![]() |
ছবি লেখকের নিজের আঁকা |
...দিব্যেন্দু গড়াই
চারিদিক ঘন
অন্ধকার। সে আঁধার ভেদ করে দেখা যাচ্ছে না কিচ্ছুটি। না আছে আলোর কণা, না আছে প্রাণের স্পন্দন। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ
যেন নিভে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বাতাসের চলাচল। দমবন্ধ, হাঁসফাঁস অবস্থা। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের
শব্দটুকু ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। চারপাশের নিস্তব্ধতার ঘোরটোপের ভেতর সেই শব্দটুকু
পরিবেশের ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এটাই কি মৃত্যুর লক্ষণ? সে কি মরতে চলেছে? কিন্তু সে মরে গেলে তার মাণিক, তার সাতরাজার ধন, মাসা’র কি হবে? কে দেখবে ওকে? না, এভাবে মাসাকে একলা ফেলে সে যেতে পারে না। ফিরতেই হবে তাকে। জোর করে ছিঁড়ে
ফেলতে হবে এই অন্ধকার। জোরে... আরও জোরে...
ঘুম ভেঙে বিছানায়
উঠে বসে বিলকিস। তার দুঃস্বপ্নেও জুড়ে থাকে আদরের নাতি, মাসা। প্রায় দুই মাস হতে চলল মাসা নিরুদ্দেশ
হয়ে গেছে। এই দুই মাস প্রায় প্রতি রাতেই ঘুম ভেঙে যায় বিলকিস দাদির। তারপর আর ঘুম
আসে না। জেগে থাকে বাকি রাত টুকু। বুকচাপা কান্না উথলে ওঠে দুচোখ বেয়ে। সব পেয়ে
হারানোর শোকে পাথর হয়ে যায় বিলকিস, দ্বিতীয়বার।
*****
সেদিন ছিল
কোজাগরী লক্ষীপুজো। সন্ধ্যেবেলা পাড়ার প্রায় সব হিন্দু বাড়িতে পুজোর আয়োজন চলছিল
জোরকদমে। ঠিক তখনই হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল কাশেমের ফৌজ। পরের একঘন্টা চলল তান্ডব।
ধারালো অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুনীদের
উল্লাসধ্বনি, অসহায় মানুষের
আর্তনাদ আর আগুনে পোড়ার চড়চড় শব্দে ভরে গেছিল গোটা পাড়া। খিড়কির দোরে পুকুরের
পাঁকে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে কাঁপছিল দশ বছরের বালিকা ঈশ্বরী। চোখের সামনে আগুনের
লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিয়েছিল তাদের বসতবাটী, গোয়ালঘর, উঠোনের শিমূল গাছ, তুলসীমঞ্চ... সব। দাউদাউ আগুনের মাঝে পাথরের মত
দাঁড়িয়ে ছিল সারারাত, মনের মধ্যে
আগুনের ভয়াবহ রূপ গেঁথে যাচ্ছিল তখন, একটু একটু করে, সারাজীবনের জন্য।
বাবা-কাকা-দাদাদের হারিয়ে শরণার্থীর দলে ভিড়ে গেছিল মা আর মেয়ে। ধর্মান্তরিত না
হয়ে উপায় ছিল না। মহামায়ার নাম হল হামিদা আর তার মেয়ে ঈশ্বরী হল বিলকিস। ঠিক পরের
বছরই স্বাধীন হল ভারতবর্ষ। উড়ল তেরঙা পতাকা। ওদেরকেও চাঁদপুর ছেড়ে, কুমিল্লা ছেড়ে চলে যেতে হল ত্রিপুরা। তারপর
বহুঘাটের জল খেয়ে, এদিক ওদিক তাড়া
খেয়ে শেষমেষ এই ঈশ্বরীগঞ্জে মাথার ওপর পাকাপাকি ছাদ পেল বিলকিস। ততদিনে মা গত
হয়েছেন। রজ্জাবের সাথে শাদি, একমাত্র সন্তান
আকবরের জন্ম, ছোট্ট জমিতে
চাষবাস ... এইসব পরপর ঘটনা ঘটে চলছিল কালের নিয়মে। বয়সের ভারে স্মৃতির ঘরে ক্রমাগত
ধূলোর আস্তরণ জমতে থাকায় সুবিধেই হয়েছিল বিলকিসের। সবকিছু ভুলে গেলেও ১৯৪৬ সালের
নোয়াখালী-দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী একটা জিনিস কখনোই ভুলতে পারেনি। সর্বগ্রাসী
আগুনের ভয়াবহ রূপ।
*****
প্রতিদিন ফজরের
নামাজের আগে উঠে পড়ে বিলকিস। গোসল করে নামাজ পড়ে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে
আল্লাতালাহ্ র পবিত্র নাম ‘আল জামেয়ু’ ১০ বার পড়ে। প্রত্যেকবার পড়ার সময় হাতের
একটি আঙুল বন্ধ করতে হয়, এইভাবে দশবার পড়া
হয়ে গেলে দু’হাতের দশ আঙুল বন্ধ করে দু’হাত দিয়ে মাসেহ করতে হয়। এটা করলে
নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তি সাতদিনের মধ্যে ঘরে ফিরে আসে, মৌলবীসাহেব বলেছেন। কিন্তু দু’মাস কেটে গেল,
মাসা’র দেখা নেই। শঙ্করের
সাথে থানা-পুলিশের চক্কর কেটেছে অনেক। ওর সাথে গিয়ে বিষ্টুপুরের মা শীতলার থানে
ঢিল বেঁধে এসেছে। সবই ব্যর্থ।
*****
তখন ভরদুপুর।
রাঁধতে ইচ্ছে হয়নি বলে দুগাল মুড়ি খেয়ে বারান্দায় শুয়েছিল বিলকিস। পুরোনো কথা মনে
পড়ছিল। ছেলে আকবর আর ছেলের বৌ নাজমা যখন লঞ্চডুবিতে মারা গেল, তখন মাসা’র বয়স পাঁচ। ঐটুকু ছেলেকে বুকে আগলে
আগলে রেখে কুড়িটা বছর পার করে দিল। কিন্তু আর বোধহয় পারল না। একমাত্র ছেলে-বৌমা’র
পর এবার হারাল একমাত্র নাতিটাকে। নিজের দুর্ভাগ্যে ভিজে উঠছিল চোখের কোণ।
-‘পানি দেবে একটু?’
চিন্তাজাল ছিঁড়ে
বাস্তবে এসে পড়ে বিলকিস। দেখে, সামনে একটি লোক
দাঁড়িয়ে। রঙ ওঠা আলখাল্লা, মাথায় পাগড়ি আর
মুখে দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গল। দুপুর রোদে, চারিদিকে যখন জনমনিষ্যি নেই, তখন গ্রামের
প্রায় প্রান্তে অবস্থিত এই কুঁড়েঘরের সামনে ইনি এলেন কোথা থেকে? এসব পরেও ভাবা যাবে। আপাতত দেখা যাচ্ছে মানুষটি
তেষ্টায় রীতিমতো শুকিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি এক গেলাস পানি আর দুটো বিস্কুট এনে দেয়
বিলকিস। আলগোছে জলপান করে আরও একগ্লাস পানি চায় লোকটি। তৃপ্তিসহকারে দ্বিতীয়
গ্লাসের জলটুকু পান করে বলে,
-‘নাতি কে খুঁজছ,
তাই না?’
নিমেষে চোখের
সামনে ফুটে ওঠে একরাশ আশার ফুল। রুখুসুখু জমি ভিজে ওঠে বারিধারায়। ভিক্ষুণীর মত
দু’হাতে আঁচল পেতে বলে ওঠে বিলকিস,
-‘আপনি যেই হন,
পীর কিংবা সন্ন্যাসী,
আমি নিশ্চিত আপনিই আমার
সোনামানিক, আমার মাসা’র
সন্ধান দিতে পারবেন। বলুন না, কোথায় গেলে তাকে
পাব?’
-‘তোমার আশেপাশেই
ঘুরঘুর করছে সে। তোমায় স্পর্শ করছে, অজান্তে তুমিও হয়ত স্পর্শ করছ তাকে। কিন্তু এ জগতে তার ফেরা মুশকিল। সে এখন এ
জগতের সমান্তরাল, অন্য এক জগতের
বাসিন্দা।’
-‘আপনার এসব কথার
অর্থ বোঝার মত সামর্থ্য আমার নেই। যদি সত্যিই জানেন, তাহলে স্পষ্ট করে বলুন সে জীবিত নাকি মৃত?’
অদ্ভুত ভঙ্গিমায়
দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে দাঁড়ায় কৃশকায় লোকটি। প্রচন্ড গরম অনুভব করে বিলকিস দাদি।
প্রথমে গোঁফ-দাঁড়ি, তারপর লোকটির
পোশাকআশাক থেকে অল্পঅল্প ধোঁয়া বের হতে থাকে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া
বিলকিস দাদির আর কিছু করার থাকে না। আচমকা দপ করে জ্বলে ওঠে লোকটির শরীর। লেলিহান
অগ্নিশিখা দেখে আতংকে নির্বাক হয়ে যায় বিলকিস। মস্তিষ্কে জেগে ওঠে ১৯৪৬ সালের সেই
দাঙ্গার বীভৎস রূপ। নিশ্চল, নিশ্চুপ লোকটি
আগুনের মধ্যে থেকে প্রখর দৃষ্টিতে তাকায় বিলকিস দাদির দিকে। দাদি দেখে, কোথায় সেই দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গল? কোথায় বা সেই পাগড়ি-আলখাল্লা? এ তো, সেই সদাহাস্যময় মায়া জড়ানো দুটো চোখ। গত পঁচিশ বছর ধরে যাকে ঘিরে তার জগত গড়ে
উঠেছে, সেই কোমল মুখখানি
অগ্নিশিখার ভেতর জ্বাজল্যমান। কোন কষ্টের লেশমাত্র নেই সেই মুখে।
করুণাময় আল্লাহ্
কে ধন্যবাদ জানায়। পরমপিতা ঈশ্বরকে বলে, ‘ভালো রেখ ওকে।’ আজ যে বিলকিস দাদি তার সাত রাজার ধন, তার সোনামাণিক মাসা’কে স্পষ্ট চোখের সামনে
দেখতে পেয়েছে...
--( সমাপ্ত)--
dibyendugarai.dg@gmail.com
কলকাতা
এই ধারাবাহিকের
প্রথম গল্প
দ্বিতীয় গল্প
পড়তে ক্লিক করুন
No comments:
Post a Comment