ধারাবাহিক গল্প (দুই )
![]() |
ছবি লেখকের নিজের আঁকা ....দিব্যেন্দু গড়াই |
এক-দুই-তিন, মোট তিনবার লাফিয়ে ঢিলটা কৃষ্ণদিঘির নীল জলে ডুব দিল। দু’দিন পর মেঘ কেটে গিয়ে আজ সূর্য উঠেছে। কিন্তু রোদের তেমন তেজ নেই। কেমন যেন মলিন আলোয় ঢেকে রয়েছে চারপাশটা। অঘ্রাণের মাঝামাঝি, এসময়ে বেশ শিরশিরে হাওয়া বয়। শঙ্কর একটা মাঝারি মাপের ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে জলে ছোঁড়ার মুহূর্তে খেয়াল করল, ও তো এতক্ষণ দিঘিতে কোন ঢিল ছোঁড়েনি। আর বিশেষ করে ‘ব্যাঙ লাফানো’র মত কোন ঢিল তো ছোঁড়ার প্রশ্নই নেই। তাহলে এই জনমানবশূণ্য জায়গায় ঢিলটা ছুঁড়ল কে? বাতাসের শিরশিরানি ভাবের সাথে একটা গা ছমছমে ভাব যোগ হয়েছে, সেটা বেশ টের পেল শঙ্কর।
*****
-‘মোগল আমলের এক
দয়ালু নবাব, ইদ্রিশ আলী এই
দিঘি খনন করেন। এ অঞ্চল তখন খরা-কবলিত। কৃষ্ণভগবান কে স্বপ্নে দেখেন সেই নবাব।
ভগবানের ইচ্ছামত মাত্র কুড়ি দিনে খনন কার্য সম্পন্ন হয় কৃষ্ণদিঘির। দিঘি তো খোঁড়া
হল, কিন্তু জল কই? তখন এক দরবেশের কথানুযায়ী নিঃসন্তান নবাব নিজের
সন্তানসম ভাগ্নের কুরবানি দেন। দিঘি ভরে ওঠে জলে। একেবারে টইটম্বুর।’
গ্রামের
দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত কৃষ্ণদিঘির পাড়ে বসে কথাগুলো বলছিল মাসা। বিড়ি ফুঁকতে
ফুঁকতে সেকথা শুনছিল বন্ধু শঙ্কর।
ছোটবেলা থেকেই
দুজনের খুব ভাব। এক স্কুলে পড়া, এক দলে খেলা,
এক সাথে বিড়ি-সিগারেটের
নেশা থেকে শুরু করে এখন কর্মস্থলও এক। সবেতেই দুজনায় মাণিকজোড়। শহরের বেসরকারী
আফিসে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে দুজনায়। একই বিল্ডিং-এ অফিস। ছোটবেলায় কতদিন এমন
হয়েছে শঙ্করের বাপ, অবনী সর্দারের
দলের কীর্তন শুনতে শুনতে মাসা ওদের বাড়িতেই থেকে গেছে। পালাকীর্তন, বাউল গান, লালন ফকিরের গান খুব আকর্ষণ করত মাসাকে।
মুসলিমদের মধ্যে এমন জিনিস সচরাচর চোখে পড়ে না। তাই ওর পাড়ার বন্ধুরা ওকে এড়িয়ে
চলত। তাতে মাসার লাভ বই ক্ষতি হয়নি। শঙ্করের সাথে বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়েছে। কীর্তন গানে
বুঁদ হয়ে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা, প্রশ্ন করত অবনী
জেঠুকে। শঙ্করের বরং অতটা আগ্রহ ছিল না নামসংকীর্তনে। শুনতে ভালো লাগত। ব্যস,
এইটুকু।
মাসখানেক আগে
ভোরবেলা ধানক্ষেতে যখন অবনী সর্দারের মৃতদেহ আবিষ্কার হল, মাসা তখন আফিসে। নাইট ডিউটিতে। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি
চলে এসেছিল। হাউহাউ করে কাঁদছিল ছেলেটা। শঙ্কর ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল সেদিন।
তারপর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই বিকেলে দুই বন্ধু মিলে কৃষ্ণদিঘির ধারে চলে আসে।
নিজেদের মধ্যে কথা হয় কম। মাসার গলায় গান শোনা যায় বেশী। কৃষ্ণদিঘির অতল জলের দিকে
নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে মাসা। কৃষ্ণদিঘির জলে নামা বারণ জেনেও কি যেন একটা প্রচন্ড
টান অনুভব করে। মনে হয়, এক্ষুনি নেমে
গেলে হয় জলে। মন শান্ত হবে। কিন্তু নামা হয় না। পাশেই সাইনবোর্ডের লেখা জ্বলজ্বল
করে,
“এ দিঘিতে কেউ ভুলেও নামবেন না। মৃত্যুর
সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ।” ওরা পাড়ে বসে থাকে যতক্ষণ না চারপাশটা আধোঅন্ধকারে ঢেকে যায়।
বড় বড় জাম-জারুল গাছগুলো বাসায় ফেরা পাখিদের কলরবে ঢাকা পড়ে গেলে উঠে পড়ে দুজন।
-‘জানিস শঙ্কর,
আমার খুব ইচ্ছে করে ঐ জলে
নামতে।’
দিঘির জলে ঢিল
ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল মাসা। ঢিলটা দুবার ব্যাঙ লাফিয়ে ডুবে গেল জলে।
-‘তুই কি পাগল হলি
মাসা। যারা ঐ জলে নেমেছে তারা কেউ আর উঠে আসেনি। বিষ-দিঘি কি এমনি এমনি নাম হয়েছে?
মারা তো গেছে অবশ্যই।
কিন্তু কখনোই তাদের মৃতদেহও ভেসে ওঠেনি। নিখোঁজ হয়ে গেছে চিরকালের মত। গরু-ছাগলরাও
এড়িয়ে চলে এই দিঘি। এসব জেনেও তুই আবোলতাবোল বকছিস?’ শঙ্করের স্বরে আতংক ফুটে উঠল।
-‘সেটাই তো
রহস্যজনক। তোর কি মনে হয়, মারা যদি যাবে
তাহলে মৃতদেহগুলো যায় কোথায়? আর তুইও লোকজনের
মত নামের ভুল ব্যাখা করছিস। কুড়ি দিন লেগেছিল এই দিঘি খুঁড়তে তাই নাম বিশ-দিঘি।
বিষ-দিঘি নয়।’
-‘কি জানি। তাই হয়ত
হবে। তবে আমার মনে হয়, কৃষ্ণদিঘির নীচে
কোন গহ্বর আছে। এতটাই গভীর সেই গহ্বর যে মৃতদেহগুলো আর ভেসে ওঠে না। ’
-‘হতে পারে। তবে
আমার মনে হয় অন্যকিছু রহস্য লুকিয়ে আছে ঐ দিঘিতে। কেমন জান টানে আমায়। চুম্বকের মত
আকর্ষণ করে।’
একদৃষ্টিতে
কৃষ্ণদিঘির কালো জলের দিকে তাকিয়ে বলল মাসা।
-‘তোর কথা শুনে ভয়
করছে আমার। এই জায়গায় এমনিতেই লোকজন কম আসে। আমি আর তুই ছাড়া বিকেলের দিকে কাউকেই
তেমন দেখি না এখানে। তুই কথা দে আমায়, কক্ষনো একা একা এখানে আসবি না।’ মিনতি
করে শঙ্কর।
শান্ত স্বরে মাসা
আশ্বস্ত করে শঙ্করকে। বলে,
-‘ জ্ঞানত আমি একা
আসব না এখানে। তবে, আমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার
কে? সবকিছুই নিয়তির হাতে।’
*****
আগের দিন সন্ধ্যে
থেকেই ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি। গত দুদিন ধরে জ্বরে ভুগে ঘরের মধ্যেই বন্দী ছিল মাসা।
ভোররাতে জ্বর ছাড়তে উঠে বসেছিল বিছানায়। জানালার বাইরে প্রকৃতি তখন কিছুটা শান্ত।
ঝড় থেমেছে। বৃষ্টিও। চারিদিকে ভেজা ভেজা গন্ধ। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রেল স্টেশনের দিকে
হাঁটা লাগিয়েছিল মাসা। চা-পিপাসা পেয়েছিল বড্ড। মাধব বৈরাগীর চা-এর দোকান ফার্স্ট
ট্রেণ ঢোকার আগেই খুলে যায়। এক ভাঁড় দুধ-চা খেয়ে শঙ্করের বাড়ির দিকে পা বাড়াল
মাসা। মিনিট কুড়ি পর যখন নিজেকে কৃষ্ণদিঘির ধারে আবিষ্কার করল, তখন সূর্যের লালাভ রঙে বিলের জল লালবর্ণ ধারণ
করেছে। মাসা একটু অবাকই হয়েছিল। তারপর নেমে গেছিল আঁজলা ভরে সিঁদুর-রঙা জল তুলতে।
এক পা-এক পা করে
দিঘির জলে নামছিল মাসা। অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছিল ওর। অপার শান্তি।
হাঁটু-কোমর-বুক-গলা জলে দাঁড়িয়ে জ্বরে ভোগা শরীরের সমস্ত ক্লান্তি নিমেষের মধ্যে
দূর হয়ে গিয়েছিল যেন। ডুব দিয়ে যখন উঠল তখন আকাশে সোনা রঙ। সূর্যের মিটিমিটি হাসি
দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা শরীরে বেশ চনমনে ভাব টের পেল মাসা। মনে মনে ঠিক করল,
এই দিঘি নিয়ে লোকের মনে
যে অন্ধবিশ্বাস তা দূর করতেই হবে। সুখবরটা সবচেয়ে আগে জানাতে হবে প্রাণের বন্ধু
শঙ্করকে। মাসা আজ দারুণ খুশী। শঙ্করের বাড়ির দিকে যেতে গিয়েই দেখতে পেল শঙ্কর
দিঘির দিকেই আসছে। উল্লাসে ফেটে পড়ল মাসা।
*****
গত কয়েকদিন জ্বরে
পড়েছিল ছেলেটা। কাজে যেতে পারেনি। রোজই খোঁজ নিত শঙ্কর। বুড়ি দাদী আর কতই বা সেবা
করতে পারে? তাই
ডাক্তার-ওষুধ-পথ্য, সব ব্যবস্থাই
শঙ্করই করত। গতকাল সন্ধ্যে থেকে নিম্নচাপজনিত ঝড়-বৃষ্টির কারণে বেরোতে পারেনি বাড়ি
থেকে। তাই আজ সকালে আকাশ পরিস্কার হতেই মাসার বাড়ি ছুটেছিল শঙ্কর। গিয়ে দেখে ও
বাড়ি নেই। দাদীও বলতে পারল না কোথায় গেছে। আশেপাশে খোঁজ করে যখন পাওয়া গেল না,
তখন কু ডেকেছিল শঙ্করের
মনে। দৌড় লাগিয়েছিল কৃষ্ণদিঘির উদ্দ্যেশে। কিন্তু না, সেখানেও মাসার কোন চিহ্ন পেল না। শঙ্করের কপালে
দুশ্চিন্তার ভাঁজ। গেল কোথায় ছেলেটা?
*****
মিনিট দশেক ধরে
শঙ্কর কে ডাকছে মাসা। চিল্লে চিল্লে গলা ব্যথা হয়ে গেল। কিন্তু শঙ্করের কোন হেলদোল
নেই। ও কি কালা হয়ে গেল? কাছে গিয়ে হাত
ধরল, তাও যেন ভ্রূক্ষেপ নেই। ও
কি রাগ করেছে? ইচ্ছে করে দেখেও
দেখছে না বন্ধুকে? তখনই মনে হল ঢিল
ছোঁড়ার কথা। শঙ্করের চোখের সামনেই মাসা ঢিল ছুঁড়ল। ঠিক তিনবার লাফিয়ে জলে ডুবে গেল
ঢিলটা। শঙ্করের মুখচোখ দেখে মাসা টের পেল ভয় পেয়েছে ছেলেটা। কিন্তু ভয় পাওয়ার কি
আছে? কারণ খুঁজতে গিয়ে মাসা
নিজেও ভয় পেতে শুরু করল এবার। প্রচন্ড ভয়।
dibyendugarai.dg@gmail.com
কলকাতা
দারুণ গল্পটা।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteখুব সুন্দর।
ReplyDeleteঅশেষ ধন্যবাদ
Deleteক্ষিতি যখন পড়োছি বুঝিনি এটা ধারাবাহিক হবে। অতি উচ্চমানের লেখা। দাদা তুমি অনেক দুর যাবে।
ReplyDeleteঅজস্র ধন্যবাদ। পঞ্চভুত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) সিরিজের পরপর পাঁচটি গল্প লেখার প্ল্যান আমার প্রথম গল্পের সময় থেকেই। চেষ্টা করছি গল্পগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। আপনার মত পাঠকের মন্তব্য উৎসাহিত করল। পরবর্তী গল্পে দেখা যাক নতুন কী আনতে পারি।
Delete