...ডঃ রমলা মুখার্জী
ইতিহাসের পাতা
ওল্টালে দেখতে পাব ভারতবর্ষে প্রধাণত দুটি দুর্ভিক্ষ বড় আকারে দেখা দিয়েছিল। ১৩৫০
বঙ্গাব্দে পঞ্চাশের মন্বন্তরে ভারতবর্ষে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা
গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর অমানবিক নীতি, তবে বর্নবৈষম্যও
কিছুটা দায়ী ছিল। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিল ১১৭৬ বঙ্গাব্দের ছিয়াত্তরের
মন্বন্তর। ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানির খাদ্যশস্যের বাজার থেকে মুনাফা লুট এবং অতিরিক্ত
রাজস্ব আদায়ের জন্যই দেখা দিয়েছিল এই চরম দুর্ভিক্ষ যার ফলে প্রায় এক কোটি লোক
মারা গিয়েছিল।
দুভাগ্যবশত আগের দুর্ভিক্ষগুলি প্রধাণত ছিল
মনুষ্যঘটিত। কিন্তু ২০২৯ এ সারা পৃথিবীর মাটিতে নেমে এল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত এক
আতঙ্ক অনুকণা। প্রকৃতিসৃষ্ট নভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা ভয়াল প্রাণঘাতী অসুখের কারণে
সারা পৃথিবী জুড়ে মড়ক লেগে গেল।১৮৯৭ সালের মহামারী রোগ আইন ও করোনা ভাইরাস
সংক্রান্ত বিধিনিষেধ অনুসারে ২৪শে মার্চ
থেকে ভারত সরকার লকডাউনের নির্দেশ জারি করতে বাধ্য হয়েছিল। স্তব্ধ হল সোনার দেশ।
সত্যি, এমন বিপর্যয়ের
কথা কি মানুষ কখনও কল্পনা করতে পেরেছিল! পৃথিবীর উন্নততম প্রজাতি যখন প্রকৃতি জয়
করার উল্লাসে দাপাচ্ছে ঠিক তখনই এই মারাত্মক করোনা কীটের আক্রমণে সারা পৃথিবী জুড়ে
কোটি কোটি মানুষ একদম ধরাশায়ী, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু মিছিল।
সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করাই ছিল এই লকডাউনের
একমাত্র উদ্দেশ্য কারণ এক মানুষ থেকে আর মানুষে খুব দ্রুত সংক্রমিত হয় এই কভিড
নাইটিন। আচমকা এই লকডাউন ঘোষণার ফলে যারা বাড়ির থেকে দূরে ছিলেন তাদের দুর্গতির আর
সীমা পরিসীমা রইল না। তারা সবাই আটকে পড়ে রইলেন, হোটেল নেই, খাবার নেই, এমনকি জল পাওয়াও মুস্কিল হয়ে পড়ল। প্রচুর অর্থের
বিনিময়ে যাদের সঙ্গতি আছে কিছু যোগাড় করতে পারলেও গরীব মানুষদের অবস্হা নিদারুণ
হয়ে পড়ল। পরিযায়ী শ্রমিকরা মাইলের পর মাইল হেঁটে ঘরে ফিরতে লাগল। অনাহারে, পথশ্রমে ক্লান্ত
শ্রমিকদের কি চরম ভোগান্তি যে হল তা বর্ণনা করা ভাষার অতীত। ক্লান্ত শ্রমিক পথে, রেললাইনে, যেখানে সেখানে
ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ওঠে, আবার পথ চলে। কিন্তু পথে অনাহারে, অসুখে, পথশ্রমে, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেক শ্রমিকের প্রাণ পথেই
শেষ হয়ে গেল, ঘরে আর ফেরা হল না।
যান চলাচল, দোকান বাজার হঠাৎ বন্ধ হওয়ার কারণে একদিকে যেমন
দেশবাসী চরম দুর্গতির সম্মুখীন হল, অপরদিকে প্রচুর মানুষ কাজের অভাবে অনাহারে
ভুগতে লাগল। দেশে নেমে এল হাহাকার, অন্নহীনতা। সরকারও চরম অর্থসঙ্কটে পড়ল, তাই সরকার আস্তে
আস্তে পয়েলা জুন থেকে লকডাউন তোলার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল। কিন্তু তার ফলে
সংক্রমণ দিন দিন লাফিয়ে লাফিয়ে যে হারে বাড়ছে, জানি না এর শেষ কোথায় ! অতিমারীর ভয়ংকর ছোঁবলে
সোনার ভারত ছারখার হয়ে যাচ্ছে; দুর্ভিক্ষ লেগে গেছে ঘরে ঘরে। এ যেন শাঁখের
করাত, ঘরে থাকলে না
খেয়ে মরতে হবে, বাইরে বেরুলে করোনা সংক্রমিত হবে।
লকডাউনের মধ্যেই আবার শস্য-শ্যামলা সোনার
পশ্চিমবঙ্গ তছনছ হয়ে গেল আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ের প্রচন্ড দাপাদাপিতে। কত শত গাছ যে আছড়ে
পড়ল তার ইয়ত্তা নেই। গৃহহারার হাহাকার প্রবল বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে বাংলার আকাশ
বাতাস ভরিয়ে তুলল। বেশ কয়েকটি জেলার চাষের জমি ভেসে গেল।শস্য, ফসলের অভবে
বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ দুয়ারে কড়া নাড়ছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। সমুদ্রের পাড় ভেঙে নোনা
জলে ডুবে গেল সুন্দরবনের গ্রামকে গ্রাম। বিশ্বউষ্ণায়ণের ফলে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বাড়ছে, তাই জলচ্ছাস
বাড়ছে। বিগত এক দশকে তাই ঝড়-ঝঞ্ঝার ঝঞ্ঝাটও বেড়ে গেছে। আবহাওয়াবিদদের মতে ঝড়ের
প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ, তাই সুন্দরবন ধ্বংস হলে কোলকাতা মহনগরীও তছনছ
হয়ে যেতে পারে।
মনুষ্য প্রজাতির অতি আধুনিকতা, ভোগ-বিলাসিতা, বেহিসেবী পদক্ষেপ
কি তাহলে হোমো সেপিয়েন্সের কাছেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। প্রকৃতি কি তার
তুলাদন্ডে ভারসাম্যের হিসেব কষতে বসেছে, নিক্তির ওজনে
বুঝে নিচ্ছে তার অম্লজানের অনুপাত, আরও সব পরিবেশের ঘাটতি। পাখির কাকলি শুনতে
শুনতে বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করার কাজে পরমা প্রকৃতি বড় ব্যস্ত তাই
মানুষের কোন প্রার্থনাই তাঁর কানে পৌঁছাচ্ছে না। কবে যে করোনার বিভীষিকা শেষ হবে
তার উত্তর জানা নেই। তবে নিজের প্রয়োজনে
করোনা সব মানুষকে ধ্বংস করবে না কারণ এই ভাইরাস যেহেতু মানুষের দেহে ঢুকে জীবন লাভ
করে তাই মানুষ না থাকলে করোনারও অস্তিত্ব থাকবে না। তবে মানুষের উন্নত মস্তিষ্ক
থেকে নিশ্চয়ই করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হবে, এই আশায় আমরা সবাই। সেইদিনটা যেন খুব তাড়াতাড়ি আসে এটাই আজ সারা পৃথিবীর
প্রার্থনা। প্রতীক্ষার শেষ কর প্রকৃতি মা, তোমাকে লাঞ্ছিত আর করবে না মানুষ। পৃথিবীকে
বিশুদ্ধ আর সুন্দর রাখবো এই অঙ্গীকারে দৃঢ়বদ্ধ আমরা সবাই।
পরমা-প্রকৃতি, ক্ষমো অপরাধ যত,
নতুন ভোরে ধুইয়ে
দেবো ক্ষত।
দুষণ-দৈন্য করে
যাব সব দূর....
সাম্য-মৈত্রী-ঐক্যে
তুলবো সুর।
অতিমারী শেষে
ধনী-দরিদ্র মিশে
হাতে হাত রেখে
বাঁচবো ভালোবেসে।
ramala10@rediffmail.com
হুগলী
No comments:
Post a Comment