1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

শিপ্রার মৃত্যু রহস্য

ছবি : ইন্টারনেট

শিপ্রার মৃত্যু রহস্য 

দীপালি ভট্টাচার্য 

শিপ্রাকে দাহ করে শূণ্য ঘরে ফিরে এলো অনিমেষ। তিন দিনে সে পুলিশি জেরায় বিধ্বস্ত! কিন্তু যেহেতু সে বাড়িতেই ছিল না,  তাই তার উপর ওঠা শিপ্রাকে হত্যার অভিযোগ এখনো টেকেনি! যদিও পুলিশ সন্দেহের তালিকা থেকে ওকে বাদ দেয় নি! কিন্তু অনিমেষের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই!  শিপ্রার মৃত্যুটা  আত্মহত্যা মনে হত যদি  কোন সুইসাইড নোট রেখে যেত শিপ্রা। আঁতিপাঁতি খুঁজেও কোন নোট পায়নি পুলিশ। আর শিপ্রার মোবাইলটাও কোথাও পায়নি পুলিশ। তাহলে কি দুর্ঘটনা? শিপ্রা ভাঙা পাঁচিলটার উপর প্রায়ই বসত। বারণ করলেও শুনতো না!

তবে পুলিশ বাড়ির কাজের লোক বিন্তি পিসিকে ধরে নিয়ে গেছে। পুলিশের মতে সেই শেষ জীবিত দেখেছে শিপ্রাকে। বিন্তি পিসি বলেছে, সে চলে যাবার সময় ছাদে যায়। সে সময় শিপ্রা ছাদের দরজার দিক থেকে পিছন করে ভাঙা পাঁচিলে বসেছিল। বিন্তি পিসি তাকে ডেকে বলে, দোরটা দিয়ে দিতে। তখন শিপ্রা মোবাইলে খুটখুট করছিল। পুলিশের মতে, বিন্তিপিসি যখন ডাকতে যায় অসাবধানতায় শিপ্রা পড়ে যায়। তাই ভয়ে সে সময় সে পালিয়ে যায়! তবে অনেকেই মনে করছে বিন্তি পিসি দোষী নয়। তাকে অযথা ফাঁসানো হচ্ছে। অনিমেষই আসল কালপ্রিট। আবার অনেকে মনে করছে বিন্তি পিসির সাহায্যে সে কিছু করেছে।

তিনদিন বাদে আজই মোবাইল খুলল অনিমেষ। হোয়াটস্ অ্যাপ ম্যাসেঞ্জারের ম্যাসেজগুলোতে চোখ বোলাচ্ছিল অনিমেষ। কেউ ছি ছি করছে, কেউ লিখেছে তুমি নির্দোষ হলে পাশে আছি। কাগজে তো রোজই বেরোচ্ছে না, 'শিপ্রার মৃত্যু রহস্য'।

হঠাৎ ম্যাসেঞ্জারের একটা ম্যাসেজে চোখ আটকে গেল অনিমেষের। কে, কে লিখছে? শিপ্রা লিখছে! কিভাবে?

শিপ্রা : তুমি আমাকে মেরে ফেললে অনিমেষ! আমি তোমাকে ভালবেসে ছিলাম! ভেবেছিলাম তুমিও আমাকে ভালোবেসেই সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিলে। পরে বুঝতে পারলাম ওটা তোমার হঠকারিতা! 

অনিমেষ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ম্যাসেজের দিকে! শিপ্রা কিভাবে লিখছে! সে তো নেই! আর ফোনটাও....

তবে কি অন্য কেউ লিখছে..কিন্তু ..!

 অনিমেষ: আপনি কে? কি আবোল তাবোল বলছেন!

শিপ্রা: আমি শিপ্রা,  ঠিকই বলছি।

অনিমেষ: আমি  বাড়িতে ছিলাম না! পুলিশও জানে সেকথা!

শিপ্রা: তুমি বাড়িতে এসে আবার ফিরে গেছ চন্দননগরে!

ম্যাসেঞ্জারে ক্রমাগত টাইপ হচ্ছে। এক অমোঘ আকর্ষণে যেন আচ্ছন্ন অনিমেষ! কিছুতেই ম্যাসেঞ্জার থেকে চোখ সরাতে পারছে না!

শিপ্রা: আমি ছাদে ছিলাম। যেদিকের পাঁচিলটা ভাঙা ঐ দিকে!

অনিমেষ: তুমি কি আমায় দেখেছ? 

শিপ্রা: না।

অনিমেষ: তবে?

শিপ্রা: অনুভব করেছি। তোমার পারফিউমের গন্ধ আমি দূর থেকেও অনুভব করতে পারি।

অনিমেষের নিজেকে কেমন দিশেহারা লাগছে! আবারও কি ঝামেলায় জড়িয়ে পরবে অনিমেষ!

ফোনটা সুইচ অফ্ করে দিল সে!

অন্য আর একটা ফোন থেকে সে ফোন করে রত্নাকে।  ফোনটা বেজে যায়! কিছুক্ষণ বাদে হোয়াটস্ অ্যাপ করে রত্না, "যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত না হচ্ছো আমায় ফোন করো না।"

এবার কি করবে অনিমেষ! সারা বাড়িটা যেন খেতে আসছে অনিমেষকে! কে শিপ্রার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার থেকে  বার বার ম্যাসেজ করছে! কে? 

মদের শিশিটা নিয়ে ড্রইংরুমে বসল অনিমেষ! নেশাটা  ধরেছে মনে হয়! দ্বিতীয়  ফোনটা হাতে নিল অনিমেষ! এখানেও আর একটা ফেক ফেসবুক একাউন্ট আছে। শিপ্রা আর রত্না ছাড়া আর কাউকে এই ফোনের নম্বর দেয়নি অনিমেষ!  মুষ্টিমেয় কজনের মধ্যে ফ্রেন্ডলিস্টে শিপ্রাও আছে। এখানেও যেই ম্যাসেঞ্জার খুলেছে দেখে শিপ্রার ম্যাসেজ। তাহলে কি রত্না কোনভাবে....? না,না রত্না তো শিপ্রার ফেসবুক ফ্রেন্ড নয়! তাহলে? পুলিশ কি কোনভাবে পিছনে লেগেছে? 

শিপ্রার ম্যাসেজ – কি গো ওই ফোনটা সুইচ অফ করে দিলে! তাই তো  ‘আমি ভালো আছি’ তোমার এই ফেসবুক একাউন্টের ম্যাসেঞ্জারে লিখছি! তুমি যখন এলে তার আগেই বিন্তি পিসি কাজ করে চলে গেছে। যাবার আগে ছাদে এসে আমাকে ডেকে বলে গেল, বউ দরজাটা দিয়ে যাও। যাই যাই করেও আর যাওয়া হয়নি! মিনিট দশেকের মধ্যেই তুমি এলে। একদিন আগেই যে তুমি চলে আসবে ভাবতে পারিনি আমি! আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম তোমাকে! আর তখনই তুমি....

অনিমেষ: কি যা তা কথা বলছ! তুমি কখন আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলে? আর কেন তোমাকে আমি মেরে ফেলব?

শিপ্রা: ও জড়িয়ে ধরিনি বুঝি! তাই কি ঠ্যালা দিয়ে  ফেলে দিলে আমাকে! 

অনিমেষের মনে হচ্ছে মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে। সে বলল, "তুমি আমায় হোয়াটস্ অ্যাপ কর!"

শিপ্রা: কেন? 

অনিমেষ: তুমি শিপ্রা নও! শিপ্রাকে আমি নিজ হাতে দাহ করেছি!

শিপ্রা: আমি শিপ্রা!

অনিমেষ: হতে পারে না! মরা মানুষ ফিরে আসে না!

শিপ্রা: আমি প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছি! আমি তোমার আশে পাশেই আছি!

বিহ্বল হয়ে যায় অনিমেষ! শিরশিরানি দেয় শরীরে।আর এক পেগ মদ গলায় ঢালে অনিমেষ!

অনিমেষ: এটা শিপ্রার ফোন নয়!

শিপ্রা: আমিই শিপ্রা। আমার ফোন থেকেই আমি লিখছি!

অনিমেষ: না, হতে পারে না! 

শিপ্রা: কেন?

অনিমেষ: না, শিপ্রা আর নেই!

শিপ্রা: কেন? নেই কেন? তোমার কাছেই আছি। সব জায়গায় আছি! 

একটা অট্টহাসির ইমোজি পড়ল লেখার শেষে!

আরো এক পেগ যখন গলায় ঢালল অনিমেষ  তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠল।

'এত রাতে কে? পুলিশ নাকি!' টলতে টলতে দরজা খুলল অনিমেষ! 

থানার বড়বাবু দুর্জয় দত্ত ঘরে এসে ঢুকলেন। ওনার সাথে দুজন কনস্টেবল।

"আবার দুর্জয় দত্ত। লোকটা আমাকে ছাড়বে না দেখছি!" অনিমেষ মনে মনে গজরায়।

অনিমেষ বাবু, আমরা শিপ্রা দেবীর বডির পাশ থেকে ওনার মোবাইলটা পাই! দেখুন তো! - দুর্জয় দত্ত বললেন।

-'না, এটা শিপ্রার ফোন নয়...'

- 'কি বলছেন? এটা শিপ্রা দেবীর ফোন নয়!'

- 'না'।

-'কিন্তু এটা তো আমরা শিপ্রা দেবীর বডির পাশ থেকেই পাই!'

-'আপনারা মিথ্যা কথা বলছেন!'

“আপনি হুঁশে আছেন তো? নাহলে অন ডিউটি পুলিশের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে না! আচ্ছা দেখুন তো অনিমেষ বাবু এই ফোনটা শিপ্রা দেবীর কিনা!” এই কথা বলে দুর্জয় দত্ত আর একটি  সেল ফোন অনিমেষের হাতে দিলেন।

- 'না, না এটা শিপ্রার মোবাইল নয়! আপনাদের আর কত বার বলব!'

ঠিক এমন সময় ঘরে একজন অপরিচিত ভদ্রমহিলা প্রবেশ করলেন। অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আপনি আমায় চিনবেন না অনিমেষ বাবু। আমাকে  শিপ্রার বান্ধবী বলতে পারেন। যদিও ওর থেকে বয়সে অনেক বড়। আমার নাম কুহেলি। আসলে আমার যখন জন্ম হয় তখন সেই বিখ্যাত 'কুহেলি' সিনেমাটি চলছিল। আর আমার বাবা-মা সিনেমা পাগল মানুষ ছিলেন,  তাই তাঁরা আমার নাম রেখেছিলেন কুহেলি।

"আপনার নামের ব্যাখ্যা আমি শুনতে চাই নি! এখানে, এমন অসময়ে কেন? আর শিপ্রাকে চিনলেনই বা কি করে?" অনিমেষ বলল।

- এই কিছুদিন আগে একটি ফেসবুক  গ্রুপের মিটে শিপ্রা আর ওর বোন শিখার সঙ্গে আমার আলাপ। তারপর থেকেই পরিচয়, হৃদ্যতা ....  শিপ্রার মৃত্যুর খবর আমি কাগজে পড়েছি। শুনলাম, ওর ফোনটা পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে ফোনটা না আমার কাছে ছিল! এই যে ফোনটা....

না,না, এটা শিপ্রার ফোন নয়! আপনি, আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না! অনিমেষ বলল।

'এটা শিপ্রার ফোন নয়! কি বলছেন!' দুর্জয় দত্ত বললেন, 'এই ফোন থেকে শেষ কলটাতো উনি আপনাকেই করেছেন'।

'ভুল বলছেন আপনি, এটা শিপ্রার মোবাইলই নয়! শিপ্রা কল করতে পারে না! ও কানে শোনে না!' অনিমেষ একই কথা বলতে বলতে শ্রান্ত!

'শিপ্রা কানে শুনতেন না!'- দুর্জয় দত্ত যেন অবাক হলেন, নাকি অবাক হবার ভান করলেন!

"দিদিয়ার ফোনটা আমার কাছে অনিমেষ দা? এই দেখো, দেখলেই চিনতে পারবে!" শিখা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল।

শিখাকে দেখে অনিমেষের মনে হল কোন এক অদৃশ্য চক্রব্যুহের জালে সে যেন ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে! সে জাল কেটে বেরোবার উপায় তার জানা নেই!

অনিমেষ মোবাইলটা দেখেই  চিনল। সে বলল, এটা শিপ্রার ফোন নয়।

-'না,না অনিমেষ দা তুমি ভাল করে দেখ, এটা দিদিয়ার ফোন!'

-'না এটা তোমার দিদির ফোন নয়,  তোমার দিদির ফোন আমি খুব ভালো করে চিনি!'

 'এটা আমার দিদিয়ার ফোন। তুমি এতটাই মদ খেয়েছ যে তোমার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেছে, তাই তুমি চিনতে পারছ না!' শিখা দৃঢ় স্বরে বলল।

- তোমার দিদি তোমাকে একটা মোবাইল ফোন উপহার দিতে চেয়েছিল, আর ফোনটা আমিই কিনে দিয়েছিলাম। এইটা সেই ফোন। অনিমেষ চিৎকার করে উঠল।


এই চাপানউতোর এখন সারারাত চলতে থাকবে। এই ফাঁকে আমরা একটু পিছনে ফিরে যাই।

অনিমেষ আর শিপ্রা দুজনেরই আদি বাড়ি চন্দননগর। পাশাপাশি বাড়ি তাই ঘন ঘন যাতায়াত লেগেই থাকত। শিপ্রাদের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়। অনিমেষ আর শিপ্রার মা পরস্পর সই পাতিয়েছিলেন। অনিমেষ পড়াশোনার জন্য কলকাতায় মামাবাড়িতে থাকত। ছুটি ছাটায় চন্দননগর ফিরে যেত।

শিপ্রার যখন ষোল সতেরো বছর বয়স তখন তার ম্যানিনজাইটিস হলো। যায়, যায় অবস্থা থেকে বেঁচে উঠল বটে কিন্তু অঙ্গহানি হল। শ্রবণ শক্তি হারিয়ে ফেলল চিরকালের জন্য। যেহেতু সে কথা বলতে পারত, তাই ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে উত্তর দেওয়া অভ্যাস করেছিল। 

অসুখের আগে শিপ্রার শরীরে যেটুকু মেদ ছিল, এখন তাও ঝরে গেল। তন্বী, অষ্টাদশী শিপ্রা ঠিক ডানাকাটা পরীও নয়, আবার তার লাবণ্যকে অস্বীকার করার কোন উপায়ও নেই। শিপ্রা সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে তার মা শয্যা নিলেন। শোনা যায়, তিনিও নাকি সম্রাট বাবরের মতো নিজের জীবনের বিনিময়ে  সন্তানের জীবন ভিক্ষা চেয়ে নিয়েছিলেন ঈশ্বরের কাছে! ঈশ্বর শুনেছিলেনও তাঁর কথা। ফলে মা মরা মেয়ে দুটো শিপ্রা আর শিখা আশ্রয় ও প্রশ্রয় দুই পেল সইমার কাছে।

 দুই বোনকে সই মা খুবই ভালো বাসতেন, একসময় তাঁর ইচ্ছে ছিল অনিমেষের সাথে শিপ্রার বিয়ে হোক। সই মানে শিপ্রার মাও  জানত সেকথা। কিন্তু এখন সে ইচ্ছেটা গেছে। কালা মেয়েকে কি ঘরের বউ করা যায়! 

শিপ্রার বয়স তখন বাইশ তেইশ। সে যে তখন কতটা লাবণ্যময়ী হয়ে উঠেছে সে ব্যাখ্যা দেবার সাধ্যি আমার নেই। তার অবিন্যস্ত কুঞ্চিত কেশরাশি যখন কপালে, কপোলে খেলা করে যায় তখন ভারি মিষ্টি লাগে তাকে। তার শব্দহীন জীবনে ডাগর চোখখানি  মেলে সে যখন  জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর পেতে চায়, তখন সে প্রশ্নের সাথি হয়ে উত্তর দিতে বেশ লাগে। অনিমেষের বাবা অমরেশ শিপ্রার এমনই এক অসম বয়সী সাথি। জেঠু ভাইজির সেই সম্পর্কে যেন বন্ধুত্বের আবদার অনেক বেশি। 

এদিকে অনিমেষ তখন আই টি সেক্টরে সবে কাজ শুরু করেছে। রত্না ওর কলেজ বেলার বন্ধু। কত বিকেল, সন্ধ্যা এমনকি রাত্রেও রত্না আর অনিমেষ নিজেদের আগামী দিন নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনেছে। তবে ইদানিং কি কারণে যেন রত্নার সাথে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়েছে অনিমেষের। আর ঠিক সেই সময়, বেশ অনেকদিন বাদেই অনিমেষ বাড়ি ফিরল। 

অনিমেষের বাড়িতে শিপ্রা শিখার যেমন অবাধ যাতায়াত, অনিমেষেরও তেমন শিপ্রাদের বাড়িতে । তবে অনিমেষ দূরে থাকতে থাকতে কিছুটা দূরের মানুষ হয়ে গেছিল। তাই সে বাড়িতে এলেও শিপ্রাদের বাড়িতে কমই যেত। সেদিন ছিল অনিমেষের জন্মদিন। শিপ্রা আর শিখাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন সইমা। মা মরা মেয়ে দুটো একা একাই যা পারে রান্না করে। কখনো কখনো ওদের বাবাও সাহায্য করেন। তাই ছেলের জন্মদিনে সইমায়েরও ইচ্ছে হল ওদের ডেকে ভালো মন্দ খাওয়াতে। খাওয়া শেষ হলে শিখা তার বাবার খাবারটা নিয়ে ফিরে গেল। ওদের বাবা নির্মল বাবু কোন কাজে সকাল সকাল কলকাতা  গেছেন। বাড়িতে আজ রান্নার ঝামেলা নেই।  সকালে, কাজে বার হবার আগে অনিমেষদের বাড়িতে এসে তাকে আশীর্বাদ করেন নির্মল বাবু। সে সময়েই অমরেশ বাবুর স্ত্রী তাঁকে ভরপেট জলখাবার খাইয়ে দেন। আবার এখন শিখার হাত দিয়ে দুপুরের খাবারও পাঠিয়ে দেন। 

   খাওয়ার পর শিখা চলে গেলেও শিপ্রা জেঠা মশাইয়ের সাথে দেখা করতে গেল। জেঠামশাই আবার বৈকালিক ভ্রমণে বের হবেন। দেখা করে শিখা ফিরেই যাচ্ছিল। কিন্তু যাওয়ার পথে অনিমেষের ঘরের বই এর তাকের দিকে নজর গেল তার, আগাথা ক্রিস্টি সিরিজ! চুম্বকের মত  বইয়ের টানে শিপ্রা অনিমেষের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। অনিমেষ তখন ঘরে ছিল না। অবেলায় খাওয়া, তাই পায়চারি করার জন্য একটু বাইরে গেছিল। এদিকে শিখা তার খাটে উপুর হয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে আগাথা ক্রিস্টি পড়তে লাগল। পায়ের নূপুর রিনিরিনি ধ্বনি তুলল। আর মাথার লম্বা বেনীখানি পিঠের মাঝ বরাবর নেমে নিতম্ব ছাড়িয়ে গেল।

ফিরে আসার সময় অনিমেষ  দেখল মা  পাশেই রুমি মাসির বাড়িতে যাচ্ছেন। সেখান থেকে রুমি মাসিকে সঙ্গে  নিয়ে তিনি মন্দিরে যাবেন। সেখানে কীর্তন হবে। মা বললেন, পুতুল দি, রঘুদাদা ঘরে আছে, ওদের বলিস, চা করে দেবেখন। আর হ্যাঁ, শিপ্রা তোর ঘরে বসে বই পড়ছে। তুই আবার বিরক্ত হোস না যেন!'

বাড়ি ফিরেই অনিমেষ রান্না ঘরে গেল। কিন্তু রান্নাঘর বন্ধ। পুতুল দি রঘুদাদা বলে ডাকাডাকি করল খানিক। কিন্তু সাড়া পেল না। ছাদে গেছে মনে হয়! সে নিজের ঘরে এল। খাটে শুয়ে শিপ্রা একমনে কি যেন পড়ছে! হঠাৎই কোথা থেকে একরাশ মুগ্ধতা এসে জড়ো হল অনিমেষের অন্তরে। রত্নার সাথে খিটিমিটি লাগার পর রত্নার উগ্র ব্যবহারে কেমন যেন বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিল অনিমেষের মন। আজ, এই মূহুর্তে এই নিষ্পাপ, সরলমতি মেয়েটির সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল সে!

অনিমেষ আলতো হাতে দোর আটকে শিপ্রার পাশে বসল। হাত রাখল তার পিঠে।

"অনিমেষ দা তুমি কখন এলে? এই দেখো না, আমি আগাথা ক্রিস্টি পড়ছি।"  শিপ্রা বলল।

"তুমি পড়। আমি এখানে বসে আছি।" অনিমেষ বলল।

শিপ্রা বুঝতে চেষ্টা করল, অনিমেষ কি বলতে চাইছে! ও বই এর দিকে মন দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু ওর কেবলই মনে হতে লাগল, দুটি চোখ একদৃষ্টিতে ওকে যেন নিরীক্ষণ করছে! ওর অস্বস্তি হতে লাগল! কি হয়েছে অনিমেষদার? কিছু বললে ও তো ভালো করে বুঝতেও পারবে না! 

হঠাৎই অনিমেষ শিপ্রার চিবুক স্পর্শ করে বলল, "আমাকে বিয়ে করবে? তোমার মা, আমার মা তো একসময় তাই চাইতেন!"

হারানো স্বপ্ন কি তবে আবার সত্যি হবে! মরে যাওয়া কথাগুলো কি আবার বেঁচে উঠবে! শিপ্রা মা, সইমার সেই ছোট বেলার কথাগুলোকে কোন দিনই পাত্তা দিত না। অনিমেষকে নিয়ে কোনদিন সেভাবে ভাবেই নি। তবে অসুখের পর, বধির হয়ে যাবার পর মাঝে মাঝেই ভাবত সে কথা! কিন্তু ততদিনে মায়েরও মৃত্যু হয়েছে আর সে কথারও! তবে আজ আবার কি সেই কথার পুনর্জন্ম হল! ছোট থেকেই সে অনিমেষকে চেনে, আজ অনিমেষের প্রস্তাবে সে কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না! তার শব্দহীন জীবনে যে কেউ আসতে পারে এই বিশ্বাসই তার ছিল না! তবুও এখন আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছে করছে শিপ্রার। সবটুকু দিয়ে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে অনিমেষকে। 

হঠাৎই অনিমেষ দরজা খুলে ঠাকুর ঘরে নিয়ে গেল শিপ্রাকে। মা দুর্গার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে  মায়ের সিঁদূর পড়িয়ে দিল শিপ্রার সিঁথিতে। সাক্ষী থাকল কেবল মূক মাতৃমূর্তি!

ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে পরে  শিপ্রা। শিপ্রাকে আরো বিস্মিত করে অনিমেষ শিপ্রার  ওষ্ঠে এঁকে দিল অনুরাগের প্রথম চুম্বন চিহ্ন।   তারপর কাছে, আরো কাছে, এক হয়ে গেল দুজনে!

শিখা বাড়ি চলে এসেছে কখন! নির্মলবাবুও ফিরে এসেছেন। দিদিয়া তো এখনো আসেনি! শিখা আবার গেল অনিমেষদের বাড়িতে। শিপ্রার ব্রীড়াবনত মুখখানি, রাঙা সিঁথি দেখে শিখা কি করবে কি বুঝে উঠতে পারল না। সে দিদিয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। নির্মল বাবু তাঁর মা মরা এই মেয়েটিকে একটু বুঝি বেশিই স্নেহ করতেন। আসলে শিখা  মায়ের মৃত্যুর পর যতটা বুঝদার হয়ে উঠেছিল শিপ্রা বড় হয়েও কেমন যেন অবুঝ ছিল। কানে না শোনাটাও হয়তো এর একটা কারণ। বড় দিদিকে সামলাতো, আগলাতো শিখাই। কিন্তু এই মূহুর্তে শিপ্রাকে দেখে নির্মলবাবু  কি করবেন দিশা খুঁজে পেলেন না! শিপ্রার মায়ের মৃত্যুর পর অমরেশ বাবুর কাছে শিপ্রা আর অনিমেষের বিবাহ প্রসঙ্গে একবার কথাও বলেছিলেন নির্মলবাবু। অমরেশবাবু  রাজি থাকলেও ওনার স্ত্রী অনিমা দেবী  বলেছিলেন, অনিমেষের মতামতটাও নেওয়া দরকার। তারপর এ প্রসঙ্গে আর কথা হয়নি। আর আজ অভাবিত ভাবে এ কি কান্ড!

দুই বাড়িতে হইহই পড়ে গেল। অনিমেষের মামা মামিমা এলেন কলকাতা থেকে। অনিমেষের উপর তাঁদের দাবিও কম নয়। মামি রত্নার প্রসঙ্গ তুললেন, "রত্নাকে তো তুই ভালোবাসিস অনি! দুদিনের ঝগড়ায় আবেগের বসে তুই এ কি কান্ড করলি?" এরপর অনিমা দেবীকে  উদ্দেশ্যে করে তিনি বললেন, "তুমি তো রত্নাকে দেখেছ দিদি!"

অমরেশ বাবু বললেন, এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই। অনিমেষ যখন শিপ্রাকে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে মায়ের সামনে, আমাদের মেনে নিতেই হবে।  অনিমা দেবী এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। সবাই সরে গেলে ভাইয়ের বউকে তিনি বললেন, শিপ্রাকে আমি খুবই ভালোবাসি। ছেলের বউ করব মনেও করেছিলাম। কিন্তু মেয়েটি বধির। এরকম মেয়ে যে আমার ছেলের বউ হবে ভাবতেও পারিনি।

অমরেশবাবু গিন্নির মনোভাব বুঝেছিলেন। তিনি গিন্নি কে বললেন, "মেয়েটাকে কেবল করুণাই করেছ, ভালোবাসনি কোনদিন! ভালবাসলে জানতে পারতে ওর মধ্যেও প্রচুর জীবনীশক্তি আছে।

        শিপ্রা আর অনিমেষের বিয়ে হয়ে গেল।  কিন্তু  যতটা মুগ্ধতা বিয়ের মূহুর্তে ছিল আস্তে আস্তে সেই মুগ্ধতা যেন ফিকে হতে লাগল, অনিমেষের কাছে। বাইরের মানুষরা এ ব্যাপারে কিছু না বুঝেলও শিখা কিছুটা বুঝতে পারত। উপর থেকে সব সাজানো মনে হলেও কেন যেন অনেকটাই মেকি মনে হত তার। যদিও শিপ্রা সেভাবে কিছু প্রকাশ করেনি। কিন্তু শিখা এও বুঝেছিল অনিমেষদার জীবনে তার প্রাক্তন প্রণয়িনী রত্না আবার ফিরে এসেছে। অনিমেষ তার বাবার কাছে শিখার বধিরতার বিষয়ে কিছু আপত্তি জানালে অমরেশ বাবু বলেন, শিপ্রাকে নিয়েই তাঁকে জীবন কাটাতে হবে। শিপ্রাকে সে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছে। কাজেই তার যদি কোন অমর্যাদা হয় তিনি পুত্রকে ত্যাজ্য করবেন। ততদিনে অনিমা দেবী গত হয়েছেন। অনিমা দেবীর কাছ থেকে অনিমেষ যতটা প্রশ্রয় পেত বাবার কাছে সেটাও আর পেল না।

এদিকে রত্নার রূপেও যেন একটা চটক আছে। সেই আকর্ষণকে কখনোই উপেক্ষা করতে পারে নি অনিমেষ! রত্না বরাবরই অনিমেষের জীবনে থেকে গেছিল।

অনিমেষ যে শিপ্রাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেছিল তা বেশ বুঝতেন অমরেশ বাবু। কখনো কখনো শিপ্রাকে কলকাতার বাড়িতে একা রেখে অনিমেষ চলে যেত মামাবাড়িতে, কখনো বা চন্দননগর। আবার শিপ্রা যখন চন্দননগরে থাকত অনিমেষ তার ত্রিসীমানায় থাকত না। তাই বলে শিপ্রাকে সে খুন করবে এটা তিনি ভাবতেই পারেন না।

অমরেশ বাবু দমদমে শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি এই বাড়িটা কিনেছিলেন। তবে অনিমেষ একা তো আর ওই অতবড় বাড়িতে থাকতে পারে না, তাই বাড়িটা ভাড়া দেওয়া ছিল। অনিমেষ থাকত মামাবাড়িতে। অনিমেষের বিয়ের পর ভাড়াটে উঠে গেলে ওরা দুজনে এখানে থাকতে শুরু করে।

বাড়ির ছাদটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।  শুধু একটা অংশ এল প্যাটার্নে ভাঙা। সেখানে গিয়েই শিপ্রা বসে সব সময়। খুট খুট করে মোবাইলে। যেহেতু সে শুনতে পায় না, হোয়াটস্ অ্যাপে  লিখে লিখে  সে সবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। আর এই ভাঙা জায়গাটি থেকেই সে নীচে পড়ে যায়। নিচের ওই অংশে শান বাঁধানো কলতলা। সেখানেই শিপ্রার থেঁতলানো দেহটা পড়ে ছিল। রাতে আবার বৃষ্টিও হয়। 

পরদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ বিন্তি পিসি কাজ করতে এসে কলতলায় শিপ্রার দেহটি দেখতে পায়।  সেই লোক জানাজানি করে। পুলিশ শিপ্রার ওড়নাটা পাঁচিলের ভাঙা অংশে খুঁজে পায়। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ চন্দননগরে অনিমেষের কাছে ফোন আসে। অমরেশ বাবু কিছুদিনের জন্য হরিদ্বার বেড়াতে গেছিলেন। গেছিলেন নির্মল বাবু আর শিখাও। তার মধ্যে এই কান্ড! 

শিপ্রাকে একা রেখে অনিমেষ কেন যে হঠাৎ চন্দননগর গেছিল কে জানে! বাড়িতে রঘুদাদা, পুতুলদিও ছিল না। তারা দুদিনের ছুটিতে দেশে গেছিল।      

    রুমি মাসির বাড়িতে চন্দননগরের বাড়ির চাবি ছিল। মাসির কাছে যখন চাবি চাইতে যায়  অনিমেষ তখন তিনি জিজ্ঞাসা করেন, "শিপ্রা আসেনি?" সে তখন না বলে। আর বলে, সে একটু দরকারে এসেছে। পুলিশি জেরায় রুমিমাসি একথা জানায়। শিপ্রার মৃত্যুর দিন বিকেলেও অনিমেষ চন্দননগরের ছিল। কারন ওদের ঘরে লাইট জ্বলছিল। টিভিতে খেলা হচ্ছিল সে আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছিল। পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি কি অনিমেষকে সন্ধ্যার পর দেখেছেন?" রুমি মাসি বলেন, "না। তবে  দুপুরেই ওর সাথে কথা হয়েছে। বাইরে থেকে খেয়ে ফিরছিল।  ওকে বেশ অন্যমনস্ক লাগছিল। বলল, একটা ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না সেটার খোঁজেই এসেছে। বিকেল থেকে বৃষ্টি নামে। উনিও আর বের হন নি। এছাড়া অনিমেষ বের হলে বাড়ির চাবিটাতো ওনার কাছেই রেখে যেতেন!"

শিপ্রার  অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেসটি নিয়ে  থানা এখন সরগরম। হত্যা না আত্মহত্যা নাকি নিছকই দুর্ঘটনা! 

কিছু হিসাব দুর্জয় দত্ত মেলাতে পারছেন না। পোস্টমর্টেমের পর নির্মলবাবু বলেছিলেন, তিনি মেয়ের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখতে পারবেন না! কিন্তু শিখা বলেছিল, হরিদ্বার থেকে তারা না আসা পর্যন্ত যেন মৃতদেহ দাহ না করা হয় …. কিন্তু অনিমেষ অপেক্ষা করেনি। শিখা এসে দেখে তার দিদির দেহ চুল্লিতে দেওয়া হয়ে গেছে। অনিমেষ বলেছিল, পচন ধরতে শুরু পারে…. কিন্তু  দেহ তো সংরক্ষণও করা যেত! রুমি মাসি সেদিন সন্ধ্যায় অনিমেষকে দেখেননি। বৃষ্টিও পড়ছিল। ঘরে আলো পাখা টিভি জ্বলছিল। 

এদিকে দমদমে শিপ্রার মৃত্যুর দিন বিকেলে অদ্ভুত ধরনের পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে বাড়ির দুধওয়ালা শিপ্রাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে। সে রোজ সকালে  প্যাকেটের দুধ দিয়ে যায়। সে বেশ লম্বাটে গোছের একজন লোককে বাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে যেতে দেখে। তখন বৃষ্টি শুরু হয়ছে। মুখটা ঠাওর করতে পারেনি সে। তবে দুধওয়ালা এটুকু  বলে যে, লোকটি অনিমেষ বাবু নয়! কারণ অনিমেষ  ওত লম্বা নয়!

কুহেলি শিখাকে ফোন করে জানায়, শেষ হোয়াটস্ অ্যাপ ম্যাসেজ শিপ্রা তার সাথেই করছিল। কুহেলি শিখাকে সেই ম্যাসেজ দেখায়।…… ও একা একা দমদমে আছে। অনিমেষ চন্দননগরে। অনিমেষ ওকে ভালোবাসে…..শাড়ি গয়না কিনে দেয় সবই ঠিক। তবুও ওর কেন যেন মনে হয় অনিমেষ এখন আর ওকে আগের মত ভালোবাসে না! 

শেষ ম্যাসেজে শিপ্রা কুহেলিকে লেখে, অনিমেষ আগামী কাল আসবে বলেছিল। আজই চলে এসেছে। 

কুহেলি বলছে…..তুই তবে নিচে যা এখন আর ফোনে সময় নষ্ট করিস না!

শিপ্রা……আকাশে খুব মেঘ করেছে। হ্যাঁ  নিচে যাব। বিন্তি পিসি চলে যাওয়ার আগে দোর দিতে বলেছিল। দেওয়া হয়নি। দরজা খোলাই আছে। ও ঘরে ঢুকেছে ...

(এ প্রসঙ্গে বলি শিপ্রা খুব তাড়াতাড়ি বাংলা টাইপ করতে পারত।)

কুহেলি ….তুই উপরে বসেই টের পেয়ে গেলি! (কুহেলি জানত শিপ্রা ভাঙা পাঁচিলে বসে ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে।)

শিপ্রা… ওর পারফিমের গন্ধ ….গন্ধটা এখন অনেক কাছে….

ব্যাস, তারপর থেকেই শিপ্রার ফোন সুইচ অফ্।

দুর্জয় দত্ত অনিমেষকে ভালো মতো চেপে ধরেছেন। অনিমেষের যেন দিশাহারা লাগছে নিজেকে। এত রাতে আবার গাড়ির আওয়াজ। অমরেশ বাবু এলেন সঙ্গে পুতুল দি, রঘুদাদা। পুতুল দি বলল, ছোট দাদাবাবু যা জানো বলে দাও না! বড় দাদাবাবুর কি অবস্থা হয়েছে দেখ! আসলে পুলিশ চন্দননগরের বাড়ি থেকে একপাটি হাই হিলের ছেলেদের বুট জুতো পেয়েছে। 

হঠাৎই অনিমেষ তেড়ে গেল পুতুল দির দিকে! "কি জানি আমি, কি জানি!"। দুর্জয় দত্ত দৃঢ় স্বরে বললেন, "শান্ত হোন অনিমেষ বাবু। অযথা উত্তেজিত হবেন না! ফোনগুলোর মধ্যে কোনটা শিপ্রাদেবীর ফোন বলুন!" 

এরমধ্যেই শিখার চিৎকার! ওরা সবিস্ময়ে দেখল, সিঁড়ি দিয়ে গলগল করে রক্তের ধারা নেমে আসছে!  শিখাও পড়ে গেছে! ওই তো মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে!

"শিখা কি হল তোমার!" অনিমেষ ছুটে যেতে চাইল শিখার দিকে! দুই কনস্টেবল চেপে ধরলেন অনিমেষকে। "আপনি ওদিকে যাবেন না," দুর্জয় দত্ত বললেন, "বলুন শিপ্রা দেবীর মোবাইলটা কোথায়!"

"ছাড়! আমাকে আগে শিখার কাছে যেতে দাও!" অনিমেষ বলল।

- আগে বলুন শিপ্রা দেবীর  মোবাইলটা কোথায়? 

- না বললে আপনি যেতে দেবেন না! তাহলে শুনুন মোবাইলটা আমি ভেঙে ফেলেছি। ওই মোবাইল এ ও সবার কাছে আমার নামে নিন্দা করত! ছাড়ুন এবার! 

অনিমেষ ছুটে গেল শিখার কাছে। শিখার সাথেও অনিমেষের ভালোই বন্ধুত্ব ছিল।অন্তত অনিমেষ তাই জানত। শিখা চোখ বুজে পড়ে আছে, মাথার চারপাশটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। অনিমেষ বলল, শিখা চোখ খোল! তোমার দিদিকে আর সহ্য করতে পারছিলাম না শেষ দিকে! ওকে বিয়ে করে জীবনটা শেষ হয়ে গেছিল। কোনদিন সন্তানের মুখও দেখতে পেতাম না! তাইতো..... এদিকে রত্নাও আমাকে ত্যাগ করল! এখন তুমিও যদি…..

শিখা তখনি উঠে বসল, "তুমিই তাহলে দিদিয়াকে  মেরে ফেলেছ! দিদিয়া  বলেছে, যবে থেকে জেনেছ, দিদিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে জ্যাঠামশাই তোমাকে ত্যাজ্য করবে, যবে থেকে তুমি কানাঘুষো শুনেছো দিদিয়া কোনদিন মা হতে পারবে না, তবে থেকেই তুমি সুযোগ খুঁজছিলে! শুধু রিপোর্টটা হাতে পাওনি! সেই রিপোর্টটা এখন তোমার ঘরে খুঁজে পেলাম! যেটা জ্যাঠামশাই লুকিয়ে রেখেছিলেন তোমার কাছ থেকে! আর রিপোর্টটা হাতে পেয়েই আমাদের সবার অনুপস্থিতিতে তুমি দিদিয়াকে শেষ করে দিলে! ওই কারণেই আমাদের সবাইকে হরিদ্বারে পাঠানোর জন্য তোমার এত তাড়া! আর শোন অনিমেষ দা, তোমাকে ম্যাসেঞ্জারে আমিই ম্যাসেজে করি। আমার ফোন থেকেও দিদিয়ার ফেসবুক একাউন্টে লগ ইন করা যায়। আমার প্রথম থেকেই তোমাকে, শুধু তোমাকেই সন্দেহ হয়েছে। " 

এরপর শিখা জ্যাঠামশাইকে বলল, "অনিমেষ দা দিদিয়াকে  মেনে না নিলে, ওকে  ত্যাজ্য করবেন এমন ভয় কেন দেখালেন, জ্যাঠামশাই! দিদিয়া কানে না শুনলেও সে শিক্ষিত মেয়ে! দিদিয়ার জন্য আমরা তো ছিলাম! পরের মেয়ের জন্য এত ভাবতে আপনাকে কে বলেছে! দিদিয়াকে আপনি বেঁধে না রাখলে দিদিয়াতো প্রাণে বেঁচে থাকত!"

অমরেশ বাবু সেই রিপোর্টটা লুকিয়ে রেখেছিলেন সংসার বাঁচানোর স্বার্থে! কিন্তু আজ সব ব্যর্থ হল। সেই রিপোর্ট খুঁজতেই অনিমেষ চন্দননগর গেছিল! এছাড়া প্রাথমিক মোহ কেটে যাবার পর শিপ্রার বধিরতাকে কখনোই মেনে নিতে পারেনি অনিমেষ!

দুর্জয়বাবু অনিমেষকে নিয়ে গেলেন। অমরেশ বাবু একটা চেয়ারে হতভম্বের মত বসে রইলেন। 

কুহেলি বললেন, "অনিমেষ হয়তো সব ম্যাসেজ ডিলিট করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। তখনই  ফোনটা ভেঙে ফেলে। কিন্তু এত রক্ত কিভাবে শিখা?"

শিখা একটু চুপ করে থেকে বলল, "রূহ আফজার সাথে  খাবারের লাল রঙ মিশিয়েছিলাম। ভয় না দেখালে শয়তানটাকে ধরার অন্য কোন উপায় ছিল না! দিদিয়াকে মেরে এবার ওর নজর আমার উপর পড়েছে!" শিখা ফুঁসছে!

হঠাৎ রঘুদাদা বলল, দেখ বড়বাবু কেমন নুঁয়ে পড়ছেন! ওরা সবাই ছুটে গেল অমরেশ বাবুর দিকে। শিখা ডাকল, "জ্যাঠামশাই, জ্যাঠামশাই।" কোন সাড়া পেল না! 

অমরেশ বাবু ততক্ষণে চিরঘুমের দেশে, চির শান্তির পাড়ি জমিয়েছেন।

আর শিখা, সে ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত! সেও এখন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল!

...(সমাপ্ত)...




No comments:

Post a Comment