1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

করোনাঃ তিনটি প্রেক্ষাপট

ছবি : ইন্টারনেট 


করোনাঃ তিনটি প্রেক্ষাপট 

ডাঃআনোয়ার আলি মল্লিক

ঘটনা ১


-হ্যালো ডাক্তারবাবু

-হ্যাঁ বলুন, কেমন আছেন? 

-সেই যে কবে দেখা হয়েছিল, আপনি এদিকে আর আসেন না। বহুদিন দেখা হয়নি, এই আর কি। 

-হ্যাঁ ওদিকে যাইনি অনেকদিন। কাজ থাকলে নিশ্চয়ই যাবো। ঘোরার শখ থাকলেও ডাক্তার যে, উপরন্তু কোভিডের সময়, এখন ঠিক হবেনা। 

-আমি ভালোই আছি, তবে ইদানীং জ্বর মাথাব্যথা হচ্ছে, তবে শ্বাসকষ্ট নাই। কাজ থেকে ছুটি দিয়েছে, কলকাতা এলাম, ভাবলাম আপনাকে ফোন করি, তাই-

-হ্যাঁ ভালোই করেছেন। হাসপাতালে আসুন, ফিভার ক্লিনিকে দেখান। এখন তো অতিমারীর সময়, ডাক্তার দেখানো এবং সাধারণ সতর্কতা অবশ্যই মেনে চলা উচিৎ। আপনি আসুন, আমি যতোটা পারি নিশ্চয়ই সাহায্য করবো। সাবধানে থাকুন, প্রচুর জল খান, বিশ্রামে থাকুন, মাস্ক পরুন। 

-হ্যাঁ, যাবো আজই।

মাত্র মিনিট দুইয়ের মুঠোফোনের বাক্যালাপ। এখন জগত এই মুঠোফোনেই। সকাল সাড়ে সাতটায় সুদূর তিনশো কিলোমিটার দূর থেকে এই ফোন। তাই ডিউটিতে যেতে দেরি হয়ে যাবে বুঝলেও ফোনটা ধরেই ফেলেছিল নির্মল। পরিচয় হয়েছিল পড়তে গিয়ে, বিদেশে, মোটরসাইকেলের মেকানিক ভদ্রলোক - হাসান সাহেব। পাতলা রোগা মধ্যবয়স্ক, মুখে ট্রেডমার্ক সর্বদা লেগে থাকা মুচকি হাসি আর 'জ্বি, বলুন', খুবই পরোপকারী মানুষ। তাই নির্মল ফোনটা ধরে ভালো করেই সব বুঝিয়ে বললো। 

যাকগে - ডিউটির তাড়া - মাস্ক পরে স্যানিটাইজার পকেটে নিয়ে চটজলদি তৈরী হয়ে যায় শল্যচিকিৎসক নির্মল। আউটডোরে শত রোগীর ভিড় সামলাতে হয়, মাস্ক সেখানে এখনো অমিল! এই অতিমারীর সময়ও মানুষের সচেতনতা কোথায় কে জানে? মুক্তি নেই ডাক্তারদের। তবে শল্যচিকিৎসা বিভাগে রোগীর ভিড় তুলনামূলকভাবে কম, তাই কাজের মাঝে মাথায় হাজারো প্রশ্ন - জীবন মৃত্যু এই এক অদ্ভুত খেলা - তাতে জয় কার? তারই মাঝে জীবনের দৌড়াদৌড়ি। 

দুপুরের দিকে হাসান সাহেবের কথা মনে হতেই ফোন করে বসল নির্মল। কিন্তু ফোন বেজেই গেল, ওপারে কোনো উত্তর নেই। মনে মনে রাগই হল। এখনই কোভিড রোগীতে ভরে যাচ্ছে হাসপাতাল গুলো। হাসান সাহেবের যা উপসর্গ, নির্ঘাত কোভিডের আক্রমণ। নির্মল ওনাকে সঠিক পথই দেখিয়েছিল কিন্তু সে-ই তো আর এল না। যোগাযোগও করল না। অথচ মানুষটা ভালো বলে নির্মল যেচেই সাহায্য করতে চেয়েছিল। একসময় মোটরসাইকেল সংক্রান্ত অনেক ব্যাপারেই উপকার পেয়েছে ভদ্রলোকের কাছে। একটু ভারাক্রান্ত ও রাগান্বিত হল মনটা। অথচ কে সে? এই বিশ্বসংসারে সে অ হাসান সাহেব সামান্য দুটি জীব মাত্র। যাকগে, ঈশ্বর ওনাকে সঠিক পথে নিয়ে যাক, এই ভেবে মাথা থেকে চিন্তাটা আপাতত বের করে দিল। 

আবার রোগীর চাপ। আর তারই সাথে আতঙ্ক। করোনা ভাইরাসভো কোভিড! কি রোগ রে বাবা! না আছে চিকিৎসা - যা কিছু চলছে - তবু - ইনফেকশন হয়েই চলেছে৷ অনেকেই চুপচাপ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে। যদিও সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে তা সামান্যই। কিন্তু আতঙ্ক আর ভয় তো গিলে ফেলছে সমাজকে। আর তার সাথে রয়েছে ব্যবসায়িক মুনাফা লোটার লোভ। দুইয়ে মিলে বেশ এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে মানুষ। 

কাজের চাপে ক'টা দিন এভাবেই কেটে গেল। নিজের শরীরটা খারাপ লাগলেই মনে ভয় ঢুকে যায় বটে তবুও যা এতদিনের অভ্যেস, জীবন যেমনই আসুক, জিততে হবেই - এই মানসিকতাতেই চালিয়ে নিচ্ছে। ইদানিং একটু পুজো-আচ্চাটাও বেশিই করছে, মনটা শান্ত হয় এসবে। ভালোই। 

সপ্তাহ খানেক পরের কথা৷ সবে রাউন্ড শেষ করেছে, সুমধুর ধ্বনিতে বেজে উঠলো মুঠোফোন। নম্বর অচেনা। সাত-পাঁচ ভেবে ধরেই ফেলল নির্মল।

-হ্যালো

-ডাক্তারবাবু কেমন আছেন?

-ভালো। (একটু হেসে) আরে হাসান সাহেব, আপনার খবর কি? এলেন না তো আর? কোথায় আছেন, কেমন আছেন? 

-এখন ভালোই আছি। কলকাতায় এসেছিলাম চিকিৎসা করাতে, এখানকার আত্মীয়রা আর হাসপাতালে যেতে দিল না, তাই আর যাওয়া হয়নি। ওরাই প্রাইভেটে দেখিয়ে দিল। 

-বাহ ভালোই তো। এখন সেরে গেছেন তো?

-হ্যাঁ এখন একটু ভালো। আপনি কেমন আছেন?

-ভালো। 

-আজ হাসপাতালে থাকবেন? দেখা করতে যাব তাহলে। 

-হ্যাঁ আসুন না। আমার আরও কিছু রোগী দেখা বাকি। এই ঘন্টাখানেক পরে আসুন। 

শেষমেশ এসেই পড়লেন হাসান সাহেব। আসলে বিদেশে থাকার সময় মোটরসাইকেল নিয়ে অনেক সাহায্য করেছেন এই ভদ্রলোক, তাই নির্মলের খানিকটা কৃতজ্ঞতাবোধও আছে ওনার প্রতি। এই করোনাযুগেও ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে একটু চা না খেলে চলে না নির্মলের। যার থেকে চা খায় তাকে বলাই ছিল, দু কাপ চা আর বিস্কুট দিয়ে গেল। হাসান সাহেবের জ্বর, মাথাব্যথা, অল্প কাশি ছিল, তবে শ্বাসকষ্ট তেমন হয়নি। কাগজ পড়ে যে কেউ কোভিড বলে দাগিয়ে দেবে। তার আত্মীয়স্বজন কি বুঝেছে কে জানে কিন্তু হাসানসাহেবকে তারা হাসপাতালে যেতে ভয় দেখিয়েছে - গেলেই করোনা টেস্ট আর রিপোর্ট না আসা অবধি চিন্তা, ওষুধও শুরু হবেনা। রিপোর্ট আসতে কতদিন লাগবে কোন ঠিক নেই, দুদিনও লাগতে পারে তিনদিনও। সোর্স লাগাতে হয়। এর মধ্যে ভর্তিও করে দিতে পারে, জেলখানার মতো কোয়ারেন্টিনেও পাঠাতে পারে। বেশ কষ্ট। তারওপর সামাজিক একটা ব্যাপারও আছে। বাড়ির আর সকলকেও কোয়ারেন্টিন কয়েদে ঢোকাতে পারে। এরকম হাজারও কারণ। আবার "আমার কাছে এসেছে আমার আত্মীয়, আমি সরকারি বিনে পয়সাতে দেখাব না, রীতিমতো পয়সা খরচ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব, আত্মীয়মহলে আমারও নাম হবে" এটাও কারণ হতে পারে। কারণ যাই হোক, শেষমেশ হাসান সাহেবের আর হাসপাতালে আসা হয়নি। 

খবরের কাগজের ভাষায় পাড়ার চেনা 'পাতি এমবিবিএস' ডাক্তারবাবুকেই দেখানো হল। বললেন, "এই ওষুধ লিখলাম - তিনদিনের ওষুধ, কমলে আসবেন, না কমলে ভর্তি হতে হবে। সিটি স্ক্যানও লাগবে। প্রাইভেটে খরচা বেশি, ভর্তি করালে সরকারিতেই করাবেন।" হাসান সাহেব তা-ই করলেন। একলা একটা ঘরে ক'দিন কাটালেন। নির্মলকে প্রেসক্রিপশনটা দেখালেন, সিটি স্ক্যানও। স্ট্যান্ডার্ড প্রেসক্রিপশন। মোটামুটি নিয়ম মেনেই চলেছেন ভদ্রলোকও। সিটি স্ক্যান দেখে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন -"হুম একটু অসুবিধা আছে বটে, তবে সেরে যাবেন মনে হয়। আরও ক'দিন আলাদা থাকুন, জল-টল বেশি করে খান, নিয়মগুলো মেনে চলুন। নির্মলও দেখলো রিপোর্ট, প্রকারান্তরে করোনার পরিচায়ক, ইনডাইরেক্ট এভিডেন্স আর কি। তবুও ওই ডাক্তারবাবু করোনার টেস্ট করাতে দেননি। রোগী তা-ই মেনে চলেছে। আরও হপ্তাখানেকে অনেকটাই সুস্থ। এখন বিকেলে ঘুরতে বের হন, শরীর দুর্বল, আরও ক'দিনে আরেকটু সুস্থ হয়ে নির্মলের সাথে দেখা করে গেলেন। 

আধঘন্টা হয়ে গেল হাসান সাহেব চলে গেছেন। নির্মল এখনো বসে বসে ভাবছে এভাবেও চিকিৎসা হয়? দারুণ তো। বিশ্বাসটাই আসল। এই অতিমারীর সময়, কারো কোভিড হয়েছে শুনলেই সেও ভয়ে আধমরা হয়ে যায়, সমাজও অচ্ছুৎ বানায় তাকে এই তথাকথিত শিক্ষার জগতেও। তবুও ঠান্ডা মাথায় একই চিকিৎসা সব জেনেও না জানিয়েও হয়। তবে হ্যাঁ, জটিলতা হলে ডাক্তারবাবু সমালোচিত হতেন, ওনার পরিচিতি বা ওনার ওপর মানুষের বিশ্বাস হয়তো ওনাকে বাচিয়ে দিত, হয়তো দিত না! কিন্তু মাইল্ড সিম্পটমের কোভিড রোগীর চিকিৎসা তো করছেন সব নিয়ম মেনেই, শুধু রোগটা কি সেটার উল্লেখ সযত্নে এড়িয়ে। তাতেই হয়তো রোগীর মনের জোরটাও বেড়ে গেছে। যেভাবেই হোক, এই অতিমারীকে জয় আমরা করবই। 

ঘটনা ২

লকডাউন নিয়ম বিধি ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে। তবে বিমলবাবু তার আবাসনে এখনো চালু রেখেছেন কঠোর নিয়মকানুন - সপ্তাহে দু'বার ব্লিচিং স্যানিটাইজ, কমন গেট ইত্যাদি স্প্রে-ও হবে, বিল্ডিংয়ে কোনো কাজের লোক ঢুকবে না, যার যার ফ্ল্যাট থেকে যতটা কম বের হওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি মেসেজ রেগুলার সবাইকে রীতিমতো মগজধোলাই করে বুঝিয়ে যাচ্ছেন সারা দিন ধরে। বিমলবাবুকে সবাই সম্মান করে, প্রেসিডেন্ট বলে কথা এই বিল্ডিং কমিটির। তবে বাড়ির মেয়েরা ওই কাজের লোক ঢুকতে না দেওয়ার একটু বিপক্ষে। তাদের যুক্তি লকডাউন তো শেষ, ভ্যাকসিনও এসে গেল বলে। সরকার বুঝেছে বলেই না….তাহলে আমাদেরও নর্মাল হতে অসুবিধা কোথায়? 

বিল্ডিংয়ের দশটা ফ্ল্যাটের মোটের ওপর বেশিরভাগেরই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রোজগেরে - ব্যবসা বা চাকরি - মোটের ওপর ভালোই চলে যাচ্ছে জীবন। এরই মাঝে - আড্ডা বা সামাজিক কথাবার্তা সবই ওই দুই মিনিটে এসে ঠেকেছে। এখন হোয়াটসঅ্যাপই সব। সেই গ্রুপে হঠাৎ মেসেজ তুতুল পজিটিভ! ওরা থার্ড ফ্লোরে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে গ্রুপে গাইডলাইনের বন্যা বয়ে গেল। কিভাবে আইসোলেটেড থাকতে হবে সবাই বলেও দিল। কিন্তু তুতুলের মা তো কেঁদেই অস্থির। তুতুলের সবে ছয়, তার আবার আইসোলেশন কি করে সম্ভব? তুতুলের বাবা বললেন, -"ঠিক আছে, গ্রুপে লিখে দিচ্ছি তুতুলকে একাকী ঘরে রেখে দেওয়া ইত্যাদি সব হচ্ছে।" ওদিকে গ্রুপে বড় বড় কথা লেখা হয়েই যাচ্ছে। তুতুলের মা তুতুলকে নিয়ে ঘরে বন্দি, কিন্তু সমস্যা হল তুতুলের বাবা বাইরে বের হবেন কিনা! কেউ বলে অমুক গাইডলাইনে এই বলেছে, তো কেউ আরও কড়া অবস্থান নিয়ে বলে ওরা সবাই হাসপাতালে যাকনা কেন? এখানে থাকারই দরকার নেই। আমরা রিস্ক নেব কেন? এই চলতে থাকে। আরেক বিপত্তি, ওদের ঘরের ময়লা ফেলা নিয়ে। পিপিই পরা কর্পোরেশনের সাফাইকর্মী সপ্তাহে একদিনের বেশি আসতে পারবে না, তাহলে ওই সাতদিনের ময়লা কোথায় থাকবে? তাহলে তো ওই ময়লা থেকেই রোগ ছড়াবে! আবার গাইডলাইন - অনেক গল্প। সমাধান অধরা। শেষে সেই বিমলবাবুই বললেন - "ঠিক আছে, আমিই ওদের ঘর থেকে ময়লা নিয়ে দূরে কোন ঢাকা কন্টেনারে রেখে দেব, কর্পোরেশনের লোক ওখান থেকেই নিয়ে যাবে।" মানুষ কতটা স্বার্থপর সেটা বোঝা যেতে লাগল। যেন তুতুলরা অপরাধী, করোনার চাষ করছে। তুতুলের বাবা ডাক্তারের কাগজ দেখাল যে ঘরে চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু সবাই মানতে নারাজ। একরকম বাধ্য হয়েই তুতুলের বাবা মানিকবাবু তুতুলকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করালেন, সরকারিতে বেড পাওয়া গেল না। দিন দশেক পর যখন ছুটি হল মানিকবাবুর আর্থিকভাবে বেশ বেহাল দশা। ততদিনে ফ্ল্যাটের আশেপাশে আরও অনেকেই পজিটিভ। তাদের অবশ্য ভর্তি হতে হয়নি, কারণ বিষয়টা তখন সবাই জেনে ফেলেছে। ঝড়টা বইলো একা মানিকবাবুর ওপর দিয়েই। 

তুতুল আজ পুরোপুরি সুস্থ। তুতুলের মা খুব খুশি - আর কাজের লোক নিয়ে সমস্যা নেই - কারণ আর সামর্থ্যই নেই কাজের লোক রাখার - করোনা বেশ করে বুঝিয়ে দিয়েছে! স্বাস্থ্যকর অভ্যেসগুলো আর কোনদিন ভুলবে না তারা। বারবার হাত ধোওয়া, হাত চোখেমুখে না দেওয়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা আর মুখ ঢেকে হাঁচিকাশি। এটুকুই তো মাত্র। করোনা থেকে সুস্থতা লাভ করল আরও কয়েক জনা। 

ঘটনা ৩

লকডাউন শেষ আজ ছয়মাস হল। দেশের অর্থনীতি নাকি এবার ভালো হবে। ভ্যাকসিনও এসেই গেছে। সুতরাং মানবসভ্যতা কোভিডকে জয় করেই ফেলল। আর চিন্তা নেই। এসব ভাবতে ভাবতে ভীম সিঙারাটায় একটা বেশ বড়সড় কামড় বসাতে যাচ্ছে তখনই ফটিক আর ক্যাবলা "ভীমদা ভীমদা, আর পনেরো দিনেই ভোট, চল চল আর দেরি নেই" বলতে বলতে এসে হাজির। মনটা একটু কেমন করে উঠলো, এবার এদেরও সিঙারার ভাগ দিতে হবে! 

কিন্তু ভোট ভোটই - কামাইও হবে। ভোটে এ'পাড়ার ছেলেগুলো খাটে বেশ, দানাপানিও পায়। নতুন উদ্যমে প্রচারের কাজ শুরু হল আবার। সব পার্টির ডাকেই ভীম দলবল নিয়ে হাজির। যে যেমন দেয় তেমন লোক জোগাড়,  এক পাড়ায় এক দল তো অন্য পাড়ায় আরেক। চলছে বেশ। কোভিড এসে একটু জীবনের ছন্দটা নাড়িয়ে দিয়েছিল। কত লোক মারা গেল, ভীম যতটা পেরেছে সৎকারের সময় সাহায্য করেছে। কত লোক তো ভয়ে ডাক্তারই দেখায়নি, এমনিই মরে গেছে। ভীম অনেক দেখেছে। মানুষ খুবই স্বার্থপর। নিজের কোভিড হলে সহমর্মিতা চায়, অন্যের হলে বয়কট। সেদিন দোকানে কোল্ডড্রিঙ্কস কিনতে গিয়ে - দাম লেখা ১২/-, বুম্বাদা দাম নেবে ১৪/-, কেন? না ইলেকট্রিক ভাড়া, ফ্রিজ ভাড়া। দোকানের তাহলে কি ইনভেস্টমেন্ট নেই? সবই যদি লাভ-ক্ষতির অংশ হবে! বড়ই অদ্ভুত। ভীম ভাবছে রেডিওতে শোনায় কনজিউমার ফোরাম ইত্যাদি - বলি সবই কি কনজিউমার? এই পৃথিবীর মালিক হয়তো অন্য আর এক পৃথিবীর কনজিউমার, তাদের মধ্যে মামলা হয়েছে, ফলে সে গায়ে বিচুটি পাতার মতন করোনা ছিটিয়ে দিয়েছে। হতেই পারে। আমরা সবাই কনজিউমার,  ফেল কড়ি মাখো তেল। ভীম ছেলেটা বখাটে। তবে জ্ঞানগম্যি কম নয়, ছোটবেলায় লেখাপড়াও করেছে, পরিবারও ভালো। তবে ওই যা হয়, অবস্থা পড়তির দিকে, কাজকর্মও তেমন জোটাতে পারেনি। পাড়ার সব কাজে এই ভীম ও তার দলবলই সাহায্য করে। সমাজের হাজার কনজিউমারদের মধ্যে হয়তো বা ব্রিজ বা সেতুবন্ধন করে এই ভীমরাই। 

কোভিড কি শেখালো? সেই ঠাকুমা দিদাদেরই কথা। পরিস্কার - পরিচ্ছন্নতা। বাইরে থেকে এলে আগে কলতলায় যেতে হত, হাত-পা ধুয়ে তবে ঘরে ঢোকা। ফ্ল্যাট - চাকরি - জীবনের ইঁদুর দৌড়ে এসব সত্যিই ভুলে গেছিল মানুষ। তখন ঠাকুমা বলত ওই দেখ পার্কে কেমন

বসে আছে, "গায়ে গা লাগিয়ে" - মানে খুব কাছাকাছি বসা - মেলামেশা পছন্দ করত না। করোনা তো আবার সেগুলোই শেখাল। 

দুইবাড়ির সম্পর্ক তলানিতে এই ইঁদুর দৌড়ের বাজারে - যখন দুই বাড়িতেই করোনা থাবা বসায় - দুই বাড়িই অসহায়তা বোঝে - মূল্যবোধ কোথাও যেন ফেরত আসে আবার। সেই যে বলে, বিপদে মানুষ চেনা যায়। করোনা অনেককে এক করে দিয়েছে। একসাথে লড়াই করার মত। 

ভীমের এত ভাববার সময় নেই। ওই আবার ডাক পড়েছে।

- "হ্যাঁ বল কুণালদা"

-"এক্ষুনি চল। তোর বৌদির খুব জ্বর। হাসপাতালে নিতে হবে। জানিস তো আমি একা। তুই একটু আয়, আমার খুব সুবিধা হবে।"

-"জামাটা গলিয়ে নিয়েই আসছি।"

আবার জ্বর। আবার করোনা ফেরত এল কি? এবার কি শেখাতে? নিজের পায়ে নিজের অর্থনীতি চালনা করার শিক্ষা দিতে? ভীম চলল সেই আগের মতই। যেটুকু পূণ্য সঞ্চয় করা যায় এই জীবনে -তারই খোঁজে।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment