1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

এই বালুকা বেলায়

ছবি : ইন্টারনেট

 এই বালুকা বেলায়  

দেবানন্দ মুখোপাধ্যায়

 সমুদ্র সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনা ,শুতে শুতেই এতো রাত হয়ে যায় সকালে ঘুম ভেঙে গেলেও উঠতে ইচ্ছে করেনা ৷একমাত্র নাইট ডিউটি যেদিন থাকে সেদিন তো রাতে ঘুমাতেই পারেনা ৷ সুযোগ পেলেও ঘুোবার অভ্যাস নেই ,ওর কাছে ডিউটি ইজ ডিউটি ৷তবে বাকি দিনগুলো সকাল সকাল ঘুম ভেঙে বিছানায় পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে  থাকাটার মতো সুখ আর কিছু  জীবনে নেই,এটা যারা না করেছে তারা বুঝতে পারবে না ৷ ।এটা ও পুরোপুরি উপভোগ করে ,অথচ ডাক্তার হিসেবে ও সবাইকে উপদেশ দেয় তাড়াতাড়ি রাতে শুয়ে পড়ে সকাল সকাল উঠে পড়তে,সকালে একটু হাঁটাহাঁটি করতে ৷ ৷কিন্তু নিজের তো খাবার বা শোওয়ার সময়েরও ঠিক থাকেনা ,অন্যকে বলা সোজা তবে ওর পক্ষে মানা মুশকিল ৷আর হাঁটা তো দুরের কথা ,কোনোরকমে স্নান করে খেয়েদেয়ে হাসপাতালে দৌড়,দৌড় ৷ শুয়ে শুয়েই ও বুঝতে পারে পেপারওয়ালা পেপার ছুঁড়ে দিয়ে গেলো ,পর্ণা মানে সমুদ্রের বৌ দুধওয়ালার কাছ থেকে দুধ নিলো ,মায় পাশের বাড়ির ক্লাস নাইনে পড়া কল্যানবাবুর ছেলে রোহিত দরজা খুলে সাইকেল নিয়ে টিউশনি পড়তে বের হোলো , সব কিছু শুয়ে শুয়েই উপভোগ করে ৷সবাই নানা কাজে ব্যস্ত সেই শুধু অলসের মতো শুয়ে আছে ,এর থেকে সুখ আর হয়না ৷তবে এ তো ক্ষণেকের জন্য ,আধঘন্টার মতো এই সুখ ,একটু পরেই কাজের ঢেউ এসে বালির তৈরি এই সুখের মিনার নিমেষে ভেঙে ফেলবে ৷

যখন নাইট ডিউটি থেকে ফেরে বা কোনো কারনে সকাল সকাল উঠে বেরোতে হয় ,দেখে কত লোকজন মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছে ,এমনকি শীতের সকালেও ৷মনে মনে এদের খুব হিংসে করে সমুদ্র আর ভাবে এরা ঘুমায় কখন ?কতটুকু ঘুমায় ?

নাইটডিউটির সময় কাজ করতে করতে শ্রান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম ,আবার নতুন পেশেন্ট ভর্তি হলে তাকে নিয়ে কখন যে সময় কেটে যায় বোঝাও যায়না ৷এই রকমভাবে কখন যে আকাশের কালো শ্লেটে সূর্য তার আলোর তুলি বোলাতে শুরু করে দেয় তার খেয়ালই থাকেনা ৷হাসপাতালের সামনের গাছে আশ্রিত পাখিগুলোর কিচিরমিচির ,চা বিক্রেতাদের বিভিন্ন ডাক “চা “ “গরম চা “ লেবু চা” ইত্যাদি শব্দের কোলাজে সমুদ্রের মনটা উদাস হয়ে যায় ৷আস্তে আস্তে এই সব শব্দের সাথে জেগে ওঠা পেশেন্ট পার্টির গুন্জন মিলেমিশে আর একটা দিনের শুরু হয়ে যায় ৷সমুদ্র এই সময়টাকে ভালোই উপভোগ করে ,যতই সে রাত জাগুক না কেনো ৷সকালের প্রকৃতির এই স্নেহের পরশ এক নিমেষেই তার সব ক্লান্তি দূর করে দেয় ৷

কালও সেরকম নাইট ডিউটি ছিলো সমুদ্রের ৷ডিউটি শেষ করে যখন বের হোলো ঘড়িতে তখন সাতটা বেজে দশ ৷শীতের সকাল ,তাই চারিদিক কুয়াশার চাদরে ঢাকা ৷মটরসাইকেল নিয়ে বড় রাস্তায় এসে দেখে মোড়টায় বেশ ভীড় ৷এ নিত্যদিনের ব্যাপার ৷আসলে মোড়টায় অনেকগুলো চা’র দোকান আছে ,ওখানে গুচ্ছ গুচ্ছ লোক দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর গল্পগুজব করছে ৷সবই পেশেন্ট পার্টি ,কিছু কিছু লোকাল  লোকও আছে ৷এর মধ্যে সমুদ্রের পছন্দের বিজয়ের চায়ের দোকানে যথারীতি ভীড় বেশী ৷সমুদ্রর এই ক’বছরে ডিউটিতে একটা অভ্যাস হয়ে গেছে ডিউটি সেরে বিশেষ করে নাইট সেরে বিজয়ের দোকানে এক কাপ চা খেয়ে বাড়ি ফেরা ৷যদিও বিজয়ের আদি বাড়ি পাটনার গর্দনিবাগ হওয়ার সুবাদে অধিকাংশ লোকই ওকে “বিহারী” বলেই ডাকে ,আর ওর দোকানটাও বিহারীর চায়ের দোকান বলেই জানে ৷এখন ওর এমন অবস্থা এমন যে ওকে কেউ বিজয় লে ডাকলে ও চমকে ওঠে ৷তা সেই চমকে দেবার লোকের মধ্যে সমুদ্র একজন ৷বিজয়ের দোকানে মটরসাইকেলটা দাঁড় করাতেই বিজয় একগাল হেসে একভাঁড় 

চা এগিয়ে দেয়ে তারপর জিজ্ঞেস করে “নাইট কেমন গেলো স্যার ?”

“খুব বাজে গেলো রে ,একটুও বিশ্রাম নিতেও পারিনি ৷শুনেছিস তো কাল মাঝরাতে চৌমাথার কাছে একটা ট্রাক আর মারুতি ভ্যানের মুখোমুখি ধাক্কা লেগেছিলো ৷অনেকগুলো পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে রাতে, তার মধ্যে একজনের অবস্থা খুব খারাপ ছিলো তাকে নিয়েই রাত কাবার হয়ে গেলো ৷যাক্ পেশেন্টটা এখন ভালো আছে ,রক্ত দিয়েটিয়ে এখন একটু চাঙ্গা ৷ওকে কলকাতা রেফার করে দিয়ে এই বের হলাম ৷ ৷”

“ভালো তো থাকবেই স্যার আপনার হাতে যখন পড়েছে  ,খারাপ হওয়ার তো কথা নয় ৷”

“সবই ওপরওয়ালার হাতে বিজয় ,আমি বা আমরা তো নিমিত্ত মাত্র !যাক্  তোর বাবার খবর কি ,কেমন আছেন এখন ?”

“এখন অনেকটা ভালো আছে ৷পারলে একবার দেখে আসবেন ৷”

গত পরশুই বাবাকে নিয়ে এসেছিলো  বিজয়ের দাদা ৷হাসপাতালে দেখাবার সব বন্দোবস্ত সমুদ্রই করে দিয়েছিলো ,চেস্ট স্পেশালিস্ট ডাঃ রায়ের আউটডোরে ৷সি ও পি ডির পেশেন্ট বিজয়ের বাবা,তা ডাঃরায় ভালো করেই দেখে একটা এক্সরে করিয়ে ,কটা টেস্ট লিখে ,নেবুলাইজেশন করতে বললেন ,কয়েকটা ওষুধও লিখে দিয়েছিলেন ৷

“টেস্টগুলো করিয়েছিস ?”ডাঃ রায়কে দেখিয়েছিস তো ?”

“হ্যাঁ,তবুও একবার দেখাতম আপনাকে “ 

“ডাঃরায় খুব ভালো ডাক্তার ,কোনো চিন্তা করিস না আমি ওনার সাথে কথা বলে নেবো ৷ঠিক আছে কাল পরশুর মধ্যে একদিন তোর বাবাকে গিয়ে দেখে আসবো ৷এখন আসি রে”৷

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ইন্জিন স্টার্ট করে ,ফোনটা বেজে ওঠে ,ফোনটা অন করতেই পর্ণার নাম ফুটে ওঠে ৷গাড়ি গিয়ারে ফেলে আস্তে আস্তে ক্লাচ ছাড়তে ছাড়তে বলে “আজ আসি রে বিজয় ,দেরি হয়ে গেলো ,একটু বিশ্রামের দরকার…….”

সমুদ্র এই হাসপাতলে এসেছে প্রায় পাঁচ বছর হোলো ৷প্রথম প্রথম এখানে এসে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগতো ৷কলকাতার কলরবমুখর পরিবেশ থেকে মফস্বলের এই সাবডিভিশন হাসপাতালে এসে মনে হোতো বনবাস পর্ব চলছে ৷যদিও খোলামেলা পরিবেশ ,কলকাতার তুলনায় লোকজন কম সবুজের সমারোহ বেশী ৷হৈ হল্লাও অনেক কম ,রাত ন’টার পরে শহরটা খুব তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যায় ..শান্ত জীবন যাপনের আদর্শ পরিবেশ ৷কিন্তু যার জন্ম থেকে শুরু করে বড় হওয়া সবই কলকাতাতে তার তো পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা খুবই মুশকিলের ৷কোয়ার্টার থেকে হাসপাতাল আর হাসপাতাল থেকে কোয়ার্টার ,মাঝেমধ্যে কলিগদের সাথে একটু গল্পগুজব এই করেই জীবন চলছিলো প্রথমদিকে ৷তখনও বিয়ে হয়নি ,যদিও বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ,চাকরিতে জয়েন করার কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ের কথা৷ এই পরিস্থিতিতে তখন মনে হোতো এ কোথায় এলাম রে বাবা ৷বাড়িঘর ,বাবা, মা ,পর্ণা সব ছেড়ে একা একা এই রাত ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া এ শহরটা কেমন ? দিনটা তবু কেটে যেতো সন্ধ্যের পর সময় কাটতেই চাইতো না ৷সমুদ্রের আবার রোজ একটু আড্ডা না মারলে চলেনা ৷কিছু কিছু কলিগের সাথে আলাপ হয়েছিলো বটে কিন্তু তারা এতো ব্যস্ত যে দল বেঁধে আড্ডা মারার সময়ও নেই তাদের ৷একটা উপায় ছিলো শহরের নার্সিংহোমগুলো থেকে মাঝে মাঝে আসা ডাকে সাড়া দেওয়া ,কিন্তু চার দেওয়ালের মধ্যে রাতদিন আবদ্ধ থাকা সে আরও কঠিন কাজ সমুদ্রর কাছে ৷কাজেই একা একা থেকে আসার কয়েকদিন পর থেকেই মনে প্রাণে দিন গুনতে শুরু করে দিলো কবে এখান থেকে বদলির  ৷এমতাবস্থায় হাসপাতালের অন্যান্য কর্মী, সহকর্মীরাই ওর কথা বলার লোক হয়ে উঠলো ।এ ছাড়া রোজ চা খেতে খেতে গল্প করার সুবাদে বিজয়কেও মনে ধরে গেলো ৷

বিজয় ছেলেটাও বেশ ভালো ৷সেই সুদূর বিহার থেকে এসেছিলো কাকার হাত ধরে তেরো বছর বয়সে ।কাকার হাসপাতালের সামনে চায়ের দোকান ছিলো ,সেখানেই বিজয় কাকাকে সাহায্য করতো ,কাকা হঠাৎ মারা যাবার পর বিজয়ই এখন দোকানের মালিক ,তা প্রায় আট ন’বছর হোলো ৷চায়ের দোকান বলতে অবশ্য ঠেলাগাড়ি ,সকাল সাতটা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত চা চপ মুড়ি বিস্কুট সবই মেলে বিজয়ের ঠেলাগাড়িতে ৷দিনের শেষে ভালো রোজগারও হয়  ৷বিজয় প্রচন্ড পরিশ্রমী ,তবে সমুদ্রকে বিজয়ের যে গুনটা সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করেছিলো সেটা হোলো ওর জানার আগ্রহ ৷নিয়ম করে ও বাড়ি ফিরে দেশ বিদেশের খবর দেখে ,জিওগ্রাফি হিস্ট্রি চ্যানেল দেখে আর সমুদ্রর সাথে দেখা হলে তাই নিয়ে আলোচনা করে  কাজের ফাঁকে ফাঁকে ---এইভাবে কিছুদিনের মধ্যেই দু’জন অসম মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো ৷

 সমুদ্র বরাবরই এ যুগের সেই বিরল প্রজাতির একজন যাদের মাথায় পরোপকারের ভূত চেপে আছে ৷প্রথম প্রথম এখানকার নিঃসঙ্গ জীবনে অনেকের পিছনে সময় খরচা করেছিলো ,কিন্তু বছর চারেক বিয়ে হওয়ার পর থেকে সংসারই তার ধ্যানজ্ঞান ৷বছর চারেক বিয়ে হলেও কোয়ার্টারে এখনও সেই সে আর পর্ণা ,এখনও কোনো সন্তান হয়নি তাদের যদিও পর্ণা বলেছিলো এবারের পিরিয়ডটা মিস্ করেছে ৷আগেও একবার এ রকম হয়েছিলো কিন্তু কোনো শুভ খবর হয়নি সেবার ৷তাই সমুদ্র এবার আর তাড়াহুড়ো করেনি ,আরও কয়েকটা দিন দেখতে চায় ও ৷এবারও যদি ভালো কিছু না হয় তা হলে পর্ণা ভেঙ্গে পড়বে আর সমুদ্রতো ভিতরে ভিতরে আরও ভেঙ্গে পড়বে ৷আজকাল আই ভি এফ করানো অনেক সোজা ঠিকই কিন্তু কোনো গ্যারান্টি তো নেই!তাছাড়া মাঝে মাঝেই তার জন্য কলকাতা যেতে হবে ,অতো ছুটিই বা কি করে পাবে ?

পর্ণা চৌধুরী ,নামটা এক সময়ে যেমন হৃদয়ে আলোড়ন তুলতো প্রাক বিবাহ যুগে , বিয়ের পাঁচ বছর পর সংসারের স্বাভাবিক নিয়মে তা অনেকটাই কমেছে ,ভালোবাসাটা অবশ্য একই রকম রয়ে গেছে ৷এখন একটা ছেলে বা মেয়ে হলে বন্ধনটা আরও জোরদার হয় ৷মনে মনে ঈশ্বরের কাছে সে প্রার্থনাই করে সমুদ্র রাতদিন ৷পর্ণা ,পর্ণা চৌধুরী আদতে নদীয়ার শান্তিপুরের মেয়ে ,শান্তিপুরের বিখ্যাত সেন বংশে মেয়ে ৷ওর দাদু স্নেহময় সেন ‘সেন ব্রাদার্স’ বলে ছোট্ট শাড়ির দোকান চালাতেন শান্তিপুরে ৷তাঁতের শাড়ি তৈরীও করতেন নিজের হাতে ৷দাদুর অধ্যবসায়ে দোকানের সুনাম একটু একটু করে ছড়াতে লাগলো ৷সে কত বছর আগেকার কথা , তারপর আস্তে আস্তে শুরু হোলো শাড়ির পাইকারি ব্যবসা ৷শাড়ির ডিজাইন ,বুনোটে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগালেন স্নেহময় ফলে বাজারের অনেককে পেছনে ফেলে স্নেহময় সেনের তৈরী শাড়ির কদর দিনকে দিন বাড়তে লাগলো ৷কলকাতা থেকে লোকজনের মানে বড় বড় শাড়ির দোকানের প্রতিনিধি আসতে লাগলো ,পছন্দ করে অর্ডার দেওয়াও শুরু হোলো ৷শুরু হোলো এক নতুন অধ্যায়ের ৷তবে স্নেময় সেন খুব ধুরন্ধর লোক ছিলেন আর ছিলেন প্রচন্ড দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ৷তাই একদিন বড়ছেলে শ্রীময় মানে পর্ণার জ্যাঠাকে ডেকে বললেন “শোন্ শ্রীময় কলকাতার ই এম বাইপাশের কাছে  মুকুন্দপুর বলে একটা জায়গা আছে ,জায়গাটার একটু খোঁজখবর নে তো৷ যাদবপুরের কাছাকাছি জায়গাটা ,ভাবছি ওখানে আমাদের একটা নিজস্ব দোকান করলে কেমন হয় ৷একদিন গিয়ে একটু সার্ভে করে আয় ,কি ভাবে ওখনে জমি কেনা যায় ,কত দর চলছে সব জেনে আসবি ৷এখানে যেমন চলছে চলুক ,কলকাতাতেও ব্যাবসাটা ছড়িয়ে দিতে হবে ৷ওখানের অনেকেই তো আমার কাছে শাড়ি নিতে আসে ,তাদেরই একজনের সাথে কথা বলেছি ,তার নাম ফোন নং দিয়ে দেবো ,ও তোকে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে ৷ওখানে ব্যাবসা শুরু করা যায় কি না? ,করলে ভবিষ্যত কি? সব যতটা পারিস বুঝে আসবি ৷ক্যাপিটাল নিয়ে চিন্তা করিস না ,শান্তি বা কৃপা কাউকে নিয়ে যেতে পারিস তবে একজনের তো ব্যাবসার বুদ্ধি নেই আর কৃপা তো গানবাজনা নিয়েই আছে ৷পর্ণার বাবা শান্তিময় বরাবরই কম কথার মানুষ ব্যাবসায় বাবাকে সাহায্য করে বটে তবে অত চৌকস নয় দাদার মতো আর কাকা কৃপাময় তো রাতদিন গানবাজনা নিয়েই ব্যাস্ত ,ও সম্পূর্ণ অন্য জগতের মানুষ ৷দাদুর দাপটে এখনও বাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে থাকে শুধু কৃপাময় বাদে ৷ এখনও তাদের এই একান্নবর্তী পরিবারে তিনভাই এর মধ্যে বনিবনার অভাব নেই ৷ পর্ণা তার দাদুর একমাত্র নাতনি ,তাই সে তার দাদুর কাছে আলাদা খাতির পায় ৷তা ছাড়া আরও একটা কারন আছে ,পর্ণার জন্মের পর থেকেই স্নেহময়বাবুর ব্যাবসার বাড়বাড়ন্ত শুরু ,তাই পরিবারের মধ্যে পর্ণার  অসীম প্রতিপত্তি ৷মাঝে মাঝে স্নেহময় বাবু ওকে বলেন ‘তোর ঠাকুমা তো আমাকে রেখে তো  অনেক আগেই চলে গেছে ,আমি আর কতোদিন থাকবো জানিনা ,চোখ বন্ধ করার আগে ভালো ঘর দেখে একজন ভলো নাতজামাইয়ের মুখ দেখে যেতে পারলে জীবনটা সার্থক হবে ৷’

শ্রীময় তো একদম বাপ কা বেটা ,খোঁজখবর আনতে বেশীদিন লাগলো না ,জমি কিনতেও দেরি হোলোনা ৷বছর দু’য়েকের  ওখানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকে বাড়িও বানিয়ে ফেললো ৷একতলাটায় বিরাট শোরুম আর দোতলা তিনতলায় থাকার জায়গা ৷শুরু হয়ে গেলো ‘সেন ব্রাদার্স’ এর কলকাতার শো রুম ৷শ্রীময় অবশ্য বাবার থেকেও এককাঠি সরেস ব্যাবসার দিক থেকে ৷এই দু’বছরে বাড়ি তৈরীর অভিজ্ঞতা ,স্থানীয় লোকদের সাথে পরচিতি এইসব কাজে লাগিয়ে টুক করে পাশাপাশি একটা বালি সিমেন্টের ব্যাবসাও খুলে ফেললো ৷ছোট্ট করে বাড়ির লাগোয়া অফিস তৈরী হলো ,শান্তিপুর থেকে কয়েকজন আর লোকাল কয়েকজনকে কর্মচারী হিসেবে রেখে দিলো ৷দুটো কাজেই প্রথম প্রথম প্রচুর বাধা এসেছিলো ঠিকই কিন্তু শ্রীময়ও পাকা খেলোয়ার ,বিভিন্ন সোর্সকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদের সাথে বসে ব্যাপরটা মেটাতে বেশীদিন লাগলো না ৷রীতিমত একটা কর্পোরেট লুক নিয়ে ধুমধাম করে উদ্বোধন হয়ে গেলো দুটো ব্যাবসারই ৷স্নেহময় তো দারুণ খুশি সেদিন ,নিজের দুরদৃষ্টি আর ছেলের ব্যবসায়ী বুদ্ধি আর পরিশ্রমের জন্য গর্ব বোধ করলেন ৷ পর্ণা দু’বছর আগে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে এবং বেশ ভালো নম্বর পেয়ে ৷ও  বরবরই পড়াশুনোয় ভালো ,স্নেহময়ের ইচ্ছে ছিলো ও ডাক্তারি পড়ুক ,কিন্তু মাধ্যমিকের পরেই ও জানিয়ে দেয় যে ইংরেজি নিয়ে পড়াই ওর একান্ত ইচ্ছে ৷স্নেহময় বা শ্রীময় সে ইচ্ছেতে বাধা দেননি ৷ওর ইচ্ছেমত সেন্ট জেভিয়ার্সে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তিও হয়ে গেলো ৷যদিও ও কলেজের কাছাকাছি একটা মেয়েদের হোস্টেলেই থাকে এখন ,সে কলকাতার বাড়ি হওয়ার দু’বছর আগের কথা৷

বেশ কিছুদিন চলে যাওয়ার পরে একদিনের কথা ভেব পর্ণার বুক আজও কেঁপে ওঠে ,আবার তার সাথে সাথে একটা সুখের পাখিও বুকর মধ্যে ডানা ঝাপটায় ৷সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি ,সে এক অন্য অনুভুতি !দিনটা ছিলো এক রবিবার ৷পর্ণা মাঝেমধ্যেই তখন শনিবার শনিবার শান্তিপুর যেতো ,প্রধানত ঠাকুর্দার  সাথে দেখা করতে  ,সোমবার ফিরতো ৷তবে কোনো কোনো রবিবার বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে যাওয়া হোতোন ৷তা সেদিনও হোস্টেলেই ছিলো ,সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়ার কথা শীতের দুপুরে৷একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সবাই গন্তব্যস্থল ঠিক করতে বসেছে  ওমনি দারোয়ান এসে খবর দিলো ‘পর্ণা দিদিমনি নীচে একজন আপনাকে ডাকছে বলছে জরুরি দরকার ,আপনার বাড়ি থেকে এসেছে ৷একরাশ চিন্তা নিয়ে নেমে দ্যাখে জ্যাঠার গাড়ির ড্রাইভার বিকাশদা দাঁড়িয়ে ৷ওকে দেখামাত্রই বলে “দিদিমনি আপনি তাড়াতাড়ি চলুন কাল ভোর রাতে আপনার জ্যাঠার প্রচন্ড পেটে ব্যাথা হওয়ায় ওনাকে ‘হেলদি লাইফ’ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছে ৷ডাক্তার বলেছে এ্যপেন্ডিসাইটিস ,এখনই অপারেশন করতে হবে , সকাল সাড়ে দশটায় তা হবে ৷শান্তিপুরে আপনা বাবাকে জানিয়েছিলাম ভর্তি করেই ,ওনারা রওনা দিয়ে দিয়েছেন  একটু পরেই পৌঁছে যাবেন ৷ওনারা আপনাকে ডেকে নিতে বললেন ৷আপনার জ্যেঠিমা একা বসে আছেন নার্সিংহোমে ৷

তারপর আর কি কয়েকজন বন্ধুসহ গাড়িতে চেপে সোজা নার্সিংহোম ৷গাড়ি থেকে নেমেই জ্যেঠিমার  সাথে দেখা হোলো ৷তারপর বাবাদের অবস্থানটা জেনে নিলো ,ওঁদের পৌঁছাতে এখনও একঘন্টা ৷জ্যেঠিমার যা অবস্থা অপারেশনের বন্ডে সই করানোই মুশকিল হয়ে গেলো ,আর এরা যা তাড়া দিচ্ছে তাতে রিস্ক বন্ডে শেষ পর্যন্ত পর্ণাকেই সই করতে হোলো ৷তারপর যখন শ্রীময়কে ও টিতে নিয়ে গেলো পর্ণার বুক ঢিপ ঢিপ করতে শুরু হোলো ৷যদিও গোটাটা একটা ফর্মালিটি তবুও একজন নিজের লোকের জীবন মরণের বন্ডে সই করা বলে কথা ৷যদিও ভালো নার্সিংহোম ,নামকরা সার্জেন ,সবই ঠিক আছে তবুও যদি জ্যাঠার কিছু হয়ে যায়,বাবারা আসার আগেই ?ভাবতেই একটা হিমেল স্রোত মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেলো পর্ণার ৷

তারপর অনন্ত অপেক্ষা ,বাবা,কাকারা এখনও আসেনি ,ফোনেও ওদের পাওয়া যাচ্ছে না তাই চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ ৷তবু বন্ধুরা আছে বলে কিছু বাঁচোয়া ৷ সব প্রতীক্ষার একটা শেষ আছে,কিছুক্ষনের মধ্যে অপারেশনের ঘরের বাইরের লাল আলোটা নিভে গেলো ৷একটা ছোট্ট ট্রে হাতে ওটির ড্রেস পরা একজন বললো “শ্রীময় সেনের বাড়ির লোক কে আছেন ?” পর্ণাই এগিয়ে গেলো৷“আপনি ?কে হন ওনার ?বড় কেউ নেই ?পুরুষ আত্মীয় ?”

“এখন নেই এসে পড়লো বলে ,তবে যা বলার  আমাকেই বলুন,আমি পর্ণা ,পর্ণা  সেন , ওনার ভাইঝি, আমি কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ি ৷তা ছাড়া আমিই তো বন্ডে সই করেছি ৷”ট্রে’র মধ্যে থাকা একটা কেঁচোর মতো জিনিষ দেখিয়ে বললো “এই দেখুন এটা এ্যপেন্ডিক্স আর কিছু পরে আনলে এটা ফেটে গিয়ে পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যেতো ৷তবে এটাও এমন জড়িয়ে গেছিলো স্যারের মতো সার্জেনেরও এটা বার করতে ঘাম ছুটে গেছিলো ,তবে পেশেন্ট ভালো আছে ,একটু পরেই বেডে দিলে একে একে দেখা করবেন ৷”

ও টি ড্রেস ,চোখে চশমা ,ভালো করে দেখতে না পলেও সেই প্রথম দেখা পর্ণা আর সমুদ্রর  !অবশ্য তখনও নাম পরিচয় জানা হয়নি সমুদ্রর যদি না পাশ থেকে এক ওয়ার্ডবয় বলে দিতো ‘উনি প্রোফেসর বক্সীর  সহকারী সার্জেন ,পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট ওনার ৷খুব ভালো ছেলে আর হাতও খুব ভালো ,না হলে বক্সী সাহেব যাকে তাকে সহকারী হিসেবে আনেন না ৷

বেডে দেওয়ার পরে প্রোঃ বক্সী সহ সমুদ্র এসেছিলো চেকআপে তখনই দুজনের ভালোভাবে দেখা ৷দুজনের চোখের খেলে যাওয়া বিদ্যুৎ বন্ধুদের নজর এড়ায়নি ৷ওরা চলে যেতেই রূপা বলে “হ্যাঁরে পর্ণা ,ছোকরা ডাক্তার তো বলে তোর জ্যাঠার পিঠে ইন্জেকশন দিয় অপারেশন হয়েছে ব্যাথা লাগবে না এখন ,তা তোর কি বুকে ব্যাথা শুরু হোলো ?দুজন দুজনকে যে ভাবে দেখছিলি আমার তো মনে হয় দুজনেরই হৃদয়ে ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে ।“বাকি বন্ধুরাও হেসে ওঠে ৷

লজ্জায় লাল হয়ে পর্ণা বলে “তোরা কি রে ?জ্যাঠার অপারেশন হোলো ,এই মাত্র বেডে দিলো আর তোরা এই সময় ফালতু বিষয় নিয়ে আমার সাথে  মজা করছিস ?চিনি না ,জানি না ,কথা পর্যন্ত হয়নি আর তোরা বেশ শুরু করে দিলি ?”

“সবই হবে, এই আমি ভবিষ্যৎবাণী করে দিলাম তুই মিলিয়ে নিস ৷ছোকরা ডাক্তার তোর দিকে এমন করে তাকিয়েছিলো ,তোর পিছু সহজে ছাড়বে বলে মনে হয় না ৷অবশ্য তুইও যা তাকালি তাতে তো মনে হচ্ছে তোরও একই দশা ৷”বলে ঋতিকা হেসে গড়িয়ে যায় ৷ 

“তোরা বেশ করছিস ভাই ,আমি মরছি নিজের টেনশনে ,বাবারা এখনও এসে পৌঁছালো না ,ফোনেও পাচ্ছিনা …….বলতে বলতেই শান্তিময়রা হুড়মুড় করে ঢোকেন নার্সিংহোমে ৷”আর বলিস না পথে যা জ্যাম ,তার সাথে আবার পেছনের টায়ার পাংচার সব মিলিয়ে খুব দেরি হয়ে গেলো ৷অপারেশন হয়ে গেলো না কি ?”

“হ্যাঁ ,এইমাত্র বেডে দিলো ,যাও দেখা করে এসো,ভালোভাবেই হয়েছে, জ্যাঠা ভালো আছে ৷আপাততঃ আমার দায়িত্ব শেষ ৷”

কৃপাময় বলে “তুই কতো বড় হয়ে গেছিস রে ৷এখন তোকে সেন বাড়ির মেয়ে বলে ভাবতে গর্ববোধ করছি ৷”

“ষাও বাবা ,কাকা ৷আমরা ক’বন্ধু মিলে সামনে থেকে কিছু খেয়ে আসি ৷”

শান্তিময় পর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে”সত্যিই তো ,সকাল থেকেই তো তোরা না খেয়ে আছিস ,যা তাড়াতাড়ি যা ৷আমরা দেখে এসে এখানেই থাকছি ৷”

ঋতিকার ভবিষ্যৎবাণী মিলেও গেছিলো ৷

পর্ণা যতই মুখে অস্বীকার করুক ,সমুদ্রকে তারও প্রথম দেখাতেই ভালোই লেগেছিলো ৷যতদিন জ্যাঠা ভর্তি ছিলো সমুদ্র একবার করে রাউন্ড দিয়ে যেতো ৷তবে পেশেন্ট দেখার থেকে বেশি খুঁজতো পর্ণাকে ৷তারপর যা হয় ,আলাপ পরিচয় ভালোলাগা থেকে সম্পর্কটা ভালোবাসায় কখন যে গড়িয়ে গেলো কেউ বুঝতেও পারল না ৷

শ্রীময়ের ছুটির আগের দিন প্রোঃ বক্সী এসে বলেন “সমুদ্র ,তোমার পেশেন্ট কেমন আছে ?”

“স্যার আমার তো নয় আপনার পেশেন্ট তো ৷”

“আমি তো অপারেশন করেই খালাস ,এ কদিন দেখভাল তো তুমিই করলে ৷জানো আমারও আদি বাড়ি শান্তিপুরে ৷সেই কবে বাড়ি ছেড়েছি ,কথায় কথায় জানতে পরলাম পেশেন্ট এর বাবা আমার বাবার পরিচিত ,ইন ফ্যাক্ট ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে ওনাদর বাড়িও কয়েকবার গেছি ৷যাক্ উন্ড ঠিক আছে ,কাল স্টিচটা কেটে ছুটিটা লিখে দিও ,আমি সই করে রেখে যাচ্ছি ৷বাই দ্যা বাই তোমার কোনো এনগেজমেন্ট আছে ?বা গার্লফ্রেন্ড ?”সমুদ্র তো আকাশ থেকে পড়লো ,লজ্জায় লাল হতে হতে বলে “না স্যার ,কেনো স্যার ?”

“আমার চুল এমনি এমনি পাকেনি সমুদ্র আর আমার বয়সও একটা সময় তোমার মতো ছিলো ৷তা আমার পেশেন্টের ভাইঝিকে তোমার কেমন লাগলো ?ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে জেভিয়ার্সে ফাইনাল ইয়ার ৷দেখতে শুনতে ভালোই ,ভালো ঘর ৷আর আমার চোখ কান যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে তবে যা দেখেছি আর এখানে ক’দিনে যা শুনছি তাতে মেয়েটকে তোমার ভালো তো লেগেইছে আর স্ভবত ও তরফেরও তাই ৷ঠিক কি না ?”

আবার লজ্জা জড়ানো কন্ঠে সমুদ্র বলে “কি যে বলেন স্যার ৷”

কিছু বলতে হবে না ,তোমার বাবার ফোন নম্বরটা দাও ,আর একটা কথা পেশেন্টেরও তোমাকে খুব ভালো লেগেছে ৷এ সব ব্যাপার আমি একদম পছন্দ করিনা ,তবে দেখা গেলো পেশেন্ট আমার পরিচিত ,একই জায়গার লোক আর তুমিও তো আমার ছেলের মতো ৷জীবনে তো অনেক অপারেশন করলাম,তোমার মতো ছেলের জন্য জীবনে একবার না হয় ঘটকালি নামক অপারেশনটাও করলাম ,কি বলো ?”

তারপর …তারপর পর্ণা পাশ করতেই চারহাত এক হয়ে গেলো ৷দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেলো ৷সমুদ্রেরও এই সাবডিভিশন হাসপাতালে সার্জেন হিসেবে চাকরীর চার বছর হয়ে গেলো ৷সবই ঠিকঠাক আছে তবে ঈদানীং এতোদিনেও সন্তান না হওয়ার দুঃখ মনের মধ্যে একটা কাঁটার মতো খচ্ খচ্ করে চলে প্রতিনিয়ত ৷সেই সব পুরোনো স্মৃতি মাথার মধ্যে বয়ে নিয়ে যেতে যেতে কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেলো খেয়ালই করেনি সমুদ্র ৷মটরসাইকেলটা স্ট্যান্ড দিয়ে ঘরে ঢুকতেই পর্ণা জিজ্ঞেস করে “ কি হোলো এতো দেরি ?নাইট কেমন গেলো ?”

“ভালোই ,ফ্রেশ  হয়ে নিই , তারপর প্রেগনেন্সি টেস্টটা করে নাও ৷কিটটা বের করে রাখো আমি বাথরুম থেকে আসছি ৷”

“ঠিক আছে ,ঠিক আছে সে তো আর পালাচ্ছেনা ৷বাবা রাতে ফোন করেছিলো ,আজ আসবে বলেছে ৷আগে মুখ হাত ধুয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও ৷তরপর স্নান করে বাজার ঘুরে এসো যদি ভালো চিংড়ি পাওয়া যায় ৷জানো তো বাবা চিংড়ি খেতে খুব ভালোবাসে৷”

“ঠিক আছে ৷”

হঠাৎই সমুদ্রর পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে ওঠে ৷অলস হাতে বের করে দেখে বিজয়ের ফোন ৷এর মধ্যে আবার ফোন করছে কেনো ?এই তো কিছুক্ষন আগেই কথা হোলো ৷ফোনটা ধরতে বিজয়ের গলা “স্যার বলতে খুব খারাপ লাগছে ,সারা রাত জাগা আপনি ,তবুও একবার যদি বাড়িতে আসেন তাড়াতাড়ি খুব ভালো হয় ৷বাবার অবস্থা খুব খারাপ ৷আসবেন স্যার একবার ?”

“যেতে তো হবেই ৷শোন তুই এক কাজ কর ,বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যা এখনই ৷আমিও হাসপাতালে যাচ্ছি দেখি কি করা যায় ৷পর্ণা ,বিজয়ের বাবার খুব শরীর খারাপ ,আমি আবার একটু ঘুরে আসছি হাসপাতাল থেকে ৷”

“যেতে তো হবেই ,তবে কাজ হয়ে গেলেই চলে আসবে ৷”

কিছুক্ষনের মধ্যেই হাসপাতাল পৌঁছে যায় সমুদ্র ৷ততক্ষনে বাবাকে ভর্তি করে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বিজয় ৷

স্যার এসেছেন ,ডাঃ ব্যানার্জী আছেন দেখে তো বললেন জোরালো হার্ট এ্যাটাক ,কিছু বলা যাবেনা এখনি ৷আপনি যদি ওনার সাথে একটু কথা বলেন  ৷”

“ঠিক আছে ডাঃ ব্যানার্জী তো মেডিসিনের ভালো ডাক্তার ,চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে ৷”

মোটামুটি ডাঃ ব্যানার্জীর সাথে কথা বলে যা বোঝা গেলো ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাকই হয়েছে ,কলকাতা নিয়ে যেতে হবে তবে এখন যা অবস্থা নিয়ে যাওয়া যাবে না ,যদি অবস্থা একটু ভালো হয় তবেই সেটা সম্ভব ৷ তবে একটা ভালো লক্ষণ ওষুধে সাড়া দিচ্ছে পেশেন্ট ৷

সমুদ্র বিজয়কে বলে বাড়ি ফিরে এলো ৷খুব বেশি সময় লাগলো যে তা নয় ,সারা রাত জাগার ক্লান্তি তাকে একদম শেষ করে দিয়েছে ৷সকালটাও এতো তাড়াহুড়োর মধ্যে কাটলো যে মাথাও কাজ করছে না ৷মনে মনে ভাবলো সকালের আসল কাজটাই তো বাকি রয়ে গেছে ৷যাক্ আগে স্নান করে খেয়ে নিয়ে ফ্রেশ হওয়া যাক তারপর ধীরে সুস্থে দেখা যাবে ৷

দুপুর বেলায় দু’জনে খুশি মনে বসে আছে ,টেস্ট পজিটিভ এসেছে ,অবশেষে তারা সম্ভবত সন্তানের মুখ দেখতে লেছে ৷পর্ণা তো ফোন করে করে দু’বাড়িতেই জানিয়ে দিয়েছে যদিও সমুদ্র এখনই জানাতে বারন করেছিলো,কিন্তু কে তার কথা শোনে৷সমুদ্র জানে অনেক সময় ভুলও হয় এইসব টেস্টের ক্ষেত্রে ,তবু ভালোটা ধরেই চলতে হবে ৷এতক্ষন বিজয়ের বাবার কথা ভুলে গেছিলো ,খবরটা নেবার জন্য ফোনের দিকে হাত বাড়াতই ফোনটা বেজে ওঠে ,ধরতেই বিজয়ের কান্না ভাঙা গলা পেলো ৷”স্যার বাবা এইমাত্র আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ৷ভালোই ছিলো ,হঠাৎই কি যে হোলো ,আপনি একবার আসবেন ?”

“আমি আর এখন গিয়ে কি করবো রে ৷বডি নিয়ে বাড়ি যা ,আত্মীয়স্বজনকে খবর দে ,আমি বিকেলে যাচ্ছি তোর বাড়ি ৷”

কাছের লোক বলতে তো আপনি স্যার ,তাই আপনাকেই প্রথম জানালাম ,দুরের আত্মীয়দের খবর দিয়েছি ,ওরা আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে ৷আপনি তাহলে আপনার সময়মতো একবার আসুন বাড়িতে৷”

ধীরে ধীরে ফোনটা নামিয়ে রাখে সমুদ্র ,মনে মনে ভাবে এই তো মানুষের জীবন ৷একদিকে আসা অন্যদিকে যাওয়া!বিশ্বের এই বালুকাবেলায় অজস্র বালুকনার মতো জীবন বাসা বাঁধছে আর সময়ের ঢেউ তাদের ফেরৎ নিয়ে যাচ্ছে ,রেখে যাচ্ছে নতুনদের !

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment