1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, September 28, 2019

অন্ধকারে লক্ষ্যভেদ

ছবি-আন্তর্জাল
"মাচানটা একবার পরিদর্শন করে ইবটসন আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেলো। আমি মাচানে চড়ে বসার কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম পণ্ডিত এক বালতি দুধ নিয়ে গাছের তলা দিয়ে নিজের যাত্রীশালার দিকে যাচ্ছেন। আমাকে মাচানে দেখতে পেয়ে বললেন, 'যাত্রীশালায় প্রায় দেড়শো তীর্থযাত্রী এসেছে। তাঁরা কিছুতেই অন্যত্র যেতে রাজি নয়...মানুষখেকোর বিপদের কথা বলবার পরেও নয়।' গাছের উপর থেকে বললাম, তীর্থযাত্রীদের যেন আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া হয়...সন্ধ্যা নামার আগেই যেন তাঁরা বাইরের সমস্ত কাজ সেরে নেন। কিছুক্ষণ পরে পণ্ডিত তাড়াহুড়ো করে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন যে আমার কথা মতো সমস্ত তীর্থযাত্রীকে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন।"

"একটু বাদেই সন্ধ্যা নামলো...গোটা উপত্যকা ডুবে গেলো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে...সেই সঙ্গে গভীর নিস্তব্ধতা। রাত ন'টার পর দেখলাম, যাত্রীশালার ভিতর থেকে একজন লোক লন্ঠন হাতে বাইরে এলো...সে রাস্তা পার হলো...মিনিট দুয়েক পরে আবার ফিরে গিয়ে যাত্রীশালার ছাউনির ভিতরে গিয়ে ঢুকলো। ঢোকার আগে লোকটা নিজের হাতের লন্ঠনটা নিভিয়ে দিলো।"

"লন্ঠনটা নিভিয়ে দেওয়া মাত্রই মালবাহকের কুকুরদুটো রাস্তার দিকে মুখ করে তারস্বরে চিতকার করতে শুরু করলো। বুঝলাম, কুকুরদুটো নরখাদকটার আভাস পেয়ে গেছে। কোনো ঝোপের আড়ালে বসে সে লন্ঠনহাতে লোকটাকে দেখতে পেয়েছে...এখন চুপিসারে নরমাংসের লোভে যাত্রীশালার দিকে এগোচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে আমি কেবলমাত্র কুকুরদুটোর চিৎকারের উপর মনঃসংযোগ করে বসে রইলাম। কুকুরদুটো আগে রাস্তার দিকে মুখ করে ডাকছিলো...কিছু পরে মনে হলো, আমার দিকে মুখ করে ডাকছে। অনুমান করলাম নরখাদকটা আমার গাছের তলায় বাঁধা ছাগলটার দিকেই আসছে।"

"কিছুক্ষণ পরে কুকুরদুটোর ডাক থেমে গেলো। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। গাছের নীচে বাঁধা ছাগলটার গলায় বাঁধা ঘণ্টার শব্দ তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিলো। সেই শব্দের দিকে রাইফেল তাক করে বসে রইলাম...ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল রাইফেলের সঙ্গে বাঁধা টর্চের বোতামের উপর...তর্জনী ট্রিগারের উপর...অপেক্ষা, ছাগলটার উপর নরখাদকের অতর্কিত আক্রমণের।"

"পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতার মধ্যে কেটে গেলো বেশ কয়েক মিনিট...যা আমার অস্বস্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলো। নরখাদকটা আসছে না কেন? তাহলে কি সে গাছের উপর আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে? নাকি ছাগলটাকে ছেড়ে যাত্রীশালার ছাউনির নীচে থাকা অরক্ষিত দেড়শজন তীর্থযাত্রীর মধ্যে একজনকে শিকার করবে বলে সে মনস্থির করেছে?"

"শেষ চিন্তাটা আমাকে খুবই ভাবিয়ে তুললো। পরপর দশটা রাত এই মাচানের উপর নরখাদকটার অপেক্ষা করে কাটিয়েছি। সুযোগ আসেনি। আজ একাদশ এবং শেষ রাত। আজ ব্যার্থ হলে গাড়োয়ালবাসীদের তাঁদের ভবিতব্যের উপর ছেড়ে দিয়ে আমাকে চলে যেতে হবে। নিজের ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, নরখাদকটাই এসেছে...কিন্তু সে কাকে আক্রমণ করবে...ছাগলটাকে নাকি তীর্থযাত্রীদের কাউকে?"

"ঠিক এইসময় মনে হলো গাছের নীচ দিয়ে কে যেন দৌড়ে গেলো...সঙ্গে সঙ্গে ছাগলটার গলার ঘণ্টা তীব্রভাবে বেজে উঠল। শব্দ লক্ষ্য করে টর্চের বোতাম টিপলাম...টর্চের আলোয় দেখলাম রাইফেলের মাছি চিতাবাঘটার কাঁধ বরাবর স্থির হয়ে আছে...রাইফেল এক ইঞ্চি না নাড়িয়ে ট্রিগার টিপে দিলাম...সঙ্গে সঙ্গে টর্চ নিভে গেলো! দ্বিতীয়বার টর্চের বোতাম টিপতে সেটা একবার ক্ষীণ হয়ে জ্বলে উঠে পাকাপাকিভাবে নিভে গেলো। আমার ছোঁড়া বুলেটের ফলাফল জানবার কোনো উপায় অবশিষ্ট রইলো না!"

"আমার রাইফেলের আওয়াজ দূরের পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেলো। পণ্ডিত দরজা খুলে চিতকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কোনো সাহায্য লাগবে কি না। কান খাঁড়া করে চিতাটার শব্দ শোনার চেষ্টা করছিলাম...পন্ডিতের কথার কোনো উত্তর দিলাম না। আমার দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে পণ্ডিত তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলেন। গুলির শব্দে তীর্থযাত্রীরা জেগে গিয়েছিলেন...কিছুক্ষণ ধরে চাপা গলায় কথা বলবার পরে তাঁরা পুনরায় চুপ করে গেলেন...আবার আগের মতো নিস্তব্ধতা।"

"গুলি চালিয়েছিলাম রাত দশটা নাগাদ। রাত দুটো নাগাদ চাঁদ উঠলে গাছের মগডালে উঠে চারপাশটা দেখবার চেষ্টা করলাম...কিন্তু কিছুই নজরে পড়লো না। ছাগলটার গলার ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো...বুঝলাম বেঁচে আছে...ঘাস খাচ্ছে।"

"ভোরের আলো ফুটতে নীচে নেমে দেখলাম, রাস্তার ধারের একটা পাথরে এক ইঞ্চি লম্বা রক্তের দাগ। উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলাম...যার শরীর থেকে এতো রক্ত পড়েছে তার আয়ু তো দুমিনিটের বেশী হওয়া উচিত নয়। লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম...রক্তের দাগ অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম। মাংসাশী প্রাণীর পিছু নেওয়ার সময় যে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত...মনে হলো তার আর প্রয়োজন নেই। প্রায় পঞ্চাশ গজ চলবার পরে দেখলাম একটা গর্তের মধ্যে চিতাবাঘটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে...চোখ দুটো আধবোজা...শেষ ঘুমে মগ্ন!"

"দিনের পর দিন রাতের পর রাত ব্যার্থ হতে হতে স্থানীয় লোকেদের মতো আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে নরখাদকটা আসলে কোনো চিতাবাঘ নয়...একটা অশুভ আত্মা...যার মাথাটা চিতাবাঘের...শরীরটা পিশাচের! বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, ওকে মারার আমার ব্যার্থ প্রচেষ্টা দেখে ও প্রতিরাতে পৈশাচিক উল্লাসে গড়াগড়ি দেয় আর কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে আমার গলায় দাঁত বসাবার আশায় ঠোঁট চাটে।"

"ওর একমাত্র অপরাধ ছিলো এই যে মানুষের রাজ্যে ও নিজের অনধিকার প্রবেশ ঘটিয়ে ছিলো...সেটা করেছিল নিজের প্রাণরক্ষার তাগিদে। আমার সামনে আজ ওর নিষ্প্রাণ শরীরটা পড়ে রয়েছে...ও কোনো পিশাচ নয়...একটা বিশাল পুরুষ চিতাবাঘ...রুদ্রপ্রয়াগের কুখ্যাত নরখাদক চিতাবাঘ...1918 থেকে 1926 সাল পর্যন্ত এই আট বছরে যার পেটে গিয়েছে 125 টা মানুষ! ওকে মারতে একাধিকবার নিজের প্রাণ সংশয় হয়েছে...ওর সঙ্গে আমার ব্যাক্তিগত দেনাপাওনার হিসেব মিটিয়ে দিয়েছে আমার রাইফেলের একটিমাত্র বুলেট।"
-----------------------------------------------------------------

উপরের লেখাটি আমার নয়...ভারতবিখ্যাত শিকারী জিম করবেটের লেখা "Man eating leopard of Rudraprayag" উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স অধ্যায় "A shot in the dark" এর কিছু অংশের বাংলা অনুবাদ।

জেমস এডওয়ার্ড করবেট বা জিম করবেট 1875 সালে ভারতের নৈনিতালে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে পিতৃহীন করবেট উনিশ বছর বয়সে উত্তর পশ্চিম রেলওয়ের ফুয়েল ইন্সপেক্টরের চাকরী নেন। এর কিছুদিন পরে তিনি মোকামাঘাটের রেলওয়ে কন্ট্রাক্টরের পদে বহাল হন এবং দীর্ঘ কুড়ি বছর সেই পদেই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজের কর্তব্য সম্পন্ন করেন।

ছোটবেলা থেকেই জঙ্গলের পশুপাখির প্রতি করবেটের ছিলো গভীর টান। দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন পশুপাখির ডাক এবং সেই ডাকের অর্থ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হন। পরে নিজের বড় দাদা টমাস করবেটের থেকে শেখেন বন্দুক চালানো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় করবেট ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে জঙ্গল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন এবং ওই সময়ে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন।

বন্দুক চালানোয় জিমের অবিশ্বাস্য প্রতিভা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিভিন্ন সময়ে উত্তর ভারতের বহুসংখ্যক নরখাদক বাঘ এবং চিতাবাঘকে হত্যা করবার জন্য অনুরোধ করে। প্রথাগত শিকারী না হওয়া সত্ত্বেও প্রতি ক্ষেত্রেই জিম সফল হন। তিনি নিজের জীবদ্দশায় আনেক নরখাদক বাঘ এবং নরখাদক চিতাবাঘকে হত্যা করে স্থানীয় অধিবাসীদের রক্ষা করেন...যার মধ্যে ছিলো চম্পাবতের নরখাদক বাঘিনী (নরহত্যার সংখ্যা 436...যা হয়তো সর্বকালীন রেকর্ড), পানারের নরখাদক চিতা (নরহত্যার সংখ্যা 400), রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতা (নরহত্যার সংখ্যা 125), চৌগড়ের নরখাদক বাঘ (নরহত্যার সংখ্যা 64)। করবেট সারা জীবনে যতো নরখাদককে হত্যা করেছেন, তাঁরা একত্রে প্রায় 1200 মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল!

অসমসাহসী পুরুষ ছিলেন জিম করবেট। প্রথাগত উপায়ে নরখাদককে কব্জা করতে না পারলে, দুঃসাহসিক কোনো পথ অবলম্বন করতে তিনি দ্বিধাবোধ করতেন না। চম্পাবতের নরখাদক বাঘিনীকে তিনি মেরেছিলেন পিছনে ধাওয়া করে; কান ফাটানো গর্জনের সঙ্গে আক্রমণ করতে উদ্যত পানারের নরখাদক চিতার সামনে দাঁড়িয়ে গুলি করেছিলেন তিনি (করবেটের সঙ্গের লোকেরা চিতার আক্রমণাত্মক ভঙ্গি দেখে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো); চৌগড়ের নরখাদক বাঘকে গুলি করেছিলেন এক হাতে রাইফেল ধরে (করবেটের মতে, "বাঘটা বসে ছিলো আমার পিছনে একটা পাথরের উপরে...আমি দুই হাতে রাইফেল ধরতে গেলে যে সময় খরচ হতো, তার মধ্যেই ও আমার ঘাড়ে এসে পড়তো...খুব কম নড়াচড়া করে গুলি করার প্রয়োজন ছিলো...তাই একটাই হাত ব্যবহার করতে পেরেছিলাম।")

কিন্তু...করবেটের মতে উপরোক্ত সমস্ত নরখাদকের চাইতে বেশী বিপজ্জনক, বেশী ধূর্ত, ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা প্রচারিত এবং কুখ্যাত নরখাদক ছিলো রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতা। কেন?

প্রথমত, চিতাটার বিচরণভূমি ছিলো বদ্রীনাথ থেকে কেদারনাথ অবধি, যেখানে বছরব্যাপী তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা লেগে থাকতো। এই কয়েকশো বর্গমাইল এলাকায় দীর্ঘ আট বছর ধরে চিতাটা এমনই সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল যে আটটি দেশের সংবাদপত্রে তাকে নিয়ে নিয়মিত লেখা হতো। কি ধরণের সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরী করেছিল সে?

করবেটের নিজের ভাষায়, "সূর্যোদয় থেকে যতক্ষণ দিনের আলো থাকতো, ওই এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত থাকতো। হাটবাজার বসতো, যান চলাচল করতো, লোকজন পাশের গ্রামে বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে যেতো। মেয়েরা গরুর জন্য বা ঘরের চাল ছাইবার ঘাস কাটতে পাহাড়ে যেতো। বাচ্চারা যে যার স্কুলে যেতো নয়তো শুকনো কাঠ কুড়াতে বা ছাগল চড়াতে জঙ্গলে যেতো। কেদারনাথ ও বদ্রিনাথ দেবপীঠের তীর্থযাত্রীরা একা বা দল বেঁধে তীর্থপথে যাতায়াত করতো।"

"কিন্তু এই দৃশ্যপট সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যেত। মানুষের গতিবিধি ও ব্যবহারে ধরা পড়তো স্পষ্ট ত্রস্ততা। যারা বাজারে ধীরে সুস্থে কেনাবেচা করছে তারা দ্রুত ঘরে ফিরে আসতো। মেয়েরা মস্ত ঘাসের বোঝা মাথায় করে পড়িমরি করে পাহাড়ের খাঁড়াই ঢাল বেয়ে নেমে আসতো। যেসব বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরতে বা ছাগলের পাল নিয়ে ফিরতে দেরী করছে তাদের মায়েরা প্রবল উৎকণ্ঠায় ছটফট করতে থাকতো। তীর্থপথে শ্রান্ত ক্লান্ত তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে দেখা হলে স্থানীয় বাসিন্দারা সত্বর তাঁদের কাছাকাছি কোনো যাত্রীশালায় চলে যেতে বলতো। রাতের অন্ধকার নামার সঙ্গে গোটা এলাকা জুড়ে বিরাজ করতো এক পৈশাচিক নিস্তব্ধতা।"

"সমস্ত ঘরবাড়ীর দরজা জানালা বন্ধ হয়ে যেত। কোথাও কোনো শব্দ, কোনো নড়াচড়া শোনা বা দেখা যেতো না। গৃহস্থ বাড়ির ভিতরে যেসব তীর্থযাত্রীর ঠাঁই পাওয়ার সৌভাগ্য হতো না, তারা যাত্রীশালায় গায়ে গা মিশিয়ে পড়ে থাকতো। সেই ভয়ংকর নরখাদকের ভয়ে সকলেই তটস্থ হয়ে থাকতো, যেন কোনো শব্দ তার কানে না পৌঁছায়। সন্ধ্যার পর থেকে সমগ্র গাড়োয়ালের প্রাণস্পন্দন চিতাটার ভয়ে এইভাবে স্তব্ধ হয়ে থাকতো। 1918 থেকে 1926 সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর গাড়োয়ালের অধিবাসী এবং তীর্থযাত্রীদের কাছে এই ছিলো সন্ত্রাস শব্দের সংজ্ঞা!"

কিন্তু এতো সাবধানতা অবলম্বন করেও রেহাই মিলত কি? চিতাটা ছিলো স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এক অশুভ আত্মা...যে বন্ধ দরজার শেকল খুলে পঞ্চাশটি ছাগলকে ডিঙিয়ে পাহারাদার রাখালকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো...কেউ কোনো শব্দ পায়নি। দুই বন্ধু যখন তামাক খাচ্ছে...একজন বন্ধু টেরও পায়নি কখন চিতাটা এসে দুহাত দূরে বসে থাকা অপর বন্ধুকে মেরে মুখে করে তুলে নিয়ে গেলো...মুখ তুলে চাঁদের আলোয় সে খালি দেখেছিল চিতাটা তার বন্ধুকে মুখে করে ধরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে!

পরপর ষোলোজন পেশাদার শিকারী ব্যার্থ হওয়ার পরে চিতাটাকে মারার দায়িত্ব করবেটকে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। দুই খেপে চিতাটার পিছনে পড়েছিলেন করবেট। প্রথমবার একমাস...দ্বিতীয়বার একবছর। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে প্রথাগতভাবে গুলি মারতে ব্যার্থ হয়ে অন্যান্য উপায়ের শরণাপন্নও হতে হয়েছিলো করবেটকে। তিনি মড়ির ভিতরে আর্সেনিক, স্ট্রিকনিন এবং সায়ানাইডের মতো বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। চিতাটা ওই বিষ দেওয়া অংশ খেয়েওছিলো...কিন্তু মরেনি...বরং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল! চিতাটাকে মারতে মড়ির সঙ্গে বন্দুকের ট্রিগারকে সুতো দিয়ে বেঁধে "বুবি ট্র্যাপ" বানিয়েছিলেন করবেট। চিতাটা সুতো আলগা করবার জন্য মড়ি তুলে ট্রিগারের দিকে এনে খেয়েছিলো! চিতাটাকে ধরতে লোহার জাঁতি ব্যবহার করেছিলেন করবেট। ধরা পড়বার পরেও চিতাটা জাঁতি ছাড়িয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো!

নিজের জীবন বিপন্ন করেও চিতাটাকে মারার চেষ্টা করেছিলেন করবেট। গাছের নীচে ছাগলের টোপ বেঁধে মারতে ব্যার্থ হয়ে চিতাটার যাতায়াতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। রাত্রিবেলায় তুমুল ঝড়বৃষ্টির ফলে তাঁর বন্দুক ভিজে গিয়ে অকেজো হয়ে যায়। অকেজো বন্দুককে কাঁধে ফেলে ডান হাতে একটা আফ্রিদি ছোরা ধরে অন্ধকার এবং ঝড়বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে পৌঁছান নিরাপদ আশ্রয়ে। তাঁর নিজের ভাষায়,"এতো ভয় সারা জীবনে আর পাইনি!" পরদিন জলকাদার মধ্যে নিজের পায়ের ছাপের পাশে দেখেছিলেন চিতাবাঘটার পায়ের ছাপ...সেই রাতে চিতাটা তাঁকে অনুসরণ করেছিল!

আরেকবার করবেট এবং তাঁর বন্ধু ইবটসন একটা ছাগলকে নিয়ে পাহাড়ের উপরে ওঠেন টোপ হিসাবে বাঁধবেন বলে। কিন্তু উপযুক্ত কোনো গাছ না পেয়ে নেমে আসতে বাধ্য হন। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার সময় ছাগলটা তাঁদের হাত ফসকে পালিয়ে যায়। কিছুদূর নেমে দেখেন...রাস্তার উপরে ছাগলটা পড়ে রয়েছে...শরীরটা তখনও কাঁপছে...গলায় চারটে দাঁতের দাগ...নরখাদকটার কাজ! করবেট লিখেছেন, "চিতাটা ছাগলটাকে মেরে আমার রাস্তার উপর ফেলে যেন আমাকে একটা বার্তা দিয়ে গেলো…'ছাগলটাকে চাইছিলে? এই নাও...দিয়ে গেলাম। তবে সন্ধ্যা হয়ে গেছে...তোমাদের বাড়িও অনেক দূর। দেখা যাক তোমাদের দুজনের মধ্যে কে জীবিত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছতে পারে!' আমার কাছে একটা দেশলাই বাক্স ছিলো। কয়েক পা হাঁটছি আর একটা করে কাঠি জ্বেলে চারদিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখছি। অবশেষে একটা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে তার দরজায় পিঠ লাগিয়ে বসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম!"

দিনের পর দিন ব্যার্থ হতে হতে আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকে করবেটের। এইসময় একদিন তিনি এবং ইবটসন চিতাটার চালচলন পর্যালোচনা করতে গিয়ে বুঝতে পারেন যে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কিছু দূরে অবস্থিত গোলাবরাই গ্রামের বাইরের একটা রাস্তা চিতাবাঘটা পাঁচদিন অন্তর পার হয়। করবেট ঠিক করেন ওই রাস্তার উপর একটা গাছে ছাগলের টোপ বেঁধে পরপর দশরাত তিনি বসবেন। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। দশদিন চিতাটার কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না...করবেটের গাছের উপর বসাই সার হলো। একাদশতম দিনের দিন সকালবেলা করবেট ঠিক করেন সেই রাত্রিটাও তিনি গাছের উপরেই কাটাবেন। যদি চিতাটা না আসে তাহলে পরদিন তিনি ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি লিখে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেবেন। কিসমত...ওই একাদশতম রাতেই চিতাটা করবেটের গাছের নীচে এলো….তার পরের কথা এই লেখার শুরুতেই আমি লিপিবদ্ধ করেছি।

বড় শিকারী ছিলেন জিম করবেট...তার চাইতেও ছিলেন বড় মানুষ। তিনি বলতেন, "আমি জন্মসূত্রে ব্রিটিশ কিন্তু মানসিকতায় খাঁটি ভারতীয়"। তিনি সর্বদা ভারতীয় জনগণকে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতেন...তাঁর প্রতিটি লেখায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কেবলমাত্র নরখাদক বাঘ মেরেই তিনি নিজের কর্তব্য সম্পন্ন করেননি...তাঁর অধীনে কাজ করা সমস্ত কুলি মজুর এবং কেরাণীদের যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। লালাজী নামক এক অজ্ঞাতকূলশীল মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হলে করবেট নিজে তাঁর সেবা শুশ্রুষা করে তাঁকে সারিয়ে তোলেন। সুস্থ হওয়ার পরে লালাজীকে করবেট তাঁর নিজের সঞ্চয় থেকে তখনকার দিনে পাঁচশ টাকা দেন নতুন করে ব্যাবসা শুরু করবার জন্য। লালাজী ওই টাকায় ব্যাবসা শুরু করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরে করবেটকে টাকা ফেরত দিয়ে যান। বুদ্ধু নামক একজন কুলিকে তার তিন পুরুষের দেনার হাত থেকে মুক্ত করেন করবেট...নিজে টাকা শোধ করে। কালাধূঙ্গির বাসিন্দা কুয়ার সিং ছিলেন করবেটের প্রাণের বন্ধু...যার কথা আমরা দশম শ্রেণীর পাঠ্য বইতে পড়েছি।

উত্তর ভারতের গরীব গ্রাম্য মানুষও করবেটকে নিজেদের একজন বলেই মনে করতো। এক নরখাদক বাঘের পিছু নিতে নিতে এক গ্রামে ঢুকে করবেট একটি পরিবারের থেকে কিছু খাবার চান। পেট ভরে খাওয়ার পরে করবেট যখন বাসন ধুতে যাচ্ছেন, তখন ওই পরিবারের একটি মেয়ে বাসনগুলো তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ধুতে শুরু করে। করবেট তাকে বলেন, "আমি খ্রিস্টান...আমার এঁটো ছুঁলে তোমার জাত চলে যাবে"।  উত্তরে মেয়েটি বলে, "আপনাকে আমরা সবাই চিনি...আপনি তো আমাদের রক্ষক...আপনাকে সবাই বলে 'গোরা সাধু'...'সন্ন্যাসী'...মা বলেছে, আপনার এঁটো ছুঁলে আমাদের জাত যাবে না, বরং আমরা জাতে আরও উঠবো"।

"গোরা সাধু", "গরীবের রক্ষক", "প্রকৃতি বিশারদ", "নরখাদক শিকারী" এবং "প্রকৃত ভারতীয়" জিম করবেটই হলেন সেই ব্যাক্তি যার নামে তৈরী হয়েছে "করবেট ন্যাশনাল পার্ক"। শোনা যায়, 1947 সালে যখন ভারত স্বাধীন হয় তখন করবেট ভারতের নাগরিকত্ব চেয়েছিলেন...কিন্তু ভারত সরকার তা দিতে রাজি হয়নি। এরপরেই অকৃতদার করবেট তাঁর বোন ম্যাগিকে নিয়ে ভারত ছেড়ে চলে যান। অদ্ভুত...ব্রিটিশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ইংল্যান্ডে ফেরেননি...বসবাস শুরু করেন কেনিয়ার নিয়েরিতে এবং সেখানেই 1955 সালে তাঁর প্রয়াণ ঘটে! আজন্মকাল যিনি রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের মধ্যে কাটিয়েছিলেন...তাঁর শেষ জীবন কাটে আফ্রিকার সিংহদের মধ্যে! সেখানেই তিনি তাঁর ভারতীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন "Jungle lore", "My India" "Man eating leopard of Rudraprayag", "Man eaters of Kumayun" এর মতো অমর রচনা...যা আজও পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়।
ছবি-আন্তর্জাল

1926 সালের 2nd মে রাত দশটার সময় যে গাছের উপর থেকে তিনি রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতাকে গুলি করেছিলেন, সেই গাছ আজও আছে। যে মাচানের উপর বসে সেইদিন তিনি গুলি করেছিলেন, সেই মাচানও ভারত সরকার সংরক্ষণ করেছে। রাস্তার পাশে যে জায়গায় চিতাবাঘটার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে তৈরী করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ, যার গায়ে লেখা আছে…"On this very spot was killed the Man eating leopard of Rudraprayag by Jim Corbett"।

জিম করবেটের রাইফেলের একটি বুলেট ভারতের সর্বাধিক কুখ্যাত নরখাদককে অমরত্ব দিয়ে গেছে।

ছবি-আন্তর্জাল
















লেখক - ইন্দ্রনীল আইচ

3 comments:

  1. অসাধারণ অনুবাদ। আর সাবলীল লেখন ভঙ্গি । মনে হয়েছে জিম করবেট বাবু বাংলাতেই লিখেছেন। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম আরো এমন লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। লেখক কে অনেক অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।।।

    ReplyDelete
  2. বেশ ভালো লাগল।

    জিম করবেটের শিকার-কাহিনীর সাথে কমবেশী সকলেই পরিচিত। তাঁর লেখার অনুবাদের সাথে সাথে ওঁর সম্পর্কে তথ্যগুলি সুন্দরভাবে পরিবেশনার জন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  3. Anyobady lekha. Asadharon anubaad. Choker samney je ghatonata dekhte pelam. Romanche ga seure uthchilo.

    ReplyDelete