1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

পুজোর শহর - শহরের পুজো

ছবি : ইন্টারনেট

পুজোর শহর - শহরের পুজো

সীমন্ত নন্দী

|| ১ ||


মোড়ে মোড়ে আবার বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। কানাগলিতে ঢুকেই বাঁশের কেল্লা। কে বলবে, ছ মাস স্তব্ধ ছিল শহর! মানুষ দূরে ছিল মানুষেরা পূর্ণ দাস রোডে গভীর কুয়োর মতোই কালো গাছের ছায়া রাস্তার দুপাশে। শান্ত। ধীর। অতল দিঘি যেন। কেয়াতলা লেনে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে দুটি ছেলে-মেয়ে। তাঁদের মুখে মাস্ক। একটু পরে, যখন ওরা লেকে ঢুকে চুমু খাবে, মাস্ক দুটো বেঞ্চিতে রেখে দেবে। কারণ, শরত এসে গেছে। চুমু আড়াল করার কিছু নেই। মাস্ক বরং এবারে নিপাত যাক... অনেক হয়েছে...

এ এক আজব সিজন। মহালয়ার পর থেকেই মন কেমন করে। এবার তায় আবার এক মাস এডভান্স মহালয়া। কি কেলো! যেন, গত ছ মাসের হিসেব চুকিয়ে দিচ্ছে ভগবান। অনেক তো চাপ নিয়েছিস...এবারে একটু ফূর্তি করে নে' টাইপ। মাধ্যমিকের পর যেমন তিন মাস ছুটি থাকত। এও তেমন। সকালে উঠেই দিকে দিকে ভ্যান গখের ছবির রংয়ের রোদ ঝকঝকে। দেখেই মনটা ভালো হয়ে যায়। হাওয়ায় চটের গন্ধ। দুপুর হলেই, কেমন থম মেড়ে যাচ্ছে আকাশ বাতাস। যেন বিয়ের আগের রাতের বধুয়া। চাপ চাপ কান্না বুকে চুপ করে আছে। কপালে লেপ্টে সিদুর। একটু পরেই হয়তো তেড়ে ঝড়জল নামবে। তাই ছাতা নিয়ে বেরলাম। কোথায় ঝড় কোথায় জল! কিছুই নামল না। কাজ সেড়ে বিকেলে দিব্যি হাওয়া খেতে খেতে গোলপার্ক ধরে হাঁটছি..দেখছি, নতুন দুটো মোমোর দোকানে রং করা হচ্ছে, নাকে এসে লাগছে নতুন রংয়ের গন্ধ, দার্জিলিংয়ের ছেলেটি মোমো প্যাক করতে করতে জানাচ্ছে, আবার ছন্দে ফিরছে পাহাড়.."আপ পুজা মে আওগে সারজি হামাড়ে পাহাড় মে? আপকো আচ্ছা লাগে গা..."

হাওয়া দেয়। এ এক অলীক ডাকের হাওয়া। শরত।

স্মৃতির শহরে সব মনে পড়ে যায়। যে সব কোনওদিন মনে করতে চাইনি। মুখোমুখি হতে চাইনি। রাসবেহারীর কাছে আমি আর স্যার হাঁটছি। দেখছি, একটা ভাঙা সেকেলে বাড়ি। কি আভিজাত্য তার আজও। রাজকীয় স্থাপত্য নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে যেন জলসাঘরের ছবি বিশ্বাস। ফাটা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা অশ্বত্থের উকি... অনামা ছোট (ছোট ফুল..ঘুরঘুর করছে প্রজাপতি. আমি আর স্যার দাঁড়িয়ে পড়ি রাসবেহারী মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রাম-বাস-রাস্তা-ঘাট...ভবানীপুরের দিক থেকে আজান ভেসে আসছে হাজরায় পথ অবরোধ করেছে সুন্দর...

মেদুর। আর, খোলা। এ দুই শব্দ ফিরে ফিরে আসে আমার কাছে এই সময়টা বোঝাতে। তাও ধরতে পারিনা। আকাশের দেবতারা পাতালে ফুল ঝরিয়ে দেয়। সেই ফুলের গন্ধে সকালে ঘুম ভাঙে । এসব সকালের নাম মহালয়া সকাল। অদ্ভূতুড়ে কিসসা যত। সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যাও মায়াময়।

রাসবেহারী এভিনিয়ের সস্তা দোকানে আজ বিরিয়ানি। খাওয়ার ভিড়। ৬০ টাকায় এক প্লোট। দোকানি বলছে, অক্টোবরে জমে যাবে বাজার। অটো চালকও তাই বলছে। অক্টোবরটা জমে যাবে বুঝলেন। উবর চালক জানান, গতকাল রাত থেকে টানা ট্রিপ করছে। অনন্ত ট্রিপ। সারারাত ঘুমোননি। সামনে পুজো কি না..ছ মাসের আলস্যটা একটু কাটিয়ে নিচ্ছেন...বলেই লাল চোখে হ্যাঁহ্যাঁ করে হেসে দেন...

সমস্যা হল, এ সিজনে প্রেম পায়। বন্ধুত্ব পায়। মেয়েরা ছেলেদের মেসেজ করে, বিকেলে কি খুব বাস্তা একটু গড়িয়াহাট যাবি? একটা জিনস কিনতাম... ছেলেটিকেও এদিকে বন্ধুরা শাসিয়ে রেখেছে, দেখা করতে হবে....অনেকদিন দেখা হয়নি...পুজোর দেখা...সে বোঝে না, মেয়েটাকে কি বলবে! আপনারা জানলে অবাক হবেন, এই ছেলে আর মেয়েটির কিন্তু দু মাস আগেই ব্রেক আপ হয়ে গেছে। মানে, বিচ্ছেদ। কিন্তু এই প্রজন্ম, ব্রেক- আপের পরেও "বন্ধু" থাকে।

মানে, সিঙ্গল হয়েও মিঙ্গল। আর, "খেয়েছো" "বাড়ি ফিরেছো" বলে প্রেম করে না আজকের ছেলে-মেয়েরা। তারা দুবার ব্লক করলে, চার বার এভাবেই আবার দেখা করে। আপনি বলবেন, আজব তো। আসলে, ওরা এই সিজনের মতোই। সকালবেলার রোদের মতোই। তপতপে। টকটকে। স্পলনেডের টোকো থুকপা দোকান যেন। পার্ক স্ট্রিটের গলিতে রাজনা দোকানের মত। অকারণ তাই সুন্দর.... অদরকারি তাই যৌথ.... 

ছেলেটি আর মেয়েটি এবার নিউ মার্কেটে জিনস কিনতে যাবে। ওদের একটু একা থাকতে দি আমরা, কি বলেন? পাঠক? পুজো তো চলে এলো...তাই না! আপনিও বেরিয়ে পড়ুন এবার...


|| ২ ||


মহাত্মা গান্ধী রোড মেট্রো স্টেশানের সামনে লুম্পেনরা সাবানের বুদবুদ ওড়াচ্ছে ফুঁ দিয়ে। আর ক দিন পরই পুজো। ভবানীপুরের অলিগলি পাকস্থলির পুরোনো বাড়িগুলোর ওপর ঝোলানো হচ্ছে আলোর চাদর। লাইটিং। ক দিন পর দপ করে জ্বলে উঠবে সেসব। তখন হেসে দেবে এই জীর্ণ বাড়িগুলো। তখন ম্যাডক্স স্কোয়ারে অষ্টমীর খোলা পিঠ সুন্দরীর। অম্লান

চার বার এভাবেই আবার দেখা করে। আপনি বলবেন, আজব তো। আসলে, ওরা এই সিজনের মতোই। সকালবেলার রোদের মতোই। তপতপে। টকটকে। স্পলনেডের টোকো থুকপা দোকান যেন। পার্ক স্ট্রিটের গলিতে বাজনা দোকানের মত। অকারণ তাই সুন্দর.... অদরকারি তাই যৌথ... ছেলেটি আর মেয়েটি এবার নিউ মার্কেটে

রোড মেট্রো স্টেশানের সামনে লুম্পেনরা সাবানের বুদবুদ ওড়াচ্ছে ফুঁ দিয়ে। আর ক দিন পরই পুজো। ভবানীপুরের অলিগলি পাকস্থলির পুরোনো বাড়িগুলোর ওপর ঝোলানো হচ্ছে আলোর চাদর। লাইটিং। ক দিন পর দপ করে জ্বলে উঠবে সেসব। তখন হেসে দেবে এই জীর্ণ বাড়িগুলো। তখন ম্যাডক্স স্কোয়ারে অষ্টমীর খোলা পিঠ সুন্দরীর। অম্লান নিজেকে সামলাতে পারবে না। যেমন কালকেও পারছিল না। হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। তারপর ছাতিমের গন্ধ নিচ্ছিল চোখ বন্ধ করে। আর আমি দেখছিলাম, বসন্ত রায় রোডের কোনও শৌখিন বাড়ির আলোছায়ায় জ্বলে থাকা ডিম লাইট। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল, প্রথম প্রেম। পুজোর প্রেম। দুর্গাবাড়ি। রাসবেহারীর এ কাফেতে একটা নতুন ছেলের সাথে তোকে দেখতে পাই আজকাল। এদ্দিন পর আর অস্বস্তি হয় না আমার। হালকা একটা তাহলে? চিনচিন শুধু। পুজোর মাস বলেই। আজ ছ মাস পর এসেও আবার দেখছি তোকে অদূরে। পাশে সেই ছেলেটাই। আমার কেন জানিনা, অসম্ভব রাগ হচ্ছে আবার। নির্বোধ রাগ। দাঁত চেপা রাগ। টেবিলে ঘুষি মারতে ইচ্ছে করছে। অম্লান বলছে, কি হয়েছে? কোনও সমস্যা? আসলে, অজানা একটা তেঁতো কষ্ট। মনে হচ্ছে, আমি পারিনি। মনে হচ্ছে, আট বছর আগে, এতদিনের সম্পর্কটা এক লহমায় ছুঁড়ে ফেলে, তুই কীভাবে চলে গেছিলি? তুই কি জানতি না, শহর তারপর আমায় গিলে খাবে? জানতি না, রাত্রি জানোয়ার নিভিয়ে দেবে সব আলো হঠাৎ? নও ধারণা নেই....... পুজোর নও ধারনাও নেই

তবে তুই বলেছিলি, আজীবন তোর আমার প্রতি সংবেদন থাকবে। তাই তুই মুখোমুখি হতে পারিস না আমার। এত বছর পরেও। আমার চোখ আজও তোকে অস্থির করে । তাই তুই তাকাস না আর আমার দিকে। এখনও তাকাচ্ছিস না। ওই ছেলেটির দিকে একটা মিথ্যে তাকানো তোকে আশ্বস্ত করছে, দেখতে পাচ্ছি। তুই নিশ্চয়তা চেয়েছিলি। আমি দিতে পারিনি। তবু আজ তুই আড় চোখে তাকাচ্ছিস কেন? কেন? আমার দিকে? এই কাফেতে তো আমি আমার বন্ধুর সাথে দিব্যি আছি। তোর মুখটাই বা এত শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? আমি তো তোদের কোনও অসুবিধে করছি না। কোনওদিন করিনি। নিজের আড্ডায় আছি।

তাহলে?

রাসবেহারী এভিনিউয়ের এই কাফেটা আজব। পুজোর আগে আরও কেমন লাগে। কত পুরোনো বন্ধুরা হঠাৎ পিঠ চাপড়ে দেয় এসে। এটা যেন একটা রিউনিয়ন সেন্টার আমাদের! পুজোর এ সিজনে দুর্গাবাড়ি যেমন। ম্যাডক্স যেমন! তুই পিছন ফিরে বসলি আমার দিকে। হয়তো অস্বস্তি এড়াতে! চুল ছেটেছিস। হাতে সিগারেট। ছেলেটি দু-চারবার আমায় মাপল। তুই মুখ ফেরালি না!

শেষ দেখায় কিছুটা চিন্তিত ছিলি, তুই চলে গেলে কি হবে আমার! কিন্তু এই তো দ্যাখ, আমি বেঁচে আছি দিব্য! লেখালেখি করে নাম-টাম হয়েছে। কত কত বিকেল যাদবপুরে তুই অপেক্ষা করেছিস আমার জন্য, আমি লেখা জমা দিয়ে ছুটে ছুটে ফিরেছি। তোর অপেক্ষাগুলো আমি আজও কিন্তু ভুলিনি। এ জীবনে ভুলতে পারবও না জানিস। সার্দান এভিনিউজুড়ে আজ পাতা ঝরে আছে। আর ক দিন পর শীত আসবে শহরে। তোর অপেক্ষাগুলো আমার একার পথ হাঁটায় এসে জানতে চাইবে তারপর, কি হবে তাদের? ট্রামে মাঝ দুপুরে বেলা নামবে।

তুই বলেছিলি, এত বড়ো একটা শহরে তুই একা হয়ে যাবি দেবর্ষি! কিন্তু কোথায় একা? মার খেতে খেতে খেতে আমি কিন্তু বেঁচে গেলাম জানিস। হালকা শীত শীত লাগছে। অক্টোবরের কলকাতায় হলুদ আলো আছড়ে পড়ছে বিবেকানন্দ রোডে। কত ছেলেমেয়ে পুজোর আগে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। যেমন আমরাও হেঁটে যেতাম। গাছ লাগাচ্ছেন এক বয়স্কা দেশপ্রিয় পার্কের পাশের তাঁর ফ্ল্যাটে। উনি তো বেশিদিন নেই, তবে গাছটা লাগাচ্ছেন কেন? কার জন্য?

কার জন্য শহর আবার সেজে উঠছে? রাসবেহারী এভিনিউ ধরে চলে যাচ্ছে ট্রাম? যুগলসে মিষ্টি কেনার ভিড়? ডিসেম্বর মাসের দূরপাল্লার টিকিট কাটার হুড়োহুড়ি? কার জন্য, আমি আর অম্লান আজ সন্ধায় গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট হেঁটে হেঁটে পুজোর আগের কলকাতা দেখছি? ক দিন পর এসব রাস্তা ভরে যাবে মানুষে। তাই অম্লান বলছে, 'দেবর্ষি, ফাঁড়ি অবনি হাঁটবি? অসুবিধে হবে? আসলে, এদ্দিন পর এসব রাস্তায় তো! সামলাতে পারছি না...'

কার জন্য? তুই বল।

|| ৩ ||

গত বছর এই দিনে পুজো শুরু হয়ে গেছিল। আকাশে বাতাসে শরতের ইশারা এ বছরও এখন অবিরত। কিন্তু পুজো আসেনি। এ যেন অনেকটা, দু জনেই টের পাচ্ছি, ভেতরে ঝড় উঠছে। কিন্তু মুখে বলছি, আমরা তো বন্ধু। জাস্ট ফ্রেন্ডস। এ সময়ে নরলোক আর দেবলোক কাছাকাছি চলে আসে। সন্ধ্যা হলেই রবি ঠাকুরের "শারদপ্রাতে" শব্দটা বারবার মনে পড়ে। তোমায় দেখেছি শারদ(ও)প্রাতে/ তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে। আরেকটি গানে লিখেছেন, "একদিন যদি খেলা থেমে যায় শারদপ্রাতে।" আরও একটি গানে লিখেছেন, "আমার রাত পোহালো শারদপ্রাতে"। কেন বারবার রবি ঠাকুর শারদপ্রাতে লিখছেন? ঠিক কি ঘটছে ওঁর মধ্যে? কেন?

আমার গগন ঠাকুরের ভাসানের ছবির রং মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অপুর সংসারের সেই অমোঘ সংলাপ। অপর্ণা লিখছেন অপুকে, আমার শরীর ঠিকাছে। মন ঠিক নেই। তুমি এলে মনের রোগ সারবে। তুমি আসবে?- আরণ্যক, পথের পাঁচালি আর রবি ঠাকুরের চিঠিগুলি ছিন্নপত্রের এ সময়ে খুব অস্থির করে আমায়। প্রকৃতি কি ভয়াবহ ভাবে যৌনতা ছাপিয়ে আধ্যাত্মে হাত রাখছে একজন একা মানুষের! তানসেন গাইলে আকাশ কালো হয়ে আসছে। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় বাজাতে বাজাতে ঘেমে যাচ্ছেন। সন্ধ্যারতি চলছে পাড়ার প্যান্ডেলে। মাইকে দ্রুত মন্ত্র উচ্চারণ করছেন বীরেন ভদ্র। প্যাণ্ডেলের পিছনের অন্ধকারে তারই মধ্যে প্রথম চুম্বন মনে পড়ছে..মনে পড়ছে..তার ঠোঁট, নাক, , লিপস্টিক, চুল, গলা, গ্রীবা, কোমর, গালের নরম... মনে পড়ছে, প্রথম উন্মাদ হয়ে যাওয়া ঢাক আবহমান...হলুদ আলোর আছড়ানো.. 

গত ক দিন ধরে খুব ঘুরতে যাওয়ার নানা স্মৃতি ভেসে আসছে। ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। বারবার মনে ভেসে উঠছে হোটেলের ঘর। অরণ্য। পাহাড়। ফেসবুকে ছবি দেখছি নানা মানুষের। সেখানে একদিকে ভেসে উঠছে জঘন্য ধর্ষণ। আর অন্যদিকে সুখী মানুষের সপরিবার ছবি। উঠতি সেলিব্রিটিদের ইগোময় মুখ। দুটো গান গেয়েছে হয়তো পুজোয় তারা। বা, একটা সিনেমা বানিয়েছে সবে। কিন্তু ওরেব্বাবা কি ঘ্যাম। যেন ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করেছে। বা, মুন ল্যান্ডিং তাদের ব্রেন চাইল্ডা শরীর থেকে তাদের ফেটে পড়ছে পারফিউম আর বোকামি। আমার তাদের বোকাচোদা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বলছি না। আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। রাস্তায় দেখছি, মূর্তি বানাচ্ছেন কারিগর। কোনও অহং নেই এই শিল্পীর। মাটির নগ্ন মূর্তি দাঁড় করানো রাস্তার পাশে সারারাত। প্লাস্টিকে মোড়া মুখ। চক্ষুদান হয়নি। এখনও। আজ জ্যোতস্না রাতে সবাই গেছে বনে..

জয় বাবা ফেলুনাথ মনে পড়ে এই চক্ষুদান শব্দে। যিনি ছবির শুরুতে চোখ আঁকছিলেন দুর্গার, সেই নিষ্পাপ বয়স্ককে খুন করেছিল মগনলাল। মনে পড়ে পুজোর বেনারসে ফেলুদার রেগে যাওয়া। "আমি হয় এর বদলা নেব /নয়তো গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব'। কাশীর ঘাটে। ফেসবুক স্কুল করে দেখি, এত অন্ধকারেও কেমন শুধু নিজেরটা বুঝে নিচ্ছে মানুষ। আবার বলছে, আপন হতে বাহির হয়ে,টয়ে একেকটা ছবি যেন একেকটা ফ্যামিলি প্যাকেজ। শুধু আমরা খাব। আমরা। আমি-বাবা-মা-বর-বস-ফেসবুক। বাকিদের মগনলাল মেরে দিক। আমাদের কি! আমরা আজ সন্ধায় কোয়েস্টে যাবই। ফুড কোর্টে গ্রুপফি তুলবই। তারপর আইনক্সে পপকর্ন কিনবই। গড়িয়াহাট মোড়ে গাড়ির কাচের উপর ভিখিরি শিশু হামলে পড়লে কুকুরের মত তাড়াবই..তারপর এসিটা হালকা করে বাড়ি ফিরে শিশুকে শেখাবই, রাস্তার ওসব ডার্টি লোকগুলোর দিকে একদম তাকাবেনা প্রমিস? বাবি??

অনেক বয়স্কদের কাছে এ কটা দিন হাঙ্গামার। জানলা বন্ধ করে তারা ধুনো দেওয়া ঘরে সন্ধায় বই পড়েন। চুপ করে। তাঁদের বয়স আশি। বাড়ির মেঝের রং লাল। তাঁরা কেউ থাকেন বাগবাজার, কেউ কালীঘাট, কেউ গড়িয়া, কেউ বেহালা। মাঝে মাঝে তাঁদের দেখতে ভালো লাগে মানুষের ভিড়। দূর থেকে। জানলা দিয়ে। সামান্য হাসেন। বহু বছর আগের মারা যাওয়া স্ত্রীর ছবির দিকে তাকান দেওয়ালে। তাঁরও প্রথম চুমু মনে পড়ে মনে পড়ে ঘুরতে যাওয়া শারদপ্রাতে অপুর সংসার-গগন ঠাকুরের ছবি সবসবসব। ঝড়ের মত নাতনি শাড়ি পড়ে ঘরে ঢুকে তাঁকে প্রণাম করে বলে, দাদাই কাম ফার্স্ট। প্রণামটা সেরে বেরতে হবে। রৌনক পাঁচটা মিসড কল দিয়ে দিয়েছে। প্লিজ, কাম কাম। এদিকে এসো।... পার্লারে সেজে ওঠা নাতনিকে আশীর্বাদ করেন দাদু এই তো আমাদের উমা! দাদু হাতে সামান্য পেনশানের টাকা গুঁজে দেন। বলেন, "দুপুরে কিছু খেয়ে নিস। তোরা কেমন?"

 || ৪ ||


প্যান্ডেল প্রায় রেডি। কোথাও সামান্য ফিনিশিং টাচ চলছে। শহর ছেয়ে গেছে হোর্ডিংয়ে। অনেক জায়গাতেই এখনও টাঙানো হয়নি বিজ্ঞাপন। কাঠের কাঠামোটা শুধু লাগানো রয়েছে। টিউবগুলো ঝুলছে। সাদা সাদা দাঁত যেন। ক দিন পরেই সেই হোর্ডিংও সেজে উঠবে পুরোপুরি। তখন হেসে উঠবে চৌমাথা। কলকাতা তখন পুরোপুরি বিয়েবাড়ি হয়ে যাবে। চলছে তারই প্রস্তুতি। সতর্কতা মেনেই চলছে। কিন্তু চলছে...

বিকেল হলেই শহরে কে ছিটিয়ে দেয় জল। শরত মুখার্জি রোডের সূর্যাস্ত। সামান্য শীত শীত করে। গোলপার্কের মৌচাকের সামনে অপেক্ষা করে কত যুবক-যুবতী। এরা কারা? যেন স্বর্গের পরিত্যক্ত প্রেমিক-সকল। যেন একবিংশ শতকের শেষতম প্রেমের বিন্দু এদের মুখে চোখে। অপেক্ষায়। ওই যে মেয়েটি বারবার ফোনের ঘড়িটা দেখছে আর ইয়ারফোনে গান শুনে চলেছে। টাইমপাস। সে ভাবছে, কখন আসবে তাঁর প্রেমিক। গড়িয়াহাটমোড় জুড়ে কত অপেক্ষা! কত অপেক্ষা দেশপ্রিয় পার্কে। রুবিতে। কসবায়। সবাই আজ ঘড়ি দেখছে আর টাইমপাস করছে গান শুনে। মোড়ে মোড়ে। কখন আসবে তাঁর প্রেমিক। কখন আসবে প্রেমিকা। একটাই প্রশ্ন। চোখেমুখের ভাষায়। একটাই প্রশ্ন, এখনও আসছে না কেন সে? কোথায় রয়েছে এখন? কোন রাস্তায়? উড়ে কি চলে যাওয়া যায় না তার কাছে??

২০২৩ সালের শরতেও খোদ কলকাতায় এভাবে রচিত হয় মেঘদূত। অপেক্ষার মেঘদূত। এই সব অপেক্ষার অবসান হলে, ওদের দেখা হলে, ছেলেটি আর মেয়েটি কোথায় যাবে? কোথায়? এত ভিড়! জন-অরণ্য! এর ভেতরেই ওরা হারিয়ে যাবে। হয়তো, উদ্দেশ্যহীন বেড়াতে বেড়াতে দেখে নেবে আগেভাগে ক'টা প্যান্ডেল। হয়তো, কসবার সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দি রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর বেলার চোখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জন দত্ত সুদূরের ডাক শুনতে পাবেন। তারপর বলবেন, চুপ করে কেন এ কি বেলা তুমি কাঁদছ! স্বপ্ন এবার হয়ে যাবে সত‍্যি...

স্বপ্ন নিয়েই তো মানুষ এ কদিন মোড়ে মোড়ে দোকান দিয়েছেন। ফুটপাতের পাশে। একরত্তি জায়গায়। একটু আয় হবে সামান্য। সবারই আশা। কেউ দিয়েছেন। সস্তা জুতোর দোকান তো কেউ সেলফোনের কভার বিক্রি করছেন। কেউ বিক্রি করছেন লাইটার আর সিগারেট। সেই লাইটার কিনে জ্বালাতে গিয়ে দেখি ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে আকাশে... শরত মুখার্জি রোডের আকাশে পিচগলা সোনা কলকাতা আনমনা হয়ে যায় তখন হিসেবি রাজনীতিকও কবিতা বলে আর কবিরা হয়ে যায় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, যতীন বাগচী রোডের ফুটপাত জুড়ে যত্ন করে কারা গাছ লাগিয়ে যান, অদরকারি ডালপালা ছেটে বড়-বড় গাছকে সুন্দর করা হয় গোলপার্কের দিকে। পুজোর আগে যতটা সুন্দর হতে পারে চারপাশ, শহর- মানুষের মন- সবারই সেটুকু চেষ্টা...

দক্ষিণ কলকাতার কাফেগুলো সন্ধ্যা হলেই জমজমাট। ড্রিফটার, এইথ-ডে কাফেতে উপচে পড়ছে যুবক-যুবতীরা। মুখোমুখি বসে, ঝুঁকে পড়ে, কি যে কথা। বলার এত নেশা। কথা-কথা-অনন্ত কথা। যতটা সুন্দর করে বলা যায় সে সব কথা তারই চেষ্টা সকলের। পাছে কেউ আঘাত না পান। রাজনীতিকরাও বিরোধী দলকে কম আঘাত দিয়ে কথা বলেন এ সময়। পুজোর মরশুম বলে কথা। কেউ আঘাত পেলে, খারাপ লাগে মানুষের। মানুষ এ সময়ে সুন্দর হতে চেষ্টা করে। আশ্চর্য! আমার পুজোর স্মৃতি গোলমেলে। বিরিয়ানি দ্রুত খেলে যেমন গলায় বেঁধে, আমারও সুখ সহ্য হয় কম। পুজোতে কোনও না কোনও ঝগড়া ও কান্নাকাটির স্মৃতি আমি দেখতে পাচ্ছি পিছন ফিরলে। কে জানে কেনা!

অথচ বারবার আমি দেখতে চেয়েছি বন্ধুতা ও সুন্দর। . কিন্তু জীবন ল্যাং মেরেছে অষ্টমির ভরা সন্ধায়। যার আসার কথা ছিল, সে আসেনি। বাড়িতে ঝগড়া হয়েছে। রাস্তায় মারামারি হতে দেখেছি। বা, অফিসের গণ্ডগোল। আরও কত কাছের মানুষের দেওয়া আঘাত বা পিঠে ছুরি। কিছু না কিছু একটা কষ্ট আমায় ঢাকতে হয়েছে এ মরসুমে। খলবলে রক্তের উপর লাগাতে হয়েছে ব্যন্ডেজ। বিয়েবাড়িতে ঝগড়া হলে যেমন সুর কাটে, কিছু-না-কিছু কেটে দিয়েছে আমারও সুর, বারবার। তাই আজকাল ভয় করে, এ সময়টা এলেই। যতই ভালো লাগুক, ভয়টাও পিছু ছাড়ে না। যে সুন্দর বা সুখের কথা বলছিলাম, মানুষ যে সুন্দর খোঁজে থাকতে চায় এ সময়ে বলছিলাম, তার পিছনেই যেন দাঁখ নখ নিয়ে লুকিয়ে থাকে এই সব পুজোর খারাপ স্মৃতি, অপবাদেরা, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসবে.....

তবু ইচ্ছে করে মানুষকে বিশ্বাস করি। তবু তো অপেক্ষা মোড়ে মোড়ে। লাইটিং। মানুষের ভিড়। রোলের দোকানে ডেকচিতে টং করে শব্দ করল হাতা। জমে উঠেছে বাজার। দুঃখগুলোকে আদর দিয়ে আড়াল করেই। বেজে উঠেছে শহর, এবারেও। এত অন্ধকার, এত খিস্তির দলা, এত মারের উপর দিয়েও নন্দিনীকে রক্তকরবী এনে দিচ্ছে রঞ্জন। আমরা যাইনি মরে আজও। তাই পুজোর এক হপ্তা বাকি, তার আগেই নতুন জামার গন্ধ কলকাতার আকাশে। মানুষ মানুষের সাথে হাত ধরে কথা বলছে পাঁচ মাথায়। কত কথা! ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়েছে সদলবলে মানুষ, মুখে মাস্ক পরেই পুরোনো স্কুল কলেজের বন্ধুরা একে অপরকে লিখছে, বিকেলে কি করছিস?

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment