...অতনু রায়
হিমালয়ের কোলে এক
অনাবিল আভিজাত্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সিকিম।এখানে পৌঁছে আমি পেলাম এক
স্বর্গীয় সুখ।নেপাল, ভুটান, পশ্চিমবঙ্গ আর তিব্বত পরিবেষ্টিত সিকিম অন্যতম
সেরা বায়ো-ডাইভার্স অঞ্চল।আর এই সিকিমের উত্তরে ,সিকিমের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট ইয়ুমথাং ।গ্যাংটক থেকে ১৪১
কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিচিত্র বর্ণের ঘাসের গালিচায় মোড়া দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা
নিয়ে এখানে তৈরী হয়েছে প্রকৃতির স্বর্গলোক।এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখার অভিজ্ঞতা আজ
আপনাদের সাথে ভাগ করে নেবো বলেই এই লেখা।
আমাদের ইয়ুমথাং
যাত্রা শুরু গ্যাংটক থেকে।একটা টাটা সুমো গাড়িতে চেপে হিমালয়ের আঁকা বাঁকা পাহাড়ি
রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চললো।অদ্ভুত সুন্দর সব দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই আমরা এগিয়ে
চললাম।দুপুরে খাওয়ার জন্য গাড়ি একবার থামলো একটা পাহাড়ি হোটেলে।খাবার মুখে তোলা
কঠিন হলেও, পাহাড়ের কোলে সুন্দর সাজানো গোছানো এই হোটেলটি মন ভালো করে দিলো।তারপর আবার
গাড়ি ছুটে চললো।পাহাড়ের কোলে সন্ধ্যা নামলো।এবার ঠান্ডার অনভূতি বেশ বেড়ে গেল।গায়ে
চাপালাম গরম জামাকাপড়।রাত আটটা নাগাদ এসে পৌঁছালাম লাচুং।সেই রাত ওখানকার হোটেলেই
থাকতে হবে।পরের দিন সকালে যাওয়া হবে ইয়ুমথাং।
লাচুং এ হোটেল
ঠিক করা ছিলো।সেও এক নতুন অভিজ্ঞতা।হোটেলের মেঝে,দেওয়াল সবই কাঠের।লাচুং এ বেশ ঠান্ডা।রাতের
খাবার খেয়ে লেপের তলায় ঢুকেতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।পরের দিন সকালটা আমার
জীবনের অন্যতম সেরা সকাল।ঘুম থেকে উঠে গরম কাপড় গায়ে দিয়ে কাঠের ব্যালকনিতে এসে,কিছুক্ষণ থমকে
দাঁড়িয়ে থাকলাম।চোখের পাতা ফেলতে পারলাম না ।মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো- অপূর্ব
।ঈশ্বর নিজের হাতে রং তুলি দিয়ে এই ছোট্ট শহরের ছবি এঁকেছেন যেন।চারিদিকে হিমালয়ের
সুউচ্চ সব চূড়া।নানা রঙের কাঠের ঘরের মাথাগুলো সূর্যের প্রথম আলোতে চকচক করছে।আমরা
পুজোর সময় যেমন দড়িতে কাগজের পতাকা টাঙিয়ে দিই,এখানেও তেমনই অসংখ্য পতাকা টাঙানো আছে।তবে
পতাকাগুলো ত্রিকোণা নয়,চৌকো।পরে জেনেছিলাম, এইগুলি মৃত মানুষের আত্মার শান্তি কামনা করে
টাঙানো হয়েছে।
এই অপূর্ব দৃশ্য
আমাকে আগের দিনের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিলো।এরকম একটা সকাল চাক্ষুষ করার জন্য আরো
অনেক দূর যেতেও রাজি আছি।ইচ্ছে করছিল ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে থাকি অনন্তকাল।কিন্তু
সময় কম।ইয়ুমথাং এর জন্য রওনা দিতে হবে।হোটেলে ব্রেকফাস্ট আর চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম
‘দ্যা ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ‘ ইয়ুমথাং এর উদ্দেশ্যে।কেন যে একে ‘দ্যা ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ‘ বলে,মালুম হলো গাড়ি
খানিকটা এগোতেই।রাস্তার দুপাশে নানা রঙের চেনা-অচেনা সব ফুলের বাহার।ক্যামেরা
হাতেই ছিলো,চটপট ফটো তুলতে শুরু করলাম।কিন্তু কোন টার ছবি তুলি, আর কোনটাই বা বাদ দিই বুঝে উঠতে পারিনি।
আমরা প্রথমে
গেলাম, ইয়ুমথাং পেরিয়ে
আরো উপরে ‘জিরো পয়েন্ট ‘ দেখতে ।জায়গাটা ভারত ও চীনের সীমন্ত এলাকা।ইয়ুমথাং থেকে
৩০ কিলোমিটার দূরে ।‘জিরো পয়েন্ট ‘ চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিলো।চারিদিক বরফে সাদা হয়ে
আছে।চশমা ছাড়া চোখ মেলা দায়।এখানে দেখতে পেলাম-প্রিমুলা,রডোডেনড্রন,চেরি,ওক এবং বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।এই অঞ্চলে বাতাসে
অক্সিজেনের মাত্রা কম।তাই একটু পরিশ্রম করলেই হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম।বেশ খানিকটা সময়
ওখানে কাটিয়ে আমরা ফিরলাম ইয়ুমথাং ভ্যালিতে।
সবুজ গালিচায়
মোড়া বিস্তীর্ন উপত্যকা ।এখানে ওখানে চড়ে বেড়াচ্ছে ইয়াক বা চমড়ি গাই।কুলু কুলু
শব্দ করে বয়ে চলেছে লাচুং চু অর্থাৎ নদী।অসংখ্য ফুলের সমারোহ।চোখ ফেরানো যায়
না।নদীর ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসলাম, অগভীর নদীর স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে সময় পেরিয়ে
গেলো।এই জায়গা ছেড়ে ফিরতে ইচ্ছে করে না।তবু ফিরতে হয়। ‘দ্যা ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স
‘ কে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম।মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভব,একই সাথে
বিচ্ছেদের বেদনা।তবে প্রকৃতির স্বর্গলোক ইয়ুমথাং এর ছবি আমার মনে গেঁথে থাকবে
সারাজীবন।
atanuroy.sobujnagar@gmail.com
ভালো লাগলো স্মৃতি রোমন্থন।
ReplyDelete