1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Friday, May 1, 2020

বৌমা

                                                                                                                   ...সুমন সেন

            মায়ের ভালোবাসা তেমনভাবে কোনোদিনই পায়নি বিনয়। তার মা পক্ষাঘাতগ্রস্থ, সারাক্ষণ হুইলচেয়ারে থাকেন, মুখ দিয়ে ‘উঁ’ ‘উঁ’ আওয়াজ করেন – আর তাতেই বুঝে নিতে হয় উনি কী বলতে চাইছেন। আগে এরকম ছিলেন না। বিনয়ের যখন ১০ বছর বয়স – তখন থেকে উনি এরকম হয়ে যান। তার আগে পর্যন্ত একজন হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মহিলা ছিলেন মিতা দেবী। বিনয়ের একটি বড় দাদা ছিল – নারায়ন। তাকে খুব ভালোবাসতেন মিতা দেবী। বহু অভাব অনটনের মধ্যে দিয়েও নিজের সবটুকু দিয়ে লালন-পালন করে বড় করেছিলেন নারায়নকে। রাইটার্স বিল্ডিং-এ কাজ করত সে। কিন্তু চাকরি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই মারা যায় সে। পোলো খেলতে গিয়ে ভুল করে এক পাগলা ঘোড়ার পিঠে চেপে পড়েছিল সে। সেই ঘোড়ারই পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয় তাকে। মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল – তাকে নাকি চক্রান্ত করেই পাগলা ঘোড়ায় বসতে দেওয়া হয়। এদিকে ছেলের মৃত্যুর খবর শুনেই মূক হয়ে পড়েন মিতা দেবী, শরীর অসাড় হয়ে পড়ে তাঁর। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়, কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হয় না। তার পর থেকেই তিনি সর্বক্ষণ হুইলচেয়ারে...
বিনয়ের বাবার আগে থেকেই যক্ষা ছিল, ওই ঘটনা ঘটার বছর দুয়েক-এর মধ্যে তিনিও ইহলোক ত্যাগ করন। এতকিছুর ফলে বিনয় ছোটোবেলা থেকেই অনেকটা সংগ্রামী প্রকৃ্তির ছেলে। একটা কঠিন ব্যক্তিত্বের অধকারী সে। নিজের পড়াশোনা, মায়ের দেখাশোনা, তারপর চাকুরী – সবই সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে এসেছে সে। একসময় আত্মীয়-বন্ধুদের চাপে পড়ে বিয়েটাও করতে হল তাকে। সত্যিই তো, একা হাতে সবকিছু সামলায় কিভাবে!
         মুশকিলটা হল বিয়ের পর থেকেই। এমন একটা দজ্জাল বউ পেল সে – যে কিনা বিয়ের পর থেকেই পুরো বাড়িকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। প্রতিদিন কারণে-অকারণে বিনয়ের সাথে ঝামেলা শুরু করে দিত। খাবার টেবিলে বসে ছুঁড়ে ফেলে দিত থালা। রান্না করতে করতে ভাতের হাঁড়িও উল্টে দিত বহুবার। চীৎকার-চেঁচামেচি তো যেন সারাদিন ধরে সারা বাড়িতে প্রতিফলিত হয়েই চলত। পাড়ার কিছু সাহসী মহিলাও অনেক সময় অধিকারের সীমানা লঙ্ঘন করে বাড়ি বয়ে বিনয়ের বউ-কে শাসন করে যেত। “তোমার শ্বাশুড়ি বুড়ি হয়েছে, তার উপর নড়া-চড়ার ক্ষমতা নেই – এরকম অবস্থায় সে কিভাবে এসব সহ্য করে? তার উপর ছেলেটা এত কষ্ট করে বড় হয়েছে, একেবারে শান্ত-নিরীহ ছেলে – তার উপর এরকম অত্যাচার করতে তোমার বিবেকে বাঁধে না বৌমা? মানুষের তো নীতি বলে কিছু থাকা উচিৎ! পাপ হবে গো পাপ! বিয়ের আগে শুনেছি তুমি নাকি খুব শিক্ষিতা? এই তোমার শিক্ষা-দীক্ষার গুণ?” -এরকম  ধরণের কথা বলে যেত পাড়ার লোক। কিন্তু বৌমার যেন দু’কান কাটা। সে প্রতিবেশীদের সমস্ত কথা উপেক্ষা করে নিয়ম-মত নিজের কাজ চালিয়েই যেত। প্রতিবেশীরাও একসময় হাল ছেড়ে দেয়। যার পাঁঠা সে মাথায় কাটুক বা লেজে কাটুক অথবা না কাটুক – তাতে তাদের কি! আশ্চর্যের বিষয় হল – বিনয় তার বউ-এর এত অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করত। কোনোদিন কোনোকিছুর প্রতিবাদ করেনি। তার জন্য আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধুরা বিনয়ের পিছনে তাকে ‘বউ-এর ভেড়া’ বলে ডাকতে শুরু করল। তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না – একজন কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিনয় কিভাবে বিয়ের পর এতটা পালটে গেল! বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ নেই, বউ যা বলছে তাই করছে, সমস্ত অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নিচ্ছে – এগুলো তার শুভানুধ্যায়ীরা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মনে মনে ফুঁসছে তারা। অনেকবার কোর্ট-কাছারী করে বউকে ডিভোর্স দেবারও পরিকল্পনা করেছে আত্মীয়রা, কিন্তু বিনয়ের এরকম গো-সুলভ আচরণ দেখে তারা সেই প্রস্তাব বিনয়ের কাছে রাখার সাহস পায়নি।
         সারাদিন বিভিন্নরকম অশান্তি করা সত্বেও শ্বাশুড়ির খুব যত্ন করত সুজাতা। শ্বাশুড়িকে নিয়মিত খাওয়ানো, স্নান করানো, সারা শরীর মালিশ করে দেওয়া, হাতের আঙ্গুল পায়ের আঙ্গুল টেনে দেওয়া, বাইরে ঘোরাতে নিয়ে যাওয়া – এইসবে কখনো কোনো ত্রুটি করত না সে। এক্ষেত্রে সে তার বাকি চরিত্রের সাথে যেন পুরোটাই বিপরীতধর্মী। তাকে মানুষ ঘৃণা করলেও শুধুমাত্র এই গুণটার জন্য সকলে অবাক হত। বিনয় নিজেও হয়ত বউ-এর এই গুণটার জন্যই তার সমস্ত অত্যাচার সহ্য করে নিত। তার কঠিন ব্যক্তিত্ব হয়ত এখানেই গলে জল হয়ে যেত। সে নিজে কোনোদিনই মায়ের পরিচর্যা এভাবে করতে পারেনি। নিজস্ব বহু কাজের মধ্যে কখনও মায়ের প্রতি দেবার মত এত সময় ছিল না তার। অথচ সে নিজে কোনোদিন মায়ের ভালোবাসা না পেলেও মাকে যথাসম্ভব ভালো রাখার চেষ্টা করত। বিয়ের পর বউ-এর ওই গুণটা দেখেই হয়ত কখনও বউ-এর বিরুদ্ধে কথা বলেনি বিনয়। সেই জন্যই হয়ত বউকে ডিভোর্স দেবারও চিন্তা তার মাথায় আসেনি।
বিনয়ের মা কিন্তু তার প্রতি বৌমার এইরুপ যত্ন-আত্তি মন থেকে মেনে নিতে পারেন না। বউমার তাকে যত্ন করার সময় বিরক্তির ভাব স্পষ্ট ফুটে ওঠে তার মুখে। কথা বলতে পারলে হয়ত বলেই ফেলতেন, “দূরে যা... তোর মত মেয়ের স্পর্শ পেতে চাই না আমি।”, হাত-পা নাড়াতে পারলে হয়ত ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতেন সুজাতাকে। আসলে ছেলের উপর নিত্যদিনের অকথ্য অত্যাচারের বোবা-সাক্ষী হয়ে থাকতেন মা। মুখে কিছু না বলতে পারলেও তাঁর গা জ্বলে যেত। ফলস্বরুপ, বউমা তাঁর কাছে এলে, তাঁর সেবা করতে এলে মানসিক ভাবে প্রচন্ড বিরক্ত হতেন; যা ভেসে উঠত তাঁর চাহনিতে।
সেদিন তো যেন একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। অত্যাচারের সমস্ত সীমানা ছাড়িয়ে সুজাতা এমন একটা কাজ করে ফেলল – যার পর তাকে আর কোনোভাবেই ক্ষমা করা চলে না। সেদিন একটা শো-পিস্‌ রাখা নিয়ে হঠাৎই বিনয়ের সাথে ঝামেলা শুরু করে সুজাতা। ঝামেলা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে সুজাতা তার স্বামীর গালে টেনে এক চড় লাগিয়ে দেয়। অনতি দূরেই মিতা দেবী হুইলচেয়ারে বসে সব দেখছিলেন। ছেলে তার বউ-এর হাতে শারিরীক নির্যাতিত হবার দৃশ্য তিনি আর মেনে নিতে পারলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে সোজা সুজাতার হাত ধরে টেনে এক চড় তিনিও কষিয়ে দেন তার ডান গালে।
বউমা, কি হচ্ছে এসব? অনেক সহ্য করেছি তোমার অত্যাচার। আর নয়। তোমার সাহস কিভাবে হল স্বামীর গায়ে হাত তোলার?” –রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে কথাগুলো বলে গেলেন মিতাদেবী।
চেঁচামেচির ফলে সেদিনও বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল জানালা-দরজা থেকে। সকলের চক্ষু চড়কগাছ! কারুর মুখে ‘রা’ নেই। একেবারে পিনড্রপ সাইলেন্স সেই মূহুর্তে। ঝড়ের পর যেন পরিবেশ একেবারে শান্ত। কেউ যেন ‘বিশ্রাম’ নির্দেশ দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে সবাইকে। আঠেরো বছর একভাবে থাকা পক্ষাঘাতগ্রস্থ এক বৃদ্ধা প্রথমবার হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে! কথা বলেছে এত বছরে প্রথমবারের মত!
সকলের অবাক হওয়া চোখগুলো ছাপিয়ে – সুজাতার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল।
***

        শিক্ষিতা মেয়ে সুজাতা। ভালো অভিনেত্রী হবার ইচ্ছা খুব ওর। থিয়েটারে কাজও করেছে প্রচুর। কিন্তু ওর বাবা-মায়ের এসব পছন্দ নয়। একসময় ওর বাবা-মা সরকারী চাকুরে পাত্র বিনয়ের সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে। যদিও বিয়ে করার কোনোরকম ইচ্ছাই ছিল না সুজাতার। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিনয়ের সাথে বিয়ের দেখাশোনা-টা করতে হয় সুজাতাকে। যদিও বাড়ির হাল, মায়ের অবস্থা – এসব সম্পর্কে সুজাতার পরিবারকে আগে থেকেই জানিয়েছিল বিনয়, তাও বিয়ের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে সুজাতাকে আলাদাভাবে ডেকে মায়ের ব্যাপারে জানায় সে। জিজ্ঞেস করে – ওই অবস্থায় পড়ে থাকা একটা মানুষের দায়িত্ব কি সুজাতা নিতে পারবে?
সব জেনে বুঝেই শেষমেষ বিয়েতে মত দেয় সুজাতা। মোটামুটি ধুমধাম করেই বিয়ে হয়েছিল তাদের। কিন্তু বিয়ের পরেই সুজাতার অভদ্র ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সকলে। শুধুমাত্র বিনয় কোনো প্রতিবাদ করত না তার।
বৌভাত-এর দিন রাতে সুজাতা বিনয়কে একটা কথা বলেছিল, “তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারবে?”
বউ-এর এহেন প্রশ্নে অবাক হয়েছিল বিনয়। কারণ জানতে চাইলে সুজাতা বলেছিল, “আমি মা কে সুস্থ করে তুলব। মা আবার আগের মত হাঁটবে, কথা বলবে। শুধু তোমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে হবে আমার উপর।”
বউ-এর এরকম দাবিতে অবাক হলেও, তার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়তা অনুভব করেছিল বিনয়। অলীক হলেও জোর ছিল তার কথায়। বিনয় বিশ্বাস করেছিল স্ত্রীকে। স্ত্রী-এর সেই কথার উপর সন্দীহান হয়ে কোনোদিন তার বিরোধিতা করেনি।
বিয়ের আগেই সুজাতা বিভিন্ন সাইকিয়াট্রিস্টদের সাথে যোগাযোগ করে, এমনকি রাঁচি মেন্টাল হস্পিটাল থেকেও ঘুরে আসে। ডাক্তারদের জানায় তার হবু শ্বাশুরির রোগের কথা, তার জীবনের কথা। সাইকিয়াট্রিস্টদের সাথে অনেক শলাপরামর্শ করে সে। অনেকেই বলেছেন – বড় ছেলে মারা যাওয়ায় শক্‌ পাবার কারণে তার এরকম অবস্থা। অনেক সময় এরকম হয় – শক্‌ পাবার পর রোগীর বাক্‌শক্তি হারিয়ে যায়, সারা শরীর অসাড় হয়ে পড়ে, পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়ে সে। যদি সেই রোগীকে কোনোভাবে দ্বিতীয়বার আবার প্রচন্ড মানসিক শক্‌ দেওয়া যায় এবং সাথে সাথে ঠিক্‌ঠাক্‌ পরিচর্যা, ফিজিয়োথেরাপি করানো, মালিশ করানো যায় – তাহলে অনেকসময় রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু তার জন্য কাউকে রোগীর প্রতি অনেক সময় দেওয়া দরকার। একনিষ্ঠ ভাবে রোগীর সেবা করা দরকার।
এটাই ঢুকে গিয়েছিল সুজাতার মাথায়। তার শ্বাশুরিকে সুস্থ করতেই হবে। দিন-রাত সে পরিকল্পনা করত দ্বিতীয়বার শাশুরিকে কিভাবে মেন্টাল শক্‌ দেওয়া যায়! স্বামীর প্রতি অত্যাচার, ভাতের হাড়ি উল্টে দেওয়া, নিত্যদিনের ঝগড়া – কোনোটাই সে মন থেকে করেনি। সবটাই ছিল শ্বাশুরিকে দেখানোর জন্য। প্রতি রাত্রে সুজাতা লুকিয়ে বিনয়ের কাছে চোখের জল ফেলত। বিনয় হাল ছেড়ে দিয়েছিল, সে বারণ করত সুজাতাকে এসব চালিয়ে যেতে। তার মনে হত - মাকে সুস্থ করার শপথ নিয়ে সুজাতা যেন নিজের জীবনটা নষ্ট করছে।
তবে সফলতা যতদিন না আসে সুজাতাও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। রাতে ঝামেলা করে খাবার থালা উল্টে দিয়ে তারা কোনোদিনই না খেয়ে থাকেনি। মা ঘুমিয়ে পড়লে অর্ডার করা খাবার খেয়ে রাত কাটিয়ে নিত তারা। এসব ব্যাপারে সবসময় বোঝাপড়া থাকত বিনয় ও সুজাতার। অথচ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধ্‌ পাড়া-প্রতিবেশীর সামনে কোনোদিনই সুজাতা নিজের আসল রুপ উন্মোচন করেনি। তার স্থির করা উদ্দেশ্যকে মাথায় নিয়ে নিজের কাজ করে গেছে সে। এবং অবশেষে জয়লাভও করল সে। প্রায় আঠেরো বছর একইভাবে থাকা এক জড়বস্তু-সম মানুষকে নিজের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা নাড়িয়ে দিয়েছে সে।

বিনয়ের মুখে সবকিছু শুনে মিতাদেবী “বৌমা!” বলে জড়িয়ে ধরেন সুজাতাকে। তারপর দুজনেই হাউমাউ করে কান্নায় ফেটে পড়েন।

suman.sen303@gmail.com

No comments:

Post a Comment