1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 1, 2020

মধুচাঁদ


ডাঃ বিশ্বজিত ব্যানার্জি
পেশায় চিকিৎসক
নেশায় ফটোগ্রাফার  ভ্রমণপাগল
                  ধুচাঁদের আলো আর জগজিৎ সিং‘তুমকো দেখা তো ইয়ে খ্যয়াল আয়া, জিন্দেগী ধুপ তুম ঘনা সায়া’
ওয়াকম্যানে লাগানো ইয়ারফোন ভাগ করে শোনা  গান,সামনে অন্ধকার সমুদ্রে জ্বলন্ত ফসফরাস আর নির্জন বালুকাবেলা...চারদিক ভেসে যাচ্ছে মধুচাঁদের আলোয়..আজ পূর্ণিমা।
          সকালবেলা এসে পৌঁছেছি পুরীতে।গতসপ্তাহেই বিয়ের ঝঞ্ঝাট মিটেছে।তারপর বেরিয়ে পড়া।ভাবছেন হয়তো সব ফেলে পুরী।একটু বলি,সালটা ১৯৯৩,সেকালে বালি বলতে সবাই জানতো বেলুড়ের কাছাকাছি একটা জায়গাকে,মরিশাস শুধু ভূগোল বইয়ে পড়েছিলাম, দুবাই মানে ভয়ঙ্কর দাউদ।ইউরোপ?সে তো কোটিপতি বাবার ছেলেমেয়েরা বিয়ের পরে যায়..ফ্রান্স,ইতালি,লন্ডন,সুইজারল্যান্ড।আমরা অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেপুলে,সবে ডাক্তারি পাশ করেছি।অতো পয়সা পাবো কোথায়?আমার বাবা-মা হানিমুনে গেছিলো দীঘা, তাও বিয়ের পরে বাড়িতে লুকিয়ে!আমি একধাপ এগোলাম,পুরী,এবং বাড়িতে জানিয়ে!যাকগে সেকথা।বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলে গেলো আমাদের দুজনের স্বাধীন ভ্রমণ(বিশ্বাস করুন,আমি মায়ের এক ছেলে,আমায় কোনোদিন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে দেয়নি,স্কুলে তো নয়ই,কলেজেও নয়)।
          হাওড়া স্টেশনেই পৌঁছেই  চট করে দুজনে কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে নিলাম,স্বাধীনতা উদযাপন আরকি!(না,তখনো চিয়ার্স বলতে শিখিনি)।তারপর,কামরা খুঁজে,বার্থ খুঁজে ট্রেনে আরোহণ।আমাদের দুটো বার্থ,লোয়ার আর মিডল এবং কামরাটি নন এসি(আজকাল আমাদের চেনাপরিচিতরা কেউ ভাবতে পারবে?নন-এসি মধুচন্দ্রিমা!)।এর জন্য আমাদের অবশ্য কোনো অসুবিধে হয়নি,সারারাত গল্প করেই কেটে গেছিলো,শুধু আপার বার্থের কাকুর নাসিকাগর্জন ছাড়া।
স্টেশন থেকে সোজা হলিডে হোমে পৌঁছে তো চক্ষু চড়কগাছ...আমাদের জন্য যে ঘর বরাদ্দ হয়েছে সেটা বাড়ির একদম পেছনে এবং কোনো জানলা নেই,নতুন বউএর কাছে আমার প্রেস্টিজ এক্কেরে পাংচার শুধু নয় টায়ার বার্স্ট(সে আমার নতুন বউ,কিন্তু পুরোনো ইসেjকেয়ারটেকার দাদাকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তো সামনেরদিকের একটা ঘর জোগাড় হলো,কিন্তু সেখানে কোন প্লাগপয়েন্ট নেই,তাহলে আমাদের জগজিৎ সিংয়ের গজলের কি হবে?সঙ্গে আনা টেপরেকর্ডারটা কি বিফলে যাবে?(সেকালে হলিডে হোমে বিদ্যুৎ বাঁচাবার জন্য প্লাগ পয়েন্ট থাকতো না)।কিন্তু আমি তো দমার পাত্র নই।সঙ্গে ছিল এক্সট্রা তার,সেটার একপ্রান্ত লাগালাম বাল্বের ফাঁকা হোল্ডারে,আরেক প্রান্ত টেপ রেকর্ডারের সঙ্গে,ব্যস, সুইচ অন গান শুরু।(ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট বাঙালি বুদ্ধি।)
তো এইবার গুছিয়ে বসার পালা।জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে,ফুরফুরে হাওয়ায় আসছে।জানলা দিয়ে দেখলাম বাঁকে করে খাবারওয়ালা আসছে।তার কাছ থেকে চন্দ্রপুলি  আর রসগোল্লা খেয়ে আমরা তো মুগ্ধ।এই বছরের প্রথমেও একবার পুরী গেছিলাম,না,সেই খাবারওযালা,সেই চন্দ্রপুলি,সেই রসগোল্লা..কিছুই আর দেখিনি, তার বদলে দেখলাম বহুজাতিক পিজার দোকান এবং সাহেবের ভাজা মুরগির পসরা, সেগুলোর সঙ্গে গায়ে এসে লাগবে মেশিনের ঠান্ডা হাওয়া, সমুদ্রের হাওয়াটাও তার কাছে হেরে ভূত হয়ে গেছে,সেই মিষ্টিওলার মতো।যাক সে কথা,খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এলো।ঘুম ভাঙল গায়ে জলের ছাঁট লাগায়।শুয়ে আছি একদম জানলার ধারে, বারান্দার একদম শেষ প্রান্তে ঘর,জানলার কোলেই খাট এবং জানলাটি খোলা।দূরে তাকাতেই মন ভালো হয়ে গেলো।আকাশের গায়ে মেঘ,ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি,জলের চাদরের ওপারে সমুদ্রটাকে কিরকম ঝাপসা রহস্যময় লাগছে।মনটা কিরকম খারাপ হয়ে এলো,কোন কারণ ছাড়াই।এরকম এক বৃষ্টির দিনেই আমরা জলপাইগুড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে,ট্রেন আসছে,মফস্বল,তিস্তা নদী, খেলার মাঠের মাথায় জেগে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা ছেড়ে চলে যাচ্ছি কলকাতায়..বাবা ট্রান্সফার হয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের পুরোনো শহরে,সঙ্গে আমার ফুরফুরে নিশ্চিন্ত শৈশব, গিয়ে ভর্তি হবো বড় স্কুলে, হারিয়ে যাবে আমার ছোট্ট স্কুলের স্লিপ, দোলনা আর নদীর ধারের কাশফুল।আমি বড় হবো।চটক ভাঙলো আরেকজনের রিনরিনে গলার আওয়াজে ‘কিগো!আমায় ডাকোনি!বাইরেটা কি সুন্দর!উফফ!কি ভালো লাগছে!’
          ঘোর কাটলো এক কৌতূহলী দাদার প্রশ্নে ‘আপনারা কি আজ সকালে জগন্নাথে এলেন?’ওনার কৌতুহল নিরসনের পরেই চোখ গেল ঘড়ির দিকে(তখনো মোবাইলে ঘড়ি দেখা চালু হয়নি,কব্জিতেই সময় বাঁধা থাকতো),দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে হাঁটা দিয়েছে কাঁটাদুটো।এতো আর হোটেল নয় যে অর্ডার দিলে খাবার হাজির হবে,তাই বৃষ্টি কমতেই বেরোলাম খাবারের খোঁজে।কাছেই পেলাম এক  হোটেল,কলকাতাতেই নাম শুনেছি।দেখে খুব একটা ভক্তি না হলেও আমাদের হাতে আর কোন অপশন নেই।তাই দুজনে যা পারি অল্পবিস্তর গলাধঃকরণ করে চটপট আবার সমুদ্রের ধারে।চায়ের দোকানগুলো তখন সাজিয়ে বসছে,আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে।মধুচন্দ্রিমায় এসে কেই বা আর ভিড় চায়?শুরু করলাম হাঁটতে, দূরে দেখা যাচ্ছে লাইটহাউস,তখন স্বর্গদ্বার ছাড়িয়ে একটু দক্ষিণে গেলেই চারদিক ফাঁকা আর শান্ত,লাইটহাউসের ওখানে তো ধু ধু বালি,অপার সমুদ্র আর হাওয়া, মাঝে মাঝে শুধু একদুটো জেলেনৌকো,বালিতে নোঙর করা,বিশ্রাম নিচ্ছে।সেরকমই একটা নৌকোর ওপরে উঠে বসলাম দুজনে।আলো কমে আসছে,চারদিকটা কেমন কোমল,মায়াময়।মনে হলো এই পৃথিবীতে কোন দুঃখ নেই।
          কথায় কথায় সন্ধে এগিয়ে আসতে লাগলো,পূব আকাশে ধীরে ধীরে চাঁদ উঠলো..সে এক অপরূপ দৃশ্য।আমরা সাধারণতঃ সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকি,এই নিয়ে কতো লেখালেখি,কতো ছবি..কিন্তু চন্দ্রোদয়ের যে কি রূপ,কি সৌন্দর্য তা এদিন প্রত্যক্ষ করলাম।সূর্যোদয়ের মতো রঙের খেলা নেই,কিন্তু অপার স্নিগ্ধতা,চুঁয়ে পড়া আলো মনের মধ্যে এক নতুন বিস্ময় তৈরি করলো,এর জন্য আমরা তৈরি ছিলাম না,এ যেন এক অনামা শিল্পীর গলায় শোনা নতুন এক রাগসঙ্গীত। ফেরার সময় দেখি সমুদ্র ভাসছে চোখের জলের জোয়ারে,আকাশ জুড়ে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে আলো উছলে পড়ছে।
স্বর্গদ্বারের হোটেলে রাতের খাওয়া সেরে গুনগুন গুঞ্জনে পথ  এবং STD বুথে 'মা,বাবু বলছি,আমরা ভালো আছি' পেরিয়ে হলিডে হোমে ঢুকতেই ঝেঁপে বৃষ্টি এলো।কাল সকালেই রওনা হবো চিল্কা।
          পরের দিনের বাসজার্নিটা কোনোদিন ভোলা যাবে না।সকাল সকাল বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে জানলার ধারের সিট দখল করে বসলাম,টু বাই টু পুশব্যাক সিট,ভাবলাম বেশ আরামে আয়েস করে নিশ্চিন্তে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।কিন্তু মানুষ ভাবে হয়,আর হয় এক।যখন বাস ছাড়লো তখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে।সহযাত্রীদের বয়স তিন থেকে সাতাত্তর।ভর্তি বাসে চারিদিকে যাকে বলে Cacophony
'এই ছেলেটাকে সামলে রাখো না!'
'লুচির প্যাকেটটা সামনে এগিয়ে দে'
'জানলার বাইরে হাত দিস না বলছি'
'এই ধর ধর,জলের বোতলটা গড়িয়ে যাচ্ছে!'
আমাদের দুজনের তো চিঁড়েচ্যাপ্টা অবস্থা।কেউ মাথার ওপর দিয়ে আলুরদমের প্লেট পাস করছে,তো কেউ ডিমের সাইজ নিয়ে অসন্তুষ্ট।আমরা পড়ে গেছি এক বড় 'চলুন পাঁচ দিনে পুরী-কোনারাক-চিল্কা-ভুবনেশ্বর ঘুরে আসি' পার্টির মধ্যে,দুজনে একা।ভেবেছিলাম মধুচন্দ্রিমা,এখন মধু বা চন্দ্রিমা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,চারিদিকে শুধু তেতো বেসুরো ফিল্মি গান আর খটখটে রোদ্দুর।
         চিল্কা পৌঁছতেই লাফ দিয়ে বাস থেকে নামলাম।'কোথায় একটু শান্তি পাই বলতে পারেন?' তা মাঝিরা বললো 'কালিজাই দ্বীপে যান,মন্দির আছে,পাখি আছে,ভীড় নেই,নৌকোতে এই কুড়ি মিনিট মতো লাগবে'এই কুড়ি মিনিট যাওয়া ও ফেরা,চল্লিশ মিনিট,আমাদের আবার গল্প,ভালো লাগার জগৎ ফিরিয়ে দিলো।
চিল্কার ঠান্ডা হাওয়া,অপার জলরাশি,সি গালের ওড়াউড়ি..সব মিলিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো।পাড়ে ফিরে আসতে আসতে দুপুর।লেকের ধারের হোটেলে টাটকা পার্শে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার পর অনেকক্ষণ বসে রইলাম জলের ধারে একান্তে।আলো পড়ে এলো,আকাশের রং বদলাতে লাগলো।চটক ভাঙলো বাসের হর্ণের আওয়াজে,ফিরতে হবে।না,ফেরার পথে সহযাত্রীদের দম ফুরিয়ে গেছিলো,তাঁরা ঘুমিয়েই কাটালেন।যখন পুরীর হলিডে হোমে ঢুকছি তখন দূরে স্বর্গদ্বার সেজে উঠেছে আলোর পসরায়,বিকিকিনি শুরু হয়েছে।মনটা খারাপ হয়ে গেল।কাল আমাদের ফেরা।

                   biswajit67@gmail.com
                  কলকাতা 




4 comments:

  1. Bhishon shundor ...mugdho hoye gelam....aaro lekha dite thako....

    ReplyDelete

  2. খুব‌ই সাধারণ ভাষায় লেখা একটি অসাধারণ narration
    পরে ভীষণ ভালো লাগল









    ReplyDelete