![]() |
ছবি : লেখক |
আজকাল রাতে
আর ঘুম আসে না।
সারারাত
জেগেই থাকেন অবনী সর্দার। বয়সকালে মানুষের অনিদ্রা রোগ হয়, সেটা অবনী জানে। তাই ঘুমের জন্য চিন্তা
নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়। ইদানীং লক্ষ্য করেছে রাতের বেলায় দৃষ্টি ও শ্রবণ, দুটো শক্তিই আগের থেকে বেড়ে গেছে। ৬৭ বছর
বয়সে এখনও কানের যন্ত্র ব্যবহার করতে হয় না ঠিকই, তবে গতবছর দু চোখের ছানি অপারেশন হয়ে গেছে। কৃত্রিম লেন্স লাগান চোখ দিয়ে
এখন দিনের আলোর তুলনায় রাতে অনেক পরিস্কার দেখতে পায় সবকিছু। ঘুম আসে না বলে মধ্যরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে
একা-একাই নিজের জমিতে গিয়ে বসে থাকে অবনী। হাতে থাকে শুধু আনস্মার্ট মোবাইল ফোন।
যার মেমরি কার্ড ভর্তি শুধু লালন ফকির, শাহ আব্দুল করিম,
আব্বাসউদ্দিন
আহমেদ,
নির্মলেন্দু
চৌধুরী,
অমর পাল, পূর্ণদাস বাউলের গানে। মাটির গান, কাদামাটি আর ধূলোমাটিতে বসে শুনতেই সবচেয়ে
ভালবাসে অবনী।
মাঝরাতে
বাড়ির সদর দরজা খুলে বাবাকে বেরোতে দেখে ছোটছেলে শঙ্কর সেদিন অবাক হয়েছিল। অবনী’র
পথ আটকে বলেছিল,
-‘এত রাতে যাচ্ছ কোথায়?’
ধরা পড়ে
ছোটখাট চেহারার অবনী গুটিয়ে ছোট হয়ে গেছিল আরো। বলেছিল,
-‘চোখে ঘুম আসে নাই রে শঙ্কর। অস্থির অস্থির
লাগে। তাই জমিতে গিয়ে বসে থাকি দু দন্ড। এট্টু আরাম পাই। আবার ভোর হওয়ার আগেই, আকাশে যখন নীল আলো ওঠে, তখন ফিরে আসি। দু চোখে তখন মস্ত ঘুম।
ঘুমিয়ে পড়ি।’
-‘ভাগ্যিস আজ এসময় পেচ্ছাপ করতে উঠেছিলাম, তাই দেখতে পেলাম। দাদা জানে?’
-‘না বোধহয়। তবে তুই জানলি তোর দাদাও
জানবে।’ বিরক্তিভরা গলায় বলে, ‘ আমাকে আর আটকাস না। যেতে দে।’
-‘যদি কোন বিপদআপদ হয়?’
-‘তোদের দুই ভাইকে যতটা না চিনি, তার চেয়ে বেশী চিনি এখানকার রাস্তাঘাট, চাষজমি, গাছপালা,
জীবজন্তু, ধূলোমাটিকে। ভালোবাসে এরা আমাকে। বিপদের
কোন কারণ নাই।’
-‘টর্চ, লাঠি এসব সঙ্গে আছে ?’
-‘এই যে মোবাইল ফোন, তোরই কিনে দেওয়া, এতেই তো টর্চ আছে। বিমলার ব্যাটা আমায়
দেখিয়ে দিয়েছে কি করে জ্বালাতে হয়। আর, লাঠির কোন দরকার নাই। তুই এবার সর। আমি যাই।’
অন্ধকারে
ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পুরোনো কথা মনে পড়ে
শঙ্করের। বেশী পুরোনো নয়। বছর দেড়-দুই আগের কথা। তার আগে আর পাঁচটা চাষীর মতই
স্বাভাবিক ছিল অবনী সর্দার।
*****
সেবার আড়াই
বিঘা জমির পুরোটাতেই রোপা আমন ধান লাগিয়েছিল অবনী। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি বীজতলায়
বীজ বুনেছিল। তারপর ভাদ্র মাসে, যখন রোপণ করেছিল তখন জমিতে গোড়ালি-জল। পুজোর সময় সেই সবুজ ধানক্ষেত দেখে
জুড়িয়ে গেছিল দুচোখ। আর মাস দুয়েকের অপেক্ষা তখন। তারপরই সন্তান জন্মাবে। পুরুষ্ট
ধানগাছ ছিল জমি অন্ত প্রাণ অবনীর কাছে মাটির সন্তান, তাই নাওয়া-খাওয়া ভুলে জমিতেই পড়ে থাকত। সবসময় কিছুনা কিছু করছে। আগাছা
তুলছে,
পোকা লাগা
পাতা ছিঁড়ে ফেলছে,
ইউরিয়া-ডিএপি-জৈব
সার স্প্রে করছে ...মাটির সাথে, গাছের সাথে কথা বলতে দেখা যেত প্রায়ই। পিতৃস্নেহে যত্ন করত গাছগুলোর। অবনী
বরাবরই এমন। যখন নরেন গোঁসাইয়ের কীর্তনের দলে খোল বাজাত, তখনও ভারি দরদ দিয়ে বোল তুলত খোলে। দূর-দূর
থেকে ডাক আসত। বছরের বেশীরভাগ সময় বাইরে বাইরেই কেটে যেত। তাই নরেন গোঁসাই মারা
যাওয়ার পরের দিনই কীর্তনের পাট চুকিয়ে দেয় অবনী। বাহান্ন বছর বয়সে আর ঘোরাঘুরি
পোষাচ্ছিল না। অল্পস্বল্প চাষবাস করা অবনী তখন পুরোপুরিভাবে চাষের জমিতেই মন ঢেলে
দিল। মাটির বুকে সোনার ফসল ফলিয়ে মহাসুখ পেত সে। ছটফটে পুরুষ্ট ধানের শীষ দেখে
আবেশে চোখ বুঝে আসত। সবকিছু চলছিল ভালোই, তারপর এল সেই দিন।
গত বছরের
কার্তিক মাসের ত্রয়োদশীর দিন। হরিভক্ত অবনীর কাছে কার্তিক ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ মাস। শ্রীহরির অনুকূলে যে
কোন কাজই এই মাসে শতগুণ বেশী ফলদায়ক হয় সেকথা অজানা ছিল না অবনীর। আগের দিন
সারাদিন উপোস করে সন্ধ্যেবেলা বিষ্ণুমন্দিরে তিনরকম প্রদীপ জ্বেলেছিল অবনী।
কর্পূরের,
ঘি-য়ের আর
তিলের তেলের। ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে ক্লান্ত শরীরে চলে গিয়েছিল ক্ষেতে। সাথে ছিল
ইউরিয়া সার। নিজেই স্প্রে করেছিল গোটা জমিতে। দুপুরে বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে গেছিল
মেয়ের বাড়ি,
পাশের
গ্রামে। অনুষ্ঠান ছিল। পরেরদিন সকালবেলায় ফোন এসেছিল পরাণ সর্দারের। অবনীর ক্ষেতের
পাশেই পরাণের জমি। অবনীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল ফোন পেয়ে। এ কি করেছে সে? নিজের হাতে নিজের ফসলকে খুন করেছে! তড়িঘড়ি
সাইকেল নিয়ে মেয়ের বাড়ি থেকে সোজা ক্ষেত। ঐ তো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে নেতিয়ে
পড়া ধানগাছগুলো। বাড়ি ফিরে গুদাম ঘরে ঢুকে বুঝেছিল কি সর্বনাশটাই না করেছে। ভুল
করে ইউরিয়া সারের বদলে আগাছা নাশক কেমিক্যাল ছড়িয়েছে সে, নিজের হাতে। ছানিপড়া চোখ, শারীরিক ক্লান্তি আর প্যাকেট দুটোর মধ্যে
সাদৃশ্য... এই মারাত্মক ভুলের কারণ। একথা দুই ছেলে, বন্ধুবান্ধব,
আত্মীয় পরিজন
বুঝিয়েছিল। তবু অবনীর মন মানতে চায়নি। পাথর হয়ে গেছিল শোকে। কিছুতেই মানতে পারছিল না এতবড় ভুল।
কয়েকদিনের মধ্যে চোখের সামনে গোটা ক্ষেতের ধান শুকিয়ে মরে গেল। নাওয়া-খাওয়া-ঘুম
ভুলে তখন সারাক্ষণ বসে থাকত জমিতে। আপনমনে মাটির সাথে, গাছের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলত। তখন থেকেই
মাটি,
ক্ষেত, ফসল নিয়ে পাগলামি শুরু হল অবনী সর্দারের।
রাত-বিরোতে বাড়ি ছেড়ে একা একা বেরিয়ে পড়ার শুরু তখন থেকেই। ছানি পড়া চোখের দৃষ্টি
ক্রমশ কমতে থাকায় চুনী-ডাক্তারের পরামর্শে ওর দুই ছেলে বিমল আর শঙ্কর শহরে গিয়ে
বাবার ছানি-অপারেশন করিয়ে এনেছিল।
*****
“কোথায় পাব তারে
আমার মনের
মানুষ যে রে!
হারায়ে সেই
মানুষে,
তার উদ্দেশে,
দেশ-বিদেশে
বেড়াই ঘুরে ...”
মোবাইল ফোনে
খুব কম ভলিউমে গান বাজছে। তবু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে অবনী। মাঝরাতে চরাচরব্যাপী
গলন্ত জোছনায় মাঠঘাট সব ফকফকা সাদা। মেঠো ইঁদুরের আনাগোণার শব্দ পরিস্কার শোনা
যাচ্ছে। আর সেই ইঁদুর ধরতে আশেপাশে সাপের দল যে হাজির, ছানিকাটা চোখে তাও স্পষ্ট অবনীর কাছে।
একটুকও ভয় হচ্ছে না। বরং ভোটের সময় নেতাদের ভাষণে শোনা শব্দযুগল ‘শান্তিপূর্ণ
সহাবস্থান’-এর মত স্থির,
অচঞ্চল অবনী
চুপ করে বসে আছে। গাছেরা নিজেদের মধ্যে যে কথা চালাচালি করছে তাও ধরা পড়ছে অবনীর
কানের পর্দায়। দেখতে পাচ্ছে জোছনা মেখে আর শিশিরে ভিজে প্রতিটা গাছ প্রচন্ড খুশি।
কলকল করে বলে চলেছে তাদের আনন্দের কথা। গত কয়েকদিন ধরে একটু একটু করে এই আনন্দের
ভাগীদার হতে পেরে অবনীও বেজায় প্রীত।
তাকে তারা
ক্ষমা করে দিয়েছে,
এটা শুনে দু-
চোখের
নোনাজল ছাড়া
আর কিছুই দিতে পারেনি সে। আকুল হয়ে ভিক্ষে চেয়েছে মাটির বুকে বসবাসকারী বিষধর
সরীসৃপের কাছে,
মাটির বুকে
মিশে যাওয়ার ভিক্ষে। দিগন্তব্যাপী এই ক্ষেতজমি, পোকামাকড়,
সাপ-ইঁদুর, সে নিজে সবই ভগবান শ্রীহরির সন্তান। তাই
তার বিশ্বাস তার প্রার্থনা বিফলে যাবে না। নশ্বর দেহ মাটিতেই লীন হবে।
*****
দুইভাই
শঙ্কার ও বিমল যখন ওদের বাবা অবনী সর্দারকে ক্ষেতের মধ্যে দেখতে পেল তখন আকাশের
নীল আলো সবে ফিকে হতে শুরু করেছে। ভোর হবহব করছে। টিট্টিউ-টিট্টিউ পাখির ধ্বনি
ফুটে উঠছে ধীরেধীরে। আর সেসবের মাঝে ভোরের শিশির মেখে চিত হয়ে শুয়ে আছে অবনী
সর্দারের নিস্পন্দ,
নীথর শরীর।
মুখে অদ্ভূত প্রশান্তি। ধূলোধূসরিত মোবাইলে বেজে চলেছে,
“আমি অপার হয়ে বসে আছি
ও হে দয়াময়,
পারে লয়ে যাও
আমায়।।
আমি একা
রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল
পাটে-
(আমি) তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি
উপায়। ....
”
লেখক -
দিব্যেন্দু গড়াই
dibyendugarai.dg@gmail.com
Very Touchy & Fantastic Story..����
ReplyDeleteঅশেষ ধন্যবাদ।
DeleteKi opurbo,lekha die aka ak chalchitro jeno.
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। খুব খুশী হলাম।
Deleteঅন্য স্বাদের গল্প|ভালো লাগলো|
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ
Deleteঅসাধারন লেখা। ছোটো হলেও মন ছুঁয়ে যায়। ধন্যবাদ দিব্যেন্দু এইরকম একটা লেখা উপহার দেয়ার জন্য।
ReplyDeleteছোট্ট প্রয়াস সার্থক হয়েছে জেনে খুশি হলাম। পরের সংখ্যা গুলোতে আরও গল্প নিয়ে আসব। এভাবেই সাথে থাকিস।
ReplyDeleteVison valo laglo
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ
ReplyDelete