...উত্তম চক্রবর্তী
ঠিক বেলা দশটার সময় ইন্টার্ভিউ শুরু হয়েছে। অধির আগ্রহে
সাতাশ বছরের রুপা মল্লিক আরও অনেকের মতই অফিসের রিসেপশনের সোফায় বসেছিল ওর ডাকের
অপেক্ষায়। সল্ট লেকে এটা একটা টেলিফোন কোম্পানির হেড অফিস। সারা ভারতে এদের হাজার
হাজার শাখা আছে এবং নেট ফেসিলিটি ছাড়াও ল্যান্ড লাইন ও সেল ফোন দুইরকম সার্ভিসই
আছে এদের। গত বুধবার খবরের কাগজে ওয়াক ইন ইন্টার্ভিউয়ের বিজ্ঞাপন দেখে রূপা আজ
শনিবার সকাল সাড়ে নটার সময়ে এসে পৌঁছায় সেই ঢাকুরিয়া থেকে। চাকরিটা ওকে পেতেই হবে।
বাবার মৃত্যুর পর পুরো সংসারটাই এখন দাদার ঘাড়ের উপর। রূপার এখন সংসারে টাকা দিয়ে
সাহায্য করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বৌদি আর দুখানা ছেলে মেয়ে নিয়ে দাদা নীলাঞ্জন
এমনিতেই হিমসিম খাচ্ছে , তার উপর মা, রূপা আর ছোট
ভাই দেবাঞ্জন, এতগুলো মানুষের ভারও তো দাদার উপরেই।
তিনজন কাস্টমর কেয়ার এক্সিকিউটিভ ও দুজন ম্যানেজারের
পোস্টে লোক নেওয়া হবে এখানে। রূপা বেশ কয়েকদিন থেকেই চাকরির খোঁজ করে যাচ্ছিল। আজ
এটাই ওর প্রথম ইন্টার্ভিউ। এদের ম্যানেজারের পোস্টে মিনিমাম চার বছরের অভিজ্ঞতা
চাই, যেটা রূপার নেই। তবে কাস্টমর কেয়ার এক্সিকিউটিভ পদে শুধু
বি এ পাশ ও কম্পিউটার চালানো জানলেই হবে। তখন পর্যন্ত মোট কুড়ি বাইশ জন মেয়ে ও
মহিলা এসেছেন ইন্টার্ভিউ দেবার জন্য। রূপার ডাক পড়ল যখন তখন বেলা প্রায় দশটা
পঁয়তাল্লিশ হবে। এখনো আরও মেয়েরা আসছে ও হলের চেয়ারে বা সোফায় বসে ডাকের অপেক্ষা
করছে তারা। রূপা উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ওড়না ঠিক ঠাক করে এগিয়ে গেল উল্টো দিকের
দরজাটার দিকে যেখানে ডেস্কে বসে একজন মাঝবয়সী মহিলা কর্মচারী একে একে মেয়েদের ডাক
দিচ্ছিলেন। রূপার বুকের ভিতরটা এক অজানা আশঙ্কায় ঢিপ ঢিপ করছে তখন।
ঘরটা বেশ বড় একটা চেম্বার। দেওয়ালের এক ধার ঘেঁসে একটা
বড় টেবিল যার ওপাশে নীল রঙের স্যুট টাই পড়া সুন্দর চেহারার এক বত্রিশ তেত্রিশ
বছরের ভদ্রলোক বসা আর তার ডান দিকে দুটো চেয়ারে পাশে একজন বছর তিরিশের সুন্দরী
মহিলা ও তার পাশে একজন রূপার সমবয়সী যুবক বসা। টেবিলের এপাশে দুখানা খালি চেয়ার।
রূপা হাতে ওর সি ভির কপি নিয়ে ঘরে ঢুকে সবাইকে “গুড
মর্নিং” বলে দাঁড়াতেই পাশে বসা সেই যুবকটা সেটা ওর হাত থেকে চেয়ে
নিলো।ওদিকে ভদ্রলোক একবার রূপাকে দেখে ওঁর
ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে থাকলেন আর পাশে বসা সেই মহিলাটি ঝুঁকে পড়ে রূপার
সি ভি দেখতে থাকলেন। রূপাকে তিনি তার আগেই ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বলায় রূপাও
বসে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
হটাত সেই যুবকটি রূপার সি ভির এক জায়গায় আঙুল দিয়ে সেই
মহিলাকে দেখালে পর উনি অবাক হয়ে একবার তাকালেন রূপার দিকে আর তারপর ওদের বসের কাছে
গিয়ে কানের কাছে ফিস ফিস করে কিছু বলে সেই যুবকের হাত থেকে রূপার সি ভি টা নিয়ে
ওঁর দিকে এগিয়ে ধরলেন। বস ভদ্রলোক রূপার মুখের দিকে তাকিয়ে এক ঝলক ওর বুকের দিকে
তাকালেন এবং ওর সি ভির দিকে মনোনিবেশ করলেন। রূপা জানতো এরপরেই ওকে একটা কঠিন
প্রশ্নের সন্মুখিন হতে হবে এবং মনে মনে রূপা তার জন্য নিজেকে বেশ শক্ত করে নিয়েই
এসেছে আজ এখানে ইন্টার্ভিউ দিতে। ও এই মুহূর্তে সবার সব রকমের প্রশ্নের উত্তর দেবার
জন্য তৈরি। তাতে ওর চাকরি হোক বা না হোক। সত্যি কথা ও কখনই লুকতে পাড়বে না,
হোক না সেটা যতই কঠিন।
দুই মিনিটের মধ্যেই টেবিলের ওপাশে বসে থাকা ভদ্রলোক হাসি
মুখে রূপার দিকে তাকিয়ে ইংরাজিতে বললেন,’নমস্কার,
আমি মিহির দত্ত, এখানকার জি এম , আর
আর ইনি হলেন আমাদের এ জি এম , কাস্টমর কেয়ার মিসেস আনিতা মুখার্জি আর এ হল আমাদের এইচ
আর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ। আপনার সি ভি টা দেখলাম। এখানে আপনার সি ভিতে আপনি যা যা লিখেছেন সেগুলির
ব্যাপারে যথাযথ ব্যাখ্যা চাইলে ঠিক মত
উত্তর দিতে পাড়বেন তো ? মানে আমি বলতে চাইছি সেটা যদি খুব ব্যক্তিগত প্রশ্নও হয়
আপনাকে কিন্তু তার উত্তর দিতে হবে। বুঝতেই পারছেন ,উই
নিড ট্র্যান্সপারেন্সি। ’
রূপা বুঝতে পাড়ল এই ভদ্রলোকই হলেন আসল,
যা ডিসিশন নেবার উনিই নেবেন। রূপা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ইংরাজিতেই বলল,‘ওকে,স্যর।
আমি রূপা মল্লিক। আপনার যা যা জানবার আমাকে প্রশ্ন করতে পাড়েন। আমি তৈরি আছি।‘
কথাটা বলার সময় রূপার চোখে মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তার ছায়া দেখা গেল যেন।
মিস্টার দত্তর রূপার এই আত্মবিশ্বাস বেশ ভাল লাগে।
মেয়েটি দেখতে শুনতে বেশ ভালই বলা চলে। গায়ের রং ফর্সা, লম্বা
, মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো ঘন কালো চুল,
বব কাট করে কাটা। ওর উদ্ধত বুক দেখেই বোঝা যায় দেহে যৌবনের বন্যা বয়ে
চলেছে। হাসি মুখে আবার জিজ্ঞাসা করলেন,’ আপনি একজন
এম এ পাশ করা শিক্ষিতা মহিলা। কম্পিউটারের কোর্স করা আছে দেখতে পাচ্ছি। যদিও কোন
অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু সেটা না হয় আমরা ট্রেনিং দিয়ে নেব, কোন
সমস্যা হবে না। কিন্তু আপনার সি ভি তে এক জায়গায় আপনি লিখেছেন আপনার সেক্স হল
আদার্স, এর মানে ঠিক বুঝতে পাড়লাম না। আপনি যদি একটু খুলে বলেন
তাহলে সুবিধা হয়। এই আদার্স কথাটার অনেক রকম অর্থ হয় কিনা তাই জিজ্ঞাসা করছি।‘
রূপা একবার তাকিয়ে দেখল মৃত্যুঞ্জয় ও মিসেস মুখার্জি
দুজনেই অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা জানে যে হয়ত আজ এই ওয়াক ইন
ইন্টার্ভিউয়ে ওই একমাত্র মেয়ে যার সি ভি তে এরা এই অসামঞ্জস্য দেখতে পেয়ে বেশ একটু
অবাক হয়ে গেছে। রূপার গলার স্বর বেশ মিষ্টি। পাড়ার ফাংশনে ও অনেকবার গান গেয়ে বেশ
নাম করেছে। রূপা গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে হেসে বলল,’স্যর,
আমি একজন ট্র্যান্স জেন্ডার। আমার জন্ম হয়েছিল পুরুষ হিসাবে। কিন্তু কিছু
বায়োলজিক্যাল ডিসঅর্ডার ছিল প্রথম থেকেই। আর তাই আমার সতের বছর বয়সে আমি অপারেশনের
মাধ্যমে আমার সেক্স বদল করে মেয়েতে পরিণত হই। আমি আগে ছিলাম রুপাঞ্জন মল্লিক,
কিন্তু অপারেশনের পড় থেকে হয়ে যাই রূপা মল্লিক।‘
মিসেস অনিতা ও মৃত্যুঞ্জয় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রূপার মুখের
দিকে তাকিয়ে থাকে। মিস্টার দত্ত রূপার এই পরিষ্কার উত্তরে মনে হল খুশী হলেন। আজকাল
সরকার এই ট্র্যান্স জেন্ডার কমিউনিটির জন্য অনেক রকম সুব্যবস্থা নিয়েছে। অনেক
জায়গায় এই ট্র্যান্স জেন্ডাররা সরকারী চাকরীতে জয়েন করে বেশ সুনাম অর্জন করেছে।
পেপারে ও টি ভি তে হামেশাই এদের নিয়ে খবর বা তর্ক বিতর্কের প্রোগ্রাম দেখেছেন উনি।
কিন্তু কোনদিনই এভাবে সামনে বসে একজন স্মার্ট শিক্ষিত ট্র্যান্স জেন্ডারের সাথে
কথা বলার সুযোগ ওঁর হয়ে ওঠেনি। একটা ছেলে একেবারে বদলে গিয়ে মেয়ে পরিণত হয়ে লেখা
পড়া শিখে আজ চাকরীর ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছে, এটাই
একটা বিরাট ব্যাপার মিস্টার দত্ত বা ওঁর সহকর্মীদের কাছে।
মিহির দত্ত রূপার ব্যপারে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞাসা
করলেন,’ আপনার বাবা কোথায় কাজ করতেন ? বাড়িতে
আর কে কে আছে একটু খুলে বলুন। আর এভাবে সেক্স পরিবর্তন করার কোন বিশেষ কারণ ছিল কি
?’
রূপা সামনের টেবিলে রাখা টেবিল টপ কম্পুটারের বর্তমানে
ল্যাপটপে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার দিকে
তাকিয়ে দেখতে দেখতে বলল,’আমার বাবা ছিলেন ইনকাম ট্যাক্সের অফিসার। আমার উপরের
দাদা নীলাঞ্জন মল্লিক একজন আই টি ল’ইয়ার,
মানে ট্যাক্স কনসালটেন্ট। আর ছোট ভাই
যাদবপুরে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, সেকেন্ড
ইয়ার চলছে। আমার দাদার দুই ছেলে মেয়ে, ছেলে ক্লাস
থ্রিতে পড়ে আর মেয়ে সবে নার্সারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমার মা বিধবা হলেও বিভিন্ন
সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। উনি এক সময় বাবার সাথে বামপন্থি রাজনীতি করতেন। এখন
যদিও প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত নন কিন্তু সামাজিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
ওঁদের একটা সমিতিও আছে।‘
মিহির রূপার পরিবারের ব্যাপারে অবাক হয়ে শুনছিল এবং সাথে
ওর দুই কলিগও। এবার মিসেস মুখার্জি
জিজ্ঞাসা করলেন,’আচ্ছা রূপা, স্যারের
আরেকটা প্রশ্নের ব্যাপারে তো কিছু বললে না তুমি !’
রূপা মিসেস মুখার্জির দিকে তাকিয়ে এক টুকরো হেসে বলল,’আসলে
ছোট বেলা থেকেই আমার চলা ফেরা বা কথা বার্তা পোশাক ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই একটা মেয়েলী
ভাব ফুটে উঠত। এমনকি আমার ছেলেদের চেয়েও মেয়ে বন্ধুর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ফলত
ছেলেরা আমাকে খুব খেপাত আর মাঝে মাঝে আমাকে রাস্তা ঘাটেও ওদের আজেবাজে নোংরা কথার
সামনে পড়ে বেইজ্জত হতে হয়েছে। আমার বাড়িতে সবাই এই ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তায়
ছিলেন। আমি নিজেই তখন ভাবতাম ভগবান হয়ত আমাকে মেয়ে বানাতে গিয়ে ভুল করে একটা ছেলে
বানিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। খুব কান্না কাটি করতাম আর স্কুলের পড় বাড়িতেই
থাকতাম। খুব একটা বেড় হতাম না। কিন্তু এমন একটা সময় আসল যখন আমার বাড়ির সামনে এসেও
ওই সব বদমাশ ছেলেরা আমার নাম নিয়ে চিৎকার করে যাতা সব কথা বলত।‘
রূপার চোখে জল জমে যায়, একটু চুপ করে রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে নেয় রূপা।
মিহির দত্ত এরকম কাহিনী শোনেননি কোনদিন। অবাক হয়ে
শুনছিলেন উনি। রূপা থামতেই মিহির সামনে রাখা একটা জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে
সহানুভূতির সুরে বললেন,’’সরি, আপনার কষ্ট হলে ছেড়ে দিন। আর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি আপনার উপর দিয়ে একটা ঝড়
গেছে ওই দিনগুলিতে।‘
রূপা স্বাভাবিক হয়ে নিয়ে জবাব দিল,’
ঠিকই বলেছেন স্যর। আমাদের সমাজে এই সমস্ত মানুষদের কোন জায়গা নেই। সমাজই
এদের একদিন হিজড়া বানিয়ে ঘর ছাড়া পাড়া ছাড়া করে। দেশে এরকম লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে
যাদের জন্মের জন্য তারা দায়ী নয়, এটা ভগবানের সৃষ্টি । এতে কারোরই কোন হাত থাকে না। আমি
যখন বুঝতে পাড়লাম যে এভাবে আমি বেশিদিন বাড়িতে টিকতে পারবো না তখন একদিন আমার
বাবাকে বললাম যে আমি অপারেশন করে মেয়ে হতে চাই। দাদা কিন্তু ভীষণভাবে আপত্তি
করেছিল, কিন্তু মা বাবা দুজনেই আমাকে সাপোর্ট করেছিলেন সেদিন।
তারপরই আমি মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করি। আমি নিজে যেতে না পাড়ায়
ওরা আমাকে নয় মাস যাবত ফোনে ও স্কাইপে কাউন্সিলিং করে শেষে অপারেশন করতে রাজি হয়।
অবশেষে বাবা মাকে নিয়ে আমি মুম্বাই যাই। আমার তখন সতের বছর বয়স,
স্কুল ফাইনাল পাশ করা হয়ে গেছে। সেদিন আমার শারীরিক ট্রান্স ফর্মের অপারেশন
হয় মুম্বাইতে প্রায় দশ ঘণ্টা যাবত ও তারপর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবার পর আমি
রূপাঞ্জন থেকে স্রেফ রূপা মল্লিক হিসাবে নিজের আইডেন্টিটি বদলে ফেলি।‘
ঘরের মধ্যে যেন একটা পিন পরলেও তার শব্দ শোনা যাবে তখন।
সবাই একদম স্তম্ভিত হয়ে শুনছিল রূপার জীবনের এই অদ্ভুত কাহিনী। বিস্মিত মিহির
দত্তর মুখ দিয়ে শুধু বেড়িয়ে এলো,’তারপর ?’
রূপা এতক্ষণে অনেক ফ্রি হয়ে গেছে। একটু মুচকি হেসে বলল,’
তারপর আর কি, অপারেশনের চার মাস বাদে পুরোপুরি ভাল হবার পড় আমি কলেজে
ভর্তি হলাম। আমার পরিচয় তখন আমি রূপা মল্লিক। কলেজে আমার সহপাঠিনীরা আমার জেন্ডার
নিয়ে কিছুই জানতো না। আর আমরাও ইতিমধ্যে উত্তর কলকাতা থেকে ভাড়া বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে
সাউথে ঢাকুরিয়াতে ফ্ল্যাট কিনে চলে আসি। নতুন এলাকায় বা কলেজে আমার আর কোন অসুবিধা
হয়নি। আমি মনেপ্রাণে এখন একজন মেয়ে হিসাবেই বেঁচে থাকতে চাই।‘
রূপা দেখল মিহির দত্তর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। ইশারায়
মিসেস মুখার্জিকে কিছু একটা বললেন উনি। মিসেস মুখার্জি রূপার দিকে তাকিয়ে বললেন,
’কিছু মনে করবেনা রূপা, তোমাকে বাইরে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমরা নিজেরা একটু
আলোচনা করে তোমাকে আবার ডেকে পাঠাব। ঠিক আছে ? তুমি
এবার বাইরে গিয়ে বোস, আমরা ডেকে পাঠাব।‘ রূপা
ঘার নেড়ে সণ্মতি জানিয়ে বাইরে চলে এসে আবার একটা সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। ওর মনের
মধ্যে তখন ঝড় বয়ে চলেছে। কে জানে ও একজন ট্র্যান্স জেন্ডার জানবার পর এরা আবার ওকে
চাকরিতে নেবে তো ? হয়ত কোম্পানিতে ওর মত ছেলে মেয়েদের চাকরি দেবার কোন
নিয়মই নেই।
রূপা যে একজন ট্র্যান্স জেন্ডার সেটা সত্যিই বোঝা যায়না।
অন্য আর পাঁচটা মেয়ের মতই রূপার চেহারা। ঘন কালো বব কাট করা কুঁচকানো চুল,
মুখটা মিষ্টি, পরিপুষ্ট স্তনে ভরা বুক, গায়ের
রঙ ফর্সা ও মসৃণ চামড়া। দেখলেই বোঝা যায় যে রূপা নিয়মিত শরীরের যত্ন নেয় এবং
চেহারা ধরে রাখতে জানে। হল ঘরে বসা আরও কয়েকজন রূপার দিকে দেখছিল বারবার। ওরা ধরেই
নিয়েছিল যে রূপাকে এরা সর্ট লিস্ট করে নিয়েছে। যদিও এরপর ভিতরে আর কারোকে ডাকা
হয়নি। মিনিট পাঁচেক বাদেই মৃত্যুঞ্জয় বেড়িয়ে এসে রূপাকে আবার ইশারায় ভিতরে যেতে
বলে অন্য দিকে চলে গেল।
রূপা এবার একটু
নার্ভাস ফিল করছিল কারণ মোটামুটি ওর ব্যক্তিগত প্রশ্ন সবই এঁরা করেছেন এবং রূপা সব
ভাল ভাবেই জবাব দিয়েছে। এবার কি তাহলে জানিয়েই দেবে যে ওরা রূপাকে নিতে পাড়ছে না
কারণ ওদের কোম্পানিতে এভাবে কোন ট্র্যান্স জেন্ডারকে চাকরিতে নেওয়া হয়না,
নিয়ম নেই। উপরওয়ালার সাথে কথা বলে মিহির বাবু হয়ত জানিয়ে দেবেন যে ওরা
অত্যন্ত দুঃখিত, কিছু করা যাবেনা।
ঘরে ঢুকে কিন্তু রূপার মনের কালো মেঘ সরিয়ে এক চিলতে
রোদ্দুর ঝিলিক মারতে লাগল। এঁরা দুজনেই রূপাকে দেখে মুচকি হেসে ওকে সাদরে সামনের
চেয়ারে বসতে বলে রূপার এক্সপ্রেশন লক্ষ করতে থাকে। রূপাকে অবাক করে দিয়ে মিসেস
মুখার্জি বলেই ফেললেন,’ কনগ্রেচুলেশন রূপা, তুমি
কাস্টমর কেয়ার এক্সিকিউটিভ হিসাবে সিলেক্ট হয়েছ। সামনের মাসের এক তারিখ থেকেই তুমি
জয়েন করতে পারবে।‘
রূপা ভাবতেই পারছিলনা যে ওর প্রথম ইন্টার্ভিউতেই এই
চাকরিটা হয়ে যাবে। মিসেস মুখার্জির কথা গুলি মনে মনে আরও একবার শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে
ওর। ওর মনের অবস্থা বুঝেই হয়ত এবার মিস্টার মিহির দত্ত হেসে রূপাকে আশ্বস্ত করবার
জন্য বললেন,’ মিস রূপা, আপনি একজন
সাহসী ও অনেষ্ট মেয়ে। আমরা এরকমই একজন বিশ্বস্ত, সিনসিয়ার
ও স্মার্ট মেয়ে খুঁজছিলাম। আপনাকে সাত দিনের একটা ট্রেনিং দেওয়া হবে এবং তারপর
আপনি আপনার ডেস্ক ও কম্পিউটার পাবেন। প্রথম ছয়মাস আপনাকে আমরা আঠেরো হাজার টাকা
মায়না দেব। এরপর যখন পার্মানেন্ট হবেন তখন আপনি পাবেন কুড়ি হাজার,
ঠিক আছে ?’ মিহির দত্ত কথাগুলি বলে রূপার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে
রইলেন।
রূপার চোখের কোনে আনন্দে জল চলে এসেছে তখন। বাবা মাস
চারেক আগে হটাত হার্ট ফেল করে চলে যাবার পর থেকেই রূপা ভাবছিল এবার ওকে একটা
চাকরিতে ঢুকতেই হবে। রূপা এম এ পাশ করে একটা চাকরির চেষ্টা করবে আগেই ঠিক করে
রেখেছিল। কিন্তু এভাবে এই প্রথম ইন্টার্ভিউ দিয়েই একেবারে কাস্টমর কেয়ার
এক্সিকিউটিভের চাকরি হয়ে যাবে সেটা রূপা ভাবতেও পারেনি। যেহেতু ও একজন ট্র্যান্স
জেন্ডার রূপা সবসময় ভাবত যে ওর সি ভি দেখেই হয়ত কেউ আর ওকে চাকরি দেবেনা।
মাস তিনেক বাদে এক রবিবার সকালে রূপাদের ঢাকুরিয়ার বাড়ির
সামনে এসে দাঁড়াল একটা সুইফট ডিজায়ার গাড়ি। গাড়ি থেকে নামলেন মিস্টার মিহির দত্ত
এবং তার দিদি, বাবা ও মা। রূপা আগেই বাড়িতে ওর মা,
দাদা ও বৌদিকে জানিয়ে রেখেছিল সব। মিহির দত্ত তার পরিবারের গার্জিয়ানদের আজ
এখানে নিয়ে এসেছেন রূপাকে ওরা দেখে মিহিরেরে সাথে ওর বিয়ের কথা পাকা করবেন বলে।
প্রথম দিন থেকেই রূপা ওর বস মিহির দত্তর মনে নিজের আসন পাকা করে ফেলেছিল। এই
তিনমাস অফিসে ওকে আরও কাছ থেকে দেখে শেষ পর্যন্ত মিহির দত্ত রূপাকেই ওর জীবন
সঙ্গিনী করবেন স্থির করেন। একদিন বিকালে অফিস থেকে রূপাকে নিয়ে গিয়ে ক্যাফে কফি
ডেতে বসে মিহির দত্ত রূপাকে ওর মনের কথা খুলে জানান। রূপা বেশ লজ্জা পেলেও খুশি
মনে শুধু বলেছিল,’আপনি এই
ব্যাপারে আমার মা ও দাদার সাথে বাড়িতে এসে কথা বলুন। আমি কিছু জানিনা।‘ কথাটা বলেই রূপা লজ্জায় রাঙা হয়ে মুখ ঢেকেছিল দুই
হাতে।যুবতী রূপার মনের আকাশে তখন একটা ছোট্ট সুখী সংসার আর একটা ফুটফুটে মিষ্টি
সন্তানের ছবি উঁকি ঝুঁকি মারছে ।
uttamchakraborty306@gmail.com
বাঙ্গালোর
No comments:
Post a Comment