...দুর্গাদাস কুন্ডু
কিছুদিন থেকে মায়ের জন্য দীপনের, অর্থাৎ ডাঃ দীপন দে, ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের একজন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, মনটা কেমন কেমন করছে। মার বয়স হয়েছে, কানেও শোনেন কম, বাত ব্যাথা, বার্ধক্য জনিত জ্বালা যন্ত্রনা সবই আছে।কোনদিন কিছুই বলেন না। জিজ্ঞেস করলে বলবেন, " ভালই আছি, আমার জন্য ভাবিস না, আমি একশ বছর বাঁচব। হাসিও পায়
দুঃখও হয়। কোনদিন
কিছু চাইবেও না। সহ্য করার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে মায়ের। মা দীপনের কাছে থাকেন না,
থাকেন অন্য ভাইদের সাথে
সেই গ্রামের বাড়ীতে। দীপন মনে মনে ঠিক করল, বৃহস্পতিবার বিকেলে গিয়ে, শুক্র শনি থেকে রবিবার ফিরে
আসবে।
বুধবার টিকিট ও রিসার্ভেসন কেটে ফেলল,
যাবে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে
বাঁকুড়া। ট্রেনটিতে আজকাল বেশ ভিড় হয়,রিসার্ভেসন না
থাকলে বেশ কষ্ট হয়। বুধবার দিনই দীপন ভাইয়ের ফোন পেল- ভাই ফোন করে বলে যে মা কথা
বলবে। মা- কেমন আছিস?
অনেকদিন আসিস নি, ভাবলাম খবরটা নিই।
-- আগামীকাল তোমার
কাছে যাচ্ছি, রাত ৯ টায় তোমার
কাছে পৌঁছে যাব, তখন সব কথা হবে।
-- আমিও তাই
ভাবছিলাম।
এরকম এর আগেও অনেকবার হয়েছে- মা
দীপনের মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। মায়েরা কি করে যে এটা পারেন কে জানে। রাত্রে
দীপন ভাবছিল, মায়েরা
ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে, খিদে পেয়েছে কি
না, বুঝতে পারেন, এখন দেখছে মায়েরা ছেলেমেয়েদের মনের
কথাও বুঝতে পারেন। দীপনের অনিলের কথা মনে এল। অনিল এক সময় দীপনের স্টাডি পার্টনার
ছিল।
অনিল খুব ভাল
বন্ধু দীপনের। অনেক সময় নানা ভাবে সাহায্যও করেছে, গত বছর অনিল একাই দীপনকে প্রায় যমের বাড়ী থেকে টেনে নিয়ে
এসেছিল। অনিল থাকে বেহালায়, নিজের একটি বাড়ী
করেছে, মা সঙ্গে থাকেন, মায়ের বয়স যথেষ্টই হয়েছে।
দীপনের বাড়ী থেকে
ওদের বাড়ী অনেক দূর। তবু একদিন, প্রায় মাস দুই
আগে, দীপন ফোন করে বাড়ীর
ঠিকানা পথ নির্দেশিকা নিয়েছিল, যাবেও বলেছিল। কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠে নি,
দূরত্ব একটা কারণ নিশ্চয়ই,
কিন্তু তা ই এক মাত্র
কারণ হতে পারে
না, দীপনের কুঁড়েমি অবশ্যই একটা বড় কারণ ছিল। নিজের
মায়ের কাছে যাবার আগে, দীপন ভাবল একবার
অনিলের সাথে কথা বলে ওর মায়ের
খবরাখবর নেয়। ফোন করল, অনিলের মায়ের খবর
জিজ্ঞেস করল। যা শুনল, দীপন স্তব্ধ হয়ে
গেল -
'মাসীমা আর নেই।
যে সময় ওদের বাড়ীর ঠিকানা ও পথ নির্দেশিকা নিয়েছিল তার কয়েকদিন পরেই উনি গত হন। এ
কি নিষ্ঠুর পরিহাস!
দীপনের ভীষণ অনুশোচনা হতে লাগল, মনে হল যদি যেতেই
পারল না তবে কেনই বা ওদের বাড়ী যাবার ঠিকানা পথনির্দেশ
নিয়েছিল। ভেবেছিল নিজের মায়ের কাছ থেকে ঘুরে এসে ওনাকে দেখতে যাবে। কিন্তু হায়! তা
আর হল
না, যখন দীপনের ওনার কাছে যাবার কথা ভাবার সময় হল,
উনি রইলেন না, যখন উনি থাকলেন দীপনের যাবার অবসর হল না, নিজেকে বড় ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করল। কান্না এসে
যাচ্ছিল, বলতে ইচ্ছে করছিল,
" মাসীমা আর কটা দিন থাকলে
না কেন গো, আমি একবার দেখতে যেতাম, শুধু একবার দেখে আসতাম, নিজের কাছে নিজে দোষী হওয়া বড় কষ্টকর।"
সত্যি এটা
বড় অসহনীয়।
পরের দিন হাসপাতাল থেকেই দীপন বেরিয়ে
গেল প্রায় তিনটের সময়। যাবার সময় সহকর্মীদের কেও কেও বলল," সাবধানে যাবেন
"। মায়ের সাথে টেলিপ্যাথির কথাও কয়েকজনকে বলল। হাওড়া স্টেশন পৌঁছে দীপনের মনে
হল,
২
কাউন্সেলর সুমিতা
আর সুদীপাকে কিছু বলে আসা হয়নি। সুমিতাকে ফোন করল, বাড়ী যাচ্ছে বলে, সুদীপাকেও জানাতে বলল।
সুমিতাকে একথাও
বলল,
-- তোর কাকীমাকে ফোন
করে খবর নিবি, খেল কি না,
রান্না বান্না করছে কি না। আমি না থাকলে একজনের জন্য তোর
কাকীমা
রাঁধেও না, খায় ও না;
কি মুশকিল বলতো?
-- এটাই হয় স্যার,
একজনের জন্য আর রাঁধতে
ইচ্ছে করে না।
-- ও হরি, তাহলে তোকে আর এসব কথা বলে লাভ কি?
-- না, না, আমাদেরও তাই হয়, তাই বললাম।
-- আচ্ছা রাখি,
ট্রেন ঢুকছে।
-- সাবধানে যাবেন।
দীপনের সেন্টারের সবাই দীপনের চেয়ে
অনেক ছোট, একেবারে নিজের
ছেলেমেয়ে বলেই মনে হয়, দীপনের
সাথে সম্পর্কও
ভাল। ট্রেনে উঠে জীবনের মাকে ফোন করল। জীবন দীপনের পাড়াতেই থাকে, ওর একটা ট্যাক্সি আছে, দীপন
ওকে এবং ওর ছোট
দুই ভাই আর এক বোনকেও নিজের ভাইবোন মনে করেই দেখে, জীবনের মাকে মাসীমা বলে। দরকারে
পাশে এসেও
দাঁড়ায়। জীবনের মা ফোন ধরতেই দীপন একই কথা অনাকেও বলল। উনিও প্রায় একই কথা বললেন,
" এ
মেয়ে-জাতের ধর্ম,
সে যাকগে তুমি নিশ্চিন্ত
মনে যাও, আমি দেখব, মায়ের খবর এসে বোলো।
এর পর দীপন মেয়েকে মানে দীপনের বউমাকে ফোন
করে একই কথাই বলল, শুনে মেয়ে বলে,
-- তুমি আর কাকে
কাকে বলেছ?
-- জীবনের মা,
সুমিতা তারপর তোকে।
-- তুমি শান্তিতে
যাও না, এত চিন্তা করছ কেন,
আমরা তো আছি নাকি?
আর জীবনদার মাকে বলেছ যখন,
উনি দুবেলা এসে খোঁজ নিয়ে যাবেন, উনি একাই একশ। কিন্তু সুমিতাটি কে?
-- ও আমাদের সাথেই
কাজ করে, কাউন্সেলর,
তোর মতই বয়স হবে।
-- তুমি বড্ড বেশী
ভাব।
-- বেশ করি, দেখব দশ বিশ বছর পরে তুই কেমন ভাবিস, তখন এই কথা মনে রাখিস। অবশ্য তখন আমিই থাকব কি না তাই বা কে জানে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা
কর, তত দিন যেন বেঁচে থাকি,
আর যদি ফুটে যাই তাহলে এই ভাবাভাবির থেকে বেঁচে যাবি আর কি।
-- ঐ শুরু হল তোমার
বকবকানি, সাবধানে যেও,
চিন্তা একটু কম কর,
দিদার প্রেসার কেমন আছে
দেখে আসবে।
-- আচ্ছা।
ট্রেন ছাড়ল পাঁচটায়। এবার চার ঘণ্টা কি
করে। একটা গল্পের বই আনলে সময়টা বেশ কেটে যেত, কিন্তু দীপন তা একদম
ভুলে গেছে। সোনালীকে ফোন করল। সোনালী দীপনের স্ত্রী। বলল,
-- তুমি রাঁধবে এবং
খাবে।
৩
-- কেন এর আগে আমি
একলা থাকলে কি সব না রেঁধেই খেয়েছি?
-- তা অবশ্য সত্যি
নয়, কিন্তু এটা ভীষণ সত্যি যে
আমি না থাকলে তুমি রাঁধও না খাওও না। যাই হোক তোমার গুনের কথা আমি অনেককেই বলে দিয়েছি।
-- সে কি! কাকে কাকে
বলেছ?
-- জীবনের মা,
সুমিতা আর মিঠিকে।
-- তুমি এটা কেন
করলে? ওরা কি ভাববে বল তো?
-- কেও কিচ্ছু ভাববে
না, কেউই অনেক দুরের মানুষ নয়,
আচ্ছা ভাবত, কাল সকালে যদি দেখ পৃথিবীর সব মানুষ তোমার আপন হয়ে গেছে, কেমন হবে বলতো?
-- মোটেও ভাল হবে না,
সবাই আপন হয়ে যাবে,
আর তুমি হয়ে যাবে পর।
সেটা আমি কখনই চাইবনা, অন্ততঃবেঁচে থাকতে নয়। কিন্তু তোমার মাথায় হঠাৎ হঠাৎ
এরকম উদ্ভট উদ্ভট চিন্তা আসে কেন বলতো? যাকগে,সাবধানে যেও, মার শরীর ভাল করে দেখে আসবে, যদি আসতে চান নিয়েই এসো।
এতক্ষন ফোনফান করে দীপনের সময় তো ভালই
কাটল, কিন্তু এখন কি করে। এক
কাপ চা নিল,কিছু টিফিন নিয়ে
এসেছে, এখন ঠিক খিদে পায় নি,
আরও কিছুক্ষণ পরেই খাবে।
ট্রেন কিছুক্ষণ আস্তে আস্তে চলার পর জোরে চলতে
শুরু করেছে। জানালার ধারেই বসার জায়গা পেয়েছে, পড়ন্ত রোদ জানলা দিয়ে ঢুকছে। এরও একটা সৌন্দর্য আছে,
কতদিন কলকাতায় থেকে খেয়ালই
করেনি, সেই ছোটবেলায় করত,
মনে পড়ল, সূর্যকে একটা লাল থালার মত লাগছে,
এই রোদটা মিষ্টি, তেমন চোখে লাগে না। দূরে আকাশে ধুসর রঙের
মেঘগুলো নানা আকৃতি নিয়ে ট্রেনের সঙ্গেই ছুটছে,
একটা টুকরো মেঘের সামনের
দিকটা কতকটা শুঁড় তোলা হাতীর মত লাগছে। দীপনের মনে পড়ল ছোটবেলায় ওর আকাশ
দেখতে কি ভালই লাগত। সূর্য অনেকটাই নেমে গেছে, কিছুটা মাটির নিচেই চলে গেছে, এখন আরও সুন্দর লাগছে,
সূর্য যেন সারাদিন হেঁটে
হেঁটে ক্লান্ত হয়ে এবার বিশ্রাম নিতে চলল। যে কটা গাছ, বাড়ী, রাস্তা দেখা যাচ্ছে সবই
কেমন যেন রঙিন লাগছে। দীপনের বিশ্রাম তো দশটার আগে নয়, মার কাছে কিছুক্ষণ গল্প তো করবে, তাতেই কখন দশটা পেরিয়ে যাবে। এবার টিফিনটা খেয়ে
নিল। আরেক কাপ চা ও হয়ে গেল। অনেকটা
সময় এখনও কাটাতে
হবে। আসে পাশের লোকজনদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল, সবাই কথা বলছে, সব শোনাও যাচ্ছে,যার সারবস্তু হল,
স্বার্থই স্বর্গ। দীপনের
কাছে শোনার মত নয়। অবশ্য সব সময় এরকম হয় না। অনেক সময় এমন এমন মানুষজনও
পাওয়া যায়, যাদের সঙ্গে কথা
বলে সময় বেশ কেটে যায়, এমন কি কখনো কখনো
লেখার রশদও মিলে যায়। দীপনের
মনে পড়ে গেল, বেশ কিছুদিন আগে
স্টিল এক্সপ্রেসে জামশেদপুর যাচ্ছিল, বড় ভায়রার কাছে। ট্রেনে
দীপনের সামনের
সিটে যাচ্ছিলেন এক বয়স্ক মহিলা, তাঁর মেয়ে এবং
একটি বছর তিনেকের মেয়ে অর্থাৎ মা মেয়ে এবংনাতনী। বয়স্কা
মহিলার এই মেয়ে ছোট মেয়ে, বড় মেয়ের বিয়ে
হয়েছে বর্ধমানে, তারও একটি পাঁচ
বছরের ছেলে আছে।কোন একবার তিনি
বড় মেয়ে আর নাতি কে বর্ধমান পৌঁছে দিতে যাবার সময়ের কথা বলছিলেন। নাতির সামনে
পরীক্ষা বলে
বর্ধমান যাচ্ছে, নইলে দিদাকে ছেড়ে
কলকাতা ছেড়ে বর্ধমান যাবার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। সে বার বার
বলছে ,"
দিদা আমি কিন্তু পরীক্ষা
দিয়েই তোমার কাছে চলে আসব, দাদুকে পাঠিয়ে
দেবে কিন্তু, ভুলে যেও না
যেন।"
দিদা-- না,
না, ভুলে যাব কেন।
নাতি -- কোথাও
চলেও যেন যেও না।
দিদা -- না,
না, যাব আর কোথায়
নাতি -- মরেও
যাবে না কিন্তু।
দিদা -- আরে মরে
যাব কেন? মরে যাবার কথা
বলছিস কেন?
নাতি -- আমার
বন্ধু সুমন পরীক্ষা দিয়ে ওর দিদার বাড়ী গিয়ে দেখে, দিদা মরে গেছে। কেন মরে গেল বলতো?
দিদা -- বয়স
হয়েছিল তাই মরে গেল হয়ত।
নাতি -- না,
না, ভোর বেলা উঠে একলা একলা বাথরুমে গিয়েছিল,
হাগু হওয়ার পর মরে গেছে।
তুমি একলা একলা বাথরুমে যাবে না।
দিদা -- না,
না, একদম না, আমার এখন মরার সময়ই নেই, আমার কত কাজ আছে এখন! তোমাকে বড় করব, তারপর তোমার জন্য একটা টুকটুকে বৌ আনব,
তারপর না মরব।
নাতি -- ধ্যাত।
দিদা -- ওরে আমার
দাদু সোনার কি লজ্জা রে।
এই কথাবার্তার সময় সবাই খুব হেসেছিল,
দীপনেরও খুব হাসি
পেয়েছিল। ছেলেটি একটি খুব সত্যি কথা কিন্তু বলেছে,
যার সঠিক কারণ দীপনেরও জানা
নেই। বয়স্ক মানুষদের হার্ট এটাক বা স্ট্রোক ভোর বা সকাল বেলার দিকেই হয়,
এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে
বাথরুমেই হয়। আমাদের ব্লাড প্রেসার নাকি ভোর সকালেই সব চেয়ে বেশী থাকে।দীপনের অনেক
সময়েই মনে হয়েছে, এটা যখন সত্যি,
ব্লাড প্রেসারের ওষুধ তো
তাহলে রাত্রেই খাওয়া উচিত যাতে ভোর
বা সকালে প্রেসার
কম থাকে। কিন্তু প্রায় সব ডাক্তারবাবুই সকালে প্রেসারের ওষুধ খেতে বলেন। এ নিয়ে
দীপনের বন্ধুদের সঙ্গে
বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বাথরুমে মারা যাবার ব্যাপারে দীপনের এক বন্ধু কৌতুক করে
বলেছিল,-
-- আরে এতো নিউটনের
তৃতীয় সুত্র, টয়লেটে মল,
মুত্র, বায়ু নিচের দিকে নির্গত হয়, আর প্রাণবায়ু বিপরীত দিকে মানে উপর দিকে মানে স্বর্গের দিকে ধাবিত হয়,
অর্থাৎ মৃত্যু হয়। ঠিকই
হয়, বৈজ্ঞানিক সুত্র মেনেই
হয়।
এই রকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে
বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। আবার ফোন করে বাড়ীতে সবার সঙ্গে কথা
বলে কিছুটা সময় কাটল, একজনের খবরের
কাগজ পড়ে কিছুটা সময় কাটল। এক সময় পৌঁছে গেল।ষ্টেশনে এক ভাই
গাড়ী নিয়ে এসেছিল, মায়ের কাছে
পৌঁছাতে বেশী সময় লাগল না। মুখ হাত ধুয়েই মায়ের খাটে উঠে বসল, তার আগে মাকে প্রণাম করল। মা বেশ খুশী মনে হল।
সোজা মাকে প্রশ্ন-
-- এবার ঠিক করে বল
দেখি কেমন আছো?
-- আমার জন্যে ভাবিস
না, আমি ভাল আছি।
-- তোমার এই কথা
অনেক পুরনো হয়ে গেছে, কোন এডিশন ই হয়
নি।
-- তোরা কি চাস,
আমি খারাপ থাকি?
-- না, না, তা কেন; তুমি ভালো থাকলেই
আমিও ভাল। জানতো মা, আজকাল ' ভাল আছি ' বলার লোক
ভীষণ ভাবে কমে আসছে। যে কাউকে 'কেমন আছে' জিজ্ঞেস কর, বলবে, ' এই মোটামুটি আছি ' , কিম্বা ' এই কেটে যাচ্ছে ', ইত্যাদি।
সব অর্থ হীন কথা। কিন্তু এই অর্থহীন কথার প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।। এই
প্রশ্ন না করা মানে অভদ্রতা। অর্থাৎ তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের তাৎপর্য-হীন উত্তর।
-- তোকে এবার বেশী
ক্লান্ত মনে হচ্ছে না, বাড়ী থেকেই আসছিস?
-- না, না, সেই পাঁচটায় উঠেছি। সব কাজ কর্ম করে, হাসপাতাল করে আসছি। ট্রেনে যা বৃষ্টি পেলাম মনে হচ্ছিল কাক ভেজা হয়ে যাব। নামার সময় সব থেমে গেল।
-- ঐ আমি বর দিয়ে
দিলাম, আর বৃষ্টি থেমে গেল,
আর কি।
-- আর এতদিন এদিকে
বৃষ্টিই হচ্ছিল না, আমি বৃষ্টি নিয়ে
এলাম।
-- নে, এবার ওঠ, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়, সারা দিন ধকল তো কম যায় নি। এক কাপ চা খাবি?
-- আরে ধ্যুর,
একটু বস না, এবার একটা কায়দা করেছি, তোমার বউমা তো আমি না থাকলে রাধেঁও না, খায়ও না। এবার কয়েকজনকে রাঁধল কি না , খেল কি না, খবর নিতে বলেছি, আবার সেটা তোমার বউমাকে বলেও দিয়েছি।
-- ব্যস ক্ষেপে গেছে
তো? ওসব না করে সঙ্গে আনলেই
তো পারতিস, কতদিন দেখিনি,
আনলে ভালই লাগত।
-- ও খুব ব্যস্ত এখন,
ওদের কলেজে ছাত্র ভর্তি
হচ্ছে না এখন? আর বাড়ীতে কেও না
থাকলে মুশকিল, হুট করে দুদিনের জন্য বাড়ী পাহারা দেবার লোকও পাওয়া
যায় না। কিন্তু সে যাই হোক একলা থাকলে রাঁধবে না, বা খাবে নাই বা কেন?
-- ওটা মেয়েদের একটা
সাধারণ রোগই বলতে পারিস, কোন ওষুধ নেই,
অতএব চিন্তা করে লাভও
নেই।
-- যাদের বলেছি
তারাও মেয়ে, সবাই একই কথাই
বলেছে। জীবনের মাকে মনে আছে? ওনাকেও বলেছি।
-- তাহলে তোর কোন
চিন্তা নেই, উনি ঠিক খবর
নেবেন, উনি খুব ভাল মানুষ,
তদের খুব ভালও বাসেন। আর
বউয়েরপেটের চিন্তা ছেড়ে এবার নিজের পেটের চিন্তা
কর। খাবি আয়।
খেয়ে দেয়ে সোনালী কে একবার ফোন করে, সব খবরাখবর নিয়ে, দীপন শুয়ে পড়ল। শুতে শুতেই ঘুমিয়ে গেল।
ক্লান্ত তো ছিলই। ঘুম ভাঙতেই সকাল। ঘর থেকে বেরিয়ে আসল, আকাশটা কি পরিষ্কার, কেও যেন জল দিয়ে ধুয়ে রেখেছে,
বোঝা গেল গতকালের
বৃষ্টিতেই আকাশটা এত পরিষ্কার হয়েছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বেশ মিষ্টি
লাগছে।মুখহাত ধুয়ে স্নান করে নিল। হালকা করে কিছু জলখাবারও খেয়ে নিল।
দীপনের স্নান
করতে করতেই চিন্তা করে নিয়েছে কি করবে। ওর এক মাসতুতো বোনের কথা অনেকবারভেবেছে কিন্তু
কোন বারই যাওয়া হয় নি, এবার যাবেই।
মাসীও অনেকবার যেতে বলেছে। মাকে বলে বেরিয়ে পড়ল। ফোনও করল না, একেবারে সারপ্রাইজ দেবে।
প্রায় ঘণ্টা
খানেক বাসে গিয়ে মাসীর বাড়ী পৌঁছে গেল। একেবারে সারপ্রাইজ। একসাথে মাসী ও মাসীর মেয়ের সাথে
দেখা হয়ে গেল। ওরা হঠাৎ দীপনকে দেখে খুব খুশী। মাসীর মেয়ের নাম আনন্দ। আনন্দের দুই
মেয়ে।দুজনেরই বিয়ে হয়ে
গেছে। ছোট মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা,ওর বরও স্কুল
শিক্ষক। বড় মেয়ের বর ইঞ্জিনিয়ার , বেঙ্গালুরুতে থাকে। আনন্দের
একটিই ছেলে, সে কলকাতায় চাকরি
করে। মেয়ে জামাইদের ছবি দেখলাম। মেয়েরা যেমন সুন্দর,জামাইরাও বেশ
সুন্দর দেখতে, বেশ মানিয়েছে।
বাড়ীটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, দক্ষিণ দিকে ছোট
এক টুকরো বাগান।
বাগানে আম,
পেয়ারা, কাঁঠাল, পেঁপে ইত্যাদি গাছ আছে। বেশ ভাল লাগল, এত দিন পড়ে দেখা, না খাইয়ে কি ছাড়ে।
বললাম,
" শন আমার মত পেট রোগাকে
খাইয়ে লাভ নেই, খেয়ে আমি পর্যন্ত
কাওকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি, না মা,না শাশুড়ি,
না বৌ; তুইও সন্তুষ্ট হবি না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি।
-- ওসব জানি না,
তুমি শুধু পাঁচ মিনিট বস,
আমার সবই করা আছে,
শুধু একটু ফিনিশ টাচ দিতে
হবে।
-- শোন না, আমাকে শুধু দুটো রুটি আর একটু তরকারি দে,
তাতেই হবে, আর তোরাও বসে পড়। মাসীর কি খাওয়া হয়ে গেছে?
-- হ্যাঁ মায়ের
খাওয়া হয়ে গেছে। তুমি একটু চুপ করে ঘরে পাখা চালিয়ে বস না।
-- তোর বাগানটা বরং
ঘুরে ঘুরে দেখি একটু। আর তোর ছেলের ফোন নম্বর দে, ফোন করি।
-- তাই কর, ও অবাক হয়ে যাবে। ফ্রিজের ওপরে দেখ একটা কালো
রঙের ডায়েরি আছে, ওতে সবার ফোন
নম্বর আছে।
দীপন ছেলেমেয়েদের ফোন করল,
কারও মুখই দীপনের মনে নেই,
ওদেরও তাই। শুধু
পরিচয় দিয়েই
কথাবার্তা হল। কিন্তু কথা বার্তা এমনই হল যেন মনে হল ওরা সামনেই আছে, পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছে।দীপন, আনন্দ এবং ওরা সবাই খুব খুশী হল।বলল,
" নে এবার খেতে বস।"
-- হ্যাঁ, বসে পড়ো, হয়ে গেছে। দীপনকে
খেতে বসিয়ে দিল; ওকেও বসতে বলল,। কিন্তু ওর মতলব অন্য, ও দীপনকে খাইয়ে পর খাবে।
দীপণ- -সে তো
হবে না। আমার সঙ্গে এখনই যদি না বসবি তো
আমি খাবই না। সঙ্গে বসেই যা না, কতদিন পরে ভাইবোনএক সাথে খাব।
ছোটবেলায় তো এরকম বলতে হত না রে, বড় হয়েই
বড় সমস্যা হয়েছে। ছোট হয়ে যা, শান্তি পাবি।
৯
এতে কাজ হল,
খাবার নিয়ে এসে দীপনের
সামনেই বসল। বলল--
-- তুমি বেশ কথা বল।
-- কেন আমার কথা ভাল
লাগে নি?
-- ভাল লেগেছে তো নিশ্চয়ই।
-- আমি ভাল মানুষ,
ভাল কথা বলব না? কি যে বলিস।
-- তোমার শরীর ঠিক
আছে তো?
-- সব ঠিক আছে,
এই তরকারি টা কিসের রে,
বেশ ভাল লাগছে তো।
-- কিসের বল তো,
ছোটবেলায় অনেক খেয়েছ,
দাদু নিয়ে আসত, দিদা প্রথমে রেগে যেত, তারপরে রান্না করে দিত।
-- আমার মনে নেই,
সব ভুলে গেছি, কিন্তু দাদুকে ভুলিনি।
-- এটা ছাতু,
আর এটা কিসের তরকারি বল
দেখি, এটাও ছোটবেলায় আনেক
খেয়েছ।
-- খেতে তো বেশ ভাল
লাগছে, যত দূর মনে হয় শামুকের
তরকারি।
-- একদম ঠিক। লক্ষী
মাসী পুকুর থেকে নিয়ে আসত, একেবারে রান্না
করার জন্য সব ছাড়িয়েই দিত।
-- লক্ষী মাসী কে
আমার খুব মনে আছে, খুব ভাল মানুষ
ছিল। তোর বৃষ্টিতে ভিজে মাছ ধরা মনে আছে?
-- খুব মনে আছে।
মেসোমশাই কোত্থেকে ঠিক খবর পেয়ে ছাড়তেন এক হুঙ্কার, আর তুমি সব ফেলে দিয়ে ছুটে পালাতে, আর আমি তোমার মাছ মাসীকে দিয়ে আসতাম, নয়তো লক্ষী মাসীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতাম। তবুও তো মাঝে মাঝে মেসোমশায়ের কাছে কি মারই না খেতে!
দেখে আমাদেরই কি কষ্ট হত।
-- আমার সব মনে পড়ছে,
বাবার মার মনে করলে এখনও
যেন পিঠ টন টন করে ওঠে। এটাও মনে আছে কখনো কখনো
মামা কোত্থেকে খবর পেয়ে চলে এসে, বাবার কাছ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিতেন, সে যাত্রা বেঁচে যেতাম। মা তো বাবাকে থামাতেই পারত না, শুধু দেখত, আর কাঁদত। মা কিন্তু আমাকে কোনদিন মারে নি।
তোদেরও কোনদিন মার
খেতে দেখিনি কারও কাছ থেকে। তোরা কি
ভাগ্যবান! বাবার বড্ড বেশী রাগ ছিল, এমন কেও আছে যে ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভেজেনি!
-- ঠিক বলেছ,
তোমার মার খাওয়া দেখলে
আমারই কান্না পাওয়ার জোগাড় হত, আরেকজন মানুষও
কাঁদত, আমি দেখেছি।
১০
-- আমি জানি,
লক্ষী মাসী আড়ালে চুপচাপ
কাঁদত। সে তো আমাদের কেও না, কাজের লোক,
তারও কষ্ট হত।
-- লক্ষী মাসী
তোমাকে, বিশেষ করে, খুব ভালবাসত। মেসোকে আমরাও খুব ভয় পেতাম। চল
খাওয়া হয়ে গেছে , উঠে হাত ধোও। আমি সব একটু গুছিয়ে যাচ্ছি।দীপন হাত মুখ ধুয়ে সোফায়
বসল। কিছুক্ষনের মধ্যেই বোন একটু মৌরি দিল, একটু নিয়ে মুখে দিল, বলল--
-- তোর কাছে এসে খুব ভাল লাগল রে। এই বুড়ো বয়সে
ছোটবেলাটা একবার ঘুরে এলাম, যেন এলাম,
খেলাম, কাঁদলাম আর ছোটবেলাটা একবার ঘুরে গেলাম।
-- কোথায় আর খেলে? একটু ফোন করে আসবে তো।
-- না রে আমি এরকমই খাই, বয়স হচ্ছে না? শরীর ভারী হয়ে গেলে আবার হাঁটুর সমস্যা হবে তো।
বাত সে তো পৈত্রিক সম্পত্তি। আর কিছু সম্পত্তি পাস বা না পাস
এ টা পাবিই।
-- ঠিকই বলেছ, বউদিও তোমার মত, খুবই কম খায়, তোমাদের সবেতেই বেশ মিল, নিয়ে আসলে না
কেন? সেই কবে ছোট মেয়ের বিয়েতে এসেছিল, এক বেলা মাত্র ছিল। একদিন দুজনেই এসো, হাতে সময় নিয়ে, খুব ভাল লাগবে।
বউদির কত গুণ।
-- তার চেয়ে তুই চল না আমার সঙ্গে; কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে যাবি। এটুকু বলতে
পারি তোর বেশ ভালই লাগবে।
-- তা লাগবে জানি, তবু উপায় নেই। ও কিছুদিন আগে এমন পিঠের ব্যাথায়
কষ্ট পেল কি বলব। দিন সাতেক পুরো বিছানায়; চিকিৎসা করে এখন কিছুটা কমেছে। কিন্তু সাইকেল
চড়া, ভারী জিনিষ তোলা বা বওয়া
বারন। তাহলে দেখলে তো সংসার করা মানে ইচ্ছার পায়ে
বেড়ি পরানো।
-- ঠিকই বলেছিস, একদম ঠিক। মনটাকে যেখানে খুশী যখন খুশী নিয়ে
যাওয়া যায়, কিন্তু শরীরটাকে
নয়, শরীর সংসারে সব দিক থেকে নোঙর করা থাকে তো, নড়ানো বড় মুশকিল। শেষ বাসটা কটায় রে?
-- চার টায়, কিন্তু কেন? তুমি আজ থেকে যাও, কাল যাবে, অনেক গল্প বাকি রয়ে গেল যে!
-- হাঁ, গল্প সব সময় বাকিই থেকে যায়, ওরা শেষ হবার নয়।
ওরা যেন আকাশের মেঘ, কতকগুলো মাঝে
মাঝে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে, বাকি গুলো ভাসতেই থাকে, শুধু সময়ের আপেক্ষায় থাকে, জোর করে নামান যায় না, জোর করে নামানোর চেষ্টাও করা উচিত নয়। পরে
আবার কোন এক দিন এমনই দেখা হয়ে যাবে, তখন বাকি কথাগুলো হবে। এখন চলি রে, মা অপেক্ষা করবে। এখনই না বেরলে বাসটা মিস করব।
মাঝে মাঝে ঘড়ীকে মনে হয় সবথেকে বড় শ্ত্রু।
-- ঠিকই বলেছ। তুমি আসলে ঝড়ের মত, চলেও যাচ্ছ ঝড়ের মত; শুধু মনের কোঠায় সাজানো স্মৃতিগুলোকে করে দিয়ে গেলে সব এলোমেলো। এসব আবার
থিতিয়ে যেতে লাগবে অনেকটা সময়।
-- এটাই নসটালজিয়ার জ্বালা।
মাসীকে প্রণাম করে,
আশীর্বাদ নিয়ে দীপন
বেরিয়ে গেল আনন্দের বাড়ী থেকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাস পেয়ে গেল,
প্রথমে বসতে না পেলেও
কিছুটা যাবার পর বসার জায়গাও পেয়ে গেল। জানলা দিয়ে দেখতে পেল মাঠে জল
জমেছে, মনে হল গতকাল ভালই বৃষ্টি
হয়েছে। এ বছর বর্ষার প্রথম দিকে বৃষ্টি ভাল না হলেও এখন হচ্ছে, যদি এরকমই বৃষ্টি হয়ে যায় চাষ মনে হয় হয়ে যাবে।
কিছু কিছু জায়গায় বীজতলা ফেলেছে চাষীরা, আবারকোন কোন জায়গায়
জমি তৈরী করছে। এখন লাঙল নিয়ে বাড়ী ফিরছে,
মনে হয় আশা নিয়েই ফিরছে।
আশা ছাড়া করারই বা কি আছে,
আশা নিয়েই তো মানুষ
বাঁচে। দূরে পড়ন্ত সূর্যকে বেশ মিষ্টি লাগছে দেখতে। হয়ত আশার
আভাসই দিচ্ছে।
আকাশে ছড়ান মেঘগুলো থেকে থেকে এ ওর কাছে গিয়ে কি শলাপরামর্শ করছে কে জানে। কোন কোনটা আবার
জ্ঞানী পণ্ডিতের মত গুরু গম্ভীর হ্যর বসেই আছে।
এ রকম ভাবতে ভাবতে
বাড়ী চলে এল দীপন; মা কে সব বলল। মা
বললেন, " আজ একটু বিশ্রাম নিলেই
পারতিস।"
-- এই তো আজ রাত আর
কাল সারাদিন বিশ্রাম।
দীপন তাড়াতাড়ি খেয়ে
শুয়ে পড়ল। রাত্রে মনে হল অম্বল হয়েছে। সকালে উঠতে ভাল লাগছিল না। অনেক ক্ষণ
শুয়েই রইল; বেলা করে স্নান
টান সারল কিন্তু আবার শুয়েই রইল, মা কে কিছু খাবে
না বলল, কিছু ওষুধ পত্র খেল।
কখনো ঘুমিয়ে কখনো জেগেই কাটাল। মা বার বার দীপনের কাছে আসছে, কখনো মাথায় হাত দিচ্ছে, বোঝার চেষ্টা করছে, জ্বর এল কি না। কখনো জিজ্ঞেস করছে, কি কষ্ট হচ্ছে। দীপন যতই বলে, তেমন কিছু না, মায়ের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। অনেকবার মায়ের
হাত থেকে সরবত খেল। দীপন ভাল হয়ে উঠছে, কিন্তু যেহেতু
সারাদিন প্রায়
শুয়ে, মা চিন্তিত। মায়ের
গতিবিধি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মা যথেষ্টই চিন্তিত, মায়েদের চিন্তার শেষ নেই। নিজেকেই আবার
অপরাধী ভেবে না বসে। মা হওয়ার এও এক জ্বালা। দীপন যতই শুয়ে থাকবে মায়ের চিন্তাই
শুধু বাড়বে। মা দীপনের
কোন কথাই বিশ্বাস করতে পারবেন না। তাই দীপন উঠে পড়ল, কয়েকটা ফোন করল। মায়ের প্রেসার দেখল।
মায়ের ওষুধ পত্র গুলি একবার দেখে নিল, কিছু কিনে এনে দিল, এবং বুঝিয়ে দিল।
ভাইপো ভাইঝি দের
সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করল। তারপর মাকে বলল,
" এবার বিশ্বাস হচ্ছে তো
আমি ভাল আছি?"
-- হচ্ছে, হচ্ছে। দুয়েকদিন থাকবি তো?
-- না,না কাল সকালেই রওনা হব। তুমিও চল না, কিছুদিন আমদের সঙ্গে থেকে আসবে। তোমার ভাল
লাগবে এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি।
-- ইচ্ছে তো করে, ভীষণই করে, মাঝে মাঝে মনে হয় বরাবরের জন্যেই চলে যাই।
-- তবে চল, বাধা কোথায়? আসার সময় সোনালী তো বলেইছে,তুমি রাজী থাকলে নিয়ে যেতে।
-- তুই তো তোর কাজ নিয়ে থাকবি, বউমা তার কাজ নিয়ে থাকবে; তোর ব্যাটা তো বাইরে, নাতবউ তার বাপের বাড়ীতে, আসলেও সেও তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আমি হয়ে
যাব একেবারে নিঃসঙ্গ। তাছাড়া আমি চলে গেলে এই নাতি নাতনীদের কি হবে? কে দেখবে? এদের নিয়েই তো আমার সারাটা দিন চলে যায়।
-- তোমার কথা বুঝলাম। তোমার যেখানে ভাল লাগে,
সেখানেই থাক। আনন্দকেও
আমার সঙ্গে যেতে বলেছিলাম কিছুদিন আমাদের সঙ্গে থাকতে বলেছিলাম। তাতে
বেশ সুন্দর একটা কথা বলেছে।
-- কি বলেছে?
-- বলল, কি করে যাই, সংসারের বাধায় যে
জড়িয়ে পড়েছি। সংসার করা মানে মনের পায়ে বেড়ী পরান।পরানোর পর আর খোলা যায় না।
-- ঠিকই বলেছে,
বেশ সুন্দর বলেছে।
-- রবীন্দ্রনাথের একটা গান মনে পড়ছে - " জীবন
আমার চলছে যেমন তেমনই ভাবে সহজ কঠিন দ্বন্দে ছন্দে কেটে যাবে।"
-- ঠিক, ছন্দ সবার আলাদা আলাদা।
রাত্রে দীপন সামান্য
কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ল, ভোরবেলা উঠে মুখ
হাত ধুয়ে সব গুছিয়ে নিল।
মা কে প্রণাম
করল। মা বলল, " আবার আসবি"
-- আসব তো নিশ্চয়ই। তুমি মনে মনে ডাকলেও চলে আসব।
এই বলে দীপন
বেরিয়ে পড়ল। পথে মনে হল- যার যেখানে বেড়ী বাঁধা, সেখানে তো ফিরতেই হবে। সচরাচর এর
কোন ব্যতিক্রম হয় না।
d_kundu1950@rediffmail.com
No comments:
Post a Comment