1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

কিওর (১৯৯৭)

 চলচ্চিত্র সমালোচনা -  অভিষেক ঘোষ 

ছবি : 'কিওর' (১৯৯৭)

পরিচালক : কিয়োশি কুরোসাওয়া ।

Cure (1997)

Dir. : Kiyoshi Kurosawa

Country : Japan.

Cast : Kōji Yakusho, Tsuyoshi Ujiki, Anna Nakagawa, Masato Hagiwara etc.

প্রথাগতভাবে ‘হরর ফিল্ম’ আমাদের যেটা দিয়ে থাকে, তা হল — ভয়ের বিনোদন । নিম্নমেধার ছবি-তে সেই বিনোদনে লঘু কৌতুকমুখর অলৌকিকের সাথে মেশে যৌন সুড়সুড়ি । মধ্যমেধার ছবি মেশায় যৌন আবেদন ও বিক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ । আর সত্যিকারের ভালো ছবি এসবের উর্ধ্বে ! মনঃসমীক্ষণ-ই তার স্বভাব । সেখানে উপাদান থাকে যত্রতত্র, অথচ কোনোটিই নিজেকে জাহির করে না । অর্থাৎ ভয়ের উপাদানগুলি মিশে থাকে প্রতিটা ফ্রেমের সঙ্গে, আমাদের ক্ষণিকের বিনোদন দেওয়া সেখানে উদ্দেশ্য নয়, বরং আমাদের চোখ-কানের গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে উপাদানগুলি প্রবেশ করতে চায়, সরাসরি চেতনায় । এই অনুভূতি প্রায়শই বেদনাদায়ক । কারণ হামেশাই এই ধরণের ছবি আমাদের পাপবোধ, অবদমন, জিঘাংসা, তীব্র রাগ, অন্তঃসারশূন্য চাহিদাগুলির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে । ভুলগুলো কবর খুঁড়ে তুলে আনে, বেদনা জাগায় । স্বভাবতই তা সহনীয় নয়, কখনোসখনো । ফলে ছবিগুলি যতই অস্বস্তির কারণ হোক না কেন, আদিমতম ভয় জাগিয়ে তোলার অনুপম সার্থকতাতেই এই ছবিগুলি আমাদের সঙ্গে থেকে যায় । কিয়োশি কুরোসাওয়া -র (আকিরা কুরোসাওয়া-র সাথে এঁর কোনো সম্বন্ধ নেই) হরর ছবি ঠিক এই অন্তিম শ্রেণিভুক্ত ।

Kiyoshi Kurosawa-র ‘Cure’ (1997) শুরু হয় এক অ্যাসাইলামে — যেখানে ডিটেকটিভ কেনিচি তাকাবে (অভিনয়ে Kōji Yakusho)-র স্মৃতিভ্রষ্ট স্ত্রী ফিউমি চিকিৎসকের সামনে বসে একাগ্র মনে জার্মান লেখক Helmut Barz-এর ‘Bluebeard’ (মূলত ফরাসি লোককথা) পড়ছে । সে জানে না কখন কীভাবে সে ঘর থেকে অ্যাসাইলামে এসে পড়েছে । কিন্তু সে বইটা-র শেষে কি হবে, সেটা দিব্যি মনে করতে পারে । অর্থাৎ অবচেতন ও চেতন মনের সমান্তরাল অস্তিত্ব ও তার অন্তরালে শায়িত রহস্যের টোপ শুরুতেই ফেলা হয়ে গেল । এরপর ছবিতে একের পর এক খুন হয়ে চলে এবং প্রতি ক্ষেত্রেই আমরা হত্যাকারীদের আবিষ্কার করি অকুস্থলেই । মৃতদেহের গলায় আঁকা ‘X’ চিহ্ন । হত্যাকারীরা নিজেরাও ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে থাকবে এবং সমানে নিজেদের অপরাধ কবুল করবে এবং তীব্র অপরাধবোধে হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে । অথচ মনে করতে পারবে না, অপরাধের মোটিভ । আচ্ছা আপনার শরীরে বাসা বাঁধা ভাইরাসগুলি-কে যদি আপনি প্রশ্ন করেন, “কেন করলে এরকম ! বলো ?” — কী উত্তর পাবেন । নাথিং । তো সেভাবেই এই ছবিতে সমাজ-সমালোচনা—চিকিৎসাশাস্ত্রের নিষিদ্ধ থেরাপি—মনঃসমীক্ষণ একসূত্রে মিলেছে । প্রত্যেকটি মানুষ এমনই বিচ্ছিন্ন একে অপরের থেকে যে, ভাইরাসের আক্রমণ সহজতর হয় । সমাজটাও ফাঁপা, সারবত্তাহীন । তাই মানুষগুলোর ভিতরটা এতটা খালি যে অজগরের মত আর একটা মানুষের বেঁচে থাকার দাবি তাকে সমেত আত্মসাৎ করে, অনায়াসে গলায় খোদাই করে দেওয়া যায় ‘X’ চিহ্ন ।

প্রথম হত্যার পরেই যেহেতু আমরা ইঙ্গিত পেয়ে যাই যে, রহস্য আছে — এর আড়ালে অন্য গল্প আছে, সেহেতু প্রথম হত্যার পরেই জনশূন্য সমুদ্রসৈকতে এক ভবঘুরে-কে দেখেও আমরা আঁতকে উঠি । সে তার পরবর্তী টার্গেটের দিকে যত এগোয়, আমরা তত অনুভব করি ‘Pure Fear’ । এখানেই ছবির সাফল্য । ছবি-তে কোথাও ভয় দেখানোর কোনো চেষ্টা নেই । আমরা শুধু উপাদানের উপস্থিতি অনুভব করলেই শঙ্কিত হয়ে পড়ি । সুচতুর পরিচালক ধীরে ধীরে হিপনোটিজম্-এর কায়দায়, আমাদের চেতনায় রোপন করে দিতে থাকেন সেইসব ভয়ের অঙ্কুর — অবচেতনের মাটির হদিশ পেলেই যা বেড়ে ওঠে । ছবিতে তৈরি হয় আশ্চর্য টানাপোড়েন । ঐ নামহীন চরিত্রটি সবাইকে সম্মোহন বা হিপনোটাইজড্ করে । তারপর হত্যা করায় । আমরা বুঝি জল, আগুনের মত খাঁটি পার্থিব উপাদানগুলিই তার সম্মোহনের উপাদান বা টুলস্ । কিন্তু ছবির চরিত্রদের মতোই ঐ লোকটির সামনে আমরা অসহায় বোধ করি, ফাঁদে পা দিই । শরিক হই কখনো ডিটেকটিভের অনুসন্ধানী ও সংযমী চেতনার, আবার কখনো মূল অপরাধী কুনিও মামিয়ার (অভিনয়ে অসামান্য Masato Hagiwara) শান্ত, স্থির ক্রূর চালের । গুলিয়ে ফেলি, আমি নিজে ভালো না মন্দ বা, আদতে আমার কী হওয়া উচিত ! ছবিতে একটা দৃশ্যে ডিটেকটিভ ‘তাকাবে’-কে এক শূন্য দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি ক্যামেরার পার্শ্বিক কোনে । পরমুহূর্তেই কোন বদলে গেলে চমকে গিয়ে দেখি, মামিয়া ঐ দেওয়ালের অন্তরালে এক খুপরি-তে তাকাবে-র মুখোমুখি । চমকে উঠতে হয় । আশ্চর্য কৌশল । এমন চমক ছবিতে অসংখ্য । সেট নির্বাচন ও তার সাথে দর্শকের পরিচয় করিয়ে দিতে লং শট্ আর ক্যামেরার অবিচলতা-কে অপূর্ব ব্যবহার করেছেন পরিচালক । ‘Shibui’-ধর্মী জাপানি শিল্পরীতির সূক্ষ্মতা এই ছবির সবচেয়ে বড়ো শক্তি । প্রায় সব দৃশ্যই সাজেস্টিভ — প্রায় সব হত্যাও — মায় ক্লাইম্যাক্স-ও । ভিলেন মামিয়া মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, সে জার্মান মনোবিদ Franz Mesmer-এর কুখ্যাত সম্মোহনবিদ্যা ‘animal magnetism’-এর উপর গবেষণা করতে গিয়ে অবসেসড্ হয়ে পরে । তারপর সে তার প্রয়োগ শুরু করে । কিন্তু সে নিজেও কি ‘মেসমেরাইজড্’ হয় নি ? তার মুখ ঢেকে দেওয়া লম্বা চুলের আড়ালে চোখের উদাসীন দৃষ্টি আর পিঠময় বিরাট পোড়া দাগের যন্ত্রণা সম্পর্কে চরম উদাসীনতা বুঝিয়ে দেও, সেও নিজেতে নেই । কিন্তু কোথাও একটা তার প্রায়োগিক সাফল্যের আনন্দ বেঁচে ছিল চোখের কোনের হাসিতে, কুটিল প্রশ্নে । তাই যে যান্ত্রিক নয়, তাকে মরতেই হতো । আর এই কৌশলটিই ছবিতে একটি তাত্ত্বিক অনুষঙ্গও সংযোজিত করে ।

এর বেশি বলা উচিত নয়, বললে ছবি দেখার মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে । শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে ছবিটা যেখানে শেষ বলে মনে হয়, তারপরও অনেক চমক অপেক্ষা করে থাকে । শুরু ও শেষের দৃশ্য বাদে গোটা ছবিটাই আবহসঙ্গীতহীন, বহু দৃশ্য সিনেমার ইতিহাসে ঢুকে যাওয়ার মতো চিত্তাকর্ষক । নির্মাণে অসম্ভব মুন্সিয়ানার জন্য পরিচালককেই কৃতিত্ব দিতে হয় । কারণ ছবিটা সেই অর্থে আধুনিক সিনেমার সমস্ত আলংকারিক সৌন্দর্য-কে বর্জন করে । সারল্য বজায় রেখেও ছবিতে আশ্চর্য জটিল আর অশুভ একটা ভয়ের অবয়ব ফুটে ওঠে । এই চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চাইলে অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত এই ছবি । আর পরিচালকের দর্শন ও বিবর্তন বুঝতে চাইলে অতি অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত তাঁর আরেক সুবিখ্যাত ছবি ‘Pulse’ (Kairo, ২০০১) । ‘কাইরো’ আপনাকে আরো বেশি ভয় পাওয়াতে পারে, কিন্তু ঐ ছবির দ্বিতীয়ার্ধে যেভাবে চূড়ান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছবিটার ঘাড়ে ভর করে, তার ভূত ছবিটার যথেষ্ট ক্ষতি করেছে । তা-নাহলে ভয় দেখানোর মৌলিকতায় ঐ ছবিটাও সেরার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিযোগ্য ।

abhisek1988ghosh@gmail.com
কলকাতা



No comments:

Post a Comment