গতমাসে রায়ার দিদিমা এসেছিলেন। ছিলেনও কয়েকদিন। তারপর যেদিন বাড়ি যাবার
ঠিকঠাক,
রায়ার মামা
অফিস থেকে ফেরার পথে দিদিমাকে নিয়ে যাবেন, ব্যাগ পত্র গোছানো হচ্ছে, তখন কিছুতেই তাঁর চশমাটা পাওয়া গেল না। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ। রায়ার মা, ব্যাপী, এমনকি মামাও
খুঁজতে লাগলেন। মা রায়াকে সন্দেহ করে বার কয়েক জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু রায়া
নির্বিকার। ঘাড় নেড়ে জানাল, সে জানেনা। সবশেষে সেটা পাওয়া গেল রায়ার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে। মা তো
তাকে এই মারতে যান সেই মারতে যান। রায়ার দিদিমা কোনওরকমে সামলালেন ব্যাপারটা। আর
দিদিমার আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে থেকে রায়া বারে বারে দাবি জানাতে লাগল,' তুমি আজ যাবে
না,
একদম যাবে
না!...,'
ক্লাস ওয়ানে পড়া রায়া এখনও দরজার ছিটকানিতে হাত পায় না। কিন্তু তাতে কি
যায় আসে! চেয়ারটা টেনে টেনে সে দরজার কাছে নিয়ে যায়। তারপর দিব্যি ছিটকানি খুলে
ফেলে। চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে এর ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে কড়া নাড়ে। কাকু কাকিমারা সব
অফিসে যান। অথবা নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু ঠাকুমা দাদুরা তাকে পেয়ে খুব
খুশি। রায়ার নিজের দাদু ঠাকুমা দেশের বাড়িতে থাকেন। তাই এই পাতানো দাদু
ঠাকুমারাই তার সঙ্গী। কত কিছু খেতে দেন তাঁরা। কখনও পিঠে পায়েস, কখনও নারকেল
নাড়ু তিলের নাড়ু, গুড়ের মোয়া। এসব খেতে রায়া খুব ভালোবাসে। শুধু অন্যরকম খাওয়া দাওয়া নয়, কতরকমের গল্প
হয় তাঁদের সঙ্গে। ঈশপের গল্প, পঞ্চতন্ত্রের গল্প, রামায়ন মহাভারতের গল্প।
এসব তো ঠিকই আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে সে ঠাকুমা দাদুদের ফ্ল্যাটের কড়া নেড়ে
পালিয়ে আসে। সবাই দরজা খুলে দেখেন ভো ভা। কে কড়া নাড়ল! কে কড়া নাড়ল! খোঁজ খোঁজ
তারপর রায়ার মাই চোরকে পাকড়াও করে ঠাকুমা দাদুদের সামনে ধরে আনেন। রায়া
দুষ্টুমির হাসি হাসতে তাঁদের কাছে ' সরি '
বলে।
রায়ার বরাবরই সকালে স্কুল। এখন আবার গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। হাতে অফুরন্ত
সময়। আন্টির দেওয়া হোমটাস্ক করে, টিভিতে কার্টুন দেখে কাহাতক আর সময় কাটে! আজ দুপুরে তাই সে চুপি চুপি ছাদে
চলে এসেছে। তার মা তো বটেই, ফ্ল্যাটের অন্যান্যরাও এখন ঘুমাচ্ছেন।
ছাদে সে খুব বেশি আসেনা। একা একা কেমন ভয় ভয় করে। বাপি মা সঙ্গে থাকলে
বিকেলের দিকে মাঝেমাঝে আসে।
ছাদে গিয়ে সে দেখল পর পর তিনটে কাচের বয়ামে আমের আচার শুকাতে দেওয়া
হয়েছে। এ নিশ্চই তিন তলার রাঙা ঠাম্মির কাজ! তাঁর ফ্ল্যাটে গেলে তিনি মাঝে মাঝে
আচার খাওয়ান।
বয়াম গুলো দেখতে যেমন সুন্দর,তেমনি চারপাশে ভুরভুরে গন্ধ। রায়া উবু হয়ে বসে। ইস দেখেই খেতে ইচ্ছে
করছে। কিন্তু খাওয়া কি ঠিক হবে! সে এদিক ওদিক তাকায়। না কেউ তাকে দেখছে না। ধুস
খাইতো! ভাবতে ভাবতে বয়ামের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয় রায়া। হাতে মাখামাখি হয়
আচারের তেল মশলা। রায়া যতটা পারে সাবধানে হাতে তোলা আচারটা মুখে পুরে দেয়।
আহ্ কি টেস্ট! থ্যাংক ইউ রাঙা ঠাম্মি! থ্যাংক ইউ! … রায়া মনে মনে বলে।
আর একটু খেলে কেমন হয়! রায়া আবার এদিক ওদিক তাকায়। না কেউ নেই। রায়া
আবার একটু আচার তুলে খায়। তারপর নিজেই নিজেকে বোঝায়। বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে
যাচ্ছে। মা জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না। এবার গুটি গুটি পায়ে সে নেমে আসে।
নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দেয়। তারপর হাত ধুয়ে ড্রয়িং
খাতাটা নিয়ে আঁকতে শুরু করে।
চোর কে তা অনুমান করতে রাঙাঠাম্মির অসুবিধা হল না। বিকেলেই তিনি রায়াদের
ফ্ল্যাটে হাজির। এসেই রায়াকে কোলে তুলে নিলেন। রায়া মোটেই কোলে উঠতে চাইছিল না।
বলছিল ,
প্লিজ ঠাম্মি, আমি এখন
আঁকছি! '
ঠাম্মি তবু
তাকে আদর করতে লাগলেন।
একসময় অবশ্য ঠাম্মির কাছে ছাড়া পেয়ে রায়া আবার আঁকার টেবিলে বসল। ঠাম্মি
সোফায় বসলেন। তারপর হাসতে হাসতে রায়ার মা অদিতিকে বললেন, ' আজ একজন আমার
আচার চুরি করেছে। তাকে আমি জানি। হাতের গন্ধ শুকে ধরতেও পেরেছি। কিন্তু কিছু বলব
না। চোর তো লজ্জা পেয়ে যাবে। বরং আমি কাল লঙ্কার আচার করে রাখব। চুরি করে খেয়ে চোর
খুব '
উঃ' ' আহ্ ' করবে, আর আমি দূরে
দাঁড়িয়ে তারিয়ে তারিয়ে দেখব।'
' মাসিমা আপনি হাসছেন! এ মেয়ে তো বড় হয়ে আস্ত চোর হবে! আমাদের মুখে চুনকালি
মাখাবে!'
অদিতি কটমট
করে রায়ার দিকে তাকান।
রায়া মনোযোগ দিয়ে তখনও এঁকে চলেছে। কারোর দিকে তাকাচ্ছে না।
আর রাঙা ঠাম্মি তখনও হেসে চলেছেন। ' কি যে বল না তুমি বউমা! সামান্য একটু আচার খেয়েছে ! …'
রাঙাঠাম্মির কথায় কান না দিয়ে অদিতি এবার গলা তুলে বলেন, ' এই রায়া, দেখি তোর
হাতটা! আমার কাছে আয়! '
রায়া না এসে কাঠের পুতুলের মতো বসে থাকে।
অদিতি নিজেই তখন উঠে গিয়ে রায়ার হাতটা শুঁকে দেখেন। হ্যাঁ,এই তো আচারের গন্ধ! সঙ্গে সঙ্গে রায়ার
কান ধরে হিড় হির করে রাঙা ঠাম্মির কাছে টেনে আনেন। রায়া ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে।
তবু অদিতি তাকে ছাড়েন না। রাগে রি রি করতে করতে বলেন, 'ঠাম্মির পা
ছুঁয়ে বল,
কক্ষনো আমি
আর এরকম করব না !'
রাঙা ঠাম্মি সঙ্গে সঙ্গে রায়াকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নেন। ' তুমি আবার
করবে সোনা । বারবার করবে। তবে আমাকে জানিয়ে। আমি চামচে করে তোমার হাতে তুলে দেব।
আচারে হাত দিলে বা ঘাটাঘাটি করলে তো আচার খারাপ হয়ে যায়। তাছাড়া তোমার
জন্যেই তো আচার করেছি। তুমি মাঝে মাঝে আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে খেয়ে আসবে।…'
রাঙাঠাম্মির কোনো কথাই রায়ার কানে যাচ্ছিল না। ঠাম্মির কোল থেকে নেমে সে
তখন মায়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছে। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছে, ' তুমি তাবলে
আমায় মারলে ! কোনোদিন তো মার না! বাচ্চাদের মারা তো অন্যায়, বেআইনী, তুমি জাননা?'...
' কি বললি তুই? ' মেয়েকে সঙ্গে সঙ্গে কোল থেকে নামিয়ে দেন অদিতি।
' হ্যাঁ,
কাল ই তো মিস
ক্লাসে বলছিল,
বাচ্চাদের
মারা অন্যায়,
বেআইনী !
স্কুলে,
বাড়িতে
কোথাও এটা করা উচিত নয়!...'
অদিতি রাঙাঠাম্মি দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন রায়ার দিকে। মেয়েটার কি
আইনজ্ঞান!
লেখক - পল্লব পত্রকার
দিব্য হয়েছে।
ReplyDeleteদারুণ।
ReplyDelete