...সংযুক্তা ঘোষ
একবার দুপুর
নাগাদ বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম । কিছুক্ষণ পর তাদের অহেতুক
ফাজলামিতে আমার অকারণ বড্ড রাগ হয়ে বসল । তখন বাড়ি থেকে সাত/আট কিমি দূরে । রাগটা
যে জমাটি হয়েছে , সেটা বোঝাতে আমি
সাইকেল ছুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম । ভেবেছিলাম ওরাও পিছনে আসবে , কিন্তু কিছুটা পর দেখলাম কেউই আসছেনা । তখন
ক্লাস নাইন , বন্ধুদের কাছে
ফিরে যাওয়াটা আমার বিজ্ঞ বুদ্ধি অনুচিত বলে ঘোষণা করলো । তো আমি বাড়ির পথেই ফিরতে
লাগলাম । গ্রামের রাস্তা এমনিতেই মোটামুটি খালি , দুপুরের রোদে তো পুরোই ফাঁকা । একটু পর থেকেই
আমার ভয় ভয় করতে লাগল । যত এগোচ্ছি নির্জন রাস্তা আমায় ততই ভয় দেখাচ্ছে । বন্ধুদের
ওপর আর নিজের ওপর রাগে তখন চোখ ভিজে । ভগবানকে মনে মনে ডাকছি ' প্লিজ তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দাও ' । হঠাৎ দেখলাম একটি লোক আমার সামনে সাইকেল নিয়ে
চলেছেন । আমি কিছু না ভেবেই তার পিছু নিলাম । মনে মনে ভাবলাম , লোকটি যেন আমার বাড়ির পথেই আর তিন/চার কিমি যান
। তারপর আমি একা চলে যেতে পারবো , এদিকটা বড্ড
অচেনা । চার কিমি টপকানোর পর ভাবলাম লোকটি যদি আরো দু/এক কিমি যান তো ভালোই হয় ।
ততক্ষণে আমার ভয়টাও অনেকটা কেটে গেছে । আরো দু কিমি যাওয়ার পর ভাবলাম লোকটির বাড়ি
বেশ আমার বাড়ির পরে হয় ! আরো কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তা দুভাগ , লোকটি হঠাৎ দাঁড়ালেন । আমি একেবারেই পিছনে
ছিলাম বলে আমাকেও দাঁড়াতে হল । লোকটি তখন আমায় জিজ্ঞেস করলেন -- " কোনদিকে
যাবে " ? আমি অবাক হয়ে দাড়িয়ে আছি । তিনি বললেন --
" আর কতটা ? দুপুরবেলা এভাবে
একা আসছ তাই জিজ্ঞেস করছি " । আমি
বললাম আর বেশি না , ডানদিকে এক/দেড়
কিমি মতো । লোকটা ' চলো ' বলে আবার সাইকেলে চড়লেন । অমি জিজ্ঞেস করলাম
" আপনি কতদূর যাবেন " ? লোকটি উত্তর দিলেন -- " আমার বাড়ি চার
কিমি আগেই পার হয়ে গেছে , তুমি একা আসতে ভয়
পাচ্ছ মনে হল তাই এলাম " । বাকি রাস্তাটাও আমি তার পিছনেই এসেছিলাম , নির্ভয়ে । ভীষণ ভালোলেগেছিল আমার সেদিন ।
লোকটিকে আর কখনো দেখিনি , কিন্তু মনে আছে
খুব । কারণ সেদিন বুঝেছিলাম রাস্তাঘাটে অচেনা পুরুষসঙ্গ সবসময় ভয়ের নয় , সাহসেরও ।
তখন বেশ বড় ,
কলেজে পড়ি । বাসে ফিরছি ।
জানলার পাশের সুরক্ষিত সিটটায় সেদিন বসতে পাইনি । আমি মোটাসোটা বলে বরাবরই বাসে
ধারের সিটে বসলে কাঁধ থেকে বেশ খানিকটা অংশ বেরিয়ে থাকে । বাসটায় প্রচন্ড ভিড় ছিল
। আমার হাত ও কাঁধের ওপর একগাদা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ঠেলাঠেলি । খুব , খুব খারাপ লাগছিল । বারবার নিষ্ফল সরতে বলার
অনুরোধ করতে করতে হতাশ । আমার পাশেও একজন মহিলাই বসেছিলেন । আমি গুটিয়ে তার দিকে
সরে যাওয়ায় তিনিও একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমায় ভাগিয়ে দিলেন । প্রচন্ড অস্বস্তিতে আমার
তখন কান্না পাচ্ছিল । মনে মনে শুধু ভগবানকে ডাকছিলাম ' প্লিজ ভিড়টা কমাও ' । তখন
পিছনের সিটে জানলার পাশে বসে থাকা একটি লোক ডেকে বললেন -- " আপনি আমার সিটটায়
আসুন , আমি আপনারটায় বসছি "
। আমি চোখের জল সামলে বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গেলাম । সেই ভিড়ে সিট পাল্টানোও
সহজ নয় । তিনিই একপ্রকার টেনে হিচড়ে হাতের আড়াল দিয়ে আমায় নিজের সিট অবধি পৌঁছে
দিলেন । সেদিনও আমার ভীষণ ভালোলেগেছিল । তাকেও আমি আর কখনো দেখিনি , কিন্তু বেশ মনে আছে । কারণ সেদিন বুঝেছিলাম
ভিড়ে অচেনা পুরুষের স্পর্শ কেবল সংকুচিতই করে না , মুক্তও করে ।
আবার একবার ,
ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি
ফিরছি । ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি আসতে সময় লাগত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা ।
ক্লাস শেষ করে হাওড়া আসতেই সেদিন ছটা ছুঁই ছুঁই । হাওড়া থেকে বাড়ি বাসে আরো ঘন্টা
তিনেক । নটা মানে গ্রামে বেশ রাত । সন্ধের পর বাস গ্রামের রাস্তায় ঢুকলে মহিলা
যাত্রী বেশি থাকেনা । যা হোক... পুনরায় বাস ধরার আগে ভাবলাম কিছু খেয়ে নিই । একটা কেক
কিনে টাকা মেটাতে গিয়ে পার্সটা ব্যাগ হাতড়ে কোথাও পেলামনা । কেক তো ফিরিয়ে দিলাম ,
কিন্তু তখন বাড়ি ফিরব
কিকরে সেটা মস্ত চিন্তা হয়ে দাঁড়ালো । সবথেকে কাছে , কলকাতার মেসে থাকা এক বন্ধুকে বললাম আমায় কিছু
টাকা দিয়ে যেতে । তবে তারও আসতে ঘন্টাখানেকের ওপর । তার মানে বাড়ি পৌঁছতে দশটার
বেশি । আমার অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই । ছলছলে চোখে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আমি তখন শুধু
ভগবানকে ডাকছি -- ' প্লিজ ভালোয়
ভালোয় বাড়ি পৌঁছে দাও ' । তখন পাশ থেকে একটা লোক বললেন -- " কতদূর
যাবেন " ? আমার গন্তব্য
শুনে বললেন -- " কিছু মনে করবেন না , ফোনে আপনার কথাগুলো শুনে ফেলেছি । সন্ধের জ্যামে আপনার বন্ধুর আসতে কিন্তু বেশ
সময় লাগবে । এতটা পথ যাবেন , খুব দেরি করা
উচিৎ হবেনা আপনার । আমি বাসভাড়াটা দিলে খুব অসুবিধে হবে ? এই বাসটাই ধরে নিন বরং " । আমি হুট করেই
রাজি হয়ে গেলাম । চোখ মুছে বাসে উঠে বসলাম । উনি ওনার ব্যাগে থাকা মুড়ির কৌটোটা
আমার দিকে এগিয়ে দিলেন । আমি উচিৎ অনুচিৎ ভাবছি দেখে হেসে নেমে একটা কেক কিনে হাতে
দিয়ে বললেন -- " এটা নিন , এটা পুরোপুরি সিল
করা প্যাকেট " । আবারও আমার ভীষণ
ভালোলেগেছিল । এনাকেও পরে কখনো দেখিনি , কিন্তু মনে আছে ভালোরকম । কারণ সেদিন বুঝেছিলাম বাসে-ট্রেনে সব অচেনা পুরুষের
অযাচিত বাক্যালাপ ও সাহায্যের হাত সন্দেহজনক নয় , বিশ্বাসভাজনও ।
আমার বাবা ,
দাদা তো সবসময়েই আমায়
রক্ষা করে । তাছাড়া আমি যখনি বিপদে পড়েছি , ভগবানকে ডেকেছি । সেসব পরিস্থিতিতে তাঁর আসা
সম্ভব হতনা কখনই । অমি পার পেয়েছি এইরকম অচেনা পুরুষের সাহায্যেই ।
আমার প্রিয় পুরুষ
, তুমি প্লিজ এরকম হয়ো । যে
কারোর বাবা , দাদা , আত্মীয় , বন্ধু না হয়েও একা ভীত মেয়ে দেখলে নিঃস্বার্থে
নিজের আরাম ছেড়ে দেবে । এর বিপরীত অভিজ্ঞতাও হয়েছে বহুবার । প্রবল ঘৃণায় কোনো
অচেনা পুরুষের হাতে খামচে রক্ত বার করে দিয়েছি বা ওড়নার সেফটিপিন খুলে কোনো অচেনা
পুরুষের পায়ে সজোরে গেঁথে দিয়েছি । তুমি প্লিজ এরকম অভিজ্ঞতা হয়ে কারোর মনে থেকে
যেওনা । তোমায় দেখেও যাতে আমার মতই ভীতু কোনো মেয়ে অচেনা পুরুষদেরও বিশ্বাস করতে
শেখে , তুমি প্লিজ সেইরকম হয়ো ।
তোমায় ভেবেও কারোর ঠোঁটে হাসি আসুক , চোখে ভয় নয় ! তুমিও অচেনা পুরুষরূপে কোনো মেয়ের মনে এভাবেই থেকে যেও , যাতে তোমাকে ভেবে সেও বলে -- " আমার প্রিয়
পুরুষ , তুমিও প্লিজ এরকমই হয়ো
" ।
sanjuktag1997@gmail.com
No comments:
Post a Comment