...জনার্দন মুরারি মাহাত
পুরুলিয়া জেলার
গর্ব অযোধ্যা পাহাড় । দলমা পাহাড়ের একটি
অংশ ও পূর্বঘাট পর্বতমালার একটি সম্প্রসারিত অংশ । ছোটনাগপুর মালভূমির সবচেয়ে
নীচু ধাপ । বাগমুন্ডি বা অযোধ্যা পাহাড়ের আশেপাশের অঞ্চলটি একটিি সম্প্রসারিত
মালভূমি। অযোধ্যা পাহাড়ের বিস্তার অনেকটা অঞ্চল জুড়ে। বাগমুন্ডি থানা এলাকায়
বেশিরভাগ থাকলেও এর বিস্তার ছুঁয়ে গেছে আড়ষা,ঝালদা, বেগুনকোদর ও বলরামপুরে। পাহাড়ে আসার জন্য এখন
অনেকগুলো রুট আছে। পুরুলিয়াা-টামনা -সিরকাবাদ হয়ে, বলরামপুর -বাগমুন্ডি হয়ে, সুইসা - বাগমুন্ডি হয়ে,ঝালদা- বেগুনকোদর দিয়ে আসা যায়। তবে এখন আরও
রাস্তা হয়েছে। উরমা- ঘাটবেড়া হয়ে উঠতে পারে। আড়়ষা থেকে আসার জন্য আরও নতুন
রাস্তা তৈরি হয়েছে।
অযোধ্যা পাহাড়ের
নামকরণ নিয়ে হিন্দু পুরাণের যোগ আছে। কথিত আছে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র বনবাসকালে
অযোধ্যা পাহাড়ে আসেন।সীতাদেবীর তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পাতালভেদী বাণ দিয়ে জল
খুঁড়ে বের করেন। স্থানটি সীতাকুণ্ড নামে পরিচিত। বিজ্ঞানের ভাষায় আর্টেজেয় কূপ।
অনবরত মুখ দিয়ে জল বের হতে থাকে। সারা বছর এরকমভাবে জল বের হয়--- বিস্ময়
জাগায়। স্থানীয় মানুষ ভুড়ভুড়ি ডাঁড়ি(বুড় বুড়ি) বলে থাকেন। অযোধ্যা রাম
মন্দির থেকে খুব কাছে। পাশেই গড়ধাম ও শিকার উৎসব ময়দান। পবিত্র জ্ঞানে আদিবাসীরা
পূজা করেন। বুদ্ধ পূর্ণিমায় মেলা বসে।অনেক প্রাচীন গাছের উপস্থিতি অযোধ্যার
প্রাচীনত্বের সাক্ষী বহন করে। জায়গাটির মনোরম পরিবেশ মুগ্ধ করে।
অযোধ্যা পাহাড়ের
সুবিশাল ব্যাপ্তি ,বৈচিত্র্যময় গাছ ,পশু-পাখি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।পাহাড়ের বুকে
ছড়িয়ে আছে ঝরনা, নদী, জলাধার নানান প্রাচীন সম্পদ।অযোধ্যা পাহাড় কে
সমৃদ্ধ করেছে এখানকার জনজাতি-- তাদের ভাষা ,সংস্কৃতি ও উৎসব। ঋতুভেদে অযোধ্যা পাহাড়ের
সৌন্দর্য বদলে যায়। গ্রীষ্মের চড়া রোদে
দিনে অস্বস্তিকর হলেও রাতে তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যায়। পাহাড় জুড়ে চলতে
থাকে ফুরফুরে হাওয়া। কেন্দ পাকা পাওয়া যায়।গাছ পাকা ফল স্বাদে অপূর্ব।ভরা
বর্ষায় ঝর্ণা, নদী ,জলাধার যৌবনে
পদার্পণ করে। সবুজ গাছপালায় ছড়িয়ে পড়ে তারুণ্যের বাণী।পাহাড়ে পাহাড়ে মেঘের
ভেলা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে শিহরন লাগে। ভ্রমণের আনন্দই
আলাদা। তাজা হাওয়া, প্রকৃতির সাথে মিশতে দু -একদিন ঘুরে যেতে
পারেন।বৃষ্টি কমতেই মাঠে-ঘাটে নদীর চরে কাশফুলের বাহার। আকাশে বাতাসে আগমনী
বার্তা। এসে পড়ে শরৎ। পুজোর আনন্দ শেষ হতে না হতে পাকা ধানের ক্ষেত হেমন্তকে ডেকে
আনে। সোনালী ফসল ঘরে ঢুকতেই শীতের পদধ্বনি শোনা যায়। জাঁকিয়ে পড়ে শীত। সকালে
খেজুর রস এক অন্যতম প্রাপ্তি। খেজুর গুড়ের স্বাদ নেওয়া যায়। রোদ বাড়ার সাথে
কুয়াশার চাদর সরে যেতে থাকে। নরম রোদের আভা মেখে পাহাড়ে ভ্রমণ
আনন্দদায়ক।পর্যটকদের ভিড়ে অযোধ্যা পাহাড়ে তখন বিশাল সমারোহ। শীত বিদায়ের সাথে
পাতা ঝরার মরসুম।কুসুম ,পলাশ, মহুয়া পাতা ঝরিয়ে নবকলেবর ধারণ করে। কুসুমের
কচিপাতা লালে লাল, মহুয়া গাছে ফুলের কলি আসে।মহুয়া ফুলের গন্ধে
ভোরবেলা এক অন্য অনুভূতি নিয়ে আসে। পলাশ মানে পুরুলিয়া। প্রকৃতি একেবারে লালে
লাল। অপরূপ শোভা মন ভরিয়ে দেয়। রঙে রঙে বসন্তের সূচনা হয়। পলাশের টানে ছুটে
আসেন বহু মানুষ। প্রকৃতির সাথে রঙে রঙ মেখে পালিত হয় দোল উৎসব। মানভূমের ছন্দে সে
এক বাঁধনহারা আনন্দ।
অযোধ্যা পাহাড়
বেড়াতে এসে সব জায়গা ঘুরে দেখা খুবই কঠিন। সময় ও দুর্গমতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
কিছু স্থান অবশ্যই ঘুরে দেখা দরকার।পাহাড়ের উপরে জায়গাগুলো সম্পর্কে কিছুটা
আলোকপাত করার চেষ্টা করি।
*উসুল ডুংরি - দিনের শুরুটা উসুল ডুংরি সূর্যোদয় দেখে করা যেতে পারে। অযোধ্যা
হিল টপ থেকে মাত্র ৯ কি.মি পথ। টুডুগোড়া, এদেলবেড়া,কারি ঝরনা গ্রাম পার হয়ে উসুল ডুংরি। চূড়ায়
সদ্য নির্মিত ওয়াচ টাওয়ার থেকে সূর্যোদয় দেখা জীবনের অন্যতম অভিজ্ঞতা। সকালের
সোনালী আভায় জেগে উঠছে সারা রাজ্য। চারপাশে পাহাড়ের শ্রেণী ঘিরে আছে। সবুজের
রাজ্যে সে এক অন্য সকাল। ফেরার পথে শিমূল বেড়া গ্রামে হাতি খুঁটা ধীরি (হাতি
বাঁধার পাথর) ও গোলবনুম বা শিস্ কারি টিলা দেখে আসা যেতে পারে।
**অযোধ্যা হিলটপ - সমগ্র অযোধ্যার ভিউ নেওয়ার জন্য একটু হেঁটে ময়ূর পাহাড়ের
চূড়ায় আসুন। চারপাশে সবুজের শ্রেণি আপনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবে।পাহাড়ের
চারপাশে ঘুরে ঘুরে অপূর্ব ভিউ নেওয়া যায়। চূড়ায় বসে সূর্যাস্তের সাক্ষী হওয়া
যায়। অবশ্যই সীতাকুন্ড ঘুরে যাবেন। প্রকৃতির বিস্ময় কাছ থেকে উপভোগ করুন।
ধর্মপ্রাণ মানুষ রাম মন্দির ,ভারত সেবাশ্রম ঘুরে যেতে পারেন। কাঠের দুর্গা
মন্দির আছে। সারাবছর অনবরত প্রদীপ শিখা জ্বলছে। আশ্রমিক পরিবেশ মনে শান্তি নিয়ে
আসে।একটু হাঁটা পথে বনদপ্তর এর অফিস থেকে ঘুরে আসতে পারেন। পাইন গাছের সারি ছাড়াও, এলাকার অনেক
গাছের সাথে পরিচয় করুন। কৃষ্ণবট আছে। পাতার গঠন ভারি অদ্ভূত। বৃন্তের দিকে
মোড়া(পাতার তৈরি চামচের মতো)। তবে পাতা ছেঁড়া বা গাছের ক্ষতি করা চলবে না। নিষেধ
আছে। ঝরা পাতা দেখে সহজেই বুঝতে পারবেন।জঙ্গলে ভ্রমণ করতে চাইলে গোবরিয়া জঙ্গলে
যাওয়া যেতে পারে। ঘন জঙ্গলে বিপদের ঝুঁকি থাকবে।হাতি বা অন্য জীবজন্তুর সাথে দেখা
হয়ে যেতে পারে।আদিবাসী গ্রামে বেড়াতে চাইলে পাশেই সাহেবডি গ্রাম ঘুরে আসতে
পারেন।তাদের জীবনের লড়াই, সুখ দুঃখের কাহিনী ভাগাভাগি করা যায়। আদিবাসী
ছন্দে তাল মেলাতে চাইলে ,অজানা সুরে মনের তরী ভাসাতে ইচ্ছা হলে রাতে
আসুন।সাঁওতালি নাচে আগুন জ্বালিয়ে আপনিও সঙ্গী হতে পারেন।
***মার্বেল লেক/ব্লু ড্যাম/দুলগুবেড়া লেক হিলটপ> বাগমুন্ডি নামার পথে রাঙ্গা মোড় থেকে ডানদিকে
হাফ কিলোমিটার দূরে মার্বেল লেক।পাহাড়ের কঠিন শিলা খনন করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের
বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। খাদে জমা জল সৌন্দর্য্যে অতুলনীয়।কাছে গেলে মনে হয় এই
বিশাল সৃষ্টির মাঝে আমরা কত ছোট। একটু শব্দ করুন প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। আকাশ
পরিষ্কার থাকলে জল ঘন নীল দেখায়। জলের দিকে চেয়ে বেশ সময় কেটে যায়। ভাসমান
সাদা মেঘের ভেলা জল ছবি আঁকে। শিল্পী মন হারিয়ে যাবে নীল জলের গভীরে।
****বামনী ঝরনা-
রাঙ্গা মোড়ের
নেতাজি মূর্তি থেকে এক কিলোমিটার নেমে বামনী ঝরনা পৌঁছে যাবেন। সমগ্র অযোধ্যার
হৃদপিণ্ড। সৌন্দর্যের রানী। ছোট সিড়ি ভেঙ্গে ঝর্ণার কাছে পৌঁছে যাবেন। ঝর্ণার
প্রথম ভিউ কিছুটা নেমে। মিষ্টি ঝরনা অনেক উঁচু থেকে নেমে আসছে ।এই পর্যন্ত সকলেই
নামতে পারবেন।
আরও ৫০০টি ধাপ
নেমে প্রধান ভিউ।গোটা দশ পাথরের বাধা
টপকাতে আরো এক মোহময়ী রূপ এর সম্মুখীন হলাম --যৌবন মদেমত্তা নৃত্যপটিয়সী ছন্দময়
নৃত্যশিল্পীর।প্রায় ১০০ ফুট উচ্চতা থেকে লাফিয়ে পড়ছে অবারিত জল রাশি। ধাপে ধাপে
নীচে নেমে গেছে। পড়ি মরি করে ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। পাথর খণ্ডে আহত জল কণা
মিশছে বাতাসে। তার শীতল স্পর্শে শরীরে চলে আসে এক অদ্ভুত সজীবতা। টাইগার হিল এর মত
দূর থেকে দেখা রূপকথা নয়, দু হাত বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সমস্ত ইন্দ্রিয়
দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। সবুজের লালিত্যে পাখির কলতানে যেন এক খন্ড স্বর্গ রাজ্য।
ঝর্ণা র জলে স্নান করার লোভ সামলাতে না পারলে নেমে পড়া যায়। নিমেষে মুছে যাবে
সমস্ত ক্লান্তি ও মনের গ্লানি।
আরো ভিউ পয়েন্ট
আছে। তবে খুবই দুর্গম ও বিপদসংকুল। এই অংশে ঝর্ণা লোয়ার ড্যাম এর সাথে মিশেছে।
খুবই খরস্রোত। গগনভেদী শব্দ ,সাথে পিচ্ছিল পাথর কাছে যাওয়ার প্রতিবন্ধক।
সোজা হয়ে দাঁড়ানো এক চ্যালেঞ্জ। একটা বড় পাথর কোনমতে উপরে উঠতেই মনে হল যেন
নতুন এক জগতের দরজা খুলে গেল ।চারপাশে প্রাচীন পাথরের কড়া বেষ্টনী ।কমপক্ষে ৫০
ফুট উচ্চ ।কঠিন শিলার বুক চিরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। খর স্রোত--- কাছে যাওয়া খুব কঠিন।
জলের স্রোত সরু খাতে প্রবাহিত বলে তীব্রতা এত বেশী কল্পনা করা যায় না।নিজেদের
কথাগুলো ঠিক মতো শুনতে পাওয়া যায় না ।জল কনা অনেক দূরে ছিটকে পড়ছে। তাদের
স্পর্শে সমস্ত ইন্দ্রিয় সজীবতায় ভরপুর
হয়ে উঠে। হিমেল হাওয়া সমস্ত ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।
উপরে উঠে আসুন
সময় নিয়ে।সিঁড়ির বাঁকে পিছনে ফিরে লোয়ার ড্যাম ও বামনী ডুংরির ভিউ নেওয়া
যায়।
##সতর্কতাঃ ---বৃষ্টির দিনে কোন মতেই ঝুঁকি নেবেন না। এখানে বৃষ্টি না হয়ে
পাহাড়ের অন্য অংশে বৃষ্টি হলে সেই জল বান
ডেকে নিয়ে আসতে পারে। স্থানীয় গাইড সম্ভব হলে নিয়ে নেবেন। পাথরের মাঝে হঠাৎ
জলের তোড়ে এলে বিপদের কোন শেষ থাকবেনা। তবে হ্যাঁ এই ভয়ঙ্কর সুন্দর সৌন্দর্যের
সাক্ষী থাকতে ঝুঁকি তো কিছুটা নিতেই হবে।
*****টুরগা ঝরনা ও জলাধার - আরো তিন কিমি নেমে টুরগা ঝরনা। নামার সিঁড়ির ধাপগুলো
বড়ো। তবে খাড়া।প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতা থেকে লাফিয়ে নামছে টুরগা। জলের তোড়ে পাথরে
ক্ষত হয়ে খাদ সৃষ্টি হয়েছে। মন চাইলে স্নান সেরে নিতে পারেন।খুব কাছ থেকে দেখলে
মনে হয় আকাশ থেকে জলরাশি লাফিয়ে নামছে। পাশের পাথরে বসে ভিউ নেওয়া যায়। টুর্গা
ঝর্ণার ধারা ধরে নীচে নামলে আরো ভিউ পাওয়া যায়। একটু নেমে এক হাঁটু জল জমে আছে।
পাশেই বালুচর। বাচ্চাদের সাথে আনন্দ করে নিতে পারেন।টুরগার আরো ভিউ গুলো নিতে
চাইলে একটু অ্যাডভেঞ্চার করতে হবে।
গাড়ি রাখুন 'জল পরীক্ষাগার' কেন্দ্রের কাছে।
পাশের ডুংরি সহজেই টপকে উপরে উঠুন। টুরগা ড্যাম এর বিস্তার বোঝা যায় । গাইড নিলে
বলতে হবে 'ঘাঘকচা' যাব। আসলে টুরগা
ঝরনার একেবারে নিচের অংশ।চলার পথে চারপাশে ঘিরে রাখা পাহাড় মন ভরিয়ে দেয়।
এখানেই ঝরনার প্রকৃত ভিউ পাওয়া যায়।প্রায় ৫০ মিটার গোটা পাথরের মাঝে দাপিয়ে
বেড়াচ্ছে সুন্দরী টুরগা।শ্বেত ,শুভ্র জলরাশি তার চপলতা ,উচ্ছ্বলতার
প্রকাশ করে।সাদা পাথরের উপর চলমান অবস্থায় কি যে সোভা বিস্তার করে ,কাছে না এলে
উপলব্ধি করা কঠিন। ঝরনার সহজ গান মনে গেঁথে যায়। অবিরাম গতি ,উৎসাহ-উদ্দীপনায়
কোন খামতি নেই। সে যেন এগিয়ে চলেছে এক অজানা গন্তব্যে।এক বন্য সৌন্দর্য, নিবিড় প্রকৃতির
মাঝে কোলাহলকে দূরে সরিয়ে অনাবিল আনন্দ উপহার দিয়ে গেল।মনের গহনে সেই আনন্দের
রাজসূয় যজ্ঞের হোম চির অমলিন থেকে যাবে। জলের পথ ধরে উপরে উঠলে আরো বেশকিছু ভিউ
পাবেন। সময় নিয়ে প্রকৃতির মাঝে মিশে যেতে পারেন।
কাছেই টুরগা
ড্যাম। একটু সময় করে ঘুরে আসতে পারেন। সেচ দপ্তর এর অধীন ড্যামটির চারপাশ ভারি
সুন্দর। পাহাড় ঘেরা পরিবেশ মন ভালো করে দিয়ে যায়।
******কেষ্টবাজার ড্যাম, লহরিয়া শিব মন্দির, সুন্দরী অযোধ্যা পর্যটন কেন্দ্র ---
কেষ্ট বাজার
ড্যাম সেচ দপ্তর এর অধীন। জলের মূল উৎস ছিল কেষ্ট বাজার নালা।PPSP সৃষ্টির আগে
বামনী ঝর্ণা ও ঝাঁটা ঝোর ঝরনার জল কেষ্ট বাজার বেড়ায় এসে মিলিত হতো। তাদের মিলিত
স্রোত হল কেষ্ট বাজার নালা।কেষ্ট বাজার বেড়া মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে মোড়া ছিল।
গ্রামের মানুষ সেখানে বনভোজন করতেন। বনভোজন শব্দটি পূর্ণতা পেত।এখন তাদের আর
অস্তিত্ব নেই।সব স্মৃতি ,সৌন্দর্য লোয়ার ড্যাম এর সুবিশাল পেটে বন্দি
হয়ে গেছে।লোয়ার ড্যাম এর জল কেষ্ট বাজার জলাধারে আসে।পাড় ধরে চারপাশে হেঁটে
বেড়ানোর আনন্দই আলাদা।ফুরফুরে হাওয়া মন-মেজাজ হালকা করে দিয়ে যায়। সূর্যোদয় ও
সূর্যাস্ত দুটোই মনোরম। বাঁধানো ঘাটে স্নান সেরে নিন। অন্য রকমের তৃপ্তি পাবেন।
পাশেই শিব
মন্দির। পুণ্য স্নান সেরে, ভক্তপ্রাণ মন চাইলে পূজো সেরে নিতে
পারেন।স্থানীয় মানুষ পবিত্র জ্ঞানে প্রজন্ম ধরে পূজা দিয়ে চলেছেন।মন্দির চত্বরে
বিষ্ণুমন্দির ,রাম মন্দির, হরি মন্দির, কালী মন্দির ,দুর্গা মন্দির আছে।মন্দিরের গায়ে নানান ছবি ও অলংকরণ পুরাণের কাহিনী কে স্মরণ
করায়।
মন্দির শেষ করে কেচা
পাহাড়ের নীচে সুন্দরী অযোধ্যা পর্যটন কেন্দ্র।পার্কিং, রান্না করা ,সুলভ শৌচালয় ও স্নানাগারের ব্যবস্থা আছে। ছোট
গাড়ি করে পাহাড়ে ভ্রমনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।পিকনিক করার আদর্শ
জায়গা।ডিসেম্বর মাসের শেষ ,জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে কোন কোনদিন প্রায়
লক্ষাধিক মানুষের ভিড়ে হয়। বাজার বসে যায়।রকমারি খাবার ,খেলনা, ঘর সাজানোর জিনিষ
পাওয়া যায়।
*******পুরুলিয়া জলবিদ্যুৎ প্রকল্প --
লোয়ার ড্যাম , আপার ড্যাম,পাওয়ার হাউস ও
পাহাড়ের গায়ে কতগুলো টানেল নিয়ে গড়ে উঠেছে।আপার ড্যামের জলকে খাড়াপথে পাঠিয়ে
খরস্রোত কে কাজে লাগানো হয়। টারবাইন ঘুরিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। চারটি ইউনিট
দিয়ে @২২৫×৪=৯০০ মেগাওয়াট
বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম।এই প্রকল্পের সুবিধা হল উচ্চ চাহিদার সময় প্রয়োজনমতো
বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। ২০০২ সালের মে মাসে কাজ শুরু হয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই
১৭/১২/০৭ নির্মাণ সম্পূর্ন হয়।২৫০০ কোটি টাকা খরচে প্রকল্পটি জাপান সরকারের
সহায়তায় গড়ে উঠেছে।
লোয়ার ড্যাম এর
ভিউ পয়েন্ট থেকে অপূর্ব দৃশ্য পাওয়া যায়। একদিকে বিস্তীর্ণ কৃষি ক্ষেত্র, গ্রামের ঘরবাড়ি, অন্যদিকে পাহাড়ে
ঘেরা লোয়ার ড্যাম।বামনী ডুংরি ও কেচা পাহাড়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।সবুজের মাঝে
জলাধারের সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। বাঁধানো রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠেছে। যাত্রাপথে
প্রাকৃতিক পরিবেশ মুগ্ধ করে রাখে। রকমারি গাছপালা ,ফুল চোখ টানে। পাওয়ার হাউস চোখে পড়ে।শাল, কেন্দ, সিধা ,গলগল ,পিয়াল ,হরিতকী গাছ
অভ্যর্থনা জানায়। পাহাড়ের চূড়ায় আপার ড্যাম। জঙ্গল ঘেরা ,ভারি সুন্দর ।
জলের ওঠা-নামা আছে, কাছে না যাওয়ায় ভালো। পাড় ধরে হেঁটে
প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়া যায়। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত উভয়ই মনোরম। একপাশে সুনীল
জলরাশি কল কল করছে, অন্যদিকে সবুজের লীলাভূমি, অযোধ্যার বিস্তীর্ণ
শ্রেণি চোখে পড়ে। ওভার ফ্লো ব্রীজ থেকে সারি সারি শাল জঙ্গল চোখে পড়ে। প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য মন ভরিয়ে দেয়।
********মুরগুমা জলাধার /সাহারজোড় সেচ প্রকল্প:
অযোধ্যা হিল টপ
থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। অযোধ্যা- মুরগুমা রোড ধরে আসা যায়। পথের দুপাশে
আদিবাসী গ্রাম, রকমারি গাছপালা চোখে আরাম দেয়। মুরগুমার বিস্তৃতি অনেকটা জায়গা
জুড়ে।পাহাড়ের বাঁকে নামার সময় সৌন্দর্যের নতুন নতুন ডালি অপেক্ষা করে থাকে।
হাতে সময় নিয়ে যাওয়া দরকার।গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা পথে পাহাড়ের গা বেয়ে মন
যেদিকে চায় চলুন। প্রকৃতির সান্নিধ্য বেশ উপভোগ করা যায়।পাহাড়ের খাঁজে জল ঢুকে
সৌন্দর্য্যে অন্য মাত্রা এনে দেয়।রকমারি ফুল ও পাখির ডাকে উপত্যকা জুড়ে এক বিপুল
আয়োজন ,সাজো সাজো
রব।নামার পথে হেঁটে বাঁদিকে একটা পাথরের চূড়া থেকে অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায়। জল
কমে যাওয়া অংশে ঘন সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন ,গবাদি পশুর বিচরণ চোখ টানে। উপত্যকা জুড়ে
সবুজের হাতছানি। দূরে দূরে সারি সারি পাহাড়। সবুজের লীলাভূমি-যতদূর চোখ যায়
তাদের বিস্তৃতি।চারপাশে পাহাড়ের শ্রেণী ছোট-বড় পরম বন্ধুর মতো আড্ডায়
মেতেছে।বাঁদিকে একটা পাথরের উপরে উঠে খুব ভালো ভিউ পাওয়া যায়। তবে নিচে খাড়া
খাদ। সাবধানতা নেওয়া দরকার। হাত-পা শিউরে উঠে।তবে বিপদের আড়ালে অনাবিল সৌন্দর্য
লুকিয়ে আছে।সৌর কিরণে জলরাশির খেলা মন মাতিয়ে রাখে। পাড় ধরে হাঁটার সময় শীতল
বাতাস মন মেজাজকে ভালো করে দিয়ে যায়।
বসন্তে সারি সারি
পলাশের মেলা।পাহাড়ের মাঝে দূর থেকে মনে হয় মুঠো মুঠো আবীর কেউ যেন ছড়িয়ে
দিয়েছে।পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত দেখা জীবনের অন্যতম অভিজ্ঞতা। সোনালী আভায় জলের
উপর রঙের মায়া খেলা স্মৃতিতে আজও অমলিন।
janardanmurari@gmail.com
No comments:
Post a Comment