...সুরশ্রী ঘোষ সাহা
জীবনকে
গুছিয়ে আনতে যাবেন ব'লে কাউকে না জানিয়ে পরদিন
ভোর ভোর বৃদ্ধাশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়েন বিপিনবাবু। পকেট ফুটো হয়ে যাওয়া পাঞ্জাবীটা
পরলেও কাঁধের ঝোলাটা নিতে ভোলেন না।
বিপিনবাবু জন্ম থেকে বেড়ে উঠেছিলেন গ্রামে কিন্তু একটা সরকারী চাকরি
পেয়েই নিজেকে সেই জায়গা থেকে কুড়ুল কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে শিকড়-বাকড় সুদ্ধ উপড়ে
ফেলতে বাধ্য হন। পাশাপাশি ততদিনে ছড়িয়ে যাওয়া ডালপালা অর্থাৎ স্ত্রী-পুত্রকেও
গুটিয়ে তুলে এনে বসান অন্য কোনখানে, আবার সেখান থেকে আরো কোথাও, আবার অন্য কোনখানে। এভাবেই নানা জায়গায় নানা ভাড়াবাড়িতে থেকে কেটে যায় তাঁর দীর্ঘ পঁঁয়ত্রিশ
বছরের চাকরিজীবন। জীবনে বহু শহর বহু বাড়ির ঠিকানাই হয়ে ওঠে তাঁর
নিজের, অন্যের
ঘর বারান্দাই হয়ে যায় নিজের ঘরসংসার। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে
বারবার তাঁর মনে হয় পুরনো ঠিকানাগুলোয় ফিরে যেতে। না, তার জন্ম নেওয়া গ্রামের
বাড়ি নয়, সে বাড়ি
মা বাবা গত হবার পরপরই দখল হয়ে যায়। বাইরের কেউ নয়,
তাঁর
আপনজনেরা কাকা জেঠুরাই নিয়ে নেয় সব কিছু। বিপিনবাবু হস্তিনাপুরের
রাজত্ব ফিরে পেতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ করেননি। চাকরিজীবন তাঁকে
বেঁধে রেখেছিল বহু বছর, যখন মুষ্ঠি আলগা করেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জীবনখাতার পাতা উল্টালে
বিপিনবাবু দেখেন তার জীবনের সকল স্মৃতিরাই আলপনা এঁকে রেখেছে নানা শহরের নানা জায়গার
বাসা-বাড়ির চৌকাঠে।
অবসর জীবন পেয়ে তিনি শুধু শুয়ে থাকেন বিছানায়, কাজ বলতে খাওয়া ঘুম
আর ভাবা শুধু ভেবে চলা। ছোট্ট ভবিষ্যতের চেয়ে বিরাট অতীত জীবন তাঁর চোখের
সামনে ভীষণ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। তিনি দেখতে পান বীরপুরের
ভুঁইয়াদের যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির ছাদে সারি বেঁধে বসিয়ে রাখা টবগুলোতে ফুল
ফুটে আছে। হঠাৎ টবগুলোয় জল দিতে ইচ্ছে করে খুব। তিনি ঘরের জানলা দিয়ে তাকান আকাশের দিকে, মনকেমন করে কতদিন
গাছগুলো জল পায়নি। হঠাৎ বিড়বিড় করে ওঠেন 'গবু তোকে কতবার বলেছি
মেঝেতে শুয়ে পড়াশুনা করবিনা। আশেপাশে জঙ্গল,
কত পোকামাকড়
সাপ বিছে ঘোরে' তারপরই সম্বিত ফিরে আসে তাঁর, ভাবনার ঘোর কেটে
যায়। জীবন এগিয়ে গেছে অনেক, গবুও এখন অনেক বড়
হয়ে বিদেশে চাকুরিরত। তবুও ভাবেন পুরনো ভাড়া বাড়িগুলোতে গেলেই তিনি
ঠিক দেখতে পাবেন ছোট্ট থেকে বড় হতে থাকা গবুকে। মনে হয় কলকাতার
লিটল মনরো স্ট্রিটের ভট্চায্যিদের বাসায় ফিরে গেলে তিনি খুঁজে পাবেন গবু স্কুলে সিক্সে
পড়ে।
শুনতে পান কোথায় কে যেন গান গাইছে, যেন বিরহের সুর। মনে পড়ে যায় কী সুন্দর মাউথ অরগান বাজাতেন তিনি, রোজ সন্ধ্যায় অফিস
থেকে ফিরে অন্ধকার ঘরে ইজিচেয়ারে বসে বাজিয়ে চলতেন একটার পর একটা গান। গবু অন্য ঘরে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকত, মনিকা রান্নাঘরে। ত্রিশ বছর আগে পুরুলিয়ার বোসপুকুরের বাসাবাড়ির জানলা দিয়ে চুরি হয়ে
যায় তার সেই শখের মাউথ-অরগানটা। মনটা হু হু করে ওঠে। আর কেনেননি তিনি, কেন আরেকটা তো কিনতেই পারতেন! কতই বা দাম?
ছেলেবেলায়
ভাল রেজাল্ট হওয়ায় বাবা কিনে দিয়েছিলেন সেটি। শেখার জন্য নিয়ে
যেতেন পাশের পাড়ায় মদন কাকুর কাছে। মদন কাকু তার জন্য
কোনদিনও পয়সা নেননি। বলতেন "সুর হল অক্সিজেনের মত, বাতাসে ছড়িয়ে দিতে
হয়, শুধু
বুক ভরে যেন মানুষ টেনে নিতে পারে, বৃক্ষ হতে শেখো বিপিন, খুব বড় ঝুরি নামানো
বটবৃক্ষ।" আজ আফসোস হয় তাঁর,কেন কিনলেন না আর?
নিজের
জীবন নিজের জগত বলেও তো কিছু রাখতে হয়। যেখানে ভগবান অধিষ্ঠিত
থাকেন, যেখানে
মাথা নত করে যখন তখন বসা যায় আর বুক ভরে শ্বাস টেনে বাঁচা যায়। নিজেকেই সান্ত্বনা দেন তখন সংসারে যে খরচের অনেক মুখ। গবুর লেখাপড়ার পিছনে কত খরচ, মনিকার অসুস্থতার খরচও অনেক। ওটার আর তেমন প্রয়োজন ছিল না। গবু তো কোনদিনও বাজাতে
বা শিখতে চায়নি। শুধুমুধু আর একটা কিনে কীই-বা হত! সেটাতো শুধু তার
একার জগতের একটা জ্বলজ্বলে তারা ছিল মাত্র। একবার যে তারা খসে
পড়ে গেছে তাকে কী করে আর আকাশে খোঁজা যায়!
সেই সন্ধ্যার চা খাওয়ার পর থেকে শুয়ে থাকেন তিনি ,অন্ধকার ঘরেই আজকাল
ভালো লাগে বেশি। চোখ বুজে কত কিছু যেন দেখতে পান। সেই যে কিছু বছর ছিলেন বাঁকুড়ার বাবুগঞ্জের কাঞ্জিলালদের বাগানওলা বাড়িতে,
ওখানে
খোলা বারান্দায় তার সাইকেলটা যেন হেলান দিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে, ঘরে ঢুকতেই দেখছেন
ওয়েলকাম লেখা পাপোসটা উল্টে আছে। ঠোঁট দুটো নড়ে ওঠে
তাঁর, গজগজ
করতে থাকেন আপনমনে। একটা পা উপর দিকে খানিক তুলে কল্পনার পাপোসটা অনবরত
সোজা করার চেষ্টা করতে থাকেন বিছানায় শুয়ে। তারপরই হঠাৎ কঁকিয়ে
কেঁদে ওঠেন, "মনি, মনি" বলে ডাকতে শুরু করেন। স্ত্রী মনিকা অসুস্থ
হয়ে মারা গেছিল দূর্গাপুরে থাকতে সাঁধুখাদের বাড়িতে। তাঁর বিশ্বাস আজও
সেখানে গেলে তিনি মনিকাকে দেখতে পাবেন। আসলে তিনি চলে এসেছেন
মনিকা আসেনি। আজকাল জীবনকে নতুন করে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে হয়
তাঁর। অনেক ঠিকানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তাঁর জীবন। শুধু গোছানোটুকু বাকি।
surashree0.sg@gmail.com
চুঁচুড়া, হুগলি
No comments:
Post a Comment