...সিদ্ধার্থ সিংহ
পর পর দু-তিনটি
গুলির আওয়াজ। তার পরেই শোরগোল। রাতের খাবার সেরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি
দেখছিল দেবমাল্য। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। গুলির শব্দ সে খুব ভাল করেই চেনে
তার বাড়ি
হাওড়ার গোলাবাড়ি থানার কালীবাবুর বাজারের কাছে। কত বছর আগে তার ঠাকুর্দা ও-বাড়ি
বানিয়েছিল ও জানে না। ও রকম জায়গায় কেউ বাড়ি বানায়! চার দিকেই সার সার
কল-কারখানা আর বড় বড় ফ্যাক্টরি। আজ এটাই তালা ঝুলছে তো কাল সেটায় গেট মিটিং।
রোজই কিছু না-কিছু নিয়ে ঝামেলা লেগেই আছে।
তার উপরে আছে
স্থানীয় এবং আশপাশে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গুন্ডাদের দাদাগিরি। সেটা ওরা মূলত দেখায়
ছোটখাটো ব্যবসায়ী, কল-কারখানার মালিকদের উপরেই। আজ একে ফোনে
ধমকাচ্ছে তো কাল তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাতেও কাজ না হলে কারখানা বা শোরুমে ঢুকে
দাবি করছে পাঁচ লাখ, সাত লাখ, দশ লাখ। না দিলেই কপালে রিভলবার ঠেঁকিয়ে--- ঢাই।
শুনে শুনে এই
শব্দটার সঙ্গে এত পরিচিত হয়ে গেছে যে, আজ মাইল দূর থেকে ভেসে এলেও ও ঠিক বুঝতে পারে
শব্দটা কিসের।
শোরগোলটা আরও
বেড়েছে। এটা কালীবাবুর বাজারের কাছে হলে হয়তো এত কিছু হত না। কেউ সে ভাবে মাথাও
ঘামাত না। কারণ, গত আট-দশ বছরে সবার এ সব গা সওয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু এটা তো
কালীবাবুর বাজার নয়। দৌলতাবাদ। বহরমপুর কোর্ট স্টেশন থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। চার
দিকে যথেষ্ট জমজমাট হলেও, যে হোটেলে ও উঠেছে, সেটা ভারী অদ্ভুত ভাবে তৈরি। জিনি বানিয়েছেন
তিনি নিশ্চয়ই খুব শৌখিন ছিলেন। তাই হোটেলের ডায়ে-বাঁয়ে এবং সামনে এতটা করে জায়গা
ছেড়েছেন। আর পিছনে তো বিশাল বাগান। দেবমাল্য দোতলার যে ঘরটায় উঠেছে, সেই ঘরের জানালা
খুললেই চোখে পড়ে হোটেলের পিছন দিকটা। একেবারে রাস্তার আগ পর্যন্ত এক-দেড় মানুষ
সমান পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এই হোটেলের সীমানা অবধি ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া সবুজ কার্পেটের
মতো লন। সেই লনে মাঝে মধ্যে আকাশের দিকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক-আধটা গাছ।
পাঁচিলের ও পারে যে সরু রাস্তাটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে, সেটা খুবই
শুনসান। লোকজন চলাচল করে না বললেই চলে। মাঝেসাঝে একটা-দুটো সাইকেল দেখা যায় শুধু।
রাস্তার ও পাশে বিশাল বড় একটা জলাশয়। তাতে কচুরিপানা ভরা। এ রকম একটা পুকুর যদি
তাদের বাড়ির আশপাশে থাকত!
দিনকে দিন
গোলাবাড়িটা যা হয়ে যাচ্ছে, ওখানে আর কত দিন ব্যবসা করা যাবে সন্দেহ আছে।
দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে, ব্যবসা করা তো দূরের কথা, বউ-বাচ্চা নিয়ে
বসবাস করাই মুশকিল।
দেবমাল্যর বিয়ের
ক'দিন পরেই
শ্বশুর-শাশুড়ি বেড়াতে এসেছিলেন মেয়ের বাড়ি। পর দিন সকালেই তাঁরা ফেরার জন্য
তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। অথচ আসার আগে বলেছিলেন, দিনকতক থাকবেন। তা হলে একটা রাত কাটিয়েই তাঁরা
চলে যাচ্ছেন কেন! কী এমন হল!
সে কি কোনও
অন্যায় বা ভুল করে ফেলেছে! নাকি এ জায়গাটা তাঁদের পছন্দ হয়নি! নাকি এখানকার
খাবার-দাবার তাঁদের মুখে রুচছে না! না, এখানে তো তেমন মশা-টশাও নেই যে, তাঁদের জ্বালাতনে
মেয়ের বাড়ি ছেড়ে তাঁরা পালাবেন! তা হলে!
না, শ্বশুর-শাশুড়ি
তাকে কিছু বলেননি। তবে মা-বাবা চলে যেতেই তানিয়া ওকে বলেছিল, সে দিন মধ্যরাতে
নাকি মুড়ি-মিছরির মতো এত বোমা পড়েছিল, এত গোলাগুলি চলেছিল যে,
তার আওয়াজে সারা রাত আর
দু'চোখের পাতা এক
করতে পারেননি তার বাবা-মা। কখন কী হয় কোনও ঠিক আছে! বিছানার ওপরে ভয়ে জড়সড় হয়ে
কুঁকরে বসে ছিলেন তাঁরা। সকালে উঠেই তাঁরা নাকি মেয়েকে বলেছিলেন, এমন জায়গায়
থাকা তো খুব বিপজ্জনক। তোরা আছিস কী করে! জামাইকে একটু বোঝা। হাতের মুঠোয় প্রাণ
নিয়ে এ ভাবে বেঁচে থাকা যায় না। দরকার হলে কারখানাটাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে
যেতে বল।
তানিয়ার কথায়
কান দেয়নি দেবমাল্য। কিন্তু জামাইষষ্ঠীতে ও যখন শ্বশুরবাড়িতে গেল, শুধু
শ্বশুর-শাশুড়িই নন, তার বড় শ্যালক, ছোট শ্যালক সবাই মিলে তাকে এমন ভাবে বোঝালেন যে, তারও মনে হল, ওঁরা ঠিকই বলছেন।
তার পর থেকেই ও
বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি দেখছিল, ব্যবসাটাকে কালীবাবুর বাজার থেকে তুলে অন্যত্র
সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যত জায়গা দেখছিল, কোনওটাই তার পছন্দ হচ্ছিল না।
এক-একদিন একেক
জায়গায় যায়, আর ফিরে এসে বউকে বলে, জায়গাটা ঠিক জুতসই নয়। কোনও দিন বলে, সামনের রাস্তাটা
এত সরু, গাড়িই ঢুকবে না।
কোনও দিন বলে, আশপাশে এত বাড়ি, রাতে কাজ করতে গেলে মেশিনের আওয়াজে ওদের
অসুবিধা হতে পারে। আর অসুবিধে হলে কি ওরা চুপচাপ বসে থাকবে? সব দল বেঁধে এসে
অবজেকশন দেবে। থানায় গিয়ে হাজির হবে। তখন আরেক সমস্যা শুরু হবে। আবার কোনও দিন
বলে, জায়গাটা
কারখানার পক্ষে সুইটেবল নয়। যে ক'টা জায়গা দেখছি, একটাও পছন্দ হচ্ছে না। কী করি বলো তো?
--- পছন্দ হচ্ছে না, না? ওই গুন্ডাগুলির ভয়ে তুমি বারবার পিছিয়ে আসছ? তানিয়া বারবার
এই প্রশ্ন করলেও ও কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। কারণ, ও যে কারখানাটাকে অন্য কোথাও সরাবার মতলবে আছে, এটা কী করে যেন
জেনে গিয়েছিল মাছ স্বপন। যার নামে খুন, ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ থেকে শুরু করে অপহরণ, হুমকি, তোলা আদায়---
হাজারখানেক কেস রয়েছে থানায়। মাঝে মাঝেই লালবাজারের অ্যান্টি রাউডি সেকশন রেড
করে ওকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু তার পর দিন সকালেই আবার ওকে বহাল তবিয়তে এলাকায়
ঘুরতে দেখা যায়। ধরা পড়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই নাকি রাজনৈতিক দাদারা ফোন করে ওকে
ছাড়িয়ে আনেন।
মাছ স্বপন মাঝে
মাঝেই এসে বলে, এখানে ব্যবসা করতে হলে সরকারকে দিন না-দিন, আমাদের ট্যাক্স দিতেই হবে। আপনাদের কারখানায় যা
ঝুট-ঝামেলা হবে, লেবার প্রবলেম হবে, ইউনিয়নে ইউনিয়নে গণ্ডগোল হবে, সে সব আমরা বুঝে
নেব। আপনারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করুন। শুধু আমাদের বখরাটা প্রতি মাসে আমাদের হাতে
তুলে দিন। তা হলে আপনাদের আর কোনও দিকে মাথা ঘামাতে হবে না।
অনেক ব্যবসায়ী
সেটা মেনে নিয়েছেন। যাঁরা মানতে চাননি, তাঁরা নিজেরা দলবদ্ধ হয়ে এককাট্টা হয়েছেন।
থানায় গেছেন। ডেপুটেশন দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। উল্টে তার ফল
হয়েছে আরও খারাপ।
যে ক'জন ব্যবসায়ী ওদের
বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছিলেন, ওরা তাঁদের কারও বাড়িতে ঢুকে বউ-ছেলেমেয়ের
সামনেই পর পর গুলি করে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। কারও গুদামঘরে চড়াও হয়ে এক কোপে
কারও মুণ্ডুু নামিয়ে অন্য ব্যবসায়ীদের বোঝাতে চেয়েছে, ওদের কথা না শোনার পরিণাম কত ভয়ানক হতে পারে।
কারও গাড়ির পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে যেতে যেতে মাঝরাস্তায় চালিয়ে দিয়েছে ওয়ান
শাটার। রক্তে ভেসে গেছে গাড়ির সিট।
মাছ স্বপন ক'দিন ধরে
দেবমাল্যকে খুব হুমকি দিচ্ছিল ফোনে। সেলফোনে। এখান থেকে ব্যবসা তুলে নিয়ে যেতে
হলে আমাদের পঁচিশ লক্ষ টাকা দিতে হবে। আর তা যদি না দেন, যদি মনে করেন,রাতারাতি ব্যবসা তুলে নিয়ে চুপিচুপি অন্য
জায়গায় চলে যাব, তা হলে যেখানেই যান না কেন, তার ফল কী হবে, আশা করি আপনাকে নিশ্চয়ই তা আর বলে দিতে হবে
না...
তাই ফোন বাজলেই
ওর বুক ধড়ফড় করে উঠত। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত। ফলে দিনকতক ধরে ও সেলফোনের সুইচ
অফ রেখেছিল। বাড়ি আর কারখানার ল্যান্ড ফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ও
তখন বুঝতে পারেনি এতে কোনও সুরাহা হবে না।
সে দিন
দুপুরবেলায় শামসের ছিল না। কী একটা কাজে যেন কোথায় গিয়েছিল। সে সময় হুড়মুড়
করে তার দলবল নিয়ে কারখানার মধ্যে ঢুকে, সোজা তার টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে বসে
পড়ল মাছ স্বপন। না, একটাও খারাপ কথা বলিনি সে। চোখও রাঙায়নি। খুব
শান্তশিষ্ট ছেলের মতো শুধু পকেট থেকে একটা ছ'ঘড়া বের করে তার টেবিলের উপরে রেখে বলেছিল, এটা কী করছেন
দাদা, আমরা কি আপনার
শত্রু? ফালতু ফালতু
লাফরা করছেন। আপনি যদি এখান থেকে ব্যবসা তুলে নিয়ে যেতে চান, যান। আমরা আপনাকে
আটকাব না। শুধু আমাদের টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে যাবেন, ব্যস। আর এখানে যদি আপনার ব্যবসা করতে কোনও
অসুবিধা হয়, আমাদের বলুন। আমরা প্রটেকশন দেব। চাল স্বপন কিচ্ছু করতে পারবে না।
মাছ স্বপনের সব
চেয়ে বড় শত্রু চাল স্বপন। দু'জনের নামই স্বপন। দুজনেই ব্যবসা করত এই
কালীবাবুর বাজারে। একজন মাছের। অন্য জন চালের। মদ খাওয়া,
জুয়া খেলা থেকে সবই করত।
খুব খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে গিয়েছিল ওরা। তাদের জন্যই মাঝে মধ্যে পুলিশ ওদের
ধরে নিয়ে যেত। লক-আপে রাখত। একবার সাত দিনের জেল কাস্টও হয়েছিল। আর জেলে থাকার
সময়ই ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল স্থানীয় এক তোলাবাজের। বাইরে বেরিয়ে আসার
পর আর ব্যবসা নয়, ওরা ভিড়ে যায় সেই তোলাবাজের দলে। দুই স্বপনকে
আলাদা করে চিহ্নিত করতেই মাছওয়ালা স্বপনের নাম হয়ে যায় মাছ স্বপন। আর চাল
বিক্রেতা স্বপনের নাম চাল স্বপন। কেউ কারও চেয়ে কম নয়। এ বলে আমাকে দ্যাখ, তো সে বলে আমাকে
দ্যাখ। আগে ওদের মধ্যে খুব ভাল বন্ধুত্ব থাকলেও, বকরার টাকা-পয়সা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরে ওদের
সম্পর্কে চিড় ধরে। ভাগ হয়ে যায় দুটো দলে। একজন অন্য জনকে শেষ করার জন্য উঠেপড়ে
লাগে। সে সময় রোজই ওদের মধ্যে গোলাগুলি চলত। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দু'জনেই দফায় দফায়
তোলা তুলত। এখন অবশ্য ওরা নিজেদের মতো করে এলাকা ভাগ করে নিয়েছে। তবুও মাছ
স্বপনের সন্দেহ, চাল স্বপন তার এলাকায় ঢুকছে। আবার চাল স্বপনেরও ধারণা, মাছ স্বপন তার
এলাকায় থাবা বসাচ্ছে।
ফের মাছ স্বপন
বলল, কোনও চিন্তা
করবেন না। আমরা তো আছি, নাকি? আপনি আমাদের দেখবেন, আমরা আপনাকে দেখব। দাদা-ভাইয়ের মতো থাকব। আপনি
ফোনটা বন্ধ করে রেখেছেন। নাম্বার পাল্টেছেন নাকি? ফোনটা খুলুন।
কোনও কথা বলেনি
দেবমাল্য। ড্রয়ার থেকে মোবাইলটা বের করে অন করে দিয়েছিল। যে চেয়ারে বসে মাছ
স্বপন কথা বলছিল, তার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল ওর সঙ্গে আসা আরও কয়েকটা ছেলে। তাদেরই একজন একটা
মোবাইল নিয়ে কী সব খুটখাট করছিল। সে হঠাৎ বলে উঠল, আপনার ফোন তো সুইচ অফ।
--- সুইচ অফ? এই তো অন করলাম।
--- দেখুন দেখুন, ভাল করে দেখুন। মাছ স্বপন বলতেই দেবমাল্য টেবিল থেকে ফোন নিয়ে দেখে সত্যিই
ফোনটা অফ হয়ে গেছে। ফের অন করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কয়েক
মুহূর্তমাত্র। ঝপ করে স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেল। ও বলল, চার্জ নেই মনে হয়!
--- চার্জে না দিলে চার্জ থাকবে কী করে? এখানে চার্জার নেই? মাছ স্বপন প্রশ্ন করতেই ও বলল, আছে, লাগিয়ে দেব।
--- পরে ভুলে যাবেন। আমাদের সামনেই লাগিয়ে দিন।
কোনও ট্যা ফুঁ
করেনি দেবমাল্য। ফোনটাকে চার্জে বসিয়ে দিয়েছিল। মাছ স্বপন ফের বলেছিল, আমি ভদ্রঘরের
ছেলে দেখে আপনার সঙ্গে এত কথা বললাম। অন্য কেউ হলে... এই দেখুন, বলেই,আঙুল তুলে
কারখানার গেট আগলে দাঁড়িয়ে থাকা টাটাসুমোটাকে দেখিয়েছিল সে। গাড়িতে কয়েকটা
ছেলে বসা। ও বলেছিল, ওই যে লাল জামা পড়ে আছে যে ছেলেটা, সে আটটা খুনের
আসামি। এখনও ওয়ান্টেড। আর ডোরাকাটা গেঞ্জি পড়ে যে, সে হচ্ছে সোমেনদার ডান হাত। ছোটবেলায় বোমা
বাঁধতে গিয়ে ডান হাতের কবজি থেকে উড়ে গিয়েছিল। বাইরে যত থাকে, তার থেকে বেশি
থাকে জেলে। এখন বেলে আছে। ওরা তো বলছিল, এত কথা কীসের? যাবি। জিজ্ঞেস করবি, দেবে কি দেবে না। দিলে ভাল। না দিলে দুটো দানা
ঘুসিয়ে দিবি। ব্যস, খেল খতম। কিন্তু আমি তো ওদের মতো না। ভাল বংশের
ছেলে। পড়াশোনা করেছি। এইট পাস সার্টিফিকেট আছে। তাই আপনাকে এত কথা বললাম। যা ভাল
বুঝবেন করবেন। আমাদের সঙ্গে দু'নম্বরি করবেন না। আমি আপনাকে ছেড়ে দিলেও, আমার এই সব
ছেলেরা যদি ক্ষেপে যায়, তখন আমার আর কিছু করার থাকবে না।
সে দিনই দেবমাল্য
ঠিক করে ফেলেছিল, ও কী করবে। মাছ স্বপন তো পঁচিশ চেয়েছে, দরাদরি করে সেটা পনেরো লাখে নামাবে। কিছু টাকা
গেলে যাক, তাও ভাল। তবু
এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। তা হলে কোথায়!
সেই জায়গাটা
খোঁজার জন্যই ও এসেছে এই দৌলতাবাদে। জায়গাটা ভারী মনোরম। চমৎকার। শান্ত।
নিরিবিলি। তার চেয়েও বড় কথা, এখানে কোন মস্তানদের উপদ্রব নেই। জুলুম নেই।
হোটেলে এসে শুধু ম্যানেজারকেই নয়, হোটেলের অন্যান্য কর্মচারী, হোটেল থেকে বাইরে
বেরিয়ে আশপাশের দোকান, পান-বিড়ি সিগারেটের দোকান, এমনকী স্থানীয়
লোকজনদের কাছেও ও জানতে চেয়েছিল, জায়গাটা কেমন? প্রত্যেকেই এক কথা বলেছেন, ভাল। সমস্যা শুধু
একটাই, আর তা হল, এখানে খুব
লোডশেডিং হয়।
স্থানীয়
মস্তানদের দৌরাত্ম্যে কালীবাবুর বাজারে ব্যবসা করা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শুনে, তার এক ব্যবসায়ী
বন্ধু তাকে বলেছিল, তুই তো বেশির ভাগ মালই সাপ্লাই দিস বহরমপুরে।
তা, ওখানকার আশপাশে
কোথাও কারখানাটা তুলে নিয়ে যা না... তাতে তো তোর ক্যায়ারিং কষ্টও অনেক কম পড়বে।
সে-ই বলেছিল, এই দৌলতাবাদের
কথা। এই জায়গাটা সম্পর্কে সে যা যা বলেছিল, তার সঙ্গে এখানকার লোকজনের অনেকগুলো কথাই মিলে
গেছে। তার মানে, বাকিগুলোও মিলে যাবে। আর তা যদি মিলে যায়, তা হলে তাকে ব্যবসা করার জন্য এখানে আর শেড বা
বাড়ি ভাড়া নিতে হবে না। তার যা বাজেট, তাতে কোনও লোন-টোনও নিতে হবে না। অনেকটা জমি
কিনে সে একাই কারখানা বানিয়ে নিতে পারবে। আর ওই বন্ধুর কথা মতো এখানে যদি কম
টাকায় লেবার পাওয়া যায়, তা হলে তো কথাই নেই। সোনায় সোহাগা। কালীবাবুর
বাজার থেকে দু'-চার জন দক্ষ কারিগরকে নিয়ে এসে এখানকার লোকদের কাজ শিখে নিলেই হবে।
পুরো ব্যাপারটা
সে ছকে ফেলেছে। মোটামুটি নিশ্চিন্ত। তাই বিকেলেই তানিয়াকে ফোন করে বলে দিয়েছে, এখানে চলে আসার
জন্য। তা হলে এই জায়গাটা সে দেখে যেতে পারবে, সে এখানে থাকতে পারবে কি না। কারণ, এখানে ব্যবসা
তুলে নিয়ে এলে, থাকতে হবে এখানেই। তা ছাড়া তানিয়া এলে এখানকার কাজ মিটিয়ে একটু
মুর্শিদাবাদটাও ঘুরে আসতে পারবে তারা। এখান থেকে খুবই কাছে। আজ থেকে প্রায় তিনশো
বছর আগে ইংরেজদের কাছে বাংলা যেখানে পরাধীন হয়েছিল, সেটা না দেখলে হয়! এখানে কত কী দেখার আছে!
খুব ছোটবেলায়
গরমের ছুটিতে ও একবার বাবার সঙ্গে মুর্শিদাবাদে গিয়েছিল। এখনও মনে আছে সেই
হাজারদুয়ারির কথা। লোকে যে কেন ওটাকে হাজারদুয়ারি বলে কে জানে! ওখানে তো হাজারটা
দরজা নেই। আছে ছ'শোটা। বাকি চারশোটা কত নকল।
মনে আছে ফুটো
মসজিদের কথা। কে নাকি এক রাতের মধ্যে তিনটি গম্বুজওয়ালা একটা প্রকাণ্ড মসজিদ
বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাজার লোকলস্কর নিয়েও শেষ পর্যন্ত তিনি আর তা করে উঠতে
পারেননি। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করলেও তৃতীয় গম্বুজটার মাথা ঢালাইয়ের
আগেই নাকি সকালের আলো ফুটে গিয়েছিল। ফলে সঙ্গে সঙ্গে কাজ বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।
সেই থেকেই ওটা ওই অবস্থায় পড়ে আছে। ওই গম্বুজের নীচে দাঁড়ালে মনে হয়, বাজ পড়ে বুঝি
মাথাটা ফুটো হয়ে গেছে। ওটার নাম তাই ফুটো মসজিদ।
মনে আছে মতিঝিলের
কথা। বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌলার মাসি ঘসেটি বেগম বড় সাধ করে, কয়েক মাইল এলাকা
জুড়ে হিরে-মণি-মাণিক্য দিয়ে কারুকার্যখচিত চোখ ধাঁধানো একটা রাজপ্রাসাদে
বানিয়েছিলেন। সামনে ছিল নিশ্ছিদ্র প্রহরী। পিছন দিক থেকেও কেউ যাতে আক্রমণ করতে
না-পারে, সে জন্য ইংরেজি
অক্ষর 'ইউ'য়ের মতো করে একটা
জলাশয়ও খনন করিয়েছিলেন তিনি। মাপজোখ করে সেটা এতটাই চওড়া করেছিলেন যাতে ও পার
থেকে অত্যাধুনিক কামান দাগলেও, তাঁর প্রাসাদের ত্রিসীমানার ধারেকাছেও গোলার
একটা ফুলকিও এসে না পৌঁছয়।
সেই জলাশয় বা
ঝিলে ঝিনুক থেকে তিনি বড় বড় মুক্তো চাষ করাতেন। সম্রাট সেই মুক্তো উপহার পেয়ে
এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে, মুক্তোকে যেহেতু চলতি ভাষায় 'মতি' বলে, তাই তিনি ওই
ঝিলটার নামই দিয়ে দিয়েছিলেন--- মতিঝিল।
মাইলকে মাইল জমির
ওপরে হিরে-জহরত খচিত যাঁর প্রাসাদ, তার কাছে না জানি কত ধনরত্ন আছে, এমনটা আন্দাজ করে
ইংরেজরা এ দেশ দখল করার পর অন্যান্য রাজপ্রাসাদের মতো এখানেও হানা দিয়েছিল লুঠপাট
করার জন্য। কিন্তু তারা কিছুই পায়নি।
পরে বাগানের
ভিতরে মসজিদের পাশে একটা বিশাল বদ্ধঘর আবিষ্কার করে তারা। যার কোনও দরজা-জানালা
নেই। লোকমুখে তারা জানতে পারে, কেউ যাতে টের না পায়, সে জন্য ঘসেটি বেগম নাকি তাঁর প্রাসাদের তলা
থেকে একটি সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে এসে এই ঘরটার ভেতরেই ধনরত্ন লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু
হাজার তল্লাশি করেও তারা সেই সুড়ঙ্গ-পথ খুঁজে পায়নি। ফলে ইংরেজরা ওটাকে ভাঙার জন্য
উঠেপড়ে লাগে। অনেক চেষ্টা করেও ভাঙা তো দূরের কথা, দেওয়ালের গায়ে এতটুকু আঁচড়ও কাটতে পারেনি
তারা। অবশেষে নিরুপায় হয়ে হাল ছেড়ে দেয়।
পরে, অনেক পরে, একবার এক চাইনিজ
গোলন্দাজ মসজিদের চাতালে কামান বসিয়ে ওই বদ্ধঘর লক্ষ্য করে মাত্র কয়েক মিটার দূর
থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী গোলা ছোড়ে। তাতে বদ্ধঘরের দেওয়ালটা অ্যালুমিনিয়ামের
বাটির মতো একটু টোপ খায় ঠিকই, কিন্তু একটা ইটও খসে পড়ে না। তার থেকেও বড়
কথা, যে দিন ওই
গোলন্দাজ কামান দাগে, সে দিনই সন্ধেবেলায় দিব্যি সুস্থ মানুষ হঠাৎ
কী হল, কে জানে! রক্ত
বমি করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর ওঠে না।
শুধু সে-ই নয়, এর ক'দিন পরে তার
একমাত্র ছেলে ইউ আঙ্ক কিটিং মাত্র পাঁচ বছর দু'মাস এগারো দিন বয়সে কোনও অসুখ-বিসুখ ছাড়াই
আচমকা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এই ঘটনার পরেই
লোকেরা বলতে শুরু করেন, ওই বদ্ধঘর ভাঙতে যাওয়ার জন্যই উনি নির্বংশ
হলেন। এই ধরনের মন্তব্যকে কাকতালীয় ঘটনা বলে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে আর এক ইংরেজ
প্রচুর লোকলস্কর নিয়ে ভাঙতে গিয়েছিল ওটা। না, মণি-মাণিক্যের লোভে নয়,
নিছক ভিতরে কী আছে, তা জানার জন্য।
কিন্তু অত লোকজন নিয়ে হাজার চেষ্টা করেও কোনও হাতুড়ির ঘা কিংবা একটা ছেঁনির
আঁচড়ও সে বসাতে পারেনি ওই বদ্ধঘরের দেয়ালের গায়ে। উল্টে সে দিনই এক বিষাক্ত
সাপের দংশনে তার মৃত্যু হয়।
ব্যস, এটাই শেষ। তার পর
আর কেউ ওটাকে ভাঙার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।
আরও অনেক কিছু
দেখেছিল সে। মিরজাফরের সমাধিতে গিয়ে ও চমকে উঠেছিল। বিশ্বাসঘাতক বলে লোকে এখনও
তাকে এ ভাবে ঘেন্না করে! সমাধিস্থল দেখতে এসে এ ভাবে থুতু ছিটায়! এই ভাবে সমাধির
উপরে ইট ছুড়ে মারে! এ জন্যই কি তার বসত ভিটে, যেখানে তার বংশধরেরা এখনও বসবাস করে, সেখানে পর্যটকদের
প্রবেশ নিষেধ! গিয়ে যদি আবেগবসত কিছু করে বসে, সেই ভয়ে! বংশের কোন এক পূর্বপুরুষ কবে কী
করেছে, তার দায় তার
উত্তরসূরিদের এখনও বয়ে বেড়াতে হবে! এর কোনও মানে হয়, ছিঃ।
এখনও আবছা-আবছা
মনে পড়ে, মুর্শিদাবাদের
প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র মেয়ে আজিমুন্নিসা বেগমের জীবন্ত কবরের কথা। তার সেই
মেয়ের গল্প শুনিয়েছিলেন গাইড। তিনি বলেছিলেন, এই মেয়েটার একটা অদ্ভুত রোগ হয়েছিল। রাজবৈদ্য
বলেছিলেন, ওকে রোজ একজন
তরতাজা যুবকের কলিজার জুস করে খাওয়াতে হবে। তবেই ও আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবে।
তাই প্রত্যেক দিন রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষে একটা করে যুবককে ফুসলে-ফাসলে, লোভ দেখিয়ে
রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হত। সম্রাট সেটা জানতেন না। যে দিন জানলেন, সে দিনই প্রকাশ্য
রাজপথের ধরে তাঁকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিলেন। সেই কবরের পাঁচ-ছ'হাত উপরে ছোট্ট
একটা ঝাঁঝরি পেতে দিলেন। তার এ পাশে ও পাশে বানিয়ে দিলেন কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তিনি
আবেদন করলেন, ওই পথ দিয়ে যাঁরা যাতায়াত করবেন, তাঁরা যেন খালি পায়ে একবার এক সিঁড়ি দিয়ে
উঠে অন্য সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান। কিন্তু সম্রাটের আবেদন তো আর আবেদন নয়, ওটা আদেশ। সেই
থেকে আজও লোকেরা খালি পায়ে এক দিক থেকে উঠে অন্য দিক দিয়ে নেমে যান। আর সেই সব
লোকেদের পায়ের ধুলো ওই ঝাঁঝরি দিয়ে গলে তার মেয়ের সমাধির উপরে পড়ে। ওই সম্রাট
বিশ্বাস করতেন, এতেই নাকি তার মেয়ের পাপ খণ্ডন হবে। তাই ওই মেয়ের প্রতি করুণার জন্যই হোক, কিংবা পাপ থেকে
উদ্ধারের জন্যই হোক, ওরাও সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে অন্য সিঁড়ি দিয়ে
নেমেছিল।
পরে, অনেক পরে
দেবমাল্য বুঝেছিল, আসলে ও সব রোগ-টোগ কিছু নয়, মেয়েটি ছিল
পুরুষ-শিকারী। প্রতিদিন তাঁর নিত্যনতুন এক-একটা পুরুষ লাগত। সারা রাত ভোগ করে
সূর্য ওঠার আগেই তাকে খতম করে দিত সে।
সম্রাটদের একটি
পারিবারিক কবরখানায় টিকিট কেটে ঢুকেছিল ওরা। দেখেছিল, সম্রাট, সম্রাটের বউ, তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ওই রাজপরিবারের পোষ্য
কবুতরদের কবরও রয়েছে ওখানে। একটা কুকুরকেও নাকি কবর দেওয়া হয়েছিল তাঁদের পাশে।
ভাবা যায়! গোটা ভারতবর্ষের সম্রাটের সঙ্গে একই কবরখানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে
পায়রা আর কুকুর!
এখানে এসে ওর
মনটা ভাল হয়ে গেছে। তাই রাতের খাবার খেয়ে নিশ্চিন্ত মনে ও টিভি খুলে বসেছিল।
কিন্তু এ কী! কী শুনল ও! এটা গুলির আওয়াজ না!
ও ঝট করে বিছানা
ছেড়ে জানালার কাছে চলে গেল। ভারী পর্দা সরিয়ে, ছিটকিনি খুলে, ইস্পাতের ফ্রেমে বাঁধানো কাচের পাল্লা দুটো
বাইরের দিকে ঠেলে দিল। মুখ বাড়িয়ে দেখল, সবুজ ঢালু লনটা উধাও। অন্ধকার ওটা গিলে খেয়েছে।
দূরে, পাঁচিলের ও পারে
সরু রাস্তাতেও তেমন কাউকে দেখতে পেল না ও। তা হলে কি গুলির শব্দ শুনে সবাই পালিয়ে
গেছে! নিশ্চয়ই পালিয়ে গেছে। তা না হলে ওই রাস্তায় অন্তত কয়েক জনকে ও নিশ্চয়ই
ছোটাছুটি করতে দেখত কিংবা ছোটখাটো এক-আধটা জটলা নজরে পরত। কিন্তু পুরো রাস্তাটাই
শুনশান। জানালা দিয়ে যতটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে, ওই রাস্তায় কিছু দূরে দূরে স্ট্রিট লাইট
জ্বলছে। তবে, তার আলো এত কম যে, এত দূর থেকে ভাল করে কিছু দেখাই যাচ্ছে না।
হঠাৎ দেখতে পেল, তার জানালার
সোজাসুজি যে স্ট্রিট লাইটটা জ্বলছে, লাইট জ্বললেও জায়গাটা কেমন জানি
অন্ধকার-অন্ধকার। তার নীচে জোব্বা পরা দুটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ওর মনে হল, ওরা তার জানালার
দিকেই একদৃষ্টে চেয়ে আছে।
দুই
ঘরের মধ্যে
এতগুলো চিল এল কোথা থেকে! চিল না শকুন! বিশাল বিশাল ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। ওরা কি বেরোবার
রাস্তা পাচ্ছে না! ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল দেবমাল্য। দেখল, চিল-শকুন নয়, দরজা-জানালার ভারী পর্দাগুলো উথাল-পাথাল খাচ্ছে।
দেবমাল্য অবাক।
তার স্পষ্ট মনে আছে, শুতে যাওয়ার আগে কাল রাতে ও খুব ভাল করে
দরজা-জানালাগুলো আটকে দিয়েছিল। তা হলে এগুলো খুলল কে! না খুললে পর্দাগুলো ও ভাবে
উঠছে কী করে! প্রথমে ঢুকে একটুক্ষণ পাখা চালিয়েছিল ঠিকই,
তখন খুব গরম লাগছিল। এসি
চালানোর পর ঘর ঠান্ডা হয়ে যেতেই সে-ই যে পাখা বন্ধ করেছিল, আর খোলেনি।
তা হলে কি রাতে
লোডশেডিং হয়েছিল! অনেক ডেকেও তাকে তুলতে না পেরে, গরমের জন্য যাতে ঘুম ভেঙে না যায়, সে জন্য হয়তো
হোটেলের লোকেরাই বাইরে থেকে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খুলে দরজা-জানালাগুলো হাট করে
খুলে দিয়েছিল।
কিন্তু তা-ই বা
কী করে হবে!এত বড় একটা হোটেল সেখানে কি জেনারেটর নেই! না,
সেটা কিছুতেই হতে পারে
না। তা হলে কী হয়েছে!
চোখ মেলে ভাল করে
তাকিয়ে দেখে, চিল-শকুন-পর্দা নয়, সারা ঘর জুড়ে মাথার উপরে বনবন করে চক্কর মারছে
কতগুলো মানুষের কাটা মুণ্ডু। কারও চোখ আগুনের গোলার মতো জ্বলছে। কারও মুখ পোড়া
কাঠ কয়লার মতো বীভৎস। আবার কারও মুখে বিকট হাসি। কারও মুখের দিকেই তাকানো যাচ্ছে
না।
দৃশ্যটা দেখে অজ্ঞান
হয়ে যাওয়ার মতো উপক্রম হয়েছিল তার। তবু কোনও রকমে মাতালের মতো খাট থেকে নেমে
ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিল ও। আর তখনই দেখল, সব ভো ভা। কোথায় সেই কাটা মুণ্ডুগুলোর
ওড়াউড়ি! কোথায় চিল-শকুনের ডানা ঝাপটানো, আর কোথায় সেই পর্দার দাপাদাপি। বারবার
দেওয়ালে আছড়ে পড়া। আর পাঁচটা ঘরের মতোই স্বাভাবিক, শান্ত।
তখনও ভযে় তার
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আছে। গলা থেকে শব্দ বেরোচ্ছে না। শুকিয়ে কাঠ। কেউ যেন দু'হাত দিয়ে তার
গলা টিপে ধরেছে।
বাড়ির বাইরে
বেরোলে মিনারেল ওয়াটার ছাড়া ও খায় না। একবার ডুলুং বেড়াতে গিয়েছিল ও। জঙ্গলের
আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে নানান গল্প বলছিল ড্রাইভার। কবে কোন
ট্যুরিস্ট জঙ্গলের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, মাঝ জঙ্গলে গাড়ি
থেকে নেমে এ দিক ও দিক তাকাচ্ছিলেন। সেও নেমে পড়েছিল গাড়ি থেকে। হঠাৎ তাকিয়ে
দেখে, তাদের গাড়িটাকে
ঘিরে রয়েছে এক দঙ্গল বুনো হাতি। শুঁড় দিয়ে গাড়িটাকে তোলার চেষ্টা করছে। কেউ
মাথা দিয়ে ধাক্কা মারছে। সে যাত্রায় যে সে কী করে বেঁচেছিল, সেটা সে-ই
জানে।একেবার জোড়া খড়্গওয়ালা একটা গন্ডার তার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। নট
নড়নচড়ন।
তার কথা শুনে মনে
হচ্ছিল, যে কোনও সময়
আশপাশের গাছ থেকে তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সে আরও কী
কী বলছিল, যত বলছিল ততই
রোমাঞ্চ লাগছিল তার। কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষে গাড়িটাকে দাঁড়
করিয়ে দিয়েছিল সে। বলেছিল, ওই দেখুন, একটা ময়াল সাপ।
ময়াল কি না ও
চিনতে পারেনি। তবে দেখেছিল, কয়েক হাত লম্বা আর এইসা মোটা একটা সাপ অত্যন্ত
শ্লথ গতিতে হেলতে-দুলতে হেলতে-দুলতে ও দিকের জঙ্গল থেকে রাস্তা পেরিয়ে এ দিকের
জঙ্গলে ঢুকছে।
পেছনে রাখা ছিল
পাঁচ লিটারের দুটো জার। দুটোরই মুখ সিল করা। কিন্তু হাতের এক লিটারের বোতলটা শেষ
হতেই পেছনে ঝুঁকে দেখে, দুটোর একটাতেও জল নেই। কাত হয়ে পড়ে আছে। কী
হল! তুলে দেখে, দুটো জারেরই নীচের দিকে ফাটা। অথচ ও তখন জঙ্গলের মাঝামাঝি জায়গায়। ভিতরে
গেলে যতটা যেতে হবে, সোজা রাস্তা ধরে অন্য যে দিক দিয়ে ওদের
বেরোনোর কথা, সে দিক থেকে বেরোতে গেলেও প্রায় ততটাই যেতে হবে। তাই আর ফেরার রাস্তা ধরেনি ও।
জঙ্গলের মাঝে মাঝে আদিবাসীদের গ্রাম চোখে পড়লেও, কারও কাছ থেকে এক গ্লাস জলও খায়নি। ড্রাইভার
বলেছিল, এখানকার জল খুব
ভাল। খেয়ে দেখতে পারেন।
ও ড্রাইভারের
কথায় কান দেয়নি। উল্টে নাক সিঁটকেছিল। বলেছিল, আর তো কিছুক্ষণ। এতক্ষণ যখন জল না খেয়ে থাকতে
পেরেছি, বাকি সময়টাও
পারবো। চলো...
সারাটা পথ জল না
খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছিল দেবমাল্য। ও বলে, জল খুব দেখেশুনে খাওয়া উচিত। এই জল থেকেই যত
রোগের উৎপত্তি।
সেই দেবমাল্য
টেবিলের উপরে তাকিয়ে দেখল, হোটেলে ঢোকার সময় দু'লিটারের যে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা নীচ থেকে
দিয়ে গিয়েছিল, সেটা একদম খালি। পাশে একটা জগ। টুবুটুবু ভর্তি। ওই বোতলের সঙ্গেই ওটা রেখে
গিয়েছিল হোটেলের বেয়ারা, যদি লাগে! ও ওটা ছুঁয়েও দেখেনি। এখন সেটাই এক
ঝটকায় তুলে ঢকঢক করে খেতে লাগল সে। যতটা খেল, তার থেকে বেশি পড়ে মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখ, গলা, বুক, পাঞ্জাবি ভিজিয়ে, পেট-টেটও ভাসিয়ে
দিল।
জল খেয়ে একটু দম
নিল ও। তার পর বাথরুমে ঢুকে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার জলের ঝাপটা মারল মুখে।
টাওয়াল দিয়ে মুছে, মোবাইলে দেখল, চারটে বাজতে এখনও অনেক দেরি। সবে দুটো আঠাশ। ও
ফের খাটে উঠে গেল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সিলিঙের দিকে। চোখের পলক পলক স্থির হয়ে
রইল। মাথার ভেতরে ছোটাছুটি করতে লাগল হাজার একটা চিন্তা, দুশ্চিন্তা।
কিছুতেই সময়
কাটছে না। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। এখনও কি সকাল হয়নি? ফের মোবাইল নিয়ে দেখে দুটো চৌত্রিশ। তার মানে
এতক্ষণে মাত্র ছ'মিনিট হয়েছে!
কখনও কখনও এ রকম
হয়। সময় কাটতেই চায় না। আবার কখন যে হুস করে সময় পেরিয়ে যায়, বোঝা যায় না। আজ
তানিয়ার আসার কথা!
সে যখন কালীবাবুর
বাজারে থাকে না, তার ব্যবসাটা মূলত সামশেরই দেখে। ভীষণ বিশ্বস্ত। নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশি।
ঘরের ছেলেই হয়ে গেছে বলা যায়। পুজোর সময় কেনাকাটায় কিংবা তানিয়াকে বাপের
বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপার থাকলে, দেবমাল্য যদি সময় করে উঠতে না পারে, সামশেরকে একবার
বললেই হল, ঝপাঝপ কারখানার
সব কাজ সেরে ও ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে বউদির কাছে। নিজেকে বউদির থেকেও বেশি সম্মান
করে তার বউকে।
ওকেই দায়িত্ব
দিয়েছিল, তানিয়াকে যেন ঠিক
ভাবে ট্রেনে তুলে দেয়। ও বলেছিল, বউদি একা একা যাবে, সেটা কি ঠিক হবে? কোনও দিন তো এ ভাবে কোথাও যায়নি, আমি কি পৌঁছে
দিয়ে আসব?
দেবমাল্য বলেছিল, কী দরকার? তুই ওখান থেকে
ট্রেনে তুলে দিবি। আমি এখান থেকে নিয়ে আসব। মাঝে তো মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার।
কিছু হবে না। তুই বরং কারখানাটা সামলা। কোনও ঝামেলা-টামেলা হলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে
ফোন করিস, কেমন?
যদিও ও জানে, শুধু ছোটখাটো নয়, বড় কোনও সমস্যা
হলেও সামশের কখনও ওকে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেয় না। যত বড় ঝড়-জলই হোক, ও ঠিক সামলে নেয়।
আর তার থেকেও বড় কথা, ও ভীষণ দায়িত্ববান।
তানিয়াকে ট্রেনে
তুলে দিয়ে সামশের কাল রাত এগারোটা নাগাদ ফোন করেছিল। বলেছিল, এইমাত্র ট্রেন
ছেড়ে দিল। মনে আছে তো কোচ নম্বর? এস ফোর। সিট নম্বর তেইশ। যে দিকে ছ'টা সিট থাকে, সেই খোপের সামনে
জানালা বরাবর যে মুখোমুখি দুটো সিট থাকে তার একটা। বউদির উল্টো দিকে যে বয়স্ক
ভদ্রলোক বসেছেন, একটু পরেই তিনি ওপরের বাঙ্কে চলে যাবেন। বউদি তখন সিটটাকে জোড়া লাগিয়ে শুয়ে
পড়তে পারবেন। কোনও অসুবিধা হবে না। শুধু পাম্প বালিশটা আনতে ভুলে গিয়েছিল, তাই কিনে
দিয়েছি।
দেবমাল্য বলেছিল, আমি থাকলে তাও
কোনও অসুবিধে হতে পারত। কিন্তু তুই সঙ্গে থাকলে যে তোর বউদির কোনও অসুবিধা হবে না, তা আমি জানি।
--- চারটে নাগাদ ট্রেনটা ওখানে পৌঁছনোর কথা। একটু এ দিক ও দিক হতে পারে। আমার মনে
হয়, একটু আগে গিয়ে
দাঁড়ালে ভাল হয়। বলা তো যায় না, ট্রেনটা যদি আগে পৌঁছে যায়। বউদি তো ওখানকার
কিছু চেনে না...
সামশের ভারী
অদ্ভুত ভাবে কথা বলে। তার বউকে আপনি-আজ্ঞে করে বললেও, তাকে কিন্তু কখনও কোনও সম্বোধন করে কিছু বলে
না। যা বলে, সবটাই সম্মোধন উহ্য রেখে বলে। ভাববাচ্যে।
আসলে দেবমাল্যর
বাবার আমলে সামশেরের বাবা কাজ করতেন। সে সময় বাবার হাত ধরে প্রায়ই সামশের চলে আসত
দেবমাল্যদের কারখানায়। দেবমাল্যর চেয়ে বয়সে একটু ছোট হলেও সামশেরের সঙ্গে ওর
খুব ভাব ছিল। সামশেরের পাল্লায় পড়েই ও রোজ সকালে ওর সঙ্গে পার্কে হাঁটতে যেতে।
সামশেরের দেওয়া দেওয়া ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করত। গোটা পার্ক চার বার করে
দৌড়ত। আর এটা করতে করতেই বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল দু'জনের। দেবমাল্য ওকে 'তুই' করে বললেও সামশের ওকে 'তুমি' করে বলত। কিন্তু পরে, যখন দেবমাল্যর বাবা শারীরিক কারণে আস্তে আস্তে
কারখানায় আসা কমিয়ে দিলেন, কারখানায় বসা শুরু করল দেবমাল্য, তখন সামশেরের
বাবা সামশেরকে নিয়ে একদিন দেবমাল্যর কাছে এলেন। যদি তাঁর ছেলেকে এই কারখানায়
একটা কাজ যাওয়া যায়!
আর দ্বিতীয় বার
বলতে হয়নি সামসেরের বাবাকে। অনুরোধ-উপরোধও করতে হয়নি। দেবমাল্য সরাসরি সামশেরকে
বলে দিয়েছিল পর দিন থেকে আসতে।
এ ভাবে যে এক
কথায় তাঁর ছেলের চাকরি হয়ে যাবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি সামশেরের বাবা। যাক্, ছেলের একটা
হিল্লে হল তা হলে! হাফ ছেড়ে বাঁচলেন সামশেরের মা-ও। এখন ছেলেকে একটু
শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে হাতের কাজ, এই যা...
কিন্তু পর দিন
যখন বাবার সঙ্গে সামশের কারখানায় গেল, দেবমাল্য কারখানার অন্য কর্মীদের সামনেই
সামশেরের বাবাকে স্পষ্ট করে বলে দিল, ওকে ও সব কাজ করতে হবে না। ও আমার সঙ্গে থাকবে।
পুরো ব্যাপারটাই দেখাশোনা করবে। আমাকে তো মাঝে মধ্যেই এখানে সেখানে যেতে হয়, সে সময় ও যা
বলবে, সে ভাবেই কাজ
করবেন।
সামশেরের বাবার
চোখে জল এসে গিয়েছিল। উনি কোনও দেবদেবী তো নয়ই, মূর্তিতেও বিশ্বাস করেন না। তবু তাঁর মনে
হয়েছিল, দেবমাল্য কোনও
মানুষ নন, পৃথিবীতে যদি
দেবতা বলে কিছু থেকে থাকে, ও সেই দেবতা। তাই বাড়ি ফিরে ছেলেকে বলেছিলেন, মনে রাখবি, ছোটবাবু কিন্তু
এখন থেকে তোর মনিব। আগের মতো আর তুমি তুমি করে কথা বলবি না। জানবি, উনি আমাদের
অন্নদাতা। সম্মান দিয়ে কথা বলবি। এ বার থেকে আপনি করে বলিস।
পর দিন
দেবমাল্যকে ও 'আপনি' বলতেই দেবমাল্যর
কানে কথাটা লেগেছিল। ঝট করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। বলেছিল,
তোর হঠাৎ কী হল? আমাকে আপনি করে বলছিল?
কথাটা এমন করে
বলেছিল, যেন তাকে আপনি
বলাটা ওর মারাত্মক অপরাধ হয়ে গেছে। তার পর থেকে ও আর কোনও দিন দেবমাল্যকে আপনি
বলেনি। বাবা বারণ করায় 'তুমি' বলাটাও ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু দরকারে-অদরকারে
কথা তো বলতেই হয়, তাই কথা বলার একটা অদ্ভুত ভাষা তৈরি করে নিয়েছিল
সে। 'তুমি' বা 'আপনি' না বলেও, ওর যা বলার, ও তা অনায়াসেই
বলে ফেলতে পারত। এখনও সেই ভাষাতেই কথা বলে ও।
ও বলেছিল, চারটে নাগাদ
ট্রেনটা বহরমপুরে পৌঁছবে। তার মানে এখনও প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো বাকি। হাতে প্রচুর
সময়। স্টেশনে যেতে আর কতক্ষণই বা লাগবে! খুব বেশি হলে কুড়ি পঁচিশ মিনিট।
হোটেলের
ম্যানেজারই কাকে যেন যেন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাকে বলা আছে। সে
সাড়ে তিনটের আগেই চলে আসবে। যদি ঘুম না ভাঙে! হোটেলের লোককেও বলা আছে, ওরা ঠিক সওয়া
তিনটে নাগাদ তাকে ডেকে দেবে।
না, ওদের আর ডাকতে
হবে না। সে উঠে পড়েছে। এ বার হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলেই হয়! কিন্তু ট্রেনটা
এখন কত দূরে! তানিয়া কি ঘুমোচ্ছে! না না, ট্রেনের ওইটুকু জায়গায় ও ঘুমোবে কী করে! ওর
কি ওই ভাবে শোওয়ার অভ্যাস আছে! এমনিই হয়তো ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। ফোনটা কি ওর
হাতের কাছেই আছে! না কি হাত-ব্যাগের ভিতরে। একবার ফোন করে দেখি তো!
তানিয়াকে ডায়াল
করতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল--- নট রিচেবল।
ও এমনিতে সচরাচর
কাউকে ফোন করে না। যদি কাউকে ফোন করে আর সে যদি ফোন না ধরে, একটানা রিং হয়ে
যায়, ওর মেজাজ বিগড়ে
যায়। যদি না-ই ধরিনি, তা হলে ফোন রেখেছিস কেন? অথচ নিজের ক্ষেত্রে
এ রকম ঘটনা ঘটলে, যে ফোন করেছিল, 'তোকে ফোন করেছিলাম, তুই তখন ধরিসনি' বলে সে অভিযোগ করলে ও মনে মনে বলে, ফোন করলেই ধরতে
হবে! আমি তোমার চাকর নাকি! অবশ্য নট রিচেবল হলে কারও কিছুই করার থাকে না। তবু ও
ভাবল, নট রিচেবল! এটা তো মেট্রো রেলে থাকলে হয়! এই ট্রেনেও নট
রিচেবল! তার মানে ট্রেনটা এখন যে জায়গা
দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে টাওয়ার নেই কিংবা সিগন্যাল পাচ্ছে না।
কী যে হয়
মোবাইলে কে জানে! সে দিন কার একটা নম্বর মোবাইলে সেভ করে,
নম্বরটা ঠিক মতো সেভ
হয়েছে কি না পরখ করার জন্য, ওই নম্বরে কল করেই, যার নম্বর সেভ করেছে, তাকে বলেছিল, আমার নম্বরটা দিয়ে দিলাম, সেভ করে নিন।
কিন্তু এ কী! ও প্রান্ত থেকে যে বলছে নট রিচেবল! অথচ যার নম্বরে ফোন করেছে, সে তার সামনেই
মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দেবমাল্য আবার
ডায়াল করল তানিয়াকে। তার পর আবার। আবার। আবার। আর প্রতিবারই শুনতে পেল সেই একই
কথা--- নট রিচেবল।
তিন
লাফ দিয়ে বিছানা
ছাড়ল দেবমাল্য। ঝপাঝপ তৈরি হয়ে নিল। চারটে নাগাদ লালগোলা প্যাসেঞ্জার ঢুকবে
বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে। তখনও চার দিক অন্ধকার থাকবে। ট্রেন থেকে নেমে তানিয়া ওকে
দেখতে না-পেলে ঘাবড়ে যাবে। কী করবে, কুলকিনারা পাবে না। সঙ্গে নিশ্চয়ই ঢাউস একটা
লাগেজ থাকবে। একটা না দুটো, নাকি তারও বেশি, ও জানে না। ওর কথা তো! আগে থেকে কিছুই বলা যায়
না।
বিয়ের পরে পরেই
বউকে নিয়ে ও বকখালি গিয়েছিল। না, গাড়ি করে নয়। গাড়ি তো সারাক্ষণই চড়ে।
ট্রেনে করে যাওয়ার মজাই নাকি আলাদা। আর সেটা যদি খুব ভোরে হয়, তা হলে তার চার্ম
আরও বেশি।
শিয়ালদহ থেকে ছ'টা পঁয়তিরিশে
কাকদ্বীপ লোকাল। লাস্ট স্টেশনে নেমে ভ্যানরিকশা করে ঘাটে। সেখান থেকে নৌকো করে ও
পারে। তার পরে বাসে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। একেবারে বকখালি। পর পর অজস্র হোটেল।
কিন্তু হোটেলে নয়, ওরা উঠবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন দফতরের বাংলায়।
ওখানে নাকি সহজে
ঘর পাওয়া যায় না। সবই মন্ত্রী-টন্ত্রি আর ভি ভি আই পি-দের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু
দাদা-বউদি যাচ্ছে শুনে কাকে ধরে যেন ওই বন বাংলোর দোতলার একটা ভাল এ সি রুম বুক
করে ফেলেছিল সামশের।
ঘরের একটা জানালা
দিয়ে তাকালে যত দূর চোখ যায় ধূসর সমুদ্র। সাদা ধবধবে ফেনাওয়ালা ঢেউ মুহুর্মুহু
আছড়ে পড়ছে পাড়ে। পাড়ের এ দিকটা সার সার ঝাউ গাছে ভরা। ওখানে নাকি বনবিবির একটা
ছোট্ট মন্দির আছে। ছোট হলেও খুব জাগ্রত। মন্দিরের গায়েই একটা মাঝারি মাপের গাছ।
লোকেরা মানত করে ঢিল বেঁধে দিয়ে যায়। মনস্কামনা পূরণ হলে, যেটা বেঁধে
গিয়েছিল, সেটা তো আর অত
ইটের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই চোখ বন্ধ করে মায়ের নাম নিয়ে যে কোনও
একটা ইট খুলে দিলেই হল।
ওই জানালার উল্টো
দিকের জানালাটা খুললে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। একটু ভাল করে দেখলেই বোঝা যায়, সব গাছের পাতা
সবুজ হলেও প্রতিটি গাছের সবুজই আলাদা আলাদা। সবুজের যে কত রকমের শেড হতে পারে, এখানে না এলে কেউ
কল্পনাও করতে পারবে না।
আর, যে বন বাংলায় ওরা
উঠবে, তার চৌহদ্দির
মধ্যেই নাকি ছোটখাটো একটা চিড়িয়াখানা আছে। ঢোকার মুখে সাইনবোর্ডে 'বন দফতরের কুমির
প্রকল্প' লেখা থাকলেও পর
পর অনেকগুলো খোপে সাত-আটটা, কি তারও বেশি কুমির হয়তো আছে। সব তো আর গোনা
যায় না। কোনটা কোন দিকে থাকে! কেউ কেউ গোটা শরীরটা জলের তলায় রেখে শুধু মুখটুকু
বের করে রাখে। কিন্তু একদম শেষ প্রান্তে ফুটবল খেলার মাঠের মতো প্রশস্ত ঘেরা
জায়গায় এতগুলো হরিণ আছে, গোটা আলিপুর চিড়িয়াখানাতেও বোধহয় অত হরিণ
নেই।
মোটামুটি সব
খোঁজখবর নেওয়া হয়ে গেছে দেবমাল্যর। ঠিক করেছে, পৌঁছনোর পরের দিন, না। একদম গাড়ি ভাড়া করে নয়। গাড়ি হুস করে
চলে যায়। দু'চোখ ভরে কিছুই দেখা যায় না। সামসের খবর নিয়ে জেনেছে,
ওখানে নাকি রাস্তার মোড়ে
মোড়ে, হোটেলের সামনে
সার সার মোটর-লাগানো ভ্যানরিকশা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের বললেই, তারা নাকি গোটা
অঞ্চলটাই ঘুরিয়ে দেয়। দেখিয়ে দেয় জম্বুদ্বীপ। ফেজারগঞ্জের মৎস্য প্রকল্প। হেনরি
আইল্যান্ড।
খুব সকালে বেরোতে
হবে। তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল সে। সকালে বেরোতে গিয়ে ওর চক্ষু চড়কগাছ।
যাচ্ছে তিন দিনের জন্য। কিন্তু তানিয়া এতগুলো লাগেজ নিয়েছে, মনে হচ্ছে তিন
মাসের জন্য এমন কোথাও যাচ্ছে, যেখানে কোনও লোকজন থাকে না। দোকান-পশারও নেই। ও
বলেছিল, এত কী নিয়েছ?
তানিয়া বলেছিল, তুমি তো একটা সেট
পড়েই যাচ্ছ। এ ছাড়া তোমার চারটে জামা, চারটে প্যান্ট, দুটো স্যুট, তিন রাতের জন্য তিন সেট চোস্তা-পাঞ্জাবি।
সমুদ্রে স্নানের জন্য তিনটে শার্ট-প্যান্ট। একটা ঘরে পরার সব সময়ের স্যান্ডেল আর
সমুদ্রে যাওয়ার জন্য স্যান্ডাকের একটা চটি। আর আমার খানকতক শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ। তিনটে
সালোয়ার-কামিজও নিয়েছি। ওখানে ধোয়া-টোয়া যাবে কি না জানি না, তাই দুটো নাইটিও
নিয়ে নিয়েছি। একটা কম নিলাম। অসুবিধা হবে না, কী বলো? এ ছাড়া তেল, সাবান, শ্যাম্পু, গামছা, চিরুনি, দাঁত মাজার ব্রাশ, পেস্ট, সেন্ট আর ওখানে গিয়ে হঠাৎ জ্বরজারি, মাথা ব্যথা বা গা
গুলোলে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সে জন্য ওষুধও নিয়ে নিয়েছি বেশি কিছু--- কী কী
নিয়েছি, একটা কাগজে লিখে রেখেছি।
--- কেন? বিস্মিত হয়েছিল
ও।
তানিয়া বলেছিল, ফেরার সময়
মিলিয়ে দেখতে হবে না? যা যা নিয়ে যাচ্ছি, সব ঠিকঠাক ব্যাগে ভরছি কি না...
--- সে ঠিক আছে, কিন্তু তা বলে স্যুট নেবে?
--- কেন? আমরা যদি বিকেলের
দিকে কোথাও বেড়াতে যাই?
--- বেড়াতে গেলে আর কোথায় যাব? আমরা কি কোনও পার্টিতে যাব? গেলে তো ওই
সমুদ্রের পারেই যাব, না কি? সেখানে কেউ স্যুট পরে যায়?
--- না, ভাবলাম...
--- আর এত জামাকাপড় কেউ নেয়? যাচ্ছি তো তিন দিনের জন্য। খোলো খোলো খোলো...
এমন তাড়া লাগল
দেবমাল্য যে, মুখের ওপরে কোনও কথা বলতে পারেনি তানিয়া কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল, প্রত্যেকটা লাগেজ
খুলে তার স্বামী কী ভাবে টেনে টেনে জামাকাপড় বের করছিল। একটা ছোট হালকা সুটকেস আর
কাঁধের একটা ব্যাগের মধ্যেই কেমন কায়দা করে ভরে নিয়েছিল সব। তার পরেও যেগুলি পড়ে
ছিল, সেগুলো আর তোলার
সময় পায়নি। ঘড়ির কাঁটা তখন ঘোড়ার বেগে ছুটছে। তাই ওগুলো বিছানার ওপর টাল দিয়ে
রেখে তার উপরে একটা বড় বেড কভার দিয়ে ঢেকে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল।
তিন দিন ভীষণ
আনন্দ করেছিল ওরা। সকাল থেকে বেলা পর্যন্ত সমুদ্র দাপিয়ে বেরিয়েছিল। ছোট-বড়
ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করেছিল। দুপুরে হোটেল একটু বিশ্রাম নিয়েই সন্ধ্যা নামতে
না-নামতেই ফের সমুদ্রে। দারুন লাগছিল ওদের। কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছে করছিল না।
বাড়ি ফিরে
তানিয়া দেখেছিল, লাগেজে তখনও ভাঁজ ভাঙা হয়নি একটা প্যান্ট, দুটো জামা, দুটো শাড়ি আর একটা সালোয়ার-কামিজের। দেবমাল্য
বলেছিল, দেখলে তো, বেড়াতে গেলে অত
কিছু লাগে না। বেড়াতে বেরোলে সব সময় ফুরফুরে মন নিয়ে বেরোবে। লাগেজ বওয়ার
কষ্টটা যেন বেড়ানোর আনন্দটাকে মাটি করে না দেয়, বুঝেছ?
ও যে বোঝেনি, দেবমাল্য সেটা
টের পেয়েছিল তার ক'দিন পরেই। মুকুটমণিপুরে বেড়াতে যাওয়ার সময়।
আগে থেকেই বারবার করে বলেছিল দেখে তানিয়া বলেছিল, হ্যাঁ রে বাবা, তোমাকে অত বলতে হবে না। আমার ঠিক মনে আছে।
যেটুকু না নিলে নয়, সেটুকুই নেব। রাতে ট্রেন তো, আমি আগে গুছিয়ে
নিই। তার পর সন্ধের আগেই তোমাকে সুটকেস খুলে দেখিয়ে দেব কী কী নিয়েছি, ঠিক আছে?
কিন্তু তানিয়া
যখন সুটকেস খুলল, মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল দেবমাল্য। তার পর থেকে কোথাও বেড়াতে গেলে, যা যা নেবার মনে
হত, তানিয়া বের করে
রাখত। লাগেজে ভরতো দেবমাল্য এবং প্রতিবারই দেখা যেত। তানিয়ে যা বের করেছে, তার টেন
পার্সেন্টও ব্যাগে ঢোকায়নি ও।
এ বার ও একাই
আসছে। সঙ্গে যে কত কী আনছে, তা ও-ই জানে। তার ওপরে আবার শামসের ওকে ট্রেনে
তুলে দিয়ে গেছে। তানিয়া যদি ঢাউস ঢাউস দশটা লাগেজও নেয়,
ও বউদিকে একবারের জন্যও
কিছু বলবে না। উপরন্তু দ্বিগুণ উৎসাহে সেগুলো ট্রেনে তুলে দেবে। দেবমাল্য মনে মনে
বলল, ওর সঙ্গে যদি
একটার বেশি দুটো লাগেজ দেখি না... তাতে যাই-ই থাক, আমি দেখব না, স্টেশন রেখেই চলে আসব।
গজগজ করতে করতে
হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে এল ও। না, এখনও গাড়ি আসেনি। ক'টা বাজে এখন! আজকাল ঘড়ি পরার চল উঠে গেছে।
আগেকার দিনে শ্বশুরমশাই যতই গরিব হোক না কেন, বিয়েতে আর কিছু না দিক, জামাইকে অন্তত
ঘড়ি-আংটি-সাইকেল দেওয়াটা ছিল ন্যূনতম যৌতুক। মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করলে বাবার
কাছে ঘড়িই আবদার করত ছেলেমেয়েরা। সেই ঘড়ি কবে যে তার কৌলিন্য হারালো বোঝা গেল
না। এখন তো একেবারেই ব্রাত্য।
দেবমাল্য পকেট
থেকে মোবাইল বের করে দেখল, এখনও গাড়ি আসার সময় হয়নি। ফুরফুর করে ঠান্ডা
হওয়া দিচ্ছে। এখানে যতই গাড়ি-ঘোড়া চলুক,চার দিকে প্রচুর গাছপালা থাকায় এখানকার বাতাস
খুব মিষ্টি। শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। এখন কেমন যেন ঘুম ঘুম
পাচ্ছে। ও বেশ জোরে জোরে বুক ভরে শ্বাস নিল।
এখনও বেশ অন্ধকার
অন্ধকার। ও ফুটের চায়ের দোকানের মাটির দাওয়ায় বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কুণ্ডলী
পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা কুকুর। এটাই বোধহয় গত কাল বিকেলে তার পিছনে ঘুরঘুর করছিল।
পুরো এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে দিয়ে রেহাই পেয়েছিল সে। কুকুরটা তখন মহানন্দে ল্যাজ
নাড়ছিল। ও একটু এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। কুকুরটা তার পিছু পিছু আসছে
কি না, তা দেখার জন্য।
তখন দেখে, ওই বিস্কুটগুলো
তার বাচ্চারা হুড়োহুড়ি করে খাচ্ছে। আর ওই কুকুরটা তখন আর একজন ট্যুরিস্টের পিছনে
ঘুরঘুর করছে। যেন বলতে চাইছে, আমাকে কিছু কিনে দাও। দেবমাল্য বুঝতে পারল না, ওরা কী করে বোঝে, কে বেড়াতে এসেছে
আর কে স্থানীয়। কারণ, তু তু করলেও স্থানীয় কারও পিছনেই ও যাচ্ছিল
না।
ওর হঠাৎ মনে হল, একটু চা খেতে
পারলে হত। কিন্তু আশপাশে কোনও দোকান খুলেছে বলে ওর মনে হল না। কখন খুলবে কে জানে!
তবে স্টেশনে গেলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। হঠাৎ দূর থেকে অন্ধকার ভেদ করে গাড়ির
দুটো হেডলাইটের আলো এসে ঠিকরে পড়ল। ও বুঝতে পারল, এটা তার জন্যই আসছে। এলেই বলতে হবে, ঘুরিয়ে নিন।
'ঘুরিয়ে নিন' বলবে কী! জানালায় উঁকি মেরে দেখে যে চালাচ্ছে, সে তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। মনে হয় সবেমাত্র
গোঁফের রেখা উঠেছে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিতেই, পেছনের সিটে নয়, একদম সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশে বসে
পড়ল দেবমাল্য। বসামাত্রই গাড়ি ছুটতে লাগল। জানালার কাচ নামানো। হু হু করে হাওয়া
ঢুকছে। এখান থেকে বহরমপুর কোর্ট স্টেশন পাক্কা দশ কিলোমিটার। যেতে যথেষ্ট সময়
লাগবে। ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমিয়ে নিলে হয়। ও আলতো করে শরীর ছেড়ে দিল।
ড্রাইভার খেয়াল
করিনি। এখানকার রাস্তাটা খুব খারাপ। পিচ-টিচ উঠে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। কোনও
গর্তে বোধহয় চাকা পড়ে গিয়েছিল। গাড়িটা লাফিয়ে উঠতেই ওর তন্দ্রা কেটে গেল।
দেখল, রাতের অন্ধকার
আস্তে আস্তে ফিকে হওয়ার পথে। ভোর হতে আর বেশি সময় নেই। ভাগ্যিস বেরোবার সময় মনে
করে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল চেয়ে নিয়েছিল কাউন্টারে বসা ছেলেটার কাছ থেকে।
কাঁধের ঝোলা থেকে সেটা বের করে জানালা দিয়ে কুলকুচি করল ও। তার পর খানিকটা জল
হাতের তালুতে নিয়ে মুখে ঝাপটা মারল।
ড্রাইভার পাশ না
ফিরেই বলল, মুখ ধোবেন? গাড়ি দাঁড় করাব?
দেবমাল্য বলল, না না, চলো। ও দিকে
ট্রেন ঢুকে পড়লে মুশকিল হবে।
--- লালগোলা তো? হাতে এখনও অনেক সময় আছে। তা ছাড়া কোনও দিনই ট্রেন ঠিক সময়ে ঢোকে না। আমার
বাড়ি তো বহরমপুরেই। আমি জানি।
--- বহরমপুরের কোথায়?
সে বলল, স্টেশনের কাছেই।
কয়েক মিনিটের রাস্তা। পায়ে হেঁটেও যওয়া যায়। বাবুলবোনা রোডে।
--- ও, আর কতক্ষণ লাগবে?
--- এই তো এসে গেছি।
দেবমাল্য অধৈর্য
হয়ে জিজ্ঞেস করল, তাও?
--- এই... মিনিট পাঁচেক।
--- তা হলে বেশিক্ষণ লাগল না, বলো? বলেই, ভূত দেখার মতো লাফিয়ে উঠল ও। গাড়ির হেড
লাইটের আলোয় দেখল, একটা হুট খোলা জিপ ওই দিক থেকে ছুটে আসছে।
ড্রাইভারের পাশে কেউ নেই। পেছনের সিটে তানিয়া বসে আছে। পোশাক-আশাক যেন কেমন।
উসকোখুসকো চুল। চোখ-মুখ চোখ দেখে মনে হয়, একটা ঝড় বয়ে গেছে তার উপর দিয়ে। বউয়ের এমন
অবস্থা দেখে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল--- এ কী!
--- কী হল?
--- ওই তো আমার বউ।
--- আপনার বউ? আপনি যে বললেন, সে ট্রেনে করে আসছে।
--- হ্যাঁ তাই তো আসার কথা। তা হলে কি ট্রেনটা আগে ঢুকে পড়েছে!
--- আগে? ওর দিকে ঘাড়
ঘুরিয়ে ছেলেটা বলল, আজ পর্যন্ত কোনও দিন হয়নি... গেলেই জানতে
পারবেন, কত ঘণ্টা লেটে
চলছে...
ড্রাইভার কথা বলে
যাচ্ছে। সে দিকে ওর কান নেই। ও শুধু তাকিয়ে আছে ওই জিপটার দিকে। জিপটা একদম
সামনে। তানিয়া নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পারিনি। তাই বাঁ দিকে ঝুঁকে জানালা দিয়ে
শরীরের প্রায় অর্ধেকটা বের করে হাত নাড়াতে লাগল ও। চিৎকার করতে লাগল তানিয়া
তানিয়া করে। কিন্তু তানিয়ার কোনও হেলদোল নেই। সম্মোহিতের মতো বসে আছে। যেন শোকে
পাথর হয়ে গেছে। ওর কথা সে শুনতে পেল বলে ওর মনে হল না। জিপটা ও পাশ দিয়ে হুস করে
বেরিয়ে গেল।
দেবমাল্য বলল, ঘোরাও ঘোরাও
ঘোরাও। ওই যে জিপটা, ওই যে, ওই যে, ওই যে... ওর পিছু নাও। তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি
তাড়াতাড়ি...
রাস্তাঘাটে খুব
একটা গাড়ি-টারি নেই। ওর গাড়ির ড্রাইভার ঝট করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিল। ইউ
টার্ন নিয়েই রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল।
কিন্তু এ কী! জিপটা কোথায়! ডান দিকে বাঁ দিকে তো কোনও রাস্তা দূরের কথা, কোনও গলিঘুঁজিও
দেখছি না! তা হলে! হ্যালুসিনেশন নয় তো! মনের ভুল! ও ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, আমরা যখন
যাচ্ছিলাম তুমি দেখেছ তো? আমাদের সামনে দিয়ে একটা জিপ ঝড়ের বেগে সাঁ...
করে বেরিয়ে গেল। তুমি বাঁ দিকে না চাপলে আমাদের গাড়িটাকে ঘষে দিয়ে বেরিয়ে যেত।
পিছনের সিটে একজন মহিলা বসে ছিল। দেখেছ না?
--- হ্যাঁ, দেখলাম তো। তিন জন বসা।
--- তিন জন!
--- হ্যাঁ, পিছনের সিটে তিন জনকেই দেখলাম তো। দু'পাশে কালো বোরখা পরা মোটা মতো দু'জন মহিলা আর
মাঝখানে একটা বউ। কেমন যেন থমথমে মুখ। শাড়ি পরা।
শাড়ি পরা, ঠিক আছে। থমথমে
মুখ, তাও ঠিক আছে।
কিন্তু দু'পাশে দু'জন মহিলা! দু'জন! সে ভুল দেখতে
পারে। কিন্তু ফোটোগ্রাফার আর গাড়িচালকদের চোখ বড় মারাত্মক হয়। সহজে তাদের ভুল
হয় না। একবার যে রাস্তা দিয়ে যায়, দশ বছর পরও সে রাস্তায় গেলে, ঠিক বুঝতে পারে, আগে এই রাস্তায়
এসেছিল। ও নিশ্চয়ই ভুল বলছে না। বরং ঠিক মতো না দেখে থাকলে, দোষটা তারই। তাই
সে ঠিক কী দেখেছিল, মনে মনে সেটা ফের মনে করার চেষ্টা করতে লাগল
সে। হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একটা জিপ। জিপটা চালাচ্ছে এক শিখ ড্রাইভার। মাথায় পাগড়ি বাঁধা।
তার পাশে কেউ নেই। পেছনের সিটে তানিয়া। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ... ওই এক ঝলকেই ও যা
দেখেছে, তাতেই ওর মনে
হয়েছে, তার চোখ-মুখ বলছে
প্রচণ্ড একটা শক পেয়েছে সে। একেবারে বিধ্বস্ত। প্রচুর কান্নাকাটি করেছে বোধহয়।
থমথমে মুখ। সামনে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু কিছুই যেন সে দেখছে না। কোনও কিছুই তাকে
স্পর্শ করছে না। প্রাণহীন একটা পুতুলের মতো বসে আছে। তার দু'পাশে কালো জোব্বা
পরা দু'জন। জোব্বা নয়, বোরখা। মুখের
ঢাকনাটা কপালের ওপর দিয়ে পেছনে ফেলা। দু'জনই মধ্যবয়স্ক মহিলা।
দৃশ্যটা মনে
পড়তেই চমকে উঠল সে। এদের দু'জনকে এর আগে সে যেন কোথায় দেখেছে! কিন্তু
কোথায়! কোথায়! কোথায়! হঠাৎ মনে পড়ে গেল, কাল রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে সে যখন খাটে শুয়ে
টিভি দেখছিল, তখন পর পর কয়েকটা গুলির আওয়াজ শোনার পরে, কী হয়েছে দেখার জন্য পেছনের জানালা খুলে বাইরে
তাকিয়েছিল সে। আর তখনই ল্যাম্পপোস্টের নীচে স্ট্রিট লাইটের আলো-ছায়ায় এই দু'জনকেই তার
জানালার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল সে। তখন মনে হয়েছিল, জোব্বা মতো কী
একটা পরা। এখন বুঝতে পারছে, জোব্বা নয়, ওটা ছিল বোরখা। ওরা কারা? তার থেকেও বড়
কথা, ওদের সঙ্গে
তানিয়া কোথায় যাচ্ছে!
রুদ্ধশ্বাসে
গাড়ি ছুটিয়ে বেশ কিছুটা গিয়েও ওই জিপটাকে আর দেখা গেল না। যেতে যেতে ড্রাইভার
নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, গাড়িটা কি ভ্যানিশ হয়ে গেল নাকি! অদ্ভুত
ব্যাপার তো!
দেবমাল্য তখন এ
দিক ও দিক তাকাচ্ছে। কোনও গলি-ঘুঁজিতে জিপটা ঢুকে পড়ল কি না... ওকে ও রকম করতে দেখে
ড্রাইভার বলল, অত ঘাবড়াবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি কোন হোটেলে আছেন, উনি জানেন তো?
--- সে তো বলেছিলাম। কিন্তু ও কি তা মনে করে রেখেছে!
--- নিশ্চয়ই মনে করে রেখেছে। তাই বোধহয় ট্রেন থেকে নেমে আপনাকে দেখতে না পেয়ে
ওই জিপ ভাড়া করে উনি আপনার হোটেলে চলে গেছেন।
পকেট থেকে মোবাইল
বের করে দেবমাল্য ডায়াল করল তানিয়াকে। এ বার আর নট রিচেবল নয়, শুনতে পেল--- দিস
নম্বর ইজ বিজি।
--- বিজি! তা হলে তাকেই ফোন করছি হয়তো। সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা কেটে দিল ও। মোবাইলের
স্ক্রিনে তখন তিনটে আটচল্লিশ। নিজের মনেই ও বলল, সিডিউল টাইমের এত আগে ট্রেন ঢুকে পড়েছে!
ওই জিপটা কোন দিকে যেতে পারে! আন্দাজ করে এগোতে এগোতে
ড্রাইভার বলল, আপনি আপনার বউকে ঠিক দেখেছেন তো? দেবমাল্য বলল, আমি আমার বউকে চিনব না?
--- না না, একই রকম দেখতে অন্য কেউও তো হতে পারে।
--- না না, বলছি না, ওটা আমার বউ। তোমার কি মনে হয় আমি ইয়ার্কি মারছি?
--- না, তা বলছি না। বলছি, জিপটারে তো দেখতে
পাচ্ছি না। একবার স্টেশনে গিয়ে দেখে এলে হত না! এখান থেকে স্টেশন তো খুব একটা দূরে
নয়। দু'মাইলও হবে না।
দেবমাল্য বলল, ঠিক আছে, চলো। কিন্তু ও তো
ফোন করল না। একবার ফোনে না পেলে আর একবার চেষ্টা করবে না! নাকি... তা হলে ও তখন
কাকে ফোন করছিল! আবার ডায়াল করল তানিয়াকে। এবং এ বারও ভেসে এল--- দিস নাম্বার ইজ
বিজি।
এতক্ষণ কার সঙ্গে
কথা বলছে ও! কার সঙ্গে! আমাকে ফোনে না পেয়ে কি সামসেরকে ফোন করেছে! সামসের ওর
বউদিকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে-ই বারণ করেছিল। এখন মনে হচ্ছে, বারণ না করলেই
বোধহয় ভাল হত। এর আগেও ও দেখেছে, সামশের নিজে থেকে যেটা করতে চায়, সেটা বাধা দিলেই
যত সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর আগেও বহু বার হয়েছে।
সে দিন ও বারবার
করে বলেছিল, খেতে আর কতক্ষণ লাগবে? এই এত বেলায় কেউ না খেয়ে বেরোয়? দশ-পনেরো মিনিট
দেরি হলে এমন কিছু মহাভারত অসুদ্ধ হবে না। ওরা ভাববে, নিশ্চয়ই জ্যামে পড়েছে। রাস্তাঘাটের যে
অবস্থা...
ও ওর মতো বলে
যাচ্ছিল। কিন্তু ওর কথায় কান না-দিয়েই দেবমাল্য বলেছিল,
তোর খাওয়া হয়েছে তো? তা হলে আর কথা
বাড়াস না। যা, গাড়িটা বার কর। আমি নামছি।
দেবমাল্য কিছু
বললে ও তার অন্যথা করে না। তাই চুপচাপ নেমে, গাড়ি নিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল
সামশের। দেবমাল্য নামতেই স্টার্ট করে দিয়েছিল গাড়ি। আর চলা শুরু করতে না-করতেই
তার গাড়িটাকে ঘষে দিয়ে একটা ট্রাক এমন ভাবে চলে গিয়েছিল, আর একটু হলেই
মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারত।
আর একবারও এ রকম
হয়েছিল। সে দিন প্রচণ্ড ঝড়-জলে চার দিক তোলপাড়। বড় বড় গাছ উপড়ে পড়েছে।
রাস্তার হাঁটু-জল দ্রুত পাস করানোর জন্য স্থানীয় ছেলেরাই ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে
দিয়েছে। বেরোনোর জন্য দেবমাল্য তোড়জোড় শুরু করতেই সামশের বলেছিল, জল নামার পর গেলে
হয় না?
দেবমাল্য বলেছিল, কখন জল নামবে, কোনও ঠিক আছে? যদি সারা রাতেও
জল না-নামে, আমি কি তা হলে সারা রাত ধরে কারখানাতেই বসে থাকব নাকি?
বলেই, হাঁটু অবধি
প্যান্ট গুটিয়ে সোজা হাঁটা দিয়েছিল বাড়ির দিকে। তার পরেই সেই অঘটন। তাকে জলের
মধ্যে কাতরাতে দেখে মুহূর্তের মধ্যে একটি ছেলে দৌড়ে এসে যদি বাঁশ দিয়ে ইলেকট্রিক
তারটা জল থেকে তুলে না-ধরত, তা হলে সে দিন যে কী হত, কে জানে!
এত ঘটনার পরেও
কেন যে তার আক্কেল হয় না, দেবমাল্য বুঝতে পারে না। যদি বুঝতে পারত, সামসের যখন তার
বউকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যেতে চেয়েছিল, সে কি বারণ করত!
তানিয়ার নম্বর
বারবার বিজি দেখে সামশেরকে ফোন করল দেবমাল্য। দেখল, সুইচ
অফ। তা হলে! তা হলে কার সঙ্গে কথা বলছ ও! কার সঙ্গে! এত সকালে নিশ্চয়ই
বাবা-মা-দাদা-ভাইকে ফোন করতে যাবে না। তা হলে!
ভাবতে ভাবতে
স্টেশনের সামনে, একদম টিকিট কাউন্টারের কাছে চলে এল ওদের গাড়ি। গাড়ি থেকে নামার আগেই
দেবমাল্য শুনতে পেল প্ল্যাটফর্মের ও দিক থেকে ভেসে আসা অ্যানাউন্সমেন্ট--- আপ লালগোলা প্যাসেঞ্জার, লালগোলা যাওয়ার
গাড়ি পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আসছে...
অবাক হয়ে গেল
দেবমাল্য। তার মানে ট্রেন এখনও আসেইনি!
চার
কী অবস্থা!
ট্রেনেই আসেনি, আর সে কিনা ভেবেছিল, ট্রেনে করে এসে স্টেশন চত্বর থেকে জিপ ভাড়া
করে তানিয়া কোথায় চলে গেছে! তানিয়ে ভেবে কোন না-কোন মেয়ের পিছনে ছুটে গিয়েছিল
সে। সত্যিই...
খুব ছোটবেলায়
কার কাছে যেন ও শুনেছিল, যমজ বাচ্চার কথা। যমজ বাচ্চারা নাকি হুবহু একই
রকম দেখতে হয়। অনেক বড় বয়সেও একই রকম পোশাক পরিয়ে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলে
নাকি কেউই চিনতে পারে না কোনটা কে! একজনের শরীর খারাপ হলে অন্য জনেরও হয়। একজনকে
মারলে আর একজনেরও গায়ে লাগে। দু'জনের কোনও একজন খেলে অপর জনের নাকি পেট ভরে যায়।
দেবমাল্য বহু বার ভেবেছে, এটা কী করে সম্ভব! এ রকম কি সত্যিই হয়! কে
নাকি একবার বলেছিল, এই পৃথিবীতে একই রকম দেখতে দুটো মানুষ ঘুরে
বেড়ায়। কখনও কখনও কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সারা জীবনেও
কারও সঙ্গে কারও মোলাকাত ঘটে না।
এর কিছু দিন পরেই
মা-বাবার সঙ্গে কোন সিনেমা হলে যেন ও 'ভ্রান্তিবিলাস' দেখতে গিয়েছিল। খুব মজার বই। নায়ক ছিলেন
উত্তমকুমার, আর তাঁর ভৃত্য হিসেবে অভিনয় করেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সিনেমায় ওই
দু'জনেরই ডবল রোল
ছিল। মানে দু'জনেই ছিলেন যমজ।
এই দিন কতক আগে
কোন একটা কাগজে ও একটা নিবন্ধ পড়েছিল। তাতে নাকি কোন এক ফরাসি তাত্ত্বিক অনেক
গবেষণার পরে জানিয়েছেন, দু'জন নয়, একই রকম দেখতে অন্তত সাত জন লোককে একই সময়ে
পৃথিবীতে কোথাও না-কোথাও দেখতে পাওয়া যায়।
তার মানে
তানিয়ার মতো হুবহু দেখতে আরও ছ'জন মেয়ে এই
মুহূর্তে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে। তারই একটা এখন বহরমপুরে। তার সামনে
দিয়ে জিপে করে একটু আগে হুস করে বেরিয়ে গেছে।
প্লাটফর্মের যে
টি-স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা চা খাচ্ছে, সেই স্টলের গায়ে প্রায় চার হাত লম্বা, দু'হাত চওড়া একটা
টিনের পাকে বড় বড় হরফে লেখা--- চা খাওয়ার উপকারিতা। তার নীচে এক, দুই, তিন, করে পর পর লেখা
উপকারের তালিকা।
লেট না করলে
ট্রেন কখন ঢুকে যেত। এতক্ষণে হয়তো তানিয়াকে নিয়ে ও হোটেলে পৌঁছে যেত। তা হয়নি
দেখে মাইকে কোনও অ্যানাউন্সমেন্ট হলেই ও সঙ্গে সঙ্গে কান খাড়া করে দিচ্ছে।
প্ল্যাটফর্মে আসার পর অন্তত পাঁচ-ছ'বার ঘোষণা হয়েছে লালগোলা প্যাসেঞ্জার
পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেটে আসছে।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট
তো নয়, যেন পঁয়তাল্লিশ
বছর। যতই স্বাভাবিক থাকার ভান করুক না কেন, আসলে ভিতরে ভিতরে
কিন্তু ভীষণ টেনশন হচ্ছে তার। আসার সময় ওই জিপ আর জিপের ভেতরে অবিকল তানিয়ার মতো
দেখতে ওই মেয়েটাকে না দেখলে হয়তো তার এ রকম হত না। কিন্তু কী করা যাবে!
মনের এই অস্থিরতা
দূর করার জন্যই চায়ে চুমুক দিতে দিতে 'চা খাওয়ার উপকারিতা' পড়তে লাগল সে। লেখার ধরন আর মাঝে মাঝেই চলটা
উঠে গিয়ে টিনের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা আদ্যিকালের। তা ছাড়া
এ ধরনের বিজ্ঞাপন তো বহু যুগ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। যখন এই প্ল্যাটফর্ম হয়, তখনই বোধহয় এই
চায়ের দোকানটা হয়েছিল। এবং সেই সময়ই সম্ভবত এই টিনের বোর্ডটা লাগানো হয়েছিল।
যিনি চায়ের দোকানটা করেছিলেন, তারই নাতি-নাতনির ছেলে কিংবা কয়েক হাত ঘুরে
অন্য কেউ হয়তো এই চায়ের দোকানটা এখন চালাচ্ছে।
তখন এ সব ছিল।
ঘরে ঘরে চা-কফি চালু করার জন্য ইংরেজরা কী-ই না করেছে। কফি বোর্ড গঠন করে সারা
দেশের সব ক'টা বড় শহরে একাধিক করে কফিহাউস খুলেছে। যতক্ষণ খুশি আড্ডা মারো, বসে বসে বিনে
পয়সায় ইলেকট্রিক পাখার হাওয়া খাও, কেউ কিচ্ছু বলবে না। কিন্তু তার বিনিময়ে এক কাপ
কফি খাওয়া চাই। পকেটে যদি তেমন রেঁস্তো না থাকে, তিন জনে মিলে একটা কফি ভাগ করে খাও। তাও খাও।
খেতে খেতে কফি খাওয়ার নেশা হোক।
শোনা যায়, প্রথম দিকে নাকি
ফ্রি-তেই কফি খাওয়াত ওরা। সেই কফিহাউসগুলো এখনও আছে। তার মধ্যে কলেজ স্ট্রিট
কফিহাউস তো জগদ্বিখ্যাত। আগে নাম ছিল আলবার্ট হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ওখানে
গিয়েছিলেন। এক সময় ওখান থেকেই গোটা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল একাত্তর-বাহাত্তর
সালের সালের সব চেয়ে ব়র্ণময় রাজনৈতিক আন্দোলন--- নকশাল মুভমেন্ট। বিখ্যাত গায়ক
মান্না দে তো কফিহাউস নিয়ে একটা গানই গেয়ে ফেলেছেন--- কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ
আর নেই / কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো / সেই...
তবু কফি নয়, ভেতো বাঙালিরা
একদিন যাতে ঘুম থেকে উঠেই চায়ের জন্য ছটফট করেন, সে জন্য প্রচুর উদ্যোগ নিয়েছিল ওরা। তার মধ্যে
প্রথম এবং প্রধান ছিল, এ দেশের লোকের কাছে চা পানের উপকারিতা তুলে
ধরা। তখনকার লোকেরা নাকি উপকার হবে জানতে পারলে, বিষ খেতেও পিছ-পা হতেন না। তাই তারা রটিয়েছিল, চা খেলে শ্লেষা
হয় না। কর্মক্ষমতা বাড়ে। ক্লান্তি দূর করে। আরও কত কী...
কী? আর কী কী? সেটা দেখার জন্যই
সেই টিনের পাতে চোখ রাখল দেবমাল্য। কিন্তু চলটা উঠে মাঝে মাঝেই অক্ষরগুলো ঝরে
পড়েছে দেখে কোনও লাইনই গড়গড় করে পড়া যাচ্ছে না। পড়া তো দূরের কথা, উদ্ধারও করা
যাচ্ছে না পুরো বাক্যটা কী! তা ছাড়া চা খাওয়ার জন্য হঠাৎ হঠাৎ দোকানের সামনে
লোকজন দাঁড়িয়ে পড়ায়, তাদের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে লেখাগুলো।
চায়ে চুমুক দিতে
গিয়ে দেবমাল্য দেখল, চা-টা একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। ও আরও এক কাপ
নিল। পাশে তাকিয়ে দেখে যার গাড়ি করে ও এসেছে, সেই ড্রাইভারটা নেই। ইতিউতি তাকিয়ে দেখে ও
দিকের ঝুড়িতে ভাড় ফেলে ও এগিয়ে আসছে। ও তাকে বলল, আর একটা চা খাবে নাকি?
ড্রাইভার বলল, না না, এই তো খেলাম।
তার কথা শেষ হল
কি হল না, মাইকে ঘোষণা
হল--- লালগোলা প্যাসেঞ্জার এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। দেবমাল্য বলল, রোজই কি লেট করে
নাকি?
ড্রাইভার বলল, না না, এটা তো রাইট
টাইমেই আসে। তবে খুব বেশি কুয়াশা পড়লে হেড লাইটের আলোতেও চার হাত দূরে কী আছে, অনেক সময় দেখা
যায় না। সিগন্যাল দেখার ক্ষেত্রেও চোখ প্রতারণা করে। আর তাতেই অ্যাক্সিডেন্টের
সম্ভাবনা শতগুণ বেড়ে যায়। ট্রেন-চালকদের ক্ষেত্রে এটা খুব হয়। সিগন্যাল লাল হয়ে
থাকলেও ওঁরা সবুজ দেখেন। আবার সবুজ হয়ে থাকলেও হলুদ দেখতে পারেন। দীর্ঘক্ষণ ট্রেন
চালালে নাকি ড্রাইভারদের এ রকম ভ্রম হামেশাই হয়। তাই প্রতি ছ'মাস অন্তর
ট্রেন-চালকদের চোখ পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। সদ্য পরীক্ষা করিয়ে এলেও
ট্রেন-চালকদের ধন্দ্ব কিন্তু মন থেকে যায় না। ফলে কুয়াশা হলেই ওঁরা সতর্ক হয়ে
যান। তখন খুব আস্তে আস্তে ট্রেন চালান। বলা তো যায় না, কখন কোথা থেকে কার গরু-ছাগল হুট করে রেল লাইনে
উঠে আসে। আর তাতেই তো লেট হয়ে যায় আসতে। সে হোক। দুর্ঘটনায় পড়ার চেয়ে লেট হওয়া
ভাল।
--- সে তো অবশ্যই। ওই তো ট্রেন আসছে। আসছে মানে এখনও মিনিট দশেক বাকি, না?
--- হ্যাঁ, তা তো লাগবেই। এখন ক'টা বাজে?
দেবমাল্য মোবাইল
বের করে দেখল, চারটে একত্রিশ। তাই বলল, সাড়ে চারটে বেজে গেছে।
--- সাড়ে চারটে তো? তা হলে ঠিকই আছে। ট্রেনটার ঢোকার কথা ছিল
চারটেয়। পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেট। তার মানে চারটে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ নাগাদ ঢুকবে। এখন
সাড়ে চারটে তো? হ্যাঁ, আর ওই মিনিট দশ-বারো।
কথাটা ড্রাইভার
বললেও দেবমাল্য বুঝি ওর কথায় ঠিক ভরসা করতে পারল না। মন ছটফট ছটফট করছে তার। মনে
মনে বলছে, হে ভগবান, তখন ওই জিপে যা
দেখেছি, সেটা যেন ভুল
দেখে থাকি। তোমাকে একশো এক টাকার পুজো দেব মা। আমার বউ যেন এই ট্রেনেই থাকে।
ভগবানের কাছে বারবার মিনতি করলেও কিছুতেই সুস্থির থাকতে পারছে না। তাই
প্ল্যাটফর্মের একদম ধারে গিয়ে বারংবার উঁকিঝুঁকি মেরে ও দেখে আসছে, ট্রেনটার হেড
লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে কি না।
সামসের বলেছিল, তানিয়া যে কোচে
উঠেছে, তার নম্বর এস
ফোর। কোনখানটায় পড়বে ওটা? যাকে জিজ্ঞেস করে, সে-ই বলে সামনে। এমন সময় কালো কোট র়া এক
টিকিট পরীক্ষককে দেখতে পেয়ে দ্রুত পা চালাল দেবমাল্য। জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, এই তো এখানে
পড়বে।
ও আর ড্রাইভার
দাঁড়িয়ে পড়ল। এক মিনিট গেল। দু'মিনিট গেল। তিন মিনিট গেল। হঠাৎ দূর থেকে তীব্র
আলো আছড়ে পড়ল রেল লাইনের উপরে। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্পষ্ট থেকে জোরে, আরও জোরে হতে
লাগল ট্রেন ঢোকার শব্দ।
হু হু করে লোক
নামছে। নামছে তো নামতেই। কিন্তু তানিয়াকে দেখা যাচ্ছে না। ও কি বুঝতে পারেনি
বহরমপুর এসে গেছে। নাকি এখনও ঘুমিয়ে আছে! ও এস ফোরেই উঠেছিল তো! যত দূর মনে পড়ছে, সামসের ওকে এস
ফোরের কথাই বলেছিল। কিন্তু ও কান শুনতে
ধান শোনেনি তো!
কামরার গায়ে
তখনও রিজার্ভেশনের তালিকাটা আঠা দিয়ে সাঁটা। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সেই তালিকায় চোখ
বোলাতে লাগল ও। কোথায় তানিয়া! কোথায়! হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সামসের বলেছিল, ওর সিট নম্বর
তেইশ। দেবমাল্য সঙ্গে সঙ্গে তালিকার তেইশ নম্বরে চোখ রাখল। দেখল, সেখানে জ্বলজ্বল
করছে তানিয়ার নাম।
হ্যাঁ, এ কামরাতেই ও
আছে। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। ও আগেই জেনেছে, এখানে অনেকক্ষণ ট্রেন দাঁড়ায়। ফলে চিন্তার
কোনও কারণ নেই। তালিকা দেখে ড্রাইভারের সামনে এসে তাকে কিছু বলতে যাবার আগেই, কামরাটার দরজার
দিকে তাকাতেই ও দেখল, নামা নয়, এ বার ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি করছে যাত্রীরা।
তা হলে কি
লাগেজটা ভারী দেখে ও টেনে নিয়ে আসতে পারছে না! নাকি সহজে তোলা যায় এ রকম ছোট ছোট
অনেকগুলো ব্যাগ নিয়ে এসেছে ও! দু'হাতে দুটো দুটো করে দরজার কাছে এনে জড়ো করছে।
এই লোকগুলো উঠে পড়লে ও ধীরেসুস্থে নামবে। তাই-ই কি? একবার গিয়ে দেখি তো!
ড্রাইভারকে বলল, কোনও মহিলাকে যদি
ভারী কোনও লাগেজ কিংবা ছোট ছোট অনেকগুলো ব্যাগ নিয়ে নামতে দ্যাখো, জিজ্ঞেস করবে তো, তার নাম তানিয়া
কি না। যদি তানিয়া হয়, তা হলে হাতে হাতে একটু নামিয়ে নিয়ো তো। কোন
গেট থেকে নামবে, তাও তো বুঝতে পারছি না। কী মেয়ে রে বাবা, জানে আমি স্টেশনে আসব। স্টেশনে আসা মানে তো
শুধু তার জন্য টিকিট কাউন্টারের সামনে হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করা নয়।
প্ল্যাটফর্মে এসে তার লাগেজটাও তুলে নেওয়া। এটুকুও বোঝে না! জানালা দিয়ে হাত
বাড়িয়ে ডাকতেও তো পারে।
ড্রাইভারকে বলল, তুমি এখানে
দাঁড়াও, আমি বরং ভিতরে
গিয়ে একবার দেখে আসি। বলেই, যারা ওঠার জন্য দরজার কাছে জটলা করে
ধাক্কাধাক্কি করছিল, ও তড়িঘড়ি তাদের মধ্যে ঢুকে গেল।
ভিতরে গিয়ে দেখে
তেইশ নম্বর সিটে আট-দশ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। দেবমাল্য তাকে জিজ্ঞেস
করল, এখানে যে
ভদ্রমহিলা বসে ছিল, সে কোন দিকে গেছে দেখেছ?
তার কথা শুনে
মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কিচ্ছু বলছে না দেখে সে এ দিক ও দিক তাকাতে
লাগল। তানিয়া কোথায়! সামসের বলেছিল, তানিয়ার সামনের সিটে যে বয়স্ক ভদ্রলোক আছেন, তিনি একটু পরেই
বাঙ্কে উঠে যাবেন। তা হলে তো তার এখন বাঙ্কে শুয়ে থাকার কথা।
ও উপরে তাকাল।
দেখল, বাঙ্কে কেউ নেই।
সিলিংপাখার হাওয়ায় শুধু চার ভাঁজ করা একটা পুরনো খবরের কাগজের দু'তিনটে পাতার কোণ
তিরতির করে কাঁপছে।
ওকে ছটফট করতে
দেখে পিছনের ছ'সিটের খোপ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ বলে উঠলেন, আপনার সিট নম্বর কত?
ও বলল, সিট নম্বর নয়, এখানে একজন
ভদ্রমহিলা ছিল, তাকে খুঁজছি।
--- ভদ্রমহিলা? হ্যাঁ, এখানে একজন ভদ্রমহিলা ছিল তো। আমি তাকে একটু আগেও দেখলাম। কিন্তু... এ সিটটা
তো অনেকক্ষণ থেকে ফাঁকা। জানালার ধার তো, আমার মেয়ে তাই ওটায় বসার জন্য ঘ্যানঘ্যান
করছিল। তাই ফাঁকা দেখে ওকে বললাম, যা ওখানে গিয়ে বস। তা,
তার কোথায় নামার কথা?
--- এই তো এখানে।
--- তা হলে দেখুন, হয়তো নেমে পড়েছে।
--- আমি তো গাড়ি আসার আগে থেকেই তার জন্য নীচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে নামেনি।
--- সে কী!
'সে কী!' শব্দটা বলার সময় লোকটার চোখ-মুখ এমন পাল্টে গেল যে, সেটা দেখে কোনও এক অজানা ভয়ে দেবমাল্য একেবারে
আঁতকে উঠল। ওর মনে হল, হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। দু'ধারের সিটের
মাঝখানের এই প্যাসেজ দিয়ে যাতায়াতের সময় কেউ যদি তাকে ধাক্কা নয়, সামান্য একটু
ছুঁয়েও যায়, সে নির্ঘাত পড়ে যাবে। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে। চোখের সামনে ঝাপসা হতে
হতে একদম অন্ধকার হয়ে গেল সব।
পাঁচ
যখন চোখ খুলল, দেবমাল্য দেখল
একটা ছাপোষা ঘরে সে শুয়ে আছে। জানালা-টানালা আছে বলে মনে হল না। লাইট জ্বলছে। দিন
না রাত বুঝতে পারছে না। থাকা তো দূরের কথা, এ রকম ঘরে সে কোনও দিন ঢুকেছে বলেও মনে করতে
পারল না। সামশেরদের ঘরের চেয়েও খারাপ অবস্থা।
পায়ের কাছে একটা
আলনা। তাতে একসঙ্গে জড়ো করা অনেকগুলো জামাকাপড়। শুকিয়ে গেছে দেখে কোনও রকমে দড়ি
থেকে নামিয়ে যেন আলনার উপরে রেখে দিয়ে গেছে। ভাঁজ করারও সময় পায়নি। তার পাশেই
কোমর-সমান একটা কাঠের পাতি আলমারি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বহু পুরনো। তেলকাষ্টি
পড়ে গেছে। কাচ বা আয়না নয়, সামনে তারের জাল লাগানো। তারই পাশে একটা
জলচৌকির ওপরে তিন-চারটে টিনের বাক্স। একটার উপরে একটা রাখা। দেয়ালে এক চিলতে কাঠ
লাগিয়ে লক্ষ্মীর আসন করা হয়েছে। সেখানে গণেশ, কালী, লক্ষ্মী থেকে শুরু করে মা মনসারও একটা ছবি আছে
মনে হচ্ছে। এ দিকে ও দিকের দেওয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে। সে দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল, সামনের বার
নিশ্চয়ই এর উপরেই নতুন বছরের ক্যালেন্ডার জায়গা করে নেবে। কারণ, যেটা ঝুলছে, সেটা পৃথক পৃথক
মাসের বারো পাতার নয়। হলে নিশ্চয়ই ক্যালেন্ডারের তলায় বারো মাসের তারিখ ছাপা এক
পাতার ওই কাগজটা সাঁটা থাকত না। সেটা এবং তার নীচে আরও অনেক ক্যালেন্ডারের পাতা
দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তার নীচে, আগের বছর, তার আগের বছর এবং তারও আগের বছরের
ক্যালেন্ডারগুলো চাপা পড়ে আছে। ঘরের মাঝখানে মাথার উপরে খয়েরি রঙের একটা
আদ্যিকালের ঢাউস ফ্যান অত্যন্ত ঢিমেতালে ঘুরছে। মনে হচ্ছে এক-এ দেওয়া। উপরটা
বোধহয় টালি বা অ্যাসবেস্টসের। তাই দরমার সিলিং।
কোথায় আছে সে
বুঝতে পারছে না। ঘরের ভেতরে অন্য কাউকে দেখতেও পাচ্ছে না যে, কিছু জিজ্ঞেস
করবে। হাতের উপরে ভর দিয়ে দেবমাল্য খাটের উপরে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু বসার আগেই
মাথার মধ্যে যেন কেমন করে উঠল। মনে হল, কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।
ও আর উঠার চেষ্টা
করল না। চুপচাপ শুয়ে রইল। দু'মিনিট, চার মিনিট নাকি দশ মিনিট ও জানে না। খুট করে
একটা আওয়াজ হতেই মাথা ঘুরিয়ে দেখে এক পাল্লার দরজা ঠেলে কে জানে ভেতরে ঢুকছে।
একে এর আগে সে কোনও দিন
দেখেছে বলে মনে
করতে পারছে না। না, পুরুষ নয়। ভদ্রমহিলা। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর বয়স
হবে। তার মাথার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, এখন কেমন লাগছে?
ও 'ভাল' বলেই উঠতে
যাচ্ছিল। ভদ্রমহিলা বললেন, না না, উঠতে হবে না। এখন একটু বিশ্রাম করো। রণো ওষুধ
নিয়ে আসছে।
রণো! রণোটা আবার
কে! এই ভদ্রমহিলাকে সে যেমন আগে কোনও দিন দেখেনি, রণোকেও কি দেখেনি! আস্তে আস্তে করে ও বলল, রণো কে?
ভদ্রমহিলা বললেন, রণোকে চেনো না? ও তো আমার ছেলে।
ও-ই তো তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
আমাকে এখানে রণো
নিয়ে এসেছে! কিন্তু রণোটা কে? এটা জানার জন্য মন ছটফট করলেও, যে তাকে তার
বাড়িতে নিয়ে এসেছে, তার মাকে কি জিজ্ঞেস করা যায়, রণো কে? তাই একটু
ঘুরিয়েই সে জানতে চাইল, ও আমাকে কোথায় পেল?
--- কেন? ট্রেনের মধ্যে।
--- কোন ট্রেনে?
--- ও মা, তাও মনে নেই? লালগোলা
প্যাসেঞ্জারে।
--- ওখানে আপনার ছেলে কী করছিল?
--- ও তো তোমাকে খুঁজতেই ট্রেনে উঠেছিল।
আমিকে খুঁজতে!
আমি লালগোলা প্যাসেঞ্জারে ছিলাম! ওখানে কী করছিলাম! ঝট ঝট করে মাথার মধ্যে পর পর
অনেকগুলো দৃশ্য সরে সরে গেল। ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল সেই ড্রাইভার। যে তাকে ভোররাতে
হোটেল থেকে স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল।
সে ঢুকতেই ওই
ভদ্রমহিলা বললেন, ওই তো রণো এসে গেছে।
ও মনে মনে বলল, ও, এরই নাম তা হলে
রণো! ফের উঠতে যাচ্ছিল দেবমাল্য, রণোই বলল, একদম না, একদম না, ডাক্তার আপনাকে রেস্ট নিতে বলেছেন।
--- ডাক্তার!
ভদ্রমহিলা বললেন, কয়েক জন মিলে
ধরাধরি করে তোমাকে খাটে শুইয়ে দেওয়ার পর, তোমার মুখে বারবার জলের ঝাপটা দিয়েও যখন তোমার
জ্ঞান ফিরল না, তখন ও ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছিল। সে-ই তো ইঞ্জেকশন দিয়ে গেল। ওষুধ লিখে
দিয়ে গেল। বলল, ভয়ের কিছু নেই। খানিক পরেই জ্ঞান ফিরে আসবে।
--- আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম! কোথায়?
রণো বলল, আপনি তো আমাকে
দাঁড়াতে বলে বউদিকে খোঁজার জন্য ঠেলেঠুলে ট্রেনে উঠে গেলেন। খানিকক্ষণ পরেই দেখি
দরজাটা ফাঁকা। ও দিকে সিগন্যাল হয়ে গেছে। এক্ষুনি ট্রেন ছেড়ে দেবে। অথচ আপনি
নামছেন না। আপনি না-হয় পুরুষ মানুষ, ট্রেন ছেড়ে দিলেও লাফ দিয়ে ঠিক নেমে পড়তে
পারবেন। কিন্তু বউদি? তার লাগেজ? যখন এ সব ভাবছি, ভাবছি কামরার ভেতরে ঢুকে একবার দেখব কি না।
কামরার গা ঘেঁষে হাঁটতে-হাঁটতে একটার পর একটা জানালায় উঁকি মেরে দেখছি, আপনি কোথায়!
হঠাৎ একটা জানালা দিয়ে দেখি, কামরার ভিতরে হইচই। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
এ তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া দিচ্ছে, তো সে বলছে, মির্গি হয়েছে বোধহয়। কারও কাছে চামড়ার চটি
আছে? ও বলছে, কেউ একটা চামচ
দিন না, দাঁত লেগে গেছে
মনে হচ্ছে। আর একজন তো বোতল থেকে হাতের তালু ভরে জল নিচ্ছে, আর তার মুখে
ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছে। আবার কেউ চিৎকার করে বলছে, কী করছে কী? সরে যান, সরে যান। ফাঁকা
করে দিন। একটু হাওয়া আসতে দিন। এই সব দেখেই আমার মনে হন, নিশ্চয়ই কারও কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কার? লোকটা যে কে, অত লোক তাকে ঘিরে
হিমড়ি খেয়ে পড়ায় তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। ছেলে না মেয়ে, তাও বোঝা যাচ্ছিল
না।
জানালার ধারে
যিনি বসেছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে দাদা? তিনি বললেন, একটা লোক অজ্ঞান হয়ে গেছে।
--- কে?
প্রশ্ন শুনে তিনি
যেন একটু বিরক্তই হলেন। বললেন, কী করে বলব? আমি কি চিনি? আমি বললাম, না না, তা বলছি না। বলছি, উনি কি প্যাসেঞ্জার?
বেশ ঝাঁঝের
সঙ্গেই তিনি বললেন, অত বলতে পারব না। দরকার হলে ভিতরে এসে দেখে
যান।
তার পর বিড়বিড়
করে বললেন। ট্রেনে প্যাসেঞ্জার উঠবে না তো কি ভূত উঠবে! যত্তসব---
আমি আর কথা বাড়়াইনি।
লাফ মেরে ট্রেনে উঠে, 'দেখি দেখি, সরুন', বলে একে ঠেলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনে
গিয়ে দেখি, আপনি নীচে পড়ে আছেন। মাথা-মুখ জামা-টামা ভিজে জবজব করছে। আপনার কোনও জ্ঞান
নেই।
আমাকে ও রকম করতে
দেখে ভিড়ের মধ্যে থেকেই কে যেন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি চেনেন নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ।
ট্রেন তখন নড়ে
উঠেছে। এই ছাড়ল বলে। একজন জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন? আমি বললাম কোথাও না। এখানেই নামব।
দু'-চার জন বলে উঠলেন, নামবেন তো বসে
আছেন কেন? ট্রেন ছেড়ে দিল
তো। সত্যিই তখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। কে যেন প্রথম বলল, চেন টানুন, চেন টানুন। তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন আরও অনেকেই।
কিন্তু কে যে চেন টানল, তাকে আমি আর দেখতে পেলাম না। ট্রেনেরই কয়েক জন
মিলে হাতে হাত লাগিয়ে আপনাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে শুইয়ে
দিল। মুহূর্তের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে গেল। ভিড়ে ভিড়াক্কা। এ এটা জানতে চায়, সে সেটা জানতে
চায়। ভিড় বাড়ছেই। সঙ্গে গাড়ি আছে শুনে, ওই লোকগুলোই ধরাধরি করে আপনাকে আমার গাড়িতে
তুলে দিল। আমি কিন্তু আর হোটেলে যাইনি। ওদের ওখানে কী ব্যবস্থা আছে, না-আছে আমি জানি
না। ওই হোটেলের আশেপাশে আদৌ কোনও ডাক্তার থাকে কি না তাও জানি না। বরং তেমন
বাড়াবাড়ি কিছু হলে আমার বাড়ির লাগোয়া যে নার্সিংহোম আছে, দরকার হলে
সেখানেই ভর্তি করে দিতে পারব। এটা ভেবেই আমি আপনাকে সোজা নিয়ে এসেছি আমার
বাড়িতে। ছোট্ট ঘর। অসুবিধে হবে জানি, তবুও...
লজ্জা পেয়ে গেল
দেবমাল্য। তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল, না না, এ সব কী বলছ? তুমি যে বুদ্ধি করে তখন ট্রেন থেকে আমাকে
নামিয়েছিলে, সেটাই তো অনেক... না হলে যে কী হত!
--- আপনি ট্রেনে উঠে বউদিকে দেখেনি, না?
--- বউদি!
--- আপনি তো বউদিকে খুঁজতেই ট্রেনে উঠেছিলেন...
শব্দ নয়, কেউ যেন লোহার রড
দিয়ে প্রচণ্ড জোেরে একটা বাড়ি মারল তার মাথায়। বিদ্যুৎ ঝসসে উঠল প্রতিটি
শিরা-উপশিরায়। ঝট করে বিছানায় উঠে বসল সে। রোগ নয়, শরীরকে কাবু করে মন। মন যখন চঞ্চল হয়, বেমালুম ভুলে
যায় শরীরের যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্রণার কথা। দেবমাল্যও ভুলে গেল। প্রথমেই জিজ্ঞেস
করল, তানিয়া কোথায়?
ফ্যালফ্যাল করে
তাকিয়ে রইল রণো। তানিয়া যে একটা মেয়ের নাম, সেটা সে জানে। কিন্তু ওই নামে কস্মিনকালেও সে
কাউকে চিনত না, এখনও চেনে না। তাই ফিসফিস করে সে-ই বরং উল্টো জানতে চাইল, তানিয়া কে?
--- আমার বউ।
আস্তে করে মাথা
নাড়িয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে সে বলল, আমি তো জানি না।
--- তার তো লালগোলা প্যাসেঞ্জারের আসার কথা ছিল। সামশের বলেছিল, চারটে নাগাদ
ট্রেন ঢুকবে। ঢোকেনি?
--- ঢুকেছিল। পঁয়তাল্লিশ মিনিটে লেটে।
--- লেট হোক। ঢুকেছিল তো? তা হলে ও কোথায় গেল!
--- তা তো আমি ঠিক...
--- চলো তো একবার স্টেশনে যাই। ক'টা বাজে এখন?
--- ক'টা হবে!
এগারোটা-সাড়ে এগারোটা।
--- সাড়ে এগারোটা? বাবা, এত বেলা হয়ে গেছে! তাও চালো। ও যদি ওই ট্রেনে
এসে থাকে আর এই স্টেশনে নেমে থাকে, তা হলে আমার জন্য ও স্টেশনেই অপেক্ষা করবে।
চলো...
--- আপনি বরং রেস্ট নিন, আমি দেখে আসছি।
--- তুমি ওকে চিনবে কী করে?
--- মাইকে অ্যানাউন্স করাব। লালগোলা প্যাসেঞ্জারে তানিয়া নামে যদি কেউ এসে থাকেন, তা হলে স্টেশন
মাস্টারের ঘরে এসে দেখা করুন। আমি স্টেশন মাস্টারের ঘরে অপেক্ষা করব। উনি এলেই
তাঁকে এখানে নিয়ে আসব। কোনও অসুবিধা হবে না।
--- না না, সেটা ঠিক হবে না। আমি যাব।
--- ডাক্তার বলে গেছেন আপনাকে রেস্ট নিতে। ওহোঃ, মা, ওনাকে কিছু খেতে দাও না... ডাক্তার বলেছেন কিছু
খেয়ে এই ট্যাবলেটটা খেয়ে নিতে। সঙ্গে একটা অ্যান্টাসিড।
--- ঠিক আছে, এসে খাবখ'ন। আগে তো স্টেশনে চলো।
এতক্ষন ওদের
সঙ্গে কথা শুনছিলেন রণোর মা। তিনি বললেন, বাবা, তোমার বউ যদি তোমার জন্য ছ'-সাত ঘণ্টা
স্টেশনে অপেক্ষা করে থাকতে পারে, তা হলে আরও পাঁচ-দশ মিনিটও পারবে। তুমি বরং
হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হও। ততক্ষণে আমি তোমাকে ক'পিস পাঁউরুটি সেঁকে দিই।
ও বুঝতে পারল, তার কথা কেউ
বুঝতে চাইছে না। সে জোর করে বেরিয়ে যেতেই পারে। কিন্তু যারা তার জন্য এতটা করেছে, তাদের সঙ্গে এ
রকম ব্যবহার করা কি ঠিক হবে! তাই উপায় না দেখে সে বলল, ঠিক আছে, করুন।
বড়
অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে করে দুধ আর একটা স্টিলের থালায় করে দশ -বারো পিস স্লাইজ
পাঁউরুটি দিয়ে গিয়েছিলেন রণোর মা। বেশ খিদে পেয়েছিল তার। সব ক'টাই দুধে চুবিয়ে-চুবিয়ে
খেয়ে নিল সে। এর আগে কোনও দিন সে এ ভাবে খায়নি। কী খাচ্ছে, বুঝতে পারছে না।
মুখে কোনও স্বাদ নেই। তেতো-তেতো লাগছে। কিছুই ভাল লাগছে না তার। মাথার মধ্যে শুধু
একটাই চিন্তা ঘুরঘুর করছে, ওকে স্টেশনে পাব তো!
একসঙ্গে দুটো
ওষুধ মুখে পুরে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিল সে। খাওয়ার পরে খেয়াল হল, এ মা, কী জল খেলে সে!
এটা তো মিনারেল ওয়াটার নয়! কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। রণোর সঙ্গে বেরিয়ে সোজা
গাড়িতে গিয়ে উঠল।
ও নিশ্চয়ই এখন
আর কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলছে না। কাল যত বার ডায়াল করেছে,
হয় শুনেছে নট রিচেবল, নয়তো দিস নাম্বার
ইজ বিজি। কোনও সুস্থ মানুষ এতক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলতে পারে!
এই তো কিছু দিন
আগে কোন কাগজে যেন পড়লাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা 'হু' নাকি বলেছে, মোবাইলে বেশিক্ষণ
কথা বললে ক্যানসার হতে পারে। ফোন এলেও, ব্যাটারি লো থাকলে সেই কল অ্যাটেন্ড করা উচিত
নয়। সকালে ওঠার জন্য মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখা খুব খারাপ। ফোনটা সরাসরি কানে
না ধরে হেডফোনে কথা বললে তাও খানিকটা রেহাই। আর রাত্রে মোবাইলের সুইচ অবশ্যই অফ
রাখা দরকার। আরও কী কী যেন সতর্ক করে দিয়েছিল। এখন আর মনে পড়ছে না। তবে ওর
স্পষ্ট মনে আছে, সেখানে লেখা ছিল, সারা দিনে ছ'মিনিটের বেশি মোবাইলে কথা বলা উচিত নয়। কিন্তু
কে শুনছে এ কথা!
বিকেল হলেই
প্রতিদিন মোবাইল নিয়ে বসে মায়ের সঙ্গে তানিয়ে যে রোজ এত কী কথা বলে দেবমাল্য
বুঝতে পারে না। না, বিলের টাকাটা তার পকেট থেকে দিতে হয় বলে নয়, মোবাইলে অতক্ষণ
কথা বললে যে ওর নিজেরই ক্ষতি, সেটা বোঝানোর জন্য শুধু মুখে নয়, ওই কাগজের
কাটিংটাও তানিয়াকে দিয়েছিল সে। কিন্তু তাতে যে কোনও কাজ হয়েছে, ওর মনে হয় না।
বাড়িতে ল্যান্ড
ফোন আছে। কত বার বলেছে, তোমার যতক্ষণ খুশি ওখান থেকে কথা বলো। কিন্তু
শুনলে তো! ল্যান্ড ফোন নিয়ে তো আর ঘরে পায়চারি করতে করতে কথা বলা যায় না। কিংবা
কেউ ঘরে ঢুকলে, তাদের মা-মেয়ের কথা যাতে সে শুনতে না পারে, ঝট করে ঝুল বারান্দায় কিংবা ছাদে চলে যাওয়া
যায় না, তাই ওই মোবাইল।
নাঃ, এ বার একটা
কর্ডলেস ফোন না-কিনলেই নয়, কত বার ও এ কথা ভেবেছে,
আর ওকে মোবাইল নিয়ে কথা
বলতে দেখলেই সেটা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ঠিক করেছে, কালকেই সামসেরকে বলবে একটা ভাল দেখে কর্ডলেস
ফোন নিয়ে আসতে। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোলেই যে ওর কী হয়! কিছুই মনে থাকে না। তাই
এত দিন হয়ে গেল, অথচ আজও একটা কর্ডলেস ফোন কেনা হয়ে উঠল না ওর।
সে না হোক, ও তো এখন আর
বাড়িতে নেই যে, কর্ডলেসে কথা বলতে হবে। ও যদি এসে থাকে, স্টেশনেই আছে। মোবাইল ছাড়া কথা বলা যাবে না।আর
ওর কাছে তো মোবাইল আছেই। এ হেঃ, এতক্ষণ এ কথাটা মনেই পড়েনি তার। তানিয়াকে
একটা ফোন করলেই তো হয়! ও পকেটে হাত ঢোকানোর আগেই রণো বলল,
এই যে এটা দেখছেন, এটা হচ্ছে
ইংরেজদের কবরখানা। আঠারোশো সাতাশি সালে তৈরি হয়েছিল। এখানে শুধু ইংরেজদেরই কবর
দেওয়া হত। স্মৃতি ফলকে এমন এমন লোকের নাম রয়েছে, দেখলে চমকে যাবেন।
--- এখানে? চোখ তুলে সামনে তাকাতেই চমকে উঠল দেবমাল্য। দেখল, একটা সাইকেল রিকশায় সামশের বসে আছে। সাইকেল রিকশাটা
সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল।
রণো দাঁড়িয়ে
আছে গলির মুখে। সিগন্যালে। সামনের গাড়ি-রাস্তা দিয়ে অনবরত গাড়ি যাতায়াত করছে।
এগুলো না থামলে ও বড় রাস্তায় উঠতে পারছে না। ডান দিক থেকে একের পর এক ট্রাক, ট্রেকার, ছোটহাতি আর
পাগোলের মতো গাড়ি আসছে তো আসছেই।
আর ধৈর্য্য সইছে
না। প্রতিটি সেকেন্ড যেন এক একটা দিন। ভেতরে-ভেতরে ভীষণ ছটফট করছে ও। কখন সিগন্যাল
সবুজ হবে। কখন? কখন? কখন? থাকতে না পেরে
দেবমাল্য বলল, একটু জোরে চালাও তো। সামনের একটা সাইকেল রিকশায় সামসেরকে দেখলাম মনে হল।
--- কে শামসের?
--- পরে বলব। পরে। আগে চলো। চলো, চলো, চলো... ওই যে সিগন্যাল খুলে গেছে। চলো, চলো, চলো... ডান
দিকে... ডান দিকে... হ্যাঁ হ্যাঁ... জোরে চালাও... জোরে... আরও একটু জোরে...
একে তাকে কাটিয়ে, অনেককে পিছনে
ফেলে রণোর গাড়ি হর্ন দিতে দিতে এগিয়ে চলল। দেবমাল্য সামনের সিটে রণোর পাশে বসে
আছে। ও অন্য কিছু দেখছে না। শুধু বাঁ দিকের সাইকেল রিকশাগুলোকে দেখছে। এই তো
দেখলাম, কোথায় গেল!
কোথায়! হঠাৎ দেখে, সামনে নয়, ওর গাড়ির লুকিং গ্লাসে সামসের। সঙ্গে সঙ্গে
পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে ও দেখে, সাইকেল রিকশায় সামসের একা নয়, সামশেরের পাশে
বসে আছে তার বউ--- তানিয়া।
ছয়
রণোই ব্যারাক
স্কোয়ারে নিয়ে গেল দেবমাল্যকে। ওখানেই বহরমপুর থানা। দেবমাল্যর মাথার ভেতরে তখন
হাজার রকমের চিন্তা-দুশ্চিন্তা কিলবিল করছে। তাই ফিরেও তাকাল না অত বড় মাঠটার
দিকে। এই মাঠেই এখন রমরম করে বইমেলা হয়। যাত্রা উৎসব হয়। ইংরেজ আমলে নাকি
সিপাইরা এখানে থাকত। নিয়ম ছিল কোনও ভারতীয় এই মাঠের উপর দিয়ে পালকি করে যেতে
পারবেন না। গেলেই ফাইন।
বিখ্যাত লেখক
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন এখানকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আশপাশে আরও অনেক
রাস্তা থাকলেও, শোনা যায়, তিনি নাকি প্রত্যেক দিন ইচ্ছে করেই এই মাঠের উপর দিয়ে পালকি করে যেতেন। আর
রোজই জরিমানা দিতেন। এটা ছিল ইংরেজদের প্রবর্তিত ওই আইনের প্রতি তাঁর প্রতিবাদ।
তাঁর চপেটাঘাত।
দেবমাল্যর মাথা
আর কাজ করছেন না। কী যে হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। তাই থানায় এসেছে সে।
জানাশোনা না থাকলে কোনও কাজ হয় না। তাই অপেক্ষা করছে, রণোর সঙ্গে আলাপ আছে যে পুলিশ অফিসারের, তাঁর জন্য। তিনি
নাকি রাউন্ডে বেরিয়েছেন। অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল, কখন ফিরবেন তিনি! উসখুস করতে লাগল ও। কাঁহাতক
আর চুপচাপ বসে থাকা যায়!
না, বেশিক্ষণ বসতে হল
না। মিনিট পনেরোর মধ্যে এসে পড়লেন তিনি। খুব মিশুকে লোক। তাঁর টেবিলের সামনের
চেয়ারে বসতে বললেন ওদের। তার পর রণোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
তা, হঠাৎ কী মনে করে, বলো?
দেবমাল্যকে
দেখিয়ে রণো বলল, ইনি আমার দাদার মতো। হাওড়ায় থাকেন। কালী বাজার না কী যেন বললেন? দেবমাল্যর দিকে
ঘুরে জিজ্ঞেস করতেই, দেবমাল্য বলল, না না, কালী বাজার না, কালীবাবুর বাজার।
রণো তখন বলতে
যাচ্ছিল, ওখানে ওর একটা
কারখানা আছে। কিন্তু তার আগেই পুলিশ অফিসারটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, চা খাবে তো?
রণো দেবমাল্যর
দিকে তাকাতেই, দেবমাল্য মাথা নাড়িয়ে 'না' জানিয়ে দিল। রণোও বলল,
না, থাক। এই একটু
আগেই খেয়েছি। হ্যাঁ। যা বলছিলাম... তা ওখানে নানা রকম সমস্যা হচ্ছে দেখে, উনি ওঁর
কারখানাটা অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে চান। তো, সেই কারখানা করার জন্যেই উনি এখানে জমি দেখতে
এসেছেন।
--- সে তো খুব ভাল কথা। তার পর?
--- কাল রাতে শিয়ালদা থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে উঠেছিলেন এনার বউ।
--- ও।
--- তা, আজ সকালে তার
বহরমপুরে নামার কথা। কিন্তু আমরা গিয়ে দেখি, উনি আসেননি।
--- উনি ওই ট্রেনেই উঠেছিলেন তো? পুলিশ অফিসারটি প্রশ্ন করতেই দেবমাল্য বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার কারখানারই
একটি ছেলে ওকে তুলে দিয়ে গেছে।
--- তুমি দিয়ে গেছে আপনাকে কে বলল?
--- ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও আমাকে ফোন করে বলেছে। তা ছাড়া রিজার্ভেশন লিস্টেও
ওর নাম রয়েছে। এস ফোর কামরার তেইশ নম্বর সিটে।
--- তার মানে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠেছে কিন্তু বরমপুর নামেনি, তাই তো?
--- হ্যাঁ।
--- তা হলে এটা তো এখানে কিছু হবে না। আপনাকে জি আর পি-তে যেতে হবে। বলেই, পণোর দিকে
তাকিয়ে বললেন, তুমি বরং ওনাকে বহরমপুর জি আর পি-তে নিয়ে যাও। এটা ওদের কেস।
--- না দাদা, এটার মধ্যে একটা প্রবলেম আছে।
--- আবার কী প্রবলেম?
--- একটু আগে উনি ওনার বউকে দেখেছেন।
--- দেখেছেন মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এই তো বললে উনি
আসেননি। তা হলে উনি ওনাকে দেখলেন কী করে?
আমতা আমতা করে
দেবমাল্য বলল, আমরা গাড়ি করে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা সাইকেল রিকশা করে ও
যাচ্ছে।
--- কখন?
--- ক'টা হবে তখন? রণোর দিকে তাকাল
দেবমাল্য। রণো বলল, এই ধরুন তল্লিশ-পঁতাল্লিশমিনিট আগে।
--- তোমরা তখন কোথায় ছিলে?
--- গাড়িতে।
--- না না, আমি তা বলছি না ।বলছি, কোন জায়গায় ছিলে? পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করতেই রণো বলল, ইংরেজদের
কারখানার সামনে।
--- উনি কোথায় ছিলেন?
--- ওখান থেকে যাচ্ছিলেন।
দেবমাল্যর দিকে
তাকিয়ে পুলিশ অফিসারটি বললেন, আপনি ডাকেননি?
--- কেন ডাকব না? ডেকেছিলাম। একবার দু'বার নয়, অনেক বার। আমার মনে হয় ও শুনতে পাইনি।
--- একটা ফোন করতে পারতেন তো। সঙ্গে মোবাইল ছিল না?
--- ছিল তো... ওটাই খুঁজতে গিয়ে দেখি, নেই।
--- ছিল। নেই। মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
--- আমার মনে হয়, সকালে যখন ট্রেনের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে
গিয়েছিলাম, তখন বোধহয় মোবাইলটা পড়ে গেছে বা কেউ তুলে নিয়েছে। অথবা... বুক বুক পকেটে ছিল
তো... বলেই, রণোর দিকে তাঁকাল ও। তোমাদের বিছানাতেও পড়ে থাকতে পারে।
রণো বলল, আপনাকে ট্রেন
থেকে নামানোর পর কিন্তু আপনার কাছে আমি কোনও মোবাইল দেখেনি।
পুলিশ অফিসারটি
বললেন, সে ঠিক আছে, মোবাইল হারাতেই
পারে। কিন্তু আপনাদের সঙ্গে তো গাড়ি ছিল। একটা সাইকেল রিকশাকে ধরতে পারলেন না?
রণো বলল, ধরেছিলাম তো...
ওনাকে জিজ্ঞেস করুন।
দেবমাল্য বলল, হ্যাঁ। ওই সাইকেল
রিকশাটা খুঁজতে খুঁজতে আমরা এগোছিলাম। হঠাৎ লুকিং গ্লাসে দেখি, আমাদের গাড়ির
পেছনে ও।
--- সাইকেল রিকশায়?
--- হ্যাঁ।
--- তার পর?
--- রণোকে বলতেই সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাকে সাইট করে ও দাঁড় করিয়ে দিল। নেমে পেছন
ফিরে দেখি, সব ভো ভা। ও তো নেই-ই। একটাও সাইকেল রিকশা নেই।
--- ওর গাড়ি দাঁড় করানো আর আপনার নামা--- এই সময়ের মধ্যে ওনার সাইকেল রিকশাটা
আপনাদের গাড়ির অন্য পাশ দিয়ে চলে যাইনি তো?
--- না।
--- এটা কী করে বলছেন?
--- কারণ ওই সাইকেল রিকশাটাকে পেছনে দেখতে না পেয়ে আমি শুধু সামনে নয়, আশেপাশে, এ দিকে ও দিকে, সব দিকেই খুব ভাল
করে দেখেছিলাম। কিন্তু দেখতে পাইনি।
--- তা হলে কি ডানা মেলে উড়ে গেল?
রণো বলল, আমি তো সেটাই
বলছি। তাও, একজন হলে না-হয় মনকে বুঝ দেওয়া যেত, কিন্তু একসঙ্গে দু'-দুটো মানুষ...
--- দুটো মানুষ মানে? সঙ্গে আর কেউ ছিল নাকি?
একটু ইতস্তত করে
দেবমাল্য বলল, হ্যাঁ।
--- কে?
--- সামসের।
--- সেটা আবার কে?
--- আমার কারখানারই একটা ছেলে।
--- বয়স কী রকম?
দেবমাল্য বলল, আমার চেয়ে কয়েক
বছরের ছোট হবে।
--- স্বভাব-চরিত্র কেমন?
--- খুব ভাল।
--- বিশ্বস্ত?
--- ভীষণ।
পুলিশ অফিসারটি
বললেন, কত দিন ধরে চেনেন?
--- খুব ছোটবেলা থেকেই। আমাদের পরিবারেরই একজন বলতে পারেন। কিন্তু আজকে ওকে এখানে
দেখে আমার কেমন যেন একটু সন্দেহ হচ্ছে...
--- কী রকম?
--- কারণ, আমার বউকে ট্রেনে
তুলে দিয়ে কাল রাতে ফোন করে ও-ই আমাকে বলেছিল, এইমাত্র ট্রেন ছেড়ে দিল। তার সঙ্গে পইপই করে
বলেছিল, চারটে নাগাদ
বহরমপুরে ট্রেন ঢুকবে। আমি যেন তার আগেই স্টেশনে পৌঁছে যাই।
--- এর মধ্যে আর একটা কাণ্ড ঘটেছে। মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটল রণো।
পুলিশ অফিসারটি
ভ্রু কোঁচকালেন--- কী?
--- আমরা যখন খুব ভোরে ওনার বউকে আনতে যাবার জন্য স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি ওনার
বউ একটা জিপে করে স্টেশনের দিক থেকে এসে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে
গেল।
--- সে কী! কখন?
--- চারটের আগেই। তখন বুঝি পৌনে চারটে-টারটে হবে।
--- তার মানে তখনও বহরমপুরে ট্রেন ঢোকেনি?
--- না। ট্রেন তো আজকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেটে ঢুকেছে।
আপনারা তখন কী
করলেন? দেবমাল্যর দিকে
তাকালেন পুলিশ অফিসারটি। দেবমাল্য বলল, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা ওই জিপটার পিছু
নিলাম।
--- তার পর?
--- অনেকটা ছুটে গেলাম। এক-দেড় মাইল তো হবেই।
--- তার পরে?
--- গিয়ে দেখি গাড়িটা নেই।
--- তার মানে!
--- আমরা তো সেটাই ভাবছি। আর তার চেয়েও বড় কথা কি জানেন,
আমি দৌলতাবাদে যে
হোটেলটায় উঠেছি, কাল রাতে সেখানে খুব গুলিগালা চলেছে।
--- দৌলতাবাদে তো? হ্যাঁ, খবর পেয়েছি। দু'জন অ্যারেস্টও হয়েছে। ও সব এখানে চলবে না। তার
পর?
--- তা, ব্যাপারটা কী, দেখার জন্য
জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি, পেছনের রাস্তাটা একেবারে সুনসান। একটা
কুকুর-বেড়ালও নেই। সেখানে একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে বোরখা পরা দু'জন ভদ্রমহিলা
দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের দৃষ্টি আমার জানালার দিকে।
--- সেটা আপনার মনের ভুলও হতে পারে। আর তারা যদি তাকিয়েও থেকে থাকে, তার সঙ্গে আপনার
বউ মিসিং হওয়ার সম্পর্ক কী?
--- ওই দু'জন তো আমার
বউয়ের সঙ্গে ছিল।
--- কখন?
--- সকালে। ওই জিপটার মধ্যে। ড্রাইভারের পেছনের সিটে ওরা বসেছিল। দু'পাশে দু'জন। আর ওদের
মধ্যিখানে আমার বউ।
--- আপনি তাদের চেনেন?
--- চিনব কী করে? দেখিইনি কোনও দিন।
পুলিশ অফিসারটি
জিজ্ঞেস করলেন, জিপটার নম্বর নিয়েছিলেন?
--- নম্বর নেব কী? এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটল, নম্বরটা টোকার
কথা মাথাতেই আসেনি। আসলেও ঢুকতে পারতাম কি না সন্দেহ আছে
--- কেন?
--- গাড়িটা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল যে...
--- ঝড়ের বেগে?
--- তা হলে আর বলছে কী?
--- আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?
--- পর্টিকুলারলি কাউকে... বলেই, পুলিশ অফিসারটির পিছনের জানালার দিকে
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল দেবমাল্য। সন্দেহজনক মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করতে
লাগল। এবং বিশেষ কাউকে চিহ্নিত করার আগেই, ফের আর একটা প্রশ্ন ছুড়ে ছিল সেই পুলিশ
অফিসারটি, আপনার কি কোনও
শত্রু আছে?
--- এমনিতে তো কোনও শত্রু নেই। তবে আমি যেখানে ব্যবসা করি,
হাওড়ার কালীবাবুর
বাজারের কাছে; সেখানে দুষ্কৃতীদের খুব দাপট। ওরা খুন, রাহাজানি, অপহরণ... সব করতে পারে। ওদের নামে লোকাল থানায়
ভুড়ি ভুড়ি কেস রয়েছে। আমার মনে হয় কি জানেন, আমার বউকে ওরাই বোধহয় কিডন্যাপ করেছে...
--- আপনার এটা মনে হচ্ছে কেন?
--- ওরা আমার কাছে পঁচিশ লাখ টাকা চেয়েছিল।
--- কেন?
--- আসলে ওখানে তো রোজই ঝুট-ঝামেলা লেগে থাকে। ভীষণ ডিস্টার্বিং এলাকা। আর যা-ই
করা যাক, ওখানে ব্যবসা করা
খুব মুশকিল। তাই ভাবছিলাম, কারখানাটাকে অন্য কোথাও সিফ্ট করব। সেই মতো
তোড়জোড়ও শুরু করেছিলাম। খুব সন্তর্পণে। ভেবেছিলাম, ওরা টেরও পাবে না। কিন্তু ওদের নেটওয়ার্ক যে
এত বড়, তা ঘুণাক্ষরেও
বুঝতে পারিনি। আমি কাজ শুরু করার আগেই কী করে যেন ওরা সেটা জানতে পেরে গিয়েছিল।
তাই কারখানায় এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল, আমি যদি কারখানাটা অন্য কোথাও তুলে নিয়ে যাই, তা হলে ওদের
পঁচিশ লাখ টাকা দিতে হবে।
--- কে বলেছিল ?
--- মাছ স্বপন।
--- আপনি থানায় জানাননি?
--- না।
--- কেন?
--- এমনিই।
--- হুম্। মাথা নাড়িয়ে 'হুম্' শব্দটা এমন ভাবে উচ্চারণ করলেন পুলিশ অফিসারটি, মনে হল, কেন ও পুলিশ
জানায়নি, সেটা উনি বুঝতে
পেরেছেন।তার পর টেবিলের ওপরে কাগজ চাপা দেওয়া বড় গোলাকার কাচের পেপারওয়েটাকে
ঘোরাতে ঘোরাতে একটু সময় নিয়ে উনি বললেন, এখন বলুন, আপনি আমার কাছে কী চান?
অতশত না ভেবেই
দেবমাল্য বলল, আমার বউকে।
ও সরাসরি এলে
হয়তো উনি এত কথা মন দিয়ে শুনতেনই না। আর এ ধরণের উত্তর শুনলে যে কী বলতেন, তা উনি নিজেও
জানেন না। কিন্তু ও এসেছে রণোর সঙ্গে। রণোকে উনি খুব ভাল করে চেনেন। খুব পরোপকারি
ছেলে। তাই তেমন কিছু বলতে পারলেন না। মুখে হাসি ফুটিয়ে শুধু বললেন, আপনার বউ যদি
আমার কাছে থাকত, তা হলে আপনাকে বলতে হত না। আপনি বলার আগেই আমি আপনার বউকে দিয়ে দিতাম।
এত টেনশনের মধ্য
কথা ক'টা যেন এক ঝলক
নির্মল বাতাস বয়ে আনল। তাতে একটু ভরসা পেয়ে দেবমাল্য বলল,
দেখুল না, আপনারা তো পুলিশে
আছেন, সব পারেন। আমার
বউকে যত তাড়াতাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় একটু চেষ্টা করে দেখুন না...
গলার স্বর
একেবারে পাল্টে সহানুভূতির সঙ্গে পুলিশ অফিসারটি বললেন, আপনি এ ভাবে বলছেন কেন?
এটা তো আমাদের ডিউটি।
আপনি একটা কাজ করুন, ও ঘরে গিয়ে প্রথমে বউয়ের নামে একটা মিসিং
ডায়েরি করুন।
--- কী বলব?
--- যা ঘটেছে, তাই বলবেন।
--- না, মানে... ঠিক কী
লিখলে...
--- আগে খুব ঠান্ডা মাথায় সেটা ঠিক করুন, কী বলবেন। ট্রেন থেকে বউ উধাও হয়ে গেছে, নাকি অপহরণ
হয়েছে। নাকি, কী যেন নাম ছেলেটার?
--- কোন ছেলেটা?
--- যে আপনার বউকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল।
--- সামশের?
--- তার সঙ্গেই তো আপনার বউকে আপনি শেষ বার দেখেছেন এখানে?
সাইকেল রিকশায়? কী, তাই তো?
পুলিশ অফিসারটি
কী ইঙ্গিত করছে বুঝতে না পেরে বোকার মতো ও মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
এই উত্তরটা শোনার
জন্যই যেন ঠোঁটের ডগায় অপেক্ষা করছিল শব্দ ক'টা। সেটাই পুলিশ অফিসারটির মুখ দিয়ে বেরিয়ে
এল, দেখুন তার সঙ্গে
পালিয়ে গেছে কি না...
কথা ক'থা শেষ হওয়ার
আগেই ঝট করে পুলিশ অফিসারটির দিকে চোখ তুলে তাকাল দেবমাল্য। কানের ভিতরে শব্দ নয়, যেন এক দলা গরম
সিসা ঢেলে দিল কেউ। তার চোখ দুটি আগুনের গোলা হয়ে উঠল। যে কোনও সময় বিস্ফোরণ
ঘটতে পারে। পাশের চেয়ারেই বসে ছিল রণো। সে বুঝতে পেরে ওর হাত চেপে ধরল।
সাত
কলিংবেল টিপতেই
যে ভদ্রমহিলা কোলাপসিবল দরজার তালা খোলার জন্য ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন, রণোকে দেখেই তিনি
বললেন, কি গো, এত দিন পর? কী মনে করে?
দেবমাল্যকে
দেখিয়ে রণো বলল, উনি একটু সমস্যায় পড়েছেন, তাই দাদার কাছে নিয়ে এলাম। দাদা আছেন তো?
--- হ্যাঁ, এই তো স্নানে ঢুকল।
--- এত বেলায়?
--- কোথায় কী ছিল যেন... খুব সকালে বেরিয়েছিল। এই তো এল। এসো...
বসার ঘরে ঢুকতেই
বাঁ হাতে পর পর দুটো কম্পিউটার দেখে দেবমাল্য একটু অবাকই হল। সাধারণত যে কোনও
বাড়িতে একটাই কম্পিউটার থাকে। দুটো থাকলে আলাদা আলাদা ঘরে থাকে। কিন্তু এ বাড়িতে
সাইবার কাফের মতো পর পর দুটো।
ডান দিকে একটা
খাটের উপরে মামুলি চাদর পাতা। নীচে কোনও তোষক-টোষক নেই। পাতলা কাঁথা আছে বলেও মনে
হল না। ও দিকে দুটো বালিশ। তার মানে এরা ও দিকে মাথা দিয়েই শোয়।
খাটে বসে রণো বলল, নতুন আর একটা
কিনলেন নাকি?
--- হ্যাঁ আগেরটা তো তুমি জানোই। তোমার দাদার অফিস থেকে দিয়েছিল। ওটা এখন
সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকে। আমি কোনও কাজ করতে পারি না। তাই এটা কিনলাম। তা, কী হয়েছে, বলো?
--- ওঃ হো, দেবমাল্যদা, ইনি হচ্ছেন রূপা বউদি। রাজীবদার ওয়াইফ। আসলে কি হয়েছে জানেন বউদি, ইনি একটা
সমস্যায় পড়েছেন...
রণোর কথা শেষ
হওয়ার আগেই ভিতর থেকে একটি বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে এ ঘরে ঢুকলেন সুবিধের বউ।
রাজীবের দাদা সুবীর। সংবাদ প্রতিদিনের বহরমপুরের প্রতিনিধি। দু'ভাই একই বাড়িতে
থাকে। সুবীররা ওপরে। রাজীবরা নীচে। দু'জনের আলাদা আলাদা এন্ট্রান্স থাকলেও ভেতরে
দিকের দরজা দিয়ে যাতায়াত করা যায়। বড় জা-কে দেখেই রূপা বলল, খেয়েছে?
উনি বললেন, সহজে খায়? যা একটা বিচ্ছু
তৈরি করেছ না... গান শুনিয়ে শুনিয়ে খাওয়াতে হয়। না হলেই গালে টোবলা করে ভাত
রেখে দেয়। কিছুতেই গেলে না।
--- তাও তো তোমার কাছে খায়। আমার কাছে তো সেটুকুও না।
--- নাও নাও, ধরো, তোমার মেয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছে। ও দিকে আমার আবার অনেক কাজ পড়ে আছে। বলেই, বাচ্চাটিকে রূপার
কোলে দিয়ে উনি ভিতরে চলে গেলেন।
এতক্ষণ বোধহয়
খেয়াল করেনি। এখন বুঝতে পেরেই রণো বলল, ও মা, পাখি তো বড় হয়ে গেছে।
--- বড় হবে না? চিরকাল ছোটই থাকবে নাকি?
রূপার দিকে তাকাল
দেবমাল্য। বলল, ওর নাম পাখি?
উনি বললেন, আমরা ওকে পাখি
বলে ডাকি। ওর ভাল নাম পর্ণভী।
--- পর্ণভী?
দেবমাল্যকে তাঁর
মেয়ের নাম ফের উচ্চারণ করতে দেখে রূপা বললেন, হ্যাঁ, পর্ণভী মানেও পাখি।
--- ভারী সুন্দর নাম তো!
--- ওর বাবা দিয়েছেন। ওর বাবা বলেন, পাখির চেয়ে সুন্দর প্রাণী নাকি পৃথিবীতে আর
একটিও নেই। একেবারে মুক্ত। স্বাধীন। কী সুন্দর ডানা মেলে এক দেশ থেকে আর এক দেশে
উড়ে যায়। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। পাসপোর্টও লাগে না। আসলে ওর বাবা কবি তো...
--- কবি! ও যে বলল, স্টার আনন্দে কাজ করে।
--- হ্যাঁ, করে তো... ওটা তো ওর চাকরি। আর কবিতাটা হচ্ছে ওর প্যাশন। ভালবাসা। এই তো কয়েক
দিন আগে দিল্লিতে ওর একটা ইংরেজি কবিতার বই বেরোল। প্রণব মুখার্জি উদ্বোধন করলেন।
--- কোন প্রণব মুখার্জি? অর্থমন্ত্রী?
--- হ্যাঁ।
এমন সময় টাওয়াল
দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের একটি ছেলে ঘরে ঢুকল। দেবমাল্য
বুঝতে পারল, এই-ই রাজীব। রাজীব ঘোষ।
থানার পুলিশ
অফিসারটি ওই কথা বলায় প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিল ও। রণো তখন তার হাত চেপে ইশারা না
করলে ও হয়তো তার মুখের ওপরেই যা তা বলে দিত। কে তাকে অধিকার দিয়েছে, তার বউ সম্পর্কে
ও রকম আজেবাজে কথা বলার? পুলিশে চাকরি দেওয়ার আগে প্রত্যেককে ট্রেনিং
দেওয়া উচিত কার সঙ্গে কী ভাবে কথা বলতে হয়। পুলিশে চাকরি করে বলে কি মাথা কিনে
নিয়েছে নাকি? দরকার নেই আমার এ রকম পুলিশের। হনহন করে থানা থেকে বেরিয়ে এসেছিল দেবমাল্য।
পিছু পিছু রণোও।
রণোই তাকে বলেছিল
রাজীবের কথা। স্টার আনন্দে কাজ করে। প্রচুর লোকের সঙ্গে জানাশোনা আছে। প্রায়
প্রতিদিনই বিকেলের দিকে একেবারে নিয়ম করে এস পি-র ঘরে আড্ডা মারতে যায়। ওই থানার
বড়বাবুর সঙ্গেও খুব খাতির। ও যদি একবার বলে দেয়...
দেবমাল্য জিজ্ঞেস
করেছিল, কোথায় থাকে?
--- এই তো কাছেই। বাবুলবোনা রোডে। আমাদের বাড়ির কয়েকটা বাড়ির পরেই। ভেতর দিয়ে
হেঁটে গেলে দশ মিনিটও লাগবে না।
--- তাই? তা হলে চলো।
'চলো' বলেছিল ঠিকই, কিন্তু মনের
মধ্যে খিচখিচ করছিল একটা সংশয়। সে-ও এই পুলিশ অফিসারটির মতো খারাপ ব্যবহার করবে
না তো! মাথা মুছতে মুছতে রাজীবকে ঘরে ঢুকতে দেখেই তার সেই সংশয় মুহূর্তের মধ্যে
উঠে গেল।
কাউকে কাউকে দেখে
ওর এ রকম হয়। চেহারা দেখেই বুঝতে পারে লোকটা কেমন। একবার একটা বারো-তেরো বছরের
ছেলেকে থামের সঙ্গে বেঁধে কালীবাবুর বাজারের ফলপট্টির লোকেরা খুব মারছিল। টাল
দিয়ে রাখা কাঁঠাল থেকে সে নাকি একটা কাঁঠাল চুরি করে পালাচ্ছিল। কে নাকি হাতেনাতে
ধরেছে।
ও তখন সবেমাত্র
কারখানায় ঢুকেছে। কারখানার পাশেই ফলপট্টি। খবর পেয়ে ও গিয়ে দেখে, মার খেয়ে খেয়ে
ছেলেটা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। থামের সঙ্গে মোটা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা না থাকলে
মাটিতে লুটিয়ে পড়ত। তখনও কেউ কেউ চড়চাপড় মারছে। চুলের মুঠি ধরে টানছে। ছেলেটিকে
দেখে ওর মনে হয়েছিল, ছেলেটি আর যা-ই হোক, চোর নয়।
ওখান থেকে সরে
এসে, খানিকটা দূরে
গিয়ে নিজের নাম গোপন করে থানায় ফোন করেছিল ও। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ
এসে ছেলেটিকে উদ্ধার না করলে যে কী হত, কে জানে! পরে জানা গিয়েছিল, ছেলেটি ভদ্রঘরের
ছেলে। ওদের বাড়িতে অনেকগুলো খরগোশ আছে। তারা আমার কলমিশাক ছাড়া কিছু খেতে চায়
না। অথচ ঝুড়িতে আর একটাও কলমিশাক নেই। তা হলে ওরা কী খাবে! তাই স্কুল থেকে এসেই
জামাপ্যান্ট ছেড়ে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ও কলমিশাক আনার জন্য বাজারে
গিয়েছিল। বাড়ির কাছেই বাজার।
কলমিশাক পাওয়া
যায় আনাজপট্টিতে। ফলপট্টির ভেতর দিয়ে ও আনাজপট্টির দিকে যাচ্ছিল। বাঁ দিকে কোথাও
একটার ওপর একটা সার সার দাঁড় করানো আপেলের পেটি। কোথাও ভুর করা পাহাড়-প্রমাণ
কলার কাঁদি। কোথাও আবার টাল দিয়ে রাখা কাঁঠাল। তার থেকেই বোধহয় একটা কাঁঠাল
গড়িয়ে এসেছে যাতায়াতের পথে। ও তাই সেটা তুলে টাল দিয়ে রাখা কাঁঠালগুলোর মধ্যে
রাখতে যাচ্ছিল, আর সেটা দেখেই কে যেন ভেবেছিল, এ-ই বুঝি সে, যে মাঝে মাঝেই তাদের ফলপট্টি থেকে এর কলার
কাঁদি, তার আপেলের পেটি, ওর কাঁঠাল চুরি
করে পালায়। তাই চোর চোর বলে চিৎকার করে জাপটে ধরেছিল ওকে। ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই
জড়ো হয়ে গিয়েছিল ফলপট্টির অন্যান্য দোকানিরা। শেষবেলায় বাজার করতে আসা লোকেরা।
তারাই ওকে থামিয়ে সঙ্গে বেঁধে উত্তম-মধ্যম দেওয়া শুরু করেছিল। তাদের দেখাদেখি
খবর পেয়ে আশপাশ থেকে ছুটে আসা অন্য লোকেরাও।
আরও একবার এ রকম
হয়েছিল। বাস থেকে টেনে নামিয়ে যাত্রীরা যাকে পকেটমার বলে বেধড়ক মারছিল, তাকে দেখে ওর মনে
হয়েছিল, এ রকম লোক কখনওই
পকেটমার হতে পারে না। সন্দেহ হয়েছিল, যার মারছিল তাদের দেখেও। তাদের কাউকেই ওর
স্বাভাবিক যাত্রী বলে মনে হয়নি। বরং যারা ভিড় করে দেখছিল, নানা মন্ত্যব্য
ছুড়ে দিচ্ছিল, কেউ বলছিল, ওকে পুলিশে দিন। কেউ বলছিল, বাচ্চা ছেলে ছেড়ে দিন। তাদেরকেই ওর অনেক বেশি
ওই পাশের যাত্রী বলে মনে হচ্ছিল।
বাসটা স্টার্ট
দিতেই হইহই করে উঠে পড়েছিল অনেকে। যারা ছিল, বাসটা চলে যাওয়ার পরে তারাও অনেক ফাঁকা হয়ে
গিয়েছিল। তার পরও যে দু'-চার জন লোক ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল, ও চায়ের দোকান
থেকে মগে করে জল নিয়ে সেখানে গিয়ে, ঠোঁট-নাক-টাক ফেটে যাওয়া, রক্তাক্ত এই
ছেলেটাকে জল নিতে গিয়ে জেনেছিল, এরই পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিয়েছে ওরা। ও
টের পেয়ে চিৎকার করে উঠতেই, পকেটমারের গোটা দলটাই এককাট্টা হয়ে ওকেই
পকেটমার-পকেটমার বলে বাস থেকে টেনে নামিয়ে মারতে শুরু করে। ওদের দেখাদেখি বাসের
অন্যান্য যাত্রীরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওকে কোনও কথা বলতেই দেয়নি ওরা।
ও মানুষ দেখলেই
চিনতে পারে। শুধু চিনতে পারেনি সামসেরকে। নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভালবাসত ওকে। কত
বিশ্বাস করত। আর সে কিনা... ও আর ভাবতেই পারছে না। এখন মনে হচ্ছে, মানুষকে বিশ্বাস
করাই ভুুল।
কম্পিউটারের
সামনের চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে রণোর দিকে তাকিয়ে রাজীব বলল, বলো, কেমন আছ?
রূপা জানে, তাঁর স্বামী
একবার গল্প নিয়ে বসলে সহজে উঠবে না। তাই ওদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল রূপা। রাজীবকে
বলল, এ কী? যাও। চুল-টুল
আঁচড়ে একেবারে এসে বসো। তুমিও চা খাবে তো?
রাজীব বলল, দাও...
দেবমাল্যর কাছ
থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল রাজীব। বলল,
আপনার কথার মধ্যে কোনও
সামঞ্জস্য পাচ্ছি না। আপনার বউকে কাল রাতে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে তুলে দিয়েছে
একজন। আর সকালে তার বহরমপুর পৌঁছনোর কথা। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, তিনি পৌঁছননি। এই
পর্যন্ত ঠিক আছে। এটা মিসিং কেস। তার পরেই আবার বলছেন, বহরমপুরে ট্রেন ঢোকার অনেক আগেই আপনি আপনার
বউকে দু'জন বোরখা পরা
ভদ্রমহিলার সঙ্গে একটা জিপে করে স্টেশনের দিক থেকে শহরে ঢুকতে দেখেছেন। এটা আর
একটা ঘটনা। এরই পাশাপাশি বলছেন, বউকে খুঁজতে একটু বেলার দিকে আবার যখন স্টেশনের
দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে দেখেছেন একটা সাইকেল রিকশা করে যেতে। তার সঙ্গে কে? না, যে কাল রাতে আপনার
বউকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল, অথচ নিজে ট্রেনে ওঠেনি,
সে। এই তিনটে বিচ্ছিন্ন
ঘটনাকে আমি কিছুতেই একটা সূত্রে বাঁধতে পারছি না। আরও অবাক লাগছে, উনি যদি সত্যিই
বহরমপুরে এসে থাকেন, তা হলে তো আপনাকে খুঁজবেন। আপনাকে ফোন করবেন।
অথচ আপনি বলছেন, জিপে করে উনি যখন আসছিলেন, গাড়ির জানালা থেকে অর্ধেক শরীর বের করে আপনি
তাকে হাত নেড়েছেন। 'এই, আমি এ দিকে, এ দিকে। দাঁড়াও দাঁড়াও', বলে চিৎকারও
করেছেন। তবুও তিনি পাথরের মতো চুপচাপ বসেছিলেন। পরে আবার যখন তাকে ওই ছেলেটার
সঙ্গে সাইকেল রিকশা করে যেতে দেখেছেন, তখনও তাকে বারবার ডেকেছেন। তিনি শুনতে পাননি।
আপনি কোন হোটেলে উঠেছেন, সেটা ভুলে গিয়ে উনি যদি আপনাকেই খুঁজতে সাইকেল
রিকশা নিয়ে শহরে বেরিয়ে থাকেন, তা হলে তো উনি বারবার এ দিকে ও দিকে মাথা
ঘুরিয়ে আপনাকেই খুঁজবেন। কান খাড়া রাখবেন। তাই না? আমি কি ভুল বলছি, বলুন? হতে পারে, প্রথম একটা-দুটো ডাক গাড়ি-টারির আওয়াজে উনি
না-ই শুনতে পারেন, কিন্তু অত বারের একটা ডাকও কি তার কানে গিয়ে
পৌঁছবে না? এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। তার পর আপনি বলছেন, ওনার ফোন
দীর্ঘক্ষণ নট রিচেবল ছিল। আমি তো কলকাতায় গেলে লালগোলা প্যাসেঞ্জারেই ফিরি। কোথায়, আমার তো কখনও এ
রকম কিছু ঘটেনি। তার পরে আপনি যা বলছেন, যত বার ফোন
করেছেন, তারা ফোন নাকি তত
বারই বিজি ছিল। কতক্ষণ? আচ্ছা, আপনার বউয়ের নাম্বারটা দিন তো, আমি একবার ফোন
করে দেখি...
--- নম্বর?
দেবমাল্যকে
অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখে রাজীব বলল, কেন, কোনও অসুবিধা আছে নাকি?
--- না, আসলে হয়েছে কি, আমার মোবাইলটা
আজকে হারিয়ে গেছে। ওর নম্বরটা তো আমার মোবাইলে সেভ করা ছিল। ওখান থেকেই ফোন
করতাম। ফলে ওর নম্বরটা লিখে রাখা বা মনে রাখার কথা আমার কখনও মাথাতেই আসেনি। আর সে
জন্য তো ওকে ফোনও করতে পারছি না।
--- আপনার বাড়ির নম্বর?
--- সেটা তো ডেড হয়ে পড়ে আছে। স্থানীয় গুন্ডারা বারবার হুমকি দিচ্ছিল দেখে
রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছিলাম। কবে যে ওটা ডেট হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। যখন টের
পেলাম, তখন সময়ের অভাবে
কমপ্লেনও করা হয়নি। সামশেরকে বলেছিলাম কি না তাও মনে নেই। বললেও, ও কমপ্লেন করার
সময় পেয়েছে কি না, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এত দূরে অফিসটা... ফলে
ওটায় পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।
--- যে ছেলেটা আপনার বউকে তুলে দিতে এসেছিল, তার নম্বর?
--- বললাম না, মোবাইলটা হারিয়ে গেছে। সব নম্বর তো ওটাতেই ছিল।
--- কারখানার নাম্বার মনে আছে?
--- হ্যাঁ, তা আছে।
--- বলুন।
দেবমাল্য নম্বরটা
বলতেই কম্পিউটারের কি-বোর্ডের ড্রয়ারটা টেনে নিজের মোবাইলটা বার করে টপাটপ বোতাম
টিপল রাজীব--- হ্যালো... বলেই, দেবমাল্যর দিকে তাকাল সে। বলল, ওই ছেলেটার নাম
যেন কী?
কার কথা জিজ্ঞেস
করছে বুঝতে না পারে দেবমাল্য বলল, কোন ছেলেটা?
--- যে আপনার বউকে কাল ট্রেনে তুলে দিয়েছিল...
--- ও, ওর নাম সামশের।
নামটা শুনেই
ফোনের ও প্রান্তের লোকটাকে রাজীব বলল, সামশের আছে নাকি?
লোকটা বলল, নেই। 'নেই' শুনেই দেবমাল্যর
দিকে তাকিয়ে ইশারা করল রাজীব। যেন বলতে চাইল, হিসেব মিলে গেছে। দুয়ে গুয়ে চার। তার মানে
সামশের এখন আপনার বউয়ের সঙ্গেই আছে। তার পর রিসিভারে মুখ রেখে জিজ্ঞেস করল, কাল ওর বউদিকে
ট্রেনে তুলে দিয়েও আর ফেরেনি, না?
ও প্রান্ত থেকে
ভেসে এল, কেন ফিরবে না? আপনি কে বলছেন?
রাজীব বলল, আপনি আমাকে
চিনবেন না। আমার নাম রাজীব ঘোষ। আমি দেবমাল্যর বন্ধু। --- ও, আপনি ছোটবাবুর
বন্ধু? কিন্তু ছোটবাবু
তো এখানে নেই। দৌলতাবাদের গেছেন।
--- জানি। উনি আমার সামনেই বসে আছেন।
--- তা হলে ছোটবাবুর কাছ থেরে সামসেরের নাম্বারটা নিয়ে ওকে মোবাইলে ফোন করে নিন
না... না হলে ঘণ্টাখানেক পরে করুন।
--- ঘণ্টাখানেক পরে মানে? ও কি ওখানে নাকি?
--- হ্যাঁ, এই তো বেরোল।
--- কোথায় গেছে?
--- তাগাদায়। দশ মিনিট আগে করলেও পেয়ে যেতেন
আরও কী কী বলতে
যাচ্ছিল লোকটা, কিন্তু আর কথা বাড়াল না রাজীব। লাইনটা কেটে দিয়ে দেবমাল্যর দিকে তাকাল।
একটুক্ষণ কী চিন্তা করে বলল, আপনি বোধহয় ভুল দেখেছেন। কারণ, আপনার বউয়ের
সঙ্গে আপনি যাকে সাইকেল রিকশায় করে যেতে দেখেছেন বলছেন, সে তো ওখানে। এত কম সময়ের মধ্যে তার পক্ষে
নিশ্চয়ই বহরমপুর থেকে হাওড়ায় যাওয়া সম্ভব নয়। কী বলেন?
রাজীবের কথা শুনে
একদম থ' হয়ে গেল
দেবমাল্য। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে
আট
রণোর গাড়ি দু'দিন আগেই বুক করে
রেখেছিল ওদের পাড়ার শীলভদ্রবাবু। সপরিবার কার পৈতেয় নাকি যাবে। বেলা তিনটের সময়
রিপোর্টিং। ভোরবেলায় স্টেশন থেকে কাউকে আনতে গিয়ে যে, সে এমন একটা কাণ্ডে জড়িয়ে যাবে, এত বেলা হয়ে
যাবে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে
পারিনি ও।
এক্ষুনি বাড়ি
গিয়ে স্নান করে কোনও রকমে নাকে-মুখে দুটোগুঁজে বেরোতে না পারলে তিনটের মধ্যে ও
কিছুতেই শীলভদ্রবাবুর বাড়িতে পৌঁছতে পারবে না। অথচ দেবমাল্যকে রাজীবদা বলছে কিনা, এমন তো হতেই পারে, ভিড়ের জন্য আপনি
হয়তো খেয়াল করতে পারেননি, আপনার বউ ট্রেন থেকে নেমে; আপনি যে হোটেলে
উঠেছেন, সোজা ওই হোটেলে
চলে গেছেন। একবার গিয়ে দেখুন না, তাঁকে ওখানে পান কি না।
উনি তো উঠেছেন
দৌলতাবাদের একটা হোটেলে। এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। এখানে যেতে গেলে রণোর আর
বাড়ি যাওয়া হবে না। রান্না না করে, না খেয়ে, সে একটা দিন কাটিয়ে দিতেই পারে, কিন্তু সে না
খাওয়া অবধি যে তার মা একটা দানাও দাঁতে কাটবে না! কী করা যায়! কী করা যায়! কী
করা যায়!
দেবমাল্যর সঙ্গে
সকাল থেকে এতক্ষণ কাটিয়ে রণো বুঝে গেছে, এই লোকটা বাস, ট্রেকার বা অটোয় করে যাওয়ার লোক নয়। তা
ছাড়া, সেই সকাল থেকে
তার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে, তার মনের এখন যা অবস্থা, ও কিছুতেই তাকে
একা ছাড়তে ভরসা পাচ্ছে না। তবু, কী করা যাবে! কোনও উপায় তো নেই। তাই রাজীবের
বাড়ি থেকে দেবমাল্যকে নিয়ে বেরিয়ে ও আর গাড়ির দিকে গেল না। পায়ে পায়ে মেন
রাস্তায় উঠে এল। এ দিকে ও দিকে তাকাতে লাগল। রণোকে ও রকম করতে দেখে দেবমাল্য বলল, কাউকে খুঁজে না
কি?
রণো লল, না, ঠিক খুঁজছি না...
--- তা হলে চলো একবার হোটেলটা দেখে আসি।
--- তার ব্যবস্থাই তো করছি।
দেবমাল্য অবাক
হয়ে লল, গাড়ি তো ওখানে।
--- আসলে, আমি যেতে পারলেই
ভাল হত। কিন্তু আগে থেকে ভাড়া ঠিক হয়ে আছে তো! তাই... চিন্তা করবেন না। আমি
আপনাকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
এ পারে ও পারে
ইতস্তত দু'-তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। রণো গিয়ে তাদের সঙ্গে কী কথা বলল, দেবমাল্য বুঝতে পারল না। রণো হতাশ হয়ে ফিরে
এল। বারবার উসখুশ করতে লাগল। ভীষণ দেরি হয়ে যাচ্ছে তার।
সেটা বুঝতে পেরে
দেবমাল্য বলল, তোমার যদি ভাড়া থেকে থাকে, তুমি চলে যাও। আমি একটা গাড়ি ঠিক ধরে নেব।
রণো বলল, না না, উল্টোপাল্টা
গাড়ি ধরলে হবে না। নতুন লোক দেখলে একেবারে ঘাড়ে চেপে বসবে। একটু দাঁড়ান না, আমি আপনাকে
ব্যবস্থা করে দিচ্ছি...
কথা শেষ হওয়ার
আগেই একটা সাদা অ্যাম্বাসাডার তাদের সামনে এসে ব্রেক কষে দাঁড়াল। দরজা থেকে মুখ
বের করে চালক বলল, কী রে, খালি নাকি?
রণো বলল, না রে বুক আছে।
কোথায় যাচ্ছিস?
সে বলল, যাব আর কোথায়? এই তো বেরোলাম।
--- যাবি?
--- কোথায়?
--- দৌলতাবাদ।
রাণোর পাশে
ধোপদুরস্ত পোশাক পরা দেবমাল্যকে এক ঝলক দেখেই সে বুঝতে পারল, তার বন্ধু এই
লোকটার জন্যই গাড়ি নিতে এসেছে। তাই বলল, আপ-ডাউন লাগবে।
এখানকার
গাড়িগুলো সাধারণত সকাল থেকেই বুক হয়ে যায়। যারা নেয়, তারা বেশির ভাগই ঘুরতে যায় মুর্শিদাবাদে।
দর্শন করে একের পর এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়।
অ্যাম্বাসাডর, টাটা সুমো, স্করপিয়--- গাড়ি
অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ভাড়া। এ সি হলে তার ভাড়া আরও বেশি। ভাড়া যাই হোক না কেন, প্রতি কিলোমিটার
যা ভাড়া, ঘণ্টা পিছু ধার্য
হয় তার দশ গুণ। গাড়ি ছাড়ার সময় দেখা হয় কত কিলোমিটার চলেছে এবং কতক্ষণ সময়
লেগেছে, হিসেব কষে যেটা
বেশি হয়, যাত্রীকে সেটাই
দিতে হয়। কিন্তু দূরে কোথাও কাউকে শুধু পৌঁছে দিতে হলে, এরা যাতায়াতের ভাড়া একসঙ্গে দাবি করে। এ-ও
তাই করল।
রণো বলল, আপ-ডাউন নিবি কী
রে? শুধু পৌঁছে দিলে
হবে না। উনি একটু প্রবলেমে পড়েছেন। উনি যেখানে যেখানে যেতে চাইবেন, সেখানে সেখানে
নিয়ে যাবি। যতক্ষণ থাকতে বলবে, থাকবি।
--- তুই যে বললি দৌলতাবাদ যাবে।
--- হ্যাঁ, এখন দৌলতাবাদ যাবেন। উনি যে হোটেলে উঠেছেন, সেখানে। তার পর উনি কোথায় যাবেন, আদৌ যাবেন কি না, সেটা ওখানে গিয়ে
ঠিক করবেন।
চালক বলল, রেট বলে দিয়েছিস
তো?
--- টাকার জন্য তোকে ভাবতে হবে না। আমি তো আছি, নাকি? বলেই, দেবমাল্যর দিকে তাকিয়ে বলল, উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন।
দরজা খুলে
দেবমাল্য উঠতেই চালক বলল, আমি কিন্তু মুর্শিদাবাদ নার্সিংহোমের সামনে
একটু দাঁড়াব। একজনকে ওষুধ পৌঁছে দিতে হবে।
রণো বলল, সে দাঁড়া না...
তুই তো ও দিক দিয়েই যাবি। ওষুধ পৌঁছে দিতে আর কতক্ষণ লাগবে? তুই তো আর আড্ডা
মারতে যাচ্ছিস না, যা যা...
ওরা যখন কথা বলছে, দেবমাল্যর হঠাৎ
মনে পড়ল, রণোর টাকা তো
দেওয়া হয়নি! তাই পেছন পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতে করতে রণোকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কত দেব?
রণো বলল, আমি কাল সকালে
আপনার ওখানে যাচ্ছি। তখন নেব।
--- সে ঠিক আছে। কিন্তু এখন তো কিছু রাখো।
--- না না, এখন দিতে হবে না।
--- তা হয় না, রাখো তো... বলেই, মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে
প্রায় জোর করেই রণোর হাতের মধ্যে গুঁজে দিল দেবমাল্য। রণো বলল, কাল সকালে দেখা
হচ্ছে তা হলে... দেবমাল্য বলল, ঠিক আছে, ও কে।
গাড়ি ছেড়ে দিল।
যেতে যেতে দেবমাল্য নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, এই রে, একটা ভুল হয়ে গেল। রাজীব বাবু যখন কারখানায়
ফোন করেছিল, যে ধরেছিল, তার কাছ থেকেই তো সামসেরের মোবাইল নম্বরটা নিয়ে নেওয়া যেত। তা হলে যে কোনও
বুথ থেকে ওকে ফোন করে বলে দেওয়া যেত, এখানে চলে আসার জন্য। যার ওপরে অনায়াসে এতটা
ভরসা করা যায়, তার সম্পর্কেই কিনা সে এতক্ষণ এই সব ভাবছিল, ছি ছি ছিঃ... ওকে একটা ফোন করতে পারলে হত। ও
পাশে থাকলে অনেক জোর পাওয়া যায়। পড়াশোনা তেমন না জানলে কী হবে, ওর প্রচুর
বুদ্ধি।
বুদ্ধি করে তখন
যদি ওর নম্বরটা ও নিয়ে নিত! অবশ্য তাতে কোনও অসুবিধে নেই। কারখানার ফোন নম্বর ওর
কণ্ঠস্থ। হোটেলে গিয়ে যদি তানিয়াকে না পায়, তা হলে কারখানায় ফোন করে, সামশেরকে পেলে
ভাল, না পেলেও যে
থাকবে, তাকেই বলে দেবে
সামশের আসামাত্রই যেন দৌলতাবাদে চলে আসে, ব্যস। দ্বিতীয় বার আর বলার দরকার হবে না। যে
ভাবে হোক ও ঠিক চলে আসবে।
কিন্তু ভাবতে
গিয়েও ওর অবাক লাগছে, যে সামশের এখন হাওড়ার গোলাবাড়ি থানার কালী
বাবুর বাজারের কাছে, তার কারখানায়, স্টেশনে যেতে গিয়ে এই এত দূরে, বহরমপুরে তাকে সে
সাইকেল রিকশার মধ্যে দেঋল কী করে! না, সে ভুল দেখেনি। সে যাকে দেখেছিল, সে সামশেরই। এত
বড় ভুল তার হওয়ার কথা নয়। কারণ, ওই একই রিকশায় সামশেরের পাশে বসে ছিল তার বউ
তানিয়া।
ও কিছুই বুঝে
উঠতে পারছে না। বুঝতে পারছে না, গত কাল রাতে তানিয়াকে যে ট্রেনে তুলে দিয়ে
গিয়েছিল সামশের, সেই ট্রেন স্টেশনে আসার আগেই, একটা কালো জিপে করে তার সামনে দিয়ে তানিয়া
হুস করে বেরিয়ে গেল কী করে! ও কি উড়ে এসেছে!
না, এটাও সে ভুল
দেখেনি। ওটা তানিয়াই ছিল। আর গত কাল রাত্রে হোটেলের ঘরে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখার
সময় পর পর গুলির শব্দ শুনে, জানালা দিয়ে ও
যাদের ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল, দেখেছিল তার জানালার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে, সে-ই বোরখা পরা
দু'জন মহিলাই বা
তানিয়ার জিপে এল কী করে! কী করে যোগাযোগ হল ওর সঙ্গে! কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না
সে। সে যত দূরে জানে, এখানকার কাউকেই তানিয়া চেনে না। জানে না। তা
হলে!
যত ভাবছি, ততই তার ভাবনা
তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মেলাতে পারছে না। গাড়ির একদম সামনে চালকের পাশে
বসে আছে সে। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে সে একেবারে চমকে উঠল। এই গাড়িটা এখানে এল কী করে!
এটা তো তার বাবার গাড়ি। হ্যাঁ, ওই তো ডাবলিউ বি জিরো ফোর... হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই তো তার
বাবার গাড়ি। কিন্তু...
নাঃ, তার মাথাটা
বোধহয় এক্কেবারে গেছে। তাই ভুলভাল দেখছে সে। তাই চালককে সে আর গাড়ি দাঁড় করাতে
বলল না। অথচ গাড়ির গতি কমিয়ে ওই গাড়িটার সামনেই তাদের গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে
দিল চালক। দেবমাল্য বলল, কী হল?
চালক বলল, এক মিনিট। একটু
আসছি। তখন বললাম না... এই নার্সিংহোমে আমাদের একজন ভর্তি আছে। তাকে একটা ওষুধ
পৌঁছে দিতে হবে। যাব আর আসব। বলেই, স্টিয়ারিংয়ের সামনে রাখা একটা সাদা রঙের
পলিপ্যাক নিয়ে সে নেমে গেল। যাবার সময় জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফের বলল, এক্ষুনি আসছি।
দেবমাল্য বলল, ঠিক আছে।
চালকটি হনহন করে
চলে যেতেই দেবমাল্য জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, বাঁ হাতেই একটা বড় বাড়ি। তার ওপরে একটা বিশাল
সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা--- মুর্শিদাবাদ নার্সিংহোম। তার নীচে লেখা---
বানজেটিয়া, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। দেবমাল্য মাথা নাড়ল, তার মানে এই জায়গাটার নাম--- বানজেটিয়া।
চালকটি বলে গেল
এক মিনিট, কিন্তু অনেকক্ষণ
তো হয়ে গেল! কখন আসবে কে জানে! রণো হলে নিশ্চয়ই এ রকম করত না। ও বেশ সিনসিয়ার। না
হলে তার কী দায় পড়েছিল, হতে পারে ও তার একজন সওয়ার। কিন্তু ও তো তার
নিজের কেউ না। দীর্ঘ দিনের পরিচিতও না। তবু একজন অচেনা অজানা লোক তার বউকে খুঁজতে
গিয়ে ট্রেনের কামরার মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল দেখে, তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল ও।
কী হল রে বাবা!
বড্ড দেরি করছে তো ছেলেটা! রাজীব বাবুর কথা মতো ও দিকে তার বউ যদি হোটেলে গিয়ে
থাকে, আর ওখানে গিয়ে
যদি তাকে না পায়, তা হলে যে সে কী করবে,
কে জানে! মোবাইলে হয়তো
ফোন করবে। কিন্তু তার মোবাইলটা তো... ধ্যাত, আর ভাল্ লাগছে না। কেন যে এখানে মরতে এসেছিলাম!
নাঃ, গাড়ির ভেতর বেশ
গরম লাগছে। ভাবামাত্র গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল সে। আর গাড়ি থেকে নামতেই সামনে
তাকিয়ে দেখে, তার বাবার গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে তাদের গাড়িটার ও পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।
গাড়ি চালাচ্ছে হারুদা। তাদের বাড়ির পুরনো ড্রাইভার। হারুদার পাশে সামসের। আর তার
পাশে জানালার দিকে তার বাবা। পিছনের সিটে বোরখা পরা ওই দুই মহিলা। আর তাদের
মাঝখানে তানিয়া।
ও চিৎকার করে
কিছু বলতে যাবার আগেই গাড়িটা বেরিয়ে গেল। এ কী! এতগুলো লোক! তাকে কেউ দেখতে পেল
না! অবাক কাণ্ড। থ' হয়ে দাঁড়িয়ে পরল সে। আর তখনই দেখল, একটি শববাহী
গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। গাড়িটির ড্রাইভারের পাশে ঠেসেঠুসে অত্যন্ত কষ্ট করে
বসে আছে, তার কারখানার তিন
জন কর্মী। ওর হঠাৎ মনে হল, ওর বাবার গাড়ির পিছু পিছু যাবে বলেই বুঝি এই
শববাহী গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছে। ও দৌড়ে গাড়িটার সামনে চলে গেল। দু'হাত তুলে বলতে
লাগল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, দাড়াও...
নয়
রিসেপশন থেকে
চাবি নিতে গিয়ে দেবমাল্য শুনল, তার বউ এসেছে। অনেকক্ষণ আগেই চাবি নিয়ে উপরে
কাছে। শোনেই তার শরীরে যেন শক্তি বেড়ে গেল। একটা নয়, একসঙ্গে দুটো-তিনটে করে সিঁড়ি টপকে টপকে
দোতালায় উঠে গেল ও। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলল তানিয়া। দেবমাল্যকে দেখামাত্র যেন
তুবড়িতে আগুন পড়ল। ছিটকে বেরোতে লাগল এতক্ষণ ধরে জমা একরাশ অভিমান--- কোথায়
ছিলে?স্টেশন থেকে
আমাকে আনতে যাবার কথা ছিল না তোমার? ফোনটাকেও অফ করে রেখে দিয়েছ। কোনও যোগাযোগ
করতে পারছি না। সামশেরকে ফোন করলাম, সেও বলল, তোমাকে নাকি পাচ্ছে না। তুমি কি জানো না, এর আগে আমি কখনও
এখানে আসিনি? এখানকার কাউকেই আমি চিনি না। তাও কোনও রকমে হোটেলে এলাম। এসে শুনি, তুমি ভোরবেলায়
বেরিয়ে গেছ। কোথায় গিয়েছিলে?
দেবমাল্য কিছু
বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তানিয়া এমন ভাবে ঝাঁঝি মেরে উঠল, ও চুপ করে গেল। তানিয়ার এই রূপ এর আগে ও কখনও
দেখেনি। আঙুল তুলে তানিয়া বলল, একটি কথাও বলবে না। একদম চুপ। তুমি যা করেছ, অত্যন্ত খারাপ
করেছ। সেই সকাল থেকে টেনশনে টেনশনে... তুমি জানো, একা একটা মেয়েমানুষ আসছি। কত রকমের বিপদে
পড়তে পারি। তুমি জানো কী হয়েছিল?
--- কী হয়েছিল?
--- এতক্ষণ যখন আমার কথা মনে পড়েনি, আর শুনতে হবে না।
--- আমি তো স্টেশনেই গিয়েছিলাম।
গলা চড়াল
তানিয়া। তুমি স্টেশনে ছিলে? এতক্ষণ?
--- তোমাকে না পেয়ে থানা-পুলিশ-প্রেস, একটার পর একটা জায়গায় গেছি, জানো?
--- তুমি স্টেশনের কোথায় ছিলে?
আমতা আমতা করে
দেবমাল্য বলল, তোমার যে কোচে করে আসার কথা ছিল, আমি তো সেই এস ফোরের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।
--- তা হলে ট্রেন থেকে নেমে তোমাকে দেখলাম না কেন?
--- তুমি কখন নেমেছ?
একটু দমে গেল
তানিয়া। বলল, আমি তো ঠিক সময়েই নামতাম। তা ভাবলাম, হোটেলটা কত দূরে, ট্রেন থেকে নেমে কতটা পথ যেতে হবে, কে জানে! একটু
ফ্রেশ হয়ে নিই। আর সেটাই হল কাল।
--- কেন? কী হয়েছিল?
--- টয়লেটে গিয়ে দেখি ছিটকিনি তো নেই-ই, লকের মতো যেটা থাকে, ঘুরিয়ে দরজা় আটকায়,
সেটাও নেই। কিন্তু দরজা
খোলা রেখে তো আর টয়লেটে যাওয়া যায় না। আর অন্য টয়লেটে যে যাব, তারও উপায় নেই।
প্রত্যেকটা টয়লেটের সামনেই তিন-চার জন করে দাঁড়িয়ে। সেখানে গিয়ে লাইন দিলে আমার
আর টয়লেটে যাওয়া হবে না। কী করি! দরজা ভেজিয়ে রেখে তো আর যাওয়া যায় না। হাজার
রকমের লোক ঘোরাঘুরি করে। এ দিকে তার একটু আগেই আমি দাঁত ব্রাশ করেছিলাম। হাতে ছিল
দাঁত মাজার সেই ব্রাশটা। আমি ওটাই খাঁচের মধ্যে ঠেসে, গায়ে যত জোর ছিল, পুরো জোর লাগিয়ে দরজাটা আটকে দিয়েছিলাম।
দরজাটা তো আটকেছিল। কিন্তু খুলতে গিয়ে দেখি, কিছুতেই খুলছে না। একদম চেপে বসে আছে। কতক্ষণ
দরজা ধাক্কালাম, টানা-হ্যাঁচড়া করলাম, কোনও লাভ হল না। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ট্রেনটা
দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার মানে বহরমপুরে এসে গেছে। আমাকে এক্ষুনি নামতে হবে। যত রকম
ভাবে পারা যায় আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু কিছুতেই ব্রাশটাকে টেনে বের করতে পারলাম
না। কী করা যায়! যখন ভাবছি, দেখি ট্রেনটা দুলে উঠেছে। আন্দাজ করলাম, ট্রেনটা ছেড়ে
দিচ্ছে। আমি জানতাম, তুমি স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছ। আমাকে না
দেখলে চিন্তা করবে। তাই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তোমাকে ফোন করলাম।
--- তুমি আমাকে ফোন করেছিলে?
--- হ্যাঁ। কিন্তু যত বারই ফোন করলাম, শুনতে পেলাম, দিস নম্বর ইজ নট একজিস্ট।
অবাক হয়ে গেল
দেবমাল্য। সে কী! তার পর?
--- তার পরেই দেখি বাইরে থেকে কে যেন দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা মারছে। আর ও দিক
থেকে ধাক্কা মারতেই খাঁচ থেকে কী করে যেন দাঁত মাজার ব্রাশটা পড়ে গেল। দরজা থেকে
বেরিয়েই দেখি, ট্রেনটা চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে। ও দিকের দরজার কাছে একটা লোক নাকি
অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ধরাধরি করে সবাই তাকে নামাচ্ছে।
--- ওটা তো আমি ছিলাম।
--- তুমি? কেন? কী হয়েছিল?
--- সে অনেক কথা। পরে বলছি, তার পর কী করলে বলো।
--- আমি তো ট্রেন থেকে নেমে চার দিকে তাকাতে লাগলাম। তোমাকে দেখতে না পেয়ে আবার
ফোন করলাম। তখনও শুনতে পেলাম ওই একই কথা। দিস নম্বর ইজ নট একজিস্ট।
--- বুঝেছি। তার মানে ফোনটা কেউ পেয়ে ততক্ষণে
সিম কার্ডটাকে খুলে ফেলে দিয়েছিল।
--- মানে?
--- আমার ফোনটা হারিয়ে গেছে তো! সে একটা পরে কিনে নেবখ'ন। আগে তোমারটা বলো, তার পর?
দেবমাল্যকে
উদ্বিঘ্ন হতে দেখে তানিয়া বলল, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম? ও হ্যাঁ, তখন কোনও উপায় না দেখে আমি ফোন করলাম
সামশেরকে। ওই-ই বলল, তুমি কোন হোটেলে উঠেছে এবং কী ভাবে যেতে হবে।
দেবমাল্য জিজ্ঞেস
করল, লাগেজগুলো কী
করলে?
--- কীসের লাগেজ?
--- কীসের আবার? তুমি যেগুলো এনেছ।
--- আমি তো কোনও লাগেজ আনিনি।
--- সে কী!
তানিয়া বলল, তুমি পছন্দ করো
না বলে আমি একটা স্যুটকেসও আনিনি। দুটো শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ হাত-ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি।
--- ও।
--- স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি সামনে সার সার অটো-ট্রেকার দাঁড়িয়ে আছে। ও দিকে দু'-তিনটে গাড়ি। যখন
ভাবছি, কীসে করে
দৌলতাবাদ যাব। তখন হঠাৎ দেখি, আমি যে সিটে বসেছিলাম,
তার বাঁ দিকে ছ'টা সিটের যে খোপ
ছিল, তাতে দু'জন ভদ্রমহিলা বসে
ছিলেন। তাঁরা একটা জিপে উঠছেন। আমাকে ও ভাবে এ দিকে ও দিকে তাকাতে দেখে ওঁরা
জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন? আমি বললাম, দৌলতাবাদ। ওঁরা বললেন,
আমরাও তো ওখানে যাচ্ছি, চলে আসুন।
--- বোরখা পরা? ওরা কারা?
--- নাম তো জানি না। তবে আসতে আসতে শুনলাম, ওঁরা নাকি এখানে একটা মিশনারি চালান। ছোট
বাচ্চাদের জন্য একটা অনাথ আশ্রমও করেছেন। যেখানে চিকিৎসার তেমন কোনও সুযোগ-সুবিধে
নেই, সেই সব গ্রামে
মেডিকেল টিম নিয়ে যান। মানে স্বেচ্ছাসেবী কর্মী আর কী... এই রে, দেখেছ, একদম ভুলে গেছি।
--- কী?
--- ওরা যাওয়ার সময় বললেন, নিচ থেকে হাত দেখাবেন...
--- কখন?
--- এই তো ওঁরা বেরোলেন।
দেবমাল্য অবাক
হয়ে বলল, ওঁরা এখানে
এসেছিলেন?
--- হ্যাঁ, ওঁরা না বললে কি রিসেপশন থেকে আমাকে এই ঘরের চাবি দিত নাকি?
--- কেন? আমি তো কালকেই
ওদের বলে রেখেছিলাম আমার স্ত্রী আসবে।
--- বলেছিলে। সেটা এখানে এসে আমি শুনেছি। কিন্তু তুমি তো ছিলে না। আমিই যে তোমার
স্ত্রী ওরা সেটা জানবে কী করে?
--- তাই? ওঁরা বলতেই দিয়ে
দিল?
তানিয়া বলল, হ্যাঁ, ওঁদের সবাই চেনে
তো।
--- এই হোটেলের লোকগুলোও?
--- শুধু হোটেলের লোকগুলোই নয়। আশপাশের সবাই। এমনকী, এই হোটেলের উল্টো দিকে যে চায়ের দোকানটা আছে, তারা পর্যন্ত।
ওঁরা জিপ থেকে নামতেই, দিদি দিদি করে সবাইকে ছেঁকে ধরল।
বিস্মিত হয়ে গেল
দেবমাল্য। মুখ থেকে শুধু অস্ফুটে বেরিয়ে এল, তাই?
--- তা হলে আর বলছি কী? এই রে, দেখেছ! সত্যি, তোমার জন্য না...
--- কেন কী হল?
--- কী আর হবে? বললাম না, ওঁরা নিচ থেকে হাত নাড়াবেন বলে গেলেন।
--- তা হলে যাও। আমি কি তোমাকে আটকে রেখেছি?
গলার স্বর নামিয়ে
তানিয়া বলল, তুমিও এসো।
--- আমি আবার কেন?
--- ওঁরা তা হলে বুঝতে পারবেন তুমি এসে গেছ।
--- ঠিক আছে, চলো।
--- চলো নয়, এ দিকে এসো। বলেই, ঘরের পিছন দিকে যে জানালা, সে দিকে গিয়ে
ভারী ভারী পর্দাগুলো দু'দিকে ঠেলে সরিয়ে ইস্পাতের ফ্রেমে বাঁধানো
কাচের পাল্লা দুটো বাইরের দিকে তানিয়া ছেলে দিতেই দেবমাল্য যেন ভূত দেখল। দেখল, দুরে, সরু রাস্তার ওপরে
একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দু'জন জোব্বা, না না, জোব্বা নয়, বোরখা পরা মহিলা তাদের ঘরের এই জানালার দিকে হা
করে তাকিয়ে আছেন। তাঁদের ক'হাত পিছনে একটা জিপ।
দৃশ্যটা দেখে ও
শিহরিত হয়ে গেল। চোখের সামনে সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। হুবহু এই
দৃশ্যটাই তো গত কাল রাতে জানালা থেকে ও দেখেছিল। তবে জিপটাকে তখন খেয়াল করেনি।
তবু এটা কী করে হয়! ও যখন এ সব নিয়ে ভাবছে, তানিয়া বলল, কী গো, হাত নাড়াও।
দেখছ না, ওঁরা টা টা করছেন।
ও হাত নাড়াতেই
মনে হল, কারা যেন ধুমধাপ
করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তানিয়ে দরজা খুলেই, কথার এমন এক-একটা অগ্নিবান পড়ছিল যে, তানিয়া তো নয়ই, আত্মরক্ষা করার
জন্য সে কী বলবে, সেই শব্দ হাতড়াতে হাতড়াতে ঘরে ঢুকে দরজাটা পা দিয়ে পিছন দিকে ঠেলে দিয়েছিল
ঠিকই, কিন্তু ছিটকিনি
দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল দেবমাল্য।
দরজাটা খোলা
পেয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল তিন-চারটে ছেলে। তাদের একজনকে দেবমাল্য চিনতে
পারল। সে দিন তার কারখানার মাছ স্বপনের সঙ্গে যারা এসেছিল,
তাদের মধ্যে ছিল এই
ছেলেটি। এর কথা বিশেষ করে মনে আছে এই জন্যই যে, এই ছেলেটাই একটা মোবাইল নিয়ে মাছ স্বপ্নের
পেছনে দাঁড়িয়ে কী সব খুটখাট করছিল। মাছ স্বপনের কথায় ও মোবাইলটা অন করার কয়েক মুহূর্ত
পরেই এই ছেলেটিই বলেছিল, আপনার ফোন তো অফ করা। যাবার সময় এই-ই বলে
গিয়েছিল, ল্যান্ড ফোনটাও
ঠিক করে রাখুন। বাড়ির ফোনটাতেও ফোন করলে যেন পাই।
তারা ঢুকে কোনও
কথা বলল না। বাকিরা দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইল। যাতে ওরা দৌড়ে পালাতে না পারে। শুধু
এই ছেলেটা দু'পা এগিয়ে এসে, যেন রুমাল বের করছে, এমন ভঙ্গিমায় পকেট থেকে একটা ছ'ঘড়া বের করে ওর
দিকে তাক করল কি করল না, টিগার টিপে দিল।
তানিয়া কিছু
বুঝে ওঠার আগেই দেবমাল্য এক ধাক্কা মেরে তাকে ও দিকে ঠেলে মুহূর্তের মধ্যে নিজেও
সরে গেল জানালার সামনে থেকে। আবার গুলি। গুলিটা কোথায় লাগল কে জানে! দেবমাল্য
মাটিতে পড়ে গেল।
একটা নয়, দুটো নয়, পর পর বেশ
কয়েকটা গুলির শব্দ শুনতে পেল দেবমাল্য। কাল রাতে যেমন শুনেছিল, ঠিক তেমন। চোখের
সামনেটা ঝাপসা হয়ে গেল। তার পরেই সব অন্ধকার। তারই মধ্যে খুব ক্ষীণ ভাবে ও শুনতে
পেল, তার বউয়ের কান বিদীর্ণ
করা আর্তনাদ। তার পর আর কিছু মনে নেই।
মৃদু ঝাঁকানিতে
আচ্ছন্নের মধ্যে ও শুনতে পেল, খুব কাছাকাছি জোরে কোথাও সাইরেন বাজছে। কিন্তু
কোথায়! কার কী হয়েছে! কোনও রকমে চোখ মেলে দেখল, অন্য কেউ নয়, সে নিজেই শুয়ে আছে একটা আম্বুলান্সের ভেতরে।
নাকে অক্সিজেনের মাক্স লাগানো। মাথার কাছে সাদা ধবধবে পোশাক পরা একজন বসে আছেন।
সম্ভবত নার্স। তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! কী হয়েছে তার! তানিয়া কোথায়! এ রকম
হাজার প্রশ্ন তার মাথার মধ্যে কিলবিল করতে লাগল। কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দও বেরোল
না। যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে।
পায়ের দিকে
তাকাতেই চোখে পরল অ্যাম্বুলেন্সের পেছনের দরজায় বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে কাচ
লাগানো। সেটা দিয়ে বাইরের সব কিছু দেখা যায়। সে দিকে তাকাতেই ও আকাশ থেকে পড়ল।
এটা কী দেখছে ও! কী!
সে দিন ভোরবেলায়
রণোর গাড়ি করে তানিয়াকে বহরমপুর স্টেশন থেকে আনতে যাওয়ার সময় তো সে এটাই
দেখেছিল! এই তো সেই জিপ। জিপটা চালাচ্ছেন একজন শিখ। মাথায় পাগড়ি বাঁধা। পেছনের
সিটে দু'পাশে দু'জন বোরখা পরা
মহিলা। মুখের ঢাকনাটা কপালের উপর দিয়ে মাথার পেছনে ফেলা। তাদের মাঝখানে বসে আছে
তানিয়া। দেখে মনে হচ্ছে, বড় কোনও একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তাই প্রচুর
কান্নাকাটি করেছে সে। প্রবল ঝড়ে পড়ে যেন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কোনও দিকে তাকাচ্ছে
না। যেন শোকে পাথর হয়ে গেছে।
শুয়ে শুয়েই
দেবমাল্য বুঝতে পারল, তার অ্যাম্বুলেন্সটা তারস্বরে সাইরেন বাজাতে
বাজাতে রুদ্ধশ্বাসে সামনের দিকে ছুটে চলেছে।
এর পরই খবর
ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। দৌলতাবাদের একটা হোটেলে পর পর বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি
চলেছে। দুষ্কৃতীরা সংখ্যায় ক'জন ছিল, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কী উদ্দেশ্যে মেরেছে তাও
পরিষ্কার নয়। ব্যবসায়িক কারণ, রাজনৈতিক কোন্দল, নাকি পারিবারিক বিরোধ,
নাকি এটা ত্রিকোণ প্রেমের
বলি? কারা মেরেছে, তা নিয়ে উচ্চ
পর্যায়ে তদন্ত শুরু করেছে।
সমস্ত নিউজ
চ্যানেল ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে। সাংবাদিকরা বারবার ফোন করছেন দৌলতাবাদ থানায়। কেউ
কেউ সরাসরি ফোন করছেন এস পি ভরতলাল মিনাকে। তিনি ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন, পুরো ব্যাপারটা
খতিয়ে দেখে রিপোর্ট পেশ করতে।
শুধু
থানা-পুলিশের বিবৃতির ওপর ভরসা না করে কলকাতা টিভির সঞ্জয় বিশ্বাস, দৈনিক
স্টেটসম্যানের কুশলকুমার বাগচী, এন ই বাংলার বিনোদ পটেল, সংবাদ প্রতিদিনের
সুবীর ঘোষেরা রওনা হয়ে গেছেন ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে।
আজ দুপুরেই যার
সঙ্গে কথা হয়েছে, যার কথার ছত্রে ছত্রে ছিল অসংলগ্নতা, য়ার একটা কথার
সঙ্গে অন্য কথার কোনও যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না সে, সে-ই ভদ্রলোকই এই ভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছে!
শোনামাত্র ক্যামেরাম্যানকে খবর দিয়ে শুধু সংবাদের জন্য নয়, একদিনের জন্য
হলেও, যখন আলাপ হয়েছিল, সেই মানবিক
কারণেই স্টার আনন্দের রাজীব ঘোষ বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল দৌলতাবাদের দিকে।
কিন্তু বহরমপুর
থেকে বিরোতে না-বেরোতেই বানজেটিয়ার কাছে এসে একেবারে বাগরুদ্ধ হয়ে গেল সে। দেখল, হুবহু সেই ছবি।
যেটা দেবমাল্য তাকে বলেছিল। কিন্তু মেলাতে না পেরে সে ভেবেছিল, লোকটা ভুলভাল
বকছে। একদম সেই ছবি। জিপটা চালাচ্ছে একজন শিখ ভদ্রলোক। মাথায় পাগড়ি বাঁধা।
পেছনের সিটে বোরখা পরা দু'জন ভদ্রমহিলা। মাঝখানে অল্পবয়সী একটা বউ। তার
মানে বিধ্বস্ত এই মহিলাই দেবমাল্যর স্ত্রী। কিন্তু এই দৃশ্যটা অত আগে দেবমাল্য
দেখলেন কী করে! রাজীব দাঁড়িয়ে পড়ল।
দশ
কারখানায় ফিরেই
সামশের খবর পেয়েছিল বহরমপুর থেকে দেবমাল্যর বন্ধু ফোন করেছিল। নিজে ফোন না করে
বন্ধুকে দিয়ে করিয়েছে! তার মানে নিশ্চয়ই কোনও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। তার ওপরে
সকাল থেকে যত বার তার মোবাইলে ফোন করেছে ও, শুনেছে সেই একই কথা--- দিস নম্বর ইজ নট
একজিস্ট।
ও সঙ্গে সঙ্গে
ফোন করেছিল বউদিকে। কিন্তু ফোনটা যে ধরেছিল তার গলা শুনেই ও বুঝতে পেরেছিল, বউদি নয়, অন্য কেউ ধরেছে।
তাই বলেছিল, বউদি কোথায়?
এর পর ও প্রান্ত
থেকে যে শব্দগুলো ভেসে এসেছিল, তার জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না ও। হাউমাউ করে
কেঁদে উঠেছিল। তার কাছ থেকেই কারখানার বাকি কর্মচারীরা শুনেছিল, তাদের ছোটবাবুর
গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা।
সঙ্গে সঙ্গে
কারখানার কাজ তারা বন্ধ করে দিয়েছিল। বড়বাবুকে এক্ষুনি এ খবর দিতে হবে। কিন্তু
কে দেবে! এ খবর ফোনে দেওয়া ঠিক হবে না। আর সামশের এই সংবাদ পেয়ে এতটাই ভেঙে
পড়েছে যে, উঠে দাঁড়াবার মতো শক্তি নেই তার। তাই কারখানার দু'জনকে গেল বড়বাবুর কাছে।
না, তাঁর ছেলে যে
গুলিবিদ্ধ হয়েছে, এ কথা তারা বলেনি। বলেছিল, ছোটবাবু বহরমপুরে
হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওখানকারই একটা নার্সিংহোমে ওকে ভর্তি করা হয়েছে।
ওরা বলেছে, ভয়ের কিছু নেই। তবু, বউদি একা আছেন তো... যদি সামলাতে না পারেন।
আমাদের এক্ষুনি যাওয়া দরকার।
ছেলের অসুস্থতার
কথা শুনে বড়বাবু তখনই ঠিক করলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বহরমপুরে যাবেন। কিন্তু এই সময়ে ওখানে যাওয়ার
কোনএ ট্রেন নেই। ট্রেনে গেলে অনেক কম সময়ে পৌঁছনো যেত। আর বাসে যাওয়ার অভ্যাস
নেই তাঁর। দু'হাত দূর দূর স্টপেজ দিতে দিতে যায়। বড় বিরক্তি লাগে। তাই তক্ষুনি খবর পাঠানো
হল হরিকে।
হরি তাদের বাড়ির
বহু পুরনো ড্রাইভার। কাছেই থাকে। কী একটা কাজে যেন বড়বাবু হাওড়া ময়দানের কাছে
গিয়েছিলেন। একটু আগে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে সে বাড়িতে খেতে গেছে। যাবার সময়
বড়বাবু তাকে বলে গিয়েছিলেন, আজ আর বেরোব না। কাল বেলা এগারোটা নাগাদ এলেই
হবে।
তবু, বাবুর তলব পেয়েই
সে ছুটে এসেছিল। শুনেছিল, কারখানার জন্য জমি দেখতে গিয়ে ছোটবাবু অসুস্থ
হয়ে পড়েছে বহরমপুরে। এক্ষুনি যেতে হবে।
অসুস্থ শুনে, ওখানে পৌঁছে যখন আসল
ঘটনা জানতে পারবেন, তখন কি আর বড়বাবু ঠিক থাকতে পারবেন! তখন তাঁকে
সামলাবে কে! তাই কারখানার কর্মচারীরাই ঠিক করেছিল, একটা গাড়িতে তো ড্রাইভার ছাড়াও আরও চার জন
খুব ভাল ভাবে যেতে পারে, তা হলে বড়বাবুর সঙ্গে তিন জন যাক না... গুলি
লেগেছে মানে তো প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে। যদি রক্ত-টক্ত লাগে!
আধ ঘণ্টার মধ্যে
হাওড়ার কালীবাবুর বাজার থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ওরা। ক'হাত গিয়েই একটা লড়ির পেছনে এমন ভাবে ফেঁসে
গিয়েছিল ওদের গাড়ি, না পারছিল এগোতে, না পারছিল পিছতে। ড্রাইভারের পাশে বসেছিল
বড়বাবু। পেছনের সিটে কারখানার তিন জন। ঠিক সেই সময় কারখানা থেকে ছুটতে ছুটতে
গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সামশের। সামনে বসার উপায় থাকলেও, ও দিকে গেলই না
ও। পেছনের দরজা খুলে, 'একটু আগে-পিছু হয়ে বস তো', বলে চেপেচুপে
ঢুকে পড়েছিল ও। ও বসতেই রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করল গাড়ি। যেন ওদের সঙ্গে একই গাড়িতে
ওকে পাঠানোর জন্যই স্বয়ং ঈশ্বর যান-জট তৈরি করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল গাড়িটাকে।
ওরা রওনা হওয়ার
আগেই মুর্শিদাবাদের এস পি ভরতলাল মিনা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছেন---
দুষ্কৃতীদের এই ধরনের হামলা বরদাস্ত করা হবে না।
এস পি-র নির্দেশে
নড়েচড়ে বসেছে আশপাশের সব ক'টি থানা। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছে।
হামলাকারীদের দেখতে কেমন, তার মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়ার জন্য বারবার
জিজ্ঞাসাবাদ করছে তানিয়াকে। কিন্তু দুষ্কৃতীদের দিকে তাকাবার আগেই তার গায়ে যাতে
গলি না লাগে, সে জন্য তাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল দেবমাল্য। তার পর ঘন ঘন গুলির
শব্দে, আর এই বুঝি কোনও
গুলি এসে তাকে বিদ্ধ করল, এই আতঙ্কে সে চোখই খুলতে পারেনি। যখন খুলেছে, দ্যাখে মেঝের
ওপরে রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছে তার স্বামী।
যারা তখন হোটেলে
ছিল, রিসেপশনে বসে ছিল, তাদেরও দফায়
দফায় জেরা করছে পুলিশ। কিন্তু এমন কোন সূত্র এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেননি, যা তাদের কাজে
লাগে। দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করতে সুবিধা হয়। তারা নাকি পিস্তল উঁচিয়ে ঝড়ের বেগে
এমন ভাবে বেরিয়ে গেছে, তাদের দেখা তো দূরের কথা, দলে ওরা কত জন
ছিল, তাও নাকি বুঝতে
পারেননি কেউ। আর সব থেকে বড় কথা, যে সি সি টি ভি ক্যামেরাগুলো ওখানে লাগানো ছিল, সেগুলো নাকি বেশ
কিছু দিন ধরে একটাও কাজ করছিল না। কোম্পানিতে খবর দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আজ আসছি, কাল আসছি করে, কেউই আসেনি।
এই সব শুনে
সরেজমিনে তদন্ত করতে আসা কোন এক পুলিশ অফিসার নাকি ইতিমধ্যে মন্তব্য করেছেন, প্রত্যেকটি
হোটেলে এ বার থেকে সি সি টি ভি ক্যামেরা কাজ করছে কি না, তা হোটেল কর্তৃপক্ষকে নজরদারি করতে হবে। এটা
বাধ্যতামূলক। তা না হলে পুলিশ আইনানুগ ব্যাবস্থা নেবে। না হলে, পুলিশ দেখলেই
সবাই বলবে, আমি তো তখন ছিলাম না। বা কোথায়, আমি তো কিছু দেখিনি। আর এই সুযোগে দুষ্কৃতীরা
তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। এটা হতে পারে না। এতে দুষ্কৃতীদের খুঁজে বের করা আমাদের
পক্ষে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। হোক কঠিন, তবু ওদের খুঁজে বের করতেই হবে।
তাই স্টেশন চত্বর, দূর দূর পাল্লার
বাস গুমটি, এমনকী, যে সব হোটেলে হঠাৎ করে তিন-চার জন ছেলে একসঙ্গে উঠেছে,
সে সব জায়গাতেও পুলিশি
হানা দিল জারি রইল। কাউকে সন্দেহজনক মনে হলেই তাকে নিকটবর্তী থানায় তুলে নিয়ে
গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকল।
এ দিকে দেবমাল্যর
অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে। নার্সিংহোমে যখন ওকে নিয়ে আসা হল, গুলি লেগেছে
শুনেই দু'কদম পিছিয়ে
গিয়েছিল নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছিল, এটা তো পুলিশ কেস। পুলিশ না আসা পর্যন্ত হাত
দেওয়া যাবে না।
বোরখা পরা ওই দুই
মহিলাকে সবাই চেনেন। চেনেন ওই নার্সিংহোমের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে
ডাক্তারেরাও। তাঁদের অনুরোধেও কর্ণপাত করল না কেউ। ভাগ্যিস, ওদের পিছু পিছু
রাজীব এসেছিল। ও মিডিয়ার লোক। ওকে যেমন অনেকে জেনে, ও-ও চেনে অনেককে। পুলিশের ভয়ে নার্সিংহোম
কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তারেরা অপারেশন করতে ভয় পাচ্ছে জানতে পেরে, ও সঙ্গে সঙ্গে
ফোন করল এস পি-কে। এস পি-র তৎপরতাতেই অপারেশন শুরু হল।
ইতিমধ্যে প্রচুর
রক্তপাত হয়েছে। এমনিতেই গরম কালে রক্তের জোগান কম থাকে। তার ওপরে দেবমাল্যর ব্লাড
গ্রুপ আবার ও নেগেটিভ। যা সহজে পাওয়া যায় না। যেন অপারেশন নয়, জমে-মানুষে
টানাটানি চলল ওকে নিয়ে। সামশের ছাড়া কারখানার আরও যে তিন জন গিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন
বলল, আমার রক্ত ও নেগেটিভ।
অবশেষে অপারেশন
সাকসেসফুল। একটি গুলি বেরোল বাঁ কাধ থেকে। আর একটি তলপেট থেকে। না, ভয়ের আর কোনও
কারণ নেই। তবে আরেকটু দেরি হলে যে কী হতো, বলা মুশকিল। যাক্, ভালয় ভালয় বিপদ কেটে গেছে। এ বার জ্ঞান ফিরলেই
হল
কোথাও না
দাঁড়িয়ে, হাওড়া থেকে সোজা বহরমপুরে চলে এল ওরা। এমনিতে বেশিক্ষণ গাড়ির ভেতরে বসে
থাকলে কিংবা চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসলেও বড়বাবুর পা ভার হয়ে যায়। ফুলে যায়। বেশ
কিছুক্ষণ পা ফেলতে পারেন না। কিন্তু আজ এতটা পথ টানা এসেও গাড়ি থেকে নেমেই সব
ব্যথা-বেদনার কথা ভুলে গিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নার্সিংহোমে ঢুকে পড়লেন তিনি। সব শুনে
তাঁর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগছিল।
শরীরটা হঠাৎ যেন গুলিয়ে উঠল। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগেই, তাঁকে ধরে ফেলল
সামশের আর কারখানার আরও দু'জন ছেলে। তারা তাঁকে ধরাধরি করে একটা চেয়ারে
বসিয়ে দিল।
তানিয়ার ফোন দু'-চার মিনিট পর পরই
বেজে উঠছে। অপারেশন সাকসেসফুল শোনার পর সে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে। একটু স্বাভাবিক
হতেই তার মনে হয়েছিল, সে একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। এত বড় একটা
ঘটনা ঘটে গেছে এখানে,অথচ সেটা তার বাপের বাড়ির কাউকে জানানোই
হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিল বড়দাকে। বড়দার কাছ থেকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই
জেনে গিয়েছিল বাবা-মা'ভাই। তাঁরা তো কেঁদেকেটে একশা। তাঁরাই এক-একজন
খানিকক্ষণ পর পরই ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেন, দেবমাল্য কেমন আছে।
এর মধ্যেই বড়দা, ছোড়দা ঠিক করে
ফেলেছেন, রাতের ট্রেনেই
তাঁরা বহরমপুরে আসবেন। এই কথা শুনে নাকি তাঁর মা-ও আসতে চেয়েছেন। বাবাও। তানিয়া
এখন তাঁদের ঠেকানোর জন্য চেষ্টা করছে। ওঁরা যত বারই ফোন করছেন, ও তত বারই বলছে, এখন তো বিপদ কেটে
গেছে। যে কোনও সময় তারা হাওড়ায় ফিরে যাবে। শুধু শুধু এখানে এসে ভিড় বাড়িয়ে
কী লাভ?
ভোররাতে ফোন বেজে
উঠল রাজীবের। --- হ্যালো, রাজীব?
গলা শুনেই ও
বুঝতে পারল, সঞ্জয়দা ফোন করেছেন। সঞ্জয়দা মানে সঞ্জয় বিশ্বাস। কলকাতা টিভি-র। নিশ্চয়ই
কোনও খবর আছে। তাই ঘুম-জড়ানো গলাতেই বলল, হ্যাঁ,বলো।
--- কোনও খবর পেয়েছিস?
--- কী?
--- হোটেলে গুলির কেসটার?
--- হ্যাঁ, শুনেছি....
--- ও তো এক্সপায়ার করে গেছে।
--- এক্সপায়ার! তরাং করে লাফ দিয়ে উঠল রাজীব। মুহূর্তের মধ্যে ঘুম চৌপাট।
ঘণ্টাখানেক আগেও ও নার্সিংহোমে ছিল। ডাক্তাররা বলেছিলেন, ভয়ের আর কোনও কারণ নেই। এ বার জ্ঞান ফিরলেই
হল। তা হলে কী এমন ঘটল যে... রাজীব জিজ্ঞেস করল, কে বললেন?
--- ডক্টর সান্যাল।
রাজীব জানে, এই ডাক্তার
সান্যালের আন্ডারেই চিকিৎসাধীন ছিলেন দেবমাল্য। এবং তিনি যখন খবরটা দিয়েছেন, তখন মিথ্যে নয়।
তাই বলল, তুমি যাচ্ছ?
--- আমি না গেলেও কাউকে পাঠাব। চার ঘণ্টার আগে তো বডি ছাড়বে না। তা ছাড়া পোস্টমর্টেমের
ব্যাপার আছে।
আমি তো কাল এস
পি-কে বলেছিলাম, এখানে এরা কাউকে চেনে না, জানে না। যদি তেমন কোনও অঘটন ঘটে, তা হলে এখানে
পোস্টমর্টেমের জন্য বডি আটকে রেখে ওদের হ্যারেজমেন্ট না করে, যাতে হাওড়াতেই
ওরা ওটা করাতে পারে, তার ব্যবস্থা করে দিতে।
সঞ্জয় বলল, বলেছিস? তা হলে তো ওদের
পক্ষে ভালই হল। একটা কাজের কাজ করেছিস। তার মানে ঘণ্টা চারেক পরেই ওরা বডি পেয়ে
যাবে।
--- কটা বাজে এখন? মুখে জিজ্ঞেস করলেও ঘরের দেয়াল ঘড়ির দিকে
তাকাল রাজীব। দেখল, চারটে বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।
ও প্রান্ত থেকে
সঞ্জয় বলল, ক'টা হবে! সাড়ে
তিনটে-চারটে।
--- তার মানে আটটা নাগাদ বডি পাবে!
--- হ্যাঁ, তা-ই তো পাওয়া উচিত।
ফোন ছাড়ার পর দু'চোখের পাতা আর এক
করতে পারেনি রাজীব। সারা রাত বিছানায় শুয়ে শুধু ছটফট করেছে। সাংবাদিকতায় আসার
পর থেকে এমন বহু ঘটনা ওর সামনে ঘটেছে, যা ওকে বিচলিত করেছে। নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু
তার জন্য তার প্রফেশনে কোনও আঁচড় পড়েনি।
দুষ্কৃতীদের
আচমকা হামলায় সদ্য সন্তান-হারা মা যখন কাঁদতে কাঁদতে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর মুখের
সামনে বুম ধরে জিজ্ঞেস করতে হয়েছে, কী হয়েছিল, ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন।
কী নির্মম তার জীবিকা।
এই প্রফেশনে আসার পর থেকে তার মনটাও কি একটু একটু করে যান্ত্রিক হয়ে যায়নি! সে
কি আর আগের মতো মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কবিতা লিখতে পারে! ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের
দিকে হা করে তাকিয়ে মেঘের আনাগোনা দেখতে পারে! কত দিন বৃষ্টিতে নেমে ভেজা হয়নি
তার। কত দিন।
এখন
গ্রাম-তস্যগ্রামকে গুরুত্ব দিতে সমস্ত প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া গ্রামেগঞ্জে
স্থানীয় সাংবাদিক নিয়োগ করলেও, এখনও সব খবরই শহরকেন্দ্রিক। রাজনীতিকেন্দ্রিক। 'দৌলতাবাদের একটি
হোটেলে দুষ্কৃতীদের গুলি চালনায় মৃত্যু'টাকে তার চ্যানেল আদৌ গুরুত্ব দেবে কি না, ও জানে না। বড়
কোনও খবর থাকলে ছোট ছোট এই সব খবর একেবারে চাপা পড়ে যায়। তবু গুরুত্ব দিয়েই এ
খবরটা ও করতে চায়। নিজের কাছে ও পরিষ্কার থাকতে চায়। তাই ফোন করে তার
ক্যামেরাম্যানকে বলে দিল, যত তাড়াতাড়ি পারে, ও যেন বানজেটিয়ার মুর্শিদাবাদ নাপ্সিংহোমে চলে
আসে।
অন্য জেলা থেকে
এসে এখানে হামলা চালিয়ে গেছে, এটা নিশ্চয়ই খুব একটা ছোট খবর নয়। সবাই কভার
করবে। একটু আগে-ভাগে না গেলে হয়!
সেই হিসেব করে
বাইক ছুটিয়ে ও যখন নার্সিংহোমের সামনে পৌঁছল, দেখল হাওড়ার নাম্বার প্লেট লাগানো--- ডাবলিউ
বি জিরো ফোর... হ্যাঁ, এই গাড়িটাকে কালকেও ও দেখেছিল। তার মানে
দেবমাল্যর বাবা আর তার কারখানার লোকজন এই গাড়িটা করেই এসেছে...
ও রাস্তার ধার
ঘেঁষে বাইকটা দাঁড় করাতে গিয়ে দেখল, ওই গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে
আসছে। গাড়ি চালাচ্ছেন হরিদা। তার পাশে সামশের। আর তার পাশে, জানালার দিকে
দেবমাল্যর বাবা। পিছনের সিটে বোরখা পরা দু'জন মহিলা। আর তাঁদের মাঝখানে বসে আছেন
দেবমাল্যর স্ত্রী। এদের প্রত্যেকেই ও কাল রাতে নার্সিংহোমে দেখেছিল। তাদের সঙ্গে
কথা বলেছিল।
ওদের গাড়ির পিছু
পিছু একটা শববাহী গাড়িও ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। গাড়িটির চালকের পাশে ঠেসেঠুসে
অত্যন্ত কষ্ট করে বসে আছে তিন-তিনটে ছেলে। এদেরও কাল দেখেছিল ও। এরা দেবমাল্যর
কারখানাতেই কাজ করে।
রাজীব স্তম্ভিত
হয়ে গেল। আরও স্তম্ভিত হয়ে যেত, যদি জানতে পারত, এই পৃথিবীর অত্যন্ত বিরল দু'- চার জন মানুষের
মতো দেবমাল্যরও একটা তৃতীয় চোখ ছিল। আর ছিল বলে, সেটা দিয়েই গত কাল দুপুরে আরও অনেক কিছুর মতো
সে তার নিজের মৃত্যুটাকেও আগাম দেখে ফেলেছিল। কিন্তু এই কথাটা তাকে বলবে কে! যে
বলতে পারত, সে তো এখন শববাহী গাড়িতে শুয়ে হাওড়ার দিকে চলেছে।
siduabp@gmail.com
কলকাতা
No comments:
Post a Comment