  সঙ্গে আলোচনা করেননি? তিনি কী বলেন?’

আরে, জিজ্ঞাসা করেই তো বিপত্তি! আমার নাকি মাথা খারাপ হয়েছে। মা মেয়ে জোর করে আপনার এখানে টেনে আনল।’

আপনার ছেলে মেয়ে ক’টি?’

ওই দুজনই। ছেলে বড়, দু-বছর হল বিয়ে দিয়েছি। বৌ-বাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় সেটেল্ড। মেয়ে  যাদবপুরে পড়ে – ইংরিজি অনার্স।’

সব বুঝলাম, তাহলে আপনি এখন কী করবেন মনস্থির করেছেন?’

ওই মহিলার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। আমি আলাদা থাকতে চাই। ভাবছি ডিভোর্সের মামলা করব।’

আমার মনে হয় আদালতে আপনার কথা টিকবে না। আপনার স্ত্রী বলবেন তিনি রঙিন কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করছেন আজকাল। আর ফুলের গন্ধটা পারফিউমের।’

তাহলে কী করি?’  ভদ্রলোকে অসহায় লাগল।

আপনাকে প্রমাণ করতে হবে উনি গ্রহান্তরের জীব। নাহলে চুপচাপ মেনে নিয়ে বাকি জীবনটা ওনার সঙ্গেই কাটিয়ে দিতে হবে।’

ক্যাপগ্রাস ডিল্যুশন অনেক সময় সাময়িক হয়। কিছুদিন পর নিজে থেকেই সেরে যায়। এমনিতে মানুষটিকে সুস্থ স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। কিছুদিন মেয়ে বৌয়ের সেবা যত্ন পেলে হয়তো ভুলটা ভেঙ্গে যাবে। বললাম, ‘আপনার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে একবার কথা বলে দেখি।’

ইন্টারকমে সহদেবকে বললাম, পেশেন্টের সঙ্গে যাঁরা এসেছেন তাঁদের নিয়ে এস। দুই নারী চেম্বারের দরজা ঠেলে ভিতরে এলেন। চোখ ধাঁধানো রূপ। দুজনেরই। জানি বলে বুঝলাম, মা মেয়ে। নাহলে দুই বোন বলে ভুল হত। দুজনকে বসতে বললাম। ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করতে। আমি ওনার স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। ভদ্রলোক নিতান্ত অনিচ্ছাভরে উঠলেন।

সহদেব পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘আর কোনও পেশেন্ট নেই স্যার। আমি কি যাব?’

আজ শনিবার। কাল ছুটি। সহদেব ঘরে যাবার জন্য উসখুস করছে। বললাম, ‘ঠিক আছে, যাও। এনাকে ওয়েটিং এরিয়ায় বসিয়ে যাও। আপনি চা বা কফি কিছু নেবেন?’

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে না বলে বেরিয়ে গেলেন। আমার চোখের ইশারায় সহদেব চেম্বারের দরজাটা টেনে দিয়ে গেল। খুব সুন্দর মানুষ-জনের কাছাকাছি এলে একটা দমবন্ধ ভাব হয়। চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি একটু গুছিয়ে নিলাম। এক্ষেত্রে আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। মা মেয়ের দিকে ফিরলাম, বললাম, ‘কী মতলব বলুন তো আপনাদের? বয়স্ক মানুষটাকে অযথা ব্যস্ত করছেন কেন?’

ভদ্রমহিলা হকচকিয়ে গেলেন। মেয়েটি আমার দিকে প্রখর চোখে তাকাল, ‘কী বলতে চান আপনি?’

আমি মেয়েটির দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার ভদ্রমহিলার দিকে ফিরলাম,  ওনাকে পাগল প্রতিপন্ন করে কী লাভ? কোনও সম্পত্তি টম্পত্তির ব্যাপার নেই তো এর মধ্যে?’

মুহূর্তের জন্য ভদ্রমহিলার চোখের মণি পান্নার মত সবুজ হয়ে জ্বলে উঠেই নিভে গেল, স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

আমি চমকালেও লাইনচ্যুত হলাম না, ‘আসল ব্যাপারটা কী একটু ঝেড়ে কাশুন তো।’

মেয়েটি কঠিন গলায় বলল, ‘আপনি মায়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনার কাছে আমরা সাহায্যের জন্যে এসেছিলাম। অনেক হয়েছে। মা, ওঠো।’

ভদ্রমহিলা মেয়েকে থামালেন। বললেন, ‘আমার স্বামী কী বলেছেন আপনাকে?’

ওনার হঠাৎ ধারণা হয়েছে, আপনি নাকি গ্রহান্তরের জীব। আপনার সঙ্গে থাকা ওনার আর পোষাচ্ছে না।’

ভদ্রমহিলার চোখের পাতা আর্দ্র হয়ে এল। চোখের মণির রঙ বদলাল আবার। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কুয়াশার মত ঘোলাটে সাদা। বললেন, ‘আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম এই ভেবে যে আপনি ওঁকে বোঝাতে পারবেন উনি মানসিক ভাবে অসুস্থ। তাহলে আর কোনও ঝামেলা থাকত না।’

তার মানে?’

মানে, উনি একবর্ণ মিথ্যে বলেন নি। আমি সত্যিই পৃথিবীর মানুষ নই।  চার দেওয়ালের মধ্যে আপনি ব্যাপারটা জানলে ক্ষতি নেই। কারণ আপনি বাইরে চাউর করলেও আপনার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। ভাববে, মনের ডাক্তার নিজেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে।’

এ তো আচ্ছা মুশকিল হল। ভদ্রমহিলাও প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন। অথচ কথাবার্তা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। মানসিক রোগের রোগীদের কথাবার্তায় সাধারণত সাযুজ্য থাকে না। ইনি বেশ যুক্তি সাজিয়ে কথা বলছেন। তাছাড়া, চোখের মণির রঙ পরিবর্তনের ব্যাপারটা যে সত্যি, আমি নিজের চোখে দেখেছি। মেডিক্যাল সায়ান্সে এর কোনও ব্যাখ্যা আছে কিনা আমি জানি না। সামান্য ইতস্তত করে বললাম, ‘দেখুন, আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক। এই চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি মেনে চলে।’

আমাকে দোষারোপ করাও কি এই পদ্ধতির মধ্যে পড়ে?’

কখনো কখনো রোগের মূলে পৌঁছনোর জন্য রোগীকে আঘাত করা অনিবার্য হয়ে পড়ে।’

কিন্তু আমি তো রোগী নই। তাছাড়া, আপনাদের বিজ্ঞান তো চেতনার সীমান্তে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওই বিজ্ঞান দিয়ে আমায় বুঝতে পারবেন না। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে আপনাদের পৃথিবীতে এসেছিলাম একটি সায়েন্টিফিক রিসার্চ টিমের মেম্বার হয়ে। আমাদের কাজ ছিল আপনাদের… মানে পৃথিবীর মানুষদের জীবন প্রণালী ভালো করে স্টাডি করা। আমাদের জিন কোডে একটা টেম্পোরাল চেঞ্জ করা হয়েছিল। আমরা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জানতাম ওই বদলটা ঠিক তিরিশ বছর স্থায়ী হবে। ওইটাই ছিল আমাদের মিশন টাইম। তারপর আমরা আবার না-মানুষ হয়ে যাব, আমাদের ফিরে যেতে হবে… অথচ ফিরে যেতে পারছি কই?’

শেষ বাক্যটা মনে হল অন্যমনস্ক স্বগতোক্তি। ভদ্রমহিলা দম নেবার জন্য থামলেন। ঠিক তখনি যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্য আমরা তিনজনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। হুড়মুড় করে চেম্বারের দরজা ঠেলে ভদ্রলোক ঢুকে পড়লেন। আঙ্গুল তুলে বললেন, ‘অ্যায়, দেখেছেন তো! আগেই বলেছিলাম। তখন মানছিলেন না। এখন বিশ্বাস হল তো ও মানুষ নয়।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ছিঃ, ছিঃ! তুমি আড়ি পেতে সব শুনছিলে?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘শুধু শুনিনি,  দেখছিলামও। আমি দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাই। তিন মাইল দূর থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পাই।’

সে কী?’

এতদিনেও বোঝোনি? এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি মানুষের জীবন প্রণালী স্টাডি করবে? মূর্খ স্ত্রী-জীব! আমিও এই পৃথিবীর মানুষ নই।’

হা ঈশ্বর! আমার তিরিশ বছরের রিসার্চ জলে গেল।’

বেশ হয়েছে। তুমি আমার তিরিশ বছর নষ্ট করনি?’

নষ্ট করেছি?  কী পাওনি তুমি? কী দিইনি তোমায়?’

ভালবাসা… ভালবাসা পাব বলেই পৃথিবীর মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম। মানে…  পৃথিবীর মেয়ে ভেবে তোমায় বিয়ে করেছিলাম। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আর কোনও গ্রহের জীব ভালবাসতে জানে না যে।’

ভদ্রমহিলা চুপ করে বসে রইলেন। তাঁর চোখের মণির ঘোলা রঙ হালকা হয়ে নীলের ছোঁয়া লাগল, যেন কেউ জলরঙে ছবি আঁকছে, ভিজে রঙের ওপর তুলির ডগায় অন্য এক রঙ চাপিয়েছে।  নিজের সঙ্গে কথা বলছেন, এমন ভাবে বললেন, ‘জানি,  মানুষের মেয়েরা ছাড়া আর কেউ ভালবাসতে জানে না। কিন্তু সমস্যাটা কী বলত, তিরিশ বছর পার করেও আমি তোমায় ছেড়ে যেতে পারছি না। যখনি ভাবি ফিরে যাব, বুকের মধ্যে টনটন করে ওঠে। যাক, আমার কাজটা তুমি সহজ করে দিলে। তুমি আমার সঙ্গে থাকতে চাও না যখন আমি চলেই যাব। আর একটু সময় দাও। মেয়েটা পাশ করুক। আমি… ।’ ভদ্রমহিলার গলা ভারি হয়ে এল।

ভদ্রলোক বললেন, ‘আহা! কাঁদ কেন?  আমি সেভাবে বলিনি।’

কীভাবে বলেছ?’

আমি আর ওঁদের মেয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে এই মান অভিমান পর্বটি পর্য্যবেক্ষণ করছিলাম। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল, ‘অনেক হয়েছে। এবার তোমাদের ঝগড়া ঝাঁটি থামাও। ঘরে চল।’

দেখ্‌ না, তোর বাবা…।’

ভদ্রলোক বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়েটি মায়ের কাঁধ জড়িয়ে চেয়ার থেকে উঠতে সাহায্য করল। তারপর তিনজনে আমায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চেম্বারের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। আমি হাঁদার মত চেয়ে রইলাম।





পরের দিন দুপুরের দিকে ফোনটা এল, ‘চিনতে পারছেন? গতকাল সন্ধেবেলা বাবা মাকে সঙ্গে করে আপনার চেম্বারে এসেছিলাম।’

আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন আছেন ওনারা?’

ভালোই। আপনাকে ধন্যবাদ। দুজনে বেশ ভাব হয়ে গেছে। তাড়াহুড়োয় আপনার ফিজটা দেওয়া হয়নি। আজ কি আপনার চেম্বার খোলা আছে?’

না, আজ তো রবিবার।’

বাবা খুব ব্যস্ত করছে,  ফিজটা মিটিয়ে দেবার জন্য। বাইরে কোথাও দেখা করা যায়?’

এ যে মেঘ না চাইতেই আঝোর বর্ষা, ‘কোথায়?’

বিকেলের দিকে একবার ফ্লুরিজে যাব। ওখানে আসতে পারবেন কি?’

সে এল। পাশে চেয়ার টেনে বসে আমার দিকে তাকাল। চোখে ঘন মেঘের কালো। কথা বলতে বলতে রঙ বদলে অতলান্ত নীল। ভয় হল ডুবে যাব। ঠিক তখনই গন্ধটা পেলাম। কেক পেস্ট্রির গন্ধ ছাপিয়ে একটা ভিজে ভিজে মিষ্টি গন্ধ। সব চেনা গন্ধর থেকে আলাদা, অথচ খুব চেনা।  মেয়ে মায়ের ওপর গেছে।
sayantanbg62@gmail.com