1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

সময়

 

ছবি : ইন্টারনেট

                                                                                                              পার্থ রায়

          পাহাড় চুড়ায় আছড়ে কপ্টারটা অরণ্যে এসে পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই।চারপাশের অজানা বড় বড় গাছেরা হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে মাতালের মত আচরণ করছে।সেসমস্ত গাছে বাসা বাঁধা অজস্র পাখির আর্ত চিৎকারে জঙ্গলের এই জায়গাটা এখন মুখরিত।পক্ষীকূল বাসায় ফেরার সময়ে এহেন দূর্গতির শিকার হয়ে যে যারপরনাই শঙ্কিত সে তাদের যত্রতত্র ওড়াউড়ি দেখেই ঠাহর করা যায়।শীতের পড়ন্ত দুপুরে কপ্টারের আচম্বিত ধাক্কায় তাদের অনেকেই নিশ্চই বাসাহীন হয়েছে।পর্বতশঙ্কুল ঘন অরণ্যে এমন অদেখা ঘটনায় বানর পরিবারও যথারীতি শঙ্কিত হয়ে চিল চিৎকার জুড়েছে।সব মিলিয়ে এতল্লাটে যেন হঠাৎ মেলা বসে গিয়েছে! 

সরকারি কাজে আমরা চারজন অর্থাৎ আমি গ্যাব্রিয়েল, ক্রেগ,ডমিনিক এবং এডি আজ সকালেই কপ্টারে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেস থেকে রওনা হয়েছিলাম।গন্তব্য ছিল চিলি।আবহাওয়াও ছিল অত্যন্ত মনোরম।কিন্তু আন্দিজ পর্বত পেরনোর সময়,মাঝামাঝি জায়গায় ইঞ্জিনের সামান্য সমস্যা দেখা দিল।তখনও আমরা দুজন পাইলট ক্রেগ আর আমি শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেছিলাম পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত মসৃণ জায়গায় কপ্টারটাকে ল্যান্ড করতে,কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগ সে আর হতে দিল কোথায়?তবে শেষবেলায় জঙ্গলে এভাবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে কপ্টার ভেঙ্গে পড়ব তা কল্পনাও করতে পারিনি কেউই।তবে দীর্ঘদিন পাইলট থাকায় আজ একটা বিষয় আমায় ভাবাচ্ছে।তাহল, ইঞ্জিন গন্ডগোল ছাড়াও কিসের যেন একটা অমোঘ টানে যেন এখানে জোর করে নামতে বাধ্য হলাম আমরা।এটা অবশ্য সম্পূর্ণভাবে আমার ধারণা। যাইহোক ঘটনার আকস্মিকতায় দলের চারজনের প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর আঘাত পেয়েছি তা বলাবাহুল্য।বোধহয় আমারই প্রথম জ্ঞান ফিরেছে কিছু আগে।তবে মাথা তুলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমি সিট বেল্ট দিয়ে তখনও লকড,পিছনে তাকিয়ে দেখলাম বাকি দুজনের অবস্থাও একই।ক্রেগকে ডাকাডাকি করে হুশ ফিরিয়ে আমি সাবধানে বাইরে বেরিয়ে দেখি কপ্টারের মুখটা নীচের দিকে আর ল্যাজের দিকটা উপরে, মানে মোটামুটি উল্লম্বভাবে সেটা লতাগুল্মের সাথে অদ্ভূতভাবে পেঁচিয়ে মাটির একহাতের মধ্যে এসে দোলনার মত অল্প অল্প দুলছে।মাথায় আঘাত লেগে কিছু রক্তপাতের ফলে ব্যাথা টের পেলাম কিছুটা পরেই।কিন্তু তা নিয়ে এখন চিন্তা করার সময় নয়।পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখি যথারীতি কোন নেটওয়ার্ক নেই।এটা অবিশ্যি আশাপ্রদই। কিন্তু মুশকিল হল এবার হেডকোয়ার্টারে আমাদের দূর্ঘটনার খবর পৌঁছাতে কালঘাম ছুটল বলে।।

বাকি সদস্যদের উদ্ধার করতেই হবে আকাশে আলো থাকতেই।এর পর এই অচেনা ঘন অরণ্যে কপালে কি আছে আর কিভাবেই বা উদ্ধার পাব তা প্রভু যীশুই জানেন।এদিকে বেলা পড়ে আসার সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে।শীঘ্রই এদের বের করতে আমি যতটা সম্ভব হাঁক ডাক শুরু করলাম,তাতে কিছুটা কাজ হল।কিছুটা বলছি এই কারনে যে, ক্রেগ আর ডমিনিক বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেও এডি কোন সাড়াশব্দ করছে না দেখে আমাদের সন্দেহ হয়।ডমিনিক কোনরকমে ভিতরে ঢুকে এডির নিথর দেহটা আবিষ্কার করে,সাথে মাথায় চাপ চাপ রক্ত। সম্ভবতঃ মাথায় গুরুতর চোটেই এডি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।আপাতত ওকে কপ্টারের মধ্যে রাখাই শ্রেয় বলে মনে হল আমাদের।প্রথমত এখনই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে আর সেক্ষেত্রে ওকে বাইরে এনে অচেনা জঙ্গলে রাখবই বা কোথায়।আর দ্বিতীয়ত,এই অঞ্চলে বাঘের আনাগোনা না থাকলেও যদি তেমন কোন মাংসাশী প্রাণীর উদ্ভব হয় তাহলে আমরা নিজেদেরই হয়তো বা বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ব,সেক্ষেত্রে এডির মৃতদেহকে আগলে রাখা একপর্যায়ে অসম্ভব হয়ে উঠবে।।

আমি যেন বেশ বুঝতে পারছি আজকের রাতটা মোটেই সুখকর হবে না।সকলেরই পেটে দুর্দান্ত ক্ষিধের আগুন জ্বলছে। ঝুলন্ত কপ্টারটার নীচে ইমারজেন্সি লাইট জ্বালিয়ে আমরা তিনজন একটা ছোট আলোচনা সেরে নিয়ে ঠিক করলাম আগে পেটে কিছু দিয়ে নেওয়া যাক।কিছু শুকনো খাবার দাবার আমাদের সাথে নিয়েই বেরিয়েছিলাম ইমার্জেন্সি পারপাসে, সেগুলো দিয়েই আপাতত প্রান রক্ষা করা গেল।আমাদের বহুদিনের সঙ্গী ছিল এডি।ছেলেটা আমাদের সকলের থেকেই বয়েসে ছোট আর শুরু থেকেই ও ছিল প্রানপ্রাচূর্যে ভরপুর একজন মানুষ। কোথাও ট্যুর থাকলে এডি কমন আর ফার্স্ট চয়েস থাকতই।এছাড়া সুন্দর স্বভাব আর বুদ্ধিমান হওয়ায় ও সকলেরই খুব প্রিয় ছিল।ট্যুরের রিমোট জায়গাগুলোতে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুপ্রবেশ নেই,সেসব জায়গায় অবসরে মাতিয়ে রাখতে এডির জুড়ি মেলা ভার। সেই এডি আজ নিশ্চুপতাকে সঙ্গী করে একলা কপ্টারের ভিতর বসে আছে।একটা আলোও জ্বালানোর ক্ষমতা নেই আমাদের।সকলেই হাক্লান্ত হয়ে একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি।কিছুটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় ও বলতে পারেন।এভাবে বসে থাকা ছাড়া কি-ই বা করতে পারি এইমূহুর্তে?

ডমিনিক স্বগতোক্তি করে বলল,এডির পরিবারের কথা চিন্তা করে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে।কারন ওর ছোট ছোট দুটো ছেলে মেয়ে আছে,আর দুজনই সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে।এমতাবস্থায় বাবাকে অকালে হারিয়ে এডির পুরো পরিবার যে অকুল পাথারে পড়বে সেটাই ওকে ভাবাচ্ছে।বাড়ি ফিরে এডির স্ত্রী রিটাকে কি ভাবে মুখ দেখাবে ও?

আমরা সকলেই ওকে সান্ত্বনা দিলাম।আসলে ডমিনিক এডির ফ্যামিলি ফ্রেন্ডও বটে।দুজনে যে অভিন্নহৃদয় বন্ধু তা আমরা সকলেই জানি।তাই এডির প্রতি ওর যে ফিলিংস অনেকটাই বেশি তা সহজেই অনুমেয়। দুহাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে রইলো ডমিনিক।। 

ঘড়ি বলছে এখন রাত ১২টা। এই মূহুর্তে অরণ্যের প্রকৃতি বর্ণনা একমাত্র কোন লেখকই হয়তো যথাযথ ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মাঝে আধখাওয়া চাঁদের উঁকিঝুঁকি, চাঁদের ম্লান আলো অরণ্যের গাছগুলোর ওপর পড়ে আলোছায়ায় যেন সমগ্র জায়গাটায় কলকা কেটে দিচ্ছে।বড় গাছগুলোর ওপর থেকে মাঝেমধ্যে পেঁচার গুরুগম্ভীর ডাক,পাখিদের ডানা ঝটপটানি আর কোনও অজানা আশঙ্কায় হঠাৎই ডেকে ওঠা...সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যথেষ্ট রহস্যময় তো বটেই।আমার খোলা চোখ দুটো তখন চাঁদের ওপরে।ভাবছি এ কোন ধাঁধায় পড়লাম?বর্হিবিশ্বের থেকে যেন দ্বীপের মত আলাদা হয়ে গেছি আমরা ক'জন। এই পরিস্থিতিতে কে ই বা আসবে আমাদের উদ্ধার করতে?সভ্য জগতের যে কোন ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে এখন আমরা বিছিন্ন। কিভাবে যে এর থেকে উদ্ধার হব....ওঃ ভগবান 

চোখটা যেন কোন অচেনা বুনো ফুলের গন্ধের আবেশে বুজে এসেছে এমন সময় কপ্টারের ভিতর ওয়াকিটকিটা যেন নড়ে চড়ে উঠল....তন্দ্রা ছুটে গেল এক নিমেষে!ঠিক শুনলাম তো???

নাঃ মনে হচ্ছে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।এই পান্ডব বর্জিত স্থানে ট্রান্সমিশন হওয়া প্রায় অসম্ভব।হাতঘড়িটা সময় দেখাচ্ছে রাত ১টা ৪৫। এসব ভাবতে ভাবতে আবার কখন চোখটা লেগে গেছে জানি না।আবার তন্দ্রা চটকে গেল কিছুক্ষণ পর। কারন ওই একই.... ওয়াকির আওয়াজ।চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় বসে ঘুমোচ্ছে। এরকম একটা শান্ত জনমনিষ্যিহীন জঙ্গলে ওয়াকির মত কর্কশ আওয়াজে আমারই বারংবার নিদ্রা ভঙ্গ হচ্ছে তাহলে?

আমি উঠে পড়লাম এবার।একটু কপ্টারে যাওয়া দরকার।টর্চের আলোয় অনেক মেহেনত করে উঠলাম কপ্টারে।আলো ফেলে যা দেখলাম তাতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।দেখলাম এডি নেই।ওকে আমি নিজের হাতে সিটে দড়ি দিয়ে বেঁধে বসিয়ে রেখে নীচে নেমেছিলাম ভাল করে চেক করার পরে!ভুল হতেই পারেনা আমার। কাঁপা হাতে টর্চটা ফেললাম নিচের দিকে।দেখলাম দড়িটা সিটের নীচে পড়ে আছে।এডি যেন ওটাকে খুব সন্তর্পণে খুলে আস্তে আস্তে নীচে নেমে কোথাও গেছে।এবার একটা আতঙ্ক যেন গ্রাস করতে শুরু করেছে আমাকে।বুঝতে পারছিনা চেঁচিয়ে এডিকে ডাকব কি না!নাকি বাকিদের ঘুম থেকে ডেকে তুলব!কি করব আমি?এ কি করেই বা সম্ভব? একজন মৃত মানুষের শরীর এভাবে সবার সামনে দিয়ে গায়েব হয়ে যায়ই বা কিভাবে?

এর পর আমার মধ্যে কি হল তা ব্যাখ্যা করা মুশকিল।সব ভয় দূরে ঠেলে ভোরের আলো না ফোটা অব্দি আমি আশেপাশের জঙ্গল তন্নতন্ন করে এডিকে খুঁজেছি।তারপর ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে ভেঙে পড়েছি।সবাই আমার জন্য মারাত্মক চিন্তা করছিল,সেজন্য প্রচুর তিরস্কারও লাভ করলাম।কীজন্য জঙ্গলে গেছিলাম তা বলতে সবার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠল।তৎক্ষনাৎ ডমিনিক চড়তে শুরু করল কপ্টারে।কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপর থেকে কিছু বাছা বাছা বিশেষন ভেসে এল আমার জন্য।আমি নাকি সকলের অলক্ষ্যে কাল রাতে নেশা করেছি।লাল জ্যাকেট পরা এডি যথারীতি কপ্টারেই রয়েছে ওর নিজের জায়গায়!

আমি আর ওপরে ওঠার প্রয়োজন মনে করিনি।

যাইহোক, সবাইমিলে পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত মসৃণ, কম জঙ্গুলে জায়গাটায় যাবার পথে একটা পাহাড়ি ঝড়নার সন্ধান পেলাম।জল একদম বরফগলা, ঠান্ডা কনকনে।তাই-ই কোন রকমে গলাধঃকরণ করে সিদ্ধান্ত নিলাম এই ঝড়নার ধারের মাটিতেই এডিকে গোর দেব।কবে এখান থেকে উদ্ধার পাব বলা একপর্যায়ে অসম্ভব।বাঁধ না মানা চোখের জলে দুপুরের মধ্যে আমরা এডির শেষকৃত্য সম্পন্ন করলাম।।

এরপরের কিছুদিন যেভাবে কেটেছে তা সিনেমার স্ক্রিপ্টকেও বোধহয় হার মানাবে।দূর্ঘটনাস্থল ছেড়ে সবাই পাততাড়ি গুটিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল নীচ থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু আর নেড়া জায়গায় চড়া।ভাগ্যক্রমে কোন উদ্ধারকারী কপ্টারের নজরে যদি পড়া যায় তবে প্রান বাঁচলেও বাঁচতে পারে।ক্ষিধে,জল পিপাসা আর ঘুমে সবাই মারাত্মক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।ক্ষিধের তাড়না এক অপ্রতিরোধ্য আর ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে শুরু করল।প্রথম কদিন আমরা পাহাড়ি নদীর মাছ আর গাছের ফলমূলের ওপর ভরসা করেছিলাম।কিন্তু এই প্রচন্ড শীতে নদীর বরফজমা জলে নেমে খালি হাতে মাছ ধরা একরকম অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।আমরা অন্যান্য আমিষ খাবার সন্ধান করতে শুরু করি।পথে পাহাড়ি উইলো আর বার্চগাছগুলোতে চড়ে পাখি ধরে ধরে উদরস্থ করতে শুরু করলাম প্রথমদিকে।যদিও অধিকাংশ সময়েই চেঁচামেচি করে পক্ষীকূলকে শতর্ক করে দিত বানরবাহিনী,যার ফলে সেদিন হয়ত অভুক্ত অবস্থায় থেকে গেলাম।এরপর অবশ্য প্রানরক্ষার তাগিদে বুনো শূয়োর,টাপির,প্যাঙ্গোলিন,সাপ এমনকি লামা কি খাইনি!বুঝলাম মানুষ সত্যিই সর্বভুক প্রানী।

এভাবে কদ্দিন কাটালাম জানি না,কিছু বলাও অসম্ভব আমাদের পক্ষে।মোবাইলগুলোর ব্যাটারি ড্রেন হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই....আমরাও সেগুলো একদিন মাটি চাপা দিয়ে সভ্য জগতের সাথে শেষ সম্পর্ক ত্যাগ করলাম।আজ কতদিন অজানার উদ্দেশ্যে হেঁটে চলেছি তার কোন হিসাব নেই।আজ কোন তাড়া নেই, কারো কোন অভিযোগও নেই।পাহাড়ে চড়ার পথে কোন জায়গা পছন্দ হলে সেখানে দিন কতক জিরিয়ে নিই।মাঝেমধ্যে এটাও ভুলে যাই আমরা চলেছিই বা কোথায়? ডমিনিক মাঝে নিজের নামই ভুলে গেছিল একবার।ওকে স্মরন করাতে বলেছিল 

----নাম মনে রেখে হবেটাই বা কি?আমরা তো আর ফিরে যেতে পারব না!

চমকে উঠেছিলাম আমি।আশ্চর্য! একথাটা আমি নিজেও যে কোন দিন ভাবিনি তা নয়।নদীর জলে প্রতিবিম্ব দেখেছি নিজের, চুল দাড়ির ফাঁকে নিজেকে চিনতেই পারিনি। মাঝে মধ্যে নিজের ফ্যামিলির কথা মনে পড়লে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠা ছাড়া কোথাও কোন অসুবিধা নেই।জঙ্গলে এখনো অব্ধি কোন নতুন মানুষের সাথেও দেখা হয়নি।আর একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি এতদিনে আমরা বন্য জীবনের সাথে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি,মানিয়ে নিয়েছি।একদিন পৌছলাম একটা খুব চেনা জায়গায়।এরকম জায়গা যা দেখে মনে হয় আমরা বেশ ক'দিন কাটিয়েছি এতল্লাটে।দেখলাম সবার মধ্যেই একটু চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে বহুদিন পর।একটু ঘোরাঘুরির পর খুঁজে পাওয়া গেল একটা হেলিকপ্টার। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে গেল সবকিছুই... এই সেই জায়গা....আমাদের দূর্ঘটনাস্থল।কেউ যেন আমাদের জন্যই ওটা সারিয়ে রেখে গেছে আর গাছের আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ করে বেজায় হাসছে আমাদের বোকা বনে যাওয়া মুখগুলো দেখে।কোন কিছু চিন্তা না করে আমি, ডমিনিক আর ক্রেগ অনেকেদিনের অভ্যাসবশত ঝট করে উঠে পড়লাম কপ্টারটাতে।সিটবেল্ট বেঁধে হেডসেটটা কানে লাগিয়ে দিলাম স্টার্ট।প্রপেলার ধীরে ধীরে গতি বাড়াল।আমরা রূদ্ধশ্বাসে বোতামটা টিপতে উড়ে চললাম উপরের দিকে....বার্চ পাইন আর বুনো লতাপাতা ভেদ করে।বহুকালের অভ্যাস আমার এই চপার চালানো, আর তাতে একটুও মরচে পড়েনি দেখে একটুও অবাক হলাম না।ভেঙে পড়া কপ্টার এতকাল পরে সারিয়ে কে রেখে গেছে আমাদের জন্য,আর তার উদ্দেশ্যই বা কি তা নিয়ে মাথাব্যাথার সময় এখন নয়।বেশ কিছুটা উড়ে গেলাম, তবে দেখলাম কোন ট্রান্সমিশন কাজ করছে না।এ অবস্থায় কপ্টার চালানো স্বভাবতই কঠিন আর ততোধিক বিপজ্জনকও।ট্রান্সমিশন ইকুইপমেন্ট ছাড়া বাদবাকি সব ঠিকই আছে বলেই মনে হয়।নীচে সবুজ জঙ্গলের চাদরের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছি মুক্ত বিহঙ্গের মত....

এইসময় একটা ব্যাপার ঘটল,যেটার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।অরণ্যের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আমি কপ্টারটাকে আরেকটু উচ্চতায় তোলার জন্য বোতামে হাত দিতেই একটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি আমাদের সকলকে যেন কাঁপিয়ে দিল।আমরা সকলেই অনুভব করছি একটা প্রচন্ড আকর্ষণ যেন আমাদের এখান থেকে বেরোবার পথে বাধা সৃষ্টি করছে।যেন অত্যন্ত শক্তিশালী এক চুম্বক পরম আবেশে কপ্টারটাকে আলিঙ্গন করতে চাইছে!ব্যাপারখানা কি ঘটছে সেটা বুঝতে না পারলেও আমি কিন্তু বোতাম থেকে হাত সরালাম না...একটা রোখ চেপে গেছে যেন।আতঙ্কে আমরা চিৎকার করতে লাগলাম অথচ বিশ্বচরাচরের কেউই যেন আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে উদ্ধার যে করতে আসবে না সেটা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছি।এরকম মনে হতে লাগল যে হয়ত দ্বিতীয়বারের জন্য প্রান হারাতে বসেছি!

এভাবে কতক্ষণ চললো কোন ধারনা নেই আমার,বলা উচিৎ আমাদের।একটা ঘোরের মধ্যে যখন সান্টা ফে -র উপর দিয়ে উড়ে চলেছি তখন সম্বিত ফিরল আচমকা ওয়াকির শব্দে....তারমানে এভিওনিক্স সিস্টেম আবার কাজ করতে শুরু করেছে??আমি অফিসের কন্ট্রোল অফিসারের সাথে কথা বলে নিলাম তড়িঘড়ি। হিসেব মত এখনো ন'হাজার কিলোমিটারের বেশি রাস্তা বাকি বুয়েনস আইরেস পৌঁছাতে,কমসে কম সন্ধ্যা হয়ে যাবে।পথে এডির কথাও চিন্তা করতে লাগলাম....কি জবাব দেব ওদের?জলজ্যান্ত ছেলেটাকে হারিয়ে আমরাও যে যথেষ্ট বিমূঢ় সেটা বাকিরা বুঝবে তো?অনেকক্ষণ উড়ানের পর যখন চপারটা হেলিপ্যাডে নামল তখন সূর্য পাটে যেতে বসেছে।অফিসের কর্মচারীরা আমাদের দেখার জন্য এখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু দূরেই।তা তো থাকবেই,এদ্দিন পরে আমরা জীবন নিয়ে ফিরছি!এতো একটা দূরুহ অভিযান থেকে সশরীরে ফেরার মতই রোমাঞ্চকর, তারা আজই সে গল্পের স্বাদ নিতে চায় হয়ত।আমরা একে একে নেমে এলাম চপার থেকে।সবার আগে কোম্পানির বড় সাহেব আব্রাহাম এগিয়ে এসে একে একে সবাইকে উষ্ণ আলিঙ্গন করলেন।সম্ভাষণ করলেন শিগগির ভিতরে আসার জন্য।অবাক হলাম,উনি এত বুড়ো হলেন কবে?কৌতুহলী ভিড়টা মাঝখান থেকে দু খন্ড হয়ে গিয়ে আমাদের চলার পথ করে দিল।আমরা ভিতরে এসে বসতেই কফি আর আমার প্রিয় কুকিজ হাজির হল।আমার কিন্তু এবার বিরক্তই লাগল...বলতেও যাচ্ছিলাম যে আপনারা কি এখন তাড়িয়ে তাড়িয়ে আমাদের কাছে গল্প শুনতে চাইছেন??কফির পেয়ালাটা মুখে তুলতে গিয়েও থমকে গেলাম।অপার বিস্ময় নিয়ে চোখ মেলে দেখি সামনেই টেবিলের ওপর রাখা ক্যালেন্ডারের পাতা রয়েছে ডিসেম্বরের ঘরে,আর সালটা ২০৪৯!এর মানে কি?আমরা কি স্বপ্ন দেখছি? মাথা এতটাও খারাপ হয়ে যায়নি যে ইতিমধ্যে সব ভুলে যাব।ব্রেন যথেষ্ট একটিভ রয়েছে।আমরা তিনজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম প্রত্যেকেই প্রায় নতুন মুখ।আমাদের সময়কার সিনিয়রদের যেমন রোনান,হিউগো,দিয়েগোকে দেখছিনা তো।হয়তো রিটায়ার্ড হয়েছেন সব।কিন্তু আমাদের সমবয়সী আন্টোনিও, মার্কো,স্টিফেন আথবা এরনেরও পাত্তা নেই কেন?সব চাকরি ছেড়ে দিল নাকি?

এবার প্রথম একটা হাত এগিয়ে এল,করমর্দনের জন্য।বয়স্ক ভদ্রলোককে ঠিক চিনতে পারলাম না বলে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম।উনি নিজের পরিচয় দিলেন রোল্যান্ড বিনি নামে।আরে রোল্যান্ড তো আমাদের বছর ছয়েকের জুনিয়র অফিসার ছিল। 

আমি মজার ছলে বললামঃ কি হে তুমিও শেষে এত বুড়িয়ে গেলে?

রোল্যান্ড উত্তর দিল- স্যর,দয়া করে কিছু মনে করবেন না,আপনারা যে তিরিশ বছর যে পরে দেশে ফিরলেন সে খেয়াল আছে?

এবার মিঃ আব্রাহাম এগিয়ে এসে বললেন-তোমাদের নিখোঁজ হওয়ার খবরে গোটা দুনিয়ায় রীতিমতো চর্চা চলছে সে খবর রাখ?আজ অব্ধি কত টন নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়ছে তার হিসেব আছে তোমাদের?সরকার তোমাদের সাথে লাগাতার ৩০ বছর ধরে যোগাযোগ রাখার চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখেননি।অন্তর্ঘাতের ভাবনা মাথায় রেখে দেশ-বিদেশে কম অনুসন্ধান হয়নি। উন্নত ইনস্ট্রুমেন্টস ব্যবহার করার ফলস্বরূপ কোন কোন সময় মাঝেমধ্যে সিগনাল রিসিভ হলেও তোমাদের ফিজিক্যাল সন্ধান সেভাবে কোন ভাবেই পাওয়া যায়নি।অবশেষে গতকাল থেকে তোমরা সাড়া দিতে শুরু করলে...

কিন্তু তোমাদের দেখে আমরা অবাক হচ্ছি...তিরিশ বছরের সময়ের ছাপ কিন্তু তোমাদের কারুর চেহারায় পড়েনি।হ্যাঁ, তোমাদের পোশাক-আশাক ঠিকঠাক নয়, চুল-দাড়িও বেড়েছে কিন্তু বয়স থেমে আছে মোটামুটি সেদিনেই, যেদিন তোমরা ডকুমেন্টস নিয়ে চিলির উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছিলে।উনি বলে চললেন আরো অনেক কথা কিন্তু সেসব আর কানে প্রবেশ করছে না,আমরা সিট ছেড়ে উঠে পড়লাম ওয়সরুমের দিকে,প্রচন্ড কৌতুহলকে সঙ্গী করে।ভিতরে বেসিনের সামনের আয়নায় তিরিশ বছর পর দেখলাম নিজেদের,সত্যি অবিশ্বাস্য ব্যাপার!আজ যদি ২০৪৯ সালের জানুয়ারীর ২৫ তারিখ হয় তাহলে হিসেব মত আমার বয়স ৭৫প্লাস হওয়া উচিৎ।কিন্তু সত্যিই আশ্চর্যজনক ভাবে আমায় দেখতে সেই বছর পঁয়তাল্লিশের মতোই রয়ে গেছে,মুখে বলিরেখার কোন ছাপ নেই,চামড়া টানটান,চুলেও তেমন পাক ধরেনি আর চেহারাও নির্মেদ টানটান।বাকিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।যেন বয়েসটা থেমে আছে একই সময়ে!তাহলে গত তিরিশটা বছরই বা কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের জীবন থেকে?আমরা ছিলামই বা কোথায় এদ্দিন? কিছু প্রবন্ধ আমি পড়েছি টাইম ট্রাভেলের ওপর,এ তবে কি তাই?মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগল..তাহলে এডিকে আমরা কোথায় হারিয়ে এলাম?আমাদের পরম প্রিয় বন্ধুকে কি সময়ের গহবরে গ্রাস করে নিল?

একে একে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম ওয়সরুম থেকে।আমরা দেখলাম এডি বিমূঢ় হয়ে বসে আছে সোফার ওপর।সেই ৩০বছর আগের বয়সে।না,ওর সামনে কোন কফির ধূমায়িত পেয়ালা নেই,নেই কোন কুকিস এর ডিস।ওকে ঘিরে কারো কোন প্রশ্ন নেই, অভিজ্ঞতা শোনার আর্জি নেই।

বুঝলাম,আসলে এডিকে কেউ দেখতেই পাচ্ছে না।।

papu.partho@gmail.com
কলকাতা





No comments:

Post a Comment