1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, August 1, 2020

বর্ষাকে শেষ চিঠি

                                                                                                                    ...শুভায়ন বসু


                                  আজ এই শেষ চিঠি লিখতে গিয়ে মনে হয়, তুমি যদি সারাজীবন ধরে আমার পাশে থাকতে, আর আমাকে প্রতিদিনই নতুন করে আবিষ্কার করতে, তবে বড় ভালো হত। কিন্তু ভেবে দেখ,এই আমাকে বাদ দিয়ে এই কথাগুলো , হয়ত এক টুকরো কাগজে লেখা ফালতু কথা হয়েই উড়ে হারিয়ে যেত। তাই অহেতুক আমার অত দাম দিওনা।
একমাত্র তোমাকে না পাবার  দুঃখ-অভিমানেই ,না বলা কথাগুলোকে বাঁধন ছিঁড়ে মুক্ত করে দিয়েছি আমার মন থেকে তোমার মনে ।কারণ তুমি সকলের থেকে আলাদা। তোমাকে আমি যেটুকু বুঝেছি, তাতে দেখেছি তুমি অনেকটা আমারই মতো।তোমার- আমার হয়তো কোনদিনই সবুজ হওয়া হয়ে উঠবে না, তবু বলছি, দূর থেকেই বলছি ,তোমার অনুরণন যে আমাকে পাগল করে তোলে, তা হয়তো বা তুমিই প্রকৃত বুঝতে পারবে একদিন ,যেদিন আমিই হয়তো থাকব না। তখন কোন শীতের দুপুরবেলা হঠাৎ নীল আকাশে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট চিলটার দিকে তাকিয়ে, আমার কথা তোমার মনে পড়বে, আর তখনই দেখো ঠিক, তোমাকে কাঁদিয়ে যাবে আমার সেই ‘আমি’ ।
আমার একান্ত আপনার জনের বিষয়ে আমার আদৌ কোনো বিশ্বাস নেই। আমি জানি সেই একজনকে আমি কোনদিনও পাবনা ।যে একদিন আমার হবে ,সে হয়ত কোনদিনই আমার কবিতা বুঝবে না ,দিন আনি দিন খাই ভালোবাসার রাতে লাল নাইটল্যাম্পের তলায় শুয়ে নীরবে কেঁদে যাবে আমার কবিতা ।সেই একজন হতে পারতে তুমি ,বর্ষপ্রেমিকা,অথচ নামহীন সম্পর্কের নদীতে ,পাতার নৌকা হয়েই সে হয়ত চিরকাল ভেসে যাবে ।তোমার কাছে থাকতে পারছি না,ইচ্ছে না হলেও বাধ্য হয়েছি তোমাকে কলকাতার পথচলতি ফুটপাতে ছেড়ে আসতে।সেখানে আমার কোনো জোর নেই, ভিড়ে হারিয়ে যাবার পর কত সহজেই, তোমার প্রতি আমার সব দাবী হারিয়ে যায় ।কিন্তু,তুমি কাছে থাকো বা দূরে ,তোমার সংজ্ঞা ,তোমার স্মৃতি, আমার মনের সবচেয়ে দামি ঘরে তালাবন্ধ হয়ে আছে ,আর সেই ঘরের ভেতরে প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র আমার। একথাই আমাকে আজ শান্তিতে রেখেছে, জীবনের সমস্ত ওঠা-পড়া,দুঃখ ,অভিমান একাকিত্বে পাশে থেকেছে, উৎসাহ দিয়েছে ,বলেছে আমার নাম আর আমার সমস্ত আবেগ, চেতনা আর বোধের মূল্য আছে ,প্রাণ আছে- আছে ভালবাসার টান- তোমাতে, যা কখনই শেষ হয়ে যেতে পারে না ।
সেইখান থেকেই আমার আবার নতুন পথচলা শুরু হয়। পেছনে পড়ে থাকে সমস্ত স্বার্থান্বেষীদের কাতরোক্তি, লোভী আর হিংসুটেদের বড় লোলুপ চোখ, হিংসার রক্তাক্ত ছুরি।সমস্ত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মলিকুলার ফিউশন আর ফিশনকে মাড়িয়ে চলি আমি, সমস্ত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমি খুঁড়ে ফেলি সুড়ঙ্গ, এমনকি সমুদ্রের তলা থেকে কুড়িয়ে আনি মুক্তোঝিনুক, শুধু তোমাকেই দেব বলে। এইভাবেই চলতে থাকে আমার জীবনযাপন ।সবাইকে, এমনকি তোমাকেও পেরিয়ে চলে যাই অজানা লক্ষ্যে  আলোয় পথ ধরে, অভূতপূর্ব চোখের ডাকে।আমার চলা একদিন শেষ হবে, যেদিন জীবনের লক্ষ্যে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে শুধু আমারই একটুকরো সবুজ দিন। সেই সবুজ বৃষ্টিতে আমি বুক পেতে দেব।আমার চোখ, মুখ, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে,আমার সারা শরীর ভিজিয়ে ,আমার সবুজ হবার পালা ।জানি সেদিন তোমার অভিমান হবে, রাগ হবে ,দুঃখ হবে। কিন্তু সে সমাপ্তি তো একান্ত আমার নিজের, তার ভাগ পাবে না তুমি, কারন তোমাকে তো বাঁচতে হবে,তোমাকে তো আমায় হারাতেই হবে। সেদিন তুমি শেষবারের মতো আমাকে হারাবে, এমনকি আমিও হারাবো তোমাকে ,শুধু এই জন্যই যে আমি আমার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ,তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি ,তোমার জন্য শুধু তোমারই হতে পারিনি, তোমাকে কাছে টেনে নিতে পারিনি ।এ আমার ব্যার্থতা নয়, এ হল এই পথের ইতিহাস,এ পথের ভবিতব্য ।এই পথে চলতে চলতে, আমি আমার সীমিত হাতের তালুতে তোমাকে ধরে রাখতে পারিনি ,আমার ছোট্ট ঘরের কোণে দুধেল বিছানায় তোমাকে নিয়ে যেতে পারিনি।আমি মন দিয়েছিও মাত্র একটুকরো ,আর তার বদলে তোমার মনেরও ঠিক একটুকরোর বেশি নিজের করে নিতে পারিনি। তুমি চলে গেছ তোমার নিজের ছন্দে, সুরে, জীবনবোধে ।তুমি যেন নদী হয়ে,আমার তৃষিত বালুচর সবুজে ভরিয়ে দিয়ে, বয়ে চলে গেছ। তুমি স্থান-কাল-পাত্র, জীবন-মরণ, পার্থিব-অপার্থিবের হাতের পুতুল নও,তুমি চিরন্তনী বহমান,তুমি আবেগ সঞ্চারী চেতনার নদী, তুমি বর্ষা।
আমি যে কে তোমার, তা চিঠি লিখে সময়ের কাছে দিয়ে দিও ,তাহলে আমিও স্বস্তি পাব।
 পাওয়া এবং হারানো এ দুই'ই আমার কাছে ভালবাসার রূপ। ভালবাসা হল মোমবাতির আলোয় দেখা তোমার মুখ , ভালোবাসা হল বুক দিয়ে ধরে নেওয়া বৃষ্টির ফোঁটা, ভালোবাসা হল ইউক্যালিপটাস গাছ, ভালোবাসা হলো আঠাশে এপ্রিল ,আর্চিস গ্যালারি,বিদায় দেবার চোখের জল আর বাড়ি ফিরে শাওয়ারের জলে স্নানের সময় মিশে যাওয়া সারা জীবনের কান্না।ভালবাসা কখনো কফি হাউজের কোণের টেবিল,বাগবাজার বাটার সামনে প্রতীক্ষা, এমনকি ভালোবাসা আমার কাছে তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়া পুরো আঠেরোটা বছর। তবু ভালোবাসা মানে নর-নারীর প্রেম শুধু নয়।জীবনের এক একটা মূল্যবান ঘটনা ,যে সময়গুলো আমি মনে রেখেছি,ভালোবেসে ফেলেছি, অসংখ্য স্মৃতি, অসংখ্য মানুষ আর তাদের সকলের সঙ্গে আমার উপস্থিতি যখন এক হয়ে যায়, যখন মনে পড়ে সে কথা, তখন মন কেমন করে ,মন ছুটে চলে যায় ,কিন্তু শারীরিকভাবে বাস্তবিক তার সঙ্গে যাওয়া যায়না, সে থেকে যায় চিরকালের জন্য অধরা।বিশ্বজনের জন্য এই আবেগ বিহ্বলতাও জীবনের ভালবাসারই অঙ্গ। তুমি যে দেখেছ ,আমি তোমার মনের কল্পিত প্রেমিক পুরুষ, এ ঠিক নয়। আমি জানি আমার মধ্যে এমন কিছু নেই, যা তোমার চিরনতুন মনের অসম্ভব আবেগ আর জটিল ভালোবাসার বিমূর্ত্ত প্রতীক হতে পারে।
শুধু একটা অভিমান,এতদিন পরেও তুমি আজও অনেক অচেনা,অজানা।এ শুধু চলে যাবার সময় আমার দুঃখময় উপলব্ধি নয়,এ আমার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস।অনেক কিছু জানা হলনা,আর হয়ত কোনদিনও হবেনা।একদিন আসবে,যখন তোমার আমার আর কোনদিনও দেখা হবে না-কালের গহ্বরে এই সম্পর্ক হারিয়ে যাবে,অনেক দূর চলে যাব আমরা, সেইসঙ্গে এইসব প্রশ্নও মিলিয়ে যাবে চিরকালের মত।
তোমারও কিন্তু পুরো আমাকে জানা হয়নি,যা করতে পারলাম না,যা বলতে পারলাম না,যে চিঠি কোনদিনও তোমার হাতে পৌঁছল না,তা শেষপর্যন্ত হয়ত ভালোর জন্যই হয়েছে।আমার দুঃখ এই দূরত্বের জন্য,এই জীবনযাপন,এই সমাজব্যবস্থার জন্য,যা বদলাবার আগেই তোমাকে হারিয়ে ফেলব আমি,জীবনটা এতই ছোট আর দ্রুত। এই চলে যাবার যদি ক্ষমা থাকে কোন,মনে মনে অন্ততঃ ক্ষমা করে দিও।আমি জানি,আমি নই, আমি পারিনি ,সেই আদর্শ প্রেমিক পুরুষ হতে। যদিও একদিন আমিই,হয়ত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমিক হতে পারব আর সবচেয়ে আগে একমাত্র তুমিই তা বুঝতে পারবে, কিন্তু তখন তো আমি থাকবো না তোমার চোখের মাঝে ! সেদিন আমায় মনে পড়বে  তো বর্ষা?

bluebasu22@gmail.com


No comments:

Post a Comment