...জয়দীপ
মুখোপাধ্যায়
"আমি আর্টিস্ট হতে চাই।" ছেলের এই একটা
কথাতেই যেন ভূমিকম্প হলো।
"আবার বল।কি বললি" আমার স্ত্রী চোখ বড় বড়
করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো।
"আমি এনিমেশন ফিল্ম বানাবো।আমার ফিল্ম পুরো
দুনিয়া দেখবে।" দুটো বড় বড় চোখে হাজার স্বপ্ন নিয়ে ছেলে বললো।
বারো ক্লাসের
বিজ্ঞান শাখায় পড়া,আপাত বেশ ভালো পড়াশোনায়, একটি লাজুক, অন্তর্মুখী ছেলের কাছ থেকে এমন বিদ্রোহ আমরা কেউ আশা করিনি। কোনো দিন নিজের
কোনো মতামত জাহির করেনি ছেলেটি।যখন যেখানে যেমনটি পড়ার বা করার তার বাইরে কোনোদিন
তাকে যেতে দেখিনি।শিক্ষকরাও কোনোদিন তার দোষের বর্ণনা করেনি।সেই ছেলে পরীক্ষার একমাস
আগে যদি এমন কথা বলে তবে তো ভূমিকম্প হবেই।
"
বাবু, কিছু প্রবলেম হয়েছে।বল না আমাদের।আমরা সবাই
মিলে সলভ করার চেষ্টা করি।কিছু চেপে রাখিস না।"আমি বুঝিয়ে বলি ছেলেকে।
"
না কিছু
হয়নি" ও জবাব দিলো।
"
কিছু খাবি।বাইরে
যাবি কোথাও খেতে।আমিনিয়া,
পিটার ক্যাট বা
বল অন্য কোথাও।যেখানে তোর ভালো লাগে।"ওর মা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।
"
প্লিজ, আমাকে তোমরা বিরক্ত কোরো না।"
"
শোন, বাবু।আমার সাথে পাশের ঘরে আয়।"আমি ওকে
পাশের ঘরে একান্তে ডাকলাম।আমার বাধ্য ছেলে আমার ডাকে সাড়া দিলো।
"
পড়াশোনার বাইরে
তোর কিছু সমস্যা আছে?
মানে কারুর সাথে
কোনো মনোমালিন্য,
মতের অমিল কিছু
হয়েছে?
কোনো টিচার কিছু
বলেছে?"আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম।
"
না তো।আমার
সেরকম কোনো বন্ধু নেই।আমার চিন্তাভাবনার সাথে কারুর মেলে না।আমি একা থাকতে
ভালোবাসি।" ছেলের স্বীকারোক্তি।
"
তা তুই কি চিন্তা করা পছন্দ করিস? "আমি জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছি।" এত বিশাল
সিলেবাসের বাইরে তুই কিকরে আলাদা চিন্তা করার সময় পাস।"
মানুষের মন বড়
বিচিত্র।আমরা বাইরে থেকে একজনকে দেখে সত্যিই বুঝতে পারিনা তার মনের ভিতরে কি
প্রচন্ড লড়াই চলছে। তার মনের ভিতরের টানাপোড়নের প্রতিফলন ঘটে তার ব্যবহারে।কিন্তু
আমরা,
ওর কাছের লোকেরা
নিজেদের কাজ নিয়েই থেকেছি।ওর মনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারিনি।
"বাবু, গান শুনবি। ইউ টিউবে চালবো। বব ডিলান এর ব্লোয়িং ইন দা উইন্ড শুনবি।"আমি
জিজ্ঞেস করলাম।
"তুমি চালাও, আমি গিটার নিয়ে আসি।"বলেই ও দৌড়ে গিটার আনতে চলে গেল।
রাত্রে দেখলাম
স্ত্রীর চোখে জল।"আমাদের এত ভালো ছেলেটার পরীক্ষার আগে কি নার্ভাস ব্রেকডাউন হলো? আমায় প্রশ্ন করে ও " ওর সাইকোলজিকাল
কাউন্সেলিং করালে হয় না?"
"
সবাইকে কেন
ডাক্তার,
ইঞ্জিনিয়ার বা
বিজ্ঞানী হতে হবে?সবাই কেন চেনা রাস্তায় হাঁটবে? কাউকে না কাউকে তো অন্য রাস্তা আবিষ্কার করতে
হবে।"আমি স্ত্রীকে আর নিজেকেও প্রবোধ দিলাম।
সকালে দেখি আমার
মা আর বাবা মুখ ভার করে বসে আছে। জলখাবারের সময় মা জিজ্ঞাসা করলো" হ্যারে, বাবু কি আর পড়াশোনা করবে না? খালি ছবি আঁকা নিয়েই থাকবে?"
"আমাদের পরিবারটা নষ্ট হয়ে গেল?"মা প্রায় কেঁদে ফেলে।"তোরা এতো পড়াশোনা
শিখলি কিন্তু ছেলেটার দিকে নজর দিলি না। ও বয়ে গেল।"মায়ের অভিযোগ আমাদের দিকে।
"শোনো, ওদের শুধু শুধু দোষ দিচ্ছ কেন?যা ভাগ্যে থাকে তা হবেই।আমরা কেউ আটকাতে পারবো না।"আমার বাবা গৃহযুদ্ধটা
সামলানোর চেষ্টা করছে।বুদ্ধিমান, পোড় খাওয়া মানুষ।জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা সামলেছেন।এখন সেই ঝড় বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ
করেছে।
একটু পরেই
শাশুড়ির ফোন " শোনো,
জয়ন্ত।আমি টিয়ার
কাছে এটা কি শুনছি?
বাবু পড়াশোনা ছেড়ে
দেবে বলেছে।"
"
কই, না তো।এমন কথা তো ও বলেনি।ওর কি ভালো লাগে
বলেছে।ওর ভালো লাগা আর আমাদের ভালো লাগা আলাদা হতেই পারে।ও তো একটা আলাদা
মানুষ।তবে যাই করুক ,
যদি ভালোবেসে
করে তবে উন্নতি করবে।"
"
তোমাদের লায়
পেয়ে ছেলেটা উচ্ছনে গেছে।আমাদের তিন পুরুষে সবাই ডাক্তার, তোমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার, তোমরা ডাক্তার, আর বাবু অমানুষ হবে?
এটা আমি কিন্তু
হতে দেবো না।
আমি দুপুরে
আসছি।" বলে ঘোচাৎ করে ফোনটা কেটে দিলেন।
ছেলের কাছে এসে
দেখলাম সে রসায়ন পড়তে মত্ত।পাশে ছবি আঁকার খাতা।তাতে একটা পায়রার ছবি আঁকা যে মনের
আনন্দে আকাশে উড়ছে।আমি বুজলাম ও উড়তে চাইছে। মাথার চুলে বিলি কেটে মনে মনে বললাম
" আমি আছি তোর এই ওড়ার সাথী হতে।"
দুদিন ধরে
বাড়িতে ঝড় বয়ে গেল।জ্যোতিষীর কাছেও আমার স্ত্রী ও শাশুড়ি গেলেন।বাড়ির কাজের
লোকেরাও ভয় পাচ্ছে।সীমার মা,আমাদের কাজের
লোক নিচু গলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলো " জামাইবাবু, বাবু কি সন্ন্যাসী হবে?"
বাবু দেখলাম
নির্লিপ্ত।আর নতুন করে কোনো কথা বলছে না।দুবেলা মন দিয়ে পড়াশোনা করছে।সবাই
নিশ্চিন্ত হলাম বোধহয় ঝড় থামল।
উচ্চমাধ্যমিক
হয়ে গেল নির্বিঘ্নে।" কিরে কেমন দিলি?" জিজ্ঞাসা করাতে উত্তর এলো "ভালো"।
সর্বভারতীয়
পরীক্ষাগুলো হয়ে গেল।
এরই মাঝে একদিন
দেখলাম বোর্ড হাতে সকালে কোনো পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে।
"কি পরীক্ষা রে?"আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
"
ডিজাইন এর
এন্ট্রান্স আছে?"
"সেটা আবার কি?" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
দেরি হয়ে যাচ্ছে
বলে ও ছুটে বেরিয়ে গেল।
ও কম্পিউটার
সায়েন্সে এ ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়েছে।বাড়িতে খুশির হাওয়া।আমার মনটা কিন্তু একটু
খারাপই লাগছে।ছেলেটার কি ইচ্ছে আছে? আজ অনেক লোকের বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল।পুজোপাঠও হলো।বড়রা সবাই ওকে আশীর্বাদ করে
চলে গেল।
দশ দিন পর ওর
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যোগ দেবার কথা।আমরা তিনজন দার্জিলিং বেড়াতে গেলাম।সকালে
ম্যালের পাস দিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চে তিনজন বসে আছি।সামনে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা
সূর্যের আলোয় চকচক করছে।বাবু পিঠের ব্যাগ থেকে একটা খাম বার করলো।
"
দেখো ডিজাইন
এন্ট্রান্সে আমি চান্স পেয়েছি। সাত দিন পর আমায় এনিমেশন এ জয়েন করতে হবে।"
বাবু আমাদের উত্তরের প্রতীক্ষায়।
আমি ওকে জড়িয়ে
ধরলাম।
"
এটা কি আমাদের
সারপ্রাইস দিলি।আগে বলিসনি কেন?"আমি অভিমান করে বললাম।
"
না, তোমরা যদি দুঃখ পাও, তাই বলিনি।"
"
শোন বাবু।তুই
যখন ছোট্ট ছিলি,
আমার খুব নাওটা
ছিলি।কোল থেকে নামতিস না।তোর পিঠ টায় হাত বোলাতাম আর ভাবতাম যেন অদৃশ্য তোর দুটো
ডানা ঘাপটি মেরে পড়ে আছে।তুই দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেলি।তোর ডানাগুলোও যে বড়ো হয়েছে, বুজতে পারিনি রে। এগুলো তোর ডানা।তুই ডানা
মেলে উড়বি তোর ইচ্ছেটাকে ধরতে তাতে আমরা যদি খুশি না হই তো কারা হবে?"
তোকে ফ্রী করে
দিলাম।তুই ইচ্ছেডানা মেলে উড়ে যা।
কলকাতা
mukhopadhyayjaydip@ymail.com
খুব সুন্দর লেখা।
ReplyDeleteদুর্দান্ত হয়েছে।
ReplyDelete