মালিনী বাচ্চাদের স্কুলব্যাগ নামিয়ে রেখে দরজার ট্রাইবোল্ট খোলে। আজ সে খুব আনমোনা। বাচ্চারা হই হই করে
বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। তাদের দুদিন ছুটি। অন্যদিন মালিনী ওদের
তাড়া দেয় ,খাবার বাড়ে । আজ সেটুকুও করার ইচ্ছে নেই তার। দরাজ গলায় বলে ,
কি পিৎজা
চলবে তো ? রণি
বণি যেন নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা। যে মা রোজ ভাত শুক্তো
ডাল মাছ এইসব বোরিং লান্চ সাজিয়ে দেয় , সে তাদের জন্য পিৎজা অর্ডার করছে! সমস্বরে
দুই ভাই বলে ওঠে “চলবে না দৌড়বে”।সুইগি তে অর্ডার
করে ফোনটা টেবিলে নামিয়ে রাখে সে।কয়েকঘন্টা আগের
ঘটনায় ফিরে যায় । প্রতিদিন ছেলেদের স্কুল থেকে আনার পথে বাপের বাড়ি
যায় মালিনী। মা বাবার সাথে গল্প করে। কোনো কোনো দিন দুপুরের
খাবারও খায় মা বাবার সাথে। আজ সেরকমই এক দিন। পাশের বাড়ির মেয়েটি নতুন চাকরী পেয়েছে । সে তার এক বছরের
মেয়েকে নিজের মায়ের জিম্মায় রেখে অফিস যাচ্ছে কিছুদিন হলো। বাচ্চাটি কান্নাকাটি
শুরু করেছে , তার দিদারও গলা পাওয়া গেল। মালিনীর মা হঠাৎ
বলে উঠলেন , শুরু হলো আরেকজনের আয়ার ডিউটি! মালিনী অবাক হলো মায়ের কথায়।দাদু ঠাকুমারা আজকাল নিজেদের আয়া ভাবছেন!এরপর বাবা বল্লেন, বিনি পয়সার বিশ্বস্ত
আয়া বুঝলেনা গিন্নি! মালিনীর আর খিদে নেই। কয়েক বছর আগে সেওতো
রণি বণি কে মা বাবার কাছে রেখে স্কুলের চাকরীটা করতে যেতো। মা বাবা তো সে সময়
কিছু বলেননি তাকে। তবে কি এটাই সেই না বলা কথা! নিশ্চয়ই তাই।
মালিনীর নিজের ছোটোবেলা মনে পড়ে। ঠাম্মির হাতে খাওয়া
, গল্প
শোনা, ঠাম্মির
গলা জড়িয়ে ঘুমোনো, রাজ্যের আবদার সবই তো ঠাম্মির কাছে! মা বাবা তো নিজেদের অফিস,
স্কুল
, টিউশনি
এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। ঠাম্মির উপরই ছিল
সংসার চালানোর দায়ভার। মিনুর মা
আর খুকুপিসির সাহায্যে ঠাম্মি সবকিছু সুন্দর ভাবে সামলাতেন।ঠাম্মি কে কি মা বিনা পয়সার আয়া ভাবতেন? আর ঠাম্মি নিজেকে?
রণি বণির স্কুল কাল থেকে ক্রীসমাসের ছুটি পড়ছে।এবছর
ওরা আন্দামান ঘুরতে যাচ্ছে।মা বাবাকেও নিয়েযেতে
চেয়েছিল অরুণ। ওরা রাজি হলেন না। তাই ওরা চারজনই যাবে।
আন্দামান মানেই রকমারি ওয়াটার স্পোর্টস আর কোরাল প্রাচীর দেখার অমোঘ
টান। রণি আর অরুণ সবকিছুই ট্রাই করতে চায়। বণি আর মালিনী নীল আইল্যান্ডের বীচে বসে ডাব খেতে ব্যস্ত।মালিনীর পাশে একজন বেশ স্মার্ট সাউথ ইন্ডিয়ান বয়স্ক মহিলা বসে আছেন। তার সঙ্গী সাথীরাও বোধহয় বোটেচেপে প্রবাল প্রাচীর দেখতে গেছেন।কিছুক্ষন পর মহিলা তার দিকে তাকিয়ে ইংরেজীতে জানতে চাইলেন তারা কোন স্টেট
থেকে এসেছে। মালিনী ওয়েস্ট বেঙ্গল বলতেই, সহাস্যে মাছের রেসিপি
জানতে চাইলেন। হিলসা উইথ মাস্টার্ড পেস্ট। মালিনী গড়গডিয়ে বলতে থাকে তার মোস্ট ফেভারিট ডিশের রেসিপি। এবার দুজনের পরিচয়ের দ্বিতীয় পর্যায়। মিসেস মিরাম্মা। একদা কেরলবাসী । বিবাহসুত্রে ইংল্যান্ডের
নাগরিক।
চারবছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। ভারতেই ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত মেয়ে জামাই প্রস্তাব দেয় ,তাদের বাচ্চাদের
দেখাশোনা করার। তিনি বলেন বেবিসিটার রাখতে গেলে যা পারিশ্রমিক দিতে
হয় , তা যদি
তারা মিরাম্মাকে দেন তবেই তিনি থাকবেন। তাঁর মেয়ে জামাই
রাজি হয়ে যায়। মিরাম্মা বলে চলেন , দ্য চিল্ড্রেন আর
গেটিং এক্স্লুসিভ পার্সোনাল কেয়ার এলং উইথ ওরিজিনাল ওয়ার্মথ অফ আ গ্রান্ডমম্ ! এন্ড
আই এম প্রোভাইডিং দ্যাট উইথ রিজনেবল প্রাইস।
মালিনীর সব ভুল হয়ে যায় , স্থান কাল পাত্র। ঠাম্মির কোলে মাথা
রাখতে চায় দুদন্ড সে। কোন দিকে চলছে সমাজ? নাড়কেল নাড়ু ,
পিঠের
মতো অরিজিনাল গ্রান্ড পেরেন্টস টাচও দোকানে পাওয়া যাবে? না কি আমাজনে বিকোবে!
তবে তো বৃদ্ধাশ্রম আরও বানাতে হবে , হবেই। তবে তো নচিকেতাকেও
নতুন গান গাইতে হবে।
বণির হাতটা শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে অন্যদিকে চলতে থাকে মালিনী। মনেমনে সে এখন বৃদ্ধা, ন্যুব্জা ,কিন্তু ঠাম্মির মতো
ঋজু মন আর অনাবিল আন্তরিকতা। মালিনী ঠাম্মি হতে
চায়। তার ঠাম্মির মতো।
mousumichak74@gmail.com
কলকাতা
কলকাতা
আয়া নয় ঠাম্মী চাই। বুকে টেনে নেওয়া ঠাম্মী। মজার গল্প বলা ঠাম্মী। আজকের যুগে অসাধারণ মেসেজ
ReplyDelete