...খালিদা খানুম
অনিক আমার
বন্ধু না, ক্লাসমেট । হয়তো ক্লাসমেট বলেই আমি
পুরুলিয়াতে দু মাস আসা সত্বেও আমাদের যোগাযোগ হয়নি । জেলা অফিসের মিটিং এ দেখা হলো
তার সাথে । পুরুলিয়াতে আমাদের ক্লাসের দু জন আছি । আনিক
আছে তিন বছর আমি দু মাস। কলেজ ছাড়ার এতদিন পর দেখা হলেও, একেবারে নতুন জায়গা বলেই
অনিকেই মনে হলো কত দিনের চেনা আপনজন ।
আমি বললাম, কি
রে ভাই একেবারে রোগা হয়ে গিয়েছিস।
অনিক হাসল, যা
চাপ রে কাজের , নতুন এসেছিস বুঝে যাবি তারপরেই , থাক কিছুদিন ।
অনিককে একটু
পরিবর্তিত লাগলো। আগের থেকে কথা বলছে বেশি । চুলে চিকনাই ।
লাঞ্চে কিছুই
নিলো না , আমি বললাম কি রে খিদে পায়নি ?
বলল, জানিসই
আমি নিরামিষ ।
অনিক বনগাঁর
ছেলে। ঠাকুরের মন্ত্রে দীক্ষত ছোট থেকেই। আমরা বহু চেষ্টা করেও পেঁয়াজ অবদি
খাওয়াতে পারিনি। আমরা বলতাম – মদে দোষ নেই পেঁয়াজে দোষ ?
আমি বললাম, এখনও ?
বলল, জোশ থাকে
না রে ভাই।আমিষ শরীরে সুট করেনা।
টুকটাক কাজের
কথায় হচ্ছিল , অফিসের কথা , সুবিধা অসুবিধার কথা ।
আমি বললাম,
বিয়ে করছিস না কেন রে ?
কিছুক্ষন চুপ
করে রইল, হাসল একটু। বললো , ধুর বাড়া মেয়ে পছন্দ হচ্ছে না ।
বাড়া আর বাল এই
দুটি শব্দ আমাদের কলেজ লাইফে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর মত ছিলো ।
বেলগাছিয়াতে
আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যেই ছিল ক্লাসরুম, লেডিস হোস্টেল, বয়েজ হোস্টেল । ক্লাস
ব্যাংক করার গল্প আমাদের ছিল না , ভোকেশনাল কলেজ গুলো অনেকটা খাঁচার মতো হয়। টানা
ক্লাশ । সেমিস্টারের প্রেশার। তাই ক্লাসের
পর আমাদের কলেজ জীবনের আসল সময় । ক্যান্টিন এ কেটে যেত বিকেল গুলো । ছেলেরা মুক্ত
কন্ঠে গাল দিত মেয়েদের সামনে । বলত – গালি দেওয়া আমাদের মৌলিক অধিকার , তোদের
শাস্তি হউয়া উচিত , যদি তোরা এই অধিকার
থেকে বঞ্চিত করিস।
আমরা বলতাম –
এট লিস্ট আমাদের সম্মান দে , আমরা মা এর জাত ।
ছেলেরা বলত
দেবী মা আমার, এই বর দাও যে আমরা কোন বাধা ছাড়াই গালি চর্চা চালিয়ে যেতে পারি ।
গালি শুধু গালি নয় ,আমাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম । আমাদের আনন্দের প্রকাশ , হতাশার
সঙ্গী , আমাদের বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ
কোরনা মাত। তারা বাল ও বাড়া শব্দ দুটি অবলীলায় বলে যেত আমাদের সামনে ।
আমি অনিক কে বললাম , মেয়ে পছন্দ হচ্ছে না কেন সমস্যা কি ?
- নিরামিশ
খাওয়া মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না । যা পাওয়া যাচ্ছে তা বাড়ির লোকের পছন্দ হচ্ছে না ।
একটু থেমে বলল –
ধুর বাড়া বিয়ে করে লাভ কি , এইতো বিন্দাস আছি, কোন চাপ নেই , যখন খুশি ঘরে ঢুকি ,
যা খুশি করে টাকা খরচ করি , এই করে চলে যাবে জীবন । তারপর টুক করে মরে যাব, বিয়ে
করলে শালা মরার সময়েও টেনশন – বৌ বাচ্চা কি খাবে ।
আনিক বলল , তুই
ফিরবি কখন ?
আমি বললাম –
বিকালে, আমার কনো তাড়া নাই। যেতে এক ধন্টা লাগবে , বিকালের টড়েন ধরলেই হবে ।
অনিক বলল –
চল বসি তাহলে কোথাও।
দামি বাইক কিনেছে অনিক , দামি মোবাইল । বাইক
স্টার্ট দিতে দিতে বলল, রেস্টুরেন্টে বসবি ?
- তোর যা ইচ্ছা
, আমি তো কিছু জানিনা, তুই অনেক দিন আছিস তুই ভালো জানবি , কোথায় বসলে ভালো হবে ।
অনিক বলল , চল
তোকে কাঁসাই নদী দেখিয়ে নিয়ে আসি। পুরুলিয়াতে এসেছিস ভাই, দেখে নে , প্রান ভরে
ঘুরে নে, পুরুলিয়ার আঁকে বাঁকে সৌন্দয্য ।
কাঁসাই নদী
দেখে আমার সত্যি মন ভরে গেল । এ যেন সেই আমাদের ছোট নদী চলে আকে বাঁকে । বষার জল
পেয়ে পুষ্ট হয়েছে কিন্তু বেগ তেমন নেই ,
কাশ ফুলের সমুদ্র যেন চারিদিকে । পরিস্কার জল যেখানে জল খুব কম নীচের বালি স্পষ্ট
দেখা যায় । বালির চরা পড়ে আছে মাঝে মাঝে । একটি ছেলে নদীর জলে চান করছে। কিছুটা
দূরে কাশ ফুলের জঙ্গলের মধ্যে বসে আছে একটা মানুষ , হাতে মনে হয় ছিপ , বাইরের জগত
থেকে পুরপুরি উদাসীন , নিবিষ্ট ভাবে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। এখানে আমরা ছাড়া আরো
একটা দল আছে যারা সেলফি ছবি তুলতে ব্যস্ত । তারা কাশ ফুলের মধ্যে একদিকটা হুল্লোড়ে ভরিয়ে রেখেছে । তাদের জন্য আমার খারাপ
লাগে , এত সুন্দর কাছে এসে একটু নীরব হতে
হয় , সম্মান জানানোর জন্য তা মনে হয় ভুলেই
গেছে তারা ।
অনেক ক্ষন চুপ
করে ছিল অনীক , বলল কেমন লাগলো ?
আমি বললাম ,
দারুণ রে ভাই , তুই না নিয়ে এলে কবে আসা হতো জানা নেই ।
- তোকে তো
কিছুই দেখাতে পারলাম না, কাঁসাই এর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রূপ, দিনের বিভিন্ন সময়
বিভিন্ন রূপ । বছরের নানা মাসে নানান রূপ ।
- তুই তো দেখি
কাঁসাই এর প্রেমে পড়ে গেছিস ।
- তা এক রকম
পড়েছি বতে পারিস। গার্ল ফ্রেন্ড কে নিয়ে কত এসেছি জানিস।
- গার্ল
ফ্রেন্ড মানে , তোর তো এইসব ছিলোনা , মানে শুনিনি কখন ।
- ছিলোনা
হয়েছে, আবার নায়।
- মানে ?
- মানে অই আর কি একটু ঘুরাঘুরি চলছিলো, সে আমাকে নিয়েই
পড়ে গেলো । আমার দ্বারা হবেনা ভাই এই সব লাফড়া।
- ঝেড়ে কাশ না
কি ব্যাপার । তোর জাত না?
- না রে মেয়ে
না , মহিলা । বাচ্চা আছে , সে সব ছেড়ে সংসার করতে চাই এখন আমার সাথে । আমি একটু
টাইম পাশ করতে গিয়ে ফেঁসে গিয়েছিলাম ।
আমি কি বলবো
অনীককে । পাঁচ বছর ব্যাচেলর ডিগ্রী , দুই বছর মাস্টার্স । সাত বছর দুটি মানুষ যদি
একসাথে থাকে , যদি তারা পরস্পর কথা নাও বলে তবু মনে হয় অনেকটা চেনা হয়ে যায় । অনীক
নিরামীষ খায়, পেঁয়াজ রসুন ও খায় না। মদ খায় । এই নিয়ে আমরা অনেক ঠাট্টা ইয়ার্কি
করেছি তাকে । কিন্তু সে অনড় । পড়াশোনা পাগল ছেলে ।
আমি বললাম –
যা হয়েছে ছাড়। একটা বিয়ে কর । একা ভালো আছিস , বিন্দাস আছিস , মানছি। কিন্তু পিঠ
চুলকানোর জন্য তো দরকার হয় একজন কে ।
আমার রসিকতায়
হাসল অনীক । বলল – টাকা পয়সা বেশি বাপ মা কে দিয়ে দি বুঝলি
। ওর চক্করে পড়ে এই দামি বাইক আর মোবাইল কিনেছিলাম। না হলে আমার কিছু লাগে নারে ।
টাকা কাছে রাখিনা , টাকা বেশি থাকলেই অন্য দিকে পা যাবে ।
- রান্নার লোক
রেখেছিস ?
- রান্না টা
আমি করি। ঘর ঝাড় বাসনকোসন মেজে সবজি কেটে দেবার লোক আছে । রাতে পড়া শুনো করি। অনেক
লোকের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, তাদের সাথেই সময় কেটে যায় ।
আমি হাসলাম ।
আমি আর কি বা বলতে পারি । আমি জিজ্ঞেস করিনা অই মেয়েটা কে সে ভালোবাসে কিনা ।
ভালোবাসা শব্দটা অনেক বড় শব্দ। ভালোবাসা শব্দটা অনেক ভারী শব্দ। আমি এই শব্দটা মাথায় বসে গেলা তাকে বহন করতে
হয়, এই বহন করে যাওয়াটা অনেকের কাছেই খুব কষ্টসাধ্য। বুঝতে পারি, অনিক মেয়েটাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। এই
কাঁসাই নদীর ধারে আমাকে নিয়ে এসে তাকেই ছুঁতে চাইছে বা আমাকে সাক্ষী রাখছে তার
অনুভবের। কিছু কিছু প্রেম স্বীকার করা কঠিন , কিছু কিছু প্রেম স্বীকার না করাই
ভালো। আমাদের বদলির চাকরি। আর এক বা দু বছর পরেই অনিকের বদলি হয়ে যাবে। এই বদলের
জীবনে কতটুকুই বা সে আর বয়ে চলবে।
অনীক বলল –
চল ফিরি তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখি ছোট বড় টিলা , ঢেউ
খেলানো জমিন।
অনীকের কথা
গুলো ছাপিয়ে মনে আসছিল কলেজের দিনগুলো । আমাদের ক্লাসমেটদের একটা গ্রুপ আছে ।
শুভেচ্ছা জ্ঞাপন ছাড়া তেমন কিছু হয় না তাতে । অনীক আমার বন্ধু ছিলো না, অথচ
অবলীলায় বলে গেছে তার পারসোনাল কথা । অথচ আমাকে একবার ও আমার কথা জিজ্ঞেস করেনি।
এমনকি স্টেশনে ছাড়ার সময় ও বলেনি –
ফোন করিস ।
bnmkhanum@gmail.com
No comments:
Post a Comment