1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, August 1, 2020

বহুরূপী

                                                                                        ...পল্লব পত্রকার



                           'কি! তোমার বড় ছেলের অফিসে …' বাক্য শেষ না করে ভ্রূ কুঁচকে কাগজটা পড়ে চলে দিবাকর 'কেন কি হয়েছে?' ধড়ফর করে উঠে বসেন সৌদামিনী
  দিবাকর উত্তর দেয় না। একমনে পড়ে চলে। তার মুখের দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকেন সৌদামিনী।পড়া শেষ হলে কাগজটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে একরাশ বিদ্রুপ ঝরিয়ে দিবাকর বলে, 'এই তো পড়, সব জানতে পারবে!' বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়ে রোদের ওম নিচ্ছিলেন সৌদামিনী। গেঁটে বাতের কষ্ট তাঁর সারা বছর। শীতের কটা দিন খুবই বাড়ে। সকালে কয়েক ঘণ্টা তাই রোদ পোহাতে ভুল হয় না। সূর্য ওঠা মাত্রই নিজের ঘর থেকে মাদুর আর বালিশটা নিয়ে বারান্দায় এসে শুয়ে পড়েন। পুবমুখী বাড়ির সামনে খোলা উঠোন। চারপাশে গাছ গাছালি। খুব সুন্দর রোদ লাগে বারান্দায়। গায়ে মেখে একটু আরাম পান। দিবাকরও চলে আসে কিছুক্ষণের মধ্যে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস তার। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মার সঙ্গে খুট খাট ঝগড়া। 'বাগানের উত্তর দিকটাতো পড়ে আছে! বিক্কির করে দাও না!' সে হয়ত বলল। সৌদামিনী কোনও উত্তর না দিয়ে ঘাড় নাড়বেন। তখন দিবাকর বলবে, 'তুমি অত টাকা পেনশন পাও! সংসারে একটু বেশি দিতে পার না?' সৌদামিনী এবার বেশ রেগেমেগে বলবেন, দিস তো দুটো দুটো খেতে! আমার জন্যে তোর খরচটা কি!' তারপর শুরু হবে মায়ে পোয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। এটুকু না করে দিবাকর তার কাজ শুরু করতে পারে না  কাজ বলতে দশটা নাগাদ হেলতে দুলতে মোড়ের মাথায় গিয়ে মোবাইলের দোকান খোলা
  দিবাকরের অসম্পূর্ণ বাক্যে বিরক্ত হলেন সৌদামিনী। বেশ ঝাঁঝ দিয়ে বললেন, 'দেখছিস চশমাটা কাছে নেই! আমি কাগজ পড়বো কি করে? কি হয়েছে সেটাই বল না!'
  'শোনো তাহলে!' বেশ জোরে পড়তে শুরু করে দিবাকর। 'ঘুষ নেবার অভিযোগ পেযে নবান্নের উচ্চ পদস্থ অফিসাররা একযোগে বাঁকুড়ার ১৮ জন আবগারি কর্মীকে সাসপেন্ড করেছেন। এদের মধ্যে জেলার সুপারিনটেনডেন্ট তো আছেনই, সেইসঙ্গে আছেন দুই ডেপুটি, চার সাব ইন্সপেক্টর, বেশ কয়েকজন কন্সটেবল।'
  এটুকু পড়ে মায়ের মুখের দিকে তাকায় দিবাকর। প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে। দেখে মা ভাবলেশহীন। নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানতে চান, 'আর কি লিখেছে? থামলি কেন! পড়!'
  আবার পড়ে চলে দিবাকর, 'মদ বিক্রেতারা সরকারকে লেখা অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন, মাসে প্রায় এক লাখ টাকা করে তাঁদের মাসোহারা দিতে হয়। দিশি মদের বটলিং প্ল্যান্ট থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠানো বাধ্যতামূলক। বড় সাহেবদের নাম করেও দামি মদের বোতল সরবরাহ করতে হয়।'
  'আর কিছু লেখেনি কাগজে?' জানতে চান সৌদামিনী
  'না আর কিছু লেখেনি।' একটু থেমে দিবাকর বলে, 'বড় ছেলের নামে তো সব সময় তুমি অজ্ঞান! এবার বোঝ কি রত্ন তোমার ছেলে?'
  সৌদামিনী তখনও নিরুত্তাপ। 'নিশাকারের নাম কোথায় পেলি তুই?'
  ' বা রে! দুজন ডেপুটির কথা বলেছে। তোমার ছেলে তো এখন ডেপুটি!'
  'নিশাকর ছাড়া কি আর কোনও ডেপুটি থাকতে পারে না?'
 'একটা জেলায় কটা ডেপুটি থাকবে?'
 'মনে হচ্ছে তুই ওর অফিসের নাড়ি নক্ষত্র সব জানিস!'
  'নাড়ি নক্ষত্র না জেনেও এটুকু বলা যায়।'
  'তুই তো খারাপ কথাই ভাববি! সেই ছোটবেলা থেকে দাদাকে হিংসা করিস!'
  দিবাকর আর কথা বাড়ায় না। বুঝতে পারে মা রেগে গেছে। ধরফর করে উঠে দাঁড়ায়। প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলে, 'শোনো, আমি নিশ্চিত তোমার বড় ছেলেও ওই চক্করে আছে। কতবার বলেছি আদিখ্যেতা বন্ধ কর! শালা-শালি, শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে দূরে দূরে বেড়াতে যাওয়া, ঘন ঘন পার্টি দেওয়া -- এসব কোথা থেকে হয়! আমরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চরি!'
  'আমরা' বলতে দিবাকর ঠিক কি বোঝাতে চাইল, তা বোধগম্য হল না সৌদামিনীর । সে আর তার এক গেলাসের সঙ্গীরা! গ্রামের কটা অকাল কুষ্মান্ড! কেউ অটো চালায়, কেউ ছোটখাট ব্যবসা করে! কেউবা আবার মা বাবার ঘাড় ভেঙে দামড়া বয়সেও বসে বসে খায়! অথচ মদের আড্ডা বসাতে একদম ভুল হয়না! পুজো আচ্চায় তো বটেই, ভোট-টোটের সময়ে, ছুটি ছাটার দিনে। সৌদামিনী কি সেসব বোঝেন না! কতদিন রাতের বেলা দরজা খুলে দিয়ে দেখেছেন, ছেলে টলতে টলতে ঘরে ঢুকছে। খাওয়া দাওয়া কিচ্ছু না করে শুয়ে পড়ছে
  দাদার ওপর তার এত রাগ কেন কে জানে! নিশাকর তো দেশের বাড়ির সব ছেড়ে দিয়েছে ভাইকে! এখনও নামে করিয়ে দেয়নি বটে, তবে সেরকমটাই করবে। মায়ের কাছে মনের ইচ্ছা জানিয়েছে। নিজের মতো বেহালায় ফ্ল্যাট কিনে বউ ছেলেকে নিয়ে থাকে। তার বদলির চাকরি। আজ শিলিগুড়ি তো কাল মালদা। পরশু হয়ত পুরুলিয়া। আগে ঘর ভাড়া নিয়ে সপরিবারে অফিসের কাছাকাছি থাকত। এখন আর থাকে না। ছেলের পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। তার বউ সুজাতাও কিছুদিন আগে একটা প্রাইভেট স্কুলে জয়েন করেছে। মাঝেমাঝে তাদের সংসারে কাটিয়ে আসেন সৌদামিনী। খুব ভালো লাগে তাঁর। নাতিটা যেমন 'ঠাকুমা ' 'ঠাকুমা' করে সারাক্ষণ পায়ে পায়ে ঘোরে, নিশাকরও শনি রবি যে দুটো দিন বাড়িতে থাকে মায়ের কাছ ছাড়া হতে চায় না। বারে বারে বলে,'মা, তুমি আমাদের ফ্ল্যাটেই থেকে যাও।  সৌদামিনী হেসে বলেন, 'আমি তোমাদের কাছে থাকলে তোমার গুণধর ভাইটা তো আরও উচ্ছন্নে যাবে! আর তোমার বাবা তিল তিল করে যে জমি বাড়ি বাগান পুকুর করেছেন, তা বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে!' সৌদামিনী ভুলে যান ছোট ছেলেকে বা সম্পত্তি আগলাতে তিনি চিরদিন থাকবেন না। নিশাকরও তাঁকে সে কথা মনে করিয়ে দেয়না। শুধু হাসে
  সুজাতাও তাঁকে খুব ভালবাসে। সারাক্ষণ 'মা এই খান, সেই খান!' 'মা আপনি বলুন আজ কি রান্না হবে।' 'পাড়ার পার্কে খুব সুন্দর একটা মেলা বসেছে। মা, যাবেন একদিন? খুব ভালো লাগবে!' নিজের পেটের মেয়ে সুহাসিনী এভাবে তাঁর সঙ্গে কখনও কথা বলে না। শুধুই ফরমালিটি করে। আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, কবে পৈতৃক ডাঙ্গা জমি বিক্রি হবে, সে টাকার ভাগ পাবে!
  দিবাকর উঠে যেতেই সৌদামিনীর সেলফোনটা বেজে উঠল। বালিশের পাশেই সেটা ছিল। তাড়াহুড়ো করে তিনি একবার স্ক্রিনের দিকে তাকালেন। মেজ বোন কাদম্বিনী ফোন করেছে। কি ব্যাপার! এই সময় তো সে ফোন করে না! সে তো রাতে কথা বলে! এখন তো সুহাসিনীর ফোন করার কথা! সেইজন্যই তো ফোনটা কাছে রাখা। ফোনের বোতাম টিপে কানের কাছে চেপে ধরেন সৌদামিনী। 'হ্যালো!'
  'দিদি আজকের কাগজ পড়েছ? নিশাকরদের অফিস নিয়ে কি সব লিখেছে?'
  'আমি পড়িনি। দিবাকর পড়ে শুনিয়েছে। তো কি হয়েছে?'
  'নিশাকরের কোনও বিপদ হয়নি তো! খুব চিন্তায় আছি। তুমি নিশাকরকে একবার ফোন করো। '
  'ঠিক আছে, করছি।'
  'খবরটা এখনই জানাও। শুধু আমি নয়, আমার ছেলে বউও ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে। কে জানে বাবা, কি হল!'
  'ঠিক আছে, তুই রাখ এখন।' বলে ফোনটা কেটে দেন সৌদামিনী। তারপর নিশাকরের নাম্বার বের করেন। নিশাকরই তাঁকে এই ফোনটা কিনে দিয়েছে। শিখিয়ে দিয়েছে কি করে ব্যবহার করতে হয়। শুধু ফোন কিনে দেওয়া নয়, প্রায় সব ব্যাপারেই তিনি বড় ছেলের ওপর নির্ভরশীল। মাসে মাসে ওষুধের ব্যবস্থা, কলকাতায় বড় বড় ডাক্তারদের কাছে দেখাতে নিয়ে যাওয়া, আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সবটাই সে করে
  বেশ কিছুক্ষণ নিশাকরের ফোনটা বেজে গেল। ছেলে হয়ত অফিস বেরোবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। শুধু ছাত্রজীবনে নয়, চাকরি ক্ষেত্রেও সে বরাবর ডিসিপ্লিনড। সময়মতো অফিস চলে যায়। কামাই করার কথা ভাবতেই পারে না। বছরে পাঁচ সাত দিন একটানা যে ছুটি নেয়, তা শুধু পরিবার ও আত্মী়স্বজনদের সঙ্গে বেড়াতে যাবার জন্য। সৌদামিনীকেও সঙ্গে যেতে বলে। তাঁর শরীরে কুলায় না। বাড়ি ছেড়ে যেতেও মন সায় দেয় না, তাই যান না। যাইহোক। কি ব্যাপার কে জানে! সত্যিই কি কোনও বিপদ হল নিশাকরের! ভাবতে থাকেন সৌদামিনী। আর মনে মনে বলেন, 'হে ভগবান, এমনটা যেন না হয়! সোনার টুকরো ছেলে আমার। আজ পর্যন্ত কোনওদিন কারো ক্ষতি করেনি। যথাসাধ্য চেষ্টা করে সবার উপকার করতে। আর সততা! রাস্তায় সোনার বাট পড়ে থাকলেও মনে হয় ফিরে তাকাবে না। অথবা তাকালেও কুড়িয়ে নিয়ে থানায় জমা দেবে।…
  পরপর তিনবার ফোন করলেন সৌদামিনী। প্রতিবারই বেজে গেল। অন্য সময় হলে এরকম করতেন না। নিশাকর শিখিয়েছে, কাউকে যখন একবার ফোন করে পাবে না, পরে চেষ্টা করবে। বুঝবে সে কোনও কাজে ব্যস্ত। আর টেনশন করবে না। টেনশন করে কোনও লাভ হয়না
  লাভ লোকসান ভেবে কি কেউ টেনশন করে!
  প্রায় দশ মিনিট উসখুশ করে কাটালেন সৌদামিনী। শোবার ঘর থেকে চশমাটা নিয়ে এলেন। খবরের কাগজের নির্দিষ্ট জায়গাটা আবার পড়লেন। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। মাঝে একবার ছোট বউমা মউপিয়ার ঘরেও উঁকি মেরে এলেন। দেখলেন মহারানীর এতক্ষণে ঘুম ভেঙেছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইলে খুট খুট করছে। যেমন দ্যাবা, তেমনি দেবি! কুঁড়েদের কখনও উন্নতি হয়! বরের মুরোদ কিছু নেই। পুকুর বাগান এসব দেখাশোনা করা তো নয়ই, ছোট্ট দোকানটাও ঠিক ঠাক চালাতে পারে না! তুই তো কিছু করতে পারিস! ডাঙ্গা ঘরদোরের একটু খোঁজ খবর রাখা! কটা বাচ্চাকে বাড়িতে পড়ানো বা সেলাই টেলাইয়ের কিছু কাজ। বি এ পাশ নাকি! ওরকম পাশের কি মূল্য আছে! একটু রূপ আছে বলে দেমাকের চোটে মাটিতে পা পড়ে না। শাশুড়ির থেকে কিছু আদায় করতে হলে ম্যা ম্যা ম্যা! আর অন্য সময় গোমড়ামুখো। সময়মত উঠে জল খাবার করা, স্বামীকে শাশুড়িকে খেতে দেওয়া -- না সেসব কিচ্ছু না। দিবাকর রোজ সকালে মোড়ের দোকানে কচুরি জিলিপি - এইসব ছাইপাঁশ খায়। সেসব কি ভালো! আর তাঁর ভাগ্যে শসা মুড়ি বাতাসা! একটু রুটি টুটিও তো করতে পারে! নিজে রোজ দুধ কর্নফ্লেক্স খায়! কি বাহাদুরি!
  হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। নিশাকর করেছে। তাড়াতাড়ি বোতাম টেপেন সৌদামিনী। কানের কাছে সেটটা নিয়ে বলতে থাকেন, 'কি রে ফোন ধরিসনি কেন?'
  'মা, আমি সুজাতা।'
  'কি ব্যাপার! তুমি কি বড় খোকার ওখানে গেছ?'
  'না না, ও কাল ফোন নিয়ে যেতে ভুলে গেছে।'
  কথা না বাড়িয়ে আসল প্রসঙ্গে চলে আসেন সৌদামিনী। 'কাগজে কি সব লিখেছে খোকার অফিসে ….'
  'হ্যাঁ মা, আমিও পড়েছি। কিন্তু যোগাযোগ করতে পারছি না। কিছু জানতেও পারছি না।'
  ওর কলিগদের কারও নাম্বার নেই তোমার কাছে?'
  'আছে, কিন্তু সেগুলো সব সুইচ অফ। কি যে করব!'
  কিছুক্ষণের জন্যে চুপচাপ। দু প্রান্তই। তারপর শাশুড়িই কথা বলেন। বউমাকে আশ্বাস দেন, 'বেশি টেনশন করো না। খোকার কিছু হয়নি, হতে পারে না! …'
  'মা আপনিও কিছু ভাববেন না। কোনও খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে জানাব। রাখছি এখন?'
  'হ্যাঁ রাখো।!'
  একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৌদামিনী ফোনটা রাখতে যান বালিশের পাশে। কিন্তু আবার তা বেজে ওঠে। এবার দেখেন দিবাকর ফোন করেছে। সে তো বাইরে থাকলে বউকে ফোন করে! মার সঙ্গে তো খুব একটা কথা বলে না। আর এই তো ছিল এতক্ষণ! কি ব্যাপার! 'বল কি বলবি?' একটু বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেন সৌদামিনী।
  'তোমার বড় ছেলের জ্বালায় তো রাস্তায় মুখ দেখানো মুশকিল! সব্বাই ছি ছি করছে! বলছে এত রমরমা তার হয় কি করে! বাঁ হাতি ইনকাম না থাকলে কেউ এভাবে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় ফ্ল্যাট কেনে!'
  'এসব কথা ফোনে বলছিস কেন? আর আমাকেই বা শোনাচ্ছিস কেন?'
  'ঠিক আছে। আমি এখনই বাড়ি ফিরে আসছি।'
  কোনও উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলেন সৌদামিনী। কিন্তু আবার তা বেজে উঠল। এবার সুহাসিনী। রোজ যে সব কথা হয়, সেগুলো বাদ দিয়ে সে বড়দার প্রসঙ্গে চলে এল। 'মা, ভাবতে পারবে না, আমার শ্বশুর বাড়িতে কি অবস্থা! সব্বাই বড়দাকে নিয়ে আলোচনা করছে। শ্বশুর শাশুড়ি দেওর ননদ সব্বাই! একেবারে ছি ছি  ধিক্কার পড়ে গেছে!'
  'তার মানে! তোর দাদার নাম কি কাগজে আছে?'
  'নাম লেখা না থাকলেও বোঝা যাচ্ছে!'
  'তোর মনে হয় তোর দাদা ঘুষ খায়?'
  'না না, তা মনে হবে কেন?....' এবার আমতা আমতা করে সুহাসিনী
  'এই তো কদিন আগে দাদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছিলি! সবাই বলে, তোমার দাদার মতো দাদা হয় না! কি ভালো! কি ভালো!...'
  'আমি কি বলব বলো!'
  'কিছু বলতে হবে না! চুপ করে থাক।' ফোনটা কেটে দেন সৌদামিনী
  একটু পরেই বড় ভাইপো আর ছোট ভাইপোর ফোন। দিবাকরদের যে খুড়তুতো দাদারা পাশের পাড়ায় থাকে, কোনওদিন খোঁজ খবর নেয় না, ভুলেও বাড়িতে আসে না, তাদের ফোন। সবারই এক কথা, এক প্রসঙ্গ
  দিবাকর বাড়ি ফিরলে সৌদামিনী তাকে বললেন, 'আমার ফোনটা অফ করে দে তো!'
  'ফোন বন্ধ করে কি লজ্জা ঢাকা যায়!' সকালের মতোই দিবাকরের গলায় বিদ্রুপ
  সৌদামিনী কোনও উত্তর দিলেন না। দিবাকর তাঁর ফোনের সুইচ অফ করতে করতে গজগজ করে। 'সেই ছোটবেলা থেকে তুমি শুধু আমার দোষ ধর। তোর দাদার মতো হতে পারলি না! পড়াশোনায় শুধু ফাঁকি! ভালো ছেলের এই তো কীর্তি! সরকার এত টাকা মাইনে দেয়, তবু কুলাচ্ছে না! ঘুষ খেতে হবে!...'
  ততক্ষণে মৌপিয়া এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। কেটে কেটে সে বলে, 'আমার বাবাও খবরটা পড়েছে। ফোন করে এইমাত্র বলল!'
  'তুমিও ফোন অফ করে রাখ। কি আর করবে!' দিবাকরের গলায় আগের মতোই বিদ্রূপ। বউয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলে, 'আজ তো দোকানই খুলতে পারব না! যে আসবে সে-ই জিজ্ঞেস করবে! ছি ছি ছি! দাদা বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা করছে!'
  অনেক সহ্য করেছেন সৌদামিনী। আর পারলেন না। 'হ্যাঁ তা তো বলবিই! দাদা যখন এখানে জন্মদিন করল, পাড়া শুদ্ধু লোককে কে ঝেঁটিয়ে নেমন্তন্ন করেছিল? তোর যে শত খানেক বন্ধু কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে গেল, তারা কোন যজ্ঞতে লাগে আমাদের! আর দোকান করার সময় দাদার কাছে যখন হাত পাতলি তখন একটুও লজ্জা করেনি!'
  এবার মিন মিন করে দিবাকর। 'তোমাকেও তো বলেছিলাম, কিছু টাকা দাও, শোধ করে দেব! তুমি তো দিলে না!...'
  'দাদার টাকা শোধ করেছিস?'
  আর কোনও উত্তর দিতে পারে না দিবাকর। বউয়ের সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করে। সৌদামিনীও আর কথা না বাড়িয়ে ঠাকুরঘরে ঢোকেন। সাধারণত স্নান করে তিনি পুজোয় বসেন।  পাড়ার একটা ছেলের ফুলের ব্যবসা। সে রোজ সময়মতো ফুল পাঠিয়ে দেয়। আজও দেবে। কিন্তু কি মনে করে ঠাকুরঘরে এখন একটু প্রার্থনা করবেন
  মেঝেতে আসন পেতে বসে সৌদামিনী মনে মনে বলতে লাগলেন, 'ঠাকুর আমার নিশাকরকে দেখ। কত বড় মন তার! কত ভালো মানুষ সে! এ যুগে তার মতো কেউ আছে! কোনও নেশা ভাং করে না! এমনকি বিড়ি সিগারেটও খায় না! ..' প্রার্থনার মাঝে মাঝে ভেসে উঠল অতীতের স্মৃতি। সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে নিশাকর যখন চাকরি পেল, ওর বাবা তখন বেঁচে ছিলেন। বার বার বলেছিলেন, 'ওই চাকরিতে তুই ঢুকিস না বড় খোকা! অন্য চাকরির চেষ্টা কর।' ও বলেছিল,'পাঁকেই তো পদ্ম জন্মায় বাবা!' ওর বাবা বেশ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। পরে বলেছিলেন, 'এখন তো তোমার বয়স অল্প, ঠিক বুঝবে না! দশচক্রে ভগবান ভূত বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। কত ভালো মানুষের জীবন যে বাজে লোকদের মাঝে নষ্ট হয় !...'
  পাশের ঘরে মউপিয়া আর দিবাকর উত্তপ্ত আলোচনায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝেই তাদের ফোন বেজে উঠছে। নিশাকরের বিষয়েই কথা চলছে। এরা সবাই ধরে নিয়েছে ঘুষ খাবার অপরাধে নিশাকরের চাকরি গেছে
  হঠাৎ মুকুন্দর গলা। 'ঠাকমা নারকেল পাড়াবে?' সে পাড়ার ছেলে। সৌদামিনীদের বাগান পুকুর দেখাশোনা করে। নারকেল, সুপারি, মাছ বিককিরির ব্যবস্থা করে। জমি পুকুর থেকে যা আয় হয়, তার খানিকটা নিয়ে দিবাকরকে বাকিটা দেন সৌদামিনী
  ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে সৌদামিনী বলেন, 'না রে, আজ নারকেল পাড়াব না!'
  'তাহলে কি মাছ ধরে বাজারে বেচে আসব?'
  'না না কিছু করতে হবে না!'
  'পুকুরে খুব পানা হয়েছে, তুলে দেব?'
  'বলছি তো আজ কিছু করতে হবে না!'
  'আমার কিন্তু আজ হাত খালি ছিল!'
  'মুকুন্দকে নাছোড় দেখে সৌদামিনী বললেন, 'ঠিক আছে! বাগানের উত্তর দিকটায় খুব জঙ্গল হয়েছে। সাফ করে দে।'
  হাসতে হাসতে কাজে লেগে পড়ে মুকুন্দ
  সৌদামিনী আবার ঠাকুরঘরে ঢোকেন
  বেলার দিকে দিবাকর কলকাতা গেল। দোকানের জিনিসপত্র কিনতে। মউপিয়াকে বলে ফোনের সুইচটা অন করে সৌদামিনী আর একবার সুজাতার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। কোনও খবর পাওয়া গেল কিনা! 'না কিছু পাওয়া যায় নি!' সে জানাল। আরও বলল,'আফিসের নাম্বারেও ফোন করেছি। শুধুই বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না।' সুজাতার গলা শুনেই সৌদামিনী বুঝলেন, বউমার বেশ চিন্তা হচ্ছে। আবার তাকে শক্ত হবার পরামর্শ দিয়ে তিনি ফোন কাটলেন। মউপিয়ার সাহায্যে সুইচটাও অফ করলেন
  বিকেলে ফিরে এল দিবাকর। বলল,'সারা দুপুর ধরে গাদা গাদা ফোন এসেছে। সবাই জানতে চাইছে দাদার খবর কিছু পাওয়া গেল কিনা।' সৌদামিনী ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ফ্যাল ফ্যাল করে। ভাবলেন ব্যাপারটা শেষমেশ না দেখে এদের বোধ হয় ভাত হজম হবে না। রাতেও এরা ঘুমাতে পারবে না!
  একটা ব্যাপার সৌদামিনীকে খুব অবাক করল! লোকের ধৈর্য এত কম কেন! যদি খারাপ কিছু হয়, ধরে নিতে হবে নিশাকরের নিয়তিতে ছিল। সজ্ঞানে অন্যায় করার ছেলে সে নয়। এতদিন ধরে যারা তাকে দেখছে, বিশেষ করে আত্মীয়স্বজনরা , তারাও কি তাকে চিনতে পারেনি!
  দুপুরে একটুও ভাত খেতে পারেননি সৌদামিনী। রাতেও তাই। দিবাকর যথারীতি বাঁকা সুরে বলল, 'বড়ছেলের কথা ভেবে ভেবে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করছ, অসুস্থ হলে কে দেখবে শুনি!' ছেলের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সৌদামিনী ছেলে বউয়ের খাওয়া দেখতে লাগলেন। আজ মাংস এনেছে দিবাকর। হাপুস হুপুস শব্দে বউয়ের সঙ্গে খেয়ে চলেছে
  … যা সবাই ভেবেছে তাই হয়েছে! নিশাকরের চাকরি গেছে! শুধু চাকরি যাওয়া নয়, হাতে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে থানায়। হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে সুজাতা। 'ওগো আমাদের কি হবে গো! তোমার ফ্ল্যাটের লোন এখনও শোধ হয়নি! বুম্বার স্কুলের খরচ! সংসার চালানো! আমি কি করব গো!'… আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীরা চারপাশে দাঁড়িয়ে ছি ছি করছে! বলছে, 'এটা তো জানাই ছিল! এত বাড় বাড়ন্ত!…'হায় হায়! এই দৃশ্য দেখার জন্য সৌদামিনী এখনও বেঁচে আছেন! এক্ষুনি তিনি মরবেন! এক্ষুনি! আলনা থেকে শাড়িটা নিয়ে দড়ির মতো পাকালেন। বিছানার ওপর চেয়ারটা টেনে নিয়ে গিয়ে তার ওপর দাঁড়ালেন। তারপর পাকানো শাড়িটা তার ওপর বাঁধলেন। এবার একটা ফাঁস! তারপর সেটা গলায় পরে চেয়ারটা পা দিয়ে ঠেলে ফেলা!
  … আঁ আঁ আঁ!  হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল তাঁর। হায় হায়! এ কি স্বপ্ন দেখলেন তিনি! এরকম আবার হয় নাকি! উঠে চুপচাপ কিছুক্ষন বিছানায় বসে থাকলেন। বাথরুম গেলেন। ফিরে এসে একটু জল খেলেন। তারপর আবার শুয়ে পড়লেন। আর ঘুম এল না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন


  বেলা করেই আজ বিছানা ছাড়লেন সৌদামিনী। অভ্যাস মতো মাদুর বালিশ আর সেলফোনটা নিয়ে বারান্দায় গেলেন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ফোনের সুইচ কাল থেকে অফ করা আছে। সেটা অন করতে হবে। একটু পরে দিবাকর যখন পাশে এসে বসল, বললেন, ' ফোনটা অন করে দে তো!' দিবাকর তাই করল। সৌদামিনীর ইচ্ছে হল সুজাতাকে একবার ফোন করার। রাতে সে কোনও খবর পেল কিনা! পরক্ষনে সংযত হলেন। খবর পেলে নিশ্চয়ই সে জানাতো। শূন্য দৃষ্টিতে কখনও ছোট ছেলের মুখের দিকে, কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ঝকঝকে নীল আকাশ। চারপাশে রোদ্দুর। সবুজ গাছ গাছালিতে তা ঠিকরে পড়ছে। শুধু তাঁর মনেই গভীর অন্ধকার!
  রাতে দেখা ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা আবার মনে পড়ল। হে ভগবান! নিশ্চয়ই ওটা মিথ্যে! দোষ না করলে কারও কখনও শাস্তি হয়!
  ভাবলেন বটে! পরক্ষনেই মনে হল, কত নিরপরাধের তো শাস্তি হয়! যুগে যুগে, কালে কালে। কোনও দোষ না করেও কত ভালোমানুষের নিন্দা রটে! কত লোককে জেল হাজতে পচতে হয়! সংসার ভেসে যায় তাদের। কাল সান্ধে পর্যন্ত নিজেকে শক্ত রেখেছিলেন সৌদামিনী। কিন্তু আর পারছেন না! বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। উদ্গত কান্না গলার কাছে আটকে আছে। যে কোনও মুহূর্তে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলবেন। ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে তিনি আবার নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলেন। মনে মনে বললেন, না না, কক্ষনও না! কিছুতেই না! নিশাকরের কোনও ক্ষতি হবে না! হতেই পারে না!...
  আজ আবার মুকুন্দ এসে হাজির। হাতে একটা নারকেল। 'এই দেখ ঠাকমা, নারকেল ঝরে পড়ছে! বলছি নারকেল গুলো পেড়ে দিই!'
  কথা না বাড়িয়ে সৌদামিনী বললেন, 'ঠিক আছে পাড়!'
  'যখন গুনব তখন তোমায় ডেকে নেব!'
  'না না ডাকতে হবে না! তোর মতো গুনে নিয়ে যা!'
   একটু পরে হকার ছেলেটা খবরের কাগজ দিয়ে গেল। কোনওদিন এই জিনিসটায় আগ্রহ পাননা সৌদামিনী। আজও না। রোজের মতো দিবাকরই কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। কালকের মতোই ভিতরের একটা পৃষ্ঠায় তার চোখ আটকে গেল।
  ' কি পড়ছিস অত মন দিয়ে?' জানতে চাইলেন সৌদামিনী
  ' কালকের ব্যাপারটা আবার দিয়েছে।' অদ্ভুত একটা গলায় বলল দিবাকর। সেটা খুশির না দুঃখের ঠিক বোঝা গেল না।
  'কোন ব্যাপারটা?'
  'দাদাদের আফিসার কেসটা!'
  'সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসেন সৌদামিনী। 'কি লিখেছে আজ?'
  ঠোঁটের ওপর কষ্টার্জিত হাসির রেখা টেনে দিবাকর বলল, 'দাদার কিছু হয়নি। বরং দায়িত্ব বেড়ে গেল।'
  ' কি রকম?'
  ' এই তো লিখেছে, জেলাশাসক রুদ্রপ্রসাদ জানিয়েছেন, আবগারি দপ্তরের সাম্প্রতিক অচলাবস্থা কাটাতে ডেপুটি একসাইজ সুপার নিশাকর বাগচিকে আপাতত সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।…'
  দিবাকরের কথা শেষ হতে না হতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন সৌদামিনী। ফোনটা টেনে নিয়ে সুজাতাকে ফোন করলেন। হাসতে হাসতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ' বউমা খবরটা পেয়েছ? বড় খোকার কিছু হয়নি। সে ভালো আছে!'
  'হ্যাঁ মা, কাল অনেক রাতে ও ফোন করেছিল। আপনি ওই সময় শুয়ে পড়েন, তাই আর জানাইনি। ও সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিল বলে যোগাযোগ করতে পারেনি। আর ওর কলিগদের সব ফোন সিজ করে দেওয়া হয়েছে। ..'
  'ঠিক আছে বউমা, আমি রাখছি এখন।'
  'হ্যাঁ রাখুন।'
  'আবার একের পর এক ফোন। কালকের মতোই। প্রথম এলো কাদম্বিনীর। উচ্ছসিত গলায় সে বলল, ' দিদি, নিশাকরের নাম বেরিয়েছে কাগজে! ওর তো প্রমোশন হয়েছে! দারুণ খবর! ওকে একদিন পার্টি দিতে বল।…' আরও অনেক কথা বলে গেল কাদম্বিনী। সৌদামিনী কোনও উত্তর দিলেন না।
  তার কথা শেষ হলে আরও অনেক ফোন। কোনওটাই ধরলেন না। দিবাকরকে বললেন, ' এই আমার ফোনটা অফ করে দে তো!'
                                                      pallabkumarparui@gmail.com
                                                                      কলকাতা 


No comments:

Post a Comment