...তুলসী সরদার
নন্দিনী, বয়সে ও আমার থেকে অনেকটাই ছোট। তবুও ওকে দেখে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছি! ওকে
প্রথম দেখেছিলাম একটি অনাথ আশ্রমে; ঠিক আজ থেকে দশ বছর আগে। আমি আর আমার কিছু সঙ্গীরা মিলে
একটি অনাথ আশ্রমে গিয়েছিলাম বাচ্চাদের পুরনো জামা কাপড় দেবো বলে। প্রায় ষাট
জনের মত বাচ্চা সেখানে উপস্থিত ছিল। আর নন্দিনী একেবারে শেষের সারিতে দাঁড়িয়েছিল
একটি জামা পাওয়ার আশায়।
শুরুর দিকটা অতটা ওকে
চোখে পড়ে নি, যখন জামা কাপড় বিতরণ
করছিলাম তখন বুঝতে পারছিলাম কিছু বাচ্চার জামা কাপড় গুলো পছন্দ হচ্ছিল না, কেউ কেউ একটু
অসন্তুষ্ট হয়ে যায় মনের মত জামা না পেয়ে। তাই সবাইকে ভালো জামা কাপড় দেওয়ার
চেষ্টায় একেবারে শেষের দিকে যারা ছিল তারা খুব একটা ভালো জামা কাপড় পায়নি,
তাদের মধ্যে নন্দিনীও ছিল একজন। একটা বড়
আলখাল্লা জামা শেষে ওর কপালে জোটে, পুরনো জামাটা
হাতে পেয়ে এতটাই খুশি ছিল বলার কথা নয়। আমি একটু ইতস্তত বোধ করে
ওকে বললাম, বাবু এর পরের বার যখন আসব
তোমাকেই ভালো জামা দেব আগে কেমন? ও বলল না না দিদি আমি
এতেই খুব খুশি। কিযে ভালো লেগেছিল ওকে, কত অল্পতেই খুশি হয়ে যায়।
এরপরে আরেকবার দেখার
সুযোগ হয়েছিল পঁচিশে বৈশাখে ওদের অনাথ আশ্রমে একটি অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ করা
হয়েছিল বলে। শিশু মাত্রই সকলের সমান তবুও
নন্দিনীর প্রতি আমার যেন একটা দুর্বলতা ছিল। কি মিষ্টি দেখতে মেয়েটিকে,
যেমন ভালো নাচে, তেমন ভালো গান
করে আর তেমন সুন্দর করে কথা বলে। উৎসাহ জাগে ওর সম্পর্কে জানার; জানতে পারি অনাথ আশ্রমের দরজার সামনে ওকে কেউ একজন রেখে চলে
যায়। নন্দিনী নামটা অনাথ আশ্রম থেকেই দেওয়া।
পড়াশোনার ইচ্ছার সাথে সাথে মেধা শক্তিও প্রবল পেয়েছে ও। সবকিছুতে ও যেন
পারদর্শী। মনে হয় স্বয়ং মা সরস্বতী ওর সহায়। ওই অনুষ্ঠানের পরে আর সুযোগ হয়নি
ওদের আশ্রম এ যাওয়ার। একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা। প্রায় দশ বছর পর আবার
পুরনো স্মৃতিচারণ করলাম কারণ কাল একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেখানে নন্দিনীও ছিল;
তবে গ্রহীতা হিসেবে নয় দাত্রী হিসাবে। গতকাল
আমরা পুজো উপলক্ষে প্রায় একশো জন
পথশিশুকে নতুন বস্ত্র বিতরণ করেছি; আর সেই
বস্ত্রগুলো আর কেউ নয় নন্দিনী দিয়েছে! শুনেছিলাম নন্দিনী নামের একজন সমস্ত
জামাকাপড় দিচ্ছে বাচ্চাদেরকে কিন্তু এই নন্দিনী যে সেই অনাথ আশ্রমের নন্দিনী তা
ভাবতেও পারিনি। আমিতো অনুষ্ঠানে দেখে ওকে চিনতে পারিনি, তবে ও কিন্তু আমাকে ঠিক চিনেছে।
বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠান
হয়ে যাওয়ার পরে নন্দিনী আমার কাছে এসে বলে দিদি কেমন আছেন?
আমি একটু অবাক হই! তাই
কিছুক্ষণ চুপ থাকি।
ও বুঝে যায় যে আমি ওকে
চিনতে পারিনি, তাই নিজেই বলে- আমি
নন্দিনী, আমি যে অনাথ আশ্রমে থাকতাম সেখানে আপনি আসতেন বস্ত্র বিতরণ
করার জন্য। আপনাদের থেকেই শিখেছি যখন প্রয়োজনের বেশি কিছু থাকে তখন যাদের কাছে
নেই তাদেরকে দিয়ে খুশি ভাগ করে নিতে হয়। কথাটা শোনার পর আমার খুব ভালো লাগলো।
ভালোলাগার কারণ- আজ এতো বছর পরেও নন্দিনী আমাকে মনে রেখেছে, ওকে সু-প্রতিষ্ঠিত
অবস্থায় দেখে আমার যে কি ভালো লাগছিল বলে বোঝাতে পারব না। তবে একটু লজ্জাও
লাগছিলো কারণ আমরা আশ্রম এ পুরনো জামা কাপড় দিতাম আর সেই পুরনো জামাকাপড় পরেই
নন্দিনী বড় হয়েছে। নিজেকে এমন জায়গায় দাঁড় করেছে যে এখন সে বাচ্চাদের নতুন
জামা-কাপড় দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। গর্ব হচ্ছিল ওকে দেখে। যারা সমাজ থেকে সাহায্য
পায় তারা যদি পরবর্তীকালে সুপ্রতিষ্ঠিত করে সমাজের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে
তাহলে সত্যিই আমরা এক নতুন সমাজ দেখার সুযোগ পাবো। নন্দিনী বলে ও নাকি আমায় দেখে
অনুপ্রাণিত হয়েছে। আমি বলি স্বার্থপরের মতন নিজের আখের গোছানোর নাম জীবন নয় বরং
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর নাম জীবন।
ওর মতে 'জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত উদ্দেশ্যের জীবন!' এই কথার মাধ্যমে ও যে কত বড় মনের পরিচয় দিয়েছে তা যাদের
মন আছে কেবল তারাই বুঝতে পারবে। আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি ওকে দেখে যদি আপনিও
অনুপ্রাণিত হন তাহলে আশা করি সমাজের উন্নয়নের কাজে আপনিও নিজেকে নিয়োজিত করবেন।
tulsisardar@gmail.com
No comments:
Post a Comment