1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Friday, May 1, 2020

এই বসন্তে

                                                                                                 ...ইন্দ্রানি দলপতি 
।।১।।



          রোদ পড়ে এলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে অনি। এইসময়টা বেশ শান্ত লাগে তার। কাজের তাড়া নেই। টার্গেট পূরণের বালাই নেই। সবকিছুর থেকে আপাতত কিছুদিনের ছুটি নিয়েছে সে। বিকেল হলে বাগবাজার ঘাটে গিয়ে বসা, কলেজে পড়াকালীন এ তার নিত্যদিনের অভ্যেস ছিল। মাঝে পাঁচ বছরের বিরতি কাটিয়ে আজ আবার পুরোনো জায়গায়। ঘাটে পৌঁছে সাতটা সিঁড়ি বাদ দিয়ে আট নম্বর সিঁড়িটায় একদম কোণের দিকের জায়গাটায় গিয়ে বসে অনি, অলিখিতভাবে ওটা ওর জন্য বরাদ্দ। একটা সিগারেট ধরায়। চারপাশটা আরো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয়। অনেক পরিবর্তন নজরে আসে। নজরে আসে সিঁড়ির নীচের শ্যাওলার গাঢ় রঙ। সিগারেট পুড়তে থাকে। ধোঁয়াটা বেশিদূর যেতে পারে না। তার আগেই মিলিয়ে যায়।

- ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

চেনা কন্ঠস্বর পেয়ে সম্বিৎ ফেরে অনির।

- তুই ডিসাইড করেই ফেলেছিস যে জীবনে পাংচুয়ালিটিকে কোনোদিন ঠাঁই দিবি না। তাই না?

- কভি নেহি সাব।

মুচকি হাসে রিনিকা।

- তোর জন্য বুক ভরা সহানুভূতি আগাম জানিয়ে রাখলাম ন্যাকা।

- শয়তান, আবার তুই আমার নামটার ষষ্ঠী পুজো করছিস তো! যা, কথা বলবো না কোনো।

- আরে আরে, চটছিস কেন? একটু মজাই তো করেছি!

- তোর মজা হয়ে গেলে আসল কথা শুরু করতে পারিস।

- বড্ড তাড়া তোর!

- সত্যিই কি তাই অনি?

অনির চোখে চোখ রাখে রিনিকা। প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে চোখে চোখে। পিছিয়ে যায় কলেজের দিনগুলোতে।



।।২।।



- ঘটিগরম না ঝালমুড়ি?

- ঝালমুড়ি।

- বেলুন না চুইংগাম?

- বেলুন।

- মিষ্টি দই না রসবড়া?

- রসবড়া

- গুপী গাইন না বাঘা বাইন ?

- ভুতের রাজা!

- তুই রুলস্ ভাঙলি কিন্তু অনি।

- সে তো আমার মজ্জাগত মামণি।

মুহূর্তে ক্যান্টিনের ৫ নম্বর টেবিলে হাসির ফোয়ারা ওঠে। আপাতত র‍্যাপিড ফায়ার রাউন্ডের মোড় ঘুরে গেছে, দুই পক্ষ, দুই পক্ষের সাপোর্টার, সাপোর্টারদের নিঃস্বার্থ সাপোর্ট। এই সবকিছুকে তুড়ি মেরে হাজির হয় গরম গরম ঘুগনী।
এরপরের ক্লাসগুলো পরিকল্পনামাফিক বাঙ্ক মেরে বেরিয়ে পড়ে রিনিকা। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে এসে পথ আগলে দাঁড়ায় অনি।

- এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?

- বাড়ি ফিরবো। বাস ধরতে যাচ্ছি।

- কিন্তু রিনি, আমাদের আজ অন্য প্ল্যান ছিল। আমরা তো সূর্যাস্ত দেখে ফিরবো ঠিক করেছিলাম।

- করেছিলাম বুঝি? হবে হয়তো। কিন্তু আমি এখন ডিসিশন চেঞ্জ করেছি। বাড়ি ফিরবো।

- রিনি তুই কি সামান্য মজাগুলো বুঝিস না? কথায় কথায় এভাবে বারবার রাগ করলে কিন্তু...

- বেশ করি।

- সব ঝগড়া এখানে করে ফেলিস না। কিছু অন্তত বাঁচিয়ে রাখ!

- ফালতু লোক তুই একটা!

এই প্রথম নয়। এর আগেও অনেক সূর্যাস্তের মুখোমুখি হয়েছে ওরা। তবে আজ প্রথমবার ওরা দুজন দুজনের কাছে ধরা পড়ে গেছে। সূর্যটা রাঙা হয়ে উঠেছে, খানিকটা যেন রিনিকারই মতো, লজ্জায়! আর কিছুক্ষণ পরেই লুকিয়ে ফেলবে নিজেকে।



।। ৩ ।।



- অনি, আর একবার ভেবে দেখতে পারতিস।

- আমার ভাবা হয়ে গেছে রিনি।

- না, তুই আদৌ কিছুই ভাবছিস না। তুই একবারও আমার কথাটা ভাবছিস না।

- এত ভালো একটা সুযোগ আমি ছেড়ে দেব বলছিস?

- ভালো সুযোগতো তুই নিজের শহরেও পেয়ে যেতে পারবি অনি। কিন্তু এই সময়টা, এই সময়টায় যে তোকে খুব দরকার আমার।

- তুই বুঝছিস না কেন, এতে আমাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।

- অনি, আমরা দুজনে মিলে সামলে নিতে পারতাম এখানে। তুই শুধু যাস না, প্লিজ।

- বাস্তবটা বোঝ রিনি। পরিণত হ' একটু। যাকগে, ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। সাবধানে থাকিস। ফোনে কথা হবে।

ট্রেনটা ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। একসময় অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে যায়। আর দেখা যায় না। অনি-রা আসলেই বোঝে না যে প্রেমিকাদের পরিণত হওয়া স্বভাববিরুদ্ধ। প্রেমিকারা আকড়ে ধরে বাঁচতেই অভ্যস্ত, তাতেই তাদের সুখ, তাতেই তাদের শান্তি।

রিনিকা বাড়ি ফেরে। আয়নার সামনে বসে। একটু একটু করে মুছে ফেলতে থাকে প্রেমিকার সাজ, খুলে ফেলে অবুঝপনার আবরণ। জীবনটা পাল্টে যায় এক বসন্তের দুপুরে। জানলা জুড়ে নেমে আসে অবসাদ।



।। ৪ ।।



- কিরে? কোথায় হারিয়ে গেলি? অনি?

- বড্ড তাড়াহুড়ো করা হয়ে গেল রে।

- হয়তো যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে।

- তুই ভীষণ অভিমান করে আছিস, আমি জানি।

- ছাড় না। কেন ডাকলি আজ বল?

- আজ নিজেকে ভীষণরকম ভুল মনে হচ্ছে রিনি। এই যে আজকের আমি, এই আমিটাকে ভীষণ বোঝা লাগছে জানিস। আমিতো...

- এক মিনিট, এক মিনিট..... কী হয়েছে বলতো তোর? আবার ছ্যাঁকা খেয়েছিস মনে হচ্ছে।

- মানে? আমি কি ইয়ে নাকি? তুই কিন্তু আমার চরিত্রে দাগ লাগাচ্ছিস!

- বাব্বাঃ ভূতের মুখে এ যে রামনাম!

- বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু রিনি।

- বাড়াবাড়ি বুঝি আমি একাই করি, আর তুই? তুই করিস না কলেজে পড়তে একটা মেয়েকে নিয়ে লাইন মারলিকিছুই করতে পারলি নাটাকার পিছনেভালো সুযোগের পিছনে ছুটে বেড়ালি আজীবনপাপবোধ জেগে উঠতে ফিরেএসে এখন একজন মাঝবয়সী মহিলার সাথে লাইন মারছিস। লজ্জা করে না তোর একটুও? তুই আমাকে সময় নিয়ে জ্ঞান দিস, আর নিজের জ্ঞানটা কবে হবে অনি?

উত্তেজনার বশে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দিয়ে থেমে যায় রিনিকা। রিনিকার এই মেজাজের সাথে অনি পরিচিত বহুকাল ধরে। এর আগেও অনেকবার মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু আমল দেয়নি। ভালো করে শোনেইনি, হয়তো শুনতেই চায়নি। অনি রিনিকার হাতের ওপর হাতটা রাখে, রিনিকা বলে – স্যরি। আজ উঠি। কিছু মনে করিস না।

অনিও রিনিকার সাথে উঠে দাঁড়ায়। পাশাপাশি অনেকটা পথ একসাথে হাঁটতে থাকে, চুপচাপ। বাগবাজার বাটায় এসে শ্যামবাজারের দিকে ঘুরতে গিয়ে পিছন থেকে হ্যাঁচকা টানে খানিকটা পিছিয়ে যায় রিনিকা।

- হাতটা ছাড় অনি। যেতে দে আমায়।
- যে কথাটা বলার জন্য ডেকেছিলাম সেটা তো শুনে যা। কলেজে যে মেয়েটার সাথে লাইন মারতাম, আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম। আর এখন যে মাঝবয়সী ভদ্রমহিলার সাথে লাইন মারছি, তাকে আমি ভালোবাসি। আগামীকাল তার বাড়িতে আমার বাবা-মা যাবে তাদের হবু-বউয়ের সাথে আলাপ করতে, তুই সেখানে থাকিস, একটু আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিস।
 ইসস! আমার বয়েই গেছে।

জীবনটা পাল্টে যায় এক বসন্তের সন্ধ্যায়… ফেরার পথে রিনিকা দেখে ওদের বাড়ীর সামনের গাছটায় থোকা থোকা পলাশে ছেয়ে গেছে।





nayonika3@gmail.com


No comments:

Post a Comment