. ..মৈত্রেয়ী মুখার্জী
ছুটতে ছুটতে যখন
বাড়ি ঢুকলাম তখন নটা বেজে গেছে।আজ অফিসে একটু বেশি দেরিহয়েগেল,অনিতা দি দরজা খুলল।ঘরে ঢুকে বললাম ‘যাও তুমি
তাড়াতাড়ি বেরিয়েযাও,তোমার অনেক দেরি
হয়ে গেল।আসলে বছরের শেষ তো ।ব্যাঙ্কে খুব চাপ।কৃষি কি করছে?’ অনিতা দি শাড়ি ছেড়ে ব্যাগ নিয়ে বলল ‘খাওয়া হয়ে
গেছে,টিভি দেখছে।দাদা বাবু
সাড়ে আট টা য় ফোন করে খবর নিয়েছে।আমি এখন আসছি গো বৌদি। ‘কুড়ি টা টাকা ওর হাতে
দিয়ে বল্লাম’বাস স্ট্যান্ড অবধি রিকশ নিয়ে
নিও, তাড়া তাড়ি পৌঁছাবে।
দু বার কাজের
বদলে কৃষকে দেখা শোনা করার জন্য অনিতা দি কে পেয়েছি,কথা কম বলে আর খুব বাধ্য।আমার ছেলের বয়স আড়াই,দোতলা বাড়ির উপরতলায় শ্বশুড় শাশুড়ি থাকেন,বাতের ব্যাথায় কাবু।ওপর থেকে ই হাঁক দিয়ে খবরা
খবর করেন।কালেভদ্রে নিচে নামেন।সত্যি বলতে
সে রকম স্বদ্ভাব নেই।আমার সাথে প্রবালের বিয়েতে ওনাদের তেমন মত ছিল না। আমরা স্বামী স্ত্রী সকালে বেরিয়ে যাই,আমি আগে প্রবাল একটু পরে।আমার ফিরতে ফিরতে সাতটা,আর প্রবাল তো দশ টার আগে ঢোকে না।কৃষ কে দেখতে
তাই অনিতা দি ই ভরসা। সিসিটিভি লাগিয়ে
নিয়েছি।আজকাল সব পরিবারের তোএই এ্ক ই অবস্থা।
আগের মাসি অনেক কথা বলত,তার সাথে মুখ খারাপও করত,বারন করে ও লাভ হয় নি।এক দিন দেখি কৃষ বলছে ‘থালা’।তাকে পত্রপাট বিদায়
করি।পরের জন ছেলের খুব যত্ন করত কিন্তু আমাকে এত উপদেশ দিত- ছেলের জন্ম বার মাথায়
শ্যাম্পু দিও না,রোজ বিকেলে ওকে
ঘুরতে নিয়ে যাও,এক বয়সের বাচ্চাদের সাথে মেশাও ইত্যাদি।আর নিতে
পারছিলাম না তাকে,তাই তারপর অনিতা
দি কে আনা।ছেলে কে বিকেলে একটু ছাদে নিয়ে
যাওয়া ছাড়া ঘরেই রাখতে বলা আছে।যা ডেঙ্গু র ভয় চার পাশে পার্কে গিয়ে কাজ নেই।ঘরে ই টিভি বা
কম্পুটার চালিয়েই ওকে রাখা হয়।
ঘরে ঢুকে দেখি
কৃষ হাঁ করে কার্টুন দেখছে।ঝটপট বাইরের জামা কাপড় ছেড়ে টিভি বন্ধ করে ওকে বিছানায় নিয়ে এলাম,প্রথমে মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ জানালেও আজ
দুপুরে নাঘুমানোর কারনেও ১৫ মিনিটের ভিতর ওঘুমিয়ে পড়ল।আমি তখন ওর দুপুরের
খাওয়ারবাসন গুলো মেজে ফেললাম,আজ অনিতা দি টাইম পায় নি।খাটনি বেশ হলেও আমিএকজন
আদর্শ মা ভেবে বেশ গর্ব ও হল।ভাল লাগা তে
গুন গুনিয়ে একটা গান গাইতেলাগলাম ।
প্রবাল ঢুকল সাড়ে
দশ টার পর জিগেশ করল’ছেলে কখন ঘুমাল?’এই ঘন্টা খানেক আগে,তা আজ দুপুরে
ফোনে খোঁজ নাওনি কেন?’’আর বল কেন,বারো টার মিটিং টা এত ক্ষন টানলনা?সাড়ে আট টায় ফোন করেছি তো ।‘’হুম সেটা জানি,যাক গে কাল ছেলের জন্য মাগুর মাছ এন,ছোট সাইজের ,হাইব্রিড গুলো নয়।‘ ‘আচ্ছা লেডি হিটলার’ বলেই
প্রবাল আমার দৃষ্টিবান খেল’।তবে এটা ঠিক আমার
সংসারে সব আমার ইচ্ছা মত ই হয়।বাড়ির বাইরে গেলে ইছেলে শুধু মায়ের দায়িত্ব
এটা যাতে না ভেবে বসে তাই আমার কড়া
নির্দেশে দিনে তিন বার ফোন করে ওকে খোঁজ নিতে হয় ছেলের।
পর দিন সকালে
অফিস বেরনোর আগে হঠাৎ দেখি সামনের জানলা টা খোলা, পাঁচিলের ওধারেই একটা বস্তি,এর আগে এই জানলা টা খুলে ছেলে কে খাওয়া তো আগের
পাকা আয়া,আর বস্তির ছেলে
মেয়ে গুলো ওকে দেখে হাসত,আদর করত। মশার
ভয়ে জানলা বন্ধ করতে বলায় উনি আমায় বলেছিলেন
‘ছেলে টা কে ওরা খুব ভালোবাসে গো আর অদের সাথে তোমার ছেলে অনেক কথা বলার
চেষ্টা ও করে।‘দরকার নেই বস্তির ছেলেদের সাথে আমার ছেলের বন্ধুত্ব করে।তবে থেকে
জানলা টা বন্ধই থাকে। আজ খুলে অনিতা দি বকা খেল আমার কাছে।
দু সপ্তাহ বাদে
এক রবিবার প্রবালের এক বন্ধুর ছেলের ৫ বছরের জন্মদিনে আমরা সকলে মিলে গেলাম।কৃষ এই
প্রথম জন্মদিনের পার্টি তে এল।অনেক বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে ,বাচ্ছাদের জন্য অনেক রকম খেলার ব্যাবস্থা করা
আছে।নানান বয়সের বাচ্ছা রা ছুটোছুটি করছে।কিন্তু ছেলে কিছু তে ই কোথাও গেল না।বরং জোর করলে মাথা
ঝাঁকিয়ে না না করতে লাগল।আমি বললাম ‘ প্রবাল জোর কোরো না ও আগে ত এতো লোক কখন দেখে
নি তাই ভয় পাচ্ছে।‘
রাতে বাড়ি ফেরার
সময় গাড়ী তে বসে প্রবাল কে দেখলাম খুব চিন্তিত।জিগেশ করায় বলল’ দেখেছ ওখানে কৃষের
বয়সী দুটো ছেলে আধ আধ গলায় কত কথা বলছিল,
ওর এখন পৌনে তিন, ও তো সেরকম ভাবে কিছু বলছে ই না,আগে যে একটা দুটো কথা বলছিল সে গুলো ও এখন বলছে না।একদম এনজয় করল না ।‘ হুম;সে ও কখন এতো লোক একসাথে দেখে নি ত।‘’ কিন্তু
আমার মনে হচ্ছে ,চল ওকে একটা প্লে
স্কুলে ভরতি করি।আমার এক বন্ধু বলছিল একবয়সী বাচ্ছা দের সাথে থাকলে কথা শিখে
যাবে।‘ প্রবাল বলল।এই প্রথম আমি প্রবালের কথা মেনে নিলাম প্রতিবাদ না করে,মন টা খুচখুচ আমার ও করছিল।
পরের সোমবার
দুজনেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির কাছের প্লে স্কুল টা তে ছেলে কে ভরতি করতে এলাম,এই স্কুল টার ভালো ই নাম আছে।পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন। সুন্দর সব ছবি
আঁকা।প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মিসেস দাশ গুপ্তা র সাথে কথা বলেও বেশ ভালো লাগল।আজ এক
ঘন্টার জন্য ওকে রাখবে।কাল থেকে পুরো দু ঘন্টা।কাল থেকে অনিতা দির সাথে ই
আসবে।‘সপ্তাহ খানেক তো লাগবে ওর স্বাভাবিক হতে’ছেলের প্রচন্ড কান্না দেখে প্রায়
কাঁদ কাঁদ আমাকে সান্তনা দিয়ে বলল প্রবাল।
এক সপ্তাহ বাদে
কৃষের কান্না একটু কমায় আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম।ও সকালে অনিতা দি র সাথে রিক্স
করে স্কুল যেতে লাগল না কেঁদে।মাস খানেক বাদে
স্কুল থেকে মিসেস দাশ গুপ্তা র ফোন,পরের শনিবার সকাল দশটায় আমাদের দুজন কে ই কিছু
জরুরী বিষয়ে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন।নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দেখি আরো দু জন
বাবা মা র ও ডাক পড়েছে।ওদের দুজনের পর আমরা ওনার চেম্বারে ঢুকলাম। আমাদের বসতে বলে
উনি গভীর ভাবে তাকালেন।আচ্ছা মিসেস দাস আপনারা তো খুব ব্যস্ত কৃষি রাজ কার কাছে সারাদিন
থাকে?’কেয়ার টেকার আছে,আর আমি বাড়ি ফিরে পুরো সময় টা ওকে দেওয়ার
চেষ্টা করি-আমি বললাম।‘আচ্ছা,আপনারা বাড়ি ফিরলে ও কি খুশি হয়ে আপনাদের কাছে
চলে আসে,বা আপনি কথা বললে সরাসরি
চোখের দিকে তাকায়।কথা তো ও এখন তেমন বলছে না দেখলাম‘ ‘প্রবাল যখন ফেরে ও তো ঘুমিয়ে
পড়ে আর আমি ফিরলে কিছুদিন যাবত দেখছি ও
টিভি দেখতেই ব্যস্ত থাকে।‘ঠিক বলেছেন মিসেস দাস আমরা ওকে এক মাস দেখলাম।সব বাচ্ছা
ই কম বেশি টিচারের সাথে বা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ও কিন্তু এক কোনায় চুপ করে বসে
থাকে।মুখে কিচ্ছু বলে না আর নাম ধরে ডাকলে চোখের দিকে তাকায় না।তাই আমাদের মনে হল
আপনাদের সাথে বিষয় টা আলোচনা করা উচিৎ’মিসেস দাশগুপ্তা বললেন।
প্রবাল
বলল’ম্যাডাম আপনি কি বলতে চাইছেন একটু পরিষ্কার করে বলুন,আমার টেনসন হচ্ছে’।
মিস্টার দাস এই
গুলো,মানে আমি বলছি না আমি
পুরো সঠিক হয়তো বা অটিসম এর লক্ষণ ।এই নিজের মধ্যে মগ্ন থাকা চোখের দিকে না তাকানো,
কথা না বলা--না না আপনারা
অত উদ্বিগ্ন হবেন না। কৃষ সবে তিন বছরের হবে আপনারা একটু একজন শিশু সাইকোলজিস্ট এর
সাথে যোগাযোগ করুন।তিনি আপনাদের ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেবেন।‘
মাথায় আমাদের যেন
আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।আমার এক সহকর্মীর অটিস্টক ছেলে আছে,তাই এর সম্পর্কে একটু ধারণা আমার ছিল।মাঝে
মাঝেই সে ছেলের থেরাপির জন্য ছুটি নেওয়ায় অফিসে বহু লোক হয়তো আমিও খুব বিরক্ত
হতাম।হায় ভগবান শেষে আমার ছেলেও।
দু দিনের ভিতর
আমরা ম্যাডামের বলে দেওয়া সাইকোলজিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করলাম।উনি বললেন হয়তো এক ই
ঘরের মধ্যে আটকে থাকা,বাবা মা,দাদু ঠাকুমা কে অত টা কাছে না পাওয়া আর ওর সাথে
অত কথা না বলার কারনে ও নিজের চার পাশে এক টা জগৎ বানিয়ে নিয়েছে।তিন মাসের জন্য
কিছু বিহেভিয়ারাল আর প্লে থেরাপি ওর চলবে, যদি কাজ না হয় তাহলে আরো ছ মাস ।আমার নিজেকে এত অপরাধী লাগছে আমার কারনে ই
হয়তো ওর-- ,যাই হোক এখন
প্রতি সপ্তাহে একদিন ব্যাঙ্ক থেকে তাড়া তাড়ি বেড়িয়ে ওকে থেরাপির জন্য নিয়ে
আসি।আমার সেই সহকর্মী আমায় সব চেয়ে বেশি সাপোর্ট করছে ।
তিন মাস বাদে
আমায় থেরাপিস্ট ডেকে পাঠালেন বললেন’মিসেস দাস,নিশ্চিন্ত হন,আপনার
ছেলে অটিস্টিক নয়।ও অনেক ভাল রেস্পন্স করেছে।এখন দরকার আপনাদের সময় আর
ধৈর্য। ও হয় তো সম বয়সীদের থেকে কথা বলা বা কিছু শেখা তে অল্প পিছিয়ে থাকবে কিন্তু
তা তে চিন্তা নেই’।‘আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব,আর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কে ও।উনি সঠিক সময়ে
পাঠিয়েছিলেন আপনাদের কাছে ‘।‘হ্যা ঠিক বলেছেন।তাড়াতাড়ি ধরা পড়লে থেরাপি ভালো কাজ
করে-আর একটা কথা বাচ্ছা রা পাখির মত,ওকে ডানা মেলতে দেবেন।খাঁচায় বন্দি রাখবেন না’।
ছ মাস বাদে কৃষ
কে নিয়ে পার্কে এসেছি।এখন বৃষ্টি বাদলা ছাড়া রোজ আসার চেষ্টা করি।ও এখন অনেক কথা
বলছে।এখানে জনা পাঁচেক বন্ধু ও বানিয়েছে।কৃষ বল ছেড়ে দৌড়ে আমার কাছে এল’মা ফুক্কা
খাব’-এইপ্রথম ও পুরো লাইন সম্পূর্ণ করে কথা বলল।আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেল,ওকে কোলে তুলে নিয়ে বললাম’ চল আজ তেঁতুল জল
দিয়ে ফুক্কা খাব’।
maitreyee1980.mm@gmail.com
ভালো লাগল গল্পটা।
ReplyDelete