...মলয় সরকার
বিষয়টা কিছুই নয়,
ব্যাপারটাও তাই।খুবই
সাধারণ। শুধু সাধারণই নয়, একেবারে নিরীহ
নির্দোষ বিষয়।নিছকই গোলগাল সাদাসিধে ভদ্র বস্তু, আলু।
হ্যাঁ, সত্যি বলছি নিছকই আলু।একে সাদাসিধে বলা যায় না ,বলুন? ঝালে ঝোলে ভাজায় যেভাবেই ব্যবহার করুন, কোন প্রতিবাদ করবে না।শুধু নিজের উপস্থিতিতে
অন্যকে স্বাদু করা ছাড়া নিজেকে জাহির করার কোন দুরভিসন্ধি নেই।
ভেবে দেখুন, ছেলে বেলায়
গ্রামের মাঠে আলুর ক্ষেত থেকে যখন আলু তোলা হত, গ্রামে বলত 'আলু ভাঙা ' , তখন ক্ষেতের থেকে পড়ে থাকা আলু কুড়িয়ে নিয়ে
প্রচুর পরিমাণে আলুপোড়া খাওয়া হত। আর
কিছুই না, অল্প একটু নুন
সহযোগে বেশ গরম গরম- আহা, সে কি স্বাদ! আজও
যেন মুখে লেগে আছে! আলুপোড়া খেয়ে পেট ভর্তি হয়ে যেত, দুপুরে ভাত খাওয়া আর হত না। মা- মাসিরাও জানত,
এই সময়ে এটা হবেই। কেউ এ
ব্যাপারে কিছু বকাবকিও করত না।চারধারে আইস্ক্রীম কি বায়োস্কোপ ওয়ালারা ঘুরত,
পয়সা চাই না, কুড়ানো আলুর বিনিময়েই ছেলেপুলেদের রংবেরঙের বরফ
জমানো আইস্ক্রীম দিত কি দিল্লী বোম্বাইএর ছবিওলা বাক্সের চোঙের মুখ খুলে বায়োস্কোপ
দেখাত।
সেই আলু, যার কিনা অন্তরে
এতটুকু কালিমা নেই, পবিত্র
শ্বেতশুভ্র দেবসুলভ হৃদয়, ভাতের মধ্যে দিয়ে
সিদ্ধ করলে একেবারে সিদ্ধপুরুষ হয়ে যায়, যেমন খুশি হাত দিয়ে দলাই মলাই করলেও কোন প্রতিবাদ তো করেই না, বরং একটু নুন ও
ঝাঁজ ওয়ালা সরষের তেল সহযোগে একেবারে অমৃতের আস্বাদন এনে দেয়। অনেকে তো ভাত খাবার
শেষে দুধ ভাতের সঙ্গে এই রকম মাখা আলু সমস্ত খাবার ফেলে খেতে পারেন বা খাবার সময়
শেষ পাতে এটি তাঁদের একেবারে আবশ্যিক বস্তু।
দেখুন তো কোথা
থেকে কোথায় চলে এসেছি।কি বলতে বসেছিলাম আর কি বকে যাচ্ছি। জানি না আলু যেমন
গোলাকার, গড়িয়ে যাবার একটা
ধাত আছে, তার সম্বন্ধে কথা
বলতে গেলেও দেখছি সেরকমই গড়িয়ে যাচ্ছে যেন। আসলে আলুর একটু গড়াগড়ি খাওয়ার রোগ আছে।
তাই তাকে বেশ শক্ত করে বস্তায় বেঁধে না রাখলেই, বা যদি বস্তায় এতটুকু ফুটো পেয়ে যায়, ব্যস ! আর কোন কথা নেই বার্তা নেই একেবারে
গড়াগড়ি খেতে শুরু করে দেয় শিশুদের মতই।আসলে শিশুদের সাথে এর তো জন্ম থেকেই
মিল।অন্যান্য ফলের মত এ তো গাছের ডালে ফলে না, আসলে এ তো ফলই নয়। এর জন্ম মাটি মায়ের বুকের
মধ্যে, সকলের লোকচক্ষুর অন্তরালে
।মাটি মায়ের বুকের রস পান করেই এর বড় হয়ে ওঠা।তাই শিশুসুলভ চাপল্য বা সেইসঙ্গে
সরলতাও যেন এর সহজাত।তবে হ্যাঁ, যতটা সরল ভাবছি, ততটা বোধ হয় নয়।নিজের সরলতায় মানুষকে ভুলিয়ে
তার সমস্ত দোষ থাকা সত্বেও তাকে 'মিষ্টি মানুষ '
করে দেয়।ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের চোখ রাঙ্গানি।' করেছেন কি? এত মিষ্টি হওয়া তো ভাল নয়।তাহলে জগতে যত দুষ্টু
লোক ( অসুখ) আছে তাদের ঠেকাবেন কি করে? ' অতএব যতই শিশুসদৃশ হোক, আলুর সাথে
মেশামিশি বা মাখামাখি এক্কেবারে বাদ। নিজে মিষ্টি হয়ে পড়লেই শতহস্ত দূরে থাকতে হবে
তার থেকে।আর 'জুল জুল' করে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে দেখতে হবে অন্যেরা কি
সুন্দর আলু নিয়ে ধূলোখেলা মাখামাখি চটকাচটকি করছে।
এই রে! আবার ভুলে
গেছি, কি বলতে চেয়েছিলাম।আসল
ঘটনাটা হল ( এবার আর কিছুতেই ভুলব না, অন্য কথায় যাবই না) আমি না সব ভুলে যাই আজকাল। গিন্নী বলেন, তুমি চিরকালই ভুলো, এখন বয়স বাড়তে আরও বেশি ভুলো হয়েছ।হতে পারে।
তবে যখন ঠিক সময় ছিল, তখন তো বাবা, তোমার ওই 'আলু আলু ' গোলগাল মুখ দেখেই ভুলেছিলাম।তখন তো বলনি,
তুমি কেন আমাকে দেখে ভুলে
গেলে! আর ভুলে ছিলাম বলেই না, এতদিন তোমার মুখ
ঝামটা খেয়েও টিকে রয়েছি সংসারে।ছেড়ে তো চলে যাই নি। এই যে আলু নিয়েই তুমি আমাকে কি
যাচ্ছেতাই না করলে, তবু তো
আয়রণম্যানের মত ঠিক দাঁড়িয়ে আছি। ভেঙ্গে তো পড়িনি।
সেদিন হয়েছে কি,
বাড়িতে অতিথি আসার
কথা।গিন্নী কিছু খাবার দাবার বানাবে। আমাকে বাজার যেতে হবে।আসলে আমি ওই ভুলে যাই,
আর এক আনতে বললে আর এক
এনে ফেলি বলে এই ডিউটিটা আমার কাজের লিস্টে নেই।রোজ এক সব্জীওয়ালা ঠেলা করে সব্জী
নিয়ে আসে, এক মাছওয়ালা মাছ
নিয়ে আসে।তাদের কাছেই সব কেনাকাটার রোজকার বন্দোবস্ত, চিরস্থায়ী
বন্দোবস্তের মত ব্যাপার।আমার শুধু একটাই কাজ, মুদী দোকানের
জিনিসগুলোর লিস্ট কর্ত্রী হাতে ধরিয়ে দেন।আর আমি বাধ্য ছেলের মত বাঁধা দোকানে সেটি
পৌঁছে দিয়েই আমার দায়িত্ব শেষ।দোকানদার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে পাঠিয়ে দেয়, দেখে নেওয়ার দায়িত্বও আমার নয়।এ হেন মানুষকে
সেদিন যেতে হয়েছিল বাজারে। কারণ সব্জীওয়ালা ছেলেটির অসুখ করায় দু একদিন আসে নি।আর
ঠিক এই সময়েই অতিথির আগমন সংবাদ।অগত্যা আমার উপরেই পড়ল বাজারের কয়েকটি জিনিস
আনার।আমিও বীরদর্পে রাজী হয়ে গেলাম, ভেতরে যতই ধুকপুকুনি থাকুক।জানিনা,
কি করে অনেকে এই বাজার
করাকে ভাল লাগার মধ্যে আনেন বা একে নেশা করে ফেলেন।যাকগে, আমি তো বেশ নিজেকে চনমনে করে তোলার চেষ্টা করছি,
যেন,' ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয় '।
বাজার করে নিয়ে
এলাম। গিন্নীর বিশেষ কোন মন্তব্য পেলাম না, শুধু দেরীর জন্য একটু --।
রান্না হচ্ছে, ভালই এগোচ্ছে
সব।আমিও পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার সম্ভাব্য ফল প্রকাশের আনন্দে গুন গুন করে সবে গান
ধরেছি, " আলু আমার আলু ওগো
আলুই ভুবনভরা--", ঠিক এই সময়েই
বোমাটা ফাটল।
এটা কি আলু এনেছ
তুমি?
কেন, খারাপ দিয়েছে? এত করে বললাম ব্যাটাচ্ছেলেকে যে, বাড়ীতে লোকজন আসবে, ভাল আলু দিও, দাম যা লাগবে লাগুক।তাও খারাপ আলু দিয়েছে।কাউকে
আজকাল আর--
কে বলেছে খারাপ
আলু?
খারাপ নয়?
তবে যে তুমি বললে--
আমি বলছি,
তুমি কি বলেছিলে
চন্দ্রমুখী আলু দিতে? আমি যে পইপই করে
কান কামড়ে বলে দিলাম-
আমার হাত নিজের
অজ্ঞাতেই নিজের কানে উঠে যায় এবং তার এখনও অক্ষত এবং অবিকৃত অবস্থায় থাকার
অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চায়।
স্মৃতিতে আবছা
যেন আসে যে, হ্যাঁ চন্দ্রমুখী না কি একটা ওই ধরণের কিছু
বলেছিল বটে--
ওদিকে তখন গর্জন
চলছে সমুদ্রগর্জনের মত গুমগুম করে-
আনতে বললাম
চন্দ্রমুখী এনে হাজির করলেন জ্যোতি আলু, সিদ্ধ হয়েও প্যাট প্যাট করে চেয়ে আছে।এ দিয়ে আমি কি করব-
আমার কাছে তখন সব
ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।চন্দ্রমুখী জ্যোতি- জ্যোতি চন্দ্রমুখী--
মনে হতে লাগল,
আমি তো আর দেবদাস হই নি
যে পারুকে ছেড়ে চন্দ্রমুখীর পিছনে ধাওয়া করব।আর জ্যোতি বলতে জীবনে তো একজনকেই
চিনেছি, যাঁর মুখে কখনও হাসি
দেখেছি বলে মনে হয় না অথচ সদা শ্বেতবস্ত্রপরিহিত পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যনিয়ন্তা হিসাবে
দীর্ঘদিন থাকার রেকর্ড করেছেন।তা, তার সঙ্গে আলুর
কি সম্পর্ক থাকতে পারে এ নিয়ে মাথায় গোল পাকাচ্ছে।মনে মনে ভাবছি, গিন্নী, তুমি তোমার
কর্তাকে স্বেচ্ছায় চন্দ্রমুখীর কাছে পাঠাতে চাইছ, এটা কি তুমি ভাল করছ? সে শুনেছি বটে আমাদের ঠাকুমার কালে গিন্নীরা
নাকি তাঁদের কর্তাদের সাজিয়ে গুজিয়ে আতর দিয়ে ফিটফাট করে জুড়িগাড়ীতে তুলে দিতেন
বাইজী বাড়ী যাওয়ার জন্য আর ঘরে এসে অন্য সখীদের সাথে আস্ফালন করে গর্ব করতেন যে
তাঁর স্বামী কত বড়দরের যে এতগুলো মেয়ে পোষেন, পারবে কারোর স্বামী এমন করতে।জানিনা এর পিছনে, চাপাকান্না কিছু
থাকত কি না।
কিন্তু আজকের আলু
প্রসঙ্গে সেইসব চন্দ্রমুখীদের কথা কেন।জ্যোতি যে ' প্যাটপ্যাট' করে চেয়ে থাকে এও
তো কখনও শুনি নি।বললাম তো, জ্যোতি বাবুর চোখ
বা দৃষ্টি কখনও প্যাটপ্যাটে ছিল না।বরং শুনেছি, তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল এবং ওই চোখের দিকে
তাকিয়ে কথা বলার ক্ষমতা খুব কম লোকেরই ছিল।
সে যাক গে,
এটা অস্বীকার করতে পারব
না বাজার যাওয়ার আগে গিন্নী এই রকম কিছু একটা শব্দ বলেছিলেন ( যতটা মনে পড়ছে),
এবং আমি যথারীতি ভুলে
গেছি ওই শব্দটা। হ্যাঁ, এটা ঠিক, বাজার যাবার সময় বিশ্বাসবাবুর সঙ্গে দেখা
হয়েছিল।মেনেও নিচ্ছি, তিনি অনর্গল তাঁর
জামাইএর বিদেশ যাওয়ার কৃতিত্বের কথা সমানে পাক্কা দশমিনিট ধরে আমার কানে বর্ষণ
করেছিলেন আমাকে একটিও কথা বলতে না দিয়ে।আমাকে উদ্ধার করেন তাঁর মোবাইল, হঠাৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসায় তিনি সেদিকে
ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আমি ছুটি পাই।তবে ছাড়া পেয়ে দেখি আমার মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করছে
আর কেমন সব গুলিয়ে গিয়ে চোখে ধোঁয়া ধোঁয়া ঠেকছে।তখনই হয়ত গিন্নীর 'চন্দ্রমুখী'ও লুকিয়ে স্মৃতি থেকে নিঃশব্দে কেটে পড়েছেন।
তবে আমার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল, দোকানের সব চেয়ে
ভাল জিনিসটা এনে দিলে তার উপর তো আর কথা হবে না।কিন্তু , অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। আর ওই '
কপালে লিখিতং ঝাঁটা, খণ্ডাবে কোন -
ব্যাটা।'
ওদিকে গর্জন
সমানে চলছে আমার মত এক হতভাগ্যকে উদ্দেশ করে-
বলেছিলে দোকানীকে
চন্দ্রমুখী আলু দিতে? আমি বার বার বলে
দিয়েছিলাম তো, বল, বলিনি?
বলেছিলে, মনে পড়ছে।তবে সেটা বোধ হয় বলা হয় নি, কিন্তু ভাল আলু
দিতে বলেছিলাম।
মিনমিন করে উত্তর
দিই।
কবে আর
বুদ্ধিসুদ্ধি হবে?
সে সম্ভাবনা যে
ভীষণই কম নিজে নিজেই উপলব্ধি করি।যে বুদ্ধি দিয়ে একটা পাঁচশ' লোকের কোম্পানী চলে, তাদের পরিবারের অন্ততঃ দেড় হাজার লোকের
রান্নাঘরের সুব্যবস্থা হয়, তা যে নিজের
রান্নাঘরে দু- তিনজন লোকের কোন কম্মে লাগে না এটা খুব ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম হল।
পরে আমি দোকানিকে
বলেছিলাম, তোমাকে যে ভাল
আলু দিতে বলেছিলাম, তুমি আমাকে এমন
আলু দিলে যে তোমার বৌদি আমাকে শুধু উত্তমমধ্যম দিতে বাকী রেখেছে । চন্দ্রমুখী না
দিয়ে জ্যোতি দিয়েছ কেন?সে খ্যাক খাক করে
হেসে পানে লাল হওয়া ভাঙ্গা দাঁত সমেত গোটা দাঁতের পাটি বের করে বিগলিত ভাবে বলল,
ভালই তো দিয়েছিলাম। তবে
আপনি তো বলেননি চন্দ্রমুখী না জ্যোতি,
তাই বুঝতে পারি নি।
আমি চুপ করে হজম
করেছিলাম তার কথা।
তবে আমি জীবনে আর
এই ভুল করিনি। আলুর মত সরল গোলগাল জিনিষের মাধ্যমে কঠিন বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে
বুঝেছিলাম, একেবারে
ধ্রুবসত্য, 'জ্যোতি' কখনোই 'চন্দ্রমুখী' হতে পারে না আর 'চন্দ্রমুখী'ও 'জ্যোতি' হতে পারেনা। দুজনেই
নিজের নিজের জায়গায় স্বমহিমায় ঊজ্বল। আর একটা শিক্ষাও নিয়েছি, গোলগাল সাদাসিধে
দেখলেই যে তার ফাঁদে পা দেব, এমন ভুল আর এ
জীবনে করব না।
msarkar53@gmail.com
সোদপুর,কোলকাতা
No comments:
Post a Comment