1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

লকডাউনে বউ পালালো


ছবি : ইন্টারনেট

                                                                                  পিনাকী চক্রবর্তী

          ঠিক ব্রাহ্ম মুহূর্তেই  প্রবল আর্তনাদ ছুটেএল! খাটের পাশে খোলা জানলা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখা যাচ্ছে৷ এখন  আকাশে আলোর হাল্কা প্রলেপ পড়েছে৷ ভোর এখনো হয়নি, রাতের মেয়াদ ফুরিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই, এই সময় খুব সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, আকাশের বুকে পাখিরা প্রথম শুরু করে সাঁতরানো, বাসা থেকে তারা বেরিয়ে আসে৷ এই দৃশ্যপটকেই উপনিষদের শ্লোকে ব্রাক্ষ্ম মুহূর্ত বলা হয়েছে৷ খাটের উপর আমি ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়েছি, ডানদিকের জানালা খোলা আছে, বাইরে আলোর খেলা চলছে, এখন চারপাশটা খুব মায়াবি হয়ে ওঠে৷ এই দৃশ্য যারা হঠাৎ দেখবে,তাদের কাছে বিস্ময় মনে হবে৷ আমিতো প্রতিদিন দেখি৷ আমি দেখছি৷ প্রতি এই সময়ে ঘুম ভেঙে যাওয়াটাই আমার অভ্যাস, আজ ভেঙে গিয়েছে আচমকাই আর্তনাদ শুনে৷ ঘুম ভেঙে যেতেই, পাশের দেওয়ালে বোবা ঘড়িটার দিকে চোখ গিয়েছে৷ চারটে বাজল৷ পাশের বাড়ি থেকেই আর্তনাদ, এই কন্ঠস্বর পরিচিত লাগছে, সরলা মাসিমার গলার আওয়াজ৷ মেসোমশাইয়ের তাহলে কিছু হল! লোকটা কাল অব্দি ভালো ছিলেন৷ লোকটা কালকে অব্দি আটটা রুটি আর একবাটি খাসির মাংস খেয়েছে, আমিই পাশে বসে ছিলাম৷ সরলা মাসিমা সেই সময় বললেন- "এতো খেয়ো না৷ বয়সের কথা মাথায় আছেতো?" মাথা থাকলেও, মেসোমশাই সেই সময় মাথার দিকে পাত্তা দিচ্ছিলেন না৷ জিভের দিকেই তার নজর রয়েছে; পেটের আবদার তিনি ফেলতে  পাচ্ছিলেন না৷ আমি উল্টো দিকে বসে ছিলাম৷ বললাম-মেসোমশাই, আপনি নিজের দিকে খেয়াল করছেন না৷ নিজের শরীরের কথা ভাবুন৷
মেসোমশাই খালি গায়ে, লুঙ্গি পড়েছেন, হাঁটু অব্দি লুঙ্গি তুলে কোনমতে বাবু হয়ে বসেছেন৷ সামনে থালায় রুটি আর খাসির মাংস রাখা আছে৷ দুহাত দিয়ে রুটি ছিঁড়ছেন, হলুদ ঝোলে চুবিয়ে, ঝোল শুদ্ধ মুখে টুকিয়ে দিচ্ছেন! কালো গোঁফ ভিজে গিয়েছে, হলুদ ঝোল মুখে মেখে আছে৷ মাথার উপর অনেক বড় টাক, এতো বড় টাক যে ফিল্ম সিটি তৈরি করা যাবে, চকচকে টাকে ঘাম দেখলাম৷ মাসিমা বলল-তুমি ঘামছো তো?
মেসোমশাই মুখটা গম্ভীর করে বললেন- ঘামবোনা, এই কাজ চাট্টিখানি নয়৷ এই বয়সে এতো গুলো রুটি  আর খাসির মাংস খেতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠলাম!
আমি বললাম- থাকুক না৷
মেসোমশাই  আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- উঃহু৷ থাকবে না৷ থাকতে পারে না৷ থাকতে দেবো না৷ আমি বয়সে সত্তর হলেও, দম এখনো  ফুরিয়ে  যায়নি।  
মাসিমা বললেন- সে তো টেরই পাচ্ছি৷ এই বয়সেও লোভ সামলাতে পারলেনা! 
মেসোমশাই বললেন, চিৎকার করে বললেন- আমাকে তোমার ছেলে পাওনি৷ ওটা একটা ভেড়া৷ আমার মতন মহিষের ঘরে ভেড়ার জন্ম হয়েছে৷ ছিঃ...
আমি বললাম- মেসোমশাই, আপনি হচ্ছেন সিংহ। মহিষ কেন হবেন?
আমার দিকে আড় চোখে তাকালেন৷ চোখে রাগ, মনে হচ্ছে আমি ওনার জাত্যাভিমানে আঘাত করলাম! উনি বললেন- আমরা ঘোষ৷ গোয়ালা৷ আমাদের গরু, মহিষ নিয়ে কারবার৷ ব্যাটাছেলে,  তাই মহিষ বললাম৷ একটু পড়াশুনো করো৷
আমি মাথা নামিয়ে নিয়েছিলাম৷ মেসোমশাইয়ের সামনে আর কিই বা করতে পারতাম! মানুষটাকে আমি খুব সমীহ করি৷ উত্তর কলকাতায় লোকটার নিজের নামে খাটাল ছিল৷ সেই খাটাল থেকে আজ মোষের দুধ বেঁচে, পাড়া কাঁপানো বাড়ি তৈরি করেছেন৷ চারতলা বাড়ি, একছেলে, ছেলের বউ আর একটি মাত্র মেয়ে আছে৷ পাড়ায় যেই যেই ক্লাবগুলো অনুদান পেয়েছে, এবং যেই গুলো অনুদান পায়নি বলে বন্ধ হয়েছে, যেই যেই ক্লাব গুলো সদ্য স্টার্টআপ ক্লাব- সবকটার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন দুলুচরণ ঘোষ, আমাদের মেসোমশাই৷ আমাদের পাড়া একটি, ক্লাব অজস্র, যতই দিন যাচ্ছে ক্লাবযে এখানে লাভজনক ব্যবসা, টের পাচ্ছি৷
চোখে জল চলে এল৷ আগের দিন রাতের কথা গুলো মনে পড়ছে৷ আজকের দিনটা খুব খারাপ কাটবে৷ ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজল৷ আমাদের এখানে পাঁচটা থেকে রাস্তায় লোকজনের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে৷ মেসোমশাইয়ের শুয়ে থাকা প্রাণহীন দেহটাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে ভিড় হবে৷ আজ এই ভিড় আরো   উপচে পড়বে, কেননা  অনেক ক্লাবেরই পেমেন্ট আটকে আছে৷ লকডাউনে  অনেকেই পকেটখালি করে ফেলেছে৷ শুনেছি চেকে সই মেসোমশাই করতেন৷ আমি দেরী না করে হাফ প্যান্টের উপরেই গোলগলার রং উঠে যাওয়া টিশার্ট গলিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় নেমে এলাম৷ উল্টো দিকের বাড়িতেই মেসোমশাই থাকেন৷ আমি  ঢুকে পড়লাম, দরজা খোলাই ছিল, এই বাড়ির কেউ খুলেছে হয়ত৷ আমি ঢুকেই দেখলাম দ্বোতলার বাবাইদার ঘরের মুখে মাসিমা, বাবাইদা, বাবাইদার  বোন  ফুলকি, বাড়ির পরিচালিকা সরলাদি  দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি দেরী না করে ঢুকে পড়লাম৷ ঢুকেই খাটের দিকে হাউমাউ করে এগিয়ে গিয়ে কেঁদে ফেললাম৷ 
কিছুক্ষণবাদে নিজের ভুলটা টের পেলাম! খাটের উপর,চিৎ হয়ে টাণটাণ শুয়ে থাকা মেসোমশাই উঠে  বসলেন! আমি ঘাবড়ে গেলাম৷ মেসোমশাই মারা যাননি!!! স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে বললাম- মেসোমশাই এখান থেকে মাসিমার কান্না শুনে ছুটে এসেছি৷ ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না৷
মেসোমশাই বললেন- বউ পালিয়েছে! লকডাউনে আমরা নিঃস্ব হলাম!!
মেসোমশাই এমন ভাবে কথা গুলো বলছিলেন, তার মুখে ক্লান্তির ভাব ফুটে উঠেছে৷ ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বেজেছে৷ খোলা জানলা থেকে আলো ঢুকছে৷ আমি কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনা! মাসিমা দাঁড়িয়ে আছেন, তাহলে বউ পালালো বলছেন কেন?
আমি মেসোমশাইয়ের কানের পাশে ফিসফিস করে বললাম- মাসিমা আছেন৷ বউ পালালো কোথায়? বুঝতে পাচ্ছিনা৷
মেসোমশাই আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন- গাধা৷ তোমরা ইয়ং জেনারেশন হচ্ছো গাধা৷ আমারটার বউ পালিয়েছে৷ আমার গাধাটা বউ ধরে রাখতে পারেনি৷ এই লকডাউনে বউ পালিয়ে গেল!
আমি বাবাইদার দিকে তাকালাম৷ মাথা নামিয়ে, খালি গায়ে আর লালচেকের লুঙ্গি পড়ে দরজার সামনে বসে আছে, বগল তুলে চুলকে নিল৷ আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ 
আমি খাটের পাশে বসেছিলাম৷ বাবাইদার কাছে এগিয়ে গেলাম, কানে কানে বললাম- দাদা, বৌদি কোথাও গিয়েছে?
বাবাইদা  নিস্পৃহ ভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল৷ মাসিমা কাঁদতে কাঁদতে আমার পাশে এসে বসলেন৷ বললেন- আমি সাড়ে তিনটের সময়  দরজা খোলা দেখি! প্রথমে চোর ঢুকেছে ভয় পাই৷ বাবাইয়ের ঘরে যেতেই দেখি বৌমা  নেই! প্রথমে  ঘাবড়ে গিয়ে বাবাইকে ডাকি৷ আরো অনেকের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল৷ আমরা খোঁজ করি৷ চারটে পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম৷ ফিরলনা!!.....
আমি বললাম-কোথায় যেতে পারে?
মাসিমা আমার দিকে তাকিয়ে কড়া ভাবে বললেন- সেটা জানতে পারলে কী আমরা এখানে থাকতাম? মাথামোটা, এরজন্যই কোন মেয়ে তোর প্রেমে পড়ল না!
মেসোমশাই  বলে উঠলেন- তোমার ছেলেটিও একই পদের৷ নিজের বউকে রাখতে পারল না!
বাবাইদা বলল- বাবা চেষ্টাতো করে গিয়েছি৷ এটা প্রথমবার অভিজ্ঞতা ছিলনা৷
আমি মনে মনে বললাম- বিয়েতেও অভিজ্ঞতা লাগে! অভিজ্ঞ বিবাহিত পুরুষদের তাই এতো চাহিদা! পাড়ার দাদা এমনকী কাকুদের হাঁটুর বয়সি বান্ধবী আছে৷ আমার দিকে পাড়ার মেয়েরা তাকায় না৷ আমিই শুধু তাকিয়ে থাকি! অভিজ্ঞতা  নেই   বলেই  পিছিয়ে পড়ছি। 
মাসিমার   দিকে তাকিয়ে, মুখে বললাম- আপনি ঠিক বলেছেন৷ ভুলটা আমারই হয়েছে৷   সে  কোথায়  জানতে পারলে, এক্ষুনি সমস্যার  সমাধান   হয়ে  যেত। 
মেসোমশাই বললেন- পাড়ায় আমি মুখ কেমন দেখাবোকেমন করে! আমার বিরোধীরা অক্সিজেন পেয়ে গেল! ছিঃছিঃ এখন ওরা বলবে, যে ঘর সামলাতে পারেনা, তার হাতে পাড়া সামলানোর দায়িত্ব নেবে কেমন করে! 
বাবাইদার দিকে তাকিয়ে বললেন- পাঁঠাটার জন্য আমার রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে গেল! এতোগুলো ক্লাবের অনুদান দিয়েছি৷ ব্যাঙ্ক একাউন্ট ফুরিয়েছি, ভেবেছিলাম কাউন্সিলার হয়ে ডবল লাভ তুলব৷ এই অপদার্থটার জন্য সব গেল!
আমি  হাল্কা স্বরে বললাম- মেসোমশাই এতো ভাববেন না৷
মেসোমশাই খাটে আধশোয়া হয়ে বললেন- ভাবতে হচ্ছেই, দুমাস বাদেই ভোটের টিকিট দেবে, শুনেছি তালিকায় আমার নাম থাকবার সম্ভাবনা আছে৷ সব গেল! 
আমি বললাম- অতো ভাবছেন কেন? মেসোমশাই আগে ঘরের সমস্যা মেটান, তারপর না হয় দেখা যাবে৷ 
আমি ঘড়িতে দেখলাম সাতটা বেজেছে৷ বাবাইদার বউ, অর্পিতা বৌদি; এই পাড়ার অনেকেই পিছন পিছন ঘুরত৷ শিক্ষিত, সুন্দরি আর ব্যক্তিত্বময়ী, অনেকেই প্রেমে পড়েছে, মেসোমশাইয়ের ভয়ে পাড়ার প্রেমিকরা খুব একটা আগ্রহ দেখাতো না৷ আমিও দূরেই থেকেছি৷ অর্পিতা  বৌদিকে গোপনে  ভালোবেসে ফেলেছি।   মেসোমশাই ঘরের বউ হারিয়ে যতটা অসহায় চোখে মুখে হয়ে উঠেছেন, আদৌ লোকটা অতটা  নিরীহ নয়, বরং পাক্কা  ঘুঁঘু বলা যায়৷ শেয়ানা লোক৷ 
আমি বাবাইদাকে ডেকে নিয়ে বাইরে এলাম৷ বাবাইদা আর আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি৷ আমরা ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম৷  বাবাইদা লুঙ্গির ভিতর গিঁট খুলে  খৈনীর ডিব্বা বের করল৷ খৈণী পিষছে৷ মুখে পুড়ে বলল- বুঝলি বিয়ের রাতে আমি বেড়াল মারতে পারিনি৷ এই দোষ আমার৷ এখন টের পেলাম, বেড়ালটাই পালিয়ে গেল! সে এখন ওকে মাছ, দুধ যে খাওয়াবে, বেড়াল তার৷ আমিতো মারতে পারিনি৷
আমি বললাম- বাবাইদা তুই বউদিকে খুব ভালোবাসতিস না?
বাবাইদা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল৷ বলল- দ্যাখ, একবার যাদের বিয়ে হয়েগেছে, তারা বউকে ভালোবাসতে বাধ্য৷ তাদের ভালোবাসা ছাড়া আর কোন গতি নেই৷ তুই ভালো না বাসলে উদ্ধার পাবিনা, আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে যাবি৷ বলতে পারিস বউ এখনকার নতুন ভাইরাসটার মতন, একবার সঙ্গদোষ হলেই, আজীবন অন্য কিছু থেকে ইচ্ছায় নিজেকে সড়িয়ে নেওয়া৷ সামাজিক কোয়ারেনটাই৷ বিয়ের পর বউ ছাড়া বাকী সবকিছু অন্ধকার দেখতে হয়৷ আমি দেখতামও৷ এখন চারপাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে! এতো স্যাক্রিফাইস করেও, তোদের বউদিকে ধরে রাখতে পারলাম না...
আমি বললাম- বাবাইদা তুই নিজেকে শক্ত কর৷ চেষ্টা করেছিলিস৷ সফলতা হওয়া বা নাহওয়া আমাদের হাতে থাকে না রে৷ আমিতো এতোবছর চেষ্টা করে একটা গার্লফ্রেন্ড জোটাতে পারলাম না! 
বাবাইদা আরো জোরে কাঁদতে শুরু করল৷ বলল- আমিতো পেয়েও হারিয়ে ফেললাম! জানিস নিজে হারিয়ে ফেললে কষ্ট সবচেয়ে  বেশী হয়৷ তুই দেখতে পাচ্ছিস না, আমার বুক ঝলসে যাচ্ছে৷
বাবাইদা কথা গুলো বলেই কিছুক্ষণ চুপ থাকল৷ বাবাইদার গলা ভেঙে গেছে৷ ভাঙা গলাতে বলল-  এই যে ঘটনা গুলো ঘটল , বিশ্বাস করবিনা কাল রাত  অব্দি আমরা একসাথে বসে লুডো খেলেছি৷
আমি বললাম- দাদা ঝামেলাটা কী নিয়ে ছিল?
বাবাইদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- আগে বউ হোক, তখন বুঝবে বউ রাখার হ্যাপা৷
আমার মনে হচ্ছে এখন যাওয়া দরকার ৷

দুপুরের দিকে ফোনে মেসেজটা ঢুকল৷ অপুর  এস এম এস  এলো৷ দুপুরের খাবার খেয়ে, আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে  শুয়ে আছি৷ এরমধ্যে আরেকটা ব্যাপার ঘটেছে, মেসোমশাইয়ের ঘর থেকে যখন ফিরছিলাম, ঠিক তখনই লোকাল থানার দারোগার মুখোমুখি হলাম৷ 
 দারোগা বাবু আমাকে চিনতে পেরেছিলেন৷ মেসো'র সাথে খুব ভালো সম্পর্ক, সেই সূত্রেই আমার সাথেও ভালো পরিচয়৷ উনিই মেসোমশাইয়ের কেসটা দেখছেন৷ বহুদিন আগে ওনার সাথে আমার কথা হয়েছিল৷ আমি ওনাকে বলেছিলাম, আমার জন্য একটা চাকরী খুঁজে দিতে৷ আচমকাই উনি আজ আমাকে বললেন, আমি যেনও ওনাকে আলাদা ভাবে তদন্ত করে বলি, অর্পিতা বউদি কেন চলে গেলেন? আমি সেই ব্যাপারটাই খুঁজছিলাম৷ এই ভাইরাসজনিত মহামারির সময়, পুরো দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হবে, ঠিক তার আগের দিনই - কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে বউ পালাতে পারে!
দুপুরেই , অপুর এস এম এস এসেছে৷
- এতো চিন্তা কিসের?
লেখাটা পড়ে মনে হলো, আজ যে  অপুর সাথে সারাদিন কথা হয়নি৷ আজ যে এস এম এস এ আমাদের কথার আলাপ হয়নি৷ অপুর কাছে খুব খারাপ লেগেছে৷ মেসোমশাইয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আমি ঘেঁটে আছি৷ অবশ্য এরমধ্যে ওই যে বললাম  আমাদের পাড়াতুতো দারোগা বাবু, যিনি আমাকে বলেছেন এই বাবাইদার বউ পালিয়ে যাওয়ার পিছনে যে কারণ গুলো রয়েছে, ওনাকে জানাতে হবে৷ আমি যদি এই কাজটা করতে পারি, আমার জন্য উনি চাকরীর ব্যবস্থা করে দেবেন৷  মেসোমশাইয়ের কেসটা উনি ভীষন গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন৷ 
আমি অপুকে ফোন করলাম৷ দুবার   ফোনের  কলার  টিউন বেজে  উঠবার  পর  তুলল। নরম, প্রশ্রয় দেওয়া মিষ্টি কন্ঠস্বর ভেসে এলো
- এতক্ষণে সময় হলো?
- সারাদিন এখানে যা হয়েছে!
- কেন?
- তুমি জানোনা?
উল্টো দিকে কিছুক্ষণ অপু থেমে আছে, বলল
- আজতো আমাকে তেমন কিছু বলনি৷
-আজই তো বলবার মতন দিন৷ মেসোমশাই খুব রেগে আছেন৷ বাবাইদার চোখ দুটো কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে গিয়েছে৷
- এত খারাপ অবস্থা!
অপুর কথায়, খানিক হেসে বললাম
- ঘরের বউ পালালে, এইরকম অবস্থা হওয়াই স্বাভাবিক নয় কি?
- ঘরের বউ পাখি নাকি, খাঁচা থেকে পাখি পালিয়ে যায়৷ জেল থেকে আসামি পালিয়ে যায়৷  বউতো স্বতন্ত্র মানুষ,  সে ছেড়ে যেতে পারে৷ পালাবে কেন? 
অপু  আমার কথায় আঘাত পেয়েছে৷ বলল
- মেয়েরা কোন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে, তোমাদের এতো আপত্তি কেন থাকে?
আমি ঢোক গিলে বললাম
- ডিভোর্স একেবারে করে দিলেই, সব সমস্যা চুকে যেত৷ এই ভাবে কাউকে না বলে বাড়ি ছাড়বার কোন কারণ নেই৷ 
অপু বলল
-  আছে৷ বিয়ের পর মেয়েদের যদি শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি ভাবা না হয়, তাহলে হয়ত এই সমস্যা হত না৷ কর্মহীন বিবাহিত মেয়ে হচ্ছে শ্বশুর বাড়ির শর্তহীন সম্পত্তি৷
- অপু, এমন ভাবে বলছো! 
- যা সত্যি তাই বললাম৷ 
- অপু, বাবাইদার কথা ভাবো! ছেলেটা এই বয়সে বউ হারিয়ে সর্বস্রান্ত হয়ে পথে গড়াগড়ি খাচ্ছে! 
- যখন যেটা করা দরকার সেটা না করলে, বাকী জীবন গড়াগড়ি দিতে হয়৷ তোমার বাবাইদাকে দেখে শেখো৷
- কষ্ট লাগছে৷ বাড়ি, অর্থ, সফলতা সব কিছু আছে৷ তারপরেও বউ পালিয়ে গেল!
- টাকা দরকার, তার থেকেও দরকার উল্টো দিকের মানুষকে সম্মান করবার চিন্তা ভাবনা৷ যাদের সেটা নেই, তারা জীবনে সফল নয়৷ সফলতার সংজ্ঞা সকলের এক নয়৷
- আমি এখন কী করব বলো?
-কেন? 
- পাড়াতুতো দারোগাকাকু আমায় একটা কাজ দিয়েছে৷ মেসোমশাইয়ের বাড়ি থেকে কেন বউ পালালো,  সেটা  ওনাকে জানাতে হবে৷ যদি জানাতে পারি চাকরী পাবো৷ বুঝতে পাচ্ছিনা কেমন ভাবে এই খোঁজ শুরু  করব! 
কিছুক্ষণ থেমে অপু বলল-  বাড়ির সবাইকে আলাদা আলাদা ভাবে জানতে চাইবে৷ 
-আমি নিরুপেক্ষ থাকব৷
- সেটাও একটা পক্ষ৷ তুমি ওদের দিকের হয়েই কথা বলবে৷ যখনই ওরা বুঝবে তুমি ওদের দলের, দেখবে আসল চেহারা দেখাতে সময় নেবেনা৷ চাকরীটাও পেয়ে যাবে৷
ফোন রেখে দিলাম৷ কাল থেকে শুরু হবে আমার নতুন দায়িত্ব৷ অনেক চেষ্টা করে চাকরী জোটাতে পারিনি৷ এইবার আরেকবার চেষ্টা করব৷

মেসোমশাই আমাকে ডেকেছেন৷ বেলা দশটা বেজেছে৷ দুদিন এই বাড়িতে আসিনি৷ মেসোমশাইদের মনমেজাজ ভালো ছিলনা৷ লকডাউন না থাকলে, জনসমাগম হত৷ আমি সোফায় বসে আছি৷ মেসোমশাই খাটে বসে আছেন৷ আমি বললাম
- আপনাকে কেমন ভাবে সান্ত্বনা দেব জানিনা, শুধু বলব বৌদি ঠিক করল না৷
মেসোমশাই আমার দিকে তাকিয়ে ধীর হয়ে বললেন
- আমার ছেলের দোষ সবার আগে দেবো৷ পাঁঠা একটা৷ ঘরের বউকে দাবড়ে, চাপরে রাখতে হয়৷ টু শব্দটি করতে পারবেনা৷ গলা টিপে দিতে হয়৷
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম
-ইয়ে, মানে সে তো ক্রিমিনাল অফেন্স হয়ে যাবে! থানা কোর্টের চক্কর কাটতে হবে৷
-হোক৷ এতো খরচ করে বিয়ে দিয়েছি কেন? আমার ছেলের দোষ ছিল।  বউকে   ধরে  রাখতে  পারেনি তাই এই লকডাউনে বউ চলে গেল!
- আপনারা খুব ভালোবাসতেন৷ সেই ভালোবাসার প্রতিদান এমন ভাবে দিল!
এই রে... আমার কথাটা শুনেই, মেসোমশাই চোখ দুটো নিয়ে প্রায় তেড়ে আসবার মতন করে চীৎকার করে বললেন
- ওই সব ছেনালি( ....প্রকাশের অযোগ্য শব্দ বলে.. বিপ বিপ... লিখলাম)মেয়েছেলেদের জন্য কোন ভালোবাসা নেই৷  এই ধরনের মেয়েছেলেরা পরিবারের, বাবার, সমাজের কলঙ্ক৷ 
আমি দেখলাম, মাছ চারা খেয়েছে৷ মনের মধ্যে খুব কষ্ট লাগছিল৷ মেসোমশাই বা অন্য কেউ নাই বা জানুক,আমিতো জানি, আমি অর্পিনা বউদিকে মনে মনে ভালোবাসতাম৷ সাহসে কুলোয়নি, মেসোমশাইয়ের কেলানি খাওয়ার ভয়ে চুপ থেকেছি, দূর থেকে দেখেছি,আর রাতে পাশবালিশ দু"পা দিয় চেপে ভালোবেসেছি, অর্পিতা বউদির প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি৷ তাকে নিয়ে এই ধরনের গালাগালি শুনে আমার খুব রাগ হচ্ছিলো৷ অর্পিতা বউদির প্রতি মেসোমশাইয়ের ভাষা খুব খারাপ৷
আমি জলে মিইয়ে যাওয়া মুড়ির মতন থেথানো হাসি দেখিয়ে বললাম
-  এইটা একদম ঠিক বলেছেন৷ আপনিই মনে হয় শুধু প্রতিবাদ করতেন৷
মেসোমশাই গর্বের হাসি হাসলেন৷ ঘরের ছেলের বউ পালানোর পর এই প্রথম আমার সামনে, মেসোমশাইয়ের মুখে আত্মবিশ্বাস দেখলাম! বললেন
- আমি বেশ কয়েকদিন বেশ গলা চড়িয়েই বলেছিলাম, তোমার স্বামী আমার হুঙ্কারে প্যান্টে এখনো হিসু করে৷ তুমি চুনোপুঁটি৷ এখানে থাকতে হলে, যা বলব তাই করবে৷
আমি বললাম- জয়তু মেসোমশাই৷
মেসোমশাইয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে বেলা এগারোটা বেজে গিয়েছে৷ আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছি, চারপাশে মানুষের পদশব্দ কমে আসছে! পাড়ার মুখে থিথিয়ে গিয়েছে কোলাহল, মাঠে বাচ্চাদের কিচিরমিচির নেই৷ উল্টোদিক থেকে সৌভাগ্যবশত বাবাইদাকে এগিয়ে আসতে দেখলাম! আমাকে দেখে থেমে গেল৷ বলল
- এটাই জীবন৷ যখন ভাবলাম লকডাউনটা ভালো কাটবে, তখনই এই অবস্থা! 
আমি বললাম
-বাবাইদা  বৌদি তোমার সাথে ঠিক করেনি৷
বাবাইদা চুপ করে থাকল৷ বলল
- বাবা ঠিকই বলেছে, আমি একটি পাঁঠা!
আমি আচমকাই বলেফেললাম - এতোদিন পর জানলে!
কথাটা বলে বুঝতে পারলাম ভুল করেছি৷ বাবাইদা বলল-
- কিছু বললি?
আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম
-দাদা  বৌদির  কথা মনে পড়ছে? 
বাবাইদা  চোখ দুটো মুছে বলল- অর্পিতার মন বুঝতে পারিনি৷ ও সরকারী চাকরী পরীক্ষায় বসতে চেয়েছিলো৷ আমি বলেছিলাম, বসে লাভ নেই৷ আমাদের বাড়ি থেকে  বিবাহিত   মহিলারা কেউ চাকরী করে না৷ আমরা চাকরী  করতে  দেবো না। 
আমি বললাম- বেশ করেছিস, খাসা করেছো দাদা৷ তুই হলি  ‘তিস মার খান’... প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে   দিয়েছো! আমরা থাকতে মেয়েরা কেন চাকরী করতে যাবে?
আমার কথা শুনে বাবাইদার মুখটা বিজয় দশমীর সাদা রসগোল্লার মতন রসে ছলছল করতে লাগল! গাল ঠেলে হাসি, হাড়ির গা বেয়ে গড়িয়ে নামা রসের মতন নামছে৷ আমার বেশ লাগল৷ এতোদিন বাদে বাবাইদার মনে আনন্দ জোয়ার এসেছে, বউ ফিরে এসেছে বলে নয়, বউকে চাকরী করতে দেয়নি বলে; এমন শ্লাঘা ভারতীয় বাঙালি পুরুষদের সাথেই মানানসই৷ আহাঃ আমি দেখছি বাবাইদার মনের আকাশে শরতের সাদা মেঘ উড়ছে৷ আহাঃ আমরা মাতৃআরাধনা করি, মাতৃ পূজোয় পাঁচটি দিন কাটিয়ে দিই৷ আমাদের চিন্তায় এমন ভাবে দুর্নীতি মিশে আছে, আমরা না-চাইলেও দুধে জল আর চালেতে কাঁকড় মেশাবো, মুখে বলবো-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাই৷
আমি বললাম- তুই বৌদিকেব ভালবাসতিস৷ সেই দাম দিতে পারল না! 
বাবাইদা হাসতে হাসতে বলল- গাড়ল, এরজন্যই কোন মেয়ে তোকে পাত্তা দিলনা৷ আজ অব্দি বউহীন হয়ে রইলি! মেয়েদের কখনই পুরোপুরি ভালোবাসতে নেই৷ অর্ধেকও ভালবাসতে নেই৷ হ্যাঁ শুধু ভালোবাসি ভালোবাসি বলে, পুরুষ মানুষের অধিকার ফলাতে হয়৷ আমি ওকে বলেছিলাম, যতই ন্যাকামো মারো৷ যতই পড়াশুনো করো৷ তোমার স্বামী মুরগির ডিম বিক্রি করে, এটাই তোমার সম্মানের৷ আমি কখনই মেনে নেবোনা, আমার বউ সরকারি চাকরী করছে৷
আমি বললাম- তা ঠিক৷ পোলট্রি দোকানের সাথে সরকারী চাকরী ঠিক যায়না৷
মাসিমা রান্না ঘরে বসেছিলেন৷ দুপুরে বাবাইদার সাথে কথা হওয়ার পর, অপুকে ফোন করেছিলাম৷ সন্ধ্যাবেলায় ভাবলাম মাসিমার সাথে কথা বলা যাক৷ মাসিমা আমাকে দেখে বললেন- সব শেষ রে৷ মেয়েটা পরিবারের মুখে কালি ছিটিয়ে চলে গেল৷ বাজে মেয়েছেলে৷ এমন সুন্দর শ্বশুরবাড়ি থাকতেও পালিয়ে গেলি! 
আমি মাসিমার সুরে সুর খেলিয়ে দিলাম৷ বললাম- হ্যাঁ খুব বাজে মেয়েছেলে, আপনাদের ঠকিয়েছে৷ আপনারা কত ভালো! আচ্ছা মাসিমা মেয়েটাকে ঘরে তুলবেন যদি ফিরে আসে?
মাসিমা চোখদুটো ভারী করে বললেন- দেখ, উনিত দয়ার সাগর৷ বুঝতেই পাচ্ছিস৷
আমি মুখ দুটোকে বাধ্য ভক্তের মতন করে বললাম- সে আর বলতে! মেসোমশাইয়ের দয়ায় পাড়ার সমাজবিরোধীরা কিছু করে খাচ্ছে৷ এমন দয়া আছে বলেই, আমরা এখনো চাঁদার নামে তোলা দিয়ে চলেছি৷ আগে ক্লাবকে ভালোবেসে চাঁদা দিতাম৷ এখন আমরা ক্লাবকে ভালোবেসে চাঁদা দেওয়ার ফলাফল টের পেয়েছি৷
মাসিমা কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে কড়া করে তাকিয়ে রইলেন৷ আমি বললাম- তোমরা একটু বেশীই ভালোবেসেছো৷
মাসিমা কিছু বলবার আগেই, বাবাইদার বোন ফুলকি বলল- না গো দাদা, মা বলেই দিয়েছিল বৌদিকে পড়াশুনো করছ করো৷ চাকরী করতে দেবও না৷
আমি হাসতে হাসতে বললাম- একদম৷ 
মাসিমা বললেন- আমার ছেলেটা মাধ্যমিক টপকাতে পারেনি৷ আমার মেয়েকে টেনে টুলে উচ্চমাধ্যমিকে বসিয়েছি, পাশ করতে পারেনি৷ আমি নিজে সই করতে পারিনা৷ এমন বাড়িতে শিক্ষিত মেয়ে আনলেও, চাকরী করলে আর সেই মেয়ের উপর খবরদারি চালানো যাবে? তুই বল৷
আমি বললাম- মাসিমা, আমার তো বউ নেই৷
মাসিমা বলল-আর আমার ছেলেটার থেকেও ধরে রাখতে পারল না!
ফুলকি বলল- তুমি কিন্তু আমার মতন মেয়েকে বিয়ে করবে, বৌদি  মতন মেয়েকে বউ করলেই ডুববে৷ 
ফুলকি কথা গুলো বলছিলো, আমি ওর চোখে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস দেখছিলাম৷ ভালোই লাগছিলো৷ আমি এই জিনিসটার অভাবেই এই জীবনে প্রেমিকা পেলাম না! অর্পিতা বৌদিকে খুব ভালোলেগেছিলো, সাহস করে বলতে পারিনি৷ প্রেমিক হওয়ার আসল শর্ত আত্মবিশ্বাসী হতে হবে৷
- তুমি সব শুনলে৷ আর কোন সংশয় আছে?
অপুর গলার আওয়াজে আমি কষ্টের জলীয় বাষ্পর আভাস পাচ্ছি! মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে৷ উত্তরকলকাতা থেকে দমদমে গিয়ে আছে, মামার বাড়িতে আছে৷ সন্তানহীন মামা অপুকে নিজের মেয়ের মতন মানুষ করেছেন৷ অপুর বিয়ে হয়েছিল, মামা এবং অপুর অমতেই, শুধুমাত্র একদিনের দেখায়, বাবা আর মায়ের জেদে৷ শ্বশুর বাড়ির লোকেরা উত্তর কলকাতার এক জাঁদরেল ব্যবসায়ী পরিবারে বিয়ে হয়৷ অপুর ইচ্ছা পড়াশুনোটা কাজে লাগিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে৷ 
এখন মাঝরাত হবে৷ বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ আমি জানলা খুলে, খাটের উপর বসে আছি৷ পা তুলে বসে আছি৷ জানলার  উল্টো পাড়ে  নদীর  মতন  আকাশ , নদীর  মতন  বয়ে  চলেছে।  আকাশে  ছড়িয়ে  থাকা তারারা টিপ টিপ করে জ্বলছে৷ লকডাউনে শহরের দূষন কমছে৷ পৃথিবীতে অনেক ভয়ংকর ভাইরাস  এসেছে,  মানুষের   দখলদারী করবার মানসিকতা, সেই অভ্যাসের ভাইরাসের থেকেও  বেশী ভয়ংকর মনে হয়৷ এখানে   এক শ্রেণীর  মানুষ  আরেক   শ্রেণীর  মানুষকে নিজের হাতের  মুঠোয়  রাখতে   চাইছে।  অর্পিতার কথা ভাবছিলাম৷ মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে, এটা খবর হয়েছে, তাঁর পালিয়ে যাওয়ার কারণ কত জন খুঁজেছে?
-তুমি হারিয়ে গেলে নাকি?
ফোনের উল্টো দিকে অপু আছে৷ মিষ্টি গলা, অন্ধকালে কালো কালো ছায়া হয়ে যাওয়া পাড়ার পুরানো বাড়িরা, স্থির রাস্তা,পাশের বাড়ির  দেওয়াল নিঃশব্দে পেড়িয়ে যাওয়া ভীরু বিড়াল, চাঁদের আলোর ছড়িয়ে থাকা, সব মিলিয়ে এই সময় মায়াবি হয়ে উঠেছে৷
অপুর গলা শুনে বললাম
- আমাদের খেলাটার আজ শেষ দিন৷
- তোমার মন খারাপ লাগছে?
- একটু লাগছে, তোমাকে অপু বলে আর ডাকতে পারবো না৷ আবার আমরা সম্পর্কে ফিরে যাবো৷ 
- কেন? আমাদের   মধ্যে একটা   সম্পর্ক   আগে ছিল। এই  দুমাসে   নতুন সম্পর্ক  তৈরী  করেছি৷ সেই   সম্পর্কের  জন্য   তুমি আমায়  অপু বলে ডাকতে পারো৷
- খেলা শুরুর প্রথম দিনের কথা মনে আছে৷ আমি ভুলিনি৷
-শুনি শুনি৷ কেমন মনে আছে দেখি৷
- আমি যে তোমায় ছাদ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি, তুমি টের পেয়েছো৷
- সে বাপু,মেয়েদের একটা আলাদা অনুভূতি থাকে৷ বুঝতে পারে, তাদের কে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে৷
- আমি ধরা পড়ে গেলাম৷
-মিথ্যুক, আমার চাপাচাপিতে, ছাদে দুজন ছিলাম৷ তুমি আর আমি, তখনই তুমি আমাকে প্রেম নিবেদন করলে৷ ভয় পেয়েছিলে৷ আমার চাপাচাপিতে বলেই দিলে৷
- সেটাই স্বাভাবিক নয়৷
- রেগে যাচ্ছো কেন? প্রেমিকদের এতো অল্পে ধৈর্য্য হারালে চলবে?
- তুমি বললে সেই থেকে দুমাস আমরা দুজনে একটা খেলা খেলব৷ 
- খেলছিতো৷ আমি যে অর্পিতা, তা তুমি ভুলে গিয়েছো৷ অর্পি বলে আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছো৷ নিজের সুখ দুঃখের কথা আমার সাথে আলোচনা করেছো৷
— তুমি যে বাবাইদার বৌ, মেসোমশাইয়ের ছেলের বৌ , আমি এই সব কিছু ভুলে গেলেও, আইন বলে একটা ব্যাপার আছে৷
- আমি বউ ছিলাম৷ ওদের বাড়ি ছেড়ে দমদমে চলে এসেছি৷ বিবাহবিচ্ছেদ বলে একটা ব্যাপার আছে৷
-ডিভোর্স!!
- ভয় লাগছে? ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে হবে বলে ভয় পাচ্ছো? আমি কিন্তু ভার্জিন৷
অর্পিতার কথা শুনে আমি লজ্জা পেলাম৷ বুকটাও ধরাস করে উঠল৷ এতোটা ঘনিষ্ঠ কথা এই প্রথম কোন মেয়ে আমাকে বলল৷ আমার মতন হাঁদার সাথে কোনও মেয়েই বন্ধুত্ব করতে চাইবে না৷ আমিযে প্রেমহীন পরিত্যক্ত যুবক৷ 
আমি বললাম
-একটু সাহস আছে অর্পিতা ম্যাডাম৷
-তাহলে মনে রেখো, তোমার কেউ একজন অনুরাগী আছে৷
- এতো জোর পাচ্ছো কেমন করে?
-তোমার থেকে৷ তুমিই দিয়েছো৷
-ধুর, যার নিজের জীবনই ব্যর্থ৷ যে নিজেই পাঁচ হাজার টাকার চাকরী জোটাতে পারেনা৷ সে তোমার কোন কাজে এসেছে?
- এই যে দুমাস আমার সাথে নতুন পরিচয়ে বন্ধুত্ব শুরু করলে৷ আমাকে বুঝিয়ে দিলে, বিবাহিত হয়েও, আমার নিজের পরিচয় আছে৷ আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারে৷ এই দুমাসে আমি ছটা সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দিয়েছি৷ ওদের শত বাঁধা পেড়িয়ে৷ তুমি যে ফর্ম গুলো এনে দিতে, আমি ফিলাপ করে শুধু তোমায় দিতাম না৷ মন দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম৷ 
-তারপর?
- জয়েনিং লেটার এসেছে৷ নবান্নতে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক৷ এরপর ডব্লু বি সিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবো৷
-ভালো৷ তোমাকে নতুন জীবনের শুভেচ্ছা৷ 
-আমার পাশে থাকবে না!
- আমি হাঁদারাম৷ তোমার মতন প্রতিষ্ঠিত মেয়ের পাশে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো?
-আবার মেল ইগো? পুরুষতান্ত্রিক আমিত্ব!
-না গো৷ আমি খুশি৷ আমি জানি আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য নই৷
-কচু জানো৷ গাড়ল একটা৷ শোনও কাল থেকে যদি  ফেসবুকে এনগেজড স্টাটাস না দাও৷ লকডাউন উঠলে, পাড়ায় গিয়ে ঝগড়া করব৷ লকডাউন উঠলে কাজের চেষ্টা করবে৷ আমিতো পাশে রইলাম, চিন্তা কিসের৷ ভয় নেই, বিশ্বাস করতে পারো৷
- এই অপু, মানে আমরা এখন থেকে প্রেমিক আর প্রেমিকা? মানে তুমি আমার অর্পিতা বৌদি নও! যাক এতোদিন বৌদিবাজির মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হলাম!
-কী আমি বৌদি!! 
-না, তা বলছিনা৷
-গাড়ল একটা....
যাঃ অর্পিতা ফোন কেটে দিল৷ রেগে গেছে৷ আমি জানি এই রাগ কাল সকালেই ভেঙে যাবে৷ 
আমি জানি দারোগাবাবুর দেওয়া চাকরীর প্রস্তাবে আমি সফল হলেও, চাকরীটা আমি পাচ্ছিনা৷ অসুবিধা নেই৷ এমন সময় ফোন বেজে উঠল৷ বাবাইদার নাম ভাসছে, ফোনের স্কীনে৷ ফোন ধরলাম৷ বাবাইদার গলা ভেসে আসছে৷ বাবাইদা আনন্দে চিৎকার করে বলছে
- "বুঝলি এই লকডাউনে শুধু আমার বউটাই পালায়নি৷ আমার আরো দুজন বন্ধুর বউও পালিয়েছে৷"
আমি  বললাম- দাদা,  বউ পালায়নি। ওঁরাও  বউকে লকডাউনে ধরে রাখতে পারেনি৷

chakrabortypinaki50@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment