1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

চন্দ্র সেনের চাঁদমারি



চন্দ্র সেনের চাঁদমারি

তরুণকুমার মুখোপাধ্যায়


চন্দ্রবাবু হঠাৎ ইজিচেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। কেন জানি না ওঁর এখন কেবলই থেকে থেকে মনে হচ্ছে কিছু একটা করা দরকার , যা দিয়ে লোকে তাঁকে এক নামে চিনবে। তিনি যদিও চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। সেই বত্রিশ বছর বয়স থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আজ সাতান্ন বছর তিন মাস একুশদিনের সকালেও কিছু করে দেখানোর আশা ছাড়েননি। সবসময় একটা চাপা উদবেগ। বড়ো মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে চুঁচড়োর এক বনেদি ঘরে সেখানেও তো তাঁর একটা সম্মানের প্রশ্ন আছে!

অফিসেও সকলেই প্রায় জানে চন্দ্রবাবু একজন দার্শনিক গোছের লোক---অথচ আজ সকাল থেকে মহা ভাবনায় পড়লেন চন্দ্রবাবু ।

রোজই যদিও ভাবনায় পড়েন তবে আজকের মতো অমনভাবে ইজিচেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন না। গেল হপ্তায় প্রতিবেশী আদ্যনাথ আঢ্য অবিশ্যি একটা সমাধানের সূত্র বাৎলেছেন, এক সপ্তাহ ধরে সেটাই ট্রাই করে চলেছেন ভদ্রলোক। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে পদ্য লিখতে বসে পড়েন। কাক-এর সঙ্গে ঝাঁক, চুলোর সঙ্গে ধুলো ইত্যাদি দু-চারটে এইরকম লিখেও ফেলেছেন কিন্তু আজ ভোরে যেন এসবেও এসবেও শান্তি পাচ্ছেন না।   

বারান্দায় এসে দেখেন ছোটো মেয়ে কবিতা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। চন্দ্রবাবু উদ্বিগ্ন চিত্তে মেয়ের কাছে কান্নার কারণ জানতে চাওয়ায় মেয়ে বলে তাদের স্কুলের কবি দিদিমণি ক্লাসে সবাইকে নিজের বা একালের কবিদের কবিতা লিখে এনে পাঠ করতে বলেছেন। চন্দ্রবাবু বললেন, ‘তাতে আর ভাবনা কী আমারই তো বেশ কিছু ইয়ে আছে… নিয়ে গিয়ে শোনাস দিদিমণিকে। নাম করা কবিদের কবিতা তো সবাই শোনাবে তুই না হয়…' বেশ তৃপ্তি পেলেন ভদ্রলোক।

অফিস যেতে ভালো লাগে না আজকাল । সেজন্য অফিস থেকে দিনকুড়ির ছুটি নিয়ে নিয়েছেন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে।অবসরের সময়ও এগিয়ে আসছে হামাগুড়ি দিয়ে। প্রচুর ছুটি জমে আছে। সব নষ্ট হওয়ার থেকে নিয়ে নেওয়া ভালো। বাড়ির পশ্চিমদিকের ব্যালকনিতে ইজিচেয়ার পেতে রেললাইনের প্যারালালে রেল কোম্পানির লম্বা ঝিলে ফলে থাকা পানিফলের শোভা দেখতে দেখতে শ্রীযুক্তবাবু চন্দ্র সেন মহাশয় ছন্দ মেলাতে থাকেন। ছুটির বেলা বলেই বোধহয় বেলা আট্টা থেকে শুরু করেন। বেলা দেড়টায় রমলাদেবী চন্দ্রবাবুকে ভাত খেতে ডাকেন। চন্দ্রবাবু নিবিড় মনঃসংযোগে মেলাতে থাকেন ছন্দ।

        ভোরবেলা আর একটা কাক

        কাকচান সেরে পাড়ছে হাঁক

        একখানা হাঁস সারাবেলা

        মাছেদের সাথে জলখেলা

        মাছরাঙা ওই ডাল থেকে

        মাছ তুলে নেয় ছেঁকে ছেঁকে

        এক বাবুইয়ে ঘাস গোনে

        তালবনে গিয়ে বাসা বোনে

        পড়ুয়ারা সব বই কাঁধে

        ইসকুলে গিয়ে রাখি বাঁধে 

        এক ছোকরা বাঁশঝাড়ে

        ডুগি-তবলা নিয়ে ঘাড়ে

        বাজিয়ে চলে সারাটা দিন

        সে এক স্পেকটাকুলার সিন।

একটু লিখেই একটা তৃপ্তির হাঁপ ছেড়ে সামনে তাকাতেই দেখেন রমলাদেবী থমথমে অথচ মাংস কাটার চপারের মতো ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলেছেন দুহাত কোমরে রেখে। অতিষ্ঠ রমলাদেবী কখন নিঃশব্দে চলে এসেছেন ব্যালকনিতে। প্রবল প্রতাপান্বিত প্রলয় আসন্ন। অথচ চন্দ্রবাবু সেসব আমল না দিয়ে নিজের সৃষ্টির আনন্দ ভাগ করে নিতে অবোধ সরল শিশুর মতো খিলখিলিয়ে উঠে বলেন, 'গিন্নি, শোনো' বলেই গড়গড় করে কাব্যের পংক্তি কটি আবৃত্তি করেন, 'শেষের লাইনটা ভাব কী অসামান্য আর অভিঘাতী, স্পেকটাকুলার সিন, আহা এখানে প্রকৃতি আর মানুষের ছন্দবদ্ধ জীবনযাপনের অমোঘ ছবি ফুটে উঠেছে, কী বল!' রমলাদেবী হাড়হিম করা বরফ-দৃষ্টিবাণ চন্দ্রবাবুর শ্রীমুখ থেকে সরিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে নিঃক্ষেপ করলেন, বেলা আড়াইটে বেজেছে তাতে। তারপর প্রথমে চাওয়া-চাওয়ি তারপর মুখোমুখি ক্রমে চাপান -উতোর আর শেষে হাতহাতি। চলছে চলবে। 

এইভাবে সাড়ে তিনদিন নিবিড় কাব্যচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন ভদ্রলোক। একের পর এক কালজয়ী কাব্য রচনা করে চলেছেন তিনি, অবশ্যই ওঁর নিজের উপলব্ধি এটা। বাইরের সমস্ত তমগুণসম্পন্নদের মস্তিষ্ক থেকে পত্রপাঠ বিতাড়িত করেছেন। কিছু একটা করে দেখাতেই হবে, কেননা এক-পা এক-পা করে গুঁড়ি মেরে বড়োমেয়ে সবিতার বিয়ের দিনও এগিয়ে আসছে। 

গেল শনিবার ছেলেবেলার বন্ধু কাম প্রতিবেশী আদ্যনাথ আঢ্য সন্ধে সাড়ে সাতটায় গাধাপেটাপেটি খেলতে এলেন। তাসের এই খেলাটাই দু-বন্ধুতে প্রবল অনুরাগের সঙ্গে খেলে থাকেন আর উপভোগও করেন শিশুর মতো আনন্দে ডুবে গিয়ে । ওঁদের মতে এই খেলা নাকি বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ ঘটায়। যদিয়ো এর সমর্থনে কোনো ব্যাখ্যাই দুজনের কেউই দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। অবিশ্যি অন্যেরা এর একটাই কারণ আবিষ্কার করেছে, তা হল, এছাড়া তাসের আর কোনো খেলাই ওঁদের জানা নেই। ছোটোমেয়ে কবিতা কতবার বলেছে ও বন্ধুদের থেকে তাসের যে খেলাগুলো শিখেছে--- গোলাম চোর, টোয়েন্টি নাইন কিংবা ফিস শিখিয়ে দেবে কিন্তু ভদ্রলোকের এক গোঁ ওই খেলাটাই দ্য বেস্ট।

সে যাইহোক, গাধাপেটাপেটি খেলতে এসে আঢ্যিবাবু একটা দামি উপদেশ চন্দ্রবাবুকে দিয়েছিলেন। সেটা হল যা দেখা যাবে বা শোনা যাবে সমস্ত কিছু থেকেই ক্ষীরটুকু স্ক্যান করে মাথার হার্ড-ডিস্কে তুলে রাখতে হবে। এগুলোই নাকি কবিতা লেখার বিশেষ উপাদান হতে পারে । আর এভাবেই নাকি মহাকবি বিশ্বকবিরা এগিয়ে গিয়েছেন সামনের দিকে বিস্তর বাধা অতিক্রম করে।

রমলাদেবী সন্ধেবেলা ঘরে ঢুকে দেখলেন চন্দ্রবাবু একমনে চোখ বুজে লাফাচ্ছেন আর নিজের মনে কী সব বকে চলেছেন বিড়বিড় করে। পাশে খুব মিহি ভল্যুমে চলছে মিউজিক চ্যানেলে উন্মত্ত নৃত্য সহযোগে গান । রমলাদেবী চায়ের কাপ নিয়ে এসে স্তব্ধবাক, রিমোট হাতে নিয়ে ভাবলেন মানুষটার মাথার ব্যামো-ট্যামো হল না তো। রিমোট অফ করতেই আরও তেত্রিশ সেকেন্ড লাফিয়ে ভদ্রলোক চোখ খুলেই বললেন, ‘এসবই কাব্যচর্চার উপাদান বুঝলে’। রমলাদেবীর চোখে তখন তন্দুরের আঁচ। ‘চা রইল’, বলে ধপধপ করে বেরিয়ে গেলেন। চন্দ্রবাবু থ। ভাবলেন বুঝি, কেন যে এরা প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সহমর্মী হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ায় না!  

চায়ে শেষ চুমুক দিতেই ছোটো মেয়ে কবিতা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঘরে ঢুকেই ভদ্রলোকের সামনে খুলে ধরল দুটো পত্রিকা। একটা স্কুলের অন্যটা শহর গ্রন্থাগারের । একঝলক চোখ বোলাতেই ভদ্রলোকের চোখ গোল গোল হয়ে গেল। তাঁরই পদ্য, শুধু কবির নাম তাঁর জায়গায় কবিতা সেন।

‘এ কী হয়েছে! জান একে চুরি বলে?’ মেয়ের দিকে সহায়-সম্বলহীন অনাথ চাউনি চন্দ্রবাবুর ।

‘চুরি!কোথায়!তুমিই তো বলেছিলে কবিতাগুলো নিতে।’ সপাট ফুলটস শট ছোটোমেয়ের।

‘সে তো কবিদিকে শান্ত করতে।’ চন্দ্রবাবুর আবার মন ভেঙে যেতে শুরু করল। মন ভেঙে যাওয়ার মড়মড় আওয়াজ স্বকর্ণে যেন তিনি শুনতে পাচ্ছেন। আর বোধহয় তাঁর বিশেষ ইয়ে ধরনের লোক হয়ে ওঠা হল না।

কিন্তু না, ছোটোবেলায় বাবার মুখে শোনা বিবেকানন্দের বাণী---ওঠো, জাগো, কাজ করো ক্রমান্বয়ে খোঁচা দিয়ে চলেছে মনের ভেতরে। দ্বিতীয় মন তখন দরবেশী ফকির, বলছে--- এ ছার সংসারের কপট মায়া থেকে বেরিয়ে আয় দারা, কন্যা কেউ কারোর নয়। এই সেদিনের দুধের মেয়ে কবিতা পর্যন্ত তাঁকে ভাঙিয়ে নাম কিনতে শিখেছে! তাঁর যদি মোটা মাইনের সরকারি চাকরিটা না থাকত রমলা তখন শহরের অমলা কমলা বিমলার মতো অমল ধবল পালে মন্দমধুর হাওয়া খেতে খেতে ভেসে বেড়াত। চন্দ্রবাবুর মুখটা তেতো হয়ে গিয়েছে। বড়ো দুঃখে তিনি খান খান হয়ে যাচ্ছেন। কেউ বুঝতে চাইল না তাঁর অন্তরের অন্তরতম বাসনাকে।

খবরে প্রকাশ চন্দ্রবাবু অফিস জয়েন করেছেন। কিন্তু সাহিত্যের ছারপোকা তাঁকে ছাড়েনি। সবসময় যেন কবিতা নিয়ে গভীর তাত্ত্বিক চিন্তায় বিভোর। ছন্দে ছন্দে চলছেন বলছেন। এই তো সেদিন রবিবারের বেলা সাড়ে আট্টার সকাল, মেয়েরা কেউ বিছানা ছাড়েনি তখনও, একতলার বারান্দায় বসে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই শুনলেন, 'বাবু কেমন আছেন, ভালো?' খড়খড়ে গলার ডাকে সম্বিত ফেরে ভদ্রলোকের। দেখেন ঝাঁকা মাথায় একজন সদরে দাঁড়িয়ে। চিনি চিনি করি তবু চিনিতে না পারি গোছের মুখ করে ধাঁ করে বলে বসলেন,  

'আমি তো আছি ভালো, 

সেদিন তোমার তালপাটালির রং ছিল বেশ কালো

ফ্রেশ দেখে পাটালি তুমি দিয়ো

ন্যায্যমূল্য যা লাগে তাই নিয়ো।'

তালপাটালিওয়ালা ঝাঁকাটা মাথা থেকে উঠোনে নামিয়ে কাঁচুমাচু মুখে বলল, 'বাবু এত বছর ধরে পাটালি খাওয়াচ্ছি কোনোদিন তো মা-ঠান এমন কথা কননি, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তালের রস জ্বাল দিয়ে পাটালি বানাই।' এরপর চন্দ্রবাবু আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ততক্ষণে পরদা সরিয়ে রমলাদেবী এনট্রি নিয়েছেন, 'তোমার বাবুর বায়ু চড়েছে, ব্যামো ব্যামো, তাই আমসত্ত্বর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন, তুমি বরং দেড় কেজি মতো দিয়ে যাও।' চন্দ্রবাবুর মুখটা শুকিয়ে যাওয়া কুমড়ো ফুলের মতো ঝুলে পড়েছে। কী অপমান! আর সয় না, এই মহা বিশ্বে তিনি একা, কেউ কারও নয়। ছোটোবেলায় ইসকুলের বাংলা মাস্টার কুশধ্বজ করমহাপাত্রের বাণী মনে পড়ে গেল — 'যা ভালো মনে করবে সদর্পে করবে, কারও মতামতের ভিত্তিতে সৃষ্টি আসে না, তোমার নিকটাত্মীয় তোমার বাধা হয়ে দাঁড়াবে, আর সে বাধা কাটিয়ে বেরোনোর ক্ষমতা তোমাকেই প্রদর্শন করতে হবে দৃঢ়চিত্তে।'

সকালের এই তাজা হাওয়া তাঁর উপভোগ করা হল না। ভদ্রলোক দোতলার পশ্চিমের ব্যালকনিতে পেতে রাখা ইজি চেয়ারে বসতে গেলেন, কেননা ওঁর কেমন জানি মনে হচ্ছে কিছু শব্দ পংক্তি আকারে মাথার ভেতর ছোটাছুটি করছে। সৃষ্টি আসছে।

সকালে বাজারের ব্যাগ হাতে বেরোন গেট খুলে। বন্ধ করার বালাই নেই। ফেরেনও সেভাবেই। বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে রেখে হাতটাত ধুতে ভেতরের উঠোনে সবে পা রাখেন, তখনই ঝাঁইঝাঁই চিৎকার রান্নাঘর থেকে---গেলাব যে, কী পিণ্ডি গেলাব? সাড়ে আট্টার সময় বাজার ফেলে দিয়ে গেলেন, মুখে কথাটি নেই যেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার দাদু নবাব আলিবর্দি খাঁ। বাড়িতে দেড়শো হুকুম তামিল করবার বাঁদি আছে।থাকার মধ্যে তো আমি একটা বিনিপয়সার বাঁদি---এসব তো রোজই প্রায় লেগেই আছে। কিন্তু সেদিন কেন জানি চন্দ্রবাবু ঘাবড়ে গেলেন।

রমলাদেবী ছুটছেন যেন ফরসা মা-কালী। এক হাতে চাটু ধরার চিমটে আর অন্য হাতে স্টিলের খুন্তি নিয়ে। বোধহয় রুটি করছিলেন টিফিনের জন্য।

ভদ্রলোকের মুখের সামনে চিমটেটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘গুষ্টির পিণ্ডি কাকে গেলাব শুনি। ছশো চুনোমাছ আর দু-আঁটি হিংচে শাক---চরতে বেরিয়ে বেলা সাড়ে আট্টায় এই বাজার! ঘরে না আছে আনাজপাতি না আছে অন্যকিছু। কাব্যচর্চা হচ্চে, নুড়ো জ্বেলে দিই অমন কাব্যচর্চার মুখে। বলি বংশে কে কবে পদ্য লিখেছে শুনি।'

চন্দ্রবাবু দুঃখে এতটুকু হয়ে গেলেন। বংশ তুলে কথা! তার ওপর কাব্যচর্চায় নুড়ো জ্বালানোর মতো জ্বালা ধরানো বাক্যবাণ। প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। কিন্তু ফেটে পড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে ছোটোবেলায় শোনা বাবার একটা উপদেশ মনে পড়ে গেল---সহ্যই উচ্চাদর্শের প্রধান অবলম্বন। ব্যাস, বৃষ্টিতে পাতকোর পাড়ে খয়েরি বেড়ালটার মতো চন্দ্রবাবু ভিজতে লাগলেন রমলাদেবীর জ্বালাময়ী ভাষণে। মেয়েদুটোও যেন যা-তা তৈরি হয়েছে।বড়োমেয়ে নিশ্চয়ই দোতলার ঘরে হবু জামাইয়ের সঙ্গে ফোনে ফাটিয়ে গল্প করছে। উফ!গতমাসে ল্যান্ড ফোনে বিল তুলেছিল দশ হাজার তিনশো কুড়ি টাকা। আরে বাবা আর আড়াই মাস পরে তো বকবকম বকবকম এমনিই করবি। তা বকর বকর যদি করবিই তবে নিজের মোবাইল ফোনে কেন করিস না, তা নয় মতলবখানা এই যে বাবার থেকে যেভাবে যতটা টেনে নেওয়া যায়। ওই টাকায় কিছু না হলেও বোর্ড-বাঁধাই করা তিন-ফর্মার প্রায় পাঁচশো কপি বই হয়ে যেত। ছোটোটা তো আরও এককাঠি ওপর দিয়ে চলে। যেই শুনেছে ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে অমনি নিজের ঘরের জানলা দরজা বন্ধ করে তারস্বরে সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ পড়তে শুরু করেছে। ওরে তোদের বাবার পতন একেবারে সমুখে শমনরূপে সমন হাতে এসে দাঁড়িয়ে আছে ---আর উপযুক্ত মেয়েরা কিনা মজা দেখছে। চন্দ্রবাবু অসহায় চোখে একবার রমলাদেবীর দিকে তাকাচ্ছেন আর চোখ নামিয়ে নিচ্ছেন। রমলাদেবী যেন মহিলা সব্যসাচী। দু-হাত অবিরাম চলছে। চশমাটা খুলে পকেটে নিয়ে নিলেন ভদ্রলোক কেননা হাল -ফ্যাশনের চশমাটা সদ্য একুশদিন হল পাড়ার জগমোহন অপটিক্যালস থেকে বানিয়ে এনেছেন সাড়ে তিন-হাজার টাকা খরচা করে। এর জন্যেও কি কম কথা শুনতে হয়েছে! বুড়ো বয়সে সখের রংমশাল জ্বলছে, কাত্তিকটি সেজে কোথায় যাওয়া হবে শুনি ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েরা বলেছিল, বাবা নিজের নিয়েই থাকে মেয়েদুটোর ভালোমন্দর দিকে কোনো নজরই নেই। চন্দ্রবাবু জানেন এসবকিছু দামি মোবাইল কিনে না দেওয়ার ঝাল। সেই ছোটোবেলায় ভদ্রলোক সাড়ে তিনমাস এনসিসি করে ছিলেন। প্যারেড সাবধান ! মনে পড়তেই ভদ্রলোক ভাবলেন আজ কঠিন পরীক্ষা। তখনও রমলাদেবী বিপুল উদ্যমে মঞ্চ মাতিয়ে চলেছেন, ‘মেয়েদুটো যে তরতর করে বাড়ছে সে খেয়াল নেই, উনি পদ্য লিখছেন। সংসারে কুটোটি নাড়া নেই, অফিস যাওয়া নেই--- চুলোর দোরে যাক অমন লেখা। যত্তসব ধাস্টামো’।

না!আর দেরি করা ঠিক হবে না। মনে মনে চন্দ্রবাবু তিন গুণে নিয়ে বললেন, তে চল্ । একই জায়গায় তিনবার মার্চ করে যেই পা-টা উঠোন থেকে ঘরে ঢোকার একটিমাত্র ধাপে রাখতে যাবেন, ধপ্…পাস! হলুদ হলুদ ফুল তারপর অন্ধকার।

চারদিকে কেমন চাপা গমগমে ভাব। পাখা চলছে ফুলস্পিডে। পাড়ার ভোলা ডাক্তার বলছে ‘ইট ইজ্ আ কেস অফ…’

ও! ওরা তাহলে ভালো ডাক্তার ডাকেনি। চোখ চেয়ে দেখেন সব ঝাপসা। একটু পরিষ্কার হতেই প্রথমেই চোখ পড়ল খাটের উল্টোদিকে ঠিক তাঁর পায়ের সামনেই পাড়ার সবচেয়ে অপয়া বলে খ্যাত শনি সামন্তের দিকে। শনিবার মুখোমুখি কথা বলা মানেই পক্ষকালব্যাপী পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা হয়ে যাওয়া। পাড়া বে-পাড়া মিলিয়ে সবাই এটা জানে ও মানে। ভদ্রলোকের আসল নাম ফনিভূষণ হারিয়ে গিয়েছে। একঝুড়ি মুখ আর দেড় ঝোলা ঠোঁট নিয়ে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘চাঁদু এ তোর ভারি অন্যায়। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধটাকেও প্রশমন করতে হবে বইকি। রাগ হল গিয়ে চণ্ডাল বুঝলি।'

‘ও মা! ওরা পাড়ার লোকের কাছে কী বলেছে! এ তো দাদা দিদির ডিগবাজির চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার। পাড়ার প্রায় সবাই ঘিরে রয়েছেন। ভোলা ডাক্তার খড়াত করে প্রেসক্রিপশন ছিঁড়ে খয়েরগোলা পানমশলা খাওয়া ছোপছোপ দাঁত বের করে রমলাদেবীকে বললেন ‘পেশেন্ট যেন কোনোমতে পেশেন্স না হারায়, আর এখনই অপরূপা এক্স রে ক্লিনিকের ফোন নম্বরে কথা বলে নাও ব্যাঁকার সঙ্গে, নম্বরটা এই এখানে লিখে দিয়েছি ও ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চলে আসবে যন্ত্রপাতি নিয়ে। রিপোর্ট রাতে বা কাল সকালে দিয়ে দেবে।মেয়েদের মধ্যে কেউ গিয়ে নিয়ে এসে চেম্বারে দেখিয়ে গেলেই হবে’। রমলাদেবী কিন্তু কিন্তু মুখে বলেই ফেললেন ‘ওর নাম ব্যাঁকা!’ একসেকেন্ড থমকে গিয়ে ভোলা ডাক্তার রাবনের মতো হাড়কাঁপানো হাসি ছড়িয়ে মুখ থেকে একরাশ পানমশলার গুঁড়ো বিলিয়ে বললেন ‘বঙ্কুবিহারি, আমরা ডাকি ব্যাঁকা, ভয় নেই মা ছবি তোলে অপূর্ব’।

হাড়পিত্তি জ্বলে গেলেও কিচ্ছুটি করবার নেই। চন্দ্রবাবু মুখে বললেন পদ্য লেখা ছেড়ে দেব।

 রিপোর্টে জানা গেল কোমরের হাড়ে সামান্য চিড় ধরেছে। মাসতিনেক বেডরেস্ট। অফিস থেকে দফায় দফায় লোক আসছেন খোঁজখবর নিতে। রমলাদেবী বেশ প্যাঁচে পড়েছেন, মনে মনে ভাবছেন কেন যে সেদিন অত রাগারাগি করতে গেলেন, চার আনার কেত্তন গাইতে গিয়ে পাঁচসিকের খোল ভেঙে বসে রইলেন। দশগুণ কাজ বেড়ে গেল ভদ্রমহিলার । ভিজিটরদের শুধু-মুখে তো আর ফেরানো যায় না নিদেন পক্ষে এককাপ চা দুটো থিন অ্যারারুট বিস্কুট তো দিতেই হয়। প্রতিদিনই যদি বিভিন্ন সময়ে ভিজিটর আসতে থাকে তবে তো পেরে ওঠা শিবেরও অসাধ্যি। সবিতা অবিশ্যি একটা জব্বর উপায় বাৎলেছে নার্সিংহোমের মতো বাড়ির সদরেই ভিজিটিং আওয়ার লিখে টাঙিয়ে দেওয়া হবে। অনুমান করে এক গামলা চা করা হবে আর মদনার দোকান থেকে কাগজের কাপের বান্ডিল এনে রাখা হবে।     

সেদিন ‘ঝাঁপাঝাঁপি’ পত্রিকা চালান অফিসেরই এক কোলিগ এসে বললেন, ‘দেশের অবস্থার হেব্বি ঘোলা চন্দ্রদা। কবিতা নয় কঠিন কঠোর গদ্যের কষাঘাতে ছিন্নভিন্ন করতে হবে প্রতিপক্ষকে’।

-- প্রতিপক্ষ কে?

-- যারা আমাদের মত মানে না।

-- তোমাদের মতটা ঠিক কী?

-- সেটা রোজই ঠিক করেন আমাদের নীতিনির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান।

-- তোমাদের নীতি কি রোজই পাল্টায় ?

-- মূলত তাই, তবে দেশে যে সন্ত্রাস চলছে তা রুখতে আমরা বদ্ধপরিকর। প্রয়োজনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে সন্ত্রাস রুখব। কেবল রাজ্য নয় একইসঙ্গে আমরা দেশের ভারও নিতে জানি। চন্দ্রদা লিখুন গর্জে উঠুন…

-- আমার এখন বেডরেস্ট ভাই।

কোলিগ ভদ্রলোক আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় রমলাদেবী হাতে ওয়াইপস আর বেডপ্যান নিয়ে মিষ্টি করে হেসে ঘরে ঢুকে বললেন ‘ওগো শুনছ, তোমার তো এবার ওই করবার …।' নিমেষে ঘর ফাঁকা। চন্দ্রবাবু কৃতজ্ঞ রমলাদেবীর প্রতি। মনে মনে রমলাদেবীর এই মিষ্টি ব্যবহারের জন্য পঁচিশ পয়সার ক্ষমা দিলেন।

সবে সপ্তাহখানেক কেটেছে। একদিন সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় ছোটোবেলার বন্ধু প্রতিবেশী আদ্যনাথ আঢ্য এসে বললেন ‘শুনলাম পদ্য লেখা নাকি ছেড়ে দিচ্ছিস?’  

-হ্যাঁ

-বেশ এবার আমি তোকে কতগুলো তথ্য দিয়ে দেব শুধু সময়মতো সাপ্লাই দিয়ে যাস। ছোটবেলায় জীবনীগোছের রচনা লিখেছিস তো, সেরকমই আরকি।

-ব্যাপারটা আর একটু খোলসা কর দিকি। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছে। আর কোনো লঘুমাত্রার জীবনযাপন আমার কাম্য নয়। মানবসেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দিতে চাই। আমার সংসার হোক বিশ্বসংসার যেখানে বিশ্বমানব গড়ে তুলবে এক মিলনমেলার পীঠস্থান। আচ্ছা তুই কি মহপুরুষদের জীবনকথাজাতীয় কিছু…। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু উত্তেজনার মাত্রা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে ডানপাশে কাত হয়ে পড়েছিলেন তারপরেই কোকিয়ে উঠলেন।

-হয়েছে হয়েছে এতেই হবে। এত উত্তেজনার কী আছে? শুধু খোঁজ নে এলাকায় নামজাদা লোক কে কে আছেন যদি সেভেনটি ফাইভ আপ হয় তবে সংগ্রহ করে রাখ।অবিচুয়ারি লিখতে হবে।

-মানে?

-মরে গেলে খবরের কাগজে দেখিস না জীবনী।

‘অ্যাঁ, সেকি!’ চন্দ্রবাবু নাক কুঁচকে বলেন।

-একটা ল্যাপটপ কিনে ফেল। যেই খবর পাবি কেউ টপকাল অমনি কী-বোর্ডে টক-টক-টক-টক, ইমেলে পাঠিয়ে দিস ছোটো বড়ো সমস্ত কাগজে।    

-এটা কেমন যেন কশাই কশাই। কে কবে মরবে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা। যেন সে গেলেই আমার প্রাণ পাওয়া।

-এটাই তো জগৎ-সংসারের প্রাগৈতিহাসিক কালের নিয়ম রে চাঁদু। দেখছিস না পৃথিবীজুড়ে জাতপাত ভাঙিয়ে দুম-দাড়াক্কা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে যখন তখন । দেশাত্মবোধের নামে লাখ লাখ লোকে কাটাকাটি করে মরছে। ওই মৃতদেহগুলোর মধ্যে থেকেই বিলাসব্যাসনে বেঁচে থাকার রসদ পাচ্ছে পৃথিবীবিখ্যাত যুদ্ধবাজেরা। আর তুই তো মানুষ মারতে যাচ্ছিস না অপেক্ষা করছিস মাত্র।

-তথ্য পাব কোথায়?

-আমার কাছে আপাতত পাঁচজনের আছে একজন বে-আইনি অস্ত্র-ব্যবসায়ী, একজন প্রভাবশালী দাঙ্গাবাজ, দুজন দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে দেশ-পালানো ধড়িবাজ প্রতারক ব্যবসায়ী আর একজন লেখক।

-সবাই পঁচাত্তরের ওপর?

-না কেউই না

-তবে!

-তবের কিছু নেই চাঁদু, অনেক ভেবে মাথা খাটিয়ে এদের তথ্য জোগাড় করেছি। প্রথম চারজনকে জনগণ কিছুদিন পর তাড়া করে ছুটিয়ে কুকুরের মতো মারবে । আর শেষজন একজন সৎ ও নির্ভীক লোক। সমাজের প্রকৃত ছবি লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তাঁকে মিডিয়া আর প্রভাবশালী মহল একঘরে করে পচিয়ে মারবে। আগেভাগে তৈরি কর দিকি বরাত খুলল বলে। 

চন্দ্রবাবু মহাখুশি। আঢ্যিবাবুর দেওয়া তথ্যগুলো থেকে গুছিয়ে জীবনী লিখে ফেলেছেন। ছোটোমেয়ে কবিতা পাতা আর রিফিল কিনে আনছে আর চন্দ্রবাবু শুয়ে শুয়েই ক্লিপ আঁটা কার্ডবোর্ডে পাতা আটকে লিখে চলেছেন। ইতোমধ্যে বাড়িতে ল্যাপটপ চলে এসেছে। সবিতা টকাটক কমপোজ করে চলেছে আর পাঠিয়ে দিচ্ছে কাগজের অফিসে। কখনও অনলাইন পত্রিকাতেও পোস্ট করে দিচ্ছে। এর মধ্যে আঢ্যিবাবুর দেওয়া নামগুলো থেকে প্রথম তিনজনের জীবনী তিনটে কাগজে আর চারটে অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত। এছাড়া ইন্টারনেট থেকে তাঁর পছন্দসই ব্যক্তিত্বগণের তথ্য জোগাড় করে দিচ্ছে বড়োমেয়ে। তুমুল ব্যস্ততায় বাড়ি একেবারে তোলপাড়। রমলাদেবী খবরের কাগজে আর ল্যাপটপ স্ক্রিনে লেখক হিসেবে স্বামীর নাম দেখে বেশ ফুরফুরে। চন্দ্রবাবু মনেমনে একটু উদার হওয়ার চেষ্টা করলেন। সবাইকে একটা চান্স দিয়ে এবারের মতো ক্ষমা দিলেন। একটু আহ্লাদিত হলেন এই ভেবে মেয়ের হবু শ্বশুরকুলের সামনে তাঁর একটা পোজিশন হল। 

এত লেখা লিখলেও, খবরে প্রকাশ, ভদ্রলোক অফিস যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়েছেন। তবে অবিচুয়ারি ফোল্ডারের ভেতরে প্রথম ফাইলে নিজের জীবনী ভরে রাখতে ভোলেননি ভদ্রলোক, কেননা ওঁর কেন জানি মনে হয়েছে, ঘরে বাইরে কখন কী ঘটে যায় বলা তো যায় না। 

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment