![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
সত্যম
ভট্টাচার্য
ওপাশ
থেকে ফোনটা ধরতেই আধো আধো গলায় তিতাস বললো-মা কত দিবির স্লট হবে এখান থেকে জিজ্ঞেথ
কথছে।তুমি বলে দিয়েথিলে,তাই আমি
বলে দিলাম ওয়ান মিলিয়ন দিবি ক্যাপাতিতি।
ওদিকে
বাড়িতে তখন আনন্দের চোটে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছে।তিতাসের প্রথম ফোন এটা ওর
বাড়িতে।যদিও বাড়িতে সবাই জানতোই যে সব ঠিকঠাক হলে এরকম একটা ফোন আসবেই নার্সিংহোম
থেকে।কিন্তু ভাবা এক ব্যাপার আর হওয়া
আরেক ব্যাপার।
আসলে
তিতাসের বয়স এখন একদিন পেরিয়ে কয়েকঘন্টা এগিয়েছে।সকালের নরম রোদে ও ওর ছোট্ট
বিছানাটায় শুয়ে হাত পা নাড়ছিলো।এখানে গোটা ঘরটা জুড়ে কত যে বাচ্চা তার ইয়ত্তা
নেই।সব একই রকমের দেখতে।বেডের বোর্ডে ওদের ডিজিটাল নম্বর ঝলমল করছে।আর সেই
অনুযায়ীই মনিটরে কন্ট্রোল রুম থেকে ওদের দেখা যাচ্ছে। তিতাসকে কিন্তু ওদের সকলের
থেকে আলাদাই রাখা হয়েছে।
নার্সরা
যখন প্রথমে সেন্ট্রাল সিস্টেম থেকে অর্ডার পেলো যে গতকালের জন্মানো এত নম্বরের
বাচ্চার কত জিবি ক্যাপাসিটির স্লট লাগবে সেটা বাচ্চার কাছ থেকেই জেনে মেইল করে
দিতে, খুবই
অবাক হয়ে গিয়েছিলো ওরা।মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলো না । ভাবছিলো যে এটা কি
জিনিসই বা লাগবে আর একদিনের বাচ্চাই বা তা কিভাবে বলতে পারবে। ওরা নিশ্চিত ছিলো যে
প্রায় সব বাচ্চার মতো এই বাচ্চাও তো ঘুমিয়েই থাকবে।তবু কেন সেন্ট্রাল সিস্টেম এমন
অর্ডার করছে।তাই খানিক কৌতূহল নিয়েই দুজন নার্স এসেছিলো তিতাসের বেডের কাছে।
তখন
তিতাস জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলো।কি সুন্দর এই পৃথিবীটা।আলো ঝলমলে আর কি সুন্দর বাতাস বাইরে।গাছেরা মাথা দোলাচ্ছে।পাখি ডাকছে।ওদের মিষ্টি গান
শুনে তিতাসের মনে হচ্ছিলো যে কবে গিয়ে ওদের সাথে ও খেলতে পারবে।এতদিন তাহলে মা ওকে
এইসব গল্পই শুনিয়েছে।মায়ের সাথে কথা হলেই বলতো-তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও সোনা
।তৈরি হয়ে নাও।এখানে যে কত কিছু দেখার
আছে।সূর্য-চাঁদ-পাখি-ফুল-ঝর্ণা-নদী-প্রজাপতি-পাহাড়-জীবজন্তু, সব যে দেখতে হবে তোমাকে,খেলতে হবে ওদের সাথে।
তিতাস
বলতো-আমার এখানে থাকতে আর একমুহূর্তও ভালো লাগে না মা।
কিন্তু
কিছু যে করার নেই সোনা ,ওখানে
নির্দিষ্ট দিন পার করেই যে তোমাকে আসতে হবে-মা বলতো।সে আমি না হয় ডাক্তারবাবুর
সাথে কথা বলে তোমাকে কদিন আগে নিয়ে আসতে পারি।কিন্তু তাতে ভালো হবে না।তোমার
শরীরের জোর কমে যাবে,অশক্ত হয়ে যাবে তুমি।ভালোমতো খেলতে
পারবে না সবকিছুর সাথে।তাই যে তারিখ ঠিক করা আছে ওতেই তুমি এসো।
নার্স
দুজনকে দেখতে পেয়ে তিতাস বললো-ইয়েথ থিথটার।শুনে তো ওরা অবা্ক।কালকে জন্মানো যে
বাচ্চার ঘুমোনোর কথা সে নাকি আজ ওদেরকে দেখতে পেয়ে বলছে ইয়েস সিস্টার।কোনক্রমে ওরা
তিতাসকে বলতে পেরেছিলো যে ও বলতে পারবে কি না যে কত ক্যাপাসিটির স্লট বসবে ওর।শুনে
তিতাস ওদেরকে বললো-জাস্ত এ মিনিত।তারপর বাতাসেই আঙুল চালিয়ে ডিভাইসটা ক্রিয়েট করে
নিয়েছিলো ও।তারপর ওতে নেটওয়ার্ক কানেক্ট করে মায়ের নম্বরটা ডায়েল করে কথা বলেছিলো
বাড়িতে।আর তারপর নার্সদেরকে বলে দিয়েছিলো যে এক মিলিয়ন জিবি ক্যাপাসিটির স্লট
বসবে।এতটা দেখে তো ওদের চক্ষু চড়কগাছ।যদিও ওরা খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলো যে
নার্সিংহোমে একটা কিছু গোপন হয়ে চলেছে কিন্তু তা যে এতটা হতে পারে তা ওরা ভাবতেও
পারেনি।
আসলে
ওরা জানে না যে তিতাসকে বড়ই করা হয়েছে সম্পূর্ন এক নতুন বৈজ্ঞানিক উপায়ে।কয়েকবছর
থেকে বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে কাজ করে যখন নিশ্চিত হয়েছিলেন যে এমনটা করা সম্ভব তখন
তারা প্রয়োগ করবার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।আসলে এতো এক জটিল পরীক্ষা।তা
ল্যাবরেটরীতে করা এক জিনিস আর মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা আরেক ব্যাপার।যে কোন সময়
সামান্য হিসেবের ভুলচুকে ঘটে যেতে পারে কোন মারাত্মক দুর্ঘটনা।তার দায় তখন কে নেবে।
আসলে
পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিলো প্রচন্ড গোপন।প্রথম থেকেই নিউ হিউম্যান জিনোম রিসার্চ
প্রোজেক্টের টার্গেট ছিলো যে যারা এই কাজে যারা থাকবে তারা ছাড়া বাইরের আর কোন
কাকপক্ষীও এই সম্পর্কে কিছু জানতে পারবে না।শুধু শেষে গিয়ে যেই নার্সিংহোমে কাজ
করা হবে তাদের স্পেশাল
ট্রেইন্ড কিছু লোকেদের এই বিষয়ে খানিক ট্রেনিং দিয়ে রাখা হবে,কিন্তু পুরো ব্যাপারটা বলা হবে না।শুধু পুরো ব্যাপারটা জানবেন কয়েকজন
ডাক্তার যারা প্রথম থেকে এই প্রোজেক্টের সাথে থাকবেন।আসলে এত গোপনীয়তা না রাখলে সমস্যা হতে পারে। বাইরে থেকে
প্রতিবাদ উঠতে পারে।তাতে কাজটা চাপে পড়ে যাবে।অথচ একবার যদি করে ফেলা যায় তারপর
দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যাবে যে কি অসাধ্য সাধন করা হল।
তাই
যখন তিতাসের মা সুজাতার ভালো খবরটা এসেছিলো আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ওকে
নিজের চেম্বারে ডেকে পাঠিয়েছিলেন নিউ হিউম্যান জিনোম রিসার্চ প্রোজেক্টের কর্ণধার
মালহোত্রা।যদিও সুজাতা এখানকারই একজন বিজ্ঞানী এবং এই প্রোজেক্টের সাথেই ও যুক্ত
আছে তাই ব্যাপারটা ওকে সহজেই বোঝানো যাবে।কিন্তু মালহোত্রা এটাও জানেন যে বিজ্ঞানী
হওয়া বা প্রোজেক্টে যুক্ত থাকা এক ব্যাপার আর যে আসছে তার ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা
করতে দেওয়া আরেক ব্যাপার।কারণ সেখানে জড়িয়ে থাকে এক বিশাল বড় মায়া।নিজের পেশাদারী
জীবনের থেকেও অনেক ক্ষেত্রেই সেই মায়া বড় হয়ে ওঠে।বেশীর ভাগ সময়েই তাই অনেক বড়
মাপের মহিলা বিজ্ঞানীরাও এতে রাজী হতে চান না।সুজাতাকে কি এতে রাজি করাতে পারবেন
মালহোত্রা।
হাসি
মুখে সুজাতা ঢুকতেই মালহোত্রা বললেন-প্লিজ বি সিটেড মাই ডটার।
সবাইকেই
এই ভাবেই ডাকেন বা কথা বলেন মালহোত্রা।কিন্তু আজকের সুজাতার সাথে ব্যাপারটা একদমই
অন্যরকম।একটু নিজেকে শক্ত করে নিলেন মালহোত্রা।অনেক কঠিন প্রস্তাব তাকে দিতে হবে
সুজাতাকে এবং রাজি না হলে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে রাজি করানোর।
ইয়েস
স্যার বলে সুজাতা চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতেই তিনি বললেন-শুধু আমরা বা আমাদের দেশ নয়
সুজাতা।বিজ্ঞান তোমার সাহায্য চায় এই মুহূর্তে।আর ভগবান অনেক সদয় যে এই সময়ে হয়তো
এই কারণেই তিনি তোমার জীবনে এই ভালো খবরটা এনেছেন।আশা করি তুমি বুঝতে পারছো
সুজাতা।নিউ হিউম্যান জিনোম রিসার্চ তাদের অনগোয়িং এ প্রোজেক্টে তোমার সাহায্য চায়।
সুজাতা
খানিক হতভম্ব হয়ে বললো-স্যার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।আমি তো প্রোজেক্টে আছিই।
মালহোত্রা
এটার জন্য প্রস্তুতই ছিলেন।বললেন-সে থাকা নয় সুজাতা,এবারে আমরা তোমার ওপরেই আমাদের পরীক্ষাটা করতে চাই।
এক
লহমায় কালো হয়ে গিয়েছিলো সুজাতার ঝলমলে মুখটা।অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে সে শুনতে
পাচ্ছিলো মালহোত্রা তাকে অনেক কিছু বলে চলেছেন।কিন্তু কিচ্ছু মাথায় ঢুকছিলো না ওর।চোখের সামনে ঘন
কালো অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলো ও।কালকেই সুখবরটা নিয়ে এসেছে প্রতীক আর আজকেই ভগবান কি পরীক্ষায়
ফেললো ওকে।যার আসার খবর হয়েছে সে ওদের অনেক প্রতীক্ষার আর স্বপ্নের ফল ।নিজের এই
স্বপ্নকে কি এইভাবে বিজ্ঞানের কাজে লাগিয়ে দিতে পারবে ও?প্রতীক শুনলে কি বলবে?আবার নিজের পেশাদার জীবনের স্বপ্নকে নিজের জীবন দিয়ে সার্থক করার সুযোগ
এসেছে আজ ওর সামনে।এও তো কম বড় কথা নয় ওর কাছে।কি করবে ও এখন।কোনক্রমে মাথাটা তুলে
ও বলতে পেরেছিলো মালহোত্রাকে-স্যার আমাকে একটু টাইম দিতে হবে ভাবতে।
মালহোত্রা
হেসে বলেছিলো-সিওর।কিন্তু ভুলো না এ তোমার জন্য এক বিশাল সুযোগ।
জানি
স্যার,বাট-সুজাতা
বলেছিলো।
এই
প্রোজেক্টের স্বপ্ন নিউ হিউম্যান জেনোম রিসার্চ বা বলা ভালো মালহোত্রা দেখতে শুরু
করেছিলেন বছর দশেক আগে থেকে।কিন্তু তিনি জানতেন এত বড় কাজ তার পক্ষে একা সামলানো
সম্ভব নয়।তাই লোক দরকার।দরকার আরো কিছু বিশ্বস্ত বিজ্ঞানী ও ডাক্তার যারা নিশ্চুপে
তার সাথে কাজ করে যেতে রাজী থাকবে।তাই হয়েওছিলো।নিশব্দেই মালহোত্রা গঠন করে ফেলতে
পেরেছিলেন বেশ কয়েকজনের একটা দক্ষ টিম।যারা সকলে প্রথম থেকেই কাজ করে চলেছেন এই
প্রোজেক্টে।তারা জানেন এই কাজে তারা সফল হলে এক ঝটকায় বিজ্ঞান এগিয়ে যাবে অনেক দূর
আর তাদের নামও ছড়িয়ে পড়বে গোটা দুনিয়ায়।
প্রোজেক্টের
প্রথম কাজ ছিলো যে ফোয়েটাস বা ভ্রুণ সদ্য জন্ম নিয়েছে তার ব্রেনে একটা নির্দিষ্ট
স্পেস তৈরি করে নেওয়া।অর্থাত বাকি সব কিছুর সাথে সাথে ঐ স্পেসও নিজেকে ধীরে ধীরে
ডেভলপ করবে।তারপর ঐ স্পেসের ওপরেই কাজ শুরু করবে হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট।কিন্তু
এতে প্রচুর সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো।প্রথমত লোক পাওয়া যাচ্ছিলো না যারা নিজেদের ওপর
এই টেস্ট করতে দেবে।আর যদি বা পাওয়া যাচ্ছিলো তারা সকলেই হচ্ছিলো সমাজের অতি
নিম্নস্তরের আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন এবং তাদের পড়াশোনা খুব একটা নেই।কিন্তু এই
প্রোজেক্টে মাকে প্রচুর ট্রেনিং দিতে হবে ফোয়েটাসকে।সেক্ষেত্রে নিরক্ষর বা পড়াশোনা
কম জানা মহিলা হলে সে এতসব পেরে উঠবে না।এছাড়াও তারা প্রধানত রাজি হচ্ছিলো টাকার
লোভে।সে নিজের প্রোজেক্টের জন্য টাকা দিতে মালহোত্রার কোন অসুবিধা ছিলো না।কিন্তু
অসুবিধা হয়ে যাচ্ছিলো অন্য জায়গায়।এই নিম্ন আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন মহিলাদের দেহের
মৌলিক উপাদানগুলি-অর্থাৎ প্রোটিন বা ভিটামিন বা অন্যান্য মিনারেলস এতই কম থাকে যে
তাদের ওপরে কাজ করতে গেলেই তাদের চূড়ান্ত ক্ষতি হয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা
থেকেই যায়।আবার কোনভাবে সেটাকে যদি সামাল দেওয়া গেলেও ফোয়েটাসটা এই চাপ নিতে পারবে
কি না সেটাও একটা প্রশ্ন থাকে।যে কোন সময় হয়ে যেতে পারে কোন দুঃখজনক পরিণতি।
এরও
আবার দুটো দিক আছে।এক সেই পরিবারটি গন্ডগোল শুরু করতে পারে।যদিও বন্ড ইত্যাদিতে সই করানোই থাকে কিন্তু এইসব
হুজ্জুতি মালহোত্রার একদম পছন্দ হয় না।আবার আরো একটা সমস্যা থাকে যে বেশ খানিকটা কাজ হবার
পর এইরকম ঘটনা ঘটলে তাতে প্রোজেক্টের সকলের মনোবলটাও অনেকটাই ভেঙে যায়।
বেশ
কয়েকবছর ধরে এরকম কয়েকটা ঘটনা ঘটার পর মালহোত্রা বা নিউ হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট
ঠিক করে নেয় যে আর নিম্ন আর্থিক স্তরের কাউকে টাকার লোভ দেখিয়ে নেওয়া হবে না।কারণ
অন্যান্য সকল ব্যাপার ছাড়াও এর সাথে জড়িয়ে থাকে বিশাল বড় একটা নীতির প্রশ্ন।তাই
কোনভাবে কোথাও সমস্যা হলে এই প্রোজেক্টই তখন সবার সামনে চলে আসবে আর সরকার থেকে
সেটাকে বন্ধও করে দেওয়া হতে পারে।তাই সমস্ত বলে যদি কাউকে রাজি করানো যায় তাহলে ঠিক আছে কিন্তু তা না হলে যেরকম এখোনো অব্দি যেরকম
পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে তাই চলতে থাকবে এবং একে আরো পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
প্রোজেক্ট
অনুযায়ী প্রথমে ফোয়েটাসের ব্রেনের ফাঁকা স্পেসে দিয়ে দেওয়া হবে কিছু অডিও ইনপুট
যাতে জন্মানোর পরই তার কথা বলতে কোন অসুবিধা থাকবে না ।মালহোত্রা মাথায় রেখেছিলেন
যে বাচ্চারা জন্মানোর পর তার কি অসুবিধা হচ্ছে বোঝাতেই পারে না।এমনকি যদি ফোয়েটাস
এবং অডিও ইনপুট ঠিকঠাক ডেভলপ করে তাহলে সে তার মায়ের সাথে কিছুদিন পর ওখান
থেকেই দিব্যি কথা বলতে পারবে।এবারে প্রশ্ন হচ্ছে দুজনের মাঝে যোগাযোগ হবে
কিভাবে।সেজন্য মাকে এক বিশেষ উপায়ে কথা বলা রপ্ত করতে হবে।যেখানে মা তার শ্বাসনালী
দিয়ে কথা না বলে খাদ্যনালী দিয়ে কথা বলবে যে কথা বাইরে না এসে ভেতরে যাবে।আর
সেভাবেই সে পথেই ফোয়েটাস কথার উত্তর দেবে।
এবারে
আসা যাক প্রোজেক্টের দ্বিতীয় ধাপে।সব ঠিকঠাক এগোবার পর এবারে ফোয়েটাসের ব্রেনের
ফাঁকা স্পেসে দিয়ে দেওয়া হবে তার মায়ের এক বিশেষ সেল নম্বর।যা তৈরিই করা হবে
কেবলমাত্র এই কাজের জন্য। সব ঠিক থাকলে বাইরে আসার পরই সে প্রথম মাকে ফোন করতে
পারবে।সেজন্য সৃষ্টি করা হবে এক বিশেষ নেটওয়ার্ক। ফোনটা সে করবে একটা ইনভিসিবল
ডিজিটাল প্যাড থেকে যার ক্রিয়েশন এবং ব্যবহার মা আগেই ফোয়েটাসকে শিখিয়ে
রাখবে।বাইরে আসার পরই সে বাতাসে ওটা ক্রিয়েট করে নেটওয়ার্কে কানেক্ট করবে।আর প্রথম
ফোনটা করবে মায়ের কাছে।
এবারে
তৃতীয় ধাপে ফোয়েটাস বা ভ্রুণ বাইরে আসার পর বাকি কাজটা করা হবে।আর এখানেই
ডাক্তাররা যারা জড়িত আছেন এই প্রোজেক্টে তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কারণ এর
আগের সব কিছু বিজ্ঞানীরা করলেও এই ধাপ থেকেই পরীক্ষা পুরোপুরি ভাবেই নির্ভর করবে
ডাক্তারদের দক্ষতার ওপরে।এই ধাপে এসেই বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা এক বিশেষ স্লট ব্রেনে
বসিয়ে দেওয়ার।যার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী সেখানে মেমোরী স্টোর করা যাবে।সে যেরকমই মেমোরী
হোক না কেন।অর্থাত সেখানে যেরকম কয়েকলক্ষ ফোন মেমোরী স্টোর করা যাবে এবং সেখান
থেকে কোন অসুবিধা ছাড়াই সেই ইনিভিসিবল ডিভাইস ক্রিয়েট করে যখন খুশি তখন ফোন করা
যাবে।আবার সে মেমোরীতে স্টোর করা যাবে অনেক অনেক ইনফর্মেশন যা ব্যবহার করে বাচ্চা
তার বয়সের থেকে অনেক এগিয়ে থাকতে পারবে।সব ঠিকঠাক হলে একটি দু থেকে তিন বছরের
বাচ্চা সাধারণ ভাবে সতেরো আঠেরো বছরের মতো ইনফররেশন ক্যারি করবে।
আর
এই প্রোজেক্টে পুরো প্রক্রিয়াই নিয়ন্ত্রিত হবে সম্পূর্ণ এক স্বয়ংক্রিয়
ব্যবস্থায়।অর্থাত এমন সিস্টেম এই প্রোজেক্ট নিয়ে আসবে যে সেখানে সাধারণ মানুষের
উপস্থিতি নগণ্য হয়ে যাবে।কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ড্রাইভার রাতবিরেতে না
থাকার জন্য বা যে কোন কারণেই হোক নার্সিংহোম থেকে এম্বুলেন্স বা মেডিকেল ভ্যান
রোগীর বাড়িতে পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়।ফলে রোগীর নানারকমের সমস্যা শুরু হয়ে যায়।এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় এই ধরণের কোন সমস্যা
উত্থাপনের কোন অবকাশই থাকবে না।কারণ ফোয়েটাস বা ভ্রুণ এবং তার মা
দুজনের আলোচনার ভিত্তিতেই ঠিক হবে যাবতীয়।আর মা সেন্ট্রাল সিস্টেমে তার
রেজিস্টার্ড ফোন নম্বর থেকে ফোন করলেই সেখান থেকে সংকেত চলে যাবে আগে থেকেই ঠিক
করে রাখা হাসপাতালে। সংকেত পাওয়ার সাথে সাথেই হাসপাতাল থেকে নিজে নিজেই রওনা দিয়ে
দেবে চালক বিহীন এম্বুলেন্স।সেখানে আগে থেকেই লোড করা থাকবে রোগীর বাড়ির
লোকেশন।নিজেই জিপিএস দেখে সে ঠিক পৌঁছে যাবে জায়গামতো।গিয়ে হর্ণ দিয়ে দরজা খুলে
অপেক্ষা করবে।রোগী বা মা গিয়ে নির্দিস্ট দরজার সামনে দাঁড়ালেই দরজা খুলে স্ট্রেচার
বেরিয়ে আসবে।রোগী সেখানে শুয়ে পড়লেই যাবতীয় দেখে নিয়ে এম্বুলেন্স আবার ছুটবে
নিজস্ব গন্তব্যে।এই গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হতে নার্সিং হোমে অপারেশন
থিয়েটার তৈরি হয়ে যাবে।
এবারে
নার্সিংহোমে মা কে থাকতে হবে সর্বসাকুল্যে দু থেকে তিন ঘন্টা।পার্কিং স্পেস থেকেই
গাড়ি সোজা ঢুকে যাবে লিফটে।লিফট তাকে মুহূর্তে পৌঁছে দেবে দেড়শো বা দুশো তলা ওপরের
অপারেশন থিয়েটারে।সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে নার্স বা ডাক্তাররা।শরীরের
যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে যাবার পর এক বিশেষ উপায়ে পূর্ণাঙ্গ ভ্রুণ বা শিশুটি
চলে আসবে মায়ের শরীরের বাইরে।এবারে দলটি দুটো আলাদা ভাগ হয়ে যাবে।একদল মাকে
পর্যবেক্ষণ করে তার শরীরের যাবতীয় দেখে নিয়ে তাকে একই উপায়ে যেভাবে সে এসেছিলো
রওনা করিয়ে দেবে বাড়ির দিকে।বাড়ি গিয়ে আবার সেন্ট্রাল সিস্টেমে সে জানিয়ে দেবে যে সে ঠিকঠাক তার নিজের কাজ সেরে ফিরে এসেছে।
আর
নার্স ডাক্তারদের আরেকটি দল তখন কাজ শুরু করে দেবে শিশুটিকে নিয়ে।সবকিছু ঠিক থাকলে
নির্দিস্ট দিনে শিশুটিকে আবার গাড়িতে উঠিয়ে দেবে নার্সরা।তাকে নিয়ে একইভাবে বাড়ি
পৌছে দিয়ে আসবে চালকবিহীন এম্বুলেন্স।এইভাবেই চলবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাটি।
মা-
বল
সোনা-
আমি
যে এখানে আর আঁটছি না-
মনে
হয় তোমার বাইরে চলে আসার সময় হয়ে গিয়েছে-
এখন
তাহলে কি হবে মা-
তোমাকে
নিয়ে আমি রেখে আসবো সোনা হাসপাতালে-
আমার
ভয় করবে যে ওখানে একা একা-
না
কোন ভয় নেই।আর তোমার কাজ হয়ে গেলে দুদিনেই ওরা তোমাকেও বাড়ি দিয়ে যাবে-
সেদিন
সকালে তিতাস আর সুজাতার এই সব কথাবার্তার পর দুপুর নাগাদই ওরা ঠিক করে ফেলে যে
সেন্ট্রাল সিস্টেমে খবর দেবে।তারপর তো গাড়ি আসে।সুজাতাকে নিয়ে যায়।কিন্তু তার আগের
ধাপটাই ছিলো সব থেকে কঠিন।
সেদিন
সন্ধ্যেতে মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে সুজাতা বাড়ি ঢুকেছিলো।প্রথমত আগে ওকে নিজেকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।তারপর সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে
প্রতীকের সাথে।কাজ করতে করতে সে সবই মাথায় ঘুরছিলো সুজাতার।এ যেন নিজের সাথে নিজের
একটা যুদ্ধ।দীর্ঘ কথোপকথন।কখোনো যুক্তি সাজাচ্ছে ওর পেশাদার বিজ্ঞানী মন।সে
বলছে-এতদিন তো এরকমই একজন মহিলা তোমরা খুঁজে বেরিয়েছ সুজাতা।যে সমস্ত জেনে শুনে
নিজেই যোগ দেবে এই প্রোজেক্টে।নিজেকে দান করবে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।তাহলে
আজ যখন তোমারই এই সুযোগ আসছে তখন তুমি ভাবছো কেন?এ কি রকমের দ্বিচারিতা?
কিন্তু
এর সাথেই কথা বলে উঠছে একজন বাঙালী মায়ের মন।সে যুক্তি সাজাচ্ছে।বলছে-তোমাদের
এতদিনের স্বপ্ন আর কিছুদিনে সত্যি হতে চলেছে সুজাতা।তুমি এটা ভাবছো কি করে।যে তুমি
এতবছর ধরে গোপনে এই স্বপ্ন বুকে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছো আজ যখন সুযোগ এসেছে কোন ভাবে
কারুর জন্যই তা হাতছাড়া কোরো না।ঐ প্রোজেক্ট হয় কাউকে পেয়ে যাবে আজ না হলে
কাল।কিন্তু তোমার এই স্বপ্ন একবার চলে গেলে কিন্তু তা ফেরত আনা আবার খুব কঠিন।
মনে
হচ্ছে তুমি খুব চিন্তায় আছো।কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছো।তোমাদের রিসার্চের
ব্যাপার কিছু?-প্রতীক
জিজ্ঞেস করলো সুজাতাকে।ইতিমধ্যে সেও ফিরে এসেছে অফিস থেকে।দুজনে একসাথে মিলে টিফিন
করবে ওরা। আগে ফিরতে রাত নটা দশটা হলেও এখন প্রতীক ঠিক করেছে যে সে আর কিছুতেই লেট
করবে না।সুজাতাকে বাড়িতে সময় দেবে।
মাইক্রোওয়েভে
খাবার গরম করতে করতে সুজাতা ভাবলো এবারে কি করবে ও।নিজের মনকেই তো স্থির করতে
পারেনি।আর এখনই যদি প্রতীককে বলে আর প্রতীক না করে দেয় তাহলে নিজের কাছেই নিজে
হেরে যাবে ও।কিন্তু এই চাপ যে ও আর নিতে পারছে না।মনে হয় প্রতীক ওকে ঠিক সাজেশনই
দেবে।এত দিনের বন্ধু ওরা।যদিও উচ্চমাধ্যমিকের পরই দুজনের গতিপথ আলাদা হয়ে গিয়েছে,কিন্তু তাতে বন্ধুত্বতে কোন চিড়
আসেনি।সুজাতা বললো-তোমার সাথে অনেক কথা আছে।খুব দরকারী।এক মিনিট দাঁড়াও,খাবারটা গরম করে নিয়ে চলে আসছি।
প্রতীক
সব শুনলো খুব মন দিয়ে।এটাই ওর অভ্যেস।তারপর সুজাতাকে জিজ্ঞেস করলো-তুমি কি ভেবেছো?
সুজাতা
বললো-আমি তো কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না গো।একবার ভাবছি যাই।এতদিন ধরে এরকমই তো
কাউকে খুঁজছিলাম আমরা।আবার ভাবছি অন্যটাও।
আমি
বলছি তুমি যাও-প্রতীক বললো।কারণ এটা আমার বিশ্বাস যে যদি তোমাদের সততা আর নিষ্ঠা
থাকে তাহলে কাজে কোনরকমের সমস্যা হবে না।
সুজাতা
যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না।এতটা সাহস প্রতীক ওকে দিচ্ছে।আর হ্যাঁ,এটা তো ঠিক যে এই প্রোজেক্টে
ওরা যারা কাজ করতে নেমেছে সেখানে কারুর সততা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই।সারারাত প্রায় জেগেই কাটলো ওদের দুজনের।ভোরের ঠান্ডা বাতাসে একটু চোখটা লেগে এসেছিলো
সুজাতার।যখন ঘুমটা ভাঙলো দেখলো জানালার বাইরে ওদের ব্যালকনিতে এসে একটা দোয়েল পাখি
টবের ছোট গাছটায় বসে দোল খাচ্ছে আর শিস দিচ্ছে।সুজাতার মনে হল পাখিটা যেন ওকেই
বলছে-যাও,তোমাদের
কোন খারাপ হবে না,সব ভালো হবে।মনস্থির করে ফেললো সুজাতা।
পরদিন
সকালে যখন মুখে ঝকঝকে হাসিটা নিয়ে সুজাতা মালহোত্রার চেম্বারে ঢুকলো,উনার বুঝতে একমিনিটও সময় লাগলো
না যে এবারে হয়তো উনার স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছে।প্রোজেক্ট এমন একজনকে পরীক্ষার জন্য
পেয়ে গিয়েছে যে সব দিক থেকে এই কাজের জন্য যোগ্য তো বটেই এমনকি ওদের প্রোজেক্টরই
একজন সঙ্গী।
কাজ
শুরু হয়ে গিয়েছিলো তারপর দিন থেকেই।সব কিছুর পরেও মালহোত্রা আরো একবার সুবিধা
অসুবিধা নিয়ে সচেতন করে দিয়েছিলেন সুজাতাকে।বার বার বলেছিলেন যদি কোন শারীরিক
সমস্যা বা অসুবিধা সে বুঝতে পারে তা যেন অবশ্যই ততক্ষণাত মালহোত্রাকে জানায়।
পরদিন
ল্যাব যেন একটা সুন্দর উতসবের চেহারা পেয়ে গিয়েছিলো।সবার আনন্দ উতসাহ ছিলো চোখে
পড়বার মতো।সবার প্রিয় সুজাতাদিই যে এইকাজে এভাবে ওদের সাথে থাকবে জানতে পেরে সবাই
যেন আরো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছিলো যে কাজটা ওদের পেরে উঠতেই হবে।
তবে
হ্যাঁ,পদে পদে
ছিলো বিপদ আর ঘোর অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা।যেদিন প্রথম ওকে ইঞ্জেক্ট করা হল ,জানালার পাশে বসে সে দিনটার কথাই ভাবছিল সুজাতা।এখন ও একদম সুস্থ।দিনে
দুবার করে কথা বলছে তিতাস ওর সাথে।একদম সুস্থ আছে সেও।সেই প্রথম দিন ইঞ্জেক্ট করার
পর কিন্তু সুজাতার শরীরে শুরু হয়েছিলো সামান্য অস্বস্তি।সবাই ভয় পাচ্ছিলো কোন অঘটন
না ঘটে যায় আবার।কাঁচের দেওয়ালের ওপারে দাঁড়িয়েছিলো প্রতীক।কিন্তু সুজাতা জানতো
যেভাবে সব দিক থেকে ওর শরীরকে প্রস্তুত করে নেওয়া হয়েছে তাতে সমস্যার সম্ভাবনা
খুবই কম।আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলো ও।আর তারপরই দেখেছিলো একটা সুন্দর
স্বপ্ন।
একটা
সুন্দর বাগানে ছোট্ট তিতাসকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।চারিদিকের বাতাসে ভাসছে
বিভিন্ন ফুলের সুগন্ধ।তিতাস সুজাতাকে একের পর এক গাছ দেখাচ্ছে,বলছে তাদের বিজ্ঞানসম্মত নাম,বিভিন্ন বৈশিস্ট্য।মাঝে মাঝে সুজাতা নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলো।এতটা সফল
হয়েছে তাদের প্রোজেক্ট।
হঠাত
বাজা একটা বিপ শব্দে ঘোরটা কাটলো সুজাতার।সকাল থেকেই সে আর প্রতীক অপেক্ষা করছে
কখন সেই স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরবে তিতাস।ও আসবে বলে সুন্দর করে ঘরগুলি
সাজানো হয়েছে আলো আর ফুলের মালা দিয়ে ।
আইহোলে
চোখ রাখলো সুজাতা।এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে।তার মানে তিতাস চলে এসেছে।ও সফল।ওদের
গোটা পরীক্ষা সফল।আনন্দ আর উত্তেজনায় দরজাই খুলতে ভুলে গিয়ে শুধু প্রতীককেই ডেকে
যাচ্ছিলো সুজাতা।চিতকার করে বলছিলো-এদিকে এসো ,তিতাস চলে এসেছে।প্রতীক দৌড়ে এসে বললো-দরজাটা খুলবে তো।
দরজা
খুলে ওরা বেরুতেই এম্বুলেন্সের পেছনের দরজাটা খুলে গেলো।স্ট্রেচারে বেরিয়ে আসলো
ছোট্ট তিতাস।সুজাতা আর প্রতীক কোলে তুলে নিলো ওকে।ও হেসে বললো-হোপ অল ইউ আর
ফাইন।আই এম ফাইন থু।।এম্বুলেন্সটা আবার সাইরেন বাজিয়ে বেরিয়ে গেলো।
No comments:
Post a Comment