![]() |
ছবি-আন্তর্জাল |
শনি বার বিকেল। কলকাতা স্কুল অফ
ট্রপিক্যাল মেডিসিন এ দু সপ্তাহের একটা ট্রেনিং ছিল। শনি বার শেষ দিন।
দীপন অর্থাৎ
ডাঃ দীপন দে, কলকাতা
মেডিকাল কলেজের রিজিওনাল পিডিয়াট্রিক এ, আর, টি সেন্টারের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, ট্রেনিং শেষে, ভাবল একবার শবনমের সঙ্গে দেখা করে যায়।
ইচ্ছে থাকলেও তো যখন তখন আসা হয় না। শবনম ব্যস্ত থাকে, দীপণও তাই। আজ কোন কাজ নেই
যখন দেখা করে যাওয়াই ভাল। শবনম ওখানেই কোয়াটারে থাকে। তিন তলার বারান্দায় পায়চারি
করতে করতে ভাবছে কার কাছে
শবনমের খোঁজ নেয়। হঠাৎই ওখানকার ডিরেক্টর বিমল বাবুর সাথে দেখা হয়ে গেল। বিমল
বাবুই জিজ্ঞেস করলেন,
-- "কাকে খুজছেন?"
-- শবনম আমার
সহপাঠী ছিল, এমনিতে তো
আসা হয় না, ট্রেনিং শেষ
হয়ে গেল যখন একবার দেখা করে যাই।
-- তাহলে আসুন
আমার ঘরে, একটু বসুন, আমি ডেকে পাঠাচ্ছি, বোধ হয় কোয়াটারেই আছে, দিদি কিন্তু খুব ভাল মানুষ।
-- হ্যাঁ, ভীষণই ভাল।
-- আপনিও তাহলে
আমাদের ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে থেকেই এম,বি,বি,এস পাস করেছেন, আমি আপনাদের থেকে এক বছর
জুনিয়র। তা ট্রেনিং কেমন লাগল?
-- ভাল, বেশ ভাল।
-- আপনি বরং
বসুন, ওকে খবর
পাঠিয়েছি, এক্ষুনি এসে
পড়বে। আমি উঠি, আমার কিছু
কাজ আছে, করে বাড়ী
ফিরব।
-- আচ্ছা।
শবনম দীপনেরই সহপাঠী ছিল। খুব ভাল মেয়ে, জাতিতে মুসলমান, গোঁড়া নয়। শবনম অনেকের সাথেই ভালভাবেই
মিশত। কলেজ জীবনের
অনেক আড্ডাতেই ও সঙ্গী হয়েছে। দীপনদের শিশুবিভাগেই ও হাউস স্টাফ ছিল, তখন তো রোজই দেখা হত। নানা বিষয়ে আলোচনাও হত।
দরকারে সাহায্যও করত। সকলের কাছে ও তখন রীতিমত এক ভাল মেয়ে। ও একদিন বলল ," আজ বাড়ী যাব, সন্ধেবেলা
আসব না। দীপন বলল-
-- আরে ঠিক আছে, তোর ইউনিটের রুগীদের আমরা দেখব, কোন চিন্তা নেই। দরকার হলে কল বুকও দেখে
রুগী দেখে যাব। অতএব শান্তিতে
বাড়ী যা, কোন চিন্তা
করিস না। কিন্তু ব্যাপারটা কি বল তো? বাড়ীতে তোকে নিয়ে স্পেশাল কিছু?
-- আরে না না।
তুই সবেতেই স্পেশাল গন্ধ পাস। আজ ঈদ না? মাংস খাবি তো বল, তাহলে কাল মাংস নিয়ে আসব।
-- এই খবরটা
এতক্ষনে দিচ্ছিস! যা যা যা যা এক্ষুনি চলে যা। ঈদ মুবারক। কি করে ভাবলি বল তো, তুই আমাদের মাংস
খাওয়াবি, আর আমরা তা না খেয়ে শুধু শুধু তোর মনে
কষ্ট দেব! আমরা এতখানি নির্দয় নই রে। জানিস, আমার বার বছর বনবাস হয়ে গেল; সেই তের বছর বয়সে বাড়ী থেকে বেরিয়েছি-
তারপর এই হোস্টেল, সেই হোস্টেল করতে করতে আজ ঠাই হয়েছে হাউস স্টাফ কোয়াটারে। জগতে সবই
পরিবর্তনশীল, শুধু একটি
জিনিষ ছাড়া, কি বলতো? অসিত বলল--
-- হস্টেলের
রান্না, সব হস্টেলের
সব সময়ের সব রান্নার স্বাদ এক।
-- একদম ঠিক
বলেছিস। তোর বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়।
শবনমকে বলল, " দেখ শবু, মাংস একটু বেশী করেই আনবি ভাই, আশিস কে দেখিয়ে বলল-জানিস ই তো
এই কেষ্টর
জীব একটু বেশী ই খায়।"
শুনেই আশিস গেল ক্ষেপে। ও একটু মোটা, খায়ও একটু বেশী। বলল," হ্যাঁ রে ব্যাটা, আমি বেশী খাই, আর তোরা খাস না, শুধু টেস্ট করিস। ঠিক আছে, কাল তাই হবে, আমি খাব আর তোরা শুধু টেস্ট করবি। সবাইতো
ঘাবড়েই গেল- এ কে কিছুই
বিশ্বাস নেই, খাওয়ার
ব্যাপারে ওর ক্ষমতা অসাধারণ। শেষ পর্যন্ত শবনমই মুশকিল আসান করল, বলল," তোরা এরকম করছিস কেন? আমি অনেক মাংস আনব, যে, যে রকম পারবি, খাবি।"
-- এই না হলে
শবনম! আমরা সবাই আশীর্বাদ করি, তোর যথা শীঘ্র সম্ভব কোন সৎ পাত্রে পতন
হোক, যাতে আমরা
মাঝে
মধ্যেই 'ঈদ মুবারক' করতে পারি।
শবনম,-- মেরে তোর মুখ ভেঙ্গে দেব।
-- মুখ ভেঙ্গে
দিলে আর মাংস খাব কি করে?
-- এই, ভাটিং শুরু হল। বেরো, আমার দেরি হচ্ছে, আমি চললাম। বলে শবু চলে গেল।
পরের দিন শবু অনেক মাংস এনেছিল, সব হাউস স্টাফ, ওয়ার্ড বয়, নার্স সবাই মিলে অনেকটা করেই খেয়েছিল।
সেদিন সন্ধেবেলা ওয়ার্ডে দীপন আশিস এসে
গেছে, অসিত আসলেই
রুগী দেখা শুরু করবে। ভাবতে ভাবতেই অসিত
এসে গেল।
অসিত এসেই বলল ," খবর
আছে।"
দীপন-- জানি
তুই গুলি খেয়েছিস, এই তো?
অসিত-- আরে, ওটা তো কোন খবরই নয়, ও আমি রোজই খাই। এ শবনমের খবর।
শবনমের খবর শুনে সকলেই অসিতের দিকে উৎসুক
হয়ে তাকাল। একযোগেই প্রায় বলে উঠল ," কি খবর?"
-- শবু লটকেছে।
-- এই তো সন্ধে
হতেই ঢপের চপ খাওয়াতে শুরু করলি! শবু সে মেয়েই নয়।
-- ও সব বোলো
না গুরু, আমি জেনুইন
খবর আনি।
-- হ্যাঁ হতে
পারে, কিন্তু এটা
ঢপের চপ, শবু খুল্লাম
খুল্লা মেয়ে, ও প্রেম
করতেই পারে না।
-- হয়ে যাক
বাজি। আজই ফয়শালা হয়ে যাবে, তুমি শুধু ডাক্তারি বই পত্রই পড়, প্রেমলজির ঘণ্টা বোঝ।
-- বাজি তাজি
রাখ, বাজি আমি
জীবনে কখনও জিতি নি। শবু আসলেই জিগ্যেস করব। কিন্তু ভাগ্যবানটি কে?
-- সে টা শুনলে, মনে হয়, অজ্ঞান ই হয়ে যাবি।
-- আরে ব্যাটা, বল ই না চটপট।
-- শ্রীমান
নন্দ।
-- তুই মনে
হচ্ছে আজ ডবল গুলি খেয়েছিস। নন্দকে আমি তোর থেকে বেশী জানি। ও পড়াশোনা ছাড়া কিছুই
জানে না। ও ব্যাটা আড্ডা মারতেই জানে না।
-- দ্যাখ, প্রেমের ব্যাপারে ও তোর চেয়ে অন্তত
বুদ্ধিমান, যেখানে
আড্ডা দিলে প্রেম হবে ও সেখানেই আড্ডা দেয়। তোর মত সব ছেলে মেয়ের সঙ্গে আড্ডা দেয় না। আর
একটা কথা লিখে রাখ, তোর জীবনে প্রেম হবে না।
-- হ্যাঁ রে, তুই কি আজকাল জ্যোতিষ চর্চা করছিস?
-- যা বললাম
মনে রাখিস। দই পাতা দেখেছিস? ঘরের কোনে দইএর সাজা দিয়ে বসতে দিতে হয়, তেমনই প্রেমের সাজা দিয়ে প্রেমও বসতে দিতে হয়। সবার সঙ্গে
কখনো প্রেম হয় না।
-- তোর এত
ফান্ডা হল কি করে রে? তোর কি প্রেমে অনার্স, না কি কারও পিছনে ইট পেতেছিস?
-- এই শবু আসছে, তুই কিন্তু জিজ্ঞেস করবি, তোকে এড়াতে পারবে না। আবার তোর কাছে সবাই
বেশ সহজও হয়ে যায়, তোর এই গুনটা অসাধারণ। শবু ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল," তোদের রাউন্ড দেওয়া হয়ে গেছে? আমার বড্ড দেরি হয়ে গেল।"
-- তা তো হবেই, তোকে আজকাল কত কত জায়গায় রাউন্ড দিতে হয়।
-- কি বলতে চাইছিস
বলতো? সবাই আমার
দিকে এরকম সার্চ লাইট ওয়ালা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছিস কেন?
-- বলছি শোন, দু মিনিট বস, একটা কথার সোজা উত্তর দে," তুই কি প্রেমে পড়েছিস- হ্যাঁ কি না?"
-- ধুর ছাড় তো, আমার রাউন্ড দিতে অনেক সময় লেগে যাবে, এখনি শুরু না করলে।
-- শবু মুখ
ঘোরাবি না, সোজা আমার
মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দে। তাতে তোর লাভই হবে, ছোট, বড় কোন ইট
থাকলে সরিয়ে দেব।
-- তোকে এড়িয়ে
যাওয়া বড় শক্ত রে।
-- তাই বল, চালিয়ে যা কোন চিন্তা নেই। নন্দকেও আমরা
মাঝে মাঝে খাপাবো, তুই কিন্তু তখন চটে যাস না।
শবনম রাউন্ড দিতে চলে গেল। দীপনরাও
রাউন্ড দিয়ে টেবিলে এসে
বসল। সব
নির্দেশ বেড হেড টিকেটে লিখে ফেলল।
রিকুইজিশন ইত্যাদি লিখতে লিখতে অসিতকে বলল-
-- হ্যাঁরে শবু
কি কাজটা ভাল করল? আমার কেমন যেন একটা ভয় করছে।
-- কেন ভয়
কিসের? ওরা চুরিও
করেনি, ডাকাতিও
করেনি। দুজনেই ভাল ছেলেমেয়ে, করেছে তো প্রেম - প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যা।
-- কিন্তু
দুজনে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর পরিবার থেকে এসেছে। নন্দ গ্রামের গোঁড়া ব্রাম্ভণ
পরিবার এবং শবু কলকাতা মুসলমান পরিবার থেকে। নন্দর বাবা নেই
কিন্তু ঠাকুরদা আছেন, আর এক দাদা আছেন। দাদাকেই বাবার মত শ্রদ্ধা
করে। আমি যতদূর জানি তেমন একটা সচ্ছল নয়।
শবনমরা যৌথ পরিবারের মেয়ে। শবনমকে দেখে ওর পরিবারকে বুঝতে যাস না। এই প্রেমকে সার্থক করতে
গেলে দুজনকেই নিজ নিজ পরিবার থেকে সমূলে উৎপাটিত হতে হবে। খুব সোজা কাজ নয়।
-- ওরা কি
ভাবছিস এসব কিছুই ভাবে নি?
-- ভেবে চিন্তে
তো আর প্রেম হয় না। প্রেম বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এক্সিডেন্ট।
-- এই জন্যই তো
বলেছি তোর কোনদিন প্রেম হবে না।
-- আমার প্রেম
হয়ে আর কাজ নেই ভাই, তোরা প্রেম কর। আশীর্বাদ করি তোদের প্রেম সফল হোক। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ প্রথম প্রেম যদি হড়কে যায়, তাহলে মহা বিপদ। কথায় আছে 'first love die hard'
- প্রথম প্রেম মরে না।
-- তুই থাম তো, প্রথম প্রথম দুই পরিবারই ভীষণ আপত্তি করবে, তারপর মেনে নেবে। একথাও আছে, 'যব মিয়া
বিবি রাজি, ক্যা করেগা কাজী?'
-- দেখা যাক।
প্রেম সফল হলেই ভাল, তাই আমরা কামনা করি।
-- চল খেতে চল, খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
-- আমারও, জীবনের আর্দ্ধেক সময় বোধ হয় ক্ষিদের
তাড়নাতেই গেল।
সেদিন দুপুর। দীপনদের আউট ডোর ছিল। আউট
ডোর থেকে সবে ইনডোর ওয়ার্ডে এসেছে। যে সব অসুস্থ
বাচ্চাগুলি আউট ডোর থেকে ভর্তি হয়েছে একে একে আসতে শুরু করেছে। দীপনরাও একে একে
চিকিৎসা শুরু করছে।
শবনমদের ইনডোর রাউন্ড ছিল। ওরা ওদের রুগীদের বেড হেড টিকিটে নির্দেশ লেখছে। এইদিনই
মেডিক্যাল
রিপ্রেসেনটেটিভরা
সাধারণত শবনমদের সঙ্গে হাউসস্টাফদের ঘরে দেখা করে ওষুধ সম্বন্ধে আলোচনা করে। ওদের
সংক্ষেপে এম আর বলা
হয়। সেদিন সব এম আররাই আলোচনা শেষ করে স্বাভাবিক ভাবেই, সবাই চলে গেছে। শুধু এক জন হাউস
স্টাফদের ঘরে বসে ছিল। ওর নাম 'হাসান'। ওকে দেখে দীপন জিজ্ঞেস করল," কি হাসান ভাই তুমি এখনো বসে!"
-- সব
ডিপার্টমেন্ট ঘুরতে ঘুরতে দেরি হয়ে গেল, এই আর কি।
-- কার জন্য
বসে আছ?
-- শবনমকে
অনেকদিন মিট (meet)করা হয় নি।
ওর জন্যে বসে আছি।
-- ডাঃ শবনম নয়, শুধু শবনম!
-- ওকে আমি বহু
বছর ধরেই জানি, ওদের
পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের দীর্ঘ দিনের আলাপ।
-- ওঃ, আচ্ছা। তুমি তাহলে বস, আমারা আমদের কাজ শেষ করি।
-- আচ্ছা।
সেদিন অনেক রুগী ভর্তি হয়েছিল। সবার
চিকিৎসা শুরু করতে করতে বেলা দুটো পেরিয়ে গেল, ক্ষিদেও পেয়েছে।
এবার ক্ষেতে না গেলেই নয়। এই ভেবে দীপনরা হাউস স্টাফদের ঘরে এল। দেখে 'হাসান' তখনও বসে আছে। দীপন বলল," আরে তুমি এখনও বসে আছ! শবনম তো কখন চলে
গেছে।"
-- না, এমনি বসে আছি। রাত্রে যাদের সাথে দেখা
করার কথা তার লিস্ট টা করে রাখছিলাম।
-- ওঃ, হয়ে গেছে?
-- হ্যাঁ, হয়ে গেছে। আমি উঠি।
-- আচ্ছা এসো, আমরাও খেতে যাই।
অসিতকে যেতে যেতে দীপন জিজ্ঞেস করল," কি ব্যাপার বলতো, শবুর প্রেমে ফেউ লাগল নাকি?"
--ধ্যুর ছাড়
তো, আগে চল খেয়ে
নি, খুব ক্ষিদে
পেয়েছে।
-- তাই চল, বলে ওরা হাউস স্টাফ কোয়াটারে খেতে গেল।
খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে সবাই সন্ধেবেলা
ওয়ার্ডে এল। রাউন্ড দেওয়া শুরু হল, সব নির্দেশ বেড হেড
টিকেটে লিখে
ফেলা হল। পরের দিন যা যা টেস্ট করতে হবে কাগজ পত্র লিখে রেডি করে রাখা হল। দীপনের
সব হাউস
স্টাফরাই খুব সহযোগী মনোভাবের, যে কোন দায়িত্বই ওরা নেয়। মনে হল যেন
একটু কফি হলে ভাল হয়। তাও হয়ে
গেল। রত্না এদিক থেকে বেশ দিলদার। সব দিন না হলেও যেদিন বেশী খাটা খাটনি যায়, সেদিন ওকে
বলতে হয় না।
একটু হালকা হয়ে অসিতকে দীপন আবার জিজ্ঞেস করল," হ্যাঁ রে কিছু ভাবলি?"
-- কি ব্যাপারে?
-- শবুর ফেউ!
-- ফেউএর
হিস্ট্রি তো আগে নিতে হবে, শবুকে আগে জিজ্ঞেস কর।
-- ঠিক বলেছিস।
শবুও রাউন্ড দিয়ে, নির্দেশ সব দিয়ে হাউস স্টাফদের ঘরে এসে
বসল। কফি খেল। দীপন জিজ্ঞেস করল-
-- হ্যাঁ রে
শবু, হাসান আজকাল
প্রায়ই তোর খোঁজে ওয়ার্ডে আসছে, তোর সাথে নাকি বহু দিনের পরিচয়।
ব্যাপারটা
কি রে?
-- ধ্যুর, ওটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে
পারিস না?
-- যাঃ বাবা, তোদের বাড়ীর সাথে ওদের বাড়ীর নাকি বহু
দিনের পরিচয় বলেছে, তখন কি করে বুঝব বলতো
ও যে তোর কোন আত্মীয় নয়?
-- ধ্যেত, আত্মীয় না ছাতা, এবার এলে সোজা বের করে দিবি।
-- বুঝেছি যা
ভেবেছিলাম তাই।
-- কি বুঝেছিস?
-- হাসান তোর
প্রেমে ফেউ। ওর ইট টা সরাতে হবে, এবং আবার যাতে ইট নিয়ে আর এমুখো হয় তার
ব্যবস্থাও করতে হবে।
অসিত বলে- ও কাজটা আমার ওপর ছেড়ে দে, আমি যা ব্যবস্থা করার করে দেব। তুই শুধু
আমার সঙ্গে থাকবি। কিন্তু শবুকে বলে দে, ইট তো আর হালকা নয়, সরাতে খাটনি আছে, একটু খরচা পাতি যেন করে।
-- কিসের খরচা?
-- আরে আমাদের
একটু আধটু খাওয়াবেও না?
-- না, না, সে ও খাওয়াবে, কিন্তু আমার তো কেমন একটু সন্দেহ হচ্ছে।
তুই ব্যাটা এক গুলি খোর, হয়ত হাসানকেও দিবি গুলি খাইয়ে।
-- এই তো ভুল
ডায়গনোসিস করে ফেললে গুরু! হাসান তো গুলি খেয়েই আছে, তাই তো ও এখনও বেহুঁশ। ওর
হুঁশ আনতে হবে, মানে ওর গুলি বের করতে হবে।
-- জানি না ভাই, যা করবি সাবধানে করবি।
-- বলছি তো কোন
চিন্তা নেই, তুই শুধু
আমার সঙ্গে থাকবি, ব্যস তাহলেই হবে।
-- আচ্ছা থাকব।
দিন কয়েক পর, দীপন দুপুর বেলা হাউস স্টাফ কোয়াটারে
একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল, শুয়ে শুয়ে একটা গল্পের বই
ওলটাচ্ছিল। হঠাৎ অসিত দীপনের ঘরে এসে বলে," চল।"
-- কোথায়? আজ আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না, আজ রবিবার, সেরকম কোন কাজ নেই, আমি ভাবছি টেনে একখানা ঘুম দেব।
-- আরে, রবি বার বলেই তো বলছি, এখন চল, রাত্রে ঘুমোবি।
-- দূর ব্যাটা, যাবি কোথায় বলবি তো?
-- নিজাম
হোটেল।
-- সেখানে আবার
কি? তাছাড়া আমার
এখন পয়সা কড়ি সেরকম নেই। তুই অন্য কাউকে নিয়ে যা।
-- আরে এ কাজ
তোকে ছাড়া হবেই না, পয়সার চিন্তা কেন করছিস, এক পয়সাও লাগবে না, শুধু খাবি, মটন
রোল, যা বানায় না গুরু, আমার এখনই জিবে জল আসছে।
-- কিন্তু
খাওয়াবে কে?
-- আরে বাবা সব
জানবি, কিন্তু এখন
নয়, এত চিন্তা
করিস কেন? চট পট্ রেডি
হয়ে নে।
অগত্যা দীপন গেল নিজাম হোটেল কাম
রেস্টুরেন্টে। দেখে হাসান এসেছে, একটা টেবিলে বসে আছে। ওর পাশেই ওরা বসল। অসিত দীপনকে আগেই বলে রেখেছে, যা বলার ও ই বলবে, ও যেন কিছু না বলে।
রোলের
অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। অসিত বলল," শবনমের আসতে একটু দেরি হবে। ও বলেছে আমরা
যেন এখানেই
অপেক্ষা করি।" দীপন তো এদের ব্যাপার কিছুই জানে না, অতএব চুপ করেই রইল।
রোল এসে গেল, খাওয়াও হয়ে গেল, শিক কাবাব কখন অর্ডার দিয়েছে কে জানে, তাও এসে গেল, খাওয়াও হয়ে
গেল। তারপর চা আসল, তাও খাওয়া হয়ে গেল। শবনমের দেখা নেই। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ অসিত বলে," তোরা বস, আমি শবুকে একটা ফোন করে আসছি।" একটু
পরে ফিরে এসে বলল, "খুব দুঃখিত ভাই, শবু আসতে
পারছে না, ওর এক মাসী
বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেছে, মাসীকে নিয়ে শবু হাসপাতালে গেছে, আজ
আর আসতে
পারবে না।" হাসান ভীষণ দুঃখ পেল, অন্তত তাই ও প্রকাশ করল - কিন্তু সেটা
শবু না আসার জন্য না কি শবুর
মাসীর জন্য, কে জানে।
কিছুক্ষণ পর ওদের মিটিং ভেঙ্গে গেল। ওরা কোয়াটারে ফিরে গেল। সন্ধেবেলা দীপন অসিতকে জিজ্ঞেস করল, "শবুর মাসী পড়ল কি করে? বয়সই বা কত?"
-- ওঃ, তুইও যেমন, আমিই কি জানি নাকি? আদৌ ওর কোন মাসী আছে কি না, তাই জানি না, আর তুই
জিজ্ঞেস করছিস, কেমন করে পড়ল।
-- বুঝলাম, সব ঢপ! শবু জানে?
-- শবু কিচ্ছু
জানে না, সব ঢপ।
এই ভাবে হাসান কে পটিয়ে, ঢপ দিয়ে আজ নিজাম, তো কাল আমিনা, আবার কোন দিন সাবির হোটেল ওদের খাওয়া
চলতে লাগল। দীপনের খুব খারাপ লাগছিল। হাসান বেচারাকে আশার আফিং খাইয়ে, মুরগী করা দীপনের আর ভাল
লাগছিল না। একদিন অসিতকে বলেই দিল, "দেখ অসিত, আমি আর এতে নেই, তুই যা পারিস করগে যা,
আমাকে অন্তত
রেহাই দে, আমার এসব
ভাল লাগছে না।"
অসিত দীপনকে অনেক ভজাবার চেষ্টা করেছিল, দীপন রাজী হয় নি। তারপর হাসানও বোধ হয়
বুঝতে পেরেছিল যে
ওকে মুরগী করা হচ্ছে। হাসান ওদের এড়িয়ে যেতে লাগল। ওয়ার্ডে আসাও কমাল। হাসানও
বাঁচল,
শবুও বাঁচল, দীপনরাও বাঁচল।
শবু এবং নন্দর প্রেম গভীর থেকে গভীরতর
হচ্ছে। ওদের ঘোরাফেরা এখন অনেকের নজরেই পড়ছে। সবাই
দীপনদের জিজ্ঞেস করে আশ্বস্ত হচ্ছে। শবু আর নন্দর প্রেম একটা জব্বর খবর। ওরা
দুজনেই আজকাল বেশ হাসিখুশিই
থাকে, যেন
স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশীই হাসিখুশি থাকে। নন্দকে বেশী না হলেও শবুকে দীপনরা
রোজই
দেখছে। ওর
চোখে মুখে একটা জেল্লা খুলে গেছে। প্রায়ই বেশ মাঞ্জাও দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে সবাই
একটু আধটু আওয়াজও দেয়, "কি রে হেভি মাঞ্জা দিয়েছিস তো"। ও
শুধু হাসে, কিছু বলে না, আর বলবেই বা কি।
নন্দ অসাধারণ ছেলে, পড়াশুনায় ও তো বরাবরই ভালো ছিল, এম ডি এনট্রান্স পরীক্ষার জন্যও তৈরী হছে, প্রেম করছে
আবার হাউস স্টাফের কাজও করছে। ওর আর একটা বিশেষত্ব হল, হাসি ওর মুখে লেগেই থাকে, আজকাল যেন একটু
বেশীই থাকে। এম ডি এনট্রান্স পরীক্ষা হয়ে গেল। ফল বেরোল, ও চান্সও পেয়ে গেল।, ভর্তিও হয়ে গেল।
ওর দাদা
মাঝে মাঝে আসেন। ওর সফলতায় দাদাও খুশী। এদিকে ওদের প্রেমের খবরও ছড়াতে থাকে।
একদিন দাদার কানেও খবরটা গড়িয়ে গেল। দাদা
এসে হাজির, নন্দের সাথে
অনেক কথা হল, নন্দকে দাদা ফেরানোর
প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। কিছুদিন পর পরই দাদা আসেন, বার বার বোঝান। কিন্তু নন্দের যেন ফেরার
রাস্তাটাই হারিয়ে
গেছে। আজকাল প্রায়শই ওকে একটু বিমর্ষও দেখায়, আমাদের কাছে মাঝে মাঝে আসে, আমাদের ইয়ার্কিতে শুকনো হাসি দেয়, বুঝতে পারি। শবুকে দেখে ওর বিমর্ষতা
কিছুক্ষণের জন্য কাটে, কিন্তু আবার তা ফিরে আসতে সময়ও লাগে না। ওকে
প্রায় সময়ই বেশ চিন্তিত দেখায়। আমরা সাহস দিই। কিন্তু বুঝতে পারি ওর সব দিক
সামলানো বেশ কঠিন
হয়ে পড়ছে।
ওর পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। শবুর অবস্থাও আসতে আসতে জটিল হতে থাকল।
ওর বাড়িতেও সব জেনে গেছে। তার উপরে হাসান এতে যথেষ্ট
ইন্ধন জুগিয়েছে। ওদের মুখের হাসি যেন কেও মুছে দিয়েছে। ওদের ঘোরাফেরা চলছে, তবে কম, বেশ কম। ওদের এখন আর
সে রকম উৎফুল্ল দেখায় না, ওদের প্রেমের যে কি পরিণতি হবে বোঝা
যাচ্ছে না।
একদিন নন্দর সাথে ওর দাদার তুমুল কথা
কাটাকাটি হল, ঘর বন্ধ
করে। নন্দের মুখে তারপর থেকে আর কোন কথা নেই, সবই করে কিন্তু নিষ্প্রাণ। খাবার সময়ও
তেমন কোন কথা বলে না। অথচ এই খাবার টেবিলই দীপনদের
একটা মিটিং প্লেস, বিশ্বব্রাম্ভান্ডের সব কিছু নিয়ে আলোচনা হয় সেখানে। অনেকদিন ও ডাইনিং হলে
যায়ই না, খাবার নিয়ে
নিজের ঘরে চলে যায়। ওদের দেখে ভীষণ খারাপ লাগে, ঠিকই, কিন্তু দীপনদের তেমন কিছু করারও নেই। ওর
দাদা ওদের থেকে অনেক বড়, আর উনি ওদের কথা শোনার লোকও ছিলেন না।
দীপনদের হাউস স্টাফ-শিপ শেষ হয়ে গেল।
বন্ধুদের বেশীর ভাগই বাড়ী চলে গেল। শবনমও বাড়ী চলে গেছে। দীপন এবং
শবনম দুজনেই ডি চি এইচ কোর্সে ভর্তি হয়েছে। তবে ওদের ইন্সটিটউসন অবশ্য আলাদা। শবুর
কোন অসুবিধা নেই, দীপনদের যাদের কলকাতায় থাকার কোন জায়গা
নেই, তাদেরই যত
মুশকিল। খোঁজ করতে করতে জানল
ইমারজেন্সি
ডিপার্টমেন্টে একজন হাউস স্টাফের পোস্ট খালি আছে। দীপন সোজা সুপারেন্টেন্ডেন্টের
কাছে গিয়ে, দরখাস্ত করে, অর্ডার বের করিয়ে একেবারে জয়েন করে নিল।
তখন দীপনের কাছে কাজ বাছার সময় নয়। কলকাতায় একটা থাকার জায়গা
চাই যেখানে থেকে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাওয়া যাবে, আর কিছু কাজ তা যা করতেই হোক, নইলে খাবে কি? সবই চলতে থাকল-ক্লাস, পড়াশুনা, ইমারজেন্সির কাজ, সবই। পরিশ্রম খুবই হত। শবু নন্দদের খবর
রাখার সময় পেত না, নিজের সমস্যা নিয়েই অনেক ব্যস্ত থাকতে
হত। ইমারজেন্সির কাজটি ছমাসের জন্য, ডি সি এইচ এক বছরের কোর্স।
অর্থাৎ পরের
ছ মাস আবার অনিশ্চয়তা। বাবার কাছে তো আর হাত পাতা যায় না, আর চাইলেও তিনি দেবেন কি না যথেষ্ট
সন্দেহ আছে। অতএব কিছু টাকাও জমাতে হবে। একটু টেনেই চালাতে হবে।
শবু বাড়ী থেকেই পড়াশুনা চালাচ্ছিল, নন্দও একটা হাউস স্টাফশিপের কাজ জোগাড়
করেছিল, তাই হাউস
স্টাফ কোয়াটার
থেকেই এম ডি পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিল। সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত, দেখা সাক্ষাত কমই হত। দীপনের এক
বন্ধু ছিল, অশোক। সেও
দীপনের সাথেই ডি সি এইচ করছিল, থাকত কাছেই গোবড়া মেন্টাল হাসপাতালের কোয়াটারে।
অশোকও ওখানেই একটা হাউস স্টাফের কাজ জোগাড় করেছিল। অশোককেই দীপন পড়াশুনার পার্টনার
করল। দীপন রোজ
সন্ধেবেলা অশোকের কোয়াটারে বই পত্র নিয়ে চলে যেত, ওদের কোয়াটারটা বেশ নিরিবিলি এবং শান্ত পরিবেশ, কোন হৈ হট্টগোল নেই, পড়াশুনার পক্ষে খুব ভাল জায়গা। দুজনেই এক
সাথে পড়ত, আলোচনা করত। এতে পড়াশুনা
এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিও ভালই হয়। সারা এম বি বি এস কোর্সেও কেও না কেও দীপনের
পড়াশুনার পার্টনার
ছিল। দীপনের বিশ্বাস এভাবে পড়লে কম খেটে বেশী পড়াশুনা হয়।
দীপন সারাদিনই ব্যস্ত থাকে, ডি সি এইচের ক্লাস, ইমারজেন্সি ডিউটি তারপর পড়াশুনা, খুবই চাপে থাকে। দীপনের বাবা
এর মধ্যে দীপনের বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ওর বাবা ওর আর পড়াশুনার কোন
গুরুত্বই বুঝতে
চাইছেন না। তাই মাঝে মাঝে মেয়ে দেখতেও যেতে হচ্ছে। একদিন দীপন আশিসকে মেয়ে দেখতে নিয়ে
গিয়েছিল। মেয়ে পছন্দ
হয়নি তো কি, আশিস খেয়েই
আনন্দ করেছিল। শবু নন্দের কোন খবর রাখতে পারে না, দেখা তো হয়ই না, সময়ই পায় না। আড্ডা দেবারও সময় পায় না।
ডি সি এইচের ক্লাস করে দীপন একদিন
কোয়াটারে ফিরছে; কোয়াটারের
সামনে দেখে প্রচুর লোক, পুলিশ, কিছু মাস্টারমশাই
এবং হাসপাতাল সুপারেন্টেন্ডেন্ট। কিছুই বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। কাছে এসে জিজ্ঞেস
করে যা জানল পুরো
স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভিড়ের মধ্যে অসিতকে দেখতে পেয়ে দীপন জিজ্ঞেস করল, " কি হল রে?"
-- কাল নন্দের
দাদা এসেছিলেন, ওর ঘরে বসে
তুমুল কথা কাটাকাটি হয়েছে। রাত্রে নন্দের সাথে আমরা গল্প করেছি।
তারপর এই কান্ড।
-- কখন করল?
-- আজ সকাল ৯
টা নাগাদ সবাই যেমন বেরিয়ে যায়, বেরিয়ে গেছে। ও একটু পরে যাবে বলে রয়ে
গিয়েছিল।
তারপরে ঘর বন্ধ করে দিয়েছে ঝুলে।
-- কখন জানলি?
-- ক্যান্টিনের
স্টাফ সনাতন কাঁদতে কাঁদতে শিশু বিভাগে গেছে, আমি ওখানে আড্ডা মারছিলাম। আমাকে বলতেই আমি সবাইকে নিয়ে ছুটে এসেছিলাম। দরজা
ভেঙ্গে যখন ঢুকলাম ততক্ষণে সব শেষ। ওটা যে এ রকম করতে পারে আমরা ভাবতেই পারিনিরে, কি খারাপ লাগছে না, কি বলব। ওর দাদা কেন যে এত জোরাজুরি করল, ওই বা কেন এই পথই বাছল, একবার তো আমাদের সঙ্গে আলোচনাও করতে পারত, কি করা যায়, আমার
মাথায় কিছুই ঢুকছে না রে। আমার এখনও মনে
হচ্ছে ও আছে, কোথাও গেছে, এক্ষুনি আসবে।
-- শান্ত হ।
আমারও কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না, ভাবলে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। তবু যা হয়ে
গেছে তাই বিশ্বাস করে নিতে হবে তাতে যত কষ্টই হোক। বাস্তব যে কত
নিষ্ঠুর হতে পারে আমরা কল্পনাই করতে পারি না। নন্দটা প্রেমই করতে পারল, প্রেমের কাঁটা তোলার চেষ্টাই করল না। যখন
প্রেমে বাধা পেল ওর পালিয়ে যেতেই ইচ্ছে করল! সংগ্রাম করার কোন ইচ্ছেই হল না। বয়স
অনুপাতে মানসিক পরিণতি হয় নি। শবু জানার পর ব্যাপারটা ও
কি ভাবে নেবে কে জানে। ওর পরিচিত যারা, যাদের সঙ্গে ওর আন্তরিকতা বেশী তাদের কে
একটু সাবধান করে দে, যেন একটু খেয়াল রাখে।
-- সব বুঝলাম, কিন্তু মন কি মানতে চায়, আমাদেরই চাইছে না তো ওর কি করে চাইবে বল? ওদের প্রেমের যে এই পরিণতি হবে আমি কোন দিনই ভাবতে
পারি নি।
-- ঠিকই বলেছিস, মেনে নেওয়া বড্ড শক্ত।
দীপনের ব্যস্ততা তো ছিলই, দিন দিন আরও বাড়ছে। ডি সি এইচের পড়াশুনার
সাথে সাথে এম ডি এনট্রান্স
পরীক্ষার জন্যও তৈরী হচ্ছিল। ইচ্ছে ছিল ডি সি এইচের ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়ে এম ডি
এনট্রান্স পরীক্ষায় বসবে। যদি
পেয়ে যায়, কলকাতায়
যেখানেই হোক একা থাকার একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। তাও যদি না পারে তাই একটা
প্র্যাকটিস করার চেম্বারও ঠিক করল, এবং প্র্যাকটিস করতেও শুরু করে দিল।
পরিশ্রমও হতে থাকল প্রচুর।
মেয়ে দেখতে দেখতে একটি মেয়ে পছন্দও হয়ে
গেল, এম এ
ফাইন্যাল ইয়ার, অর্থাৎ
প্রচুর চাপ। পড়াশুনায় ভাল।
জিওগ্রাফী ওনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস নম্বর নিয়ে পাস করেছে।
তার চেয়ে বড় কথা হল এই মেয়ের
বাবা এবং দীপনের বাবা এক সময় এক কলেজেই পড়াশুনা করেছেন, অর্থাৎ পূর্বপরিচিত। অতএব এ মেয়েকে না পছন্দ
হবার কোন কারণই নেই। মেয়েটির নাম সোনালী। সোনালী বা দীপন কেওই চাইছিল না ওদের
ফাইন্যাল পরীক্ষার
আগে বিয়ে করতে, কিন্তু মেয়ের
বাড়ী থেকে বিশেষ করে মেয়ের মা বিয়ে ফেলে রাখতে চাইলেন না। বিয়ে হয়েও
গেল। সব দিক থেকে চাপ আরও বাড়ল। সোনালী এম এ ফাইন্যাল পরীক্ষা অব্দি ওর বাপের
বাড়ীতে এবং
দীপন ডি সি
এইচ পরীক্ষা অব্দি হাউস স্টাফ কোয়াটারেই রইল। কলকাতায় থাকার জায়গাও নেই, রোজগারও নেই, দীপন সোনালী ছাড়া এ ব্যাপারে কারও কোন
চিন্তাও
নেই। দীপনের
একার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা গেলেও যেতে পারত কিন্তু দুজনের ব্যবস্থা করা সম্ভব
হত না। তাহলে আর এম ডি এনট্রান্স পরীক্ষা দিয়েই বা কি হবে? চান্স পেয়ে গেলে বরং আরও কষ্ট হবে। রত্না, আশিস কিন্তু বসতে বলেছিল।রত্না
চান্স পেয়েও গেল, ভর্তিও হয়ে গেল। রত্না বলেছিল " আমি যখন পেলাম তুইও পেয়ে যেতিস, তুই বোধ হয় ঠিক করলি
না।" রত্না বেঠিক কিছু বলে নি। কিন্তু দীপনের নিজেকে বড় অসহায় লাগল, কেও ওকে বুঝতে চাইল না, বাবাও না! যাদের কলকাতায় বাড়ী আছে
তাদেরকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল।
দীপন সোনালী কে নিয়ে বাঁকুড়ায় ওর পৈত্রিক
বাড়ীতেই চলে গেল। ওখানেই প্র্যাকটিস শুরু করল। বাবা খুশী, সকলেই খুশী, কিন্তু দীপনরা নয়। অল্প কিছু দিনের
মধ্যেই সোনালী কলকাতায় একটি কলেজে অধ্যাপিকার কাজ পেয়ে চলে
গেল কলকাতায়। দীপনও তার এক সপ্তাহের মধ্যেই কলকাতার কাছেই একটি ই এস আই হাসপাতালে
মেডিক্যাল
অফিসারের চাকরি পেয়ে গেল। দুজনেই কলকাতা চলে এল। সোনালী ওর চাকরি চালিয়ে যেতে পারল, কিন্তু
দীপনকে পাঁচ বছরের মধ্যেই নানা অসুবিধার মধ্যে চাকরি ছাড়তে হল। অতএব দীপন
প্রাকটিসের উপর ভরসা করেই রইল।
পড়াশুনার দফা রফা তো আগেই হয়ে গেছে, ওর মন কে ওই ভাবেই শান্ত করে নিল। বুঝে
নিল, সবার
সব কিছু সব
সময় হয় না।
দীপনের বন্ধুদের খবর আলাদা, শবু স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে, রত্না কলকাতা মেডিকেল কলেজে, আশিস পি জি
হাসপাতালে আছে। শবু আর সংসার করে নি। তবে ওরা সবাই কালক্রমে নিজের নিজের জায়গায়
অনেক উন্নতিও
করেছে। রত্না মেডিকেল কলেজে শিশু বিভাগের প্রধানও হয়েছে। দীপনের বাবা গত হয়েছেন।
একটি ছেলে,
ইঞ্জিনিয়ার
হয়ে চাকরি করছে, বিয়েও দিয়ে
দিয়েছে। দীপনের সংসারে দায়িত্বও কমে এসেছে, একটু একঘেয়েও লাগতে শুরু করেছে
মাঝে মাঝে। বয়সও বেড়ে চলেছে। একদিন মেডিকেল কলেজের একটি কন্ট্রাক্ট এস এম ও
পোস্টের
বিজ্ঞাপন দেখে
দরখাস্ত করে, সুযোগ পেয়ে
চাকরিটিতে ঢুকেও পড়ল। পাশেই স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে শবুর খবর জোগাড়
করে একদিন ফোনই করে বসল। শবনম দীপনের গলা শুনেই চিনে ফেলল, পরিচয় দেবার দরকারই পড়ল না।
-- কি করে
চিনলি রে?
-- তোর তো কোন
পরিবর্তনই হয় নি, সেই একই রকম কথা বলার ধরন, গলাটাও তো একই রকম আছে। দেখতেও হয়ত একই রকম আছিস। আমার
ডিপার্টমেন্টে চলে আয় না একদিন, গল্প করা যাবে।
-- যাব, কিন্তু তুই ই আগে আয় না, আমার কাছে, কে কেমন দেখতে হয়েছি দেখে নেওয়া যাবে।
-- তুই তো বিয়ে
করেছিস, কোথায় থাকিস?
-- হ্যাঁ, একটি ছেলেও আছে, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি করছে, বিয়ে দিয়ে দিয়েছি, সংসার করছে, বরানগরে একটি ছোট
বাড়ী করেছি, বরানগরেই প্র্যাকটিস করি, তুই কোথায় থাকিস?
-- আমি এখানে
কোয়াটারে থাকি; তা বুড়ো
বয়সে আর চাকরি করতে এলি কেন?
-- বড় একঘেয়ে
লাগছিল রে, জানি না
এখানে কত দিন ভাল লাগবে, না লাগলে ছেড়ে দেব।
-- না, না, ছাড়বি কেন? কর না, মাইনে কম পাবি ঠিকই, তোর দায় দায়িত্বও তো সে রকম নেই। একদিন
আয় গুছিয়ে গল্প করা যাবে।
-- যাব, নিশ্চয় যাব, আজ রাখি, ভাল থাকিস।
-- আচ্ছা, তুইও ভাল থাকিস।
দীপনের একটা ট্রেনিঙের সুযোগ আসল স্কুল
অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে। দীপন ট্রেনিংটা নেবে ঠিক করল, কারণ তাতে ওর কাজের সুবিধাই হবে। ট্রেনিং
চলা কালিন একদিন খাবার সময় শবুর খোঁজে ওর ডিপার্টমেন্টে দীপন
গিয়েছিল, শবু তখন ছিল
না, কোন কাজে
স্বাস্থ্য ভবনে গিয়েছিল; ঠিক করল ট্রেনিং শেষ হলেই দেখা করবে।
শনিবার ট্রেনিং শেষ হল। সবাই বাড়ী যাবার
তোড়জোড় করছে, তিনতলায়
গিয়ে ভাবছে কার কাছে শবনমের খোঁজ
নেয়। হঠাৎ ডিরেক্টর ডাঃ বিমল রায়ের সঙ্গে দেখা, কথা প্রসঙ্গে জানা গেল উনি দীপনের চেয়ে এক বছরের
ছোট, একই কলেজ
থেকে পাস করেছে। উনি দীপনকে নিজের ঘরে বসিয়ে শবনমকে ডেকে পাঠিয়ে বেরিয়ে
গেলেন। কিছুক্ষণ পর শবু এল। দীপন শবুকে দেখল, শবুও দীপনকে দেখল। তিরিশ বত্রিশ বছর আগের দেখার থেকে
এখনকার দেখার অনেক তফাৎ। এ দেখা যেন কে কতটা বুড়িয়েছে তাই মাপার একটা চেষ্টা বা দীর্ঘশ্বাস।
দেখা না হলেই কি ভালো হত! দীপনই বলে উঠল-
-- এত
বুড়িয়েছিস কেন রে? দ্যুর দেখা না হলেই মনে হয় ভাল হত।
-- কেন, তুই কি কম বুড়িয়েছিস? তবে আমার চেয়ে বোধ হয় কম। তুই সেই রকমই
কথা বার্তা বলিস, তোর মনটা বোধ হয় বুড়োয় নি। তোর শরীর কেমন আছে?
-- ভাল না মন্দ
কি বলি বলতো? ওই এক রকম।
অত চিন্তা করে কি করব রে? যখন পটল-ডাঙা এক্সপ্রেসে উঠতে হবে, উঠে পড়ব। জানিস, আমাদের ব্যাচের বার জন এখন ওপারে। তা তোর
শরীর কেমন?
-- তোর
উত্তরটাই ভাল উত্তর। তবে এখন বাতে কষ্ট পাচ্ছি। সিঁড়ি নামতে বেশ কষ্ট হয়, হাঁটুগুলো টন টন করে উঠে।
-- একটু হাঁট, হাঁটলে নাকি হার্ট ও হাঁটু দুই ই ভালো
থাকে। আমারও একটু একটু যে হয় না, তা নয়, তবে পাত্তা দিই না। যখন পাত্তা দিতে হবে তখন
দেখা যাবে। তোর মনে বাত হয় নি তো? ওটা হলেই চিন্তার ব্যাপার। মনটা ঠিক
রাখবি। কারও সাথে যোগাযোগ হয়? সত্যর ছেলে ডাক্তার হয়েছে, মেডিকেল কলেজেই
নাকি এম ডি করছে, ভাল ছেলে। চন্দ্রর ছেলেও ডাক্তার হয়েছে, দেখি মোটাকে ফোন করি, পাওয়া যায় কি না দেখি। দীপন নিজের ফোন থেকেই আশিসকে ফোন করল, পেয়েও গেল, কথা বলল, শবুর সাথে কথা বলিয়ে দিল। সত্যকে
ফোন করতে রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। একটু পরে সত্যই ফোন করেছিল। শবুকে সত্যর সাথেও কথা বলিয়ে
দিল। তারপর দীপন জিজ্ঞেস করল, "এদের সাথে কথা বলে তোর কেমন লাগল, বল।"
-- খুব ভাল
লাগল রে।
-- মাঝে মাঝে
সবাইকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফোন করবি, ভাল লাগবে।
-- এক কাজ কর
না, একটা গেট
টু-গেদার কর না, আমার
ফ্লাটেই একটা ছুটির দিন দেখে করতে পারিস, তোর
তো অনেকের সাথেই যোগাযোগ আছে, তুই কি রকম দুম দাম সবার মনের ভিতরে ঢুকে
পড়িস! তোর কোন
রাখ ঢাক নেই।
-- কি হবে রে
রাখ ঢাক রেখে? ও গুলো নিয়ে
কি স্বর্গে যাব? আর সবার
সাথে গেট টু-গেদার করে কি বলবি?-
- পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়, ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা, সেও কি ভোলা যায়।
এই তো?
লেখক - দুর্গাদাস কুণ্ডু
d_kundu1950@rediffmail.com
প্রেমের পরিণতি কি নন্দর আত্মহত্যাতেই শেষ হয়ে হয়ে গেল? তারপর তো কেবল দীপনের আত্মজীবনী আর অন্যান্য বন্ধুদের খবর!আমি যতটুকু জানি শবনম্ সারাজীবন ঐ অসফল প্রেমের স্মৃতি বহন করছে।
ReplyDelete