1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 1, 2020

প্রিয় পুরুষ


                                                                            ...সংযুক্তা ঘোষ 


         একবার দুপুর নাগাদ বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম । কিছুক্ষণ পর তাদের অহেতুক ফাজলামিতে আমার অকারণ বড্ড রাগ হয়ে বসল । তখন বাড়ি থেকে সাত/আট কিমি দূরে । রাগটা যে জমাটি হয়েছে , সেটা বোঝাতে আমি সাইকেল ছুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম । ভেবেছিলাম ওরাও পিছনে আসবে , কিন্তু কিছুটা পর দেখলাম কেউই আসছেনা । তখন ক্লাস নাইন , বন্ধুদের কাছে ফিরে যাওয়াটা আমার বিজ্ঞ বুদ্ধি অনুচিত বলে ঘোষণা করলো । তো আমি বাড়ির পথেই ফিরতে লাগলাম । গ্রামের রাস্তা এমনিতেই মোটামুটি খালি , দুপুরের রোদে তো পুরোই ফাঁকা । একটু পর থেকেই আমার ভয় ভয় করতে লাগল । যত এগোচ্ছি নির্জন রাস্তা আমায় ততই ভয় দেখাচ্ছে । বন্ধুদের ওপর আর নিজের ওপর রাগে তখন চোখ ভিজে । ভগবানকে মনে মনে ডাকছি ' প্লিজ তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দাও ' । হঠাৎ দেখলাম একটি লোক আমার সামনে সাইকেল নিয়ে চলেছেন । আমি কিছু না ভেবেই তার পিছু নিলাম । মনে মনে ভাবলাম , লোকটি যেন আমার বাড়ির পথেই আর তিন/চার কিমি যান । তারপর আমি একা চলে যেতে পারবো , এদিকটা বড্ড অচেনা । চার কিমি টপকানোর পর ভাবলাম লোকটি যদি আরো দু/এক কিমি যান তো ভালোই হয় । ততক্ষণে আমার ভয়টাও অনেকটা কেটে গেছে । আরো দু কিমি যাওয়ার পর ভাবলাম লোকটির বাড়ি বেশ আমার বাড়ির পরে হয় ! আরো কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তা দুভাগ , লোকটি হঠাৎ দাঁড়ালেন । আমি একেবারেই পিছনে ছিলাম বলে আমাকেও দাঁড়াতে হল । লোকটি তখন আমায় জিজ্ঞেস করলেন -- " কোনদিকে যাবে " ?  আমি অবাক হয়ে দাড়িয়ে আছি । তিনি বললেন -- " আর কতটা ? দুপুরবেলা এভাবে একা আসছ তাই জিজ্ঞেস করছি " ।  আমি বললাম আর বেশি না , ডানদিকে এক/দেড় কিমি মতো । লোকটা ' চলো ' বলে আবার সাইকেলে চড়লেন । অমি জিজ্ঞেস করলাম " আপনি কতদূর যাবেন " ?  লোকটি উত্তর দিলেন -- " আমার বাড়ি চার কিমি আগেই পার হয়ে গেছে , তুমি একা আসতে ভয় পাচ্ছ মনে হল তাই এলাম " । বাকি রাস্তাটাও আমি তার পিছনেই এসেছিলাম , নির্ভয়ে । ভীষণ ভালোলেগেছিল আমার সেদিন । লোকটিকে আর কখনো দেখিনি , কিন্তু মনে আছে খুব । কারণ সেদিন বুঝেছিলাম রাস্তাঘাটে অচেনা পুরুষসঙ্গ সবসময় ভয়ের নয় , সাহসেরও ।
         তখন বেশ বড় , কলেজে পড়ি । বাসে ফিরছি । জানলার পাশের সুরক্ষিত সিটটায় সেদিন বসতে পাইনি । আমি মোটাসোটা বলে বরাবরই বাসে ধারের সিটে বসলে কাঁধ থেকে বেশ খানিকটা অংশ বেরিয়ে থাকে । বাসটায় প্রচন্ড ভিড় ছিল । আমার হাত ও কাঁধের ওপর একগাদা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ঠেলাঠেলি । খুব , খুব খারাপ লাগছিল । বারবার নিষ্ফল সরতে বলার অনুরোধ করতে করতে হতাশ । আমার পাশেও একজন মহিলাই বসেছিলেন । আমি গুটিয়ে তার দিকে সরে যাওয়ায় তিনিও একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমায় ভাগিয়ে দিলেন । প্রচন্ড অস্বস্তিতে আমার তখন কান্না পাচ্ছিল । মনে মনে শুধু ভগবানকে ডাকছিলাম ' প্লিজ ভিড়টা কমাও '   তখন পিছনের সিটে জানলার পাশে বসে থাকা একটি লোক ডেকে বললেন -- " আপনি আমার সিটটায় আসুন , আমি আপনারটায় বসছি " । আমি চোখের জল সামলে বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গেলাম । সেই ভিড়ে সিট পাল্টানোও সহজ নয় । তিনিই একপ্রকার টেনে হিচড়ে হাতের আড়াল দিয়ে আমায় নিজের সিট অবধি পৌঁছে দিলেন । সেদিনও আমার ভীষণ ভালোলেগেছিল । তাকেও আমি আর কখনো দেখিনি , কিন্তু বেশ মনে আছে । কারণ সেদিন বুঝেছিলাম ভিড়ে অচেনা পুরুষের স্পর্শ কেবল সংকুচিতই করে না , মুক্তও করে ।
          আবার একবার , ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছি । ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি আসতে সময় লাগত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা । ক্লাস শেষ করে হাওড়া আসতেই সেদিন ছটা ছুঁই ছুঁই । হাওড়া থেকে বাড়ি বাসে আরো ঘন্টা তিনেক । নটা মানে গ্রামে বেশ রাত । সন্ধের পর বাস গ্রামের রাস্তায় ঢুকলে মহিলা যাত্রী বেশি থাকেনা । যা হোক... পুনরায় বাস ধরার আগে ভাবলাম কিছু খেয়ে নিই । একটা কেক কিনে টাকা মেটাতে গিয়ে পার্সটা ব্যাগ হাতড়ে কোথাও পেলামনা । কেক তো ফিরিয়ে দিলাম , কিন্তু তখন বাড়ি ফিরব কিকরে সেটা মস্ত চিন্তা হয়ে দাঁড়ালো । সবথেকে কাছে , কলকাতার মেসে থাকা এক বন্ধুকে বললাম আমায় কিছু টাকা দিয়ে যেতে । তবে তারও আসতে ঘন্টাখানেকের ওপর । তার মানে বাড়ি পৌঁছতে দশটার বেশি । আমার অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই । ছলছলে চোখে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আমি তখন শুধু ভগবানকে ডাকছি -- ' প্লিজ ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছে দাও '   তখন পাশ থেকে একটা লোক বললেন -- " কতদূর যাবেন " ? আমার গন্তব্য শুনে বললেন -- " কিছু মনে করবেন না , ফোনে আপনার কথাগুলো শুনে ফেলেছি । সন্ধের জ্যামে আপনার বন্ধুর আসতে কিন্তু বেশ সময় লাগবে । এতটা পথ যাবেন , খুব দেরি করা উচিৎ হবেনা আপনার । আমি বাসভাড়াটা দিলে খুব অসুবিধে হবে ? এই বাসটাই ধরে নিন বরং " । আমি হুট করেই রাজি হয়ে গেলাম । চোখ মুছে বাসে উঠে বসলাম । উনি ওনার ব্যাগে থাকা মুড়ির কৌটোটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন । আমি উচিৎ অনুচিৎ ভাবছি দেখে হেসে নেমে একটা কেক কিনে হাতে দিয়ে বললেন -- " এটা নিন , এটা পুরোপুরি সিল করা প্যাকেট " ।  আবারও আমার ভীষণ ভালোলেগেছিল । এনাকেও পরে কখনো দেখিনি , কিন্তু মনে আছে ভালোরকম । কারণ সেদিন বুঝেছিলাম বাসে-ট্রেনে সব অচেনা পুরুষের অযাচিত বাক্যালাপ ও সাহায্যের হাত সন্দেহজনক নয় , বিশ্বাসভাজনও ।
           আমার বাবা , দাদা তো সবসময়েই আমায় রক্ষা করে । তাছাড়া আমি যখনি বিপদে পড়েছি , ভগবানকে ডেকেছি । সেসব পরিস্থিতিতে তাঁর আসা সম্ভব হতনা কখনই । অমি পার পেয়েছি এইরকম অচেনা পুরুষের সাহায্যেই ।
        আমার প্রিয় পুরুষ , তুমি প্লিজ এরকম হয়ো । যে কারোর বাবা , দাদা , আত্মীয় , বন্ধু না হয়েও একা ভীত মেয়ে দেখলে নিঃস্বার্থে নিজের আরাম ছেড়ে দেবে । এর বিপরীত অভিজ্ঞতাও হয়েছে বহুবার । প্রবল ঘৃণায় কোনো অচেনা পুরুষের হাতে খামচে রক্ত বার করে দিয়েছি বা ওড়নার সেফটিপিন খুলে কোনো অচেনা পুরুষের পায়ে সজোরে গেঁথে দিয়েছি । তুমি প্লিজ এরকম অভিজ্ঞতা হয়ে কারোর মনে থেকে যেওনা । তোমায় দেখেও যাতে আমার মতই ভীতু কোনো মেয়ে অচেনা পুরুষদেরও বিশ্বাস করতে শেখে , তুমি প্লিজ সেইরকম হয়ো । তোমায় ভেবেও কারোর ঠোঁটে হাসি আসুক , চোখে ভয় নয় ! তুমিও অচেনা পুরুষরূপে কোনো মেয়ের মনে এভাবেই থেকে যেও , যাতে তোমাকে ভেবে সেও বলে -- " আমার প্রিয় পুরুষ , তুমিও প্লিজ এরকমই হয়ো " ।

sanjuktag1997@gmail.com


No comments:

Post a Comment