১
খান
সাহেবের চিঠিটা পেয়েছি প্রায় দিন সাতেক আগে I
এমনিতে
আমায় বিশেষ চিঠিপত্র কেউ লেখে নাI বিশেষ
কেন….কেউই লেখে না I এখন ই মেলের যুগে হাতে
চিঠি লিখে সময় নষ্ট করার বান্দা নয় কেউই I সবাই
ভীষণ রকম ব্যস্ত I সময় অসময়ে আমি নিজেও তাই
করি I কিন্তু, হাতে লেখা চিঠি পেলে মনটা কেন জানিনা একটা অদ্ভুত খুশিতে ভরে ওঠে I যেন মনে হয় দূরে থাকা সেই প্রিয় মানুষটির স্পর্শ মিশে আছে
ওই কাগজের গায়ে I
খান সাহেব আমার বিশেষ পরিচিত I এর আগে বহুবার ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে দুজনে একসাথে গেছিI বড় সরল মনের মানুষI বিদ্বানও
বটেI ফিজিওলজি তে তাঁর অবদান গোটা বিশ্বে
অনস্বীকার্যI একসময় হাভার্ডে প্রফেসর
ছিলেনI পড়িয়েছিলেন বছর পাঁচেকI তারপর হঠাৎ একদিন বিদেশের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে এলেন I মুম্বাইতে নিজের বাড়িতেই ছোটো একটা ল্যাব বানিয়ে রিসার্চ শুরু করলেন I নিন্দুকেরা বলে পণ্ডিত ব্যক্তিরা নাকি এরকম পাগল গোছের হয় I আমি অবশ্য এতে দোষের কিছু পাইনিI নিজের দেশ কে ভালোবাসা যদি পাগলামি হয় তাহলে আমি হাজারবার পাগল হতে রাজীI আর হাভার্ডের মোটা মাইনে নিয়ে করতেনই বা কি? খেতে তো হত সেই ডাল...ভাত...আলুপোস্ত I খুব বেশি হলে মুরগীর ঝোলI পাঁঠা টাঁঠা তো
কোলস্টেরলের জন্য কবে থেকেই বন্ধ I মানুষ যে কেন এতো টাকার
পেছনে ছোটে কে জানে! বড়লোকে কি সোনা খায়!
খানসাহেব বিশেষ ইমেল টিমেল এর ভক্ত নন I হাতে চিঠি লেখাটাই পছন্দ করেনI ইন ফ্যাক্ট, উনিই একমাত্র মানুষ যিনি
আমাকে চিঠি লেখেনI তাই চিঠিটা পেয়ে বুঝতেই
পেরেছিলাম সেটা কে পাঠিয়েছেI চিঠির তলায় গোটা গোটা
অক্ষরে নাসির খান নামটা লেখার কোনো দরকারই ছিল নাi
চিঠিটা খুব একটা বড় নয়I কিছু একটা যন্ত্র উনি বানিয়েছেন যেটা নাকি কিছু ফিজিওলজিক্যাল ডিসঅর্ডার কে
এক্কেবারে সারিয়ে দিতে পারবেI কিন্তু যন্ত্রটায়
সামান্য কিছু একটা ত্রুটি রয়ে গেছে I সেটা যে ঠিক কি...সেটা
অনেক ভেবেও খান সাহেব বের করতে পারছেন নাI তাই
যন্ত্রটা একবার দেখতে আর তাতে ফাইনাল টাচ দিতে আমাকে ডাকাI অন্য কেউ হলে অবশ্য একাই কৃতিত্ব নিত, কাউকে
ডাকতো নাI ফল্টি মেশিনেরই পেটেন্ট নিতI কিন্তু খান সাহেব কে যতটুকু চিনি….একেবারে মাটির মানুষI রিসার্চের সাফল্যেই ওনার শান্তি I খ্যাতি বা টাকার পেছনে ছোটার মানুষ খান সাহেব নন I
চিঠিটা পাওয়া থেকে অদ্ভুত একটা উৎকন্ঠায় আছি I কি যন্ত্র...কি ভাবে কাজ করে...কোন কোন ফিজিওলজিক্যাল
ডিসঅর্ডারে কাজ করে...কিছুই জানিনা I পরের দিনই যাবার ইচ্ছে
ছিলI কিন্তু আমার ডি - ল্যাকটেট যন্ত্রটার কাজ
একটু বাকি ছিল বলে সময় পাইনি I এটা খুবই দরকারি যন্ত্র
হয়ে উঠবে অদূর ভবিষ্যতেI শুধু একটা স্টিকারের মতো
জিনিস I ওপরের কোটিং টা জেল টাইপের I পায়ের কাফ্ মাসলে লাগিয়ে নিতে হবে I মানুষ কিছুটা দৌঁড়ানোর পর পায়ের মাসল গুলোতে...বিশেষত কাফ্ মাসলে অবাত শ্বসন (
অ্যানেরোবিক রেসপিরেশন) হওয়ার জন্য ল্যাকটিক অ্যাসিড জমে যায়...তাই মানুষ ফ্যাটিগ
অনুভব করে I এই ডি ল্যাকটেট কাফ্
মাসল থেকে ল্যাকটিক অ্যাসিড শোষণ করে নেবে I শুধু
তাই নয়, বাতাসের অক্সিজেন শোষণ করে তাকে মাসলের
রক্তনালী তে পাঠাবে I যতোই দৌঁড়াও ফ্যাটিগ হবে
নাI
কাল রাতেই শেষ করেছি কাজ টাI আজ খুব টায়ার্ড I রেস্ট
নেবI কাল দুপুরের ফ্লাইটে মুম্বাই যাবোI টিকিট
করে রেখেছি I কাল সকালে ওয়েব চেকিং টা
সেরে ফেলবোI
২
ফ্লাইটে
বসে ডায়েরি লিখছিI আমি
এখন মাঝ আকাশে I কলকাতা ছেড়েছি
ঘন্টাখানেক হল I আর দেড় ঘন্টা পরেই
মুম্বাই পৌঁছে যাবোI সাথে আমার ডি ল্যাকটেট ও
নিয়েছি I নিজের ওপর টেস্টিং ও হয়ে যাবে...খান সাহেবের
মূল্যবান মতামতও পাবোI
জামা কাপড় খুব বেশি একটা নিই নি সাথেI দরকারই বা কি! আমি এক পোশাকে তিন চার দিন কাটিয়ে দিতে পারি I তাছাড়া ঘুরতে তো যাচ্ছিনা যে সকাল বিকেল পোশাক চেঞ্জ করে
ফটো তুলবো I সময়টা তো ল্যাবেই কেটে
যাবেI টুকিটাকি জিনিসের ব্যাগটা অবশ্য সঙ্গেই আছে I আমারই তৈরি কয়েকটা জিনিসI স্টুপিডাইজ গানটা সঙ্গেই আছে I ইচ্ছে করে এনেছি তাই নয়I ব্যাগটার ভেতরে ছিল, বের
করতে ভুলে গেছি I এটা ঠিক গান নয়...কোনো
ক্ষতি করে না...অনেকটা মাউথ অর্গানের মতো দেখতেI এতে ফুঁ দিলে সাউন্ড এনার্জী ইলেকট্রিক এনার্জীতে কনভার্ট হয় আর চারশো মিটার
দূরত্বের মধ্যে সরলরেখার থাকা মানুষের হার্টের নরমাল ইলেকট্রিক্যাল রিদম কে
ডিসরাপ্ট করে I ফলে মানুষটির সাময়িক হার্ট
ব্লক হয়...মিনিট পাঁচেকের জন্য মানুষটার কোনো ঞ্জান থাকে নাI পাঁচ মিনিট পরে অবশ্য সে আবার নরমাল হয়ে যায়I মানুষের মস্তিষ্ক আট মিনিট পর্যন্ত ইস্কিমিয়া সহ্য করতে পারে, তাই পার্মানেন্ট ক্ষতি
হবার কোনো আশংকা নেই. নিজের সেফটির জন্যই বানিয়েছি I উটকো লোকের থেকে দূরে থাকা যায় I গান টা প্রফেসর শঙ্কুর
অ্যানাইহিলিন গান থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে বানানো...যদিও অতোটা শক্তিশালী নয় মোটেইI তবু দরকারে কাজ চলে যায়I আর মানুষ মারার প্রয়োজন তো আমার নেইI শুধু
বিপদ আপদে শত্রুকে পাঁচ মিনিটের জন্য বোকা বানাতে পারলেই হল I স্টুপিডাইজ নামটাও আমারই দেওয়াI
এ ছাড়াও কিছু নার্ভফ্রেশ ট্যাবলেটও সঙ্গে
নিয়েছিI এটা যেকোনো অবস্থায় মানুষের নার্ভ গুলোকে
শান্ত করেI মানুষের শরীরে দুরকম
নার্ভ থাকেI সিম্প্যাথেটিক নার্ভ
উত্তেজনা সৃষ্টি করে, আর প্যারা সিম্প্যাথেটিক
উত্তেজনা প্রশমন করে মানুষকে শান্ত করেI আমার
এই নার্ভফ্রেশ কোনো স্পেসিফিক অবস্থায় এই দুটি নার্ভের অ্যাক্টিভিটি পয়েন্ট আউট করে দুটি নার্ভকেই ফাইন টিউনিং করেI তাই মানুষ এক গভীর শান্তি অনুভব করেI এটা ইচ্ছে করেই নিয়েছি I বেশি উত্তেজনা রিসার্চের
জন্য ভালো নয়I
প্লেন আর আধঘন্টার মধ্যেই ল্যান্ড করবেI প্রফেসর খানের বাড়ির এ্যাড্রেস আমি জানি I এয়ারপোর্ট থেকে খুব একটা দূর নয় I ট্যাক্সিতে আধঘন্টার বেশি লাগার কথা না I অবশ্য মুম্বাই এর ট্র্যাফিক তো! জানিনা কি হবেI যাক গেI আমারও বিশেষ তাড়া নেইI
৩
খান
সাহেবের বাড়িতে পৌঁছেছি ঘন্টা খানেক হলI বেশ
কষ্ট করেই পৌঁছেছিI আধঘন্টার রাস্তা এসেছি
প্রায় পৌনে দু ঘন্টায়I একে তো মুম্বাইয়ের
ট্র্যাফিক, তার ওপর কোনো এক
ফিল্মস্টার রাস্তায় বেড়িয়েছে….তাকে দেখার ভীড় I কি আদিখ্যেতা রে বাবা! আর লোক গুলোরও কোনো কাজ নেই I ফিল্মস্টার বলে কি দুটোর জায়গায় চার টে হাত! নাকি মাথায় শিং টিং আছে!
এখানে এসে আরেকটা ব্যাড নিউজI প্রফেসর খান একটা আর্জেন্ট মিটিং এ তিন চার দিনের জন্য
লাহোর গেছেনI সার্কের সব দেশ থেকেই
রিসার্চ স্কলার রা যাচ্ছেনI আজই ভোরের ফ্লাইটে
বেড়িয়ে গেছেনI কালই মেল টা এসেছিল..তাই
আমাকে আর জানাতে পারেন নিI
সার্ক সম্মেলনের ব্যাপারটা সত্যিI আমাকেও ইনভাইট করেছিলI আমি যেতে পারবো না বলে দিয়েছি. তাই হয়তো শেষ মুহূর্তে খান সাহেব কে রিকোয়েস্ট
করেছে I এই বয়সে এসে সম্মেলনের দৌঁড়ঝাঁপ আর পোষায় নাI খান সাহেব মাটির মানুষ I ওনার কথা আলাদা I চট করে কাউকে না বলতে
পারেন নাI
এখানে আপাতত খান সাহেবের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট
রিসার্চ দেখাশোনা করছেI ছোকরা টাইপের একজন i নাম নিরঞ্জন গুপ্ত i বয়েস
আন্দাজ করাটা একটু ডিফিকাল্টI পঁয়ত্রিশ থেকে
পঁয়তাল্লিশ...যা কিছু হতে পারেI কিন্তু আমার বা প্রফেসর
খানের থেকে অনেকটাই কমI খান সাহেব নাকি তাকে
ইনস্ট্রাকশন দিয়ে গেছেন আমায় যেন ওনার নতুন রিসার্চের কাজ টা নিয়ে সবরকম সহয়োগিতা
করেI সে ছোকরা রিসার্চের ফাইল গুলো আমায় দিয়ে গেছেI আমি যখন বলবো সে ল্যাবের দরজা খুলে দেবেI এক কাপ ব্ল্যাক কফিও দিয়ে গেছেI সাথে আলুর চিপস্ I ছোকরার দেখছি আতিথেয়তা
ঞ্জান প্রবল!
রিসার্চের পেপার গুলো দেখে যতোটা না অবাক
হয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছি I খান
সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা টা অনেকটা বেড়ে গেলI এভাবে
এর আগে কেউ ভেবেছে বলে শুনিনি, আর যদি কেউ ভেবেও
থাকে...ব্যাপারটাকে এভাবে বাস্তব রূপ দেবার চেষ্টা গোটা বিশ্বে এই বোধহয় প্রথম I চিকিৎসা বিঞ্জানে এ এক মহা মৃত্যুঞ্জয় ওষুধ হিসাবে কাজ করবে
এতে কোনো সন্দেহই নেই I আর প্রফেসর খান কে
যতটুকু চিনি ….উনি এর পেটেন্ট না নিয়ে মানুষের সেবায় এই আবিষ্কার উৎসর্গ করবেনI
ব্যাপারটা পুরোপুরি ব্লাড রিলেটেডI আমাদের শরীরে যতোরকমের রক্ত কণিকা আছে সেগুলোর প্রত্যেকটার
রূট একই I মানে একই কোষ থেকে বিভিন্ন রকম রক্ত কোষ তৈরী
হয়I যাকে বিঞ্জানের ভাষায় স্টেম সেল বলেI উনি চেষ্টা করছেন কোনো একজন মানুষের যেকোনো একটা কোষ নিয়ে
আগে সেটাকে স্টেম সেল এ পরিবর্তন করতেI তারপর
সেই স্টেম সেল কে পরিবর্তন করে, কোষ বিভাজনের মাধ্যমে
ইচ্ছা মত যে কোনো রক্ত কোষ তৈরী করতেI এই
যে ডেঙ্গু তে প্লেটলেট কমে যাচ্ছে, ব্লাড ব্যাঙ্কে প্লেটলেট
পাওয়া টা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এক্ষেত্রে রোগীর যেকোনো
একটা কোষ পেলেই সেটা থেকে লাখ লাখ প্লেটলেট তৈরী করা যাবে ল্যাবে I সেগুলো ট্রান্সফিউজ করে দিলেই হলI ব্লাড ডোনেশনের আর দরকারই পড়বে নাI এরকম
ব্লাড রিলেটেড অনেক রোগেতেই এই আবিষ্কার ম্যাজিকের মতো কাজ করবেI ব্যাপারটা অনেকটা ...আমার কাছে একটা কাঠের চেয়ার আছে I কিন্তু আমার চেয়ারের দরকার নেইI আমার দরকার একটা কাঠের টেবিলI তো আমি সেই কাঠের চেয়ার
ভেঙ্গে সেই কাঠ দিয়ে আগে যে গাছ কেটে চেয়ারটা তৈরী হয়েছিল সেই গাছটা পুনর্নিমাণ
করলাম; মানে আগের অবস্হায় ফিরে গেলাম, তারপর সেই গাছ কেটে আবার টেবিল তৈরি করলামI একটু অদ্ভুত লাগছেI আমার
কাছেওI তাই ইন্টারেস্ট টা ক্রমশ বেড়েই চলেছেI এভাবে ভাবাটা একমাত্র প্রফেসর খানের পক্ষেই সম্ভবI
খান সাহেব দেখছি গোটা ব্যাপারটাই শেষ থেকে
শুরু করেছেন I অন্তত রিসার্চ পেপারে তো
সেরকমই দেখছিI স্টেম সেল থেকে শুরু করে
প্লেটলেট এ যান নিI শুরুই করেছেন প্লেটলেট
থেকে I তারপর আগের কোষ ...তার আগের কোষ ...এইভাবে
স্টেপ সবাই স্টেপ পিছিয়ে স্টেম সেলে গিয়ে পৌঁছেছেনI যাক গেI এতে আমার বোঝার কোনো
অসুবিধে হবে নাI
কফিটা শেষ করে ফেলেছি I চিপস্ টা শেষ করে ভাবছি একবার ল্যাব টা দেখে আসি I রিসার্চ পেপারটা পড়ে বেশ একটা কৌতুহল অনুভব করছিI সাথে মানুষের উপকার করার একটা তাগিদওI প্রফেসর
খান সাধারণত রিসার্চ শেষ না হলে পেপার লেখেন নাI এক্ষেত্রে উনি থাকবেন না বলেই হয়তো আমার জন্য লিখে রেখে গেছেনI হাতের লেখা দেখে খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন বলেই তো মনে হয়I ওই ছোকরা গুপ্ত কে বোধহয় ঠিক ভরসা করতে পারেন নিI
৪
গত দু দিন ডায়েরি লেখার
সময় পাই নিI শুধু যে ল্যাব আর
রিসার্চ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই নয়, এই দু দিনে অনেক কিছুই
ঘটে গেছে I মনের যা অবস্থা তাতে
কতটা গুছিয়ে লিখতে পারবো জানি নাI তবু যতটা সম্ভব ঘটনা
গুলো পরপর লেখার চেষ্টা করছিI ঘটনা না বলে দুর্ঘটনা
বলাই বোধহয় উচিত I কিছু একটা গন্ডগোল যে
আছেই সেটা আগেই একটু একটু আন্দাজ করেছিলাম, কিন্তু
মানুষের লোভ যে এই পর্যায়ে যেতে পারে তার কোনো ধারণাই ছিল না আমারI
দেখ কাণ্ড! গুছিয়ে পরপর লিখবো বলেও আবার
এলোমেলো করে ফেলছি I
দুদিন আগে যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকেই শুরু করিI
চিপস্ টা শেষ করে নিরঞ্জন কে ডাকলামI রিসার্চ পেপার টা পড়া ইস্তক ব্যাপারটা ল্যাবে হাতে কলমে
দেখার একটা প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিলI
গুপ্ত ছোকরা টা বোধহয় আশেপাশেই ছিলI একবার ডাকতেই বেড়িয়ে এলোI দেখলাম ল্যাব দেখার আমার যা উৎসাহ , ও
ছোঁড়ার উৎসাহ তার চেয়ে কম নয়...বোধহয় একটু বেশি ই I
যাই হোক, ঘর থেকে বেড়িয়ে কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ নেমে মেজেনাইন ফ্লোরে ল্যাব টাI দরজায় কোন লক ছিল নাI ঠেলতেই
খুলে গেলI নিরঞ্জন আমার পিছনেই ছিলI দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে সে এগিয়ে এসে লাইট গুলো জ্বেলে দিল I মেজেনাইন ফ্লোর তো...দিনের আলো একেবারেই ঢোকে না I
সামনে একটা বড় টেবিলের ওপর একটা বড় উল্টানো
কলসি টাইপের যন্ত্রI পুরোটাই আয়নার মতো চকচকে
I কিন্তু কাঁচের মতো স্বচ্ছ নয় I ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে নাI বোধহয় যন্ত্রের ভেতর টা আলো নিরোধক করার জন্যইI এই আয়নার মতো আবরণে আলো পড়লে তার পুরোটাই রিফ্লেক্ট হয়ে বেড়িয়ে যাবেI অত্যন্ত সহজ ফিজিক্সI কিন্তু
মেটিরিয়ালটা দেখে কাঁচ বলে মনে হল নাI বরং
কোনো ধাতু বলেই মনে হলI
যন্ত্রটার মাঝামাঝি কয়েকটা বাটনI টাচস্ক্রীন I সিম্বল দেওয়া আছেI আর মাথার দিক থেকে একটা লম্বা অ্যান্টেনার মতো জিনিস বেরিয়ে
আছেI
নিরঞ্জন আমায় ডেমনস্ট্রেট করছিলI একটা পিন নিয়ে নিজের আঙ্গুলে ফুটিয়ে এক ড্রপ রক্ত বের করলো I তারপর যন্ত্রটার গায়ের ওই বাটন গুলোর একটা টাচ্ করতেই নিচের
দিতে একটা ট্রে মতো বেরিয়ে এলোI ট্রের ওপরটা কাঁচেরI অনেকটা স্কুলে জীবনবিঞ্জান পড়ানোর সময় যে কাঁচের স্লাইড
ব্যবহার করা হয়...সেই রকম I দশ সেকেন্ড পরে ট্রে টা
অটোমেটিক্যালি যন্ত্রের ভেতরে ফিরে যেতেই সামনের দেওয়ালে সিনেমা স্ক্রীনের মতো ছবি
ফুটে উঠলোI সেই রক্তের কোষগুলোর ছবি
I মানে ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, যন্ত্রটার সাথে একটা মাইক্রোস্কোপ ফিট করা আছে.
এ পর্যন্ত দেখে খুব একটা অবাক হইনিI চমক শুরু হল এর পর থেকেI একটা সবুজ লেসার টাইপের জিনিস হাতে নিয়ে নিরঞ্জন দেওয়ালের ছবিটার দিকে ফেলে
বললো এই লেসার তাক করে দেওয়ালে দেখতে পাওয়া যে কোনো একটা কোষের ওপর ফেললেই বাকি সব
কোষের ছবি মুছে গিয়ে শুধু সেই কোষ টাই ১০০ গুণ বড় করে দেখাবে I মানে যে কোষের ওপর রিসার্চ করে সেটাকে স্টেম সেল এ কনভার্ট
করা হবে আর কি! রিসার্চের ভাষায় মাদার সেলI
ইচ্ছে করেই একটা নিউট্রোফিলের ওপর ফেললাম
লেসারের আলোI ( যদিও জানি ওটা ঠিক লেসার
নয়). ওতে নিউক্লিয়াসের সাত থেকে ন টা খন্ড থাকে. দেখতে ...বুঝতে...আর কাজ করতে
...সবেতেই সুবিধাI
নিরঞ্জনের কথামতো নিউট্রোফিলটার ওপর আলোটা
পড়তেই বাকি সব কোষের ছবি মুছে গিয়ে এই কোষটার ছবিই এনলার্জ হতে শুরু করলোI যখন থামলো ...তখন নিউট্রোফিল টার মধ্যেকার সমস্ত অরগ্যানেল
পরিস্কার বোঝা যাচ্ছেI
নিরঞ্জন কে জিগ্যেস করলাম প্রবলেম টা ঠিক
কোথায়!
নিরঞ্জন ভাঙ্গা ভাঙ্গা যেটুকু বললো….বিশেষ
একটা কোষকে টার্গেট করে সেটাকে স্টেম সেল অব্দি নিয়ে যাওয়া যাচ্ছেI কিন্তু তারপর সেটা থেকে বিভাজনের মাধ্যমে স্পেসিফিক কোনো
কোষে কনভার্ট করা যাচ্ছে নাI বরং স্টেম সেল টা
অ্যামাইনো অ্যাসিডে ভেঙ্গে যাচ্ছেI
নিরঞ্জন বোধকরি এ বাড়ির কেয়ারটেকারওI আমাকে পুরো বিষয় টা এক্সপ্লেন করে সে চলে গেলI সত্যি বলতে কি আমিও এখন একটু একটা থাকতেই চাইছিলাম I রিসার্চের সময় একাগ্রতা দরকারI সেটা পাশে কেউ থাকলে হয় নাI কেউ বলতে অবশ্যই খান
সাহেবের মতো মানুষ নয় I উনি থাকলে আমি খুশীই
হতামI
যন্ত্রটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যে
দুঘন্টা কেটে গেল বুঝতেই পারি নিI হঠাৎ হাতঘড়িটার দিকে চোখ
পরতেই খুব কফির তেষ্টা পেলI আমি বাড়িতে ল্যাবে থাকলে
একটা বড় ফ্লাক্সে ব্ল্যাক কফি নিয়ে রাখিI ঘন্টায়
ঘন্টায় কফি না খেলে আমার ঠিক পোষায় নাI
যাই হোক, কফি খাবো বলে ল্যাব থেকে বেড়িয়ে ওপরে ঘরে যেতে গিয়ে দেখি দরজা বাইরে থেকে বন্ধI অনেক টানাটানিতেও খুললো নাI বোধহয় বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখা হয়েছেI এরকম
তো হবার কথা নয়I নিরঞ্জন ছোকরা টাকে কতটা
বিশ্বাস করা যায়! আমি বোধহয় একটু বেশীই করে ফেলেছিI কিন্তু প্রফেসর খান কে আমি অনেক বছর ধরে চিনিI আমার নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করিI তাহলে
খান সাহেবও কি আমার মতো…..
একটা বড় ভুল করেছি মোবাইল টা ঘরে রেখে এসেছিI অবশ্য আনলেই বা কি হত ! নিরঞ্জন যদি জেনেশুনেই আমাকে বন্দী বানিয়ে রাখতে চায় তাহলে ওকে ফোন করলেই কি ও
এসে “ বুকে আসুন দাদা “ বলে দরজা খুলে আমাকে মুক্ত করে দিত! মোদ্দা কথা হচ্ছে আমি
এখানে বন্দীI
নার্ভফ্রেশ খাওয়ার দরকার এখনই অনুভব করছি নাI মাথা আমার বিপদে আপদে বেশ ঠান্ডাই থাকেI আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছিI শুধু একটা ব্যাপারে নিজেকে গাধা বলে মনে হচ্ছেI লাহোরে প্রফেসর ওহিদুল্লা কে একবার ফোন করে খান সাহেবের কথাটা জিঞ্জেস করলে
হতোI যাক গে! যা হয়নি সেটা নিয়ে ভেবে লাভ নেইI
খান সাহেবের পুরো ল্যাব টা ঘুরে দেখতে শুরু
করলামI যদ্দুর মনে হচ্ছে আপাতত
ঘন্টা কয়েকের মধ্যে মুক্তির আশা নেইI রাত হলে নিশ্চয়ই খাবার
আর জল দিতে আসবেI আমাকে মেরে ফেলা নিশ্চয়ই
ও ছোকরার উদ্দ্যেশ্য নয়I তাহলে আর এতো খাতির করে
কফি আর চিপস্ খাওয়াতো না, আগেই মেরে দিতI আর আমার মতো একজন ষাটোর্ধ বৈঞ্জানিক কে মেরে করবেই বা কি!
উল্টাদিকের টেবিলে দেখছি পুরোনো দিনের রেডিওর মতো একটা যন্ত্র বসানো আছেI গায়ে রেডিওর মতো দুটো নবও আছেI এখন তো সবই রিমোট কন্ট্রোল্ড….এরকম হাতে ঘোরানো নব আজকাল আর দেখাই যায় নাI
কৌতুহল বশত একটা নব ক্লক ওয়াইজ ঘুড়িয়ে দিলামI একটা চাপা হুইসেল এর মতো শব্দ আসছে কি! তীখ্ণ অথচ চাপাI একটু কাছে যেতেই মাথাটা কেমন জানি ঘুরে গেলI অথচ নব টা আর উল্টোদিকে ঘোরানোও যাচ্ছে নাI যেন কেউ আঠা দিয়ে চেপে আটকে দিয়েছে নব টাI রিফ্লেক্সে হাতটা অন্য নব টার দিকে চলে গেলI যদি এটা ঘুরিয়ে ওই বীভৎস শব্দটা বন্ধ করা যায়! কিন্তু, নব টা ঘোরাতে গিয়েও হাতটা আপনা থেকেই থেমে গেলI আচ্ছা, খান সাহেব রিসার্চ
পেপারটা উল্টোভাবে লিখেছেন কেন! শেষ থেকে শুরু! এটা আমার প্রতি কোনো ইঙ্গিত নয় তো!
চিঠিটা কি উনি নিজের ইচ্ছায় লিখেছিলেন নাকি গুপ্ত ছোকরা জোর করে ওনাকে দিয়ে লিখিয়ে
নিয়েছে! রিসার্চ পেপারটাও কি তাই! তাই কি উনি ব্যাকওয়ার্ড লিখে আমায় ক্লু দিতে
চেয়েছেন!
অন্য নব টা একটু ভেবে নিয়ে অ্যান্টিক্লক
ওয়াইজ ঘুরিয়ে দিলামI যা থাকে কপালে. ওই
বজ্জাত গুপ্তর হাতে মরার চেয়ে এই ল্যাবে এক্সপেরুমেন্ট করতে গিয়ে মরা অনেক শান্তিরI নবটা বামদিকে খাানিকটা ঘোরাতেই দেখলাম আগের সেই শীষের মতো
শব্দ টা অনেকটা কমে এলI যাক বাবা, আপাতত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলামI কিন্তু, এ কী! টেবিলে আঙ্গুল
ঠোকার মতো শব্দ পাচ্ছি না? কিছুক্ষণ চুপ করে শুনলামI তারপর এক চমকে মন টা খুশিতে ভরে উঠলোI এ তো বেমক্কা আঙ্গুল ঠোকা নয়….এ যে মর্স কোড! কে যেন একই শব্দ বারবার বলে
যাচ্ছেI “ বাসু...বাসু...বাসু…” এই বদ্ধ ল্যাবে কে আমার
নাম ধরে ডাকছে! নিজের অজান্তেই হাতটা টেবিলের ওপর নেমে এলI মর্সকোডেই টেবিলের ওপর আঙ্গুল চালিয়ে বললাম “ ইয়েস…”.
খানিকক্ষণ সব চুপচাপI তারপর আাবার রেডিওয় ঠকঠক শব্দI একটু শুনেই বুঝলাম এবার
আর একটা শব্দ নয়, দু তিনটে বাক্যI মনে মনে ক্যালকুলেট করে দু তিনটে বাক্য বোঝার মতো কেউকেটা
আমি নইI কোনোকালেই ছিলাম নাI পকেট হাতড়ে একটা কাগজ পেলামI একদিকে আমার ডি
ল্যাকটেটের ডায়াগ্রাম আঁকাI উল্টোদিকটা সাদাI টেবিলের একপ্রান্তে পড়ে থাকা একটা পেন্সিলের টুকরো দিয়ে
লিখতে শুরু করলামI “ বাসু...ডেঞ্জার...সেভ
মি...ইনসাইড দ্য ওয়াল…” ফের আঙ্গুল ঠুকে জানতে চাইলাম….” হাউ টু সেভ ইউ? আর ইউ খান? “ উত্তর পেলাম ওই উল্টোনো
কলসির মতো যন্ত্রটার মাথায় যে অ্যান্টেনার মতো জিনিস টা বেড়িয়ে আছে, সেটা ভেতরে ঢোকাতে হবেI জানতে চাইলাম…” হাউ?” কিন্তু এবারে আর কোনো
শব্দ পেলাম নাI এতক্ষণ কাগজ আর
পেন্সিলেই মগ্ন ছিলামI রেডিওর মতো যন্ত্রটার
দিকে চোখ যায়নি একেবারেইI এবার যন্ত্রটার দিকে
তাকিয়ে দেখি ধোঁয়া বের হচ্ছেI নব দুটো বোধহয় বেশি
ঘুরিয়ে ফেলেছিI যাক গে. তাড়াতাড়ি ওই
টেবিলটা ছেড়ে আগের কলসির মতো যন্ত্রটার কাছে ফিরে এলামI যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবেI ওই গুপ্ত শয়তানটা ফেরবার
আগেইI
এলাম তো. কিন্তু করবো টা কী! এই অদ্ভুত
যন্ত্রের কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে নাI নিশ্চয়ই কোনো স্যুইচ আছেI অ্যান্টেনা টা হাতের চাপে ঢোকে না নিশ্চয়ইI বরং চাপ দিতে গিয়ে ভেঙ্গে গেলে সর্বনাশI বিহাইন্ড দ্য ওয়াল কে আছে জানিনাI কিন্তু আমার মন বলছে খান সাহেবই হবেI নাহলে
মর্সকোড জানা সব মানুষের কম্ম নয়I
এবার একটা নার্ভফ্রেশ খেতেই হবেI বেশ একটু উত্তেজনা অনুভব করছি I হাতে পালস্ রেট দেখলাম একশ কুড়িI মানে বেশ অনেকটাই বেশিI এতো উত্তেজনায় ব্রেন ঠিক কাজ করবে নাI আচ্ছা, আগে ওই সবুজ লেসার লাইট
টা দিয়ে যন্ত্রটার গায়ের সবকটা বাটন দেখে নিইI যদি এমন কিছু থাকে যেটা আমি আগে দেখতে পাইনি! টর্চ থাকলে আরো ভালো হতো, কিন্তু টর্চ তো সেই ব্যাগটায়I ঘরে রেখে এসেছিI নেহাত নার্ভফ্রেশ টা
রিসার্চের সময় লাগতে পারে মনে করে গোটা দশেক ট্যাবলেট একটা ছোটো শিশিতে ভরে পকেটে
রেখেছিলামI এখন যখন লেসার টা
আছে...তাই সইI ওটা দিয়েই যন্ত্রটার গা
টা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে একটা নার্ভফ্রেশ খাবোI উল্টোপাল্টা বাটনে টাচ করলে কি যে বিপর্যয় হবে কে জানে!
খুব একটা বেশি বাটন নেই যন্ত্রটার গায়েI নীচের দিকেই যা চার পাঁচটা আছেI ওপরের দিকে দুটো মাত্রI তাও কোনো সিম্বল আঁকা
নেইI এসব বাটনে সাধারণত ইন্টারন্যাশানালি
অ্যাক্সেপ্টেড সিম্বল থাকেI তাতে বাটনের কাজ বুঝতে
কোনো অসুবিধা হয় নাI আরে! যন্ত্রটার মাথাতেও দেখছি একটা বাটনI টাচ বাটন এটাওI কিছু
একটা লেখা আছেI হরফ বলে তো মনে হচ্ছে নাI কোনো সঙ্কেত কি! লেসার টা দিয়ে ভালো করে দেখতে হবেI
খান সাহেব বিঞ্জানী হলেও ধার্মিক মানুষI কোনো নতুন এক্সপেরিমেন্ট শুরু করার আগে আল্লার নাম নিয়ে
শুরু করেনI ওনার মতে এতে নাকি একাগ্রতা
বাড়েI শুধু আল্লা কেন, যে কোনো জিনিসেরই একমনে চিন্তা করলে একাগ্রতা বাড়েI
আমি আবার চরম নাস্তিকI খান সাহেবের ল্যাব যখন….আল্লা বলেই শুরু করিI একাগ্রতা কতোটা আসবে জানিনা, কিন্তু প্রণম্য খান
সাহেবের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো তো হবেI
আল্লার নাম নিয়ে লেসার টা ওই বাটনের ওপর
ফেলতেই এক কেলেংকারী হলI
লেসারের সবুজ আলোটা নিভে গিয়ে একটা টিমটিমে
কমলা রঙের আলো ফুটে উঠলোI কি জানি কি সর্বনাশটা
করলাম! এই টিমটিমে আলোয় তো ভালো করে বাটন্ টা দেখতেই পাবো নাI যাক গেI কি আর করা যাবেI যেটুকু আলো আছে লেসারটায় সেটা দিয়েই চেষ্টা করি
দেখার….যতোটা দেখা যায়I
লেসারের
ওই হ্যারিকেনের মতো আলো বাটন্ টার ওপর ফেলতেই যন্ত্রের সারফেস টা আবছা সবুজ হয়ে
গেলI আর তাতে লেখা ফুটে উঠলোI বাইনারী সিস্টেমে লেখাI শুধু ১ আর ০. নিজের
থেকেই ডিকোড হচ্ছে I আমি শুধু দেখে যাচ্ছি I আর কিই বা করতে পারি! ভালো করলাম না আরো বড় সর্বনাশ ডেকে
আনলাম কে জানে! বেশ খানিক্ষণ ডিকোড হবার পর দেখলাম লেখাটা থেমেছেI স্ক্রীনে শুধু দুটো নাম্বারI লেফ্ট সাইডে ১...রাইট সাইডে ০ ; বাইনারি তে ১ মানে হ্যাঁ
আর ০ মানে নাI তাহলে কি এটা ওই অ্যান্টেনা
টা ঢোকাবার কোড! ১ এ লেসার ফেললেই কি ঢুকে যাবে! ১ এর ওপর লেসারের আলো ফেলতে গিয়েও
থমকে দাঁড়ালামI খান সাহেবের শেষ থেকে
শুরু করা রিসার্চ পেপারের মধ্যে থাকা ইঙ্গিতের পরিচয় একটু আগেই পেয়েছিI কিন্তু তাই বলে সব ক্ষেত্রেই কি তাই হবে! একটু ইতস্তত করে ০ টার ওপরই লেসার ফেললামI যা থাকে কপালেI স্ক্রীনের
ওপর কুড়ি থেকে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছেI আমার
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামI নার্ভফ্রেশ খাওয়ার আগেই
এতোকিছু ঘটে গেলI পকেট থেকে নার্ভফ্রেচের
শিশিটা বের করলামI ১০...৯..৮...৭….
একটা ট্যাবলেট মুখে পুরে দিলামI এটার সুবিধা হচ্ছে খেতে গেলে জল লাগেনাI লজেন্সের মতো চুষে খেতে হয়I সাবলিঙ্গুয়াল অ্যাবসর্পসন হয়I মানে জিভের নীচের দিকে
থাকা রক্তবাহকের মধ্যে মিশে যায় ওষুধ টাI
৫...৪...৩…
এক একটা মুহূর্ত যেন এক এক ঘন্টা মনে হচ্ছেI যা হবার হোকI আর পারছি নাI
স্ক্রীনে ০ হতেই একটা শব্দ হলI দেখলাম অ্যান্টেনা টার গোড়ার দিকে যন্ত্রটার গায়ে একটা অংশ
স্লাইডিং ডোরের মতো খুলে গেল, আর অ্যান্টেনা টা ফোল্ড
হতে হতে যন্ত্রটার ভেতরে ঢুকে গেলI
হে আল্লাহ্…. হে ইশ্বর…. শেষ পর্যন্ত পারলাম
তাহলে! যে দেওয়াল টায় মাইক্রোস্কোপের ছবি ফুটছিল, সেই দেওয়াল টা একদিক থেকে স্লাইডেং ডোরের মতো খুলতে শুরু করেছে ততক্ষণেI আর তার ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসছে এক লম্বা চওড়া মানুষI কে ইনি? একটু কাছে আসতেই চিনতে
পারলামI প্রফেসর নাসির খানI
৫
খান
সাহেব কে দেখে আমি কিছুটা এগিয়ে গেছিলামI মুখে
চওড়া লিউকোপ্লাস্ট সাঁটানোI চেহারা টা একেবারে
ভেঙ্গে পড়েছেI
মুখের লিউকোপ্লাস্ট টা খুলে দিতেই খান সাহেব
আমায় কিছু বলতে না দিয়ে প্রথমেই বুকে টেনে নিলেনI আবেগে গলা বুঁজে এলো আমারওI বেশ কিছুক্ষণ কথা বেরোলো
না দুজনের কারোরইI তারপর দুজনেই একটু শান্ত
হতে ল্যাবের এক কোনায় গিয়ে বসলামI খান সাহেব বললেন, “আমি জানতাম বাসু. এই ষড়যন্ত্র থেকে যদি আমায় কেউ আমায়
উদ্ধার করতে পারে সে একমাত্র তুমিI উল্টো করে লেখা রিসার্চ
পেপার থেকে বাইনারী সিস্টেম উল্টোপথে ভাবার সাহস হয়তো অনেকেরই আছে; কিন্তু মুশকিল হলো তুমি ছাড়া আমি যে সেরকম আর কাউকেই চিনি
না!”
মনে মনে বললাম, এই অবস্হায় যে এরকম রসিয়ে রসিয়ে কথা বললাম যায়….সেরকমও তো আপনি ছাড়া আর কাউকে
চিনি নাI মুখে আর কিছু বললাম নাI শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম খান সাহেবের দিকেI
খান সাহেব বুঝতে পারলেন সেই দৃষ্টির মানেI যেন মর্নিং ওয়াক করে ফেরার পথে চা খেতে খেতে গল্প করছি এরকম
ঠান্ডা গলায় বললেন
“অনেক কিছুই জানতে চাইছো
বাসু. এখন ছোটো করে যতটা পারি বলছিI বেশি দেরি হলে আবার ওই
গুপ্ত এসে হাজির হবে” I আমি
নির্বাক শ্রোতা হয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ...আর খান সাহেব বলে যেতে লাগলেন….
খান সাহেবের সাথে নিরঞ্জন গুপ্তর আলাপ প্রায়
বছর খানেক আগেI ফিজিক্সে মাস্টার্স
করেছেI পি.এইচ.ডি করার আগে কিছুদিন প্রফেসর খানের
তত্বাবধানে কাজ করতে চায়I প্রথম দিকে কয়েক মাস
ভালোই কাজ করছিলI তারপর মাসচারেক আগে যখন
খানসাহেব এই যন্ত্রটা বানাতে শুরু করলেন তখন থেকেই নিরঞ্জনের নজর খারাপ হতে শুরু
করেI যন্ত্রটা ব্লাড সেল তৈরি করার জন্য
কমার্শিয়ালি ব্যবহার করার জন্য খান সাহেব কে বিভিন্ন ভাবে চাপ দিতে শুরু করেI প্রথমে টাকার লোভ, তারপর
তাতে কাজ না হলে ভয় দেখানোI এই বিহাইন্ড ওয়াল গুপ্ত
ঘরটার কথা খান সাহেব ই নিরঞ্জন কে প্রথম দিকে একবার বলেছিলেন বিশ্বাস করেI শয়তান টা সেটাই ব্যবহার করে খান সাহেবকে বন্দী রাখার জন্যI
বললাম, “ আর আপনি ব্লাড সেল তৈরীর প্রসেসটা বলতে চাননি বলেই আপনার নামে জাল চিঠি পাঠিয়ে
আমাকে ডেকে এনেছে. এবার বুঝেছি”I
“ না হে বাসুI কিচ্ছু বোঝোনি “...প্রফেসর খান বললেন…” ওই চিঠিটা আমার ই
লেখাI জাল নয়I হ্যাঁ, কপালে
রিভলবার ঠেকিয়েছিল সত্যি কথা…..কিন্তু চিঠিটা আমি খুশি মনেই লিখেছিলামI হাতের লেখা আমার না হলে তুমি বুঝতে পারতে না!”
যুক্তিটা ঠিকইI খান সাহেবের হাতের লেখা আমি বিলক্ষণ চিনিI বললাম “ কিন্তু আমি যদি আপনার ওই যন্ত্রটা থেকে ব্লাড সেল তৈরির কায়দা টা বের
করে ফেলতে পারতাম! ওই গুপ্ত ছোঁড়া তো আমাকেও বন্দী বানিয়ে নিজের পেটেন্ট নিয়ে
ব্যবসা করতো!”
“ বন্দী! সেটা হলে তো
মেরেই ফেলতোI দুজনকেইI তবে ….তুমি কাজটা একবছর চেষ্টা করলেও পারতে না”I
একটু কপট রাগ দেখিয়ে বললাম “ আমার ওপর ভরসা
নেই বুঝি!”
“আরে নাI তুমি ভুল বুঝলে বাসুI ও
কাজটা তুমি কেন, আমি চেষ্টা করলেও পারতাম
নাI কারণ যন্ত্রটা ও জন্য বানানোই হয়নিI ব্লাড সেল গুলো শরীরে কি কি স্টেপ পার হয়ে কিভাবে তৈরি হয়
সেটা জানাই এই যন্ত্র তৈরীর উদ্দ্যেশ্যI নিরঞ্জন
কে এ কথা বারবার বলেওছিলাম I কিন্তু লোভের বশবর্তী
হয়ে সেই আমায় চাপ দিতে শুরু করে এ যন্ত্র দিয়ে কমার্শিয়ালি ব্লাড সেল তৈরী করার
জন্য”I
অবাক হয়ে বললাম “ আর আপনার রিসার্চ পেপার! “
“ সেটা একটা গেমI আমি প্রথম দিকে নিরঞ্জন কে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে এই
যন্ত্র দিয়ে ব্লাড সেল তৈরী করা যায় নাI সে
সেটা বিশ্বাস তো করেইনি, উল্টে আমার মুখ খোলানোর
জন্য আমার ওপর অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশ বাড়াচ্ছিলI সারাক্ষণ টর্চার করলে ঠান্ডা মাথায় মুক্তির কথা ভাববো কখন! তাই ওই রিসার্চ
পেপারটা লিখিI এতে একদিকে যেমন নিরঞ্জন
ভাবলো যে ওর অত্যাচারে আমি সবকিছু লিখে দিয়েছি...এবার তুমি এসে বাকিটা করে
ফেলবে….তাই আমাকে রেহাই দিলো….অন্যদিকে তুমিও ‘শেষ থেকে শুরু ‘র ক্লু টা পেয়ে
গেলে”I
“ আর ওই রেডিওর মতো
যন্ত্রটা!”
“ ওটা একটা সাউন্ড
অ্যাম্প্লিফায়ারI যে শব্দ নর্মালি শোনা
যায় না, সেই শব্দ অ্যাম্প্লিফাই করে শোনা যায়I আমি দেওয়ালের ওপাশ থেকে মর্সকোডে কথা বলছিলাম….তুমি
অ্যাম্প্লিফাই করে শুনেছো”I
“ যদি নবটা ক্লক ওয়াইজ
ঘুরিয়ে দিতাম!”
“ দিতে নাI আমি জানি. তোমার বুদ্ধির ওপর এটুকু ভরসা আছেI তাই তো তোমাকেই চিঠি পাঠিয়ে কলকাতা থেকে ডেকে এনেছি “ I ….একটু থেমে খান সাহেব বললেন …” ঠিকঠাক টিউনিং হয়নি বলে অবশ্য
ভেতরে আই.সি টা পুড়ে গেছেI যাই হোক , পরে সারিয়ে নিলেই হবে”I
“ লেসারটা বোধহয় ভয়েস
অ্যাক্টিভেটেড”
“ এক্স্যাক্টলিI ‘ আল্লা ‘ ওটার ভয়েস পাসকোড”; খান সাহেব একগাল হেসে বললেন “ ইন ফ্যাক্ট এই ল্যাবের নাইনটি পার্সেন্ট
মেসিনারীই ভয়েস অ্যাক্টিভেটেডI নেহাত ওই বজ্জাত গুপ্ত
ঘুমের মধ্যে আগেই লিউকোপ্লাস্ট ঠেসে আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল তাইI নাহলে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হতো সেই নেক্স্ট ওয়ার্ল্ড
কংগ্রেসেIএ যন্ত্রটা ওখানেই প্রথম ডেমনস্ট্রেট করবো
ভেবেছিলামIভয়েস অ্যাক্টিভেটেড
যন্ত্রের সমস্যা জানো তো! তুমি বোবা হলে…. তো সন্ন্যাসী বনে গেলেI কোনো যন্ত্রই আর কাজ করবে নাI হিমালয়ের গুহায় বসে সারাদিন শুধু ইয়েতি দেখ গে”I
এতোক্ষণ পরে দুজনেই প্রাণ খুলে হাসলামI
হঠাৎ দরজায় একটা শব্দ হলI তালা খোলার শব্দI আমরা
উঠে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে পরার আগেই নিরঞ্জন ঘরে ঢুকলোI হাতে চকচকে কালো রিভলবারI ভুরু দুটো নাচিয়ে বললো “
এতো তাড়াতাড়ি দুই বন্ধুর দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনিI মহামান্য বাসু সাহেব যদি এই গরীবের আতিথেয়তা থেকে মুক্তি চান….তাই ভয় দেখাতে
বন্দুকটা নিয়ে আসাI এখন দেখছি এটা অন্য কাজে
লাগবে…”
ঠান্ডা গলায় বললাম “ নিরঞ্জন, ভুল করছোI হাতের বন্দুকটা সরিয়ে রাখোI আমরা দুজনেই মরে গেলে
তোমার এই ব্যবসার স্বপ্ন কোনদিনই পূর্ণ হবে না”I
নিরঞ্জন প্রথম কয়েক মিনিটের জন্যে একটু
থমকালোI হঠাৎ অনুভব করলাম ঘাড়ের কাছে একটা তীব্র
ব্যথাI খান সাহেব কি একটা ইঞ্জেকশন টাইপের দিলেনI কী এটা! বন্দুকের গুলির অ্যান্টিডোট বানানো সম্ভব বলে তো
আমার বুদ্ধিতে মনে হয় নাI
নিরঞ্জনের হাতে আবার রিভলবার উঠে এসেছেI খান সাহেবের ইঞ্জেকশন দেওয়াটা ও দেখেছেI ঠোঁটের কোনে চাপা একটা হাসি ফুটিয়ে বললো “ মরতেই যদি
হয়...তো শুধু বিষ ইঞ্জেকশনে কেন! আমার একটা গুলিও সাথে থাকI আমার তরফ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ! ওপরে যমরাজ্যেই পাঠাই আজ দুজনকে”I
খান সাহেব কখন যে হাতে সবুজ লেসার টা
নিয়েছিলেন টের পাইনিI নিরঞ্জনের কথা শেষ হতেই
খান সাহেব “ তবে আল্লাই নেমে আসুক ওপর থেকে “ বলে হাতের লেসার লাইট টা তাক করলেন
ওপর দিকেI সাথে সাথে কলসির মতো যন্ত্রটার গা থেকে অজস্র
কাঁচের নলের মতো ছোটো ছোটো পাইপ বেড়িয়ে তা থেকে ধোঁয়ার মতো বের হতে শুরু করলোI গন্ধ নেই কোনোI কিন্তু
মাথা সোজা রাখতে পারছি নাI চোখে অন্ধকার দেখছিI মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে দেখার চেষ্টা করলাম ওপরে সিলিং এ
রাখা সেন্সরটা যেটাকে লেসারের কমলা রঙের টিমটিমে আলো অ্যাক্টিভেট করে আমাদের
দুজনকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেI কিন্তু
পারলাম নাI টাল সামলাতে না পেরে পড়ে
গেলাম মাটিতেI
৬
মুম্বাই
এসেছি আজ ঠিক সাতদিনI আজ ফিরে যাচ্ছি কলকাতায়I বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ফ্লাইটI বেড়িয়েছি অনেকটা আগেইI এখন দু টো পনেরোI জ্যামে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছেI সেই সুযোগে ডায়েরি লিখছিI
সেদিন হাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে
গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু জ্ঞান ছিলI প্রফেসর খানের অ্যান্টিডোট ইঞ্জেকশনের প্রভাবে মিনিট দশেক
পর থেকেই ঘোর ভাবটা কাটতে শুরু করেI খান সাহেব নিজেও অ্যান্টিডোট
ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেনI বেচারা নিরঞ্জন
অ্যান্টিডোট পায়নি...তাই বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রভাবে গভীর ঘুমে ছিলI সে ঘুম বেচারার ভেঙ্গেছে টানা পনের ঘন্টা পরI হাসপাতালের বেড এI ল্যাব
থেকে বেড়িয়েই খান সাহেব পুলিশে ফোন করে দিয়েছিলেনI এখানকার এস.পি খান সাহেবের বিশেষ পরিচিতI হাসপাতালে দু দিন থাকার পরে সে মহারাজ এখন পুলিশ লক আপ এI
খান সাহেবের সাথে পাঁচদিন চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে
আজ কলকাতায় ফিরছিI খান সাহেব আমার ডি
ল্যাকটেট যন্ত্রটার ভূয়সী প্রশংসা করেছেনI নেক্স্ট
ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে ওটার প্রেজেন্টেশন করবোI নার্ভফ্রেশ
টা আরেকটু স্ট্রং করা দরকারI অতি উত্তেজনায় খুব ভালো
কাজ করছে না দেখলামI মধ্যে একদিন ডায়েরিতে
সেদিনের ঘটনাটাও লিখে রেখেছিI অবশ্য সেই ঘটনার ( নাকি দুর্ঘটনার!) দু দিন পরে অবশ্যI
গাড়ির জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি লোকাল একটা
ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প চলছেI মন টা একটা অদ্ভুত ভালো
লাগায় ভরে গেল.I মানুষ ইচ্ছা করলে হয়তো
সত্যিই একদিন এমন যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারবে যা দিয়ে সমস্ত ব্লাড সেল কমার্শিয়ালি
তৈরী করা যাবে, কিন্তু ব্লাড ডোনেশনে
মানুষের সাথে মানুষের মনের যে মিলন টা গাঁথা হয়, মানুষের দুর্দিনে মানুষের সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে মানবতার যে
জয়গান অনুরণিত হয়….সেই মানবতা বোধই মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনI কোনো নির্জীব যন্ত্রের সীমিত ক্ষমতায় মানব মনের অতল গহ্বরের
সেই অন্তহীন মূল্যবোধ কে কখনো ছোঁয়া যায়নি….কখনও যাবেও নাI
No comments:
Post a Comment