...অভীক মণ্ডল
ঊনবিংশ
শতাব্দীর শেষ ভাগ | আসামের
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা,যশোর,হুগলী,নদীয়ার
গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে
পড়ল ভয়ংকর এক মারণব্যধি
| রোগের লক্ষণ বার বার
জ্বর আসা, ওজন হ্রাস,
রক্তাল্পতা, চামড়া কালচে হওয়া
, রক্তশূন্যতা | ভয়ঙ্কর এই রোগের
কোনও উপযুক্ত চিকিৎসা সেই সময় ছিল
না | অজানা রোগে মারা
গেলেন বহু মানুষ | আক্রান্ত
তারও বহুগুন | অচিরেই গ্রামবাসীরা আবিষ্কার
করলেন, এর থেকে রেহাই
পাওয়ার একমাত্র উপায় এলাকা ছেড়ে
পালানো। গ্রামের
পর গ্রাম অস্বাভাবিক দ্রুতবেগে
শূন্য হয়ে যেতে লাগল
| চারিদিকে আতঙ্কের পরিবেশ |
হ্যাঁ
ঠিকই ধরেছেন | রোগটি কালাজ্বর | লিশম্যানিয়া
গণভুক্ত এক প্রকার প্রোটোজোয়া
পরজীবী এই রোগটির সংক্রমণ
ঘটায় এবং বেলেমাছির কামড়ের
দ্বারা এই অসুখ বিস্তার
লাভ করে।
দায়িত্ব
দেওয়া হল নোবেল পুরষ্কার
বিজয়ী রোনাল্ড রসকে | তিনি বহু
গবেষণা করলেন | ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন দিয়ে
কালাজ্বর রোধ করার চেষ্টা
করলেন | না , কিছুতেই কিছু
হল না | মৃত্যুমিছিল বাড়তেই
থাকল | ব্রিটিশ সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ
পড়ল |
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ | এক
বাঙালি চিকিৎসক কালাজ্বরের বিরুদ্ধে শুরু করলেন তাঁর
ঐতিহাসিক সংগ্রাম | গবেষণার জন্যে পেলেন তৎকালীন
ক্যাম্পবেল কলেজের (বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল
কলেজ) একটি ছোট ঘর
| ঘরে জলের কল,গ্যাস
পয়েন্ট বা বিদ্যুত সংযোগ
কিছুই নেই। সম্বল
একটি পুরোনো কেরোসিন ল্যাম্প
| কিন্তু চিকিৎসক অবিচলিত |
ব্রাজিল
ও ইটালীর ডাক্তাররা তখন
দাবি করছিলেন , দক্ষিণ আমেরিকায় এন্টিমনিল
পটাসিয়াম টারট্রেট ব্যবহার করে কালাজ্বরে তাঁরা
ভাল ফল পেয়েছেন।কিন্তু তিনি জানতেন
ডাক্তার লোনার্ড রজার দশজন ভারতীয়
কালাজ্বরের রোগীর ওপর এই
ওষুধ প্রয়োগ করে সন্তোষজনক
ফল পাননি।
তিনি পটাশিয়মের বদলে সোডিয়াম ব্যবহার
করেন,কিন্তু সোডিয়াম এন্টিমনিল
টারট্রেট তেমন কার্যকরী হল
না।তখন
তিনি শুরু করেন বিশুদ্ধ
সূক্ষ্মচূর্ণ ও কলোডিয়াল ফর্মে
অ্যান্টিমনি তৈরির কাজ।
কয়েকমাসের মধ্যে হলেন এবং
অ্যান্টিমনি ধাতু ইন্ট্রাভেনাস উপায়
রোগীর দেহে প্রবেশ করানোর
যন্ত্রও উদ্ভাবন করলেন। কিন্তু
এই পদ্ধতির সমস্যা ছিল,অ্যান্টিমনি
ধাতু সহজ পাওয়া যেত
না,প্রতিবার প্রয়োজনের সময় তৈরি করে
নিতে হত |১৯১৯ সালে
তিনি ইন্ডিয়ান রিসার্চ
ফান্ড এসোসিয়েশন থেকে তাঁর গবেষণার
জন্য একটি বড় অনুদান
পান।অ্যান্টিমনির
অজৈব যৌগের নানা সীমাবদ্ধতা,সংরক্ষণের অসুবিধা,ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদির
কথা স্মরণ করে তিনি
ঠিক করেন অ্যান্টিমনি ও
জৈবযৌগের সংযোগ ঘটাবেন | রোগীদের
কষ্ট লাঘবের জন্য তিনি
ইউরিয়া ও পেন্টাভ্যালেন্ট অ্যান্টিমনি
সংযোগ করেন কারণ ইউরিয়ার
যন্ত্রণা উপশমকারী গুণের কথা আগেই
জানা ছিল।মূলতঃ
এই ভাবনার উপর ভিত্তি
করে তৈরি হয় ইউরিয়া
স্টিবামাইন - এক ঐতিহাসিক জীবনদায়ী
ওষুধ।
সেদিন
রাত ১০টা | গবেষণাগার ধোঁয়ায়
আচ্ছন্ন | গবেষণার ফলাফল দেখতে তিনি
প্রথমে ওষুধটি খরগোশের শরীরে
প্রয়োগ করেন ও লক্ষ্য
করেন তাঁর গবেষণালব্ধ ইউরিয়া
স্টিবামাইন কালাজ্বরের
বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ কার্যকরী | সাড়া পড়ে গেল
চারিদিকে | ইতিহাসে এক আলোকিত নব
দিগন্তের সূচনা হল |
১৯২৩ সালে ক্যাম্পবেল ও
কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কালাজ্বর
রোগীদের ওপর মাত্র ১.৫ গ্রাম ইউরিয়া
স্টিবামাইন প্রয়োগ করে আশাতীত
ফল পাওয়া যায় ।
আগে কালাজ্বরের চিকিৎসায় প্রায় ১২ সপ্তাহ
বা তারও বেশি সময়
লাগত,কিন্তু এই নতুন
ওষুধে মাত্র ২-৩
সপ্তাহের মধ্যেই কালাজ্বরের নিরাময়
সম্ভব হল। এই
ওষুধ কলকাতা সহ দেশের
বড় বড় মেডিকেল কলেজে ব্যবহার
হতে লাগল। সবচেয়ে
যা উল্লেখযোগ্য, কালাজ্বরে মৃত্যুহার ৯০% থেকে নেমে
এল ১০% এ | ১৯৩২
সাল পর্যন্ত আরোগ্যের সংখ্যা দাঁড়ায় আনুমানিক
পঞ্চাশ লাখ। অন্যান্য
দেশেও এই ওষুধের ব্যবহার
শুরু হয়।
তাঁর আবিষ্কারের কথা প্রথম প্রকাশিত
হয় 'ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চে'। কালাজ্বর
ছাড়াও তিনি ফাইলেরিয়া, ডায়াবেটিস,
কুষ্ঠ, মেনিনজাইটিস প্রভৃতি রোগ নিয়েও গবেষণা
করেছিলেন। প্রকাশ
করেছিলেন প্রায় ১৫০টি গবেষণা
পত্র।১৯২৮
সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত
তাঁর গ্রন্থ 'ট্রিটিজ অন কালাজ্বর' যেটি
আজও প্রামাণ্য গ্রন্থ বলে বিবেচিত
| জার্মান চিকিৎসাবিদ ডাঃ কার্লমেনস রচিত
চিকিৎসাবিজ্ঞান গ্রন্থের কালাজ্বর অধ্যায় তাঁরই প্রণীত।
উপেন্দ্রনাথ
ব্রহ্মচারী | জন্ম ১৯ ডিসেম্বর,
১৮৭৩ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের
অন্তর্গত জামালপুর গ্রামে | পিতা প্রখ্যাত ডাক্তার
নীলমণি ব্রহ্মচারী,মাতা সৌরভসুন্দরী দেবী। উপেন্দ্রনাথ
ছিলেন গোপাল ভারতী ব্রহ্মচারীর
বংশধর। গোপাল
ভারতী তাঁর অনুজ কেশব
ভারতীর কাছে দীক্ষা নেন
ও মুখোপাধ্যায় পদবী পরিবর্ত্তন করে
ব্রহ্মচারী পদবী গ্রহণ করেন। উপেন্দ্রনাথের
ছাত্রজীবন শুরু হয় জামালপুরের
ইষ্টার্ণ রেলওয়েজ বয়েজ হাইস্কুলে | এই
স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে
এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে তিনি
হুগলী কলেজে ভর্ত্তি হন।রসায়নশাস্ত্র
ও গণিতে অনার্স সহ
তিনি স্নাতক হন।
বি এ পরীক্ষায় গণিতশাস্ত্রে
প্রথম হন | প্রেসিডেন্সী কলেজে
রসায়ন নিয়ে স্নাতোকত্তর বিভাগে
ভর্ত্তি হন। ১৮৯৪
সালে রসায়ন বিদ্যায় প্রথম
শ্রেণিতে এম এ পাশ
করেন।
এরপর ভর্তি হন কলকাতা
মেডিকেল কলেজ | সেখান থেকে
মেডিসিন ও সার্জারিতে তিনি
প্রথম স্থান অধিকার করেন। পড়াশোনায়
বরাবরের মেধাবী ছাত্র উপেন্দ্রনাথ
'গুডিভ' ও 'ম্যাকলাউড' পদক
লাভ করেন। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি এম.ডি ও পিএইচডি
ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯০২ সালে তিনি এম.ডি ডিগ্রী অর্জন
করেন,যা ছিল সেই
সময়ের নিরিখে এক বিরল
সম্মান।উপেন্দ্রনাথের
গবেষণার মূল বিষয় ছিল
'লোহিত কণিকার ভাঙন'।
উপেন্দ্রনাথ
১৮৯৯ সালে প্রভিন্সিয়াল মেডিকেল
সার্ভিসে যোগদান করেন।
স্যার গেরাল্ড বমফোর্ড গবেষণায় তাঁর আগ্রহ দেখে
মুগ্ধ হন এবং তাঁকে
ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে অধ্যাপক হিসাবে
নিযুক্ত করেন।১৯০৫
সালে কলকাতা ফিরে এসে
তিনি ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে "টিচার অফ মেডিসিন
এন্ড ফার্স্ট ফিজিসিয়ান" পদে যোগ দেন।১৯২৩
সালে তিনি ক্যালকাটা মেডিকেল
কলেজে যোগ দেন।১৯২৭ সালে কারমাইকেল
মেডিকেল কলেজে প্রফেসর হিসাবে
যোগদান করেন | উপরোক্ত পদগুলি
ছাড়াও তিনি ছিলেন ন্যাশনাল
মেডিকাল ইন্সটিটিউটের ট্রপিকাল মেডিসিনের প্রধান , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রী
বিভাগের প্রধান এবং সাম্মানিক
অধ্যাপক।
ব্যক্তিজীবনে
উপেন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু
| ভূমিকম্প ত্রাণ তহবিল, বহু
সমাজসেবী সংস্থায় তিনি মুক্তহস্তে দান
করতেন | দরিদ্র রোগীদের কথা
ভেবে তিনি সরকারের কাছে
ইউরিয়া স্টিবামাইন কেনা দামে বিক্রি
করতেন ও এই ওষুধের
কোন পেটেন্ট তিনি নেননি।
ভারতবর্ষের
প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয়
ব্লাড ব্যাঙ্কটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উপেন্দ্রনাথ | শুধু তাই নয়,
তৎকালীন ভারতীয় রেড ক্রস
সোসাইটির প্রশাসনিক দপ্তরের প্রশাসক হিসেবে তিনিই ছিলেন
প্রথম ভারতীয়। ইংল্যান্ডের
রয়্যাল সোসাইটি অফ
মেডিসিনের সভ্য ছিলেন তিনি। ইন্দোরে
ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত হন
উপেন্দ্রনাথ। ভারতীয়
বিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃকও সম্মানিত হন উপেন্দ্রনাথ।
চিকিৎসাশাস্ত্রে
যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য উপেন্দ্রনাথ নোবেল
পদকের জন্যে মনোনয়ন পেয়েছিলেন
কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোনও
অজ্ঞাত কারণে তাঁর নাম
বাদ পড়ে যায় ।
ডাঃ উপেন্দ্রনাথ 'রায়বাহাদুর' ও 'নাইট' উপাধি
পান। কালাজ্বরের
ওপর তাঁর কাজের জন্যে
কলকাতা স্কুল অব ট্রপিক্যাল
মেডিসিন এন্ড হাইজিন তাকে
মিন্টো পদকে ভূষিত করে।এছাড়া
'এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল' তাঁকে
'স্যার উইলিয়াম জোন্স' পদকে সম্মানিত
করে। এছাড়াও
তিনি 'কাইজার-ই-হিন্দ'
স্বর্ণপদকও লাভ করেন।
নোবেল
পুরষ্কারের জন্য নমিনেশন,মারণব্যধির
অব্যর্থ ওষুধ আবিষ্কার, পৃথিবীর
দ্বিতীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক স্থাপন
করা -এত কীর্ত্তির ইতিহাস
খুব কম চিকিৎসক রচনা
করতে পারেন। ১৯৪৬
সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী এই
বিজ্ঞানসাধকের মহাপ্রয়াণ ঘটে।
উপেন্দ্রনাথ
ব্রহ্মচারী বাংলা ও বাঙালির
গর্ব | এই মহান মানুষটিকে
প্রণাম ও শ্রদ্ধার্ঘ্য |
তথ্যসূত্র-
উইকিপিডিয়া, গুরুচন্ডালি ব্লগ ও বঙ্গদর্শন
avik.mandal@iiml.org
কলকাতা
No comments:
Post a Comment