1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Showing posts with label কল্পবিজ্ঞান. Show all posts
Showing posts with label কল্পবিজ্ঞান. Show all posts

Wednesday, October 21, 2020

পোর্টাল

 

ছবি : ইন্টারনেট 
                                                                                                              সায়ন নাথ

     এই ব্রহ্মাণ্ডে কদাচিৎ এমন সব ঘটনা ঘটে হরেশীয় বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। সেই সমস্ত ঘটনার রেশ প্রত্যক্ষদর্শী দের মনে এক দীর্ঘ সময় ব্যাপী ছাপ ফেলে যায়। এই গল্পের শিরোনাম যাই হোক না কেন গল্পে আমার ব্যাক্তিগত নামের সেরূপ কোনো প্রয়োজন নেই তাই সেটা পাঠকদের সামনে পরিফুষ্টিত না করার প্রয়োজন বোধ করি। গল্পের পাঠকগণ সেক্ষেত্রে আমাকে বক্তা বলে চিহ্নিত করলে তাতে আমি বিন্দুমাত্র শঙ্কা বোধ করবো না। 

  এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে আমি একজন নামজাদা খবরের কাগজের অফিসের চিত্র সাংবাদিক । দেশ বিদেশের বিভিন্ন খবর সংগ্রহের জন্য অনেক সময় আমাকে অনেক জায়গায় যেতে হয়। সেবার একর্মসুত্রেই এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছিল আমার । সেই অভিজ্ঞতার কথা-ই আজ পাঠকদের কাছে পেশ করতে চলেছি।  

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে "THE TIMES" পত্রিকায় ছাপা একটি খবর সমকালীন বাংলা, সমগ্র ভারতের এবং বিশ্বের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তে পরিণত হয়। খবরটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিল , ভারত ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনের  আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর পশ্চিম হিমালয়ের অন্তর্গত ভারতীয় ভূখণ্ডের উচ্চতম, পর্বৎসংকুল ,লাদাখ মালভূমির  কংগা পাসকে কেন্দ্র করে। সেখানে নাকি প্রায়শই রাতের আকাশে অদ্ভুত কিছু রংবেরঙের আলো দেখা যায় । ভিনগ্রহীদের স্পেসশিপ বা ফ্লাইং সসার থেকে যে ঐ কিম্ভুত মার্কা ,অদ্ভুত  আলো দেখা গেছে সে কথা এই অঞ্চলে বসবাকারী স্থানীয় লোকজন রা মনে করেন। তাই এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরই অনেক বিজ্ঞানী এখানে এসে নিরলস গবেষণা করেছিলেন। আর সেই সূত্রেই এক গবেষণা রত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দের সাথে কর্মযোগ - এ আমার তিবত্মীয় পর্বৎসঙ্কুল , লাদাখ মালভূমির কং গা পাশে আসা। 

এককথায় ছবির মতো সুন্দর সেই ছোটো ভিনদেশী গ্রমখানী। সুবিশাল লাদাখ মালভূমির বিশালাকার পর্বত শৃঙ্গ গুলির কানভাসে র পটে কোনো এক শিল্পীর তুলিতে আঁকা সুন্দর একটি অকপট মঙ্গলীয়দের গ্রাম এটি। গ্রাম বললে হয় তো কিছু ভুল হবে কারণ ছোটো ছোটো গৃহস্থ গুলি একটির থেকে অনেক দূরে দূরে অবস্থান করছে সেখানে। সভ্যতার মূলস্রোতের থেকে বিচ্ছিন্ন এক একটি হ্যামলেট কদাচিৎ খোলা আকাশের নীচে পর্বত পাদদেশে আপন গরিমায় দন্দায়মান। হাতে গোনা কয়েকটি ছোটো ছোটো ঘর ছাড়া বিশেষ কোনো জনমানব নেই সেখানে আছে শুধু এক দারুন নিস্তব্ধতা আর প্রকৃতির নয়নাভিরাম, নৈসর্গিক দৃশ্য।  তাই আমার মনে হয়েছিলো এই পাণ্ডব বর্জিত দেশে এমন সব কিংবদন্তি গড়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগে না।১৯৬২ সালে ভারত - চিন যুদ্ধের পর থেকেই এই অঞ্চলটির জনসংখ্যা ভীষণ ভাবে কমে যায়। আসলে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অঞ্চলটির আর্থ- সামাজিক কাঠামো দারুন ক্ষতিগ্রস্ত হোয়েছিল। তাই পরিব্রাজন এর পরিমাণটাও সমকালীন সময়ে অঞ্চলটিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

যাই হোক, মূল গল্পে আসা যাক!  

এই সময়েরই আমার ব্যাক্তিগত জীবনের এক সন্ধ্যাকালীন অভিজ্ঞতার কথা বলবো তোমাদের। কর্মসূত্রে এখানে এসে আমার সাথে এক বিশিষ্ট মেক্সিকান বৈজ্ঞানিক রুডলফ পমার এর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে ক্রমে আমরা একে অপরের পরিপূরক আর বন্ধুত্ব পরায়ণ হয়ে পরি। রুডলফ দারুন অমায়িক গোছের । দিনের শেষে পাহাড়িয়া গ্রামের মাথায় ঝুপ করে সন্ধ্যা নামলে নিজের দলের এবং আমাদের দলের সকলকে পরদিনের গবেষণার কাজ বুঝিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজ সে অত্যন্ত সন্তর্পনে দারুন কর্তব্যের সাথে পালন করতো। এক কথায় দু তিনটে ক্যাম্পের গুরু দায়িত্ব সে অত্যন্ত সন্তর্পনে সম্পূর্ণভাবে নিজের ইচ্ছেই পালন করতো। কারণ সব ক্যাম্পার দের থেকে ওর অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি আর বয়সে আমাদের সকলের থেকে বড়ো। জীবনে ও একাধিক দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংকান্ত্র কাজে যোগ দিয়েছিল। তাই ওর অভিজ্ঞতার কাছে আমরা সকলে ছিলাম নিতান্তই অপ্রতুল বা শিশু সুলভ। তবে ওর দুর্বলতা ছিল একটিই। বছর পঞ্চানন বয়স হওয়ার পর ও যে লোকটা কোনো কাজ কে করতে দ্বিধা বোধ করতো না সেই অমায়িক পার্সোনালিটি র অধিকারী  নিদারুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন লোকটি ছিল প্যারালাইজড। 

ওর শরীরের বামদিকের অঙ্গগুলোর সঞ্চালন হতে  কখনো আমি দেখিনি। ওর শরীরের এমন দুরাবস্থার কথা আমাদের ক্যাম্পের সদস্যরা বার কয়েক ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো রুডলফ সেই প্রশ্নের প্রতি  কখনো আমল দেননি। বা দিলেও উত্তর দেওয়ার জন্য কখনো কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। তাই এরপর কেউ আর সেভাবে ওকে প্রশ্ন করেনি।

ক্যাম্পের চতুর্থ দিনের শেষে সন্ধাবেলায় কোয়েক পশলা তুষার, অভিক্ষেপের আকারে ঝরতে শুরু করেছিল। তাই ঠান্ডার প্রকপটা গত কয়েক দিনের তুলনায় অনেক বেশী অনুভব করেছিলাম।  সেই দিন সন্ধ্যায় বিশেষ কোনো কাজ না থাকায় , আমি কাপতে কাপতে রুডলফ এর তাঁবুতে গিয়ে উঠলাম। উদ্দেশ্য ছিল ওর  ব্যাক্তিগত জীবনের আর গবেষণার সংকন্ত্র  অভিজ্ঞতার গল্পঃ শোনা। আমার মত নিদেন পক্ষে এক চিত্র সাংবাদিকের পক্ষে এমন সব ঘটনা র বিবরণ শোনার লোভ সংবরণ করাটা ছিল খুব কঠিন। 

তাঁবুতে যেতেই রুডলফ আমায় এক পেয়ালা কফি আর টোস্ট দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। ও কয়েক্ প্রস্থ আলাপচারিতার পর আমি আমার সংকোচ বোধ দুর করে ওকে জিজ্ঞসা করলাম "আচ্ছা রুডলফ আমায় একটা কথা বলবে"? রুডলফ সেই অমায়িক হাসি হেসে বললো "বলো কি জানতে চাও"?  আমি বললাম " তোমার বাম শরীরের এমন দুরাবস্থার কারণ টা সম্পর্কে জানতে পারি, আসলে আমি জানি তুমি এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে চাও না তাও জিজ্ঞেস করলাম। আমায় তুমি বন্ধু ভেবে নিঃসংকোচে বলতে পারো আমি কাউকে কিছু বলব না।" রুডলফ বললো" আসলে আমি ওসব কথা কাউকে কিছু বলি না বলতে চাই না কারণ গল্পঃ শেষে শ্রোতা রা হোয়ত আমায় পাগল বলে চিহ্নিত করবে সেটা আমার ভালো লাগবে না "। 

আমি আবার বললাম " তুমি সংকোচ না করে বলে ফেলো আমি অন্তত তোমায় পাগল বলে মনে করবো না আর তা ছাড়া তোমার প্রতি আমার ভালবাসা, বন্ধু প্রীতি, বিশ্বাস, আর শ্রদ্ধা অনেক বেশি তাই নিতান্তই এই এই উত্তরে আমার শঙ্কা বোধ করার মত কিছু নেই"।  আর অযথা সময় নষ্ট না করে  রুড়লফ বলতে শুরু করলো --

" সেটা ১৯৮৬ সালের গোড়ার দিকে,  আমি সবে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইসিয়ানা ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাফলি য়েটেড পদার্থবিদ্যায় ph.d শেষ করেছি। আমার গবেষণার বিষয় ছিল তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তুমি জানো হয়তো কোয়ান্টাম মেকানিক্স এমন কিছু কথা বলে যা শুনলে আমাদের আশর্য হতে হয়। যেমন dual পসিবিলিটি অর্থাৎ এক বস্তু একই সময় একাধিক জায়গায় থাকতে পারে সেটা হচ্ছে পদার্থের ক্ষুদ্রতম পার্টিকেল বা কোনো তরঙ্গের রূপে। কোনো একক সময়ের নিরিখে আমরা সেই বস্তুটিকে যে ভাবে প্রত্যক্ষ করি আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় সেটিকে সে ভাবে প্রত্যক্ষ করে। তবে কি বস্তুটির বাদ বাকি রূপ গুলি শেষ  হয়ে যায়? উত্তরটা আপেক্ষিক। কারণ আমরা এমন এক দুনিয়ায় বাস করি যেখানে মাত্র তিনটি মাত্রাই বিদ্যমান। আর আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় সেই তিনটি মাত্রার অধিক কোনো কিছুকেই আর ডিটেক্ট করতে পারে না ।তাই হাইপার ডাইমেনশাল অবজেক্ট বা সুপার ডাইমেনশন কে আমরা কখনোই সেন্স করতে পারি না। যেমন সময়। এটি আইনস্টাইন এর সিদ্ধাতে ৪ থ মাত্রা হিসেবে স্থান পেয়েছে। আমরা সময়কে পরিমাপ করতে পারি কিন্তু কখনোই দেখতে বা সময়ের উপর দিয়ে উপর নিচে বা বাম দিক ডান দিকে যাত্রা করতে পারি না। কিন্তু আমরা জানি সময় এই মহাবিশ্বে বিরাজমান। কোয়ান্টাম মেকানিক্স তাই একাধিক হাইপার ডাইমেনশন এর পাশাপাশি একাধিক মহাবিশ্বের অবস্থানের কথায় যুক্তি উপস্থাপন করে। 

যাই হোক , ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করার পর আমি এই হাইপার ডাইমেনশন, সুপার পসিসনিক স্টেট আর সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ডে র অবস্থান বিষয়ক তত্ত্ব গুলিকে আত্মস্থ করতে শুরু করি । সেই মতো কর্মসূত্রে আমি জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবজ্ঞান এর অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হই। 

এখানে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন এক ছাত্রের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। ছেলেটির নাম মার্ক জেমারসন। দারুন প্রতিভার অধিকারী ছেলেটি তার পড়াশুনার পাশাপাশি একাধিক মহাবিশ্বের অবস্থানের কথায় আমার সমকক্ষ ছিল। আমাদের মধ্যে ছাত্র ও শিক্ষক এর সম্পর্কের তুলনায় সম্পর্ক টা ছিল দারুন মিত্রতার। 

মার্ক আমায় একদিন বললো আসলে সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশের পথ নাকি সত্যিই রয়েছে  দক্ষিণ আমেরিকার  পেরু তে। পেরুর রাজধানী লিমা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে" মারকাওয়াসি স্টোন ফরেস্ট" নামে এক গহীন অরণ্য। সেই অরণ্যে লোক চক্ষুর অন্তরালে এমন কিছু রহস্য ময় স্থান মাঝে মধ্যে পৃথিবীর বুকে আপনা থেকেই উম্মোচিত হয়। সেগুলিকে অন্য কোনো মহাবিশ্বে প্রবেশের portal বলা যেতে পারে। 

যেই বলা অমনি কাজ , রাতারাতি পেরুর রাজধানী লিমা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের টিকিট কেটে ফেললাম দুজনের জন্য। সেইমত রহনা দিলাম তারপর দিন সকালে। ২০ জুন তারিখে সকালে লিমা পৌঁছলাম আমরা। তারপর তার দুদিনের মধ্যে অর্থাৎ ২২জুন তারিখে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিট ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে লিমা ছাড়লাম আমরা দুজন। পথ সেখানে বড়ো দুর্গম। কিছুটা নৌযানে কিছুটা পায়ে হেঁটে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত মারকাওয়াসী স্টোন ফরেস্ট এ পৌঁছানো গেলো দিনের শেষে দারুন অক্লান্ত পরিশ্রম করে। দুই দিন তিন রাত্রি সেখানে ক্যাম্প করে অস্থানা গারলাম আমরা। কিন্তু কোনো portal  প্রথমটায় চোখে পরলনা। ২৫সে জুন তারিখে মাঝ রাতে আমার ঘুম ভাঙলো মার্কের হাতের মৃদু স্পর্শে। তড়িঘড়ি ঘুম থেকে উঠে দেখি মার্ক আমার সামনে বসে আছে। দৃষ্টি তার বিস্ফারিত। দেখলাম ও ডানহাতের তর্জনীটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। সেইমত আমি সেইদিকে দৃষ্টি পাত করতেই ব্যাপারটা চোখে পরলো। দেখলাম একটি অকপট শুভ্র ও পিতকায় বর্ণের এক অদ্ভুত ,গোলাকার আলোর আভা দুটো জির্ন কায় সিডার গাছের ফাঁকা দিয়ে চকমক করছে। দেখতে দেখতে আলোর চমকটা কিছুটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। আমি আর দেরি না করে উঠে বসলাম তারপর হাতে টর্চ নিয়ে সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা ছোট খাটো আলোর portal যার ভিতর থেকে দারুন ইলেকট্রনিক ম্যাগনেটিক তরঙ্গের আভা ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর দেখলাম পর্টাল এর ভিতরে সপ্তদশ শতাব্দীর পোশাক পড়া এক বিশিষ্ট মেক্সিকান বৈজ্ঞানিক এর চেহারা। হ্যা এই চেহারাটা আমি চিনি আমি আয়নায় বহুবার এই এই virtual চেহারাটার সম্মুখীন হইছি। এ যে সপ্তদশ শতাব্দীর পোশাক পরিহিত এক শতাব্দী প্রাচীন রুডলফ পম্যার। আর কিছু বোঝার আগে কোন এক মহ আমায় পাগল করে তুলল প্রাণের মায়া ছেড়ে পাগলের মতো এক লহমায় ঝাঁপ দিতে গেলাম সেই portal এর ভিতরে।  তারপর আমার আর কিছু মনে ছিল না। জ্ঞান যখন হলো তখন দেখলাম আমি লিমার এক হসপিটাল এ শুয়ে। পাশে বসে মার্ক। আমায় দেখে ও বললো " আপনি ঠিক আছেন স্যার"? উত্তরে আমি হ্যা বললাম। তারপর বাম হাতটা উপরে তুলতে গিয়ে দেখি আমি আমার বাম হাতের উপর আমার নিজের নিয়ন্ত্রণ খুঁয়েছি। " 

এই বলে থামলো রুডলফ । আমি ততক্ষণে তার কাহিনীর বহর শুনে হা করে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। রুডলফ আবার বললো "বলো কি বুঝলে তুমি?" ছার আমিই বলছি বলে আবার বলতে শুরু করল  "আসলে portal এ প্রবেশের সময় মার্ক পিছন থেকে আমায় এক ঝটকায় সরিয়ে দেয় আর সেই সময়ই পর্টালের virtual দেওয়ালে র  ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক তরঙ্গের আঘাতে আমার এই দুরবস্থা হয়। তারপর আমি জ্ঞান হারাই।" 

রুডলফ এর ঠোঁট এ গল্পঃ শেষে এক মৃদু হাসি দেখতে পেলাম আমি আর শুনতে পেলাম  রাত্রিকালীন পার্বত্য এলাকার প্রাকৃতিক প্রলয়ের ঘণ্টা । বাইরে বোধয় এতক্ষণে আবার মৃদুমন্দ গতিতে বাতাস বইতে শুরু করেছে সঙ্গে তুষার পাত ও। 

sayann169@gmail.com
কলকাতা




নতুন আলো

 

ছবি : ইন্টারনেট

                                                                                         সত্যম ভট্টাচার্য

            ওপাশ থেকে ফোনটা ধরতেই আধো আধো গলায় তিতাস বললো-মা কত দিবির স্লট হবে এখান থেকে জিজ্ঞেথ কথছে।তুমি বলে দিয়েথিলে,তাই আমি বলে দিলাম ওয়ান মিলিয়ন দিবি ক্যাপাতিতি

ওদিকে বাড়িতে তখন আনন্দের চোটে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছে।তিতাসের প্রথম ফোন এটা ওর বাড়িতে।যদিও বাড়িতে সবাই জানতোই যে সব ঠিকঠাক হলে এরকম একটা ফোন আসবেই নার্সিংহোম থেকে।কিন্তু ভাবা এক ব্যাপার আর হওয়া আরেক ব্যাপার

আসলে তিতাসের বয়স এখন একদিন পেরিয়ে কয়েকঘন্টা এগিয়েছে।সকালের নরম রোদে ও ওর ছোট্ট বিছানাটায় শুয়ে হাত পা নাড়ছিলো।এখানে গোটা ঘরটা জুড়ে কত যে বাচ্চা তার ইয়ত্তা নেই।সব একই রকমের দেখতে।বেডের বোর্ডে ওদের ডিজিটাল নম্বর  ঝলমল করছে।আর সেই অনুযায়ীই মনিটরে কন্ট্রোল রুম থেকে ওদের দেখা যাচ্ছে। তিতাসকে কিন্তু ওদের সকলের থেকে আলাদাই রাখা হয়েছে

নার্সরা যখন প্রথমে সেন্ট্রাল সিস্টেম থেকে অর্ডার পেলো যে গতকালের জন্মানো এত নম্বরের বাচ্চার কত জিবি ক্যাপাসিটির স্লট লাগবে সেটা বাচ্চার কাছ থেকেই জেনে মেইল করে দিতে, খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলো ওরা।মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলো না । ভাবছিলো যে এটা কি জিনিসই বা লাগবে আর একদিনের বাচ্চাই বা তা কিভাবে বলতে পারবে। ওরা নিশ্চিত ছিলো যে প্রায় সব বাচ্চার মতো এই বাচ্চাও তো ঘুমিয়েই থাকবে।তবু কেন সেন্ট্রাল সিস্টেম এমন অর্ডার করছে।তাই খানিক কৌতূহল নিয়েই দুজন নার্স  এসেছিলো তিতাসের বেডের কাছে

তখন তিতাস জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলো।কি সুন্দর এই পৃথিবীটা।আলো ঝলমলে আর কি সুন্দর বাতাস বাইরে।গাছেরা মাথা দোলাচ্ছে।পাখি ডাকছে।ওদের মিষ্টি গান শুনে তিতাসের মনে হচ্ছিলো যে কবে গিয়ে ওদের সাথে ও খেলতে পারবে।এতদিন তাহলে মা ওকে এইসব গল্পই শুনিয়েছে।মায়ের সাথে কথা হলেই বলতো-তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও সোনা ।তৈরি হয়ে নাও।এখানে যে কত কিছু দেখার আছে।সূর্য-চাঁদ-পাখি-ফুল-ঝর্ণা-নদী-প্রজাপতি-পাহাড়-জীবজন্তু, সব যে দেখতে হবে তোমাকে,খেলতে হবে ওদের সাথে

তিতাস বলতো-আমার এখানে থাকতে আর একমুহূর্তও ভালো লাগে না মা

কিন্তু কিছু যে করার নেই সোনা ,ওখানে নির্দিষ্ট দিন পার করেই যে তোমাকে আসতে হবে-মা বলতো।সে আমি না হয় ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলে তোমাকে কদিন আগে নিয়ে আসতে পারি।কিন্তু তাতে ভালো হবে না।তোমার শরীরের জোর কমে যাবে,অশক্ত হয়ে যাবে তুমি।ভালোমতো খেলতে পারবে না সবকিছুর সাথে।তাই যে তারিখ ঠিক করা আছে ওতেই তুমি এসো

নার্স দুজনকে দেখতে পেয়ে তিতাস বললো-ইয়েথ থিথটার।শুনে তো ওরা অবা্ক।কালকে জন্মানো যে বাচ্চার ঘুমোনোর কথা সে নাকি আজ ওদেরকে দেখতে পেয়ে বলছে ইয়েস সিস্টার।কোনক্রমে ওরা তিতাসকে বলতে পেরেছিলো যে ও বলতে পারবে কি না যে কত ক্যাপাসিটির স্লট বসবে ওর।শুনে তিতাস ওদেরকে বললো-জাস্ত এ মিনিত।তারপর বাতাসেই আঙুল চালিয়ে ডিভাইসটা ক্রিয়েট করে নিয়েছিলো ও।তারপর ওতে নেটওয়ার্ক কানেক্ট করে মায়ের নম্বরটা ডায়েল করে কথা বলেছিলো বাড়িতে।আর তারপর নার্সদেরকে বলে দিয়েছিলো যে এক মিলিয়ন জিবি ক্যাপাসিটির স্লট বসবে।এতটা দেখে তো ওদের চক্ষু  চড়কগাছ।যদিও ওরা খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলো যে নার্সিংহোমে একটা কিছু গোপন হয়ে চলেছে কিন্তু তা যে এতটা হতে পারে তা ওরা ভাবতেও পারেনি

আসলে ওরা জানে না যে তিতাসকে বড়ই করা হয়েছে সম্পূর্ন এক নতুন বৈজ্ঞানিক উপায়ে।কয়েকবছর থেকে বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে কাজ করে যখন নিশ্চিত হয়েছিলেন যে এমনটা করা সম্ভব তখন তারা প্রয়োগ করবার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।আসলে এতো এক জটিল পরীক্ষা।তা ল্যাবরেটরীতে করা এক জিনিস আর মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা আরেক ব্যাপার।যে কোন সময় সামান্য হিসেবের ভুলচুকে ঘটে যেতে পারে কোন মারাত্মক দুর্ঘটনা।তার দায় তখন কে নেবে

আসলে পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিলো প্রচন্ড গোপন।প্রথম থেকেই নিউ হিউম্যান জিনোম রিসার্চ প্রোজেক্টের টার্গেট ছিলো যে যারা এই কাজে যারা থাকবে তারা ছাড়া বাইরের আর কোন কাকপক্ষীও এই সম্পর্কে কিছু জানতে পারবে না।শুধু শেষে গিয়ে যেই নার্সিংহোমে কাজ করা হবে তাদের  স্পেশাল ট্রেইন্ড কিছু লোকেদের এই বিষয়ে খানিক ট্রেনিং দিয়ে রাখা হবে,কিন্তু পুরো ব্যাপারটা বলা হবে না।শুধু পুরো ব্যাপারটা জানবেন কয়েকজন ডাক্তার যারা প্রথম থেকে এই প্রোজেক্টের সাথে থাকবেন।আসলে এত গোপনীয়তা না রাখলে সমস্যা হতে পারে। বাইরে থেকে প্রতিবাদ উঠতে পারে।তাতে কাজটা চাপে পড়ে যাবে।অথচ একবার যদি করে ফেলা যায় তারপর দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যাবে যে কি অসাধ্য সাধন করা হল

তাই যখন তিতাসের মা সুজাতার ভালো খবরটা এসেছিলো আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ওকে নিজের চেম্বারে ডেকে পাঠিয়েছিলেন নিউ হিউম্যান জিনোম রিসার্চ প্রোজেক্টের কর্ণধার মালহোত্রা।যদিও সুজাতা এখানকারই একজন বিজ্ঞানী এবং এই প্রোজেক্টের সাথেই ও যুক্ত আছে তাই ব্যাপারটা ওকে সহজেই বোঝানো যাবে।কিন্তু মালহোত্রা এটাও জানেন যে বিজ্ঞানী হওয়া বা প্রোজেক্টে যুক্ত থাকা এক ব্যাপার আর যে আসছে তার ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেওয়া আরেক ব্যাপার।কারণ সেখানে জড়িয়ে থাকে এক বিশাল বড় মায়া।নিজের পেশাদারী জীবনের থেকেও অনেক ক্ষেত্রেই সেই মায়া বড় হয়ে ওঠে।বেশীর ভাগ সময়েই তাই অনেক বড় মাপের মহিলা বিজ্ঞানীরাও এতে রাজী হতে চান না।সুজাতাকে কি এতে রাজি করাতে পারবেন মালহোত্রা

হাসি মুখে সুজাতা ঢুকতেই মালহোত্রা বললেন-প্লিজ বি সিটেড মাই ডটার

সবাইকেই এই ভাবেই ডাকেন বা কথা বলেন মালহোত্রা।কিন্তু আজকের সুজাতার সাথে ব্যাপারটা একদমই অন্যরকম।একটু নিজেকে শক্ত করে নিলেন মালহোত্রা।অনেক কঠিন প্রস্তাব তাকে দিতে হবে সুজাতাকে এবং রাজি না হলে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে রাজি করানোর

ইয়েস স্যার বলে সুজাতা চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতেই তিনি বললেন-শুধু আমরা বা আমাদের দেশ নয় সুজাতা।বিজ্ঞান তোমার সাহায্য চায় এই মুহূর্তে।আর ভগবান অনেক সদয় যে এই সময়ে হয়তো এই কারণেই তিনি তোমার জীবনে এই ভালো খবরটা এনেছেন।আশা করি তুমি বুঝতে পারছো সুজাতা।নিউ হিউম্যান জিনোম রিসার্চ তাদের অনগোয়িং এ প্রোজেক্টে তোমার সাহায্য চায়

সুজাতা খানিক হতভম্ব হয়ে বললো-স্যার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।আমি তো প্রোজেক্টে আছিই

মালহোত্রা এটার জন্য প্রস্তুতই ছিলেন।বললেন-সে থাকা নয় সুজাতা,এবারে আমরা তোমার ওপরেই আমাদের পরীক্ষাটা করতে চাই

এক লহমায় কালো হয়ে গিয়েছিলো সুজাতার ঝলমলে মুখটা।অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে সে শুনতে পাচ্ছিলো মালহোত্রা তাকে অনেক কিছু বলে চলেছেন।কিন্তু কিচ্ছু মাথায় ঢুকছিলো না ওর।চোখের সামনে ঘন কালো অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলো ও।কালকেই সুখবরটা নিয়ে এসেছে প্রতীক আর আজকেই ভগবান কি পরীক্ষায় ফেললো ওকে।যার আসার খবর হয়েছে সে ওদের অনেক প্রতীক্ষার আর স্বপ্নের ফল ।নিজের এই স্বপ্নকে কি এইভাবে বিজ্ঞানের কাজে লাগিয়ে দিতে পারবে ও?প্রতীক শুনলে কি বলবে?আবার নিজের পেশাদার জীবনের স্বপ্নকে নিজের জীবন দিয়ে সার্থক করার সুযোগ এসেছে আজ ওর সামনে।এও তো কম বড় কথা নয় ওর কাছে।কি করবে ও এখন।কোনক্রমে মাথাটা তুলে ও বলতে পেরেছিলো মালহোত্রাকে-স্যার আমাকে একটু টাইম দিতে হবে ভাবতে

মালহোত্রা হেসে বলেছিলো-সিওর।কিন্তু ভুলো না এ তোমার জন্য এক বিশাল সুযোগ

জানি স্যার,বাট-সুজাতা বলেছিলো

এই প্রোজেক্টের স্বপ্ন নিউ হিউম্যান জেনোম রিসার্চ বা বলা ভালো মালহোত্রা দেখতে শুরু করেছিলেন বছর দশেক আগে থেকে।কিন্তু তিনি জানতেন এত বড় কাজ তার পক্ষে একা সামলানো সম্ভব নয়।তাই লোক দরকার।দরকার আরো কিছু বিশ্বস্ত বিজ্ঞানী ও ডাক্তার যারা নিশ্চুপে তার সাথে কাজ করে যেতে রাজী থাকবে।তাই হয়েওছিলো।নিশব্দেই মালহোত্রা গঠন করে ফেলতে পেরেছিলেন বেশ কয়েকজনের একটা দক্ষ টিম।যারা সকলে প্রথম থেকেই কাজ করে চলেছেন এই প্রোজেক্টে।তারা জানেন এই কাজে তারা সফল হলে এক ঝটকায় বিজ্ঞান এগিয়ে যাবে অনেক দূর আর তাদের নামও ছড়িয়ে পড়বে গোটা দুনিয়ায়

প্রোজেক্টের প্রথম কাজ ছিলো যে ফোয়েটাস বা ভ্রুণ সদ্য জন্ম নিয়েছে তার ব্রেনে একটা নির্দিষ্ট স্পেস তৈরি করে নেওয়া।অর্থাত বাকি সব কিছুর সাথে সাথে ঐ স্পেসও নিজেকে ধীরে ধীরে ডেভলপ করবে।তারপর ঐ স্পেসের ওপরেই কাজ শুরু করবে হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট।কিন্তু এতে প্রচুর সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো।প্রথমত লোক পাওয়া যাচ্ছিলো না যারা নিজেদের ওপর এই টেস্ট করতে দেবে।আর যদি বা পাওয়া যাচ্ছিলো তারা সকলেই হচ্ছিলো সমাজের অতি নিম্নস্তরের আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন এবং তাদের পড়াশোনা খুব একটা নেই।কিন্তু এই প্রোজেক্টে মাকে প্রচুর ট্রেনিং দিতে হবে ফোয়েটাসকে।সেক্ষেত্রে নিরক্ষর বা পড়াশোনা কম জানা মহিলা হলে সে এতসব পেরে উঠবে না।এছাড়াও তারা প্রধানত রাজি হচ্ছিলো টাকার লোভে।সে নিজের প্রোজেক্টের জন্য টাকা দিতে মালহোত্রার কোন অসুবিধা ছিলো না।কিন্তু অসুবিধা হয়ে যাচ্ছিলো অন্য জায়গায়।এই নিম্ন আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন মহিলাদের দেহের মৌলিক উপাদানগুলি-অর্থাৎ প্রোটিন বা ভিটামিন বা অন্যান্য মিনারেলস এতই কম থাকে যে তাদের ওপরে কাজ করতে গেলেই তাদের চূড়ান্ত ক্ষতি হয়ে যাবার  একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।আবার কোনভাবে সেটাকে যদি সামাল দেওয়া গেলেও ফোয়েটাসটা এই চাপ নিতে পারবে কি না সেটাও একটা প্রশ্ন থাকে।যে কোন সময় হয়ে যেতে পারে কোন দুঃখজনক পরিণতি

এরও আবার দুটো দিক আছে।এক সেই পরিবারটি গন্ডগোল শুরু করতে পারে।যদিও বন্ড ইত্যাদিতে সই করানোই থাকে কিন্তু এইসব হুজ্জুতি মালহোত্রার একদম পছন্দ হয় না।আবার আরো একটা সমস্যা থাকে যে বেশ খানিকটা কাজ হবার পর এইরকম ঘটনা ঘটলে তাতে প্রোজেক্টের সকলের মনোবলটাও অনেকটাই ভেঙে যায়

বেশ কয়েকবছর ধরে এরকম কয়েকটা ঘটনা ঘটার পর মালহোত্রা বা নিউ হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট ঠিক করে নেয় যে আর নিম্ন আর্থিক স্তরের কাউকে টাকার লোভ দেখিয়ে নেওয়া হবে না।কারণ অন্যান্য সকল ব্যাপার ছাড়াও এর সাথে জড়িয়ে থাকে বিশাল বড় একটা নীতির প্রশ্ন।তাই কোনভাবে কোথাও সমস্যা হলে এই প্রোজেক্টই তখন সবার সামনে চলে আসবে আর সরকার থেকে সেটাকে বন্ধও করে দেওয়া হতে পারে।তাই সমস্ত বলে যদি কাউকে রাজি করানো যায় তাহলে ঠিক আছে কিন্তু তা না হলে যেরকম এখোনো অব্দি যেরকম পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে তাই চলতে থাকবে এবং একে আরো পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে

প্রোজেক্ট অনুযায়ী প্রথমে ফোয়েটাসের ব্রেনের ফাঁকা স্পেসে দিয়ে দেওয়া হবে কিছু অডিও ইনপুট যাতে জন্মানোর পরই তার কথা বলতে কোন অসুবিধা থাকবে না ।মালহোত্রা মাথায় রেখেছিলেন যে বাচ্চারা জন্মানোর পর তার কি অসুবিধা হচ্ছে বোঝাতেই পারে না।এমনকি যদি ফোয়েটাস এবং অডিও ইনপুট  ঠিকঠাক ডেভলপ করে তাহলে সে তার মায়ের সাথে কিছুদিন পর ওখান থেকেই দিব্যি কথা বলতে পারবে।এবারে প্রশ্ন হচ্ছে দুজনের মাঝে যোগাযোগ হবে কিভাবে।সেজন্য মাকে এক বিশেষ উপায়ে কথা বলা রপ্ত করতে হবে।যেখানে মা তার শ্বাসনালী দিয়ে কথা না বলে খাদ্যনালী দিয়ে কথা বলবে যে কথা বাইরে না এসে ভেতরে যাবে।আর সেভাবেই সে পথেই ফোয়েটাস কথার উত্তর দেবে

এবারে আসা যাক প্রোজেক্টের দ্বিতীয় ধাপে।সব ঠিকঠাক এগোবার পর এবারে ফোয়েটাসের ব্রেনের ফাঁকা স্পেসে দিয়ে দেওয়া হবে তার মায়ের এক বিশেষ সেল নম্বর।যা তৈরিই করা হবে কেবলমাত্র এই কাজের জন্য। সব ঠিক থাকলে বাইরে আসার পরই সে প্রথম মাকে ফোন করতে পারবে।সেজন্য সৃষ্টি করা হবে এক বিশেষ নেটওয়ার্ক। ফোনটা সে করবে একটা ইনভিসিবল ডিজিটাল প্যাড থেকে যার ক্রিয়েশন এবং ব্যবহার মা আগেই ফোয়েটাসকে শিখিয়ে রাখবে।বাইরে আসার পরই সে বাতাসে ওটা ক্রিয়েট করে নেটওয়ার্কে কানেক্ট করবে।আর প্রথম ফোনটা করবে মায়ের কাছে

এবারে তৃতীয় ধাপে ফোয়েটাস বা ভ্রুণ বাইরে আসার পর বাকি কাজটা করা হবে।আর এখানেই ডাক্তাররা যারা জড়িত আছেন এই প্রোজেক্টে তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কারণ এর আগের সব কিছু বিজ্ঞানীরা করলেও এই ধাপ থেকেই পরীক্ষা পুরোপুরি ভাবেই নির্ভর করবে ডাক্তারদের দক্ষতার ওপরে।এই ধাপে এসেই বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা এক বিশেষ স্লট ব্রেনে বসিয়ে দেওয়ার।যার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী সেখানে মেমোরী স্টোর করা যাবে।সে যেরকমই মেমোরী হোক না কেন।অর্থাত সেখানে যেরকম কয়েকলক্ষ ফোন মেমোরী স্টোর করা যাবে এবং সেখান থেকে কোন অসুবিধা ছাড়াই সেই ইনিভিসিবল ডিভাইস ক্রিয়েট করে যখন খুশি তখন ফোন করা যাবে।আবার সে মেমোরীতে স্টোর করা যাবে অনেক অনেক ইনফর্মেশন যা ব্যবহার করে বাচ্চা তার বয়সের থেকে অনেক এগিয়ে থাকতে পারবে।সব ঠিকঠাক হলে একটি দু থেকে তিন বছরের বাচ্চা সাধারণ ভাবে সতেরো আঠেরো বছরের মতো ইনফররেশন ক্যারি করবে

আর এই প্রোজেক্টে পুরো প্রক্রিয়াই নিয়ন্ত্রিত হবে সম্পূর্ণ এক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায়।অর্থাত এমন সিস্টেম এই প্রোজেক্ট নিয়ে আসবে যে সেখানে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি নগণ্য হয়ে যাবে।কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ড্রাইভার রাতবিরেতে না থাকার জন্য বা যে কোন কারণেই হোক নার্সিংহোম থেকে এম্বুলেন্স বা মেডিকেল ভ্যান রোগীর বাড়িতে পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়।ফলে রোগীর নানারকমের সমস্যা শুরু হয়ে যায়।এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় এই ধরণের কোন সমস্যা উত্থাপনের কোন অবকাশই থাকবে না।কারণ ফোয়েটাস বা ভ্রুণ এবং তার মা দুজনের আলোচনার ভিত্তিতেই ঠিক হবে যাবতীয়।আর মা সেন্ট্রাল সিস্টেমে তার রেজিস্টার্ড ফোন নম্বর থেকে ফোন করলেই সেখান থেকে সংকেত চলে যাবে আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হাসপাতালে। সংকেত পাওয়ার সাথে সাথেই হাসপাতাল থেকে নিজে নিজেই রওনা দিয়ে দেবে চালক বিহীন এম্বুলেন্স।সেখানে আগে থেকেই লোড করা থাকবে রোগীর বাড়ির লোকেশন।নিজেই জিপিএস দেখে সে ঠিক পৌঁছে যাবে জায়গামতো।গিয়ে হর্ণ দিয়ে দরজা খুলে অপেক্ষা করবে।রোগী বা মা গিয়ে নির্দিস্ট দরজার সামনে দাঁড়ালেই দরজা খুলে স্ট্রেচার বেরিয়ে আসবে।রোগী সেখানে শুয়ে পড়লেই যাবতীয় দেখে নিয়ে এম্বুলেন্স আবার ছুটবে নিজস্ব গন্তব্যে।এই গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হতে  নার্সিং হোমে অপারেশন থিয়েটার তৈরি হয়ে যাবে

এবারে নার্সিংহোমে মা কে থাকতে হবে সর্বসাকুল্যে দু থেকে তিন ঘন্টা।পার্কিং স্পেস থেকেই গাড়ি সোজা ঢুকে যাবে লিফটে।লিফট তাকে মুহূর্তে পৌঁছে দেবে দেড়শো বা দুশো তলা ওপরের অপারেশন থিয়েটারে।সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে নার্স বা ডাক্তাররা।শরীরের যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে যাবার পর এক বিশেষ উপায়ে পূর্ণাঙ্গ ভ্রুণ বা শিশুটি চলে আসবে মায়ের শরীরের বাইরে।এবারে দলটি দুটো আলাদা ভাগ হয়ে যাবে।একদল মাকে পর্যবেক্ষণ করে তার শরীরের যাবতীয় দেখে নিয়ে তাকে একই উপায়ে যেভাবে সে এসেছিলো রওনা করিয়ে দেবে বাড়ির দিকে।বাড়ি গিয়ে আবার সেন্ট্রাল সিস্টেমে সে জানিয়ে দেবে যে সে ঠিকঠাক তার নিজের কাজ সেরে ফিরে এসেছে

আর নার্স ডাক্তারদের আরেকটি দল তখন কাজ শুরু করে দেবে শিশুটিকে নিয়ে।সবকিছু ঠিক থাকলে নির্দিস্ট দিনে শিশুটিকে আবার গাড়িতে উঠিয়ে দেবে নার্সরা।তাকে নিয়ে একইভাবে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসবে চালকবিহীন এম্বুলেন্স।এইভাবেই চলবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাটি

মা-

বল সোনা-

আমি যে এখানে আর আঁটছি না-

মনে হয় তোমার বাইরে চলে আসার সময় হয়ে গিয়েছে-

এখন তাহলে কি হবে মা-

তোমাকে নিয়ে আমি রেখে আসবো সোনা হাসপাতালে-

আমার ভয় করবে যে ওখানে একা একা-

না কোন ভয় নেই।আর তোমার কাজ হয়ে গেলে দুদিনেই ওরা তোমাকেও বাড়ি দিয়ে যাবে-

 

সেদিন সকালে তিতাস আর সুজাতার এই সব কথাবার্তার পর দুপুর নাগাদই ওরা ঠিক করে ফেলে যে সেন্ট্রাল সিস্টেমে খবর দেবে।তারপর তো গাড়ি আসে।সুজাতাকে নিয়ে যায়।কিন্তু তার আগের ধাপটাই ছিলো সব থেকে কঠিন

সেদিন সন্ধ্যেতে মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে সুজাতা বাড়ি ঢুকেছিলো।প্রথমত আগে ওকে নিজেকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।তারপর সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে প্রতীকের সাথে।কাজ করতে করতে সে সবই মাথায় ঘুরছিলো সুজাতার।এ যেন নিজের সাথে নিজের একটা যুদ্ধ।দীর্ঘ কথোপকথন।কখোনো যুক্তি সাজাচ্ছে ওর পেশাদার বিজ্ঞানী মন।সে বলছে-এতদিন তো এরকমই একজন মহিলা তোমরা খুঁজে বেরিয়েছ সুজাতা।যে সমস্ত জেনে শুনে নিজেই যোগ দেবে এই প্রোজেক্টে।নিজেকে দান করবে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।তাহলে আজ যখন তোমারই এই সুযোগ আসছে তখন তুমি ভাবছো কেন?এ কি রকমের দ্বিচারিতা?

কিন্তু এর সাথেই কথা বলে উঠছে একজন বাঙালী মায়ের মন।সে যুক্তি সাজাচ্ছে।বলছে-তোমাদের এতদিনের স্বপ্ন আর কিছুদিনে সত্যি হতে চলেছে সুজাতা।তুমি এটা ভাবছো কি করে।যে তুমি এতবছর ধরে গোপনে এই স্বপ্ন বুকে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছো আজ যখন সুযোগ এসেছে কোন ভাবে কারুর জন্যই তা হাতছাড়া কোরো না।ঐ প্রোজেক্ট হয় কাউকে পেয়ে যাবে আজ না হলে কাল।কিন্তু তোমার এই স্বপ্ন একবার চলে গেলে কিন্তু তা ফেরত আনা আবার খুব কঠিন

মনে হচ্ছে তুমি খুব চিন্তায় আছো।কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছো।তোমাদের রিসার্চের ব্যাপার কিছু?-প্রতীক জিজ্ঞেস করলো সুজাতাকে।ইতিমধ্যে সেও ফিরে এসেছে অফিস থেকে।দুজনে একসাথে মিলে টিফিন করবে ওরা। আগে ফিরতে রাত নটা দশটা হলেও এখন প্রতীক ঠিক করেছে যে সে আর কিছুতেই লেট করবে না।সুজাতাকে বাড়িতে সময় দেবে

মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করতে করতে সুজাতা ভাবলো এবারে কি করবে ও।নিজের মনকেই তো স্থির করতে পারেনি।আর এখনই যদি প্রতীককে বলে আর প্রতীক না করে দেয় তাহলে নিজের কাছেই নিজে হেরে যাবে ও।কিন্তু এই চাপ যে ও আর নিতে পারছে না।মনে হয় প্রতীক ওকে ঠিক সাজেশনই দেবে।এত দিনের বন্ধু ওরা।যদিও উচ্চমাধ্যমিকের পরই দুজনের গতিপথ আলাদা হয়ে গিয়েছে,কিন্তু তাতে বন্ধুত্বতে কোন চিড় আসেনি।সুজাতা বললো-তোমার সাথে অনেক কথা আছে।খুব দরকারী।এক মিনিট দাঁড়াও,খাবারটা গরম করে নিয়ে চলে আসছি

প্রতীক সব শুনলো খুব মন দিয়ে।এটাই ওর অভ্যেস।তারপর সুজাতাকে জিজ্ঞেস করলো-তুমি কি ভেবেছো?

সুজাতা বললো-আমি তো কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না গো।একবার ভাবছি যাই।এতদিন ধরে এরকমই তো কাউকে খুঁজছিলাম আমরা।আবার ভাবছি অন্যটাও

আমি বলছি তুমি যাও-প্রতীক বললো।কারণ এটা আমার বিশ্বাস যে যদি তোমাদের সততা আর নিষ্ঠা থাকে তাহলে কাজে কোনরকমের সমস্যা হবে না

সুজাতা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না।এতটা সাহস প্রতীক ওকে দিচ্ছে।আর হ্যাঁ,এটা তো ঠিক যে এই প্রোজেক্টে ওরা যারা কাজ করতে নেমেছে সেখানে কারুর সততা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই।সারারাত প্রায় জেগেই কাটলো ওদের দুজনের।ভোরের ঠান্ডা বাতাসে একটু চোখটা লেগে এসেছিলো সুজাতার।যখন ঘুমটা ভাঙলো দেখলো জানালার বাইরে ওদের ব্যালকনিতে এসে একটা দোয়েল পাখি টবের ছোট গাছটায় বসে দোল খাচ্ছে আর শিস দিচ্ছে।সুজাতার মনে হল পাখিটা যেন ওকেই বলছে-যাও,তোমাদের কোন খারাপ হবে না,সব ভালো হবে।মনস্থির করে ফেললো সুজাতা

পরদিন সকালে যখন মুখে ঝকঝকে হাসিটা নিয়ে সুজাতা মালহোত্রার চেম্বারে ঢুকলো,উনার বুঝতে একমিনিটও সময় লাগলো না যে এবারে হয়তো উনার স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছে।প্রোজেক্ট এমন একজনকে পরীক্ষার জন্য পেয়ে গিয়েছে যে সব দিক থেকে এই কাজের জন্য যোগ্য তো বটেই এমনকি ওদের প্রোজেক্টরই একজন সঙ্গী

কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিলো তারপর দিন থেকেই।সব কিছুর পরেও মালহোত্রা আরো একবার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সচেতন করে দিয়েছিলেন সুজাতাকে।বার বার বলেছিলেন যদি কোন শারীরিক সমস্যা বা অসুবিধা সে বুঝতে পারে তা যেন অবশ্যই ততক্ষণাত মালহোত্রাকে জানায়

পরদিন ল্যাব যেন একটা সুন্দর উতসবের চেহারা পেয়ে গিয়েছিলো।সবার আনন্দ উতসাহ ছিলো চোখে পড়বার মতো।সবার প্রিয় সুজাতাদিই যে এইকাজে এভাবে ওদের সাথে থাকবে জানতে পেরে সবাই যেন আরো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছিলো যে কাজটা ওদের পেরে উঠতেই হবে

তবে হ্যাঁ,পদে পদে ছিলো বিপদ আর ঘোর অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা।যেদিন প্রথম ওকে ইঞ্জেক্ট করা হল ,জানালার পাশে বসে সে দিনটার কথাই ভাবছিল সুজাতা।এখন ও একদম সুস্থ।দিনে দুবার করে কথা বলছে তিতাস ওর সাথে।একদম সুস্থ আছে সেওসেই প্রথম দিন ইঞ্জেক্ট করার পর কিন্তু সুজাতার শরীরে শুরু হয়েছিলো সামান্য অস্বস্তি।সবাই ভয় পাচ্ছিলো কোন অঘটন না ঘটে যায় আবার।কাঁচের দেওয়ালের ওপারে দাঁড়িয়েছিলো প্রতীক।কিন্তু সুজাতা জানতো যেভাবে সব দিক থেকে ওর শরীরকে প্রস্তুত করে নেওয়া হয়েছে তাতে সমস্যার সম্ভাবনা খুবই কম।আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলো ও।আর তারপরই দেখেছিলো একটা সুন্দর স্বপ্ন

একটা সুন্দর বাগানে ছোট্ট তিতাসকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।চারিদিকের বাতাসে ভাসছে বিভিন্ন ফুলের সুগন্ধ।তিতাস সুজাতাকে একের পর এক গাছ দেখাচ্ছে,বলছে তাদের বিজ্ঞানসম্মত নাম,বিভিন্ন বৈশিস্ট্য।মাঝে মাঝে সুজাতা নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো।এতটা সফল হয়েছে তাদের প্রোজেক্ট

হঠাত বাজা একটা বিপ শব্দে ঘোরটা কাটলো সুজাতার।সকাল থেকেই সে আর প্রতীক অপেক্ষা করছে কখন সেই স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরবে তিতাস।ও আসবে বলে সুন্দর করে ঘরগুলি সাজানো হয়েছে আলো আর ফুলের মালা দিয়ে 

আইহোলে চোখ রাখলো সুজাতা।এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে।তার মানে তিতাস চলে এসেছে।ও সফল।ওদের গোটা পরীক্ষা সফল।আনন্দ আর উত্তেজনায় দরজাই খুলতে ভুলে গিয়ে শুধু প্রতীককেই ডেকে যাচ্ছিলো সুজাতা।চিতকার করে বলছিলো-এদিকে এসো ,তিতাস চলে এসেছে।প্রতীক দৌড়ে এসে বললো-দরজাটা খুলবে তো

দরজা খুলে ওরা বেরুতেই এম্বুলেন্সের পেছনের দরজাটা খুলে গেলো।স্ট্রেচারে বেরিয়ে আসলো ছোট্ট তিতাস।সুজাতা আর প্রতীক কোলে তুলে নিলো ওকে।ও হেসে বললো-হোপ অল ইউ আর ফাইন।আই এম ফাইন থু।।এম্বুলেন্সটা আবার সাইরেন বাজিয়ে বেরিয়ে গেলো

satyamastha@gmail.com
জলপাইগুড়ি




সময়

 

ছবি : ইন্টারনেট

                                                                                                              পার্থ রায়

          পাহাড় চুড়ায় আছড়ে কপ্টারটা অরণ্যে এসে পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই।চারপাশের অজানা বড় বড় গাছেরা হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে মাতালের মত আচরণ করছে।সেসমস্ত গাছে বাসা বাঁধা অজস্র পাখির আর্ত চিৎকারে জঙ্গলের এই জায়গাটা এখন মুখরিত।পক্ষীকূল বাসায় ফেরার সময়ে এহেন দূর্গতির শিকার হয়ে যে যারপরনাই শঙ্কিত সে তাদের যত্রতত্র ওড়াউড়ি দেখেই ঠাহর করা যায়।শীতের পড়ন্ত দুপুরে কপ্টারের আচম্বিত ধাক্কায় তাদের অনেকেই নিশ্চই বাসাহীন হয়েছে।পর্বতশঙ্কুল ঘন অরণ্যে এমন অদেখা ঘটনায় বানর পরিবারও যথারীতি শঙ্কিত হয়ে চিল চিৎকার জুড়েছে।সব মিলিয়ে এতল্লাটে যেন হঠাৎ মেলা বসে গিয়েছে! 

সরকারি কাজে আমরা চারজন অর্থাৎ আমি গ্যাব্রিয়েল, ক্রেগ,ডমিনিক এবং এডি আজ সকালেই কপ্টারে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেস থেকে রওনা হয়েছিলাম।গন্তব্য ছিল চিলি।আবহাওয়াও ছিল অত্যন্ত মনোরম।কিন্তু আন্দিজ পর্বত পেরনোর সময়,মাঝামাঝি জায়গায় ইঞ্জিনের সামান্য সমস্যা দেখা দিল।তখনও আমরা দুজন পাইলট ক্রেগ আর আমি শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেছিলাম পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত মসৃণ জায়গায় কপ্টারটাকে ল্যান্ড করতে,কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগ সে আর হতে দিল কোথায়?তবে শেষবেলায় জঙ্গলে এভাবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে কপ্টার ভেঙ্গে পড়ব তা কল্পনাও করতে পারিনি কেউই।তবে দীর্ঘদিন পাইলট থাকায় আজ একটা বিষয় আমায় ভাবাচ্ছে।তাহল, ইঞ্জিন গন্ডগোল ছাড়াও কিসের যেন একটা অমোঘ টানে যেন এখানে জোর করে নামতে বাধ্য হলাম আমরা।এটা অবশ্য সম্পূর্ণভাবে আমার ধারণা। যাইহোক ঘটনার আকস্মিকতায় দলের চারজনের প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর আঘাত পেয়েছি তা বলাবাহুল্য।বোধহয় আমারই প্রথম জ্ঞান ফিরেছে কিছু আগে।তবে মাথা তুলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমি সিট বেল্ট দিয়ে তখনও লকড,পিছনে তাকিয়ে দেখলাম বাকি দুজনের অবস্থাও একই।ক্রেগকে ডাকাডাকি করে হুশ ফিরিয়ে আমি সাবধানে বাইরে বেরিয়ে দেখি কপ্টারের মুখটা নীচের দিকে আর ল্যাজের দিকটা উপরে, মানে মোটামুটি উল্লম্বভাবে সেটা লতাগুল্মের সাথে অদ্ভূতভাবে পেঁচিয়ে মাটির একহাতের মধ্যে এসে দোলনার মত অল্প অল্প দুলছে।মাথায় আঘাত লেগে কিছু রক্তপাতের ফলে ব্যাথা টের পেলাম কিছুটা পরেই।কিন্তু তা নিয়ে এখন চিন্তা করার সময় নয়।পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখি যথারীতি কোন নেটওয়ার্ক নেই।এটা অবিশ্যি আশাপ্রদই। কিন্তু মুশকিল হল এবার হেডকোয়ার্টারে আমাদের দূর্ঘটনার খবর পৌঁছাতে কালঘাম ছুটল বলে।।

বাকি সদস্যদের উদ্ধার করতেই হবে আকাশে আলো থাকতেই।এর পর এই অচেনা ঘন অরণ্যে কপালে কি আছে আর কিভাবেই বা উদ্ধার পাব তা প্রভু যীশুই জানেন।এদিকে বেলা পড়ে আসার সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে।শীঘ্রই এদের বের করতে আমি যতটা সম্ভব হাঁক ডাক শুরু করলাম,তাতে কিছুটা কাজ হল।কিছুটা বলছি এই কারনে যে, ক্রেগ আর ডমিনিক বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেও এডি কোন সাড়াশব্দ করছে না দেখে আমাদের সন্দেহ হয়।ডমিনিক কোনরকমে ভিতরে ঢুকে এডির নিথর দেহটা আবিষ্কার করে,সাথে মাথায় চাপ চাপ রক্ত। সম্ভবতঃ মাথায় গুরুতর চোটেই এডি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।আপাতত ওকে কপ্টারের মধ্যে রাখাই শ্রেয় বলে মনে হল আমাদের।প্রথমত এখনই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে আর সেক্ষেত্রে ওকে বাইরে এনে অচেনা জঙ্গলে রাখবই বা কোথায়।আর দ্বিতীয়ত,এই অঞ্চলে বাঘের আনাগোনা না থাকলেও যদি তেমন কোন মাংসাশী প্রাণীর উদ্ভব হয় তাহলে আমরা নিজেদেরই হয়তো বা বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ব,সেক্ষেত্রে এডির মৃতদেহকে আগলে রাখা একপর্যায়ে অসম্ভব হয়ে উঠবে।।

আমি যেন বেশ বুঝতে পারছি আজকের রাতটা মোটেই সুখকর হবে না।সকলেরই পেটে দুর্দান্ত ক্ষিধের আগুন জ্বলছে। ঝুলন্ত কপ্টারটার নীচে ইমারজেন্সি লাইট জ্বালিয়ে আমরা তিনজন একটা ছোট আলোচনা সেরে নিয়ে ঠিক করলাম আগে পেটে কিছু দিয়ে নেওয়া যাক।কিছু শুকনো খাবার দাবার আমাদের সাথে নিয়েই বেরিয়েছিলাম ইমার্জেন্সি পারপাসে, সেগুলো দিয়েই আপাতত প্রান রক্ষা করা গেল।আমাদের বহুদিনের সঙ্গী ছিল এডি।ছেলেটা আমাদের সকলের থেকেই বয়েসে ছোট আর শুরু থেকেই ও ছিল প্রানপ্রাচূর্যে ভরপুর একজন মানুষ। কোথাও ট্যুর থাকলে এডি কমন আর ফার্স্ট চয়েস থাকতই।এছাড়া সুন্দর স্বভাব আর বুদ্ধিমান হওয়ায় ও সকলেরই খুব প্রিয় ছিল।ট্যুরের রিমোট জায়গাগুলোতে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুপ্রবেশ নেই,সেসব জায়গায় অবসরে মাতিয়ে রাখতে এডির জুড়ি মেলা ভার। সেই এডি আজ নিশ্চুপতাকে সঙ্গী করে একলা কপ্টারের ভিতর বসে আছে।একটা আলোও জ্বালানোর ক্ষমতা নেই আমাদের।সকলেই হাক্লান্ত হয়ে একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি।কিছুটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় ও বলতে পারেন।এভাবে বসে থাকা ছাড়া কি-ই বা করতে পারি এইমূহুর্তে?

ডমিনিক স্বগতোক্তি করে বলল,এডির পরিবারের কথা চিন্তা করে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে।কারন ওর ছোট ছোট দুটো ছেলে মেয়ে আছে,আর দুজনই সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে।এমতাবস্থায় বাবাকে অকালে হারিয়ে এডির পুরো পরিবার যে অকুল পাথারে পড়বে সেটাই ওকে ভাবাচ্ছে।বাড়ি ফিরে এডির স্ত্রী রিটাকে কি ভাবে মুখ দেখাবে ও?

আমরা সকলেই ওকে সান্ত্বনা দিলাম।আসলে ডমিনিক এডির ফ্যামিলি ফ্রেন্ডও বটে।দুজনে যে অভিন্নহৃদয় বন্ধু তা আমরা সকলেই জানি।তাই এডির প্রতি ওর যে ফিলিংস অনেকটাই বেশি তা সহজেই অনুমেয়। দুহাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে রইলো ডমিনিক।। 

ঘড়ি বলছে এখন রাত ১২টা। এই মূহুর্তে অরণ্যের প্রকৃতি বর্ণনা একমাত্র কোন লেখকই হয়তো যথাযথ ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মাঝে আধখাওয়া চাঁদের উঁকিঝুঁকি, চাঁদের ম্লান আলো অরণ্যের গাছগুলোর ওপর পড়ে আলোছায়ায় যেন সমগ্র জায়গাটায় কলকা কেটে দিচ্ছে।বড় গাছগুলোর ওপর থেকে মাঝেমধ্যে পেঁচার গুরুগম্ভীর ডাক,পাখিদের ডানা ঝটপটানি আর কোনও অজানা আশঙ্কায় হঠাৎই ডেকে ওঠা...সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যথেষ্ট রহস্যময় তো বটেই।আমার খোলা চোখ দুটো তখন চাঁদের ওপরে।ভাবছি এ কোন ধাঁধায় পড়লাম?বর্হিবিশ্বের থেকে যেন দ্বীপের মত আলাদা হয়ে গেছি আমরা ক'জন। এই পরিস্থিতিতে কে ই বা আসবে আমাদের উদ্ধার করতে?সভ্য জগতের যে কোন ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে এখন আমরা বিছিন্ন। কিভাবে যে এর থেকে উদ্ধার হব....ওঃ ভগবান 

চোখটা যেন কোন অচেনা বুনো ফুলের গন্ধের আবেশে বুজে এসেছে এমন সময় কপ্টারের ভিতর ওয়াকিটকিটা যেন নড়ে চড়ে উঠল....তন্দ্রা ছুটে গেল এক নিমেষে!ঠিক শুনলাম তো???

নাঃ মনে হচ্ছে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।এই পান্ডব বর্জিত স্থানে ট্রান্সমিশন হওয়া প্রায় অসম্ভব।হাতঘড়িটা সময় দেখাচ্ছে রাত ১টা ৪৫। এসব ভাবতে ভাবতে আবার কখন চোখটা লেগে গেছে জানি না।আবার তন্দ্রা চটকে গেল কিছুক্ষণ পর। কারন ওই একই.... ওয়াকির আওয়াজ।চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় বসে ঘুমোচ্ছে। এরকম একটা শান্ত জনমনিষ্যিহীন জঙ্গলে ওয়াকির মত কর্কশ আওয়াজে আমারই বারংবার নিদ্রা ভঙ্গ হচ্ছে তাহলে?

আমি উঠে পড়লাম এবার।একটু কপ্টারে যাওয়া দরকার।টর্চের আলোয় অনেক মেহেনত করে উঠলাম কপ্টারে।আলো ফেলে যা দেখলাম তাতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।দেখলাম এডি নেই।ওকে আমি নিজের হাতে সিটে দড়ি দিয়ে বেঁধে বসিয়ে রেখে নীচে নেমেছিলাম ভাল করে চেক করার পরে!ভুল হতেই পারেনা আমার। কাঁপা হাতে টর্চটা ফেললাম নিচের দিকে।দেখলাম দড়িটা সিটের নীচে পড়ে আছে।এডি যেন ওটাকে খুব সন্তর্পণে খুলে আস্তে আস্তে নীচে নেমে কোথাও গেছে।এবার একটা আতঙ্ক যেন গ্রাস করতে শুরু করেছে আমাকে।বুঝতে পারছিনা চেঁচিয়ে এডিকে ডাকব কি না!নাকি বাকিদের ঘুম থেকে ডেকে তুলব!কি করব আমি?এ কি করেই বা সম্ভব? একজন মৃত মানুষের শরীর এভাবে সবার সামনে দিয়ে গায়েব হয়ে যায়ই বা কিভাবে?

এর পর আমার মধ্যে কি হল তা ব্যাখ্যা করা মুশকিল।সব ভয় দূরে ঠেলে ভোরের আলো না ফোটা অব্দি আমি আশেপাশের জঙ্গল তন্নতন্ন করে এডিকে খুঁজেছি।তারপর ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে ভেঙে পড়েছি।সবাই আমার জন্য মারাত্মক চিন্তা করছিল,সেজন্য প্রচুর তিরস্কারও লাভ করলাম।কীজন্য জঙ্গলে গেছিলাম তা বলতে সবার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠল।তৎক্ষনাৎ ডমিনিক চড়তে শুরু করল কপ্টারে।কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপর থেকে কিছু বাছা বাছা বিশেষন ভেসে এল আমার জন্য।আমি নাকি সকলের অলক্ষ্যে কাল রাতে নেশা করেছি।লাল জ্যাকেট পরা এডি যথারীতি কপ্টারেই রয়েছে ওর নিজের জায়গায়!

আমি আর ওপরে ওঠার প্রয়োজন মনে করিনি।

যাইহোক, সবাইমিলে পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত মসৃণ, কম জঙ্গুলে জায়গাটায় যাবার পথে একটা পাহাড়ি ঝড়নার সন্ধান পেলাম।জল একদম বরফগলা, ঠান্ডা কনকনে।তাই-ই কোন রকমে গলাধঃকরণ করে সিদ্ধান্ত নিলাম এই ঝড়নার ধারের মাটিতেই এডিকে গোর দেব।কবে এখান থেকে উদ্ধার পাব বলা একপর্যায়ে অসম্ভব।বাঁধ না মানা চোখের জলে দুপুরের মধ্যে আমরা এডির শেষকৃত্য সম্পন্ন করলাম।।

এরপরের কিছুদিন যেভাবে কেটেছে তা সিনেমার স্ক্রিপ্টকেও বোধহয় হার মানাবে।দূর্ঘটনাস্থল ছেড়ে সবাই পাততাড়ি গুটিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল নীচ থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু আর নেড়া জায়গায় চড়া।ভাগ্যক্রমে কোন উদ্ধারকারী কপ্টারের নজরে যদি পড়া যায় তবে প্রান বাঁচলেও বাঁচতে পারে।ক্ষিধে,জল পিপাসা আর ঘুমে সবাই মারাত্মক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।ক্ষিধের তাড়না এক অপ্রতিরোধ্য আর ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে শুরু করল।প্রথম কদিন আমরা পাহাড়ি নদীর মাছ আর গাছের ফলমূলের ওপর ভরসা করেছিলাম।কিন্তু এই প্রচন্ড শীতে নদীর বরফজমা জলে নেমে খালি হাতে মাছ ধরা একরকম অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।আমরা অন্যান্য আমিষ খাবার সন্ধান করতে শুরু করি।পথে পাহাড়ি উইলো আর বার্চগাছগুলোতে চড়ে পাখি ধরে ধরে উদরস্থ করতে শুরু করলাম প্রথমদিকে।যদিও অধিকাংশ সময়েই চেঁচামেচি করে পক্ষীকূলকে শতর্ক করে দিত বানরবাহিনী,যার ফলে সেদিন হয়ত অভুক্ত অবস্থায় থেকে গেলাম।এরপর অবশ্য প্রানরক্ষার তাগিদে বুনো শূয়োর,টাপির,প্যাঙ্গোলিন,সাপ এমনকি লামা কি খাইনি!বুঝলাম মানুষ সত্যিই সর্বভুক প্রানী।

এভাবে কদ্দিন কাটালাম জানি না,কিছু বলাও অসম্ভব আমাদের পক্ষে।মোবাইলগুলোর ব্যাটারি ড্রেন হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই....আমরাও সেগুলো একদিন মাটি চাপা দিয়ে সভ্য জগতের সাথে শেষ সম্পর্ক ত্যাগ করলাম।আজ কতদিন অজানার উদ্দেশ্যে হেঁটে চলেছি তার কোন হিসাব নেই।আজ কোন তাড়া নেই, কারো কোন অভিযোগও নেই।পাহাড়ে চড়ার পথে কোন জায়গা পছন্দ হলে সেখানে দিন কতক জিরিয়ে নিই।মাঝেমধ্যে এটাও ভুলে যাই আমরা চলেছিই বা কোথায়? ডমিনিক মাঝে নিজের নামই ভুলে গেছিল একবার।ওকে স্মরন করাতে বলেছিল 

----নাম মনে রেখে হবেটাই বা কি?আমরা তো আর ফিরে যেতে পারব না!

চমকে উঠেছিলাম আমি।আশ্চর্য! একথাটা আমি নিজেও যে কোন দিন ভাবিনি তা নয়।নদীর জলে প্রতিবিম্ব দেখেছি নিজের, চুল দাড়ির ফাঁকে নিজেকে চিনতেই পারিনি। মাঝে মধ্যে নিজের ফ্যামিলির কথা মনে পড়লে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠা ছাড়া কোথাও কোন অসুবিধা নেই।জঙ্গলে এখনো অব্ধি কোন নতুন মানুষের সাথেও দেখা হয়নি।আর একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি এতদিনে আমরা বন্য জীবনের সাথে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি,মানিয়ে নিয়েছি।একদিন পৌছলাম একটা খুব চেনা জায়গায়।এরকম জায়গা যা দেখে মনে হয় আমরা বেশ ক'দিন কাটিয়েছি এতল্লাটে।দেখলাম সবার মধ্যেই একটু চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে বহুদিন পর।একটু ঘোরাঘুরির পর খুঁজে পাওয়া গেল একটা হেলিকপ্টার। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে গেল সবকিছুই... এই সেই জায়গা....আমাদের দূর্ঘটনাস্থল।কেউ যেন আমাদের জন্যই ওটা সারিয়ে রেখে গেছে আর গাছের আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ করে বেজায় হাসছে আমাদের বোকা বনে যাওয়া মুখগুলো দেখে।কোন কিছু চিন্তা না করে আমি, ডমিনিক আর ক্রেগ অনেকেদিনের অভ্যাসবশত ঝট করে উঠে পড়লাম কপ্টারটাতে।সিটবেল্ট বেঁধে হেডসেটটা কানে লাগিয়ে দিলাম স্টার্ট।প্রপেলার ধীরে ধীরে গতি বাড়াল।আমরা রূদ্ধশ্বাসে বোতামটা টিপতে উড়ে চললাম উপরের দিকে....বার্চ পাইন আর বুনো লতাপাতা ভেদ করে।বহুকালের অভ্যাস আমার এই চপার চালানো, আর তাতে একটুও মরচে পড়েনি দেখে একটুও অবাক হলাম না।ভেঙে পড়া কপ্টার এতকাল পরে সারিয়ে কে রেখে গেছে আমাদের জন্য,আর তার উদ্দেশ্যই বা কি তা নিয়ে মাথাব্যাথার সময় এখন নয়।বেশ কিছুটা উড়ে গেলাম, তবে দেখলাম কোন ট্রান্সমিশন কাজ করছে না।এ অবস্থায় কপ্টার চালানো স্বভাবতই কঠিন আর ততোধিক বিপজ্জনকও।ট্রান্সমিশন ইকুইপমেন্ট ছাড়া বাদবাকি সব ঠিকই আছে বলেই মনে হয়।নীচে সবুজ জঙ্গলের চাদরের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছি মুক্ত বিহঙ্গের মত....

এইসময় একটা ব্যাপার ঘটল,যেটার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।অরণ্যের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আমি কপ্টারটাকে আরেকটু উচ্চতায় তোলার জন্য বোতামে হাত দিতেই একটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি আমাদের সকলকে যেন কাঁপিয়ে দিল।আমরা সকলেই অনুভব করছি একটা প্রচন্ড আকর্ষণ যেন আমাদের এখান থেকে বেরোবার পথে বাধা সৃষ্টি করছে।যেন অত্যন্ত শক্তিশালী এক চুম্বক পরম আবেশে কপ্টারটাকে আলিঙ্গন করতে চাইছে!ব্যাপারখানা কি ঘটছে সেটা বুঝতে না পারলেও আমি কিন্তু বোতাম থেকে হাত সরালাম না...একটা রোখ চেপে গেছে যেন।আতঙ্কে আমরা চিৎকার করতে লাগলাম অথচ বিশ্বচরাচরের কেউই যেন আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে উদ্ধার যে করতে আসবে না সেটা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছি।এরকম মনে হতে লাগল যে হয়ত দ্বিতীয়বারের জন্য প্রান হারাতে বসেছি!

এভাবে কতক্ষণ চললো কোন ধারনা নেই আমার,বলা উচিৎ আমাদের।একটা ঘোরের মধ্যে যখন সান্টা ফে -র উপর দিয়ে উড়ে চলেছি তখন সম্বিত ফিরল আচমকা ওয়াকির শব্দে....তারমানে এভিওনিক্স সিস্টেম আবার কাজ করতে শুরু করেছে??আমি অফিসের কন্ট্রোল অফিসারের সাথে কথা বলে নিলাম তড়িঘড়ি। হিসেব মত এখনো ন'হাজার কিলোমিটারের বেশি রাস্তা বাকি বুয়েনস আইরেস পৌঁছাতে,কমসে কম সন্ধ্যা হয়ে যাবে।পথে এডির কথাও চিন্তা করতে লাগলাম....কি জবাব দেব ওদের?জলজ্যান্ত ছেলেটাকে হারিয়ে আমরাও যে যথেষ্ট বিমূঢ় সেটা বাকিরা বুঝবে তো?অনেকক্ষণ উড়ানের পর যখন চপারটা হেলিপ্যাডে নামল তখন সূর্য পাটে যেতে বসেছে।অফিসের কর্মচারীরা আমাদের দেখার জন্য এখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু দূরেই।তা তো থাকবেই,এদ্দিন পরে আমরা জীবন নিয়ে ফিরছি!এতো একটা দূরুহ অভিযান থেকে সশরীরে ফেরার মতই রোমাঞ্চকর, তারা আজই সে গল্পের স্বাদ নিতে চায় হয়ত।আমরা একে একে নেমে এলাম চপার থেকে।সবার আগে কোম্পানির বড় সাহেব আব্রাহাম এগিয়ে এসে একে একে সবাইকে উষ্ণ আলিঙ্গন করলেন।সম্ভাষণ করলেন শিগগির ভিতরে আসার জন্য।অবাক হলাম,উনি এত বুড়ো হলেন কবে?কৌতুহলী ভিড়টা মাঝখান থেকে দু খন্ড হয়ে গিয়ে আমাদের চলার পথ করে দিল।আমরা ভিতরে এসে বসতেই কফি আর আমার প্রিয় কুকিজ হাজির হল।আমার কিন্তু এবার বিরক্তই লাগল...বলতেও যাচ্ছিলাম যে আপনারা কি এখন তাড়িয়ে তাড়িয়ে আমাদের কাছে গল্প শুনতে চাইছেন??কফির পেয়ালাটা মুখে তুলতে গিয়েও থমকে গেলাম।অপার বিস্ময় নিয়ে চোখ মেলে দেখি সামনেই টেবিলের ওপর রাখা ক্যালেন্ডারের পাতা রয়েছে ডিসেম্বরের ঘরে,আর সালটা ২০৪৯!এর মানে কি?আমরা কি স্বপ্ন দেখছি? মাথা এতটাও খারাপ হয়ে যায়নি যে ইতিমধ্যে সব ভুলে যাব।ব্রেন যথেষ্ট একটিভ রয়েছে।আমরা তিনজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম প্রত্যেকেই প্রায় নতুন মুখ।আমাদের সময়কার সিনিয়রদের যেমন রোনান,হিউগো,দিয়েগোকে দেখছিনা তো।হয়তো রিটায়ার্ড হয়েছেন সব।কিন্তু আমাদের সমবয়সী আন্টোনিও, মার্কো,স্টিফেন আথবা এরনেরও পাত্তা নেই কেন?সব চাকরি ছেড়ে দিল নাকি?

এবার প্রথম একটা হাত এগিয়ে এল,করমর্দনের জন্য।বয়স্ক ভদ্রলোককে ঠিক চিনতে পারলাম না বলে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম।উনি নিজের পরিচয় দিলেন রোল্যান্ড বিনি নামে।আরে রোল্যান্ড তো আমাদের বছর ছয়েকের জুনিয়র অফিসার ছিল। 

আমি মজার ছলে বললামঃ কি হে তুমিও শেষে এত বুড়িয়ে গেলে?

রোল্যান্ড উত্তর দিল- স্যর,দয়া করে কিছু মনে করবেন না,আপনারা যে তিরিশ বছর যে পরে দেশে ফিরলেন সে খেয়াল আছে?

এবার মিঃ আব্রাহাম এগিয়ে এসে বললেন-তোমাদের নিখোঁজ হওয়ার খবরে গোটা দুনিয়ায় রীতিমতো চর্চা চলছে সে খবর রাখ?আজ অব্ধি কত টন নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়ছে তার হিসেব আছে তোমাদের?সরকার তোমাদের সাথে লাগাতার ৩০ বছর ধরে যোগাযোগ রাখার চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখেননি।অন্তর্ঘাতের ভাবনা মাথায় রেখে দেশ-বিদেশে কম অনুসন্ধান হয়নি। উন্নত ইনস্ট্রুমেন্টস ব্যবহার করার ফলস্বরূপ কোন কোন সময় মাঝেমধ্যে সিগনাল রিসিভ হলেও তোমাদের ফিজিক্যাল সন্ধান সেভাবে কোন ভাবেই পাওয়া যায়নি।অবশেষে গতকাল থেকে তোমরা সাড়া দিতে শুরু করলে...

কিন্তু তোমাদের দেখে আমরা অবাক হচ্ছি...তিরিশ বছরের সময়ের ছাপ কিন্তু তোমাদের কারুর চেহারায় পড়েনি।হ্যাঁ, তোমাদের পোশাক-আশাক ঠিকঠাক নয়, চুল-দাড়িও বেড়েছে কিন্তু বয়স থেমে আছে মোটামুটি সেদিনেই, যেদিন তোমরা ডকুমেন্টস নিয়ে চিলির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছিলে।উনি বলে চললেন আরো অনেক কথা কিন্তু সেসব আর কানে প্রবেশ করছে না,আমরা সিট ছেড়ে উঠে পড়লাম ওয়সরুমের দিকে,প্রচন্ড কৌতুহলকে সঙ্গী করে।ভিতরে বেসিনের সামনের আয়নায় তিরিশ বছর পর দেখলাম নিজেদের,সত্যি অবিশ্বাস্য ব্যাপার!আজ যদি ২০৪৯ সালের জানুয়ারীর ২৫ তারিখ হয় তাহলে হিসেব মত আমার বয়স ৭৫প্লাস হওয়া উচিৎ।কিন্তু সত্যিই আশ্চর্যজনক ভাবে আমায় দেখতে সেই বছর পঁয়তাল্লিশের মতোই রয়ে গেছে,মুখে বলিরেখার কোন ছাপ নেই,চামড়া টানটান,চুলেও তেমন পাক ধরেনি আর চেহারাও নির্মেদ টানটান।বাকিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।যেন বয়েসটা থেমে আছে একই সময়ে!তাহলে গত তিরিশটা বছরই বা কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের জীবন থেকে?আমরা ছিলামই বা কোথায় এদ্দিন? কিছু প্রবন্ধ আমি পড়েছি টাইম ট্রাভেলের ওপর,এ তবে কি তাই?মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগল..তাহলে এডিকে আমরা কোথায় হারিয়ে এলাম?আমাদের পরম প্রিয় বন্ধুকে কি সময়ের গহবরে গ্রাস করে নিল?

একে একে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম ওয়সরুম থেকে।আমরা দেখলাম এডি বিমূঢ় হয়ে বসে আছে সোফার ওপর।সেই ৩০বছর আগের বয়সে।না,ওর সামনে কোন কফির ধূমায়িত পেয়ালা নেই,নেই কোন কুকিস এর ডিস।ওকে ঘিরে কারো কোন প্রশ্ন নেই, অভিজ্ঞতা শোনার আর্জি নেই।

বুঝলাম,আসলে এডিকে কেউ দেখতেই পাচ্ছে না।।

papu.partho@gmail.com
কলকাতা





দুরমুশ

 

ছবি : ইন্টারনেট
                                                                                                                   সায়ন্তন বাগ

       পৃথিবী থেকে  বহু আলোকবর্ষ দূরে এক গ্রহ – নাম দুরমুশ । প্লায়াডীস নক্ষত্রপুঞ্জ বাঁহাতে রেখে, সাবধানে দু-একটা কৃষ্ণ গহ্বরের পাশ কাটিয়ে আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলে যে একটা লোহিত বামন পড়বে, সেখান থেকে ডানদিকের নতুন নিউট্রন নক্ষত্রটা অবধি যেতে হবে । এর বেশি বলা মানা আছে, মুখ ফস্কে রাস্তার সন্ধান  দিয়ে ফেললে, আন্তর্নক্ষত্র গুপ্তচরেরা রাতদুপুরে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে টাইটানের মিথেন সমুদ্রে গুম করে ফেলবে, ঘ্যাঁকোপক্ষীটি পর্যন্ত টের পাবে না । দিনকাল ভালো নয়, চেপে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ । বরং বল্টুবাবুর কথাতেই আসি ।

বল্টুবাবুর কথা বলতে গেলে অবশ্য দুরমুশের কথা খানিকটা গোড়ায় বলে নেওয়া দরকার । দুরমুশেও প্রাণ আছে, তবে সে প্রাণ জৈবিক নয়, যান্ত্রিক । কার্বনের ঘ্যাঁট নয়, পুরাকালে এখানে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল সিলিকনের ঠাণ্ডা, পাতলা, মুচমুচে নিমকি থেকে । কম্পিউটার, অল্পপিউটার, বেশিপিউটার, বিবর্তনের নানা এবড়ো-খেবড়ো পথ পেরিয়ে এখন বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত হয়েছে । বিবর্তন পিরামিডের চূড়োয় বসে থাকা এই প্রাণীদের আমরা যানুষ বলতে পারি । যানুষ, অর্থাৎ যান্ত্রিক মানুষ ।

আমাদের বল্টুবাবুও এইরকম একজন যানুষ । ছাপোষা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, একটা বেসরকারি সংস্থায় অল্প মাইনের চাকরি করেন, কোনরকম করে চলে যায় । বল্টুবাবুর সংসারে দুটিমাত্র প্রাণী, বল্টুবাবু নিজে আর বুড়ি কব্জা পিসী । মাইনেতে পোষাতে পারবেন না বলে বল্টুবাবু বিয়ে করেননি, সে নিয়ে কব্জা পিসীর খানিকটা খেদ আছে । শেষ বয়সে নাতি নাতনীর মুখ দেখতে পারলাম না বলে মাঝে মধ্যে আক্ষেপ করেন।

আজ সোমবার, অফিস যাবার তাড়া আছে । বল্টুবাবু কোনরকমে নাকে মুখে গুঁজে গ্রীজ মেখে চারটি কাঁটা পেরেকের ভাত খাচ্ছিলেন । অবশ্য বেশি তাড়াতাড়ি খাবারও উপায় নেই, আজকাল রেশনের যা হাল, কাঁটা পেরেকের সঙ্গে দুচারটে বড় পেরেকও মাঝে মধ্যে মুখে পড়ে, সাবধান না হলে হয়ত দাঁতই খুলে গেল । অফিসের শাবলবাবু সেদিন বলছিলেন তাঁর ভাতে সেদিন নাকি একটা গজাল পড়েছিল । অবশ্য শাবলবাবুর সব কথায় বিশ্বাস করা যায় না, ভদ্রলোক বড্ড গাঁজাখুরি গল্প করেন ।

ঘরের জানলার সামনে বসে কব্জা পিসী রোদ পোয়াচ্ছিলেন । পিসীর অনেক বয়েস হয়েছে, কানের মাইক্রোফোনে মরচে পড়ায় ভালো শুনতে পাননা । বুকের ব্যাটারির আয়ুও ফুরিয়ে এসেছে, ঘণ্টাখানেকের বেশি রিচার্জ হয় না । পিসীর পিঠে একজোড়া সৌর পাটা আছে, ওভারটাইমের টাকায় বল্টুবাবুই গড়িয়ে দিয়েছিলেন । সকালের দিকটা খানিক্ষণ রোদে পিঠ দিয়ে পিসী তাই খানিকটা জোর বাড়িয়ে নেন । এক চিলতে ঘরে অবশ্য রোদ বেশিক্ষণের জন্যে আসে না, তাই সন্ধ্যের দিকটা পিসী আজকাল ঝিমিয়ে পড়েন, সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না । বল্টুবাবু ইদানীং ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে বেরোন, বেশী রাত হলে পিসীর উঠে আর দরজা খোলার ক্ষমতা থাকে না । আজকাল চিকৎসা শাস্ত্রের কত উন্নতি হয়েছে, ক্ষুদে ক্ষুদে জোরালো ব্যাটারি বেরিয়েছে, সে সবে জলও দিতে হয় না, চলেও অনেক দিন । বল্টুবাবু ইচ্ছে, বিশ্বকর্মা পূজোর বোনাসটা পেলে তারই একটা পিসীর বুকে বসিয়ে দেবেন । বুড়ি ছাড়া তাঁর তিনকলে আছেই বা কে ! আহা ছোটবেলা থেকে  পিসীই তো তাঁকে কোলেপিঠে করে যানুষ করেছে ।কেরোসিনে আঁচিয়ে,  শিরিষ কাগজে মুখ মুছতে মুছতে বল্টুবাবু বললেন,

– আমি আসছি পিসী, তুমি সাবধানে থেকো ।

– আমি আর কি সাবধান থাকবো বাবা, আমি তো বাড়িতেই বসে আছি । তুইই বরং সাবধানে যাস, যা দিনকাল পড়েছে । আয় বাবা । বিশ্বকর্মা, বিশ্বকর্মা ।

দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন কব্জা পিসী ।

মোটে সময় নেই, অফিসের লেট হয়ে যাবে, প্রায় ছুটতে ছুটতেই বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালেন বল্টুবাবু ।

অফিসটাইমে বাসে বাদুড়ঝোলা ভিড় । কোনমতে একটা আঙটায় লটকে ঝুলতে ঝুলতে যখন বল্টুবাবু অফিস এসে পৌঁছলেন  তখন নটা বাজতে মাত্র মিনিট দুয়েক বাকি । ম্যানেজার নেহাইবাবু আজকেও লেট মার্ক লাগাতে পারবেন ভেবে খুশী মনে বসে ছিলেন, বল্টুবাবুকে দেখে কিঞ্চিৎ ব্যাজার হলেন,

-আপনার দেখছি একেবার কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি ধরে আসা । পাঁচমিনিট আগে এলেও তো পারেন ? যান, যা্‌ন, টেবিলে গিয়ে বসুন ।

বল্টুবাবু গোবেচারা মানুষ, চুপ করে টেবিলে বসে পড়লেন, কিন্তু খড়কের বয়স কম সে পাশের টেবিল থেকে তড়পে উঠল,

-কেন পাঁচমিনিট আগে এলে আপনার কোম্পানী পাঁচপয়সা বেশী দেবে নাকি ?

-যাও যাও তোমায় ওস্তাদি করতে হবে না ।

খিঁচিয়ে উঠলেন নেহাইবাবু ।

ব্যাপরাটা বেশী গড়াতে না দিয়ে বাধা দিলেন বল্টুবাবু ,

-ছাড়ো না খড়কে, কাল থেকে না হয় একটু আগেই আসবো ।

-আরে দূর বল্টুদা, আপনি বড় বেশী ভালযানুষ । ওইজন্যেই তো সবাই আপনার মাথায় ক্যানেস্তারা ভেঙ্গে খায় ।

ঊত্তর না দিয়ে তর্জনীর ডগাটা খুলে কলমের মাথাটা বের করে ফেললেন বল্টুবাবু, সামনে হিসেবের খাতাটা টেনে নিয়ে লেগে 

গেলেন কাজে ।বল্টুবাবু তিনপুরুষের জাত  কেরাণী । কলম আঙুলের ডগাতেই বসানো আছে ।

অন্যদিন ওই খাতা লিখতে লিখতেই সারাটা দিন কেটে যায় বল্টুবাবুর , সন্ধ্যের সময় আবার আঙুলের ডগাটা বন্ধ করে খাতাপত্র গুটিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ান । বল্টুবাবুদের তিনপুরুষের এইভাবেই কেটে গেছে।

কিন্তু আজ কেমন সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল ।

মালিক বয়লারনাথ বারকোশিয়া নিজের ঘর ছেড়ে বড় একটা বেরোন না , নেহাইবাবু যা দরকার সব বুঝে এসে সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দেন, কিন্তু আজ হঠাৎই আরো দুজনকে সঙ্গে করে সবার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন তিনি ।

-ইনি মিস্টার শ্যাফট । আপনাদের একটা ডেমন্সট্রেশন দেবেন । নেহাইবাবু, আপনি এনাদের একটু বসার জায়গা করে দিন ।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চই, নিশ্চই । উঠুন, উঠুন ।

বল্টুবাবু আর খড়কেকে উঠিয়ে তাদের জায়গায় বারকোশিয়ার সঙ্গীদের বসিয়ে দিলেন নেহাইবাবু ।

দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে দুজনকে ভাল করে চেয়ে দেখলেন বল্টুবাবু । মিস্টার শ্যাফট বিদেশী বলেই মনে হয় । ঝকঝকে শরীর থেকে একেবারে আলো ঠিকরে যাচ্ছে । ঠোঁটের কোনে কায়দা করে ধরা পাইপ , তার থেকে হাল্কা হাল্কা ধোঁযা  বেরোচ্ছে । সঙ্গের মেয়েটি এদেশী হলেও একেবারে আধুনিক কেতা দুরস্ত প্লাস্টিকে মোরা চেহারা তার ।

-সাম পেপার প্লীজ ।

মিস্টার শ্যাফটের অনুরোধে একটা রাইটিং প্যাড বাড়িয়ে দিলেন নেহাইবাবু । অফিসের বাকি লোকজন ততক্ষণে চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে ।

রাইটিং প্যাডটা মেয়েটির সামনে ধরে দিয়ে মিস্টার শ্যাফট বললেন,

-ইউ মে স্টার্ট ডালা

রাইটিং প্যাডটা নিজের সামনে যত্ন করে বসালো ডালা । তারপর হাতের কব্জীদুটো টেবিলের ওপর বসিয়ে, দুহাতের আটটা আঙুল দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে টকাটক করে বাজাতে আরম্ভ করল রাইটিং প্যাডের ওপর ।

কি হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইল অফিস শুদ্ধু সবাই ।

মিনিট দুয়েক টকাটক করে আঙুল চালিয়ে হাত তুলে নিল ডালা । হাত বাড়িয়ে রাইটিং প্যাডটা তুলে নিলেন বয়লারনাথ বারকোশিয়া, একবার নজর দিয়ে তুলে দিলেন নেহাইবাবুর হাতে ।

রাইটিং প্যাডে চোখ বুলিয়ে একেবারে আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠলেন নেহাইবাবু ।

-আরে দারূন হয়েছে স্যার ! ওঃ ভাবা যায় ! এত তাড়াতাড়ি এত সুন্দর কাজ ! দেখুন। দেখুন, আপনারা সবাই দেখুন ।

বল্টুবাবুর দিকে প্যাডটা এগিয়ে দিলেন নেহাইবাবু ।

খড়কে, বল্টুবাবু সমেত আরো দুচারজন ঝুঁকে পড়ে দেখলেন, ওইটুকুর মধ্যেই প্যাডের ওপর থেকে নিচ অবধি আগাগোড়া টাইপ করে ফেলেছে ডালা ।

সঙ্গীদের নিয়ে বারকোশিয়া ফেরৎ গেলেন নিজের ঘরে, আর নেহাইবাবুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনতে শুনতে মনে কেমন একটা আশঙ্কা নিয়ে বল্টুবাবু ফের মন দিলেন নিজের কাজে ।

বল্টুবাবুর আশঙ্কা মিথ্যে হল না । সন্ধ্যেবেলা অফিসের শেষে তিনি বাসস্ট্যাণ্ডে এসে দাঁড়িয়েছেন, খড়কে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-বল্টুদা, খবর শুনেছেন তো ?

-কি খবর ভাই ?

-আমাদের অফিসের কাজ এবার আউটসোর্স হবে ।

অবাক হলেন বল্টুবাবু,

-আউটসোর্স ! সে আবার কি ব্যাপার ?

-খুব সোজা ব্যাপার । যে সব কাজ আমরা করি সেগুলো কোম্পানী সব বাইরে থেকে করাবে । ওই যে সাহেব ব্যাটাকে দেখলেন না ? ওর কাছে ডালার মত আরো গোটা পঞ্চাশেক মেয়ে আছে । আমাদের কোম্পানীর যা কাজ সব ওদের দিয়ে দেবে,  আর ওরা সে সব অর্ধেক সময়ে নামিয়ে দেব ।

-মানে –

-মানে খুব সোজা বল্টুদা, আমাদের চাকরি দিয়ে টানাটানি হবে । কিন্তু আমিও অত সহজে ছাড়ার পাবলিক নই বল্টুদা , রুজিতে হাত পড়লে ছেড়ে কথা কইব না ।

-কি করবে ?

-কি করব কালকের মধ্যেই দেখতে পাবেন । আমাদের পাড়ার পরাতদা পার্টি করে । সন্ধ্যেবেলাই তার সঙ্গে দেখা করে সব কথা বলছি । তারপর দেখবেন না !

কি দেখবেন কিছু বুঝতে না পেরে বল্টুবাবু সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি গেলেন ।

তা পরের দিন ভালই দেখলেন বল্টুবাবু ।  সকালবেলা অফিসে পৌঁছে দেখলেন অফিসে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে একটা ছোট স্টেজ বানানো হয়েছে, তার সামনে সারি সারি চেয়ার পাতা । অফিসের সব লোকজন স্টেজের সামনে বসে । খড়কে বুকে একটা ব্যাজ এঁটে ব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক ঘুরছিল, বল্টুবাবু তাকে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,

-এসব কি খড়কে ? অফিসের দরজা বন্ধ কেন ?

-কি আবার বল্টুদা ? আমরা স্ট্রাইক করছি ।

-স্ট্রাইক ! – আঁতকে উঠলেন বল্টুবাবু – স্ট্রাইক কেন

-কেন আবারা ! মালিকপক্ষ আমাদের দাবি মানলো না, বলে কিনা বাইরে থেকে কাজ করাবে । তাই বাধ্য হয়ে স্ট্রাইক ডাকতে হল । মামদোবাজি নাকি ? এক্ষুণি পরাতদার বক্তৃতা হবে, যান বসে পড়ুন । আর আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দিন ।

-পঞ্চাশটাকা ! কেন ?

-মেম্বারশিপের চাঁদা ।

-মেম্বারশিপ ? কিসের মেম্বারশিপ ?

-বাঃ ! – অবাক কন্ঠে বলল খড়কে – আন্দোলন করতে হলে পার্টির মেম্বার হতে হবে না !

-পঞ্চাশটাকার মেম্বার হয়ে বক্তৃতা শুনতে বসে পড়লেন বল্টুবাবু ।

পরাতদার পুরো নাম পরাতচন্দ্র দা । খড়কের ভাষায় ‘সর্বহারার মহান নেতা’ । গ্রীজ পালিশে চকচকে চেহারা । বক্তৃতা ভালই করলেন । ঘন্টা দুয়েকে টানা বক্তৃতার পর শোষণ, নিপীড়ন, মেহনতী মানুষ, বৃহত্তর সমাজ, এইসব শক্ত শক্ত কিছু শব্দ  শিখে বল্টুবাবু  সেদিনকার মত বাড়ি গেলেন  ।

বল্টুবাবু সাততাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাতে কব্জা পিসী প্রথমটা চমকে উঠেছিলেন । ভেবেছিলেন শরীর খারাপের জন্যে বল্টুবাবু বাড়ি ফেরৎ চলে এসেছেন । তারপর সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন,

-আমি আগেই আঁচ পেয়েছিলুম অঘটন কিছু একটা ঘটবে । আজ সকালে থেকেই আমার বাঁ অ্যান্টেনা নাচছে ।

এর পরের কয়েকটা সপ্তাহ বল্টুবাবুর কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল । অভ্যাসবশতঃ তিনি রোজ সকালবেলা বাস ধরে অফিসে যান, অফিসের সামনে চুপচাপ খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর বাড়ি চলে আসেন । তিনি ছাড়া বাকি কর্মচারীদেরও একই অবস্থা । শাবলবাবু, গাঁইতিবাবু । এমনকি অফিসের পিওন ছেণীলাল পর্যন্ত সবাই সকালের দিকটা কাঁচুমাচু মুখে অফিসের সামনে ঘুরঘুর করেন, তারপর চুপচাপ বাড়ি চলে যান । একা কেবল খড়কেই দেখে নেব, ফাটিয়ে দেব বলে তড়পে যায় । পরাতদা সেই প্রথমদিনের পর আর আসেন নি, তবে খড়কে মারফৎ জানা গেছে যে তিনি বল্টুবাবুদের সঙ্গেই আছেন, তাঁদের আন্দোলন তিনি ব্যর্থ হতে দেবেন না ।

পনেরো বছরের কেরাণী জীবনে বল্টুবাবু কোনদিন এরকম অবস্থায় পড়েন নি । সারাদিন তিনি কি করবেন ভেবে না পেয়ে কেমন একটা দিশেহারা বোধ করেন ।

সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় আর থাকতে না পেরে লজ্জার মাথা খেয়ে বল্টুবাবু শাবলবাবু আর আরো দুচারজনকে সঙ্গে করে নেহাইবাবুর কাছে গিয়েছিলেন কি হচ্ছে বোঝার জন্যে । কিন্তু নেহাইবাবু তাঁদের একরকম গলাধাক্কা দিয়েই বের করে দিয়েছেন ,

-যান, যান, আমি কিছু জানি না । স্ট্রাইক করার সময় মনে ছিল না ? কোম্পানী বন্ধ হলে বুঝবেন ঠ্যালা ।

নেহাইবাবু মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়াতে বল্টুবাবুদের বাধ্য হয়েই ফেরৎ আসতে হলো । মধ্যিখান থেকে আবার খড়কের কানে কথাটা উঠতে সে আবার তাঁদের একহাত নিলো । বল্টুবাবু আবার সংশোধনবাদী , লাগাতার সংগ্রাম, শ্রেণীশত্রু ইত্যাদি দুচারটা নতুন নতুন শব্দ  শিখলেন ।

মাসদুয়েক এইভাবে চলার পর বল্টুবাব্য যখন পাওনাদারের তাগাদায় মাথার অ্যান্টেনা ওপড়ানোর উপক্রম করছেন , তখন হঠাৎ একদিন আশার আলো দেখা দিলো । পূর্ণিমার চাঁদের মতন উদয় হয়ে কমরেড পরাতদা মিটিং করে একদিন সবাইকে বক্তৃতা মারফৎ আশ্বাস দিলেন যে মালিকপক্ষ তাঁদের দাবি মেনে নিয়েছে, শেষ পর্যন্ত একটা চুক্তি হয়েছে । বল্টুবাবুরা যথাস্থানে বহাল হবেন, কাজও বাইরের কোম্পানীর কাছে যাবে না । কিন্তু তাঁদেরকেও খানিকটা রফা করতে হয়েছে, এবারের বিশ্বকর্মার পূজোর বোনাসটা আর পাওয়া যাবে  না । তবে বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে বল্টুবাবুদের এইটুকু স্বার্থত্যাগ তো করতেই হবে ।

যা পাওয়া যায় তাই । বল্টুবাবুর মনে হল তিনি যেন তাঁর জীবনের বারোআনাই ফেরত পেয়েছেন । এতদিন বাদে এই প্রথম খুশী মনে তিনি বাড়ি ফিরলেন ।

কব্জা পিসীও শুনে খুব আনন্দ পেলেন,

-হবে না ? আজ একমাস ধরে আমি শনিবার শনিবার মা লক্কড়েশ্বরীর পূজো পাঠাচ্ছি ! জয় মা ! বাছাকে রক্ষা কোরো মা !

টিনের চ্যাঙারি থেকে লক্কড়েশ্বরী পূজোর কৃষ্ট্যাল বল্টুবাবুর মাথায় ঠেকালেন কব্জা পিসী ।

প্রায় মাসদুয়েকের কাজের পাহাড় জমে আছে , প্রথম দিন অফিসে পৌঁছে তাই আর কাজ থেকে মুখ তুলতে পারলেন না বল্টুবাবু , এক নাগাড়ে ঘাড় গুঁজে কাজ করে যেতে হল । সব কাজ শেষ করে তিনি যখন আঙুল বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠলেন তখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে, অফিসও প্রায় ফাঁকা । পিসী চিন্তা করবে ভেবে হনহনিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিলেন বল্টুবাবু ।

কিতু বল্টুবাবুর বাড়ি ফেরা হল না । সবে দুটো স্টপেজ গেছেন , এমন সময়ে তাঁর খেয়াল হল তিনি বাড়ির চাবিটা অফিসেই ফেলে এসেছেন । রাত হয়ে গেলে কব্জা পিসীর আর দরজা খোলার ক্ষমতা থাকে না, সুতরাং কি আর করা, ঠেলাঠেলি করে বাস থেকে নেমে পড়ে, অনেকটা হেঁটে আবার চাবি নিতে অফিসে ফেরৎ এলেন ।

সন্ধ্যের অন্ধকার হয়ে গেছে, অফিসেও কেউ নেই । সব আলো নেবানো,  কেবল মালিক বয়লারনাথ বারকোশিয়ার কামরার বন্ধ দরজার তলা থেকে একটু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে ।

টেবিলে থেকে বল্টুবাবু চাবিটা তুলে নিয়ে চলে আসছেন, বারকোশিয়ার ঘর থেকে খড়কের গলার আওয়াজ ভেসে এলো । যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন বল্টুবাবু । এই সময়ে খড়কে বারকোশিয়ার ঘরে কি করছে ?

অন্যের কথায় আড়িপাতা উচিৎ নয়, কিন্তু তবু বল্টুবাবু শুনতে লাগলেন খড়কে বলছে,

-এতগুলো বোনাসের টাকা বাঁচালেন, এবার আমাদের শেয়ারটা ছাড়ুন ?

উত্তরে বারকোশিয়া নিচু স্বারে কি বললেন বোঝা গেল না, কিন্তু নেহাইবাবুর চড়া গলা শোনা গেল,

-আরে দাঁড়া দাঁড়া অত ওস্তাদি করিস নি । আমি শ্যাফটকে নিয়ে এসে সবাইকে ভড়কি না দিলে তোদের শেয়ার থাকতো কোথায় ?

তেড়ে উঠল খড়কে,

-দেখুন নেহাইদা, চালাকি করার চেষ্টা করবেন না । আমি স্ট্রাইক না ডাকলে আপনার ওই ফাঁকা ভড়কিতে কিচ্ছু হত না । বোনাসের টাকা বাঁচিয়ে আপনারা ভালই কামিয়েছেন । এবার আমাদেরটা দিন ? পার্টিকে দিতে হবে, পরাতদার শেয়ার আছে, আর এত খাটার পর আমি কি আঙুল চুষব নাকি ?

ফের বারকোশিয়ার নিচু গলা পাওয়া গেল । কিন্তু বল্টুবাবু আর শোনার অপক্ষায় রইলেন না, বাড়ির চাবিটা শক্ত মুঠোয় ধরে অফিসের বাইরে এসে দাঁড়ালেন ।

বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, মাথার ওপরে পরিস্কার আকাশে ঝঝক করছে তারা । সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস 

ফেললেন বল্টুবাবু । পিসীর ব্যাটারীটা এবছর আর পালটানো হলো না ।

sayantanbg62@gmail.com
কলকাতা