ছবি : ইন্টারনেট |
রাক্ষসের মা
স্বরবী রায়
'মা ভাত দিবি না?কখন থেকে বলছি খিদে লাগছে।
ও মা ভাত হল?'
'দিব দিব একটু সবুর করো বাপ আমার।একটু আগেই তো মুড়ি খেয়েচ এত তাড়া দিচ্ছ কেন?'
'একটু আগেই কোতায়?কোন সকালে একটু বাতাসা মুড়ি খেয়েচি।'
বিনি মহা বিপদে পড়ল।পাঁচ বছরের তার ছোট্ট ছেলে তো কোনো ভুল কথা বলেনি।দুপর গড়িয়ে এল।রোজ এসময় তার ভাত খাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু আজ সে কি করবে?ছেলের ভাত যে সেই পোড়ামুখো রাক্ষসটাই খেয়ে ফেলেছে।বিনির চোখে জল এল।ওই একরত্তি ছেলের মুখের ভাত টাও সে মা হয়ে রাখতে পারলো না।ঘরে চাল বাড়ন্ত।নতুন করে রেঁধে দেওয়ার উপায় নেই ।ও বেলা তার স্বামী রজত দিনমজুর খেটে রোজের পয়সা দিয়ে মুদিখানা নিয়ে আসবে।ততক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারবে না বাচ্চা ছেলে ।বিনি একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে ছেলের হাত ধরে ঘরের বাইরে এল।
'একন আবার কোতায় নিয়ে যাচ্ছিস আমায়? আমি কুতাও যাব না।বলছি না ভাত দে,খাব..'
'আহা চলই না বাছা আমার, দিদার ঘরে খাবে আজ'
দিদার ঘরে যাবার কথায় ছেলে খুশি হল।দিদার ঘরে যখনই যায় ভালোমন্দ খাবার জোটে ।
পথ বেশি নয়।তবু বিনির মনে হল ছেলের হাত ধরে কত কাল সে যেন হেঁটে চলেছে। এই অভাব দারিদ্র্যের সাথে তার পথ চলা আজকের কথা নয়, বহু জন্ম ধরে সে বুঝি এই ভাবেই কাটাচ্ছে। বিনির বাপের বাড়ির অবস্থা তুলনামূলক ভালো।তার মা তিন চার ঘরে রান্নার কাজ করে।বাবা নেই।তবে এক ভাই আছে।সে কোলকাতায় বড় কাপড়ের দোকানে কাজ করে।আয় মন্দ হয় না।বিনি চট করে বাপের বাড়ির সাহায্য নেয় না।তবে আজ সে ঠিক করেছে মা কে সবকিছু খুলে বলবে।না বলে উপায় নেই।
বিনিকে দেখে অবাক হল তার মা।
'ও কি! এত রোদ মাথায় করে দুপুর বেলা ছেলেকে টানতে টানতে নে এলি যে?এই শরীর নে একা এভাবে আসতে আছে?জামাই কোথা?'
'ওসব কতা পরে হবে মা আগে ছেলেটাকে দুটি খেতে দাও তো?'
'সে কি কথা !বাপধন আমার খাই নি একনও?বোসো বোসো।এ কি অলুক্ষুনে কান্ড !বোসো বাছা।আজ মাছের ঝোল দে ভাত খাও।আহা দুকুর গড়িয়ে গেল'
বিনির মা যত্ন করে খাওয়াতে বসলেন নাতিকে।
বিনি তখনও হাঁপ ছাড়ছে।এইটুকু পথ হেঁটেই সে ক্লান্ত।শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল 'তোমার ভাগেরটা ওকে দিলে।তোমার জন্য আরেকটু ভাত চাপিয়ে দি?'
'থাক্।অনেক হয়েচে।আগে বল্ কি হয়েচে?জামাই এর সাথে ঝগড়া হল বুঝি?'
'না না সেসব কিছুই না।এক অদ্ভুত রোগে ধরেচে আমায়। দিন রাত খিদে পায়।'
'তা এ আবার নতুন কতা কি?পেটে যে আর একজন এয়েচে খিদে পাবে না?'
'না গো মা তেমনটা নয়।পোচুর খিদে।মনে হচ্ছে পেটের ভিতর রাক্ষস আচে।একাই তিনজনের ভাত খেয়ে ফেলি।একঘন্টা যেতে না যেতি আবার খিদে পায়।তোমার জামাই কষ্ট করে দুবেলার খাবার জোগাড় করে, একন রাক্ষস পোষার ক্ষমতা তার কি আছে?'
'ও আবার কি বাজে কতা বলচিস রাক্ষস রাক্ষস করে?এসময় অনেকের অনেক কিছু হয়।বাচ্চা হয়ে গেলি সব ঠিক হয়ে যাবে।শোন্ কটা দিন খোকন সোনা না হয়ে আমার এখানে থাক।তুই বিশ্রাম নে।
আমি মা বেপদহারিনীর মন্দিরে ওবেলা পুজো দিয়ে তোকে তাবিজ পরিয়ে দেব। সব টিক হয়ে যাবে।'
'তাই ভালো মা।এই সবে পাঁচ মাস ।কি করে যে দিন যাবে ভগবান জানে...'
বিনির মা কিছু বললো না।শুধু অবাক হয়ে ভাবলো পাঁচ মাসে কারো এত বড়ো পেট হয় নাকি!
মায়ের কাছে কিছুক্ষণ থেকে বিকেলবেলা বিনি বাড়ি ফিরলো।মা তাকে রিক্সায় বসিয়ে ভাড়া দিয়ে দিল।না হলে রিক্সায় চাপার ক্ষমতা তাদের কোথায় !
রজত বাড়ি ফিরলে বিনি তাকেও পরিষ্কার করে সব কথা বললো।রজত অন্যমনস্ক ভাবে সেসব শুনলো।
কিছুই বললে না।
দেখতে দেখতে সময় বয়ে গেল।সাত মাস পেরিয়ে গেলেই বিনির মনে হল বাচ্চা বুঝি গায়ের জোরে গুঁতো মারছে।বিনির মা বললো পেটের ছবি করাতে।রজত গা করলো না।ওসব বাবুয়ানি তাদের জন্য নয়।পেটে বেদনা উঠলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। যা হওয়ার সেখানেই হবে।
বেদনা উঠতে দেরী হল না।আট মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বিনি হাসপাতালে এল।
বিনির কেমন যেন ভয় হল।যে ভূমিষ্ঠ হতে চলেছে তার অস্তিত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে তার মনে?সে পুত্র না কন্যা সে তো পরের কথা ,সে ঠিকঠাক মানুষ তো!
গর্ভবস্থায় বার বার এই উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসতো বিনির।আজ সব চিন্তার অবসান ঘটবে।বিনির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।দুজন আয়া দিদি ওর হাত পা মালিশ করছে।
'ও বোনটি ঘুমিয়ে পোড়ো না জেগে থাকার চেষ্টা করো বেশিক্ষণ লাগবে না তোমার।'
বিনির প্রথম সন্তান হওয়ার সময় খুশির বান এসেছিল জীবনে।খোকন সোনাকে পেয়ে তার মনে হয়েছিল গরীবের সংসারে এই প্রথম এক মূল্যবান সামগ্রী এল।যাকে আগলে রাখতে হবে।তা না হলে বিনিরা যদি রাতে দরজা খুলেও ঘুমায় এক বিনির সন্মান ছাড়া আর কোনো কিছুই তাদের চুরি যাওয়ার ছিল না।প্রসূতি যন্ত্রণার কঠিন মুহূর্তেও বিনির খোকন সোনার কথা মনে এল।মনটা যেন একটু আরাম পেল।বিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিল নিশ্চয়ই খোকনের মতো ফুটফুটে এক খুকুমণি আসছে।
হঠাৎ এক আর্তনাদে চঞ্চল হয়ে উঠলো প্রসূতি গৃহ।
আর্তনাদ বিনির নয় তার সন্তানেরও নয়।বিনির সন্তান কে দেখে চিৎকার করে উঠেছে আয়া ও নার্স দিদিরা।
'মানুষের পেট থেকে এ কি বেরোলো গো?'
'উলু দাও উলু দাও দেবতা গো শিবের রূপ দেখো না ভালো করে কেমন নীল রং এর গলা।'
'খালি গলা দেখলে হবে মাথায় সি্ং রয়েছে যে'
'কিন্ত ওইখানটা দেখো না ছেলেদের জিনিসও রয়েছে আবার মেয়েদের জিনিসও আছে'
'বাবা রে কান্না তো নয় যেন দানবের হুঙ্কার'
' ইনক্রেডিবল..!!'
'ডক্টর বাসু আপনার কি মত ?'
'নো আইডিয়া ডক্টর রায়'
'কোলকাতা মেডিক্যাল এ একটা খবর পাঠিয়ে দি?'
'নিশ্চয়ই '
'ও ডাক্তার বাবু দেখুন এ তো চড়চড় করে বড় হয়ে যাচ্ছে ।'
'মাই গড! ডক্টর রায় প্লিজ হারি আপ মেডিকাল টিম রেডি করতে হবে।এ বেশিক্ষণ সারভাইভ করবে বলে মনে হয় না'
-----
বিনির আজীবন মনে হয়েছে ভগবান ভাগ্যবানদের জন্যে।তার মতো তলানিতে যারা বেঁচে আছে তাদের
পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েই ভগবান তাদের কথা ভুলে যান।তাই ঈশ্বরকে সে ডাকেও না কিছু চায়ও না কোনোদিন।না পাওয়া না থাকা এগুলোই তার জীবনে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। সেই অতি পরিচিত
অতি সাধারণ নিম্নমানের জীবনটায় গত দুদিন ধরে অসাধারণ সব কান্ডকারখানা শুরু হয়েছে।মাঝে মাঝে বিনির মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে না তো!কিংবা দু্ঃস্বপ্ন!
বিনি তার সন্তানের মুখ দেখেনি।মানে তাকে দেখতে দেওয়া হয় নি।বাচ্চাটি অস্বাভাবিক ।তার মাথায় দুটি সিং ।গায়ের রং জন্ডিস রুগীর মতো হলদেটে।গলা থেকে বুক নীল।যৌনাঙ্গে পুরুষ নারী উভয় চিহ্ন বর্তমান ।শিশুটি দ্রুত লম্বায় বাড়ছে।জন্মের দশ মিনিটের মধ্যেই তাকে অন্য ঘরে আলাদা করে রাখা হয়েছে।চিকিৎসকরা জানে না এই অদ্ভুত শিশুর থেকে কি রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
তাই তাকে আলাদা করে রাখাটাই নিরাপদ বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি বিনির কাছে দুধ খাওয়াতেও দেওয়া হয় নি।
এদিকে বিনি ও রজতের ছবি উঠে গেল খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আশ্চর্য শিশুর মাতা পিতা হিসাবে।রজত বেশ উৎসাহ সহকারে সাক্ষাৎকার দিয়েছে।বিনির কাছেও আসতে চেয়ছে
খবরের কাগজের লোকেরা কিন্তু বিনির ইচ্ছা করছে না কারো সাথে কথা বলতে। ওর শরীর মন কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে। নড়তে ইচ্ছা হয় না বিন্দুমাত্র ।
আশ্চর্য শিশুকে নিয়ে ডাক্তার নার্স আয়াদিদিরা কেউ তাদের মতামত জানাতে খামতি রাখে নি।কেউ বলে শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপ।কেউ বা বলছে দানব। চারিদিকে রটে যাওয়ায় হাসপাতালে কাতারে কাতারে লোক আসছে তাকে দেখতে।
বিনির বেড দেওয়াল ঘেঁষে।বেশীর ভাগ সময়ে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকছে সে।
কাণে আসছে অনবরত তার সন্তানকে নিয়ে নানা আলোচনা।
বেড নাম্বার ২৮ এর রোগী আয়াদিদিকে জিজ্ঞাসা করলো
'কেমন দেখলেন দিদি ।খুব ভিড় হয়েছে নাকি তাকে দেখার জন্য '
'ওরে বাবা লোকের লাইন পড়ে গেছে।অনেকে তো প্রনাম ঠুকে দক্ষিণা দিয়ে যাচ্ছে ।''
'অ্যাঁ বলেন কি?'
'হ্যাঁ তাই তো'
'আশ্চর্য !হাসপাতাল এসব আলাউ করছে কেন?'
'আর আলাউ!একটা দিনের ব্যপার।আজ রাতেই তো কলোম্বিয়া থেকে একটা দল আসছে বিজ্ঞানীদের।ওরা নিয়ে যাবে ওকে।রিসার্চ করবে গো'
'তাই নাকি?'
'হ্যাঁ !ডাক্তার সিনহা তো বলছিলেন সম্ভাব্য অন্য গ্রহের প্রাণীর সাথে একটা মিল...'
'সে কি কথা দিদি ।অন্য গ্রহ থেকে কে এসে এখানে ইয়ে করে দিয়ে গেল হে হে হে'
'হে হে কি যে বলেন ।'
অন্য একজন বললে
'এই কি যে বলেন সত্যিকারের যদি দেবতা হয় আপনারে পাপ দেবে।'
'হুঁ ওই ভয়েই মরো।দেবতা কি যেখানে সেখানে আসে।রাম এসেছিল দশরথ রাজার ঘরে কৃষ্ণ নন্দরাজার ঘরে।বুদ্ধও তাই।ভগবানও জন্ম নেওয়ার আগে রাজা রাজড়াদের বেছে নেয়।বস্তিতে আসতে দেবতার বয়ে গেছে'
'তা যা বলেছেন।তবে কি এও সাধারণ বাচ্চা নয়'
'ছাড়ুন তো বিকৃতি বিকৃতি ।দেখুন গে বাপ মায়ের কি রোগ আছে না আছে।'
'তবে হ্যাঁ আজকালকার মেয়ে কোনো নিয়ম কানোন মানে না।দেখো গে পেটে বাচ্চা নিয়ে হয়তো খোলা চুলে রাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে।কোনো অপদেবতা সুযোগ বুঝে ধরে নিয়েছে।'
'হ্যাঁ ।তবে যেভাবে বড় হচ্ছে তাতে ওকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন।'
'তা ও খাচ্ছে কি?'
'সেলাইন আবার কি?তাতেই প্রতি দুঘন্টায় এক ইন্চি করে বাড়ছে।দুধ খাওয়ালে তো রাতারাতি রাক্ষস হয়ে উঠে দাঁড়াবে গো?হে হে হে'
বক্তার সাথে বাকিরাও হাসিতে যোগ দিল।
বিনির পাথর হয়ে যাওয়া শরীর মন যেন হঠাৎ ঝাঁকুনি পেয়ে নড়েচড়ে উঠলো ।
বিনির অস্তিত্ব কে কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছিল না।এখন ও উঠে বসায় সকলেই একটু চুপ করে গেল।
আয়াদিদি কথা ঘুরিয়ে বিনিকে জিজ্ঞাসা করলো 'তোমার কিছু লাগবে?'
'ঘুমের ওষুধ দেবেন?'
এইসময় হঠাৎ একদল গন্যমান্য ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করলো ।পেছন পেছন রজত ও বিনির চেনা হাসপাতালের দুজন ডাক্তার ।ওনাদের মধ্যে একজনকে বাকিরা হইহই করে বিনির বেডের পাশে বসার জায়গা করে দিল।ভদ্রলোক বিনির দিকে তাকিয়ে বললেন 'দেখো মা যাকে তুমি জন্ম দিয়েছ সে সকলের থেকে অনেকটাই আলাদা।তবে আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে আফ্রিকার হেপিচাগো নামের এক গ্রামে এই ধরনের এক জীবের জন্ম হয়েছিল। সেও দিন পনেরোর বেশী বাঁচেনি। তার শরীরটা সংরক্ষণ করে
বিজ্ঞানীরা এখনও রিসার্চ করছে।তারা তোমার সন্তানের খবর পেয়ে রওনা দিয়েছে।কালকের মধ্যে এসে পড়বে।ওদিকে কলোম্বিয়া থেকেও একটা দল আসছে।তোমাকে লক্ষ টাকা দিয়ে এরা ওই শিশুকে নিয়ে যেতে চাইবে।সে এখন মহামূল্যবান রিসার্চ মেটিরিয়াল।এখন তুমি কার সাথে ওকে পাঠাবে সেটা তোমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত ।তবে আমি তোমায় একটা কথা বলি..'
রজত মাঝখান থেকে বলে উঠলো 'বলছি ইয়ে মানে ডাক্তার বাবু কোন দলটি মানে যারা আসছে কা্রা বেশী নামকরা?'
ভদ্রলোক রজতের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে আবারও বলতে শুরু করলেন ' আমি জানি মা তোমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়।সেক্ষেত্রে যারা বেশী টাকা অফার করবে তাদের হাতেই তোমরা সন্তানকে দেবে।তবু এতো ছোটো শিশুর ক্ষেত্রে মায়ের অনুমতি ছাড়া আইন মতে কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না অন্য কেউ।তাই আমি তোমায় একটু অন্যরকম প্রস্তাব দিচ্ছি।কোলকাতায় আমার ল্যাবরেটরী আছে। সেখানে আমি জিন নিয়ে গবেষণা করি।আমি এই অদ্ভুত শিশুকে সেখানে রেখে পরীক্ষা নিরীক্ষা করব ও যত বেশি দিন সম্ভব তাকে বাঁচিয়ে রাখবো।হ্যাঁ সে ক্ষমতা আমার আছে।তুমি যখন খুশি তাকে দেখতে যেতে পারবে ।যতবছর রিসার্চ চলবে প্রতি মাসে তুমি একটা মাসোহারা পাবে।এখন তোমরা সিদ্ধান্ত নও চিরকালের মতো তাকে দূরদেশে পাঠাবে নাকি নিজেদের নাগালে রাখবে।'
বিনি সব শুনে গেল।বিনির হাবভাব দেখে মনে হল না ও আদৌ কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক ।গন্যমান্য ব্যক্তিদের ভিড় পাতলা হলে রজত এল বিনির সাথে কথা বলতে
'কি রে বিনি বড় চুপ করে আছিস যে!বলি এবার যে আমাদের সুখের দিন এল।সত্যিই ভগবানের কৃপারে।
নিশ্চয়ই গত জন্মে কোনো পুন্যি করেছিলি তাই ভগবান সাক্ষাৎ এসে আমাদের দুঃখ কষ্ট দূর করে যাবে বুঝলি কিছু ?'
রজত আনন্দে বিনির থুতনি টিপে আদর করে।
বিনি শুকনো গলায় বলে ওঠে 'এ কি ধরণের রসিকতা করলেন ঠাকুর আমাদের সাথে ?না হয় গরীবের জেবন তা বলে এই রকমের খেলা করা আমাদের নে?মা হয়ে কিনা শেষ পর্যন্ত সন্তানকে বেচে খেতে হবে?'
'আহা হা তুই এসব কি কতা বলচিস?আমরা কি তাকে বেচতে গেছি?লোকে খুশি হয়ে দিলে আমাদের দোষ কি?আর শোন্ এই যে একটু আগে এসেছিল লোকটা ওর ফাঁদে পা দিবি না।যদি পাঠাতেই হয় বাচ্চাকে আমরা বিদেশেই পাটাবো।এদেশের লোকেদের টাকা নেই যত সব ভুল বুঝিয়ে আমাদের বাচ্চা নে যাবার তাল।বুঝেছিস তো?যাক গে একন আমি চলি।'
রজত চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েও আবার বসে পড়লো।এদিক ওদিক তাকিয়ে বিনির কাণের কাছে
মুখ এনে বলল'আজ লোকে তাকে দেখে দক্ষিণে দিয়ে গেছে। কত হয়েচ বলতো?'
বিনি অবাক হয়ে তাকালো স্বামীর মুখের দিকে।রজত চকচকে চোখমুখে তাকিয়ে বলল,
'হুঁ হুঁ ভাবতেও পারবি না।পুরো এক হাজার টেকা।কিছু ঝাড় গেছে বুঝলি।দারোয়ান ব্যটা আর দুটো আয়া মাগী ছিল টাকা সরানোর তালে।আমিও ঝানু জিনিস বেশী সুবিধে করতে পারে নি ।এখন আরো সাবধানে থাকতে হবে।শোন্ যদি ভালো চাস আমি যা বলবো সেই বুঝে চলবি।।আজ রাতে কলোম্ব না কোত্ থেকে কে জানে একটা মালদার পাটি আসবে আমি পুরো এক লাখ টাকা দাবী করবো বুঝলি!ওখান থেকেও হাসপাতালকে কিছু দিতে হবে ।তবে সুপারের সাথে কথা হয়েছে তাকে যদি আলাদা করে কিছু দিতে পারি তো সে এমন ব্যবস্থা করে দেবে যাতে হাসপাতালকে আর কিছুটি দিতে না হয়।কি বুঝলি?
সবাই তালে আছে কিছু কামিয়ে নেবার।তুই ভালো করে জেনে রাখ কারো কথায় কোনো টিপ সই দিবি না।ডাক্তার বললেও না।যদি কোনো গোলঘাট করেছিস ঘরে তুলবোনা তোকে জেনে রাখ।'
সে রাতে বিনির খুব গভীর ঘুম এল অলপ সময়ের জন্য ।স্বপ্ন না সত্যি তা সে জানে না। তবে স্পষ্ট দেখলো গুটি গুটি পায়ে ওর মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো ছোট্ট এক বছর চারেকের শিশু ।ছোটোবেলা বিনি পাশের বাড়ি একটা ঠাকুর দেবতার সিরিয়াল দেখতে যেত। সেখানে দেবতা আর রাক্ষসের যুদ্ধ দেখাতো।সেই রাক্ষসেরই ছোটো রূপ যেন এই শিশু ।তবে চোখে মুখে হিংস্রতা নেই। নেই কোনো ধূর্ততার ছাপ।বরং অদ্ভুত এক মায়াবী মুখ। যেন দুঃখের নদী থেকে সদ্য চান করে উঠে এল।
রাক্ষসটা বিনির চোখের দিকে তাকিয়ে করুণ সুরে বললে'মা আমায় কোলে নিবি নে?'
বিনির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ধড়পড় করে জেগে উঠে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো সে।
তখন আশেপাশের মানুষ জন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ।
বিনি শুনেছে তার সন্তানকে একতলার তিন নম্বর ঘরে রাখা হয়েছে।বিনি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলো।যারা ডিউটিতে আছে সব ঘুমোচ্ছে।তিন নম্বর ঘর খুঁজতে বিনির অসুবিধা হল না।ঘরে ঢুকে বিনি দেখল ছোট্ট রাক্ষস ঘুমিয়ে আছে তবে ছটফট করেছে ।অবিকল স্বপ্নে দেখা মুখ।তিন দিনের শিশু অথচ লম্বা চওড়ায় তিন বছরের বাচ্চাকে হার মানায়।বিনির খুব কান্না পেল।ইচ্ছা হল ওই অভিশপ্ত শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরতে।বিনির পায়ের শব্দে চেয়ারে বসে ঢুলতে থাকা আয়াদিদি চোখ মেলে সোজা হয়ে বসে বললে' কি চাই?'
বিনি জড়ানো গলায় কোনোমতে বলল'ওকে একটু নেব?'
আয়াদিদি কিছু বলার আগেই শিশু গোঙাতে শুরু করলো।বিনি আর কারো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না।তাড়াতাড়ি করে ওকে কোলে তুলতে গেল।কিন্তু ওর রোগা শরীর ওই বাচ্চার ভার সামলাতে গিয়ে টাল খেয়ে গেল।ওদিকে সেলাইনের তার জড়িয়ে গেল।আয়াদিদি ধমকে উঠলো 'বলি হচ্ছে টা কি?
বিনি কোনোমতে বললো'আমি ওর মা গো একটিবার কোলে নিতাম'
'দাঁড়াও দাঁড়াও কোলে নেব বললেই হবে।এতদিন কোথায় ছিলে।হঠাৎ রাতদুপুরে কোলে নেবার ঝোঁক চাপলো মাথায় ।ডাক্তারবাবু বারণ করেছে ওকে ধরতে।'
বিনি ওসব কথা শুনেও থামলো না ।কোনোমতে বাচ্চাকে কোলে নিল।আয়াদিদিও গজগজ করতে করতে বাধ্য হয়ে বিনিকে সাহায্য করলো। বিনি বাচ্চাকে কোলে জড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল । গোঙানি তখনও থামে নি। বিনি আয়াদিদির দিকে তাকিয়ে বললো'ও দিদি ও এমন করছে কেন?যেন কোনো কষ্ট হচ্ছে ।'
আয়াদিদি বললো 'ও থেকে থেকেই এমনটা করে। খিদে পেয়েছে বোধহয় ।'
বিনি ইতস্ততঃ করে বললো 'দুধ দি?'
'মাথাটা খারাপ নাকি তোমার?ওকে দুধ খাইয়ে নিয়ে তুমি নিজে মরবে ?ও এক টানে তোমার শরীরের সব রস টেনে নেবে।বোসো চুপ করে।আমি এখনি সেলাইন চালু করছি।'
বিনি হঠাৎ চমকে উঠলো ।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো' একটু দেখেন তো ভাল করে।শরীরটা কেমন নেতিয়ে গেছে ।ঠাণ্ডা হয়ে গেছে....'
আয়াদিদি তাড়াতাড়ি নাড়ি টিপে দেখলো ।একমিনিট পরে দৌড়ে সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল।
বিনি বুঝলো যা হবার হয়ে গেছে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিনি তার সন্তানের কপালে চুমু দিয়ে বলল
'যাও মানিক আমার যেখান থেকে এসেছিলে সেইখানেই ফিরে যাও।এই বিচ্ছিরি জগতে থাকলে তোমায় অনেক অবজ্ঞা হাসি মস্করা অপমান সহ্য করতি হত।সকলে তোমায় নিয়ে পরীক্ষে করতো কিন্তু কেউ ভালবাসতো না।তার চেয়ে এই ভাল।'
ইতিমধ্যে বাইরে থেকে দু তিনজন মেয়েমানুষের কন্ঠস্বর শোনা গেল।বিনি তড়িৎ বেগে ওর সন্তানকে নিয়ে বেডের তলায় সেঁধিয়ে গেল।ভাগ্যক্রমে সেখানে কিছু খালি ওষুধের বাক্স প্যাটরা ডাঁই করা ছিল।সেগলোর আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে অসুবিধা হল না।বিনি জানে না এত শক্তি ও কোথা থেকে পেল।একটু আগেই বাচ্চাটাকে কোলে তুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল।এখন মনে হচ্ছে ভারটা সয়ে গেছে।
আয়াদিদি নার্স ডাক্তার সবাইকে ডেকে নিয়ে এল।মা ছেলে দুজনেই উধাও দেখে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল।ঘন্টা খানেক বিনি মশার কামড়ে ওখানেই পড়ে রইলো ঘাপটি মেরে।ভাগ্যক্রমে খাটের তলায়
শোরগোল ক্রমশ বাড়ছিল।হাসপাতালের বাইরে গাড়ির আওয়াজ লোকজনের কোলাহল।বিনির কাণে এল কারা যেন বলছে"চল চল বাইরে যাই।মজা দেখি।বাচ্চার বাপ নাকি হেবি রেলা নিচ্ছে ।বলছে হাসপাতালের দারোয়ান থেকে ডাক্তার সব ধান্দাবাজ কেউ একটা ওর বউবাচ্চাকে পাচার করেছে ।"
"বলিস কি রে!চল চল দেকে আসি ব্যাপারখানা।
তাই ভাবি এদিকে কেউ নেই কেন! সবাই বুঝি বাইরে তামাসা দেখতে জড়ো হয়েচে"
ওদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই বিনি আসতে আসতে বেরিয়ে এল।ছোটো বেলা থেকেই কিছু হলেই এই হাসপাতালে আসে ও ফ্রি তে চিকিৎসা করাতে।এখানকার ওলি গলি ওর চেনা।বিনি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পাঁচিলের গায়ের ছোটো গেট টপকালো।হাসপাতালের এরিয়া শেষে।এরপর ঘন আমবাগান।বিনি আমবাগানের মধ্যে দিয়ে ছুট দিল।ভোরের আলো তখন ভালোই ফুটেছে।
চারিদিকের মানুষজন তখনও ঘুমের আদর খাচ্ছে ।
বিনির মনে হল এই প্রথম অদ্ভুতভাবে ভগবান ওর সাথ দিল।হাসপাতালের লোকেরা সাততাড়াতাড়ি রজতকে খবর দিল আর রজতও এসে এমন ঝামেলা জুড়লো যে সবাই সেখানেই জড় হয়ে গেছে।
এই সুযোগ কাজে না লাগালে বিনি আর কিছু করতে পারবে না।বিনি প্রাণপণে ছুটছে।কষ্ট হচ্ছে না ওর।
সন্তানের জন্য এই পথ চলা এই লড়াই ওর একজনমের নয়।বহু জীবন ধরে ও এইভাবে ছুটে আসছে সন্তানের ভালোর জন্য ।কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনি পৌঁছলো শেতলজ্যাঠার বাড়ি।শ্মশানের এক ধারে এক কামরা টালির বাড়িতে শেতল জ্যাঠা থাকে।মানুষটার সংসার নেই।বিনির বাবার বন্ধু ।
ঝাড় ফুক টোটকা এইসব ওনার নেশা পেশা।
বিনিকে দেখে শেতল জ্যাঠা অবাক হলেন কিন্তু অস্থির হলেন না।মৃত শিশুকে কোলে রেখে মেঝেতে বসলো বিনি দেওয়ালে হেলান দিয়ে ।
হাঁপিয়ে ওঠা শরীরটাকে একটু ধাতস্ত করে বিনি বলে
'ওর একটা গতি করে দিন জ্যাঠা।আমার হাতে এক পয়সা নেই।আপনার সাথে তো শ্মশানে এদের জানাশোনা আছে ওকে দাহ করিয়ে ওর পারলৌকিক কাজকর্মের ভার আপনারে দিলাম।
এইটুক দয়া করুন অভাগিনীর ওপর ।ওর শরীরটাকে নিয়ে আমি কাউকে কাটা ছেড়া কোরতি দেব না।তাই সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে অনেক কষ্টে এখানে নিয়ে এসেছি আপনার কাছে।আপনি ছোট থেকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন আমায়। এইটুকু দয়া করুন জ্যাঠা।বাছা আমার সদ্গতি পাক।আবার যদি এই রাক্ষসদের পৃথিবীতে ও আসে দেহটা যেন মানুষের মতোই নিয়ে আসে।'
বিনির বুকের তলার যন্ত্রণার কবর খু্ুঁড়ে কান্না বেরিয়ে এল।
শেতল জ্যাঠা ওর মাথায় হাত রাখলেন।
সেদিন অনেক রাতে রজত বাড়ি ফিরলো টলতে টলতে।চোখে মুখে তার লাল নেশা।রাতারাতি লটারি পেয়েছিল সে।বিনি নেমকহারামের জন্য সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেল।এ শোক ভোলার নয়।তবু রজত ভোলার চেষ্টা করলো আকন্ঠ মদ্যপান করে।কিছু ধার হল বটে।তা হোক গে।
রজত তার ঘরের দরজা খুলে দেখলো বিনি শুয়ে আছে মাদুর বিছিয়ে ।বিনিকে দেখে আসুরিক শক্তি ভর করলো রজতকে।ওর টলতে থাকা শরীর সোজা হয়ে গেল।সজোরে এক লাথি মারলো সে বিনির কোমরে।একবার নয় বার বার মেরে মেরে ঘরের বাইরে বার করে দিল।বিনির শরীরে উফ্ করার শক্তিটুকুও নেই।তার যন্ত্রণায় কাতরানো নীরব শরীরটা উঠোনে পড়ে রইলো।
দরজা বন্ধ করে দিল রজত।ভেতর থেকে রজতের চিৎকার শোনা গেল"যা বেরিয়ে যা বেয়াদপ মেয়েছেলে।যে ভাতারের সাথে শুয়ে ঔ রাক্ষসটাকে বিইয়েছিলি তার কাছে যা।ভেবেছিস আমি কিছু জানি না!যতসব পাপের ফল।অামাকে ঠকালি!বাচ্চাকে বেচে দিলি ভাতারের সাথে যুক্তি করে!"
বিনি সব শুনতে পাচ্ছিল কিন্তু ওর খুব ঘুম পেল।
সেই রাত কাটলো।তারপর আরো কয়েকটা রাত কাটলো বিনির জীবনে।অল্পদিনের মধ্যেই এক ঝলমলে সকালে বিনির ঘরে একটা চিঠি এল।
বিনি বিশ্বাস করে ওই চিঠি রাক্ষস মুখো একটা ধূসর মেঘ পাঠিয়েছে ।বিনি সরকারি স্কুলে রান্নার চাকরী পেল।অনেক দিন আগে ওর মায়ের কথায় দরখাস্ত করেছিল কিন্তু অন্য কাউকে নেওয়া হবে ,ও বাদ।এমনটাই শুনেছিল বিনি।তাই ও ব্যাপারটা সে ভুলেই গেছল।হঠাৎ অসময়ের প্রাপ্তি বিনিকে আনন্দে ভাসিয়ে দিল।ওই স্কুলেই বলে কয়ে দারোয়ানের কাজে রজতকে বহাল করতে পারলো কিছু দিনের মধ্যেই।হতদরিদ্রের সংসারে যেন সেই প্রথম শ্রী এল।রজত আবার বিনিকে ভালোবাসে আগের মতোই ।
সকাল দশটা বাজলেই বিনি ও রজত ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে চাকরী করতে।খোকনসোনাকেও একটা স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে।সেদিন রজতের শরীরটা খারাপ হয়েছিল।বিনি একাই যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির গোপার মা বিনিকে দেখে হেসে বললে "কি বৌদি ইস্কুলে চললে ,আজ একা যে?'
বিনি উত্তর দিল'ওঁর জ্বর'
এগিয়ে যেতে যেতে বিনি শুনতে পেল গোপার বুড়ি ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করলো 'কার সাথে কথা কইলে বৌমা?'
গোপার মা বললো'ও বাড়ির বৌদি'
'কোন বাড়ি?'
'আরে ওই যে রাক্ষসের মা'
'অ তাই বলো'
কথাটা কানে যেতেই বিনি এক মুহূর্ত থামলো।হঠাৎই আকাশ থেকে রোদ সরে গেল।বিনি দেখলো ওই রাক্ষস মুখো ধূসর মেঘটা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।বিনিও হাসলো ওকে দেখে।
স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছিল।বিনি আবার পা চালালো।
---সমাপ্ত ---
No comments:
Post a Comment