ভারতীয় ইংরেজি
নাটক বা আঞ্চলিক নাটকের ইতিহাস প্রাচীন, বহুবিধ রসে সমৃদ্ধ, এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে,
নানান ক্রমপর্যায়ে
বিভক্ত। হাইব্রিড বা বর্ণসংকর-যদি এইভাবে ভাবি, তাহলে হয়তো আমরা এই নাটকগুলোর ভারতীয় এবং
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বুঝতে সক্ষম হবো। প্রাচীন যুগ থেকেই ভরতের
নাট্যশাস্ত্র রোষ, ভাব, অভিনয়, ধার্মিক, বৃত্তি, প্রবৃত্তি, সিদ্ধি, অবোরস, বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য এবং গীতের এক মনোমুগ্ধকর সমাহার হিসেবে
আমাদের কাছে সবসময় সমাদৃত।ভারতীয় ইংরেজি নাটকে বা আঞ্চলিক নাটকে সেভাবে দেখতে গেলে
যদিও মহিলা নাট্যকার অথবা শিল্পীরা একেবারে ব্রাত্য ছিলেন না, তবুও বলা ভালো, ১৯৭০ এর পর থেকে, এবং তারও বেশ
কিছুটা আগে, স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যে মহিলা কবি, ঔপন্যাসিক এবং
নাট্যকারেরা আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, পারিপার্শিক বেশ কিছু ঘটনার উত্থান-পতন তাঁদের
লেখায় তুলে ধরতে সক্ষম হন।নারী সবসময় হেঁসেলের কাজ করবে, নারী ভালোবাসা, কাম, লালন, পালন এবং একটি সুখী গৃহস্থবাড়ির রূপরেখা আঁকতে
সবসময় সক্ষম, এইরকম বৃহত্তর প্রাচীন ধ্যানধারণা এবং যুগান্ধতা সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে ভারতীয়
ইংরেজি মহিলা নাট্যকারেরা বারবার ভারতীয় লেখাসমূহের সাংস্কৃতিক গঠনশৈলীকে প্রশ্ন
করে গিয়েছেন।নাটক যেরকমই হোক, লোকধর্মী, বা নাট্যধর্মী, স্থান,কাল, পাত্র আর চরিত্র নির্বাচন এবং রূপায়ণ একটি
বৃহত্তর সময় ধরেই পুরুষ-স্মিত শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলো, ফলত, যেসব ভারতীয় ইংরেজি নাটকে মহিলাদের দুস্থ, অজ্ঞ, কুলটা কিংবা
অবিসংবাদিত সহজলভ্য হিসেবে দেখানো হয়নি, সেই নাটকগুলিতেও যে তাদের অতলস্পর্শী সহমর্মিতা
দেখানো হয়েছে তা নয়।ভারতীয় সাংস্কৃতিক নির্মাণ এবং বিনির্মানের মধ্যে দিয়েই
বারংবার উঠে এসেছে নারীর বাকস্বাধীনতা এবং চেতনার প্রশ্ন,
এবং একইসাথে একটি
অনতিক্রম্য দূরত্ব রয়ে গিয়েছে একজন পরিণতমনস্ক নাট্যকার কতটা 'সত্যি' তাদের অঙ্কিত
নাট্যচরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তুলে ধরতে পারেন বিষয়ে।
ভারতীয় আঞ্চলিক
ক্ষেত্রে মহিলাদের লেখা নাটক প্রধানত আমরা পাই মারাঠি এবং বাংলা ভাষায়, যেখানে চরিত্রদের
ধ্যানধারণা, গতিপ্রকৃতি এবং নাট্যকারের মঞ্চায়নের স্ট্রাকচার হয়ে ওঠে নির্দিষ্ট
স্পর্শনদ্বারা অনুভবনীয়।এই 'ট্যাঞ্জিবল রিয়ালিটি'র ধারণা বারংবার উঠে আসে স্বর্ণকুমারী দেবীর
বিখ্যাত বেশ কিছু নাটকে, যেমন ১৯০৪ সালের 'দ্য ওয়েডিং ট্যাংগল', এবং এরপরে 'রাজকন্যা' এবং 'দিব্যকাম' নামক আরো দুটি নাটকে। এরপরে, ১৯৪৩ সালে ভারতী
সারাভাইয়ের রচনা করা 'দ্য ওয়েল অফ দ্য পিপল'
নাটকটি প্রাক-স্বাধীনতা
যুগে নাটক নির্বাচন এবং সামগ্রিকভাবে ভারতীয় নাটকের একটি নির্দিষ্ট ধারা এবং
ক্রমবিকাশ বুঝতে সাহায্য করে। অভিনয়ের কার্যকারিতা, আলো-স্বর-ব্যাকগ্রাউন্ড আওয়াজের সমৃদ্ধ
প্রক্ষেপন, কিছুটা নারীবাদী বিস্ফোরণ না করেও নারীস্বাধীনতা নিয়ে বেশ কিছু জায়গায় সামাজিক
ন্যায়কে স্থির করা- এই সবই আমরা পাই ভারতী সারাভাইয়ের এই নাটকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী
সময়ে, যখন একেএকে
সঙ্গীত নাটক আকাদেমি এবং 'ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশন' তৈরী হলো, তখন শুধুমাত্র
আর্থ-সামাজিক বিপন্নতা কিংবা ঘরোয়া প্রতিকূলতার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে, ভারতীয় নাটকে
আসতে লাগলো এমন এমন সব চরিত্রের পরিস্ফুটন এবং থিম যা বহুবিস্তীর্ণ, জটিল এবং যা
নিরন্তর নাটকের সংজ্ঞাকে আধুনিকতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করলো। একদিকে যেমন আমরা পাই
গিরিশ কার্নাড, বাদল সরকার, মোহন রাকেশ এবং বিজয় তেন্ডুলকরের মতো প্রখ্যাত নাট্য-রচয়িতাদের, অন্যদিকে, মঞ্চায়ন, নাট্যশৈলী, নাট্যচরিত্রের
পূর্ণসংসাধন ঘটিয়ে চলেছেন পয়েল সেনগুপ্ত (ইংরেজি), শাঁওলী মিত্র (বাংলা),
বর্ষা এডাল্যা (গুজরাটি), মঞ্জুলা পদ্মনাভন
(ইংরেজি), দিনা মেহতা
(ইংরেজি), ত্রিপুরারী শর্মা
(ইংরেজি), গীতাঞ্জলি শ্রী
(হিন্দি), ইরপিন্দার ভাটিয়া
(হিন্দি) এবং তেলুগুতে বিনোদিনী।
যদিও ফেমিনিজম
এবং অস্তিত্ববাদের তাত্বিক ডোমেইনগুলি সাহিত্যের তত্বের বিভিন্ন সেগমেন্ট হিসেবে
পড়া হয় তবুও নারীবাদী অস্তিত্ববাদ শারীরিক অধ্যয়নের পাশাপাশি আরো ৱ্যাডিক্যাল
চিন্তার সংমিশ্রণ নিয়ে একটি বিশিষ্টতার স্থান দখল করেছে। Simone
de Beauvoir যেরকম 'দ্য সেকেন্ড
সেক্স' বইটিতে বলেছেন
নারী কেবল জন্মগ্রহণ করেন না, বস্তুত তিনি নারী হয়ে ওঠেন । একইভাবে
অস্তিত্ববাদী নারীবাদীরা যুক্তি প্রয়োগ করার প্রক্রিয়া, যুক্তি-তক্কের পরিণতি এবং স্ব-প্রতারনার প্রভাব
বারেবারেই তাঁদের লেখনীর মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেন যা কিনা ভারতীয়ও ইংরেজি নাটকের
মধ্যেও সংগঠিত এবং প্রবলভাবে সঞ্চারিত হয়। ভারতীয় ইংরেজি মহিলা নাট্যকারেরা
বারেবারেই শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কেও বলেন যা নারী পরিচালক এবং অভিনেত্রীদের মধ্যেও
ভেতরে ভেতরে অনেকদিন থেকেই তৈরী হচ্ছিলো। এখানে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠে আসে যে
ভারতীয় এবং পাশ্চাত্যব্যাপী তাত্বিক অংশগুলি এবং ইংরেজি নাটকের নাট্যতত্বের দিকে
মনোনিবেশ করলে আমরা কিভাবে অস্তিত্ববাদ এবং নারীবাদকে সম্পৃক্ত করতে পারি।
ইংরেজিতে আধুনিক
ভারতীয় নাটকের ক্ষেত্রটি নতুন এবং উদ্ভাবনী থিম এবং কৌশল দিয়ে পূর্ণ। ভারতীয়
ইংরেজি নাট্যকারেরা এবং আঞ্চলিক নাট্য-উপস্থাপকরা ভারতীয় ইংরেজি নাটকের ঐতিহ্যগত
অবসর থেকে আর্থ-সামাজিক এবং ধর্মীয় কারণগুলি সন্ধান করে নতুন আধুনিক থিয়েটার
দর্শকদের সামনে বিভিন্ন ভাববাদী এবং প্রতীকী কৌশলগুলির মিশ্রনের মাধ্যমে উপস্থাপন
করেন। স্টেজ লাইট, প্রপস, চরিত্র এবং কথোপকথন ব্যবহার করে তারা ভারতীয়
মঞ্চ নাটকের স্টিরিওটিপিক্যাল ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং একটি নতুন রূপ দেয়।
মঞ্জুলা পদ্মনাভন, উষা গাঙ্গুলী এবং মহেশ এলকুনছওয়ারের মতো
আধুনিক নাট্যকারেরা দক্ষতার সাথে এমন নাটক তৈরি করেন যা দর্শকদের মাঝে আনন্দ ও
বেদনা জাগিয়ে তোলে।
১৯৯০-এর দশকের
পরে ইংরেজিতে ভারতীয় নাটক হয়ে ওঠে আরো পরিপক্ক, প্রায়শই কেবল দুজন বা তিনজন মানুষের জীবনবোধ
বা আত্মিক গতিপ্রকৃতির নির্ধারণ করে না, বরং সভ্যতার মহানগরীতে অবস্থিত মানুষের
আণুবীক্ষণিক জীবনকে কেন্দ্র করে জন্ম দেয় নতুন নতুন নাটকীয় পরিভাষার। ভারতীয়
ইংরেজি ভাষায় ঊষা গাঙ্গুলির নাম মূলত নারীবাদী নাট্য রচনার পুরো ধারণাটির সাথে
খুব ভালভাবে উচ্চারিত হতে পারে। তিনি একজন সাহসী চিত্রনাট্য লেখক, এবং তৃপ্তি
মিত্রের মতো প্রবীণ নাট্যকার এবং মৃণাল সেনের মতো পরিচালকের দ্বারা
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন অভিনেত্রী। গাঙ্গুলির নাটক 'রুদালী' একই নামে একটি সংক্ষিপ্ত কথাসাহিত্যের উপর
ভিত্তি করে তৈরি, যেটি মহাশ্বেতা দেবী রচিত।এই নাটকটি হিন্দিতে এবং হিন্দি এবং বাংলাভাষী উভয়
দর্শকের সমন্বয়ে দর্শকদের জন্য পরিবেশিত হয়েছে। মঞ্চে অভিনবতা এবং অভিনয়ের কৌশল
রয়েছে যা নারীর মনস্তত্ব এবং সত্তাকে গভীরভাবে তৈরি করে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তার
পুনর্বাসিত অবস্থানকে সামনে আনে। শনিচরী এখানকার প্রধান নারী চরিত্র, এবং এই গ্রামের
মহিলা সমাজের এক নিম্নবর্ণের মহিলা, সুতরাং প্রান্তিককরণের দ্বৈত রূপ রয়েছে এই
নাটকে, যেখানে আমরা
নারীকে সমাজের নিম্নবর্ণের অন্তর্ভুক্ত বলে চিহ্নিত করি এবং একজন মহিলার একজন নারী
থেকে প্রান্তিক হয়ে যাওয়া, সমাজের তার প্রতি নিকৃষ্ট ব্যবহার এবং সর্বোপরি, তার একাকিত্ব
সত্বেও আত্মনির্ভরতা ফুটিয়ে তোলা- এ সবই এই নাটকে ভীষণভাবে বিদ্যমান। এছাড়াও তার
আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নাটক হলো 'হম মুখতারা' এবং 'হিম্মত মাই' (বের্টোল্ট ব্রেখটের 'মাদার কারেজ'-এর উপর ভিত্তি করে) যা ধারাবাহিক উদ্ভাবনে প্রসারিত
একটি নাটকীয় সেট আপ তৈরী করে নারীদের আধুনিক গল্পটি কিংবা তাদের সাধারণ হয়েও
কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব হিসাবে বুনে।
ভারতীয় আঞ্চলিক
নাটক এবং ভারতীয় ইংরেজি নাটকের জন্ম ও বিকাশের বিষয়টি যখন আসে তখন কিছুটা
আন্তঃসম্পর্কিত ফর্মের এবং কাঠামোর পরিচালনার ব্যাপারে একটি দীর্ঘায়িত পড়াশোনার
প্রয়োজন হয়। নারীবাদ এবং অস্তিত্ববাদের সংমিশ্রনে এই নাটকগুলি হয়ে ওঠে আধুনিক
নারীমনের রূপান্তরের এক তীব্র রূপরেখা, যা কোনও একজন মহিলা, বা শুধু তার অধিকারগুলি যেভাবে প্রমাণিত হয় তা
নিয়ে মঞ্চায়নে উদ্যত হয়না; বরং, তার জীবনের শূন্যতাটিকে যেভাবে ডিকনস্ট্রাক্ট
করা হয় এবং তারপরে আবার একটি বিকল্প অস্তিত্বের অনুমোদন দেওয়া হয় - এগুলি সমস্ত
ক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক দলিল হিসেবে প্রতিফলিত হয় নাট্যচিন্তা এবং মঞ্চায়নের
মধ্যে দিয়ে। একটি প্রপঞ্চনাময়, ধারাবাহিক, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক পরিকাঠামোগুলির দ্বারা
চিহ্নিত বেশ কিছু নারীবাদী ভারতীয় ইংরেজি নাটক। যৌতুক, সামাজিক অন্যায়, বৈবাহিক কোড এবং নৈতিক রায় এমন কিছু উপাদান যা
দিনা মেহতা বা মঞ্জুলা পদ্মনাভনের নাটকের প্রধান অংশ তৈরি করে। পদ্মনাভনের তার বেশ
কিছু উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে 'লাইটস আউট' (১৯৮৪) এবং 'হারভেস্ট' (২০০৩)।
এই নাটকগুলিতে
অস্তিত্ববাদী উদ্বেগগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং আমরা এও দেখতে পাই যে আধুনিক
মহিলারা অস্তিত্ববাদের একাধিক দিক রয়েছে বলে মতবাদের কোনও সাধারণ অঙ্গকে গ্রাহ্য
করেন না। নারীর অস্তিত্বকে লালিত করে, তারপর একটি ভিন্ন রূপ প্রদান করে, ছিন্নভিন্ন করে
এবং কৌতুকপূর্ণ ও বৈরিতাবাদী উপায়ে খেললে নারীবাদী অস্তিত্ববাদের দিক থেকে
পাঠকদের কাছে বেশ কিছু আধুনিক ভারতীয় ইংরেজি নাটক কৌতূহল অধ্যয়নের নিরসনে পরিণত
হয়। এখানে আমরা অবশ্যই একটি পয়েন্ট চিত্রিত করতে পারি যা সার্ত্রে চিত্রিত মতবাদটির
অত্যন্ত বিরোধী, যখন তিনি বলে যে সাবজেক্টিভিজম দুটি নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয়তে নিযুক্ত করা যেতে
পারে, প্রথমটি, যা পৃথক বিষয়ের
স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত, এবং দ্বিতীয়টি আলোকিত করে মানুষ মানুষের subjectivity অতিক্রম করতে
পারে না যে সত্য, তার বিষয়ে। শেষে, এটিই বলা যায় যে, যখন আমরা ভারতীয় ইংরেজি নাটকের গ্রন্থগুলিতে
এবং মঞ্চে অস্তিত্ববাদী নারীবাদের মত একটি বিষয় নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি, তখন বিচ্ছিন্ন
কণ্ঠগুলির আরো বেশি একটি বিচ্ছিন্নতা রয়ে যায় যা হয়তো এখনও শোনা যায় না।
অধ্যয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে থিয়েটারস্কেপগুলি কীভাবে গঠিত হয় তা একটি আকর্ষণীয়
হলেও ভীষণভাবে অনাবিষ্কৃত অঞ্চল। ভারতে অস্তিত্ববাদী নারীবাদী থিয়েটার কেবল
সংশোধনমূলক নাটক বা কৌশলগুলির মতো সহজ পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি দর্শকদের
প্রবেশ ও প্রস্থান, সহানুভূতি এবং সহানুভূতির বিকাশ, জনতার প্রতিক্রিয়া
এবং আধা-রাজনৈতিক ও অনুপ্রেরণার মধ্যে দিয়ে ভিড়ের মতো নতুন কৌশলে প্রসারিত হয়
এবং প্রায়শই উর্ধমুখী মানব স্বভাবের সার্বিক শূন্যতা প্রদর্শন করে।
schakraborty3@kol.amity.edu
কলকাতা
No comments:
Post a Comment